ভালোবাসা
২৮তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
আমার কোন খোঁজখবর না পেয়েই খুব সম্ভবত বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগে অবশেষে অরু একদিন বাড়ি এলো। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সে ইতস্তত করছিলো ভেতরে ঢুকতে। এ ক’দিন ঘরে থেকে থেকে দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছিলো দেখে আমি তখন ছাদে গিয়েছিলাম মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে। ছাদ থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম তার অস্বস্তি। সে বোধহয় খুব বেশি অন্যমনস্ক ছিলো, তাই আমায় খেয়াল করে উঠেনি। আমি নেমে এসে নিজের ঘরে আবার শুয়ে পড়লাম।
একসময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে গিয়ে ফের দরজা খুলতেই দেখলাম অরু দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দেখে নীরবতা ভেঙে সে ই বলে উঠলো, এখন কেমন আছিস তুই?
মন চাইলো বলি, যেমনটা দেখছিস…কিন্তু তা না বলে আমি বলেই ফেললাম, ভালো।
সে ফের বললো, খাওয়াদাওয়ার কি ব্যবস্থা? রান্না করতে পারিস নাকি হোটেলে খাস?
কেন জানি অরুর ওপর খুব রাগ হচ্ছিলো আমার। তাই আমি বলে উঠলাম, সেসব নিয়ে তোকে আর ভাবতে হবে না…আমার মতো আমি চালিয়ে নিচ্ছি তাই চলে যাচ্ছে দিন।
আমার এমন অকস্মাৎ রাগান্বিত স্বরে কথা বলায় সে একটু যেন অপ্রস্তুতবোধ করলো।
আমার রাগটা কি জন্যে হচ্ছিলো কে জানে…হয়তো বা গত চারদিনে সে একবারও আমায় দেখতে আসেনি তাই কিংবা অসুস্থ অবস্থায় ফেলে চলে গেলো কি করে!!! সেসব ভেবেই হয়তো ভেতরে ভেতরে মনঃক্ষুন্ন ভাব হয়েছিলো।
ডক্টর দেখিয়েছিলিস?…জানতে চাইলো অরু।
আমি বললাম, আজাদ নিয়ে এসেছিলো সাথে করে।
আজাদ তাহলে তোর ভালোই খেয়াল রেখেছে, এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, বন্ধু তো তুই ও ছিলিস…কি খোঁজ রেখেছিস আমার বল তো?
সে মাথা নত করে যেন নিশ্চুপ হয়ে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
খানিকক্ষণ পর আমি বললাম, তুই কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি ভেতরে আসতে তোর পায়ে ধরতে হবে আমার?
সে বলে উঠলো, চল…বাহিরে কোথাও গিয়ে বসি।
আমি আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। আজ অরু নিজ থেকে যে এসেছে সেটাই অনেক বড় কিছু আমার জন্যে।
ঘরে তালা দিয়ে বের হয়ে দেখি সে তখনও সেখানটায় দাঁড়িয়ে।
গেট পেরিয়ে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই অরু বললো, হাঁটতে পারবি নাকি রিকশা ডাকবো?
আমি ঠিক আছি, চল হেঁটে যাই আরেকটু সামনে গিয়ে নাহয় বাস ধরবো।
আমরা বাসে উঠতেই দেখি অনেক ভিড় আর কোন সিট ফাঁকা নেই তাই অরু একপাশে দাঁড়িয়ে আর আমাকেও একটু দূরে আরেকপ্রান্তে দাঁড়াতে হলো।লোকের মাথা আর ঘাড়ের ফাঁক-ফোকর দিয়ে যতটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম তাতে যেন এক মূহুর্তের জন্যেও অরুকে চোখের আড়াল করতে আমার মন চাইছিলো না। বাস চলতে শুরু হয়ে কিছুদূর যেতেই আমি বুঝলাম, অরুর যেন খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। তার মুখ চোখের হাবভাব আমায় খুব একটা শান্ত থাকতে দিচ্ছিলো না। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি কোন এক ষণ্ডাগুণ্ডা টাইপ লোক বারবার নানা ছুতো আর বাসের ঝাকির বাহানায় তাকে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করছিলো। আমার যেন সহ্য হচ্ছিলো না, আর তাই তাড়াতাড়ি ভিড় ঠেলে অরুর দিকে এগুতে গিয়ে লোকের গালমন্দ ও খাচ্ছিলাম।
সেসব গায়ে না মেখে তার চিন্তায় অস্থির হয়ে আমি সেখানটায় গিয়ে আমার দুহাত অরুর দু’পাশের বাসের হ্যান্ডেলে রেখে যেন ওকে আগলে রাখতে চাইলাম বুক দিয়ে। ফের চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো, আমি যে বুঝতে পেরে তাকে বাঁচাতে চলে এসেছি সেজন্যে যেন ধন্যবাদ সূচক অভিব্যক্তি। তার টলটলে চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু বিন্দু দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, ঘুরে গিয়ে অরুকে পেছনে রেখে সেই লোকটির দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো দেখে অরু কিছু একটা বুঝে নিয়ে আমার বাহুতে ধরে আমায় থামিয়ে দিয়ে ইশারায় মাথা নেড়ে না বোধক মনোভাব বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। যেন বলতে চাইলো, বিজু না…মারপিট করিস না, তুই যে আছিস আমার জন্যে সেটাই যথেষ্ট।
বাস থেকে নেমে যাওয়ার আগেই আমি অরুর হাত ধরলাম। সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম…আমার অরু একা নয়, আমি আছি তার পাশে। অরুও যেন খুব ভয় পেয়েছিলো তাই আর আমায় বাধা দিলো না। আমার হাতটা এত শক্ত করে ধরেছিলো যে রীতিমতো আমি ব্যাথা পাচ্ছিলাম, কিন্তু তবু্ও ভালো লাগছিলো। যেন সেই পুরনো অরুকে আমি আবার একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছিলাম।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে এলাম ব্রিজ সংলগ্ন নদী তীরে। তখনও অরুর হাত আমার হাতের মুঠোয়। আমি বসে গিয়ে তার হাত টানতেই সে অতর্কিতভাবে পড়ে গেলো বালুতে, ফের আমার হাসি দেখে নিজেও হাসতে লাগলো। এতক্ষণে তার দুর্ভাবনাগুলোয় ছেদ পড়লো। তাই আমি চাইছিলাম সে যেন একটু সহজ হয় আর বাসের ইনসিডেন্টটা ভুলে থাকতে পারে।
নদী তীরে লোকের ঘাট পারাপার আর কর্মব্যস্ত দিনে সকালের কাজকর্ম দেখতে দেখতে একসময় যেন আমার সম্বিৎ ফিরলো তার কথায়…
সে বলে উঠলো, ছ’মাস আগে এসেছি আমি। এসে প্রথমে সীমাদের বাড়িতেই উঠেছিলাম। কিন্তু এভাবে আর কারো বাড়ি ক’দিন থাকা যায় বল…আর তাই কাজ খুঁজে নিতে চাইলাম। শুরু করে দিলাম জব সার্কুলার দেখে চাকরির ইন্টারভিউ দেয়া। মোটামুটি স্যালারির স্কুল টিচার হিসেবে পেয়েও যাই একটা। কিন্তু শুধু সেটুকুতে আমার হোস্টেলের খরচ উঠলেও হাতখরচ আর বাদবাকি জবের জন্য পড়াশোনার বইপত্র কেনাটা হচ্ছিলো না। আর তাই যখন টিউশন খুঁজে ফিরছিলাম তখন আমার এক টিচার নিজেই তার ক’জন ছাত্র পড়ানোর কাজটা আমায় দেয়।
এত কষ্ট করছিস কেন? এখনতো আমি আছি, আমার থেকে নিলে কি তোর পাপ হয়ে যাবে!!!
তেমন কিছু নয় রে বিজু, আমি নিজের যোগ্যতায় ভালো কিছু করে নিজের পায়ে দাড়াতে চাই।
আমি কি সেটা করতে নিষেধ করেছি? ধার হিসেবেই নাহয় নিলি, পরে ভালো জব হলে দিয়ে দিস।
তোর থেকে আর কত নেবো বল তো…আগেও তো কত কি খরচ দিতিস পড়ালেখার, এটা সেটা কেনাকাটার।
তোকে দিয়েছি বলে কি আমার কিছু কমে গিয়েছে! আরে দিতে পারলে যে ভালো লাগে আমার, সেটা কবে বুঝবি?
বুঝি বলেই তো…বলে যেন অরু কথাটা আর শেষ করতে চাইলো না।
আমি বলে উঠলাম, বুঝিস বলে ভাবছিস যে এসবের বিনিময়ে তোকে তোর কাছে জোরপূর্বক দাবি করে বসবো!!!
আমি তেমন কিছু ভাবিনি বিজু…বললো অরু।
তোকে ভালোবাসি তাই পর হয়ে গেলাম না, শুধু বন্ধু হলে নিতিস তাই তো?
এরকম নয় রে, তোর কষ্ট দেখে আমারও খুব কষ্ট হতো বিজু। আর তাই চেয়েছিলাম তুই জীবনে এগিয়ে গিয়ে সুখী হ। আমার প্রতি কোন পিছুটান থাকলে তো আর এগুতে পারবি না।
আমি এগুতে পারি বা না পারি তোর পথের কাটা যে কখনো হবো না সে ব্যাপারে তুই নিশ্চিত থাকতে পারিস, বললো বিজু।
অরু যেন প্রসঙ্গ পাল্টাতেই আনমনে বলে উঠলো, তোর দাদা আমার সাথে এমন কেন করলো বলতো?
আমি এর কোন সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে বালিতে আঁকিবুঁকি কাটতে লাগলাম।
তারপর সে একটানা বলে যেতে লাগলো, শেষ যেদিন তার সাথে বসেছিলাম কথা বলতে সেদিন কি হয়েছিলো জানিস…বলে যেন হঠাৎ করে স্মৃতিতে হারিয়ে গেলো।
অরু বললো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
মলয় নাস্তা খেতে খেতে… হুম বলে ফেলো শুনছি।
তুমি আগে খাওয়া শেষ করো তারপর নাহয় বলি, বললো অরু।
দেখো আমি খুব ব্যস্ত…যা বলার চটজলদি বলো।
মেয়েটা কে?
কোন মেয়েটা?
সেই বিদেশি মেয়েটা।
এখানে কত বিদেশি মেয়েইতো আমার স্টুডেন্ট, কার কথা জানতে চাইছো স্পেসিফিকলি বলো।
অরু যেন একটু ইতস্তত করছিলো যে কিভাবে জানতে চাইবে, আর তাই কথা গুছিয়ে বলার জন্যে সময় নিচ্ছিলো।
সেটা দেখে মলয় বললো, দেখো আমার হাতে এত সময় নেই তাই ডিরেক্ট বললে ডিরেক্ট এন্সার দিয়ে বেরুবো এখন।
তোমায় প্রায়ই কল করে যে…
কল তো কতজন কত প্রয়োজনেই করে, অরু তুমি কি সেসব নিয়ে আমায় এখন সন্দেহ করছো?
অরু যেন তার এই মিথ্যাচার আর মেনে নিতে পারছিলো না। কি শান্ত স্বরে ঠান্ডা মাথায় মলয় সব বলে যাচ্ছিলো সাজিয়ে গুছিয়ে…
যার সাথে প্রেমালাপ তোমার ক্ষণে ক্ষণে চ্যাটিং আর মেসেজেসই সাক্ষ্য দেয়…চেঁচিয়ে বলে উঠলো অরু।
মলয় যেন একটা ধাক্কা খেলো…সে চুপচাপ কিছুটা সময় বসে থেকে ফের বললো, তুমি আমার ফোন চেক করেছো!!!
হ্যাঁ করেছি…বছরের পর বছর যে ধোঁকায় আমায় রেখেছিলে তা যখন অবুঝ বয়সের ছিলাম তখন লক্ষ্য করিনি হয়তো, কিন্তু এখন তো আর তা নই তাই চোখে পড়ে গিয়েছিলো তোমার নির্লিপ্ততায়।
মলয় যেন রাগে ফেটে পড়ে বললো, কারো অনুমতি ব্যতীত তার ফোন ধরা যে ব্যাড ম্যানার্স সেটুকু জ্ঞান ও কি তোমার নেই?
জ্ঞান? আমায় চিট করা ব্যক্তির কাছ থেকে এখন জ্ঞান শিখতে বলো!!!
চিট করলে তো তোমায় ছেড়েই আসতাম। ছোট শহর থেকে এনে লন্ডনের বাড়িতে তুলতাম না। কি দেইনি তোমায় বলো তো, সাথেই তো রাখছি আর কি চাও?
বৌকে বাড়িতে এনে সাথে রাখলে, তার খাওয়াপরার খরচ দিলে বুঝি বাইরে যা খুশি তা করে বেড়ানোর লাইসেন্স পাওয়া যায়?
আমি এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছি, বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে ক্যারিয়ার গড়েছি আর একটু সুখ করতে পারবোনা!!! বলে যেন আচমকা গর্জে উঠলো মলয়।
সুখ…সেটা যে কেউ এভাবে পেতে পারে তা আমার জানা ছিলো না, আচ্ছা যখন জানলাম তখন নাহয় আমায় যেতে দাও।
কেন যেতে চাইছো বলো তো? তোমায় কি আমি কম ভালোবেসেছি!!!
আমায় ভালোবাসলে তাহলে তার সাথে যোগাযোগ রেখেছিলে কেন?
কিসব পাগলামো শুরু করলে অরু….আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর তাকেও। তুমি তোমার মতো ভালো থাকো না, আর তাকে তার জায়গায় থাকতে দাও। সে স্ত্রীর অধিকার চাইতে যে কখনোই আসবেনা, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো…অকপটে বলে ফেললো মলয়।
আমায় বলতে গিয়ে এটুকু মনে হতেই যেন অরুর চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করে উঠলো।
দাদাকে তুই এখনো খুব ভালোবাসিস না?…বলে যেন জবাবের প্রতীক্ষায় অরুর মুখের পানে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বিজয়।
#চলবে…
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।