#মৃগতৃষ্ণা-৭
#লেখিকা -মেহরুমা নূর
★কাঠফাটা রোদের তীব্রতা যেন কমার নামই নিচ্ছে না। সূর্যের হঠাৎ এতো ক্রোধ কেন হলো কে জানে। পুকুরের সিড়িটাও রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। গাছপালার ছায়া ভেদ করে রোদ তার জায়গা করে নিচ্ছে।গাছের পাতার ছায়ার সাথে রোদ মিশে একাসাথে সিড়িতে দুলুনি খাচ্ছে। তপ্ততার মাঝেই একটু ছায়াঘেরা জায়গায় পুকুরের সিড়ির ওপরে গিয়ে বসলো পঙ্খি। রোদের তপ্ততাকে শীতল পবন একটু শিথিল করার চেষ্টাও করছে। মজুমদার বাড়ির এই একটা জায়গাই তার একটু পছন্দের। মন খারাপ বা ভালো দুটোরই অনুধাবন করতে সে এখানে এসে বসে। এখানে আসলে আলাদা একটা শিথিলতা পায় সে। পুকুরে ফোটা পদ্ম ফুলের শোভায় মুগ্ধ হওয়া, আর শুভ্র রাজহাঁস গুলোর ছন্দপতন উপভোগ করা তার কাজ। রাজ হাঁসগুলো তার শাশুড়ির। জাহানারা বেগমের অতি শখের প্রাণী এগুলো। পঙ্খিও এদের দেখাশোনা করে। বাড়ির বাইরে যাতে না যায় সেটা খেয়াল করে।লেখিকা-মেহরুমা নূর নাহলে দস্যু শেয়াল গুলো যে খেয়ে ফেলবে এদের।
মনটা এখনো বিষন্ন পঙ্খির। কাল রাতের কলুষিতা তাকে ক্ষুন্ন করে দিচ্ছে। রাবেয়ার কাছ থেকে একটু শান্তনা পেলেও এতে পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হতে পারছে না সে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে শুধু সেসব ভাবনাই দৌড়াচ্ছে। তাইতো মনটা একটু শান্ত করতে এখানে এসে বসেছে পঙ্খি। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হতেই কোথাথেকে ছায়া হাসির ফুলঝুরি ছড়িয়ে তার পাশে এসে বসলো। হাতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে সে হেসেই যাচ্ছে। আজকাল এই ফোন নিয়েই সে পড়ে থাকে। ছায়ার ইন্ধন ভাইয়া বিদেশ থেকে তার জন্য এই উপহার এনেছে। যদিও ছায়া আগেই তাকে বলে দিয়েছিল স্মার্ট ফোন আনার জন্য। তার কাঙ্খিত বস্তুটি পেয়ে সে এখন নাওয়া খাওয়া ভুলে এটাতেই নিমজ্জিত হয়ে থাকে। ছায়ার এতো দম ফাটানো হাসির হেতু জানার উদ্দেশ্যে পঙ্খি বলে উঠলো।
–কি হয়েছে? এতো হাসছ কেন?
ছায়া হাসতে হাসতেই জবাব দিলো।
–আরে ভাবি দেখ এটা কি। তুমি দেখলে তুমিও হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাবে।
ছায়া ফোনের স্ক্রিন টা ঘুরিয়ে পঙ্খির দিকে ধরলো। ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখতেই পঙ্খি দেখতে পেল ওদের গ্রামের মতির মা আর করিমের মা দুইজন কোমড় বেঁধে তুমুলঝ,গড়া করে যাচ্ছে। সে কি ঝ,গড়া বাপরে! এক হাতের ওপর আরেক হাত গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে মুখ দিয়ে অ,শ্রাব্য ভাষার প্রয়োগ করছে। ঝগড়া দেখিয়ে ছায়া বললো।
–আরে ভাবি সেকি কান্ড। মতির মা মতির বাপরে নাকি রাতের বেলা করিমের মায়ের বাড়ি থেকে বের হতে দেখেছে।লেখিকা-মেহরুমা নূর ব্যাস এই নিয়েই বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ হয়ে গেছে। আমিতো সব ভিডিও করে নিয়েছি। দেখ দেখ মতির মায়ের অবস্থা। ছায়ার কথায় পঙ্খ আরেকটু কৌতুহলী হয়ে তাকালে শুনতে পেল মতির মায়ের বানী।তিনি হাতের ওপর হাত গুঁতিয়ে করিমের মায়ের দিকে তেড়ে যেতে যেতে ক্ষিপ্র কন্ঠে বলছেন।
–ওই মা,গি তোর কয়ডো লাগে লো? একটোই ভরে না? নিজের ডো কম পইরা যায় যে আমার মদ্দার ওপর নজর দিছু? তোর কি পাল আইছে লো? তোক তো আমি দুই পাও দুই দিকে ধইরা এহারে ফাইরা ফেলামু। তোর সব কা,মুড় মিটাই দিমু।
করিমের মাও কোনমতে পিছিয়ে নেই। সেও পাল্টা জবাব দিয়ে বললো।
–আইসেক, আইসেক নাহা। তোর কতো জোর আমিও দেখমু।আমিও হাত পাও ব্যাংকে থুয়ে আসিনাই। উঁউহ আইছে আবার আমাক মারতে।আমার ঠেহা পইড়ছে তোর কাইলাচান মদ্দারে দেহার।যেনা আমার চেদারা। তোর মদ্দাই আমার পিছে ঘুর ঘুর করে। আমার বাইয়া পাও যায়না হ্যার কাছে। নিজের মদ্দাক ঠেকাবার মুরোদ নাই আবার আমাক কস তাইনা।
অতঃপর দুজন মিলে ডাব্লিউ ডাব্লিউ এর ম্যাচ শুরু করে দিলো। দুজন দুজনার চুল ধরে হেঁচড়া হেঁচড়ি করছে আর অ,শ্রাব্য ভাষায় গা,লি দিয়ে যাচ্ছে। পঙ্খি আর শুনতে পারলোনা। সে ফোন থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বললো।
–ছিঃ ছিঃ ছায়া এসব দেখতে নেই। এসব শোনা ঠিক না। বন্ধ করো।
–আরে কি বলছ ভাবি, আমার তো হেব্বি মজা লাগছে। তোমারও মজা লেগেছে তাইনা বলো?
সত্যি বলতে পঙ্খির মজাতো একটু লেগেছেই। এতক্ষণের মন খারাপ টাও একটু কমে গেছে। তবে ছায়ার সামনে সেটা জাহির করলো না। কারণ সে ছায়াকে ভুল কাজে উৎসাহ দিতে চায়না। তাই সে বললো।
–মোটেও না। দেখ এসব ঝগড়া বিবাদ দেখতে নেই। এতে খারাপ মনোভাব পড়ে।
–তুমি যাই বলো আমার কাছে তো হেব্বি লাগছে। আমি তো ভাবছি এটা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবো। একদম ভাইরাল হয়ে যাবে।
ছায়ার সাথে আর না পেরে পঙ্খি হাল ছেড়ে দিলো। মেয়েটা একটু বেশিই চঞ্চল। ওদের কথাবার্তার মাঝেই ওখানে ইন্ধন এসে উপস্থিত হলো। ছায়ার মাথায় আলতো করে চাটি মেরে বললো।
–কিরে গরু এভাবে ছাগলের মতো হাসছিস কেন?
–আরে ভাইয়া তুমি দেখোনা এইটা তারপর তুমিও হাসি থামাতে পারবেনা।
ছায়া ইন্ধন কেও ভিডিও টা দেখাতে লাগলো। ইন্ধন কে দেখে পঙ্খি মাথার কাপড় টেনে আস্তে করে ওখান থেকে উঠে চলে যেতে লাগলো। লোকটার থেকে দূরেই থাকবে এখন থেকে সে। কি দরকার শুধু শুধু লোকের মুখে অকথ্য শোনার? পঙ্খির এভাবে যাওয়া টা ইন্ধনের চোখ এড়ালো। ব্যাপার টা সে বুঝতে পারলো। ছায়াকে ভিডিও দেখা অবস্থায় রেখে সে উঠে এসে পঙ্খির পিছে এসে তাকে ডাক দিলো। পঙ্খি দাঁড়ালো তবে পেছনে ফিরলো না। ইন্ধন বলে উঠলো।
–আমি জানি পঙ্খি তুমি হয়তো দাদীর কথায় মন খারাপ করেছ। দাদীর পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি। আসলে দাদী পুরাণ চিন্তাধারার মানুষ। তাই তিনি তার ধারণা অনুযায়ী কথা বলে দেন। তার কথা এতো সিরিয়াসলি নিও না।নাঈম বয়সে আমার দুমাসের ছোট ছিল।সেইজন্য তোমাকে নাম ধরে ডাকি।কিন্তুু আমরা তো আমাদের অবস্থান টা ঠিকই জানি তাইনা? তাই আর এই নিয়ে মনে কোন খেদ রেখনা।লেখিকা-মেহরুমা নূর।
পঙ্খি পেছনে না ঘুরেই বললো।
–সবসময় নিজের জানাটাই যথেষ্ট হয়না। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কখনোই না। মেয়েদের কোন কিছুই তাদের ইচ্ছে মোতাবেক হয়না। না ভাগ্য না বদনাম। আমি যতই ভালো থাকি তাতে কিছু যায় আসে না। বাদবাকি আপনি নিজেই অনেক বুদ্ধিমান।
কথাটা বলেই পঙ্খি জায়গা প্রস্থান করলো। ইন্ধন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে বুঝতে পারলো পঙ্খি তাকে কি বোঝাতে চাইছে। অল্পবয়সেই মেয়েটা বেশিই দূর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে।
__
সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে চারপাশে। চারিদিকে আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পুকুরে থাকা রাজহাঁস গুলো নিতে এসেছে পঙ্খি। জাহানারা বেগম ছায়াকে বলেছিল কাজটি করতে। তবে অলস ছায়া যথারীতি কাজটা পঙ্খির ঘাড়ের চেপে দিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেছে। পঙ্খি একটা চিকন লাঠি হাতে পুকুর পারে এসে চঁই আয়, চঁই আয় করে হাসঁগুলোকে ডাকছে। রোজকার অভ্যাস অনুযায়ী হাঁসগুলোও সব সারিবদ্ধ হয়ে ডাঙায় উঠে এলো। প্যাঁক প্যাঁক শব্দ তুলে তারা চললো বাড়ির ভেতরে। লাঠি হাতে পঙ্খি তাদের পিছু পিছু যাচ্ছে। খোপের কাছে আসলে হাঁসগুলোর প্যাঁকপ্যাঁকানি আড়ও বেড়ে গেল। খাবার চাই তাদের এটাই বোঝাতে চাইছে তারা। পঙ্খি আগে থেকেই গামলায় গুঁড়া (ধানের খোসার গুঁড়া) মাখিয়ে রেখেছিল। গামালা টা নিচে রাখতেই হাঁসগুলো সমানে হামলে পড়লো তাদের ওপর। গপগপ করে গিলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই গামলা খালি করে ফেললো। খাওয়া শেষে তারা একে একে খোপের ভেতর ঢুকে গেল। খোপের দরজা আটকে দিয়ে পঙ্খি বাসার ভেতর ঢুকতে নিলেই হঠাৎ কিছু একটা দেখে তার ভ্রু কুঁচকে এলো।
চাদর পেঁচিয়ে কিছুটা চোরের মতো কনিকাকে বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে যেতে দেখে অনেক টা অবাক হলো সে। ব্যাপার টা কেমন সন্দেহজনক মনে হলো তার। সে পিছা করলো কনিকার। কিছুদূর এগুতেই দেখতে পেল কনিকা বাড়ির পেছনের গেটে কারোর সাথে দেখা করছে। সেই কারোটা যে একটা যুবক ছেলে তা আবছা আঁধারেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো পঙ্খি। কারণ লোকটাকে সে আগেও দেখেছে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন চেয়ারম্যান বাড়িতে আসতে দেখেছে তাঁকে। কিন্তু কনিকা এই লোকটার সাথে এভাবে গোপনে দেখা করছে কেন এটাই বোধগম্য হলোনা পঙ্খির। সে দেখলো কনিকা একটা সাদা খামের মতো কিছু একটা ওই ছেলেটার হাতে দিলো। তারপর কিছু কথা বলে আবারও চুপিসারে পেছন দিক দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। পঙ্খি দূর থেকে সবই লক্ষ করলো। ভাবনায় পড়ে গেল সে। কনিকা ভাবি লোকটার সাথে কি করছিলেন? লোকটা কি উনার পরিচিত? তাহলে এভাবে চোরের মতো কেন দেখা করছে? ভাবি কি কোন ভুল পথে পাড়া দিচ্ছে? এমন অনুরূপ নানান প্রশ্নের বেড়াজাল খাচ্ছে। কি করবে এখন ও? ভাবিকে কি সরাসরি গিয়ে জিজ্ঞেস করবে? কিন্তু ভাবি যদি আরও রেগে যায়?এমনিতেই উনি উনার বিষয়ে নাগ গলাতে মানা করেছেন। অন্য কাউকেউ তো বলা যাবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে।
মাগরিবের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। নামাজ কাযা হওয়ার ভয়ে পঙ্খি আপাতত সেটার জন্য উদ্যত হলো। এই বিষয়ে নাহয় পড়েও দেখা যাবে।
__
নামায শেষে পঙ্খি আজ একটু বই খুলে বসলো। ধানের খন্দ আসায় ঠিকমতো পড়াশোনাই হয়নি এই কয়দিন। সামনে আর কিছুদিন পরই এক্সাম। এখন থেকেই প্রস্তুতি না নিলে শেষে ফেল করতে হবে। ম্যাথ খাতা বের করে কিন্তু অংক চাইলো। কিন্তু একটা অংকে গিয়ে আটকে গেল সে। কিছুতেই সল্ভ করতে পারছেনা। সামছুল মজুমদার একজন মহিলা গৃহ শিক্ষিকা ঠিক করে দিয়েছিল ওর জন্য। কারণ পুরুষ শিক্ষক এবাড়িতে তিনি কখনোই আনবেন না। অবশ্য পঙ্খিরও তাতে কোনো অমত ছিলনা। শিক্ষক হলেই হলো। তিনি রোজ এসে পঙ্খিকে পড়িয়ে যেত। তবে কিছুদিন হলো তার ডেলিভারি হয়েছে। তাই তিনি আসতে পারছেন না।আর পঙ্খি কলেজের ক্লাসও করে না। যার কারণে পঙ্খির অনেক অসুবিধা হচ্ছে । অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও অংক সল্ভ করতে পারছে না।
তখনই বালিশ হাতে হেলেদুলে কক্ষে প্রবেশ করলো ছায়া। বিছানায় বালিশ টা রেখে গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লো সে। পঙ্খি মৃদু হেসে বললো।
–কি ব্যাপার বালিশ কেন এনেছ? আমার বিছানায় বালিশ কি নেই?
–হ্যাঁ আছে। তবে আমি আমার বালিশ ছাড়া অন্য বালিশে ঘুমুতে পারি না। আমার ঘাড় ব্যাথা করে।
পঙ্খি আর কিছু বললো না।লেখিকা-মেহরুম নূর নিজের কাজে আবারও মনোযোগ দিলো। ছায়া কিছুক্ষণ বসে মোবাইল ঘাটলো। মতির মায়ের বিনোদন মূলক ঝগড়া সে সত্যি সত্যিই সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে দিয়েছে। আর ঘন্টাখানিকের মাঝে তা ভাইরালও হয়ে গেছে৷ কমেন্টের পাহাড় জমিতে গেছে। ছায়া সেসব কমেন্ট পড়ছে আর একা একাই হাসছে। বেচারি মতির মা আর করিমের মা রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেল। অথচ তারা সেটা জানেই না। ব্যাপার টায় আরও বেশি হাসি পাচ্ছে ছয়ার। সে উঠে এসে পঙ্খিকেও কমেন্ট গুলো দেখাতে চাইলো। পঙ্খির এসবে এখন মন নেই। সে বললো।
–ছায়া তুমি দেখ। আমার ইচ্ছে নেই। এমনিতেই অংকগুলো নিয়ে পেরেশানিতে আছি।
–কেন কি হয়েছে?
–আরে জাবেদা ম্যাডাম কয়েকদিন হলো আসতে পারছেনা। এদিকে আমি এই অংকগুলো কিছুতেই বুঝতে পারছিনা। তাই একটু ঝামেলায় আছি।
ছায়া কিছুক্ষণ ভেবে বললো।
–ওওও এই কথা? ঠিক আছে চলো আমার সাথে।
–কোথায়?
–আরে চলোতো।দেখবে তোমার সমস্যা এক তুড়িতে দূর করে দিবো। বই খাতা নাও আর আমার সাথে চলো।
–আরে কিন্তু কোথায় যাবো তাতো বলবে?
–তুমি সমাধান চাও কিনা তাই বলো?
–হ্যাঁ চাইতো।
–তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে চলো আমার সাথে।
ছায়ার জোরাজুরিতে পঙ্খি অগত্যা বই খাতা নিয়ে ওর সাথে গেল। ছায়া পঙ্খির হাত ধরে সোজা ইন্ধনের রুমে নিয়ে এলো। ইন্ধনের রুমের দরজায় আসতে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গেল পঙ্খি। ছায়ার হাত থামিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি ফিসফিস করে বললো।
–একি! ছায়া তুমি এখানে কেন নিয়ে আসলে আমাকে? চলো এখান থেকে।
পঙ্খির স্বরধ্বনি ছায়ার কর্ণ গুহায় প্রবেশ করলো বলে প্রতীয়মান হলো না। সে পূর্বের ন্যায় পঙ্খিকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো। পঙ্খি হাত ছাড়িয়ে চলে আসতে গিয়েও পারলোনা। ইন্ধন দেখে ফেললো ওদের। বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে কিছু কাজ করছিল সে। ছায়াদের আসতে দেখে ও বললো।
–আরে তোরা এখানে? কিছু বলবি?
–হ্যাঁ ভাইয়া। আসলে পঙ্খি ভাবির শিক্ষিকা কিছুদিন হলো আসতে পারছেনা। তাই ভাবির অংকগুলো বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। তাই তোমার কাছে নিয়ে আসলাম। তুমি একটু ভাবিকে অংকগুলো বুঝিয়ে দাওনা।
–ও আচ্ছা, ঠিক আছে এখানে এসে বসো আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।
–না না ঠিক আছে আমি নিজেই করে নিবো। আপনার কষ্ট করতে হবে না।
কথাটা বলেই পঙ্খি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হতেই ইন্ধন পেছন থেকে ডাক দিলো তাকে। থেমে গেল পঙ্খি। ইন্ধন ছায়ার উদ্দেশ্যে বললো।
–ছায়া যাতো আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আয়।
ইন্ধনের আদেশ অনুযায়ী ছায়া বেড়িয়ে গেল কফি আনতে। ছায়া যেতেই ইন্ধন পঙ্খির উদ্দেশ্যে বললো।
–দেখ পঙ্খি একই বাড়িতে থেকে কতক্ষণ এভাবে চলতে পারবে? তারচেয়ে স্বাভাবিক থাকাটাই শ্রেয়।তুমি কোন অন্যায় করোনি যে এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে। আর আপাতত অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে তোমার পড়ালেখার বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আমি অন্তত এটাই মনি করি। বাকি তোমার ইচ্ছে।
ইন্ধনের কথা শুনে পঙ্খির মনও শায় দিলো। আপাতত পড়ালেখার বিষয় টাই বেশি জরুরি। নাহলে সামনে পরিক্ষা ভালো যাবে না। অতঃপর পঙ্খি ইন্ধনের টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসলো। ইন্ধন উঠে এসে পঙ্খিকে অংকগুলো বুঝিয়ে দিতে লাগলো।পঙ্খি খেয়াল করলো শিক্ষক হিসেবে ইন্ধন মন্দ না। কতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। তবে খুবই কড়া শিক্ষক উনি। পঙ্খিকে অংকগুলো করতে দিয়ে ইন্ধন একটু ওয়াশরুমে গেল। পঙ্খি মনোযোগ সহকারে অংক করে যাচ্ছে। হঠাৎ কেমন যেন কোন বস্তুর ঝলকানির মতো কিছু এসে লাগলো চোখে। পঙ্খি সেটার উৎপত্তি খোঁজার উদ্দেশ্যে মাথা তুললো। এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ বেডের পাশে ছোট টেবিলের ওপর নজর পড়লো তার। টেবিলের ড্রয়ারের কিঞ্চিৎ ফাঁকের ভেতর থেকে রুপালী কোন বস্তুর অংশ চিকচিক করছে। আলোর ঝলকানিটা বোধহয় ওখান থেকেই এসেছে। জিনিস টা কি সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পঙ্খির একটু কৌতুহল জাগলো জিনিস টা কি দেখার। তবে সংকোচ হচ্ছে, অন্যের জিনিস এভাবে দেখা টা কি ঠিক হবে? কিছুক্ষণ দ্বিধা দন্দ করে পঙ্খি শেষমেশ এগিয়ে গেল সেটার দিকে। ড্রয়ারের কাছে এসে বস্তুটাতে হাত দিতে নিলেই খপ করে একটা শক্ত পুরুষালী হাত এসে পঙ্খির হাত ধরে ফেললো। চকিত হয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই আৎকে উঠলো পঙ্খি। অগ্নিরুপ ধারণকৃত ইন্ধনের রক্তিম মুখমন্ডল দেখে অন্তর্দেশ কেঁপে উঠল তার। ইন্ধনের এমন ভয়াবহ রুপ তার অপরিচিত। পঙ্খির ভীতিকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে ইন্ধন পঙ্খির হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে, ক্রোধিত চাপা স্বরে বলে উঠলো।
— কি করছিলে তুমি? বিনা অনুমতিতে কারোর পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়া যে চরম অভদ্রতা তাকি তুমি জানোনা?
হতভম্ব হয়ে গেল পঙ্খি। লজ্জিত হলে সে। মাথা নিচু করে কম্পিত স্বরে প্রয়াস চালিয়ে কোনরকমে বললো।
–দু দুঃখিত। আমার ভুল হয়ে গেছে।
হুঁশ এলো ইন্ধনের। চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে বললো।
–সরি, আসলে কেউ আমার পার্সোনাল জিনিসে হাত দিক সেটা আমার একদম পছন্দ না। রাগ উঠে যায় আমার। ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবে। তুমি বরং এখন যাও। বাকি অংক আমি তোমাকে পড়ে বুঝিয়ে দেবো।
পঙ্খি আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো ওখান থেকে।লেখিকা-মেহরুমা নূর। এতটুকু সামান্য কারণে ইন্ধনের এতো ক্রোধ কেমন যেন হজম হলোনা পঙ্খির। লোকটাকে যতটা সহজ ভেবেছিল ততটাও না। আজকের এই ব্যবহার অন্তত সেটাই বয়ান করছে। কি এমন না জানি ছিল ওই জিনিস টা?
চলবে……..