স্নিগ্ধ_গাংচিল,১১,১২

0
899

#স্নিগ্ধ_গাংচিল,১১,১২
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১১

আদ্রিন ক্লাসে স্যার-রূপে ঢুকার কিছু-সময় পর শিক্ষার্থীদের পরিচয় পর্ব নেওয়া শুরু করলো। একে একে পরিচয় দিতে দিতে মুনের পাশে ইরার পালা আসলো। ইরা তো হাসি হাসি মুখ করে এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে স্যার-রূপে আদ্রিনের দিকে। এদিকে পরিচয় দেওয়ার পালা আসছে সেই খবর তার নেই। ইরার এমন-ভাবে স্যারকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্লাসের সবার দৃষ্টি এখন ইরার দিকে। মুন মাথা নিচু অবস্থায় ইরাকে হাতের কনু দিয়ে ধাক্কা দিতেই ইরার হুশ ফিরলো। আশেপাশে তাকিয়ে সে লজ্জায় মাথা নিচু করে উঠে পরিচয় পর্ব দিলো। এরপর মুনের পালা আসতেই মুন দাঁড়ালো। সে ভেবেছিলো আদ্রিন তাকে ভুলেনি কিন্তু তার ভাবনার মাঝে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে আদ্রিন মুনের পরিচয় দিতে বলল। মুন এক রাশ অভিমান নিয়ে তার পরিচয় দিলো। আদ্রিন এমন ভাব করলো, অন্য সব স্টুডেন্টের মতো মুনকে সে আজই প্রথম দেখলো। মুন ভেবে পায় না, একটা মানুষ এতো তাড়াতাড়ি কাওকে ভুলে যেতে পারে!
এরপর যথারীতি নিয়ম অনুসারে আদ্রিন ক্লাস শেষ করে বিদায় নিল।

——————

দেখতে দেখতে কেটে গেল এক মাস। রিফাত কাজের সূত্রে ঢাকার বাইরে একটা প্ল্যাট নিয়ে একা থাকে। মূলত কাজ থেকেও বেশি সে একাই থাকতে চায়। এইবার আফজাল শেখ পাঠায়নি তাকে, রিফাত নিজেই এমন পরিকল্পনা করে পরিবার থেকে দূরে চলে এসেছে। অপরাধ-বোধ জেগে উঠে সবসময়। প্রীতির সাথেও ঠিকঠাক মন থেকে কথা আসে না। এখন বুঝতে পারছে রিফাত, প্রীতি অর সাময়িক মোহ ছিল। আর প্রীতিকে এতো করে চাওয়ার কারণ হচ্ছে প্রথমবার চাওয়াতে পাই না, তাই এর প্রতি আকর্ষণীয় কাজ করেছে রিফাতের।

~মানুষ যদি কোনো জিনিস একবার চাইতেই সাথে সাথে পেয়ে যায় – সেটার প্রতি কোনো আকর্ষণীয়-বোধ থাকে না। আর যদি কোনো সস্তা জিনিস’ বারবার চাইতে হয়, হোক সেটা কোনো সস্তা জিনিস তাহলে সেই সস্তা জিনিসটার’ই প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করে ;পরবর্তীতে ওই বারবারে চাওয়া সস্তা জিনিসটাই দামি মনে হয়। তখন একবারে পাওয়া দামি জিনিসটা থেকে বারবার করে চাওয়ার পর পাওয়া সস্তা জিনিসটার মূল্য বেড়ে যায় মানুষের কাছে কারণ দামি জিনিসটা একেবারেই পেয়ে গিয়েছে কিন্তু সস্তা জিনিসটা একবারে পায়নি তাই তো সেটাই পাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে উঠে।’~
রিফাতের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। মুনকে একবার চাইতেই পেয়ে গেল তাই এর মূল্য বুঝতে পারেনি কিন্তু প্রীতিকে প্রথমে না পাওয়ার ফলে এর প্রতি আকর্ষণবোধ বেড়ে গিয়েছিলো। রিফাতের এখন কোথাও শান্তি শান্তি লাগে না। প্রীতির সাথেও ভালোভাবে কথা হয় না, দুয়েকটা কথা না পারতে বলে। ইদানিং প্রীতিও আর আগ-বাড়িয়ে রিফাতের সাথে কথা বলে না। তার আচরণ রিফাতের কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। তবুও রিফাত সেদিকে আর মাথা দিল না, সে যথা-সম্ভব নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকতে চায়।

——

মুনও নিজেকে অনেক গুছিয়ে নিয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা পার্ট-টাইম জব নিয়ে নিজের খরচ নিজে চালিয়ে ফেলে। প্রতিদিন সময় করে পরিবারের সাথে কথা বলা, নিজের ভার্সিটির ক্লাসের পড়াশোনা আর জব – সবমিলিয়ে ব্যস্তটায় দিন কেটে যাচ্ছে মুনের। এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে অতীতটা ভুলতে চেষ্টা করছে মুন। কিন্তু আসলেই কী ভুলা যায়! রাত হলেই তিক্ততা-মিশ্রীত অতীতটা তার চোখে হানা দেয়। তবুও ভুলার চেষ্টায় আছে মুন।
ভার্সিটিতে আদ্রিন স্যারের ক্লাস সপ্তাহে মাত্র দুইটা। কারণ উনি এই টিচিংটা শখের বশে নিয়েছে তাই সবসময় সময় দিতে পারে না। সবসময় বিজনেসের কাজে একেক-জায়গায় থাকে।
মুনের তো ইচ্ছে করে এই মানুষটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। ‘হু, যত্তসব শখের বশে টিচিং করে না-কি মেয়েদের নিজের চেহারা দেখাতে আসে!’ মুন আপনমনেই বিড়বিড় করে গালি দেয় মানুষটাকে। যতবারই মানুষটা ক্লাসে ঢুকবে সব মেয়েদের এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে মুন আপনমনে বিড়বিড় করে এই গালিটা দেয়, এই বিড়বিড় করার জন্য মুনকে অনেকবার মানুষটা সম্পূর্ণ ক্লাসে সবার সামনে শাস্তি দিয়েছে। মুন ক্যান্টিনে আড্ডা দেওয়ারত অবস্থায় সবার সাথে হাসা-হাসি করার কারণে অনেকবার বিনা কারণে শাস্তি দিয়েছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো মুনের ভীষণ কিন্তু এখন সয়ে গেছে। এখন আর রাগ হয় না মানুষটার উপর। কেন জানি এক অন্যরকম মায়া জমে গেছে মানুষটার প্রতি। ভার্সিটির সব স্টুডেন্টই মানুষটাকে ভারী পছন্দ করে। হয়ত মানুষটা’ই মায়াই ভরপুর। সবমিলিয়ে মুনের ম্যারিল্যান্ডের দিনগুলো সুন্দর-ভাবে চলে যাচ্ছে।

———–
দেখতে দেখতে আরো কয়েক মাস গড়িয়ে গেল। বসন্তের দিন এখন। ম্যারিল্যান্ডের বসন্তের দিনগুলো ভারী সুন্দর।
সেদিন ভার্সিটিতে আদ্রিনের ক্লাস ছিল না। মুন ভার্সিটি থেকে ফিরেই দেখল বড়ো বাবা মেসেজ পাঠিয়েছে। ক্লাসে থাকায় মুন কল ধরতে পারেনি। যার কারণে আফজাল শেখ মেসেজ পাঠিয়েছে, একটু সময় নিয়ে কলটা ধরার জন্য। কিন্তু মুনের মোবাইল ব্যাগে থাকার কারণে মেসেজটা চোখে পড়েনি। বড়ো বাবার এমন ইমার্জেন্সি মেসেজ করার কারণ মুন বুঝতে পারলো না। কারণ মুন সময় করে রাতের একটা সময় পরিবারের সাথে কথা বলে। কালকেও রাতেও বলেছিলো আর আজকে রাতেও বলার কথা। কিন্তু এর মাঝে এমন কী হয়ে গেল যে বড়ো বাবা এত্তো কল করেছে।
মুন ব্যাগ রেখে কল ব্যাক করতেই বড়োবাবা অপর-পাশ থেকে কিছু বলতেই মুনের হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। মুন বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। পাশে ইরা বসেছিল, মুনের এমন রিঅ্যাকশন দেখে সে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। মুনের দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। ইরা কিছু বুঝতে না পেরে মোবাইল কানে নিয়ে আফজাল শেখের সাথে কথা বলে জানতে পারল মুনের মা হাসপাতালে ভর্তি। এখনো জ্ঞান ফেরেনি। সকালে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

ইরা মোবাইল রেখে মুনকে আশ্বাসের সুরে বলল,’আন্টির কিছু হবে না দেখিস। তুই চিন্তা করিস না।’

মুন কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,’এই মা’ই আমার দুনিয়ায় সবচেয়ে আপন। বাবা মরার পর মা কোনোরকম অপূর্ণতা রাখেনি আমার। আমার যেভাবেই হোক, দেশে ফিরতে হবে।’

-‘তুই দেশে যাবি?’

-‘দেশে না যাওয়া ছাড়া আমি শান্তি হতে পারবো না। হয়ত আর নাও ফিরতে পারি এখানে। মায়ের আগে আমার আর কিছুই নই। মা সুস্থ হলে মায়ের সাথেই থেকে যাবো আমি।’

ইরা মন খারাপ করে বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। তার মা নেই, তাই সে মায়ের কদর বুঝে। বাবা কোনোকিছুর অপূর্ণতা না রাখলেও মায়ের পূর্ণতা ভালোভাবে চাইলেও করতে পারেনি। ইরা হয়তোবা বাবার সামনে হাসিখুশি ভাবে থাকতো কিন্তু দিন শেষে রাতে মায়ের কথা মনে পড়ে। চাইলেও সবকিছু বাবাকে বলা যায় না। এই যে এখন, ইরা প্রতিরাতে পার্টিতে যায়- যদি মা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়ত যেত না। কারণ প্রথম যেদিন ইরা পার্টিতে গিয়েছিলো সেদিন বাসায় কেউ ছিল না, এরপরই সাহস বেড়ে প্রতিদিন যাওয়া শুরু করেছিল। বাবা সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে রাতে ঘুমালে আর কিছুর খবর থাকে না কিন্তু যদি মা থাকতো! তাহলে তিনি হয়ত সবসময় বাসায় থেকে ইরার সঙ্গ দিতো। ইরাও মায়ের সঙ্গ পেয়ে গভীর রাতে পার্টিতে যাওয়ার দুঃসাহস করতো না। মা থাকলে ইরার জীবনটা আজ হয়ত অন্যরকম হতো!

ইরা কী বুঝে বলে উঠল,’তোর সাথে আমিও যাবো আন্টিকে দেখতে। আমি বাবার সাথে কথা বলে এখনই ইমার্জেন্সি দুইটা টিকেটের ব্যবস্থা করছি। বাবা পারবে। কারণ উনি সবসময় বিজনেসের কাজে একেক দেশে যাতায়াত করে তাই।’

মুন চোখ মুছে ইরাকে জড়িয়ে ধরলো। এই মেয়েটা তার জন্য অনেক করেছে। আজ-কাল এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের কাছের মানুষগুলোই আজ-কাল ধোঁকা দেয় অথচ এই মেয়েটা স্বার্থ ছাড়া সবসময় পাশে ছিল।


রাতের ফ্লাইট মুন-ইরার। মুন তো কেঁদে-কেটে অবস্থা খারাপ। ইরার বাবা মেয়েকে মুনের সাথে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তিনিও মনে করেন মুনকে এই দুর্বল অবস্থায় একা এই দেশ থেকে পাঠানো উচিত হবে না। আর মেয়েও কয়েকদিন নিজের মাতৃভূমি থেকে ঘুরে আসুক। তিনি ইরাকে শর্ত জুড়ে দিলেন, কোনো দুষ্টমি যেন না করে। ইরাও হাসিমুখে মেনে নিলো সব। ইরা নিজের কাপড় গুছিয়ে, মুনের গুলো সহ গুছিয়ে দিলো। এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে রিক-সিমিদের একবার কল দিয়ে বলল ইরা তাদের দেশে যাওয়ার কথা। ইরা-মুনকে এয়ারপোর্টে বিদায় দেওয়ার জন্য তারা তিনজন এসেছিলো। মুন একে একে সবাইকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো ম্যারিল্যান্ড থেকে। রিক-সিমিরা মন খারাপ করে মুন-ইরাকে বিদায় দিল। এই ভিনদেশে এতো ভালো মনের বন্ধু পাবে মুন কল্পনাও করেনি। অবশেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে প্লেনে উঠে পড়ল মুন-ইরা। প্লেন নিজের দেশের উদ্দেশ্যে ছাড়তেই মুন জানালা দিয়ে শেষবারের মতো ম্যারিল্যান্ডকে একবার দেখে নিলো। সে জানে না আর আসবে কী না এখানে! ইরা মুনের হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাস দিল।

#চলবে

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১২

আদ্রিনের আজ ভার্সিটি’তে ক্লাস ছিল। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে ক্লাস করতে যেতে পারলো না। কারণ বিজনেসের কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অন্য একটা বড়ো কোম্পানির সাথে জরুরি মিটিং থাকার কারণে ভার্সিটি যেতে পারেনি। যার ফলে আজ সে তার প্রাণসীকে দেখতে যেতে পারেনি। প্রতিদিন তার চাঁদকে এক পলক দেখা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যে করেই হোক, কাল ভার্সিটিতে উপস্থিত হতে হবে। আদ্রিনের টিচিং পেশাটা পছন্দের নয়, সে শুধুমাত্র মুনকে দেখার জন্যই এই টিচিং পেশাটায় জয়েন করেছে। শুধুমাত্র মুনের জন্যই সে এই বিরক্তিকর পেশাটা নিয়েছে। মুনকে অগোছালো-রূপে প্রথম যেদিন এয়ারপোর্টে দেখেছে সেদিনই আদ্রিন মুনের মধ্যে আটকে গিয়েছে। এরপর কুইন্সে দেখে মুনের মধ্যে পুরোপুরি আদ্রিন নামক মানুষটা আটকে গিয়েছে। আদ্রিন মুনের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সেদিন সাদা গ্রাউনে মুনকে আদ্রিনের দিকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে দেখে আদ্রিনের শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠেছিল, মুনের স্পর্শ, ভয় পাওয়া সবকিছুতে আদ্রিন আটকে গিয়েছিলো। আদ্রিন তার এই অনুভূতিটাকে প্রথমে মোহ ভেবে মুনকে না চাইতেও বিভিন্ন বাজে কথা বলেছিলো কিন্তু দিন যতই যায় আদ্রিন বুঝতে পারে – এটা তার মোহ নয়।

আদ্রিন মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরে নানীমার সাথে আগে দেখা করলো। এরপর নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে তার দেয়ালে আটকানো সেদিনের ছবিটাতে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকলো। আরেকটা দিন। কাল সকালে গিয়েই আদ্রিন তার মনের কথা মুনকে বলে দিবে। সে যে এভাবে লুকোচুরি করতে আর পারবে না। অনেক তো হলো লুকোচুরি। এই টিচিং পেশাটা অনেকদিন মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করেছে এখন আর করতে পারবে না। কাল গিয়েই মুনকে সব কথা বলে টিচিং পেশাটা ছেড়ে দিবে।

———–

ইরা-মুন দেশে ফিরেই আফজাল শেখের সাথে আগে হাসপাতালে চলে গিয়েছে। মুনের মা রাশিদা ইসলামের জ্ঞান ফিরেছে। তিনি জানতো না, মুনের দেশে ফেরার কথা।
মুন গিয়ে ক্যাবিনের সামনে দাঁড়াতেই ডাক্তার বেরিয়ে এসে আফজাল শেখের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘রোগী বেশি টেনশন করে। এতো চিন্তা মাথায় প্রেসার পড়ে। সবসময় মন ভালো রাখতে চেষ্টা করবেন। যদি এমন-ভাবেই চলতে থাকে তাহলে হিতে-বিপরীত হবে।’ বলেই ডাক্তার নিজ গন্তব্যে চলে গেল।

মুন ধীরে ধীরে পা ফেলে রাশিদা ইসলামের পাশে বসে ডাক দিল। তিনি মুনের ডাক শুনে ফিরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিনি বুঝতে পারছেন না -এটা কী তার স্বপ্ন না-কি ভ্রম! তিনি তার হাতটা ধীরে ধীরে এগিয়ে মুনকে ছুঁয়ে দেখে কান্না করে দিল। মুনও মা’কে এভাবে দেখে আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলো না।

মা-মেয়ে অনেক্ষন কান্না-কাটি করে ঠিক হতেই মুন ইরার কথা বলল রাশিদা ইসলামকে। দূর থেকে ইরা ঝাপসা চোখে মা-মেয়ের কথোপকথন দেখছে। তার এখন ভীষণ করে মায়ের সান্নিধ্য লাভ করতে ইচ্ছে করছে। মুন ইরার চোখ দেখে মা’কে ইশারায় কিছু একটা বুঝালো। রাশিদা ইসলাম আস্তে আস্তে উঠে বসে ইরাকে হাত দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকলেন। ইরা এগিয়ে যেতেই তিনি হাসিমুখে ইরাকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন – তাকে যাতে মায়ের মতোই মনে করে, যখন যেটা ইচ্ছে ঐটা খাওয়ার আবদার ধরতে মুনের মতো। ইরা হাসিমুখে মাথা নাড়লো। মুনকে দেখে রাশিদা ইসলাম আর হাসপাতালে থাকতে চাইলো না। ডাক্তারও হাসিমুখে চিকিৎসা করে বলল, রোগী সুস্থ আছে মুটামুটি, দুইদিন ব্যাড রেস্টে থাকলেই হবে।

অবশেষে সবকিছু নিয়ে মুন-ইরা সহ হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এতকিছুর মাঝে তাদের প্রীতির উপর আর কারো খেয়াল ছিল না। বাসায় গিয়ে দেখল প্রীতি নেই। হয়ত কোনো কাজে বাইরে গিয়েছে ভেবে সবাই চুপচাপ ছিল কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ার পরেও প্রীতির না ফেরা দেখে সবার মাথায় দুঃচিন্তা ভর করলো। রিফাতকে খবরটা দিতেই সে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল।
সবারই দুঃচিন্তা, শুধু একজন ছাড়া। সে হলো আফজাল শেখ। তিনি জানতেন এমন কিছুই হবে। তার মোটেও মেয়েটিকে সুবিধার মনে হয়নি, আর তার এই ছেলের প্রাপ্য শাস্তি মেয়েটিই দিয়ে দিল। আফজাল শেখকে উপরে চিন্তাগ্রস্ত দেখা গেলেও মনে মনে তিনি মহা-খুশি। তবুও সবার এরূপ চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে তিনি থানায় জিডি করে আসছেন। বাসায় এসে দেখে প্রীতির সাথে সাথে রিফাত প্রীতিকে যা অর্থ জমা দিয়েছিলো – সেগুলোও গায়েব। সবার আর বুঝতে বাকি রইলো না -কাহিনী কী!
আফজাল শেখের অর্থ বা প্রীতির জন্য কোনো চিন্তা নেই। তিনি এতদিনে একটা মন-ভরে শ্বাস ফেলল,’যাক বাবা! এতদিনে একটা মনের মতন কাজ হলো!’ আপনমনেই বিড়বিড় করে হেসে উঠল। প্রীতি নিজে থেকে এই বাড়ি থেকে বের না হলেও আফজাল শেখ বের করতো। ‘যেমন ছেলে তেমন মেয়ে’ বলে মনে মনে হাসলেন।

মুন বাসায় এসে এগুলোতে মাথা না দিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। ইরা সহ আসার পরে রাতে খেয়ে শুয়ে পড়ল দুইজনেই। সারাদিন এতো ক্লান্তির ফলে চোখ বন্ধ করতেই দুজনেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।

এদিকে রিফাতের চোখে ঘুম নেই। ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করে এপাশ-ওপাশ করেও চোখে ঘুম ধরা দিলো না। এই না যে- সে প্রীতির চলে যাওয়াতে কষ্ট পাচ্ছে। সে বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় বুঝতে পেরেছিল, প্রীতি তার ভালোবাসা ছিল না, ছিল শুধু মোহ। তাই সেও প্রীতির প্রতি তেমন আকর্ষণ-বোধ দেখাতো না। কয়েকদিন ধরে প্রীতির সবকাজ তার চোখে ধরা পড়েছে কিন্তু সে ততটা পাত্তা দেয় নাই, প্রীতির অনেক রাত পর্যন্ত অনলাইনে থাকা – সেটাও রিফাতের চোখ এড়াতো না কিন্তু রিফাত নিজের মতো করে থাকতো। রিফাত এপাশ-ওপাশ করে ঘুম না আসাতে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। এরপর আরেকটা বন্ধুকে কল দিল। কল দিয়ে যা শুনল তা শুনে রিফাতের পায়ের নিচ থেকে মাঠি সরে গিয়েছে মনে হয়েছে। সে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়তে লাগলো। শেষপর্যন্ত রিফাতকেই বোকা বানালো সবাই। মাঝখানে গিয়ে রিফাত ওদের গুটির পাল্লায় পড়ে মুনকে কষ্ট দিয়ে পরিবারের কাছে খারাপ হলো। রিফাত গুনাক্ষরেও তার বন্ধুর এমন কুৎসিত চাল ধরতে পারেনি। নিজেদের স্বার্থের জন্য রিফাতকে কত্ত বড়ো বোকা বানাল তারা। মাঝখান থেকে রিফাতের সবকিছু হারাতে হলো,পরিবারের এত্তো এত্তো ভালোবাসা জলে ভাসিয়ে দিলো রিফাত, মুনের বিশ্বাস ভঙ্গ, বাবা-মা’কে কষ্ট দেওয়া আর নিজের সম্পর্কে যা বিশ্বাস এতদিন মানুষের কাছ থেকে অর্জন করেছিল তা সব এক নিমিষেই সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সবকিছু মিলিয়ে রিফাতের মনে হলো এতো মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করার চাইতে মৃত্যুই শ্রেয়।
সে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে কিছু একটা লিখতে বসে পড়লো। এরপর কিছু একটা লিখে কাগজটা -টেবিলে এক সাইটে রেখে হাতে কিছু একটা নিয়ে ফ্যানে বেঁধে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। শেষবারের মতো আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আফজাল শেখের নম্বরে কল দিল কিন্তু অপরপাশ থেকে রিসিভ হলো না। রিফাত মোবাইলটা ছুড়ে মারলো। ‘ক্ষমা করে দিও বাবা, তোমার যোগ্য পুত্র হয়ে উঠতে পারলাম না,’ বলেই বিড়বিড় করে মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলো রিফাত এরপর পায়ের নিচের ছোট টুলটা পায়ে ঠেলে ফেলে দিতেই পুরো নিস্তব্ধ রাতটাতে ঝনঝন করে কিছু একটার শব্দের সাথে গোঙ্গানির শব্দে মুহূর্তের মধ্যে চারপাশটা ভারী হয়ে উঠল। কিছুসময় পর আবারো আগের মতো শান্ত হয়ে গেল রাতটা। শুধুমাত্র কোনো একটা প্রাণের অস্তিত্ব চিরতরে বিলীন হলো।
———–

সকালে নিচ থেকে প্রচুর চেঁচামেচি শুনে মুন ঘুম থেকে উঠে কাহিনী কী দেখার জন্য এলোমেলো চুলে বাইরে যেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here