#স্নিগ্ধ_গাংচিল,৯,১০
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯
আজ অনেকদিন পর রিফাত তার বাবার দেওয়া সেই কাজটা শেষ করতে পেরেছে। বিয়ের আগের সময় হলে কাজটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত কিন্তু এখন প্রীতির চিন্তায় কাজটা এতো দেরিতে শেষ হলো। প্রায় পনেরো দিন পর সে তার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। মূলত বাসায় ফেরার চাইতে প্রীতিকে অনেকদিন পর দেখবে বলে বেশি খুশি লাগছে। সে জানে না এখনো ওই বাসায় সবার কী অবস্থা। ঢাকা যাওয়ার জন্য রাতে বাসটাতে উঠার ফলে সকালেই ঢাকা পৌঁছে যেতে পেরেছে।
রিফাত বাস থেকে নেমে চারদিকে একবার চোখ বুলালো। না, তাদের বাসার কাওকে দেখা যাচ্ছে না, কেউ নিতে আসেনি রিফাতকে । আজ রিফাত বাসায় ফিরবে এটা সে বাবাকে খবর দিয়েছিলো কিন্তু বাবা আসেনি। রিফাতের একটু মন খারাপ হলো। আগে রিফাত বাসা থেকে দুইদিন কোথাও বাইরে থাকলে বাবা-মা পাগলামি শুরু করে দিতো, কাজের জন্য ঢাকার বাইরে গেলে দুইদিনের দিন ফিরে আসতে হতো বাবা-মায়ের পাগলামির জন্য, বাবা স্টেশনে এসে রিফাতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত, রিফাত বাস থেকে নামতেই এসে জড়িয়ে ধরতো। অথচ আজ! এতদিন পরে আসছে তাও কেউ নিতে আসলো না। রিফাত বুঝলো বাবা-মায়ের মনে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে হয়ত। কিন্তু নিমিষেই প্রীতির কথা ভাবতে গিয়ে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে বাবা-মা’য়ের সামনে মুনের থেকে ক্ষমা চাইবে রিফাত। অন্তত মুন কোনোদিন ক্ষমা না করে পারবে না। মেয়েটির সাথে একটু বেশিই অন্যায় হয়ে গিয়েছে, মুন ক্ষমা করে দিলে বাবা-মা’ও রিফাতের কাছ থেকে আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না, এতে রিফাত নিশ্চিত। সে আর কিছু না ভেবে বাস থেকে নেমে পড়ল। এরপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
—————–
সকালে মুন চোখ খোলার আগেই পানির গর্জন কানে এল। মুন আর শুয়ে থাকতে পারলো না। চিলেকোঠার মই বেয়ে নিচে নেমে এলো। দরজার বাইরে প্রচন্ড আওয়াজ। ছোট্ট রান্না-ঘরটাতে মধ্যবয়স্ক চাচাটি কিছু বানাতে ব্যস্ত। মুন কৌতূহল-বশত বাইরে এতো আওয়াজের কারণ জিজ্ঞেস করতে চাচার পাশে এগিয়ে গেল।
-‘চাচা, কীসের আওয়াজ এটা?’
-‘মনে হচ্ছে খালের পানি,’ বলে চাচা রান্নাঘরের ছোট্ট কাঁচের জানালাটা খুলতেই কয়েকগুন বেড়ে গেল ভীতিকর শব্দটা।
-‘এ যে প্রচুর বৃষ্টি!’ চাচা জানালাটি খুলে মুনের উদ্দেশ্যে আবারো বলে উঠল।
জানালা খোলার সাথে সাথে বৃষ্টির আওয়াজ তীব্র হলো। মুন আওয়াজের জন্য কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দেখল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার অনেক। মেঘে পুরো দিনের আলোটা আড়াল করে রেখেছে।
-‘চাচা, এতো বৃষ্টির মধ্যে খালের পানি উঠে যাবে না তো?’ বৃষ্টির জোর দেখে মুন চাচার উদ্দেশ্যে বলল।
চাচা কফির পানি চুলার দিকে এগিয়ে নিতে নিতে বলল,’চিন্তা নেই। খালের পানি এতো উপরে উঠবে না ; উপরের নিচের মতো জায়গাটা ছাপিয়ে নিচে নেমে যাবে পানিগুলো।’ বলতে বলতে জানালাটি বন্ধ করে দিলো।
জানালা বন্ধ করার সাথে সাথে আওয়াজটার তীব্রতা কমে গেল।
মুনের হঠাৎ দেশের ইচ্ছেটা তীব্রভাবে জেগে উঠল। এমন একটা স্বপ্নের মতো জায়গায় তার এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে না পারলে তার আফসোস থেকে যাবে। সে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে এক দৌড়ে সামনে এগিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। বরফ-শীতল বৃষ্টির পানি মুনের সারা গা মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল। কিন্তু মুন সেদিকে পরোয়া না করে আরও দু’পা এগিয়ে ক্রিকের দিকে তাকালো। ক্রিকের পানি মুনের ঠিক পায়ের কাছে উঠে এসেছে, প্রচন্ড গর্জন ছেড়ে সামনের দিকে স্রোত-আকারে ছুটছে পানিগুলো, পাক খাচ্ছে। সেই আপন মনে বক বক করা ক্রিকের পানির এমন রুদ্ধ-মূর্তি কল্পনাইও আনতে পারেনি মুন।
মুন দু’হাত মেলে চারদিকে ঘুরতে লাগল। আজকে ডাক দেওয়ার মতো কেউ নেই, এতদিন মায়ের জন্য দেশে এমন ইচ্ছেটা ভালোভাবে পূর্ণ করতে পারেনি আর আজ! এমন সুন্দর একটা দিন তার জীবনে আসবে তা সে কল্পনায়ও আনেনি।
সামনের ঘরের কাঁচের জানালাটির ধারে বসে আদ্রিন প্রকৃতির এই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যটি পেইন্টিং করছিলো। হঠাৎ এরই মাঝে কোনো এক সাদা পরীর দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেল। সে তার পেইন্টিং’য়ে প্রকৃতির দৃশ্যর মাঝে পরীটিকেও স্থান দিল। অনেক্ষন যাবৎ জানালা দিয়ে সে সেদিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইল। এরপর কিছু বুঝে উঠতেই সে পেইন্টিং শেষ করে সেটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে চাচাকে ডাক দিল। চাচা আসতেই আদ্রিন মুনকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলার আদেশ দিল। চাচা গিয়ে মুনকে ডাকতেই মুন কী বলল সেটা আদ্রিন বুঝতে পারেনি ঘর থেকে কিন্তু চাচার হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে ফিরে আসতে দেখে আদ্রিনের মাথায় রাগ চড়ে বসল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে মুনের পাশে দাঁড়ালো। আদ্রিনের কোনো কালেই বৃষ্টি পছন্দ ছিল না, সে বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করে না কিন্তু তাই বলে অন্যের পছন্দের জিনিসে আদ্রিন বারণ করবে – সেটা কোনোদিন করেনি। কিন্তু আজ এই মেয়ের এতো বেশি বৃষ্টিতে ভেজা আদ্রিনের সীমা লঙ্গনের মতো লাগছে। হয়ত এই মেয়ে নিজের বাসায় মা-বাবার জন্য শখটা পূরণ করতে পারেনি বলে এখানে পূরণ করছে। আদ্রিনের মাথা ব্যথা বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে নয় ; মেয়েটির শখটা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে যা আদ্রিনের জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুন চোখ বন্ধ করেই বৃষ্টি উপভোগ করছিলো যার ফলে পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে খেয়াল করতে পারেনি।
-‘এই মেয়ে! ঘরে যাও।’ আদ্রিন ইংরেজিতেই বলে উঠল।
হঠাৎ কারো গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মুনের পিলে চমকে উঠল। সে এতক্ষন নিজেকে অনেক স্বাধীন মনে করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কল্পনার রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল কিন্তু মাঝখানে এই ইংরেজ ব্যাটা এসে তার শখের মধ্যে পানি ঢেলে দিবে তা তার ভাবনার বাইরে ছিল।
মুন চোখ খুলে আদ্রিনের দিকে এক ফলক তাকিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই ইংরেজ ব্যাটার জন্য তার এতো সুন্দর কল্পনাতে ব্যাঘাট ঘটছে তাই সে আদ্রিনের প্রশ্নে কোনো জবাব না দিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে আগের মতো প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করল।
মুনের এমন গা-ছাড়া ভাব দেখে আদ্রিন রেগে মুনের হাত শক্ত করে ধরে এক টানে ঘরের ভেতর নিয়ে এল।
মুন চোখ লাল করে আদ্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। আদ্রিন না দেখার ভান করে মুনকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ব্যাগ গুছাতে মনোনিবেশ করল।
এতক্ষনে বৃষ্টির ঘনত্ব কমে এসেছে। আদ্রিন পুরোপুরি ব্যাগ গুছিয়ে চাচাকে ডেকে সে চলে যাওয়ার কথা বলল। মুন তা শুনেও যেন শুনলো না। তার কেন জানি আদ্রিনের উপর ভীষণ-ভাবে অভিমান জন্মেছে। বলা হয়, অভিমান শুধু আপনজনদেরই উপর জন্মে কিন্তু মুনের কেন জানি এই একরাতের পরিচয়ে এই মানুষটার উপর অভিমান এসেছে তা সে ভাবতে পারছে না। অথচ মানুষটার সাথে ভালোভাবে এক বাক্য কথাও এখনো বিনিময় হয়নি।
আদ্রিন ব্যাগ গুছিয়ে মুনকে পেরিয়ে বের হতে নিতেই চাচা এসে মুনের কথা জানাতেই সে আড়চোখে এক ফলক মুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,’গাড়িতে পেছনের সিট্ পড়ে আছে, যার ইচ্ছে উঠতে পারে, চাইলে শহর পর্যন্ত যেতে পারে।’
মুন বুঝতে পারলো কথাগুলো তারই উদ্দেশ্যে ছিল। এই ইংরেজ ব্যাটা ছাড়া সে কোনোমতেই নিজের বাসায় যেতে পারবে না তা ভেবে অভিমান এক পাশে রেখে ওভাবেই ভেজা শরীরে গাড়িতে উঠে পড়ল মুন।
গাড়িতে উঠতেই আদ্রিন গাড়ি না ছেড়ে নিজের ব্যাগে কী যেন একটা খুঁজে বের করে সেটা গাড়ির পেছন সিটে বসা মুনের দিকে ছুড়ে মারলো।
মুন হাতে নিয়ে দেখতে পেলো একটা বড়ো টাওয়াল। মুন সেটা না নিয়ে ওভাবেই রেখে দিল। তার এখন ভীষণ রাগ পাচ্ছে মানুষটার উপর, মুনকে পশুর মতোই করছে সব।
-‘আমার গাড়ি ভেজালে ভুলেও নিবো না। গাড়ি থেকেই ফেলে দিবো বলে দিলাম। আমার সিট্ যাতে না ভিজে।’ আদ্রিন ড্রাইভিং সিটে বসে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল।
মুন বুঝতে পারলো এই ব্যাটা যা বলে তা অক্ষরে অক্ষর পালন করে। এমনও হতে পারে, অর্ধেক পথে গিয়ে সিট্ ভেজা দেখে মুনকে গাড়ি থেকে ফেলে চলে যাবে। তাই মুন আর না পারতে টাওয়ালটা টেনে নিতেই আদ্রিন গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ির মধ্যে কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি ওদের। শহরে আসতেই আদ্রিন গাড়িটা এক পাশে থামিয়ে মুনকে নেমে যেতে বলল। মুন গাড়ি থেকে নামতেই আদ্রিন মুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল। মুনের হঠাৎ করে ভীষণভাবে কান্না পেলো। মানুষটা এমন কেন। মুন এক আকাশ পরিমান অভিমান আর কান্না-মাখা চোখে আদ্রিনের গাড়িটা যাওয়ার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইল। দেখতে দেখতে গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর কী দেখা হবে মানুষটার সাথে!
#চলবে
#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০
রিফাত বাসায় এসে কারো সাথে কথা বলতে গেলেও সবাই তাকে এড়িয়ে গেল। এত্তো ছোট বিষয় নিয়ে এতগুলো দিন রেগে থাকার কারণ রিফাত ভেবে পায় না। আজ সকালে রিফাত যত খুশি নিয়ে বাসায় ফিরেছিল, বাসায় ফেরার পর ততটাই হতাশ হয়েছে। কিন্তু প্রীতিকে এতদিন পর দেখে নিমিষে মন ভালো হয়ে গেল।
রাতে রিফাত সবার সাথে খাওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে নেমে টেবিলে বসতেই দেখলো একে একে সবাই আছে কিন্তু মুন নেই। মুনের চেয়ারটা খালি দেখে কেন জানি রিফাতের বুক ধক করে উঠল। সে খাওয়ার মাঝে বারে বারে সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে, এই বুঝি মুন সিঁড়ি বেয়ে চেয়ারটাতে বসে অভিমান-ভরা চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলবে,’তোমরা সবাই আমাকে ফেলে বসে যেতে পারলে!’ রিফাত তার ভাবনার মাঝেই হেসে দিল। টেবিলে সবার দৃষ্টি রিফাতের দিকে। প্রীতিও খাওয়া ফেলে রিফাতের দিকে তাকালো। রিফাতের হুশ ফিরতেই সে আশেপাশে তাকিয়ে মাথা নিচু করে খাবারে মনোযোগ দিল, খাওয়ার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে বারবার মুনের চেয়ারটাতে চোখ বুলাচ্ছে রিফাত। রিফাতের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো -সে আগের দিনগুলোতে ছিল, রিফাতের হাসি দেখে মুন এসে রিফাতের হাতে খামচি দিয়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু এখন তেমন কিছুই হয়নি। মুনের চেয়ারটা রিফাতের সামনাসামনি হওয়াতে বারবার না চাইতেও দৃষ্টি ওখানেই আবদ্ধ হচ্ছে কিন্তু আজ খালি। কেউ মুনকে খেতে ডাকছে না কেন রিফাত ভেবে পাচ্ছে না, সে যে মুনকে একটিবার দেখতে চায়। রিফাতের আজ কেন জানি বুঁকের কোথাও শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। হঠাৎ করে মুনকে দেখার তীব্র ইচ্ছে জ্ঞাপন করল রিফাত। কিন্তু আফসোস! সবার খাওয়া শেষ আর মুনের চেয়ারটা এখনো খালিই রয়ে গেল। একে একে সবাই খেয়ে উঠে গেল কিন্তু তার ভাবনার মতো করে মুন আর সিঁড়ি বেয়ে নেমে তার সামনের চেয়ারটাতে বসে অভিমান-ভরা চোখে কারো দিকে তাকালো না। রিফাত আজ প্রীতির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে মুনকেই খুঁজতে লাগল। তবে কেন এমন হচ্ছে! সে তো মুনকে ভালোবাসেনি! এটা কী মায়া না-কি ভালোবাসা! এর উত্তর রিফাতের জানা নেই।
রাতে খাওয়া শেষ করে রিফাত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় কোনার রুমটাতে না চাইতেও দৃষ্টি দিল। রুমটা বন্ধ। রিফাত নিজের রুমে ঢোকার আগ-মুহূর্তেও মুনের রুমটার দিকে আবারো দৃষ্টি দিল। না, দরজা বন্ধ।
রাতে প্রীতি সব গুছিয়ে রুমে এসে দেখল, রিফাত ব্যালকনিতে অন্য-মনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত ব্যালকনিতে গিয়েও বারে বারে তার পাশের মুনের ব্যালকনিটার দিকে নজর বুলাচ্ছে, যে এই বুঝি মুন আসবে ব্যালকনিতে। সেই রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে বুঝতে পারছে না, মেয়েটা রিফাতের চোখে একবারও ধরা দিচ্ছে না।
পেছন থেকে প্রীতি রিফাতকে জড়িয়ে ধরতেই রিফাত বিরক্তসূচক শব্দ করে প্রীতিকে ছাড়িয়ে নিল। প্রীতি অবাক দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকাল।
-‘উফ প্রীতি, বিরক্ত করো না তো।’
রিফাতের এভাবে প্রীতিকে ছাড়িয়ে নেওয়ায় প্রীতির অপমান লাগলো। প্রতিবার তো রিফাত নিজেই প্রীতিকে জড়িয়ে ধরতো। অথচ আজ, রিফাত নিজেই ছাড়িয়ে নিলো প্রীতিকে। সে রিফাতের কাছ থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী হয়েছে তোমার? খাওয়ার আগে থেকেই তোমাকে অন্য মনস্ক মনে হচ্ছে।’
-‘প্রীতি একটা সত্যি কথা বলবে?’ রিফাত কোনো ভঙ্গিমা ছাড়া প্রীতির দিকে ফিরে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠল।
-‘হ্যাঁ, বলো?’
-‘আসার পর থেকে মুনকে একবারও দেখলাম না। সে কই? সে কী আমি এসেছি বলে সামনে আসছে না?’
রিফাতের কথা শুনে প্রীতি অবাক দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।
প্রীতির এভাবে তাকানো দেখে রিফাত বিরক্ত-সূচক শব্দ করে বলে উঠল,’কী হয়েছে? এভাবে তাকাচ্ছ কেন?’
-‘এ কী! মুনের ব্যাপারে তুমি জানো না?’
-‘কী জানবো?’
-‘কী জানবে মানে! মুন তো এখানে নেই। সে তো ম্যারিল্যান্ডে।’
প্রীতির কথা শুনে রিফাতের মুখ হা হয়ে গেল। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রীতির দিকে তাকিয়ে রইল।
-‘ক,, কী বললে এই মাত্র তুমি?’
-‘সত্যিই তো! তোমার পরিবারের কথা তুমি জানো না ভেবে অবাক লাগছে আমার। তোমাকে কী কেউ বলে নি? পরিবারের কাছে তুমি এতটা নিচু! ভাবতেও অবাক লাগছে আমার। এ আমি কাকে বিয়ে করলাম। যার পরিবারে সে নিজেকেই কোনো মূল্য দেয় না আর আমাকে কীভাবে দিবে!’ বলে হনহন করে প্রীতি রুমে ঢুকে গেল।
আর এদিকে রিফাতের কানে প্রীতির এতো কথা ঢুকেনি। তার কানে শুধু একটা কথায় বাজছে -‘মুন এখানে নেই, ম্যারিল্যান্ডে।’
মুনের এদেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণ কী রিফাতই! সে নিজেই কী! মুন এই পরিবার ছাড়া কোনোদিন একরাতও অন্য কারো বাসায় ছিল না। সে এই পরিবারের বাইরে কোনো জায়গায় থাকার কথা মাথায়ও আনতো না আর আজ এতগুলো দিন কীভাবে বাইরে একটা অচেনা দেশে আছে! তা ভাবতেই রিফাতের মনে একরাশ খারাপ লাগা কাজ করল। কেউ না জানুক অন্ততঃ রিফাত জানে, যে মুন উপরে শক্ত দেখালেও ভেতরে অনেক নরম মনের একটা মেয়ে। হয়ত সেদিন উপরে শক্ত থাকলেও ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলো তার মনটা। মুনের পরিবার ছাড়া অচেনা একটা দেশে থাকার কথা ভাবতে গেলেই রিফাতের ভীষণ খারাপ লাগছে। তার চেয়ে বড়ো কথা, মেয়েটার কাছ থেকে এতো বড়ো অন্যায়ের জন্য আর ক্ষমাও চাওয়া হলো না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তার বোন সমান এই মেয়েটিকে সে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে হয়তো নিজেরই অজান্তে। রিফাত মুনের ব্যালকনির দিকে এক ফলক তাকিয়ে গ্রিলের বাইরে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে ‘ক্ষমা করে দিস মুন’ আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠল।
—————-
কেটে গেল আরো কয়েক সপ্তাহ। এর ভেতর সব আবার আগের মতোই শুরু হলো মুনের। প্রতিদিন উঠে ভার্সিটি যাওয়া, আসা, বিকেলে ইরার সাথে একটু ঘুরতে যাওয়া আবার রাত হলে পড়তে বসা তারপর ঘুমিয়ে পড়া আর ইরার গভীর রাতে নিজের রূপ ফিরিয়ে এনে পার্টিতে যাওয়া। এভাবেই কেটে যাচ্ছে মুনের ম্যারিল্যান্ডের দিনগুলো। এর মধ্যে মুনও সেই মানুষটাকে পুরোপুরি ভুলতে বসেছে।
এমনই একদিন ভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারলো নতুন কোনো টিচার জয়েন করবে। ইরা-সিমির মুখ থেকে ওই টিচারের কথা পড়ছেই না। ইরা-সিমির ক্রাশ না-কি টিচারটা, শুধু ইরারই নয় ভার্সিটির প্রায় মেয়েই উনার কথা ফেলছে না। এর মধ্যে একদিন এসেছিল তবে ক্লাস করায়নি, সেদিন মুনের মাথা ব্যথা থাকার জন্য ভার্সিটিতে আসেনি কিন্তু ইরারা এসেছিলো। মুন না আসাতে ইরা ওই কথাগুলোতে মসলা মেখে ইন্টারেস্টেড করে মুনের মাথা খাচ্ছে। আজ টিচারটার ক্লাস আছে যার ফলে ইরা, সিমি দুইজনেই ভারী ভারী মেক-আপ করে ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়েছে।
ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মুনরা ক্যান্টিনে গিয়ে প্রতিদিনের মতো আড্ডায় বসলো। রিক তো সিমিকে কোনো কথাতেই ছাড়ছে না, এমনি সিমির ভারী মেক-আপের জন্য রিক অনেক রাগী মুডে রয়েছে। সে চায় না, সিমি অন্য কারোর উদ্দেশ্যে সাজুক। রিকের এমন ব্যবহারে অন্যরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। সিমি নিজেও এর কারণ বুঝতে পেরেছে তাই সে রিককে আরো উল্টা উল্টা জবাব দিতে লাগল।
ক্লাসের সময় হতেই আড্ডা শেষ করে ওরা ক্লাসের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে গিয়ে বসলো।
অবশেষে ইরাদের ক্রাশ টিচার এসেই গেল। মুন ইরাদের ক্রাশকে দেখার জন্য অনেক আগ্রহের সহিত ক্লাসের দরজার দিকে তাকালে তার পিলে চমকে উঠল। সে এক দৃষ্টিতে ঐদিকেই তাকিয়ে রইল।
মুনের এভাবে তাকানো দেখে ইরা মুচকি হেসে মুনকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,’কী ক্রাশ খেয়েছিস তুইও? বলেছিলাম না, অনেক সুন্দর টিচার এটা। আমার সাথে একদম পারফেক্ট।’
মুন যেন চোখই ফেরাতে পারছে না। সে ভেবেছিলো, মানুষটার সাথে বুঝি আর দেখাই হবে না! এভাবে দেখা হওয়াটা তার ভাবনার বাইরে ছিল তাও স্যারের রূপে!
#চলবে