স্নিগ্ধ_গাংচিল,৫,৬

0
931

#স্নিগ্ধ_গাংচিল,৫,৬
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫

পাড়ি জমালো এক ভিনদেশে মুন। যে দেশে তার কোনো চেনা-পরিচিত মানুষ নেই শুধুমাত্র ছোটবেলার একটা বান্ধবী ছাড়া। সেও এখন এখানের স্থানীয়।
প্লেন একটা বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে ল্যান্ড করতেই মুন অন্যদের দেখাদেখি নিজেও নেমে পড়লো। প্লেন থেকে নামার পরে ভিনদেশে প্রথমবারের মতো পা দিতেই তার এক অন্যরকম অনুভূতি অনুভব হলো।ম্যারিল্যান্ড শহরের ছোঁয়া এই প্রথমবারের মতো গায়ে মাখাচ্ছে মুন।
প্লেন থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরে তাকিয়ে সামনে যেতেই দেখলো অনেকে তাদের আপনজনের নামে সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনের নার্ভাস লাগছে, সে আশেপাশে তাকিয়ে ইরাকে না দেখে হতাশ হলো। ইরা তো আগে থেকেই এসে যাবে বলেছিলো কিন্তু এখনো তার আসা হচ্ছে না। মুনের প্লেন থেকে নামা প্রায় মানুষ আস্তে আস্তে আপনজনদের সাথে এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নিচ্ছে। তার হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে, এর দূর দেশে ইরা ছাড়া আর কেউই নেই ; এই ভিনদেশে সে একা যাবেই বা কোথায়! সে এগিয়ে একটা জায়গায় বসলো। এই সকাল সকাল এয়ারপোর্টটা জনশূন্য একদম। যে কয়েকজন আছে তারা ভিনদেশি মুনের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এসব দেখে মুনের চোখ বেয়ে আপনা-আপনি অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। সে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে মাথা নিচু করে বসে রইল।
হঠাৎ মুনের পাশে তার থেকে কিছু দুরুত্ব বজায় রেখে কেউ বসতেই সে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল ট্রাউজারের সাথে গেঞ্জি আর মুখে মাক্স পরিহিত কেউ একজন সামনের দিকে তাকিয়ে বসলো। বোঝায় যাচ্ছে, সকালের জগিং করছে। মুখমন্ডল দেখার উপায় নেই। সকালের সূর্যের তির্যক রশ্মী ছেলেটার মুখে পড়তেই চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। ছেলেটা মুনের দিকে তাকাতেই মুনকে কান্নারত অবস্থায় দেখে কিছু বলতে নিল। মুনের হঠাৎ করেই জনশূন্য এলাকায় এমন মুখমন্ডল ঢাকা একজনকে দেখে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। কারণ কেউ জগিং করতে বের হলে মাক্স পড়ে তা মুনের জানা নেই। সে টিভিতে এমন কিডন্যাপের খবর অনেক দেখেছে। হয়ত মুনকে ভিনদেশের মনে হওয়ায় ছেলেটা নিজের মুখমন্ডল ঢেকে নিজের কার্যসাধন করতে এসেছে। মুনের ভাবনায় এটা আসতেই সে দ্রুত ব্যাগ-পত্র নিয়ে বসা থেকে কোনোমতেই উঠে পড়ল।

পাশের মেয়েটাকে কিছু নিয়ে ভীতিগ্রস্থ হয়ে ব্যাগ নিয়ে অতি-দ্রুতর সহিত উঠে দাঁড়াতে দেখে আদ্রিন ব্রু কুচকালো। সে বুঝতে পারছে না, মেয়েটি কী তাকে দেখে ভয় পেয়েছে! সে একবার নিজের দিকে তাকালো। না তো! তাকে তো সাধারণ মানুষের মতোই লাগছে। সে জগিং করে এই রোড দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটিকে মাথা নিচু করে চোখ মুছতে দেখা গেল। দেখে মনে হচ্ছিলো মেয়েটি এখানকার নই। তাই তো কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার জন্য এখানে এসে দুরুত্ব বজায় রেখে বসছে। কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই মুহূর্তে মেয়েটি ভয় ভয় দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়ালো। সে মেয়েটিকে পিছন থেকে ডেকে উঠতেই মেয়েটি ভয়ে দৌড় দিল। আদ্রিন মেয়েটির কান্ড দেখে হেসে দিল। আদ্রিনকে দেখে আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েই দূরে সরে যায়নি উল্টো তার পাশে বসতে চায়তো, সে সবসময় মেয়েদের থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে চলে। তাই তো মাক্স পড়েই বের হয়েছিল। অথচ এই প্রথম একটা মেয়ে এরকম দেখলো! এরপর সে উঠে দাঁড়াতেই একটা কানের দুল দেখতে পেল। সে দুলটা নিয়ে মুনকে ডাকতে নিতেই সেদিকে আর মুনকে দেখা গেল না। সে বুঝতে পারছে মেয়েটি তাকে ভালোই ভয় পেয়েছে। সে মুচকি হেসে দুলটা ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে পার্কিং এরিয়াতে গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

মুন উঠে দৌড়ে ওখানে থেকে একটু দূরে এসেই বুকে হাত দিয়ে হাঁফাতে লাগলো। ঠিক তখনই দৌড়তে দৌড়তে ইরা মুনের সামনে এসে হাঁটুর উপর দুহাত রেখে দাঁড়ালো। এরপর উঠে মুনকে জড়িয়ে ধরতে নিলে মুন মুখ ফিরিয়ে নেয়।

-‘আ’ম এক্সট্রিমলি সরি মুন। ঘুম থেকে উঠতে লেট্ হয়ে গিয়েছিলো। তুই তো জানিস, সেই ছোট কাল থেকেই আমার ঘুম ভীষণ ভারী। অ্যালার্ময়ের আওয়াজেও ঘুম ভাঙলো না, অবশেষে পাপা উঠে ডাকার পর মনে পড়লো তুই আসবি যে এটা। এবারের মতো মাফ করে দেয় মুন।’ ইরা বাচ্চা বাচ্চা ভাব করে কানে ধরতেই মুন হেসে দিলো। এরপর ইরা গিয়ে জড়িয়ে ধরতে মুনও এতদিন পর বান্ধবীকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো।

পিছন থেকে আদ্রিন গাড়ি বের করে চলে যাওয়ার সময় ওদের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসলো।
‘মুন’ ‘চাঁদ’ বলেই আপনমনে বিড়বিড় করে বাঁকা হেসে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিল।

——————
ইরার সাথে গাড়িতে উঠে বসে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ক্রান্তিতে ম্যারিল্যান্ডের রাস্তা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারলো না মুন। ইরাদের বাসাটা হচ্ছে মূলত ডুপ্লেক্স বাড়ি। ম্যারিল্যান্ডয়ের প্রায় বাড়িই এমন সুন্দর সুন্দর। ইরাদের বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান আছে। ইরা আর ইরার বাবা-ই থাকে এই বাড়িতে। মুন বাসায় ঢুকে আশেপাশে না তাকিয়ে ইরার কাছ থেকে রুম জেনে নিল। এরপর মোবাইল রেখে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
কারো ধাক্কা ধাক্কিতে আধো আধো চোখ খুলে ইরাকে দাঁত বের করে হাসতে দেখে মুনের রাগ চরম পর্যায়ে উঠে গেল।
-‘এভাবে ডাকছিস ক্যান? ঘুমাচ্ছি না?’

-‘আর কত ঘুমাবি? একটু বিছানা ছেড়ে উঠে দেখ?’

মুন চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা নেমেছে। তার মানে, সেই সকালে এসে শুয়েছিল! সে এতক্ষন ঘুমিয়েছে!
-‘আমি পুরোদিন ঘুমাইলাম!’

-‘না, আমাদের এখানে সকাল না হতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। এখন উঠ। পাপা আসছে। আর কিছুই তো খেলি না। আয় খেতে আই। তুই ফ্রেস হয়ে আয় আমি অপেক্ষা করছি।’

মুন উঠে ফ্রেস হয়ে ইরার সাথে নিচে নামল। ইরার বাবার সাথে পরিচয় হয়ে খেয়ে নিলো একসাথে। তিনি জানাল, এখানকার একটা নামকরা ভার্সিটিতে ইরা পড়ে। মুন আসবে ইরা জানিয়েছিল তখনই তিনি মুনের জন্য সব রেডী করে ফেলেছেন। এখন শুধু ইরার সাথে গিয়ে ক্লাস করার পালা। মুনের বড়ো বাবা আফজাল শেখের সাথে তার কথা হয়েছে। এখানে মুনকে নিশ্চিন্তে থাকতে বলেছেন, কিছু লাগলে ইরার সাথে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছেন।এসব শুনে মুন চিন্তামুক্ত হলো। যাক অন্তত একজন সঙ্গী ওর সাথে আছে তাই চিন্তা হচ্ছে না আর। ইরার বাবার সাথে কথা বলে বোঝা গেল, মানুষটা বড্ড ভালো। কী সহজে মুনকে নিজের মেয়ের মতো কথা দিয়ে আপন করে ফেলল। ইরার বাবা সবসময় বাড়ি থাকে না, ব্যবসার কাজে একেক সময় একেক জায়গায় যেতে হয়, এসময় ইরা এতো বড়ো বাড়িতে একাই থাকে, মুন আসাতে তিনি চিন্তামুক্ত হলেন।

রাতে খেয়েদেয়ে মুন রুমে এসে বসলো। ইরাও এসে সাথে বসলো।
-‘আজকের দিন তো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলি। কিছুই তো দেখলি না ম্যারিল্যান্ডের!’

-‘সমস্যা নেই। কাল দেখবো।’

-‘প্রতিদিন ক্লাস আছে রে। তুই কী কাল থেকে যাবি ক্লাসে? না কি আর কয়দিন রেস্ট নিবি?’

-‘না রে, আমি বাসায় একা একা কী করবো। আর কীই বা রেস্ট নিবো। আমিও কালকে থেকে ক্লাসে যাবো। তুই তো আছিসই।’

-‘হ্যাঁ,’ ইরার মোবাইলে কল আসাতে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে মুনের দিকে তাকালো। ইরার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মুন যা বোঝার বুঝে ফেলল। সে মুচকি হেসে বলল,’ যা কথা বল।’

মুনের কথা শুনে ইরা আমতা আমতা করে বলে উঠল,’আমি পার্টিতে যাবো।’

ইরার কথা শুনে মুন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। এতো রাতে পার্টি!

-‘তুইও চল, ইনজয় করবি আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে।’ ইরা মুনের উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে উঠলো।

-‘ইরা তোর মাথা ঠিক আছে? এতো রাতে পার্টিতে যাচ্ছিস! আঙ্কেল জানলে কী হবে ভাবতে পারছিস?’

-‘এগুলো এখানে স্বাভাবিক। তুই এখানে প্রথম তাই তোর অবাক লাগছে। কয়েকদিন যেতেই সব বুঝে যাবি। আর পাপা এখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাবে, সকালে পাপা উঠার আগেই আমি চলে আসবো।’

-‘সকালে উঠার আগে বলতে! তুই কী সারারাত ওখানেই কাটাবি!’

-‘ওহ হো, মুন। এগুলো এখানে সবাই করে। তুই গেলে আই।’

-‘না, আমি যাবো না। তুই যা।’

-‘আচ্ছা আমি যায়। তুই ঘুমা।’ এই বলে ইরা জামা চেঞ্জ করে বেরিয়ে গেল। মুন ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো ইরা একটি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছেলেটির সাথে গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে। মুনের খারাপ লাগলো। এসবই কী এদেশের সংস্কৃতি! ইরার পরনে হাটু উপর বরাবর একটা জামা। মুন ভেবেছিল অন্তত ইরা এদেশের সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে এতটা খারাপ হবে না কিন্তু এখানে এসে তার ধারণা পাল্টে গেল। তার এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে। কেন যে এখানে আসতে গেল! সে কী এদেশের এমন সংস্কৃতিকে ইগনোর করে চলতে পারবে! ইরা এখানে এসে নিজের সুন্দর সংস্কৃতিটাকে পায়ে ঠেলে এই দেশেরটা গ্রহণ করেছে। সে জানতো, এখানকার মানুষরা এমন কিন্তু ইরাও যে এমন হবে তা তার ধারণার বাইরে ছিল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬

মাঝরাতে হঠাৎ করে মুনের ঘুম ভেঙে যাওয়াই পাশ ফিরে দেখলো ইরার জায়গা এখনো খালি। মুন হাতে মোবাইল নিয়ে সময় দেখে নিল একবার। রাত তিনটা বাজতে চলল আর ইরা এখনো আসেনি। হয়ত ইরা এখানে আগে থেকেই এসব করে আসছে। মুন আর না ঘুমিয়ে ইরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ নিচ থেকে গাড়ির হর্ণয়ের আওয়াজ শুনতেই সে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো ইরা নামছে। ইরাকে কেমন জানি অগোছালো লাগছে মুনের কাছে।
ইরা রুমে ঢুকেই হ্যান্ড ব্যাগটা ছুড়ে মেরে অগোছালোভাবেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। মুন কিছুসময় ইরার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর এগিয়ে গিয়ে ইরাকে সোজা করে শুয়ে দিল। পা থেকে জুতো-জোড়া খুলে রাখল আর গায়ে লেপ টেনে দিল। এরপর নিজেও আবার শুয়ে পড়ল। সে ভাবেনি ম্যারিল্যান্ডে তার প্রথম রাত এতো তিক্ত-ভাবে কাটবে। তার সব ছেড়ে-ছুড়ে নিজের পরিবারের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে তো হবেই কারণ সবাইকে কথা দিয়ে আসছিল- এখানে থেকেই পড়াশোনা শেষ করে ফিরে যাবে আবারো নিজের মাতৃভূমিতে।

————-
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে ধরণীর বুকে সূর্যের কিরণের ছড়াছড়ি ম্যারিল্যান্ডে। মুন আধো আধো চোখ খুলতেই সূর্যের তির্যক রশ্মি চোখে পড়তেই চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাতেই দেখল ইরা জানালার পর্দা সরিয়ে মুনের সামনে কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরাকে দেখতে একদম স্বাভাবিক লাগছে। মনে হচ্ছে যেন রাতের সবকিছু মুনের দেখা স্বপ্ন ছিল, যে স্বপ্নের ছিটে-ফোটার এক অংশও বাস্তবের সাথে মিল নেই।
মুনকে ইরার দিকে অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় তাকিয়ে থাকতে দেখে ইরা হাসলো,
-‘তোর মনে হচ্ছে রাতের সবকিছু স্বপ্ন দেখছিলি তাই না?’

মুন ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ইরা মুনের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে তার পাশে বসল,
-‘আসলে এখানে থাকতে থাকতে এটাই আমার সংস্কৃতি মনে হয়। সবার দেখাদেখি আমিও এখন পার্টিতে যায়, ড্রিঙ্কস পান করি, রাত করে আসি। এগুলো ছাড়া এখানে একটি মেয়েও পাবি না। আমিও প্রথম প্রথম তোর মতোই ছিলাম। আর এখন দেখ! এসব ড্রিঙ্কস পান করতে করতে এমন পর্যায়ে এসে গেছি যে এখন আর এগুলো ছাড়া চলতে পারি না, আর প্রথম কয়েক ঘন্টা এগুলোর নেশা লেগে থাকলেও এখন সয়ে গেছি। পাপা এসবের কিছুই জানে না রে। তুইও সয়ে যাবি ফ্রেন্ডসদের সাথে চলতে চলতে।’

মুন এখনো ঘোরের মাঝে আছে। ইরা কী বলছে এসব!
মুনকে কিছু বলতে না দেখে ইরা কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠলো,’ আচ্ছা যা ফ্রেশ হয়ে নেয়। আজ ভার্সিটিতে তোর প্রথম ক্লাস আর ম্যারিল্যান্ডের রাস্তাও দেখতে পারবি। দেরি হয়ে যাচ্ছে, উঠে পর।’

মুন মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
ফ্রেশ হয়ে দুইজনে একসাথে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো।
মুন গাড়ি থেকেই মাথা বের করে ম্যারিল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। সে বারে বারে মুগ্ধ হচ্ছে ম্যারিল্যান্ডের রাস্তাঘাট দেখে। তাদের গাড়ির পাশ দিয়েই চলে গেল আরেকটা গাড়ি। ইরা তাড়াতাড়ি মুনকে ডাক দিয়ে ভেতরে ঢুকতে বলল। আদ্রিনের গাড়িই গিয়েছিলো মুনের পাশ দিয়ে। আদ্রিন মুনদের গাড়ি পাস করে চলে যাওয়ার সময় পাশের গাড়ির মেয়েটির বাচ্চামো স্বভাব দেখে মুচকি হাসলো এরপর গাড়ি’র স্পিড বাড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় ফ্রন্ট আয়নায় পিছনে মুনকে আরেকবার দেখে নিল।
পাশেই ইরা মুনের দিকে তাকিয়ে ওর বাচ্চামো স্বভাব দেখে হাসলো।

গাড়ি থামল একটি পার্কিং এরিয়াতে গিয়ে। ইরা মুনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। কিছুসময় হাঁটার পরেই মুনের স্বপ্নের ভার্সিটি চোখে পড়ল। সে কিছুক্ষন নিস্পলক দৃষ্টিতে সাইনবোর্ডটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বড়ো বড়ো অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা,’ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড, বালটি’মোর,’। মুন বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো ভার্সিটির নামটা। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আধো কী এটা সত্যি না-কি স্বপ্ন।
ইরা মুনের কান্ড দেখে হেসে দিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে মুনের হাতে জোরে চিমটি দিল।
চিমটিটা বেশ জোরে পড়ায় মুন ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে চিৎকার দিয়ে উঠল। মুনের চিৎকার শুনে আশেপাশের কয়েকজন স্টুডেন্ট তার দিকে তাকালো। মুন চোখ খুলেই এমন পরিবেশ দেখে ‘ইরাকি বাচ্চি’ বলে বিড়বিড় করে ইরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। ইরা মুনের চাহনি দেখে কেবলাকান্ত মার্কায় হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
-‘তুই স্বপ্ন ভেবে এখানে ওই সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইছিস তাই আমি চিমটি দিয়ে বোঝাইলাম এটা স্বপ্ন নই, সত্যি। বাট চিমটিটা জোরে পড়ে গিয়েছে।’
মুন আশেপাশে তাকিয়ে আর কোনো কিছু বলল না শুধু ইরাকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে কিছু একটা বোঝালো যার অর্থ,’তোরে আমি পরে দেখে নিবো।’

ইরা তা বুঝেও না বুঝার ভান করে নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,’ চল, ঐদিকটায় আমার ফ্রেন্ডসরা আছে। তোকে পরিচয় করিয়ে দিই।’ এই বলে ইরা ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা ধরলো। মুনও ইরাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলো।

ক্যাম্পাসের এক জায়গায় গিয়ে ইরা থামলো। সেখানে একটি ছেলে আর দুইটি মেয়ে বসে আছে। ইরা ওখানে গিয়ে ওদের পাশে বসে মুনকে ইশারা করলো বসতে। মুন বসতেই ওদের দৃষ্টি মুনের দিকে পড়লো। ওদের প্রশ্ন-বোধক চাহনি দেখে ইরা ওদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘হেই গাইজ। শি ইজ মুন & শি নিউ হেয়ার। শি কাম’স ফ্রম বাংলাদেশ।’
ইরার কথা শুনে তিনজনই মুনকে উদ্দেশ্য করে ‘হাই’ জানালো।
ইরা মুনকে উদ্দেশ্য করে আবারো বলে উঠল,’মুন, ও হচ্ছে রিক, ও সিমি আর ও রিহি। ওরা সবাই এ দেশের।’
ওরা তিনজনই ইরার মতো ফর্সা। অবশ্য, সেই দেশের সবাই ফর্সা। ইরাও তাদের মতো ফর্সা। তবে মুন ওদের মতো অটো ফর্সা নয়।

এতক্ষন আড্ডার মাঝখানে বসে মুন বুঝতে পারলো রিক আর সিমি একজন আরেকজনের সাথে পড়ে না। তারা দুজনই কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যায়। আর রিহি চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। মুন আর রিহি সম্পূর্ণ আড্ডা-মহলে চুপচাপ ছিল।
এরপর ক্লাসে গিয়ে ঠিকঠাকভাবে সব শেষ করলো। সামনেই তাদের ভ্যাকেশন তাই ভার্সিটিতে একটা ট্যুর দিবে যেখানে সব স্টুডেন্টরাই থাকবে, কোনো একটা সুন্দর জায়গায় ট্যুর দিবে। ইরা তো ট্যুর নিয়ে অনেক এক্সসাইটেড। গল্পের মাঝখানে সে ট্যুরের কথা ফেলছেই না। ইরার বেশি খুশির কারণ হচ্ছে উপরের ক্লাসের স্টুডেন্টরাও যাচ্ছে আর ওখানে তার বয়ফ্রেন্ড রনও আছে। মুনের এসবের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই তাই সে চুপচাপ। এরপর ভার্সিটি শেষে তারা বাসার দিকে রওনা দিল। সব মিলিয়ে মুনের ম্যারিল্যান্ডের প্রথম দিন ভালোই কাটলো। মুন প্রথম দিন নিয়ে যতটা ভয়ে ছিল ততটা ভয় লাগেনি। রিক, সিমি, রিহি এরা খুব সহজেই মিশে গেল মুনের সাথে। এদের দেখে ভিনদেশের প্রতি থাকা ধারণাটা এক নিমিষেই হাওয়াই মিলে গেল মুনের।
মুনের মিশতে ততটা খারাপ লাগেনি কারণ ম্যারিল্যান্ডের কোনো দপ্তরিক ভাষা নেই। ইংরেজিতেই সবাই কথা বলে। যার কারণে মুনের ফ্রেন্ডশিপ করতে কষ্ট হয়নি।

বিকেলে ইরা মুনকে সাথে নিয়ে বের হলো ম্যারিল্যান্ডের বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করানোর জন্য। সবসময়ের মতো ইরা শর্ট কাপড়ই পড়লো আর মুন লং কুর্তি,গলায় একটা স্কার্ফ পড়লো আর চুলে বিনুনি করে সেটা সামনে এনে দিল। এরপর দুইজনেই বেরিয়ে পড়ল। ওরা মূলত হাঁটতে বেরিয়েছিল। ম্যারিল্যান্ডের বিকেলের রাস্তা সকালের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। মুনের পাশ দিয়ে দুইটা বাদামি চুলের ছেলে মেয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো। মুন হেটে হেটে সব দেখতে লাগলো। রাস্তার এক পাশে এক ভদ্রলোককে গিটারের সাথে গান করতে দেখা গেল। মুন কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে গান শুনলো। লোকটি অসম্ভব সুন্দর করে গান গাইছে। ইরা বিকেলের নাস্তা করার জন্য মুনকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। যেটি নদীর পাড়ে। মুন ম্যারিল্যান্ডের সৌন্দর্য প্রথমবারের মতো সবকিছু মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here