ভালোবাসারা_ভালো_নেই,সূচনা_পর্ব – ০১

0
1532

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,সূচনা_পর্ব – ০১
#অজান্তা_অহি

গতকাল রাতে আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ এনেছে। নতুন বউ বয়সে আমার বড় আপার সমান হবে। বড়ো লজ্জার বিষয়। অথচ এই ভয়ঙ্কর লজ্জা জনক কাজ করা আমার আব্বার মুখটা হাসি হাসি। বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নেই। চেহারায় সুখী সুখী ভাব। তিনি বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে রোজকার মত আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘আইজ কি মাছ আনা যায় ক তো দোয়েল?’

আমার নাম দোয়েল না। সুন্দর একটা নাম আছে আমার। ফুলের নামের নাম। যে ফুলে গন্ধ প্রচুর। ধরতে পেরেছেন তো? হ্যাঁ। জুঁই আমার নাম। কিন্তু বাবা আদর করে দোয়েল বলে ডাকেন। শুধু আমাকে না। আমার সব বোনদেরকে তিনি ডাক নাম দিয়েছেন। সব পাখির নামে নাম। সব বোন বললাম কারণ আমার ভাই নেই!

আব্বা এখনো যাননি। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে মাছের নাম না শুনে তিনি যাবেন না। আমি শীতল সুরে বললাম,

‘নতুন মায়ের থেকে মাছের নাম শুনে আসবো? কোন মাছ তার পছন্দের?’

‘হুনবি? তাইলে তাই কর! হুনে আয়।’

আব্বার চোখে মুখে গদগদ ভাব। থাকার কথা-ই! কারণ নতুন বউ নিয়ে তিনি গতরাতে ফিরেছেন প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে। ভেবেছিলেন অনেক হইচই হবে। কান্নাকাটি হবে, নাটক হবে। তার কিছুই হয়নি। আমরা বেশ স্বাভাবিক! আব্বার বিশাল বড়ো দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। আমি বারান্দা দিয়ে ঢুকে নিজের রুমে এলাম। মাথা ঝিমঝিম করছে সকাল থেকে। অথচ আব্বার আকস্মিক কাজটি আমাকে তেমন বিস্মিত করেনি। তিনদিন আগে বাজার করার কথা বলে তিনি বের হয়েছিলেন। কাল রাতে ফিরেছেন বউ নিয়ে। যেনো এমন হওয়ার কথা ছিল। আব্বা যে বদলে গিয়েছিল তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি। বুঝতে পারেনি আমার বাকি বোনেরা। আর আমার রুগ্ন মা! তারা গতরাত থেকে শ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন। বাকরুদ্ধ সবাই! তাদের মুখে এখনো ভাষা ফুটেনি।

বেলা গড়াচ্ছে। আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের মতো বড়ো মাপের খবরটা দুপুর পর্যন্ত লুকিয়ে রাখা গেলো। সময় বাড়ার সাথে সাথে সেটা সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। তারপরের অংশ স্বাভাবিক। গ্রামের আনাচে কানাচে থেকে সবাই আমাদের বাড়ি মুখী হওয়া শুরু করলো। সামনের ছোট্ট উঠোনে তখন তুমুল ভিড়। লোকে লোকারণ্য! এক চোখে দেখতে না পাওয়া মজিদার মা থেকে শুরু করে বাদ যায়নি টুটুলের বয়স্কা দাদী। আমি বারান্দার এক কোণা থেকে সবাইকে লক্ষ্য করছিলাম। নতুন বউ উঠোনের মাঝে চেয়ারে বসে আছে। পাশের বাড়ির চাচী সবার দেখার সুবিধার্থে তাকে খোলা জায়গা বসিয়ে দিয়েছে। তাকে ভীত দেখাচ্ছে না। বড় লাজুক চেহারা। ঝলমল দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সে কি জানতো না , যে লোকটিকে সে বিয়ে করছে তার ঘরে বড় বড় চারটে কন্যা আছে? আছে রুগ্ন দেহের এক স্ত্রী?

ওড়নায় টান পড়ায় নিচের দিকে তাকালাম। পুতুল মুখে আঙ্গুল দিয়ে ডাকছে আমায়। কোলে তুলে নিলাম ওকে। আমার সবচেয়ে ছোট বোন পুতুল। বয়স আড়াই হবে। সবেমাত্র কথা বলা শিখেছে। ওকে কাছে টেনে বললাম,

‘পুতুল খিদে পেয়েছে?’

ও দুই দিকে মাথা নাড়ল। তার উত্তর হ্যাঁ নাকি না বুঝতে বেগ পেতে হলো। ওকে নিয়ে মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। পুতুল এখনো বুকের দুধ খায়। দেখি মা একটু কাছে নেয় কিনা!

মা রুম অন্ধকার করে রেখেছে। দক্ষিণের জানালাটা পর্যন্ত বন্ধ। অথচ ওই জানালা মা কোনোদিন বন্ধ করে না। ঝড় বৃষ্টির রাতেও না! ওটা বন্ধ করলে নাকি মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসে। আজ মায়ের দম বন্ধ হয়ে আসছে না? নিঃশ্বাস আটকে আসছে না? মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম। মা একা নেই। তার সাথে বড়ো আপা আর সেজো আপা বসে রয়েছে। সবার মুখ শুকনো। বড়ো আপাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘আপা, দুপুরে খাবে না?’

আপা আগের মতো নির্বিকার রইলো। আপা অন্তঃসত্ত্বা। এখন খালি পেটে থাকা পেটের বাবুর জন্য ক্ষতিকর। আপা বুঝে না যেনো! এত অবুঝ হলে হবে? সেজো আপাকে ডাক দিলাম আমি। আপাও প্রতিত্তর করলো না। সামান্য নড়লো শুধু। সেজো আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে আমাদের পাশের গ্রামের। এখন একটু সতর্ক থাকতে হবে। চেহারা সুন্দর রাখতে হবে। এত দুশ্চিন্তা করলে চলবে? বিয়ের আগের গুটিকয়েক দিন আপাকে নিজের যত্ন নিতে হবে। বিয়ের দিন যেনো তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কনে লাগে।

আমার বুকে ছোট্ট একটা ভয় দানা বেঁধেছে। আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা যদি পাত্রপক্ষের কানে যায় তারা কি বিয়েটা করবে? আমি মনে মনে দুয়া করতে থাকলাম। সেজো আপার বিয়েটা যেনো ভেঙ্গে না যায়।

________

সন্ধ্যা মিলাবে মিলাবে। আমি বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম। শুকনো পুকুর। বর্ষায় জলে ভরে উঠে। বর্ষা চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে শুকিয়ে মাটি বের হয়ে যায়। পানিশূন্য পুকুর আমার ভালো লাগে না। এবারে বর্ষা আসতে এত দেরি করছে কেনো?

সময় গড়াচ্ছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক বেড়ে চলেছে। পুকুর পাড়ে বসে থাকা অবস্থায় চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। আজ অন্ধকার এত ঘন কেন? আমার মন খারাপের তীব্রতা টের পেয়েছে বুঝি?

উঠোন থেকে পুতুলের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম। পুকুর পাড় ছাড়ার আগ মুহূর্তে পুব দিকের বাড়িটিতে তাকালাম। সারা বাড়ি জুড়ে জ্বলজ্বলে সাদা আলো জ্বলছে। আমার এপাশে এত অন্ধকার। ও বাড়িতে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটি কি টের পাচ্ছে এ অন্ধকার?

সারা বাড়ি অন্ধকারে নিমজ্জিত। বিদ্যুৎ চলে গেছে দীর্ঘক্ষণ হলো! বারান্দায় বসে কাঁদছিল পুতুল। কাছে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম। আব্বা বাজার থেকে এখনো ফেরেনি। রান্নাঘরে গিয়ে বাতি খুঁজলাম। পেয়ে গেলাম দ্রুত। দেয়াশলাই ঠুকে জ্বালিয়ে দিলাম। কিন্তু শলতে নিভু নিভু হয়ে গেলো দ্রুত। এলাকায় দু-দিন বিদ্যুৎ থাকবে না। মাইক দিয়ে ঘোষণা করে গেছে গতকাল। ঘরে চার্জার লাইট নেই, কুপিতে তেল নেই! এখন উপায়?

পুতুলকে রেখে বের হলাম আমি। মোড়ের মুন্সি কাকার দোকানটার দিকে। একহাতে ছোট্ট এক প্লাস্টিকের বোতল। আরেক হাতে ময়লাযুক্ত টাকার নোট নিয়ে। হাতে বিশ টাকা! টাকাটা আব্বা দিয়েছিল মাস খানেক আগে। স্কুলে যাওয়ার সময়। খরচ করা হয়নি।

মাথায় লম্বা করে ওড়না টেনে এগিয়ে চলেছি আমি। পরিচিত কারো নজরে না পড়ি যেনো। বিশেষ করে ওই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সামনে তো আরো নয়!

‘জুঁই!’

এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটছিলাম। দ্রুত পায়ে! আচমকা এক পুরুষ অবয়ব পথ আগলে দাঁড়ালো। কণ্ঠস্বর কানে যেতে নিঃশ্বাস আটকে এলো আমার। রাফি ভাই? এড়িয়ে চলে যেতে ফের ডাক দিল,

‘জুঁই কোথায় যাস?’

এতক্ষণে গলা উপচে কান্না পেয়ে গেলো আমার। এই একটা মানুষের সামনে পড়তে চাচ্ছিলাম না। তবুও কেনো এই মানুষটার সাথে দেখা হতে হবে? সারাদিনের জমিয়ে রাখা সমস্ত অভিমান উপরওয়ালার উপর গিয়ে জমলো। আমি ব্যথা লুকিয়ে বললাম,

‘মোড়ের দোকানে রাফি ভাই।’

‘চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। এখন দোকানে কেনো যাবি?’

রাফি ভাইয়ের কণ্ঠে চাপা রাগ আর স্পষ্ট অধিকার বোধ ফুটে উঠেছে। বিস্মিত হলাম আমি। রাফি ভাই তো এত কথা বলার মানুষ না। আমাকে দেখেও সারাজীবন না দেখার ভান করে চলে গেছে। আজ আগ বাড়িয়ে এত কিছু জিজ্ঞেস করছে কেনো? আমার মন ভালো করার জন্য? উনি কি জানতে পেরেছেন আজ আমাদের ভীষন দুঃখের দিন?

‘মোড়ের দোকানে। কেরোসিন তেল আনতে যাই।’

‘মাথা খারাপ? এত রাতে তোর যেতে হবে? বাড়িতে আর কেউ নাই?’

আমি উত্তর দিলাম না। রাফি ভাই বুঝতে পারলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘তোর আব্বা কই?’

‘বাজার থেকে ফেরেনি। মাছ কিনতে গেছে।’

রাফি ভাই অস্পষ্ট সুরে কিছু বললো। আমার বোধগম্য না হলেও বুঝতে পারলাম আব্বাকে গালি দিলো হয়তো। এবারে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘বোতল দে। আমি তেল এনে দিচ্ছি। এখানে দাঁড়িয়ে থাক।’

‘আমি পারবো। আপনার কষ্ট করতে হবে না।’

‘এক থাপ্পর খাবি। বোতল দে!’

বোতল দিতে হলো না আমাকে। রাফি ভাই হাত থেকে টেনে নিল। টেনে নেওয়ার সময় হালকা যে স্পর্শ লাগলো তাতেই আমি জমে গেলাম। কোনো রকমে বললাম,

‘টাকা টা?’

রাফি ভাই পেছন ঘুরে তাকালো। দ্বিধান্বিত কয়েক মুহূর্ত অতিক্রম হলো। পরক্ষণে বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে টাকাটা নিয়ে মোড়ের দিকে হাঁটা ধরলো। আমি পাথরের মতো সেখানে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

রাফি ভাই আমার প্রথম প্রেম। আমার প্রথম অনুভূতি। আমার প্রথম আবেগ। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু এই মানুষটার বসবাস। তাকে নিয়ে আমার শ’য়ে শ’য়ে জল্পনা কল্পনা! এই মানুষটাকে ভেবে আমার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে হয়। এই মানুষটাকে বুকে নিয়ে আমি ঘুমাতে যাই। ঘুম ভাঙতে সর্বপ্রথম এই মানুষটার কথা মনে পড়ে। অথচ রাফি ভাই তার কিচ্ছু জানে না। কিচ্ছু বোঝে না। সে আমার বড়জোর তিন কি চার বছরের বড়। কলেজে পড়ে। আমি তার কলেজের উল্টো দিকের হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ি। তাকে এক পলক দেখার জন্য কতশত পাগলামি করি। দুটো কথা বলার জন্য কতশত অপেক্ষা করি! অথচ সেই মানুষটা আজ নিজে থেকে কত কথা বললো।

রাফি ভাইয়ের বাবা-মা দুজনই শিক্ষিত। বাবা বড়ো চাকুরী করে। বাড়িতে সুবিশাল বিল্ডিং। কথাবার্তা চমৎকার। পোশাক-আশাক চমৎকার। এই গ্রামের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি তারা। তার সাথে আমাদের কিচ্ছু যায় না। তবুও এই মানুষটাকে নিয়ে রোজ রাতে আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি। তাকে নিয়ে কল্পনায় আস্ত এক সংসার সাজিয়ে বসে আছি। সেই সংসার বাস্তবে রূপ দিতে নিজেকে একটু একটু করে পরিবর্তন করছি রোজ। আব্বার নিষেধাজ্ঞা না মেনে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখছি। আরো কত কি! আমায় তো রাফি ভাইয়ের যোগ্য হতে হবে। বুকে সাহস নিয়ে তাকে একদিন বলতে হবে, ‘আপনাকে আমি আমার দেহ-মন সঁপেছি অনেক আগে। বহুদিন অপেক্ষা করেছি। এবার আমার অপেক্ষার বাগানে খিল দিন তো।’

বাড়ি থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। আব্বার জোরালো গলা শোনা যাচ্ছে। পুতুলও বিকট সুরে কান্না করছে। আর অপেক্ষা করা যায় না। রাফি ভাই এখনো ফিরছে না কেনো? রাস্তার মোড়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে উল্টো পথে দৌঁড়ে বাড়ি আসলাম।

আব্বা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কাছে যেতে কষে এক চড় বসিয়ে দিলো। ছিটকে কিছুদূর সরে এলাম। মাথা ভনভন করছে। কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখলাম। আব্বার হঠাৎ এতো রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। অথচ তাতেই লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেলো। ব্যথা সয়ে আসতে আব্বার দিকে তাকালাম। আব্বা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। কানে কিছুই ঢুকছে না আমার। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে চোখ গেলো রাস্তার বেড়ার ওদিকে। রাফি ভাই বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলেন উনি? আমি আকুল মনে বার বার বললাম,

‘চলে যান রাফি ভাই। দয়া করে এদিকে আসবেন না। আপনাকে যেনো আব্বা না দেখে। চলে যান!’

রাফি ভাই আমার মনের আকুল আবেদন শুনতে পেলো না। ঝাপসা চোখে দেখলাম সে রুদ্র মূর্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here