ভালোবাসারা_ভালো_নেই,১২,১৩

0
709

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,১২,১৩
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-১২

‘খালা কলিং বেল বাজছে। কেউ এসেছে!’

সালেহা খালার গভীর ঘুম। একবার ঘুমিয়ে পড়লে দিন দুনিয়ার খেয়াল থাকে না। তার পাশে আমি কত রাত কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। সে কিচ্ছু টের পায়নি। দিনের বেলা প্রায়ই তাকে কপাল কুঁচকে বলতে দেখা যেতো,

‘কি রে ফুল? চোখ ফোলা ক্যা? পোকায় কামড় দিছে?’

আজও ঘুম ভাঙলো না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আপনা-আপনি উঠে পড়বে। কলিং বেল আর বাজছে না। বার দুয়েক বেজে চুপ হয়ে গেছে। আমি রুম থেকে বের হলাম। ড্রয়িং রুমে আবছা আলো। সিঁড়ির নিচে জিরো বাল্ব জ্বলছে। তার আলোতে যতটুকু অন্ধকার দূর হয়! আমার চিন্তার মাঝে তৃতীয় বার কলিং বেল বাজলো। সদর দরজার পানে চেয়ে রইলাম আমি। কিন্তু অন্য সময়ের মতো দৌঁড়ে গিয়ে খুললাম না। কে না কে! যদি চোর ডাকাত হয়?

হুট করে কানে শব্দ এলো। ধুপধাপ করে পা ফেলার শব্দ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে জাবিরকে চোখে পড়লো। হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। সিঁড়ির সম্মুখে আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,

‘তুই বাইরে কেন? ঘুমাস নি?’

‘কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। এইজন্যে বের হলাম। কেউ এসেছে বোধ হয়।’

পরক্ষণে বললাম,

‘আপনি নিচে নামলেন কেন? কলিং বেলের শব্দ তো উপর তলায় যায় না।’

‘রাজ ভাইয়া অনেকবার ফোন দিয়েছে। ঘুমিয়ে ছিলাম বলে টের পাইনি। পরে হয়তো কলিং বেল বাজিয়েছে।’

‘রাজ ভাইয়া?’

চমকে উঠলাম আমি। উৎফুল্ল হয়ে বললাম,

‘তাহলে বড় মা, সামান্তা আপু, বাকি সবাইকে ডেকে দেই।’

তড়িঘড়ি করে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতে হাতে টান পড়লো। জাবির থামিয়ে দিয়ে বললো,

‘ভাইয়া বারণ করেছে। কাউকে জানাতে নিষেধ করেছে।’

আশ্চর্য! কপাল কুঁচকে এলো আমার। এসব কোন ধরনের ফাজলামো? তার জন্য বাড়ির এতগুলো মানুষ চিন্তিত। আর সে কিনা সবাইকে নিয়ে মজা করছে। ভীষণ রাগ উঠলো আমার। জাবিরের হাতের ফোন কাঁপছে। দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। দরজা খুলতে আবছা অন্ধকার সাথে নিয়ে এক ছেলে প্রবেশ করলো। মুখটা অল্প অল্প পরিচিত। ছবিতে কয়েকবার দেখেছিলাম। সামান্তা আপুর ফোনে।

জাবির উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা মৃদু আর্তনাদ করলো। ব্যথাতুর আর্তনাদ। জাবির দ্রুত ছেড়ে দিল।

‘কি হয়েছে ভাইয়া? এ অবস্থা কেন?’

রাজ ভাইয়া স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বললো,

‘ছোট্ট অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। পুরনো বন্ধুদের সাথে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। মাওয়া হাইওয়েতে। বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছি।’

‘ডাক্তারের কাছে যাওনি?’

‘ধুর! এইটুকু ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো!’

আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ব্যথা অল্প নয়। হাতে পায়ের উন্মুক্ত অংশে বেশ কয়েক জায়গা চামড়া ছেঁড়া। থুতনীর নিচে কাটা দাগ। সারা দেহে মাটি। তবুও কেমন শক্ত হয়ে রয়েছে। আমার কেন জানি মনে হলো এই ছেলের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা অসীম! আমার ভয় হতে লাগলো। যাদের ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা সীমাহীন, প্রকৃতি ঘুরেফিরে তাদেরই বেশি দুঃখ দেয়।

‘এসো ভাইয়া। বসো সোফায়।’

জাবিরের হাত ধরে কয়েক পা এগোতে থমকে গেল ছেলেটি। সটান দাঁড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণে আমায় খেয়াল করলো। কপাল কুঁচকে বললো,

‘ও কে? তোকে না বলেছি কাউকে জানাবি না!’

‘ও জুঁই!’

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। এগিয়ে গিয়ে বললাম,

‘এ বাড়িতে কাজ করি। বছর দুই হলো।’

জাবিরের অসম্পূর্ণ কথা পূর্ণ করলাম। রাজ ভাইয়া কিছু বললো না। সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। পানি এগিয়ে দিল জাবির। পানি খেয়ে সে সোফায় শুয়ে পড়লো। জাবির সরে এসে আমায় ডাক দিল।

‘জুঁই?’

‘হুঁ?’

‘খাবার কিছু থাকলে গরম করে দে তো একটু। শব্দ হয় না যেন!’

মাথা নেড়ে রান্নাঘরে গেলাম। ফ্রিজ ভর্তি খাবার। সব রাজ ভাইয়ার জন্য রান্না করা হয়েছিল। কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। আমি নিঃশব্দে সেগুলো গরম করলাম।

ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে রাজ ভাইয়া খেল। আয়েস করে। খাওয়া শেষ করে জাবিরের রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। আমাকে শাসিয়ে বললো,

‘এই পিচ্চি! আমি যে এসেছি কেউ যেন না জানে! জানলে কি হবে? চাকরি নট হয়ে যাবে।’

‘কাউকে বলবো না।’

‘ঠিক তো?’

‘হুঁ!’

নিশ্চিত হতে রাজ ভাইয়া হাঁটা ধরলো। জাবির তার পিছু পিছু। দুই জন উপরে চলে গেল। সদ্য বিদেশ ফেরত ছেলেটার মতি গতি কিছু বুঝলাম না। নিজের বাড়ি, নিজের ঘর, নিজের পরিবার। অথচ এত নাটক করার কি আছে? সামান্তা আপু একবার বলেছিল, রাজ ভাইয়া আর ফাইজান দুজন দুই মেরুর। সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। ফাইজান ভাই যেমন দায়িত্বশীল, পড়ুয়া, জ্ঞানী আর সুশীল। রাজ তেমনি একগুঁয়ে, পড়াশুনায় ফাঁকিবাজ আর উচ্ছৃংখল স্বভাবের। তার এই বিপরীত স্বভাবের জন্য সবাই তাকে আর ফাইজান ভাইকে তুলনা করতো। তার বাবা বকাঝকা করতো। সব মিলিয়ে ফাইজান ভাইয়ের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো না। দুই ভাইয়ের যোগাযোগ নেই কত বছর হলো!

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব গুছিয়ে রাখলাম। থালাবাসন ধুয়ে টেবিল আগের মত পরিষ্কার করলাম। সব সমাপ্ত করে যখন রুমে ঢুকলাম তখন চারিদিকে ফজরের আযান পড়ছে!

_________

পরদিন বাড়ির সবার ঘুম ভাঙলো দেরিতে। কাল অর্ধেক রাত জেগে থাকার দরুণ সকালের নাস্তা কেউ খেলো না। দুপুরের পর পর সবাই নিচে নামলো। আমি আর খালা ডাইনিং সাজিয়ে রেখেছিলাম। সবাই খাওয়া শুরু করলো। বড় মা আজ আরো দেরিতে নামলো। ফ্রিজ খুলতে তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘রাজের জন্য যে আলাদা করে রান্না করছিলাম সে খাবার কই?’

বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। বড় মা অল্প অল্প করে বেশ কয়েক পদ করেছিল। রাজ ভাইয়া খেতে খেতে বেশিরভাগ বাটি খালি করেছে। আমি কি জবাব দিবো এখন? বড় মায়ের স্বভাব বুঝি না আমি। এই ভালো, তো এই অন্যরকম! তার ব্যবহার আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। প্রথম দিকে খারাপ লাগতো। এখন সয়ে এসেছে।

বড় মা ডাইনিং এ এসে সালেহা খালা কে জিজ্ঞেস করল। খালা উত্তর দিতে পারলো না। সব দোষ গিয়ে পড়লো আমার উপর। সঙ্গে সঙ্গে দাদী বলে উঠলো,

‘এই মাইয়া খাবার চুরি কইরা খাওয়া শিখ্যা গেছে। কি সব্বনাশ!’

দাদীর বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু গলার তেজ বাড়ছে বৈকি কমছে না। মুহূর্তে হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। যার যার মতো চেঁচামেচি শুরু করলো। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম জাবিরের কথা বলি। বলি, রাতের বেলা জাবির খেয়েছে!

‘কি হয়েছে? এতো চেঁচামেচি কিসের? খাবার আমি খেয়েছি। রাতেরবেলা!’

সবগুলো চোখ একত্রে পেছন ঘুরল। আমিও তাকালাম। কয়েক হাত দূরে রাজ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। ছেঁড়াফাড়া জিন্স। সাথে উদ্ভট টাইপের ফতুয়া। টেলিভিশনে দেখানো মানুষদের মতো লাগছে তাকে। থুতনীর কাটা দাগ লাল হয়ে এসেছে।

‘রাজ?’

বড় মায়ের সুরে সবার ধান ভাঙলো। অনেকগুলো বছর পর সাক্ষাৎ। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বড় মা দৌঁড়ে গিয়ে রাজ ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরলেন। তার পিছু পিছু সবাই খাবার ছেড়ে চলে এলো। মুহূর্তে একের পর এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলো চারপাশ। হৈ-হুল্লোড় লেগে গেল। তার শব্দে যে দু-চারজন উপরে ছিল তারাও নেমে এলো। বড় মা কাদঁছে!

কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘কোথায় গিয়েছিলি তুই! এইভাবে সবাইকে দুশ্চিন্তায় রেখে।’

রাজ ভাইয়া তাকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হলো। ছেলেটা পাগল নয়তো? আমাকে কাল শাসিয়ে গেল যেন কাউকে না বলি। এখন দুপুর হতে না হতে নিজে হাজির! তবে ভালোই হয়েছে। আর কোনো লুকোচুরি করতে হবে না।

আমি কিছুটা পিছিয়ে এলাম। সামান্তা আপু নেই। কোন দরকারে সকালে বের হয়েছে। এসে রাজ ভাইয়া কে দেখে ভীষণ খুশি হবে। জাবির এক কোণায় বসে ফোন টিপছিল। পায়ের উপর পা তুলে। চোখে চোখ পড়তে সরে গেলাম।

_________

বড় মায়ের বাপের বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। বাড়ির সবার। আলতাফ মামার ছেলের জন্মদিন। বড়সড় অনুষ্ঠান হবে। সবাই আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। কে কি ড্রেস পরবে, কি করবে, কখন যাবে ইত্যাদি। জাবিরকে হোস্টেল থেকে আসতে বলা হলো। রাজ ভাইয়ার বাড়ি ফেরা উপলক্ষে কয়েকদিনের জন্য এসেছিল। সপ্তাহ খানেক হলো আবার হোস্টেলে ফিরে গেছে। সে এলো না। শুনলাম পরীক্ষা চলছে।

অনুষ্ঠানের আগের দিন রাতেরবেলা সামান্তা আপু আমায় তার রুমে নিয়ে গেল। বাহারি ডিজাইনের জামা কাপড় বের করলো। কোনটা তার সাথে ভালো মানাবে জানতে চাইলো। সবগুলো জামা চোখ ধাঁধানো সুন্দর। আমি বেছে বেছে ধূসর জামাটা দেখিয়ে বললাম,

‘আপু এটা বেশি সুন্দর।’

‘তাহলে এটা আমি পরবো। বাকি গুলো থেকে একটা পছন্দ করে নে তুই। কালকের জন্য!’

‘কি?’

অবাক হলাম আমি। আপু একগোছা জামা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘এগুলো পছন্দ হয় না? কোনো একটা নিয়ে নে। কাল গায়ে দিয়ে যাবি আমাদের সাথে।’

‘আমি তো যাচ্ছি না আপু।’

‘যাবি না মানে? সবাই যাবো আর তুই বাসায় থাকবি? এক চড় দিবো।’

সত্যি বলতে ও বাড়িতে যেতে আমার মন টানছে না। গেলে আলতাফ মামার সামনে পড়তে হবে। তার ব্যবহার, গা ঘেঁষা স্বভাব ভীষণ অস্বস্তিকর। এ বাড়িতে এলে সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে থাকি। আর কাল কিনা তার নিজের বাড়ি যেতে হবে। আমি কিছুতেই যাবো না।

‘জুঁই?’

নিচ থেকে কেউ নাম ধরে ডাকছে। এ বাড়ির পরিচিত নাম এটা। যখন যে খুশি ডাকে। দৌঁড়ে যেতে হয়। তার কাজ শেষ হতে না হতে আবার আরেকজন ডাকে। সামান্তা আপুর সাথে কথোপকথন অসমাপ্ত রেখে নিচে নামলাম।

ডাক দিয়েছে জাবিরের আম্মু। জুলি আন্টি। বসার ঘরে টেবিলে বসে পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন তিনি। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো। এক পলকের জন্য। তার কলমের নিব ক্রমাগত চলছে। খাতার বেশিরভাগ লাইন ঘঁষে ঘঁষে কেটে দিচ্ছে। আমি ঢোক গিললাম। না জানি কোন বেচারার খাতা! তিনি রাগান্বিত স্বরে বললেন,

‘এতো রাত হয়ে গেছে। ছাদের শুকনো কাপড় কে আনবে? আমি আনবো?’

‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।’

ছুট দিলাম ছাদের দিকে। এতো ভুলোমনা হয়ে গেছি! সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন। অথচ কাপড় তোলার কথা মনে নেই। ছাদের দরজা ভেড়ানো ছিল। ভারী পাল্লা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। রাতের বেলা খুব কম আসা হয় ছাদে। আসলেও সামান্তা আপুর সাথে। লুকিয়ে! একা নয়।

সম্পূর্ণ ছাদ ফাঁকা। দরজার ওখানে বাল্ব লাগানো। তার আলো ক্ষীণ। চারপাশটা অত্যধিক নির্জন। আবছা অন্ধকার। কেমন ভয় হতে লাগলো। ঝড়ের গতিতে এক হাতে কাপড় টেনে আরেক হাতে জড়ো করলাম। চলে আসার জন্য পা বাড়াতে কেউ ডেকে উঠলো।

‘জুঁইফুল নাকি?’

মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো। তাকিয়ে দেখি চিলেকোঠার ছাদে রাজ ভাইয়া বসে আছে। পা ঝুলিয়ে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অন্ধকার বলে আর কিছু নজরে এলো না। আমি কিছু বললাম না। হাঁটা শুরু করতে বললো,

‘শুনলাম তোমার নাকি ফাইজানের সাথে বেশ সখ্যতা। ওর মধ্যে কি এমন আছে যে সবাই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এক দেখায় শিষ্য হয়ে যায়। বলো তো! ওর সিক্রেট কি? ওর কি এমন আছে যা আমার মধ্যে নেই?’

রাজ ভাইয়ার কথা কেমন পেঁচানো। হতাশা জড়ানো। ভয় হতে লাগলো আমার। যেভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে! আমি ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘বড় মা ডাকছে। আমি যাই।’

যাই বলে আর দেরি করলাম না। পড়ি কি মরি করে ছুটে এলাম। তবে রাজ ভাইয়ার প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলল।

__________

পরদিন সকাল থেকে সাজগোজ শুরু হয়ে গেল। আমি আমার মতো কাজ করছিলাম। রাজ ভাইয়া উপর থেকে কফির হুকুম করেছে। বানিয়ে সালেহা খালাকে ডাক দিলাম। খালা এলো। কফির মগ হাতে নিয়ে বললো,

‘তুই যা ফুল। ওদের সাথে ঘুইরা আয়। ভালো লাগবো। কতগুলান দিন হইলো শুধু ঘরের মধ্যি আছস।’

খালার অভিমত সঠিক। সেই যে বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে পা রেখেছি। এর মধ্যে কয়েক মাস কেটে গেছে। আর বের হওয়া হয়নি। ঘরের মধ্যে কাজ করে গেছি। সবাই আনন্দ করে যাচ্ছে। খালা হয়তো ভাবছে আমার মন খারাপ। তা ঠিক। মন খারাপ কিছুটা! কিন্তু যাওয়া যাবে না। আমি কাজে মনোযোগ দিয়ে বললাম,

‘যাবো না খালা। সবাই গেলে বাড়িতে কে থাকবে!’

‘আমি থাকবো মাইয়া। একজন থাকলেই হইলো।’

‘তোমারে একা রেখে যাবো না।’

খালা আর জোর করলো না। মন ভার করে চলে গেল। রান্নাঘরে এলো বড় মা। উসখুস করে একবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘যাবি নাকি রে জুঁই?’

আমি না করতে তিনি যেন বড় বাঁচা বাঁচলেন। হাসি হাসি মুখে তিনি বের হতে ছুটে এলো সামান্তা আপু। একটানে আমার হাত থেকে পালং শাকের আঁটি নিয়ে নিল। শাক কাটছিলাম ফ্রিজে রাখার জন্য। সে কাটতে দিলো না। দাঁড় করিয়ে বললো,

‘এক্ষুণি রেডি হবি তুই জুঁই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে।’

দুপুরের আগে আগে সবাই বের হলো। হ্যাঁ! সাথে আমিও আছি। সামান্তা আপু ছাড়েনি। জোর জবরদস্তি করে নিয়ে এলো। জিদ করে। আমি না গেলে সে-ও নাকি যাবে না। তার এই পাগলামিতে সবাই রেগে গেলেও একজন মানুষ ভীষণ খুশি হলো। সালেহা খালা!

লোকসংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দুইটা গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ ভাইয়াকে দেখলাম আমাদের সামনের গাড়িতে উঠলো। সামান্তা আপুকে নিয়ে আমি পিছনের গাড়িতে বসলাম। সামনে দুজন বসে পড়েছে। ড্রাইভার আর ফাইজান ভাইয়ের বাবার বন্ধু লতিফ আঙ্কেল। পারিবারিক বন্ধু। এ বাড়িতে যাতায়াত অনেক তার। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন তিনি। তাকে ছাড়া কিছুই হয় না যেন! আমাদের দেখে হাসি হাসি মুখে কথা বললেন। ড্রাইভিং সিটের পেছনে বসলাম আমরা। মাঝে জাকারিয়াকে দিয়ে একপাশে আমি। আরেক পাশে সামান্তা আপু।

গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে আমার পাশের দরজা খুলে গেল। খুললো রাজ ভাইয়া। একপলক আমাকে দেখে বললো,

‘জুঁইফুল নাকি! দেখি ওদিকে চেপে যাও তো। সামনের গাড়িতে জায়গা নেই।’

আমি গলা উচুঁ করে বাহিরটা দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম রাজ ভাইয়ার বাবা! পরে বুঝলাম কেন সে সামনের গাড়ি ছেড়ে চলে এলো।

‘এখানে বসে পড়ো ভাইয়া। দারুণ মজা হবে। জুঁই এদিকে সরে আয়।’

আমি কিছু বলার আগেই ফোড়ন কাটলো সামান্তা আপু। ভারী খুশি হয়ে গেল। উৎসাহ পেয়ে রাজ ভাইয়া আর অপেক্ষা করলো না। মুহূর্তের মধ্যে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়লো।

(চলবে)
#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব – ১৩

উৎসাহ পেয়ে রাজ ভাইয়া আর অপেক্ষা করলো না। মুহূর্তের মধ্যে আমার গা ঘেঁষে বসে পড়লো। এটা কি হলো? বিমূঢ় হয়ে তাকালাম একবার। রাজ ভাইয়া পাত্তা দিল না। দরজা বন্ধ করে আয়েস করে বসলো। এদিকে কাঁচুমাচু হয়ে গেলাম আমি। ভেতরটা অস্বস্তিতে টইটুম্বুর হয়ে গেল। সামান্তা আপুর ওপাশে গিয়ে বসলে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত? এখন এতখানি পথ যাবো কি করে!

গাড়ি চলা শুরু করেছে। জাকারিয়া ধুমছে গেম খেলছে। এই পিচ্চি সিক্সে পড়ে। কিন্তু ফোনের প্রতি নেশা মারাত্মক। সামান্তা আপু কাউকে মেসেজ করছে। তার চোখে মুখে সেই লাজুক হাসি। আমি না দেখেও বুঝলাম ফাইজান ভাই। ফাইজান ভাই বাড়ি এসেছিল সাত-আট মাস আগে। তার বাবা আজাদ আঙ্কেল কোনো অফিসের কাজে কিছুদিন বাড়ি ছিল না। তখন এসেছিল। ফাইজান ভাই থাকাকালীন সেই গুটি কয়েক দিন সামান্তা আপুর খুশি ধরে না। দু-চোখ জুড়ে মুগ্ধতা শুধু। একটা নির্দিষ্ট মানুষের জন্য মুগ্ধতা। চট করে ধরে ফেলা যায়। শুধু ধরতে পারে না ফাইজান ভাই।

আমার বামপাশে রাজ ভাইয়া। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। কোনো জড়তা নেই। এইদিকে আমি উসখুস করছি শুধু। উনার বাহুতে বাহু আটকে আছে। খালি ডানদিকে চেপে যাচ্ছিলাম। আমায় ক্রমাগত নড়তে দেখে একসময় বিরক্ত হলেন তিনি। মুখ উঁচিয়ে বললেন,

‘সমস্যা কি? এতো নড়াচড়া করছো কেন? কনসেনট্রেট করতে পারছি না।’

আমি প্রতিত্তর করতে পারলাম না। তবে জলের মতো স্থির হয়ে এলাম। সামান্তা আপু এবারে তাকালো। ফোন রেখে বললো,

‘ভাইয়া কিছু বললে?’

‘বলিনি।’

রাজ ভাইয়ার উত্তরে সে বললো,

‘তুমি ফোন রাখো তো ভাইয়া। চলো গল্প করি। তোমার জার্মানির কথা বলো।কোনো বিদেশিনীকে পছন্দ করোনি? কারো প্রেমে পড়নি?

‘আরে ধুর! ওদের মধ্যে পছন্দ করার মতো কিছু নেই। প্রেম তো দূরের ব্যাপার। এই ধর বাঙ্গালী মেয়েরা। এদের ক্ষণে ক্ষণে নাক ফোলানো দেখে প্রেমে পড়া যায়, এদের অস্বস্তির সমুদ্র দেখে প্রেমে পড়া যায়, এদের নিশ্চুপতা উপলব্ধি করেও প্রেমে পড়া যায়।’

সামান্তা আপু হেসে ফেললো। বললো,

‘তোমার মতি-গতি কিছু বুঝি না। জব করবে না কোনো? বিয়ে করবে কবে?’

‘বিয়ে? তোকে বিদেয় না করে বিয়ে করবো কিভাবে?’

‘আমি সারাজীবন তোমাদের বাসাতেই থাকবো। কোথাও যাচ্ছি না!’

আপুর লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠ। আর কিছু বললো না সে। কাচের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। রাজ ভাইয়া ধরতে পারলো না তার আদরের বোনটা ফাইজান ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। জানতে পারলে ভীষণ অবাক হবে।

গাড়ি চলছে মাঝারি গতিতে। বেশিদূর এই গতি ধরে রাখতে পারলো না। জ্যামে আটকে পড়লো। ড্রাইভারের পাশে বসা লতিফ আঙ্কেল বাহিরটা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল। দেখে হতাশ সুরে বললো,

‘দুপুর টাইম এখন। এই জ্যাম সহজে ছাড়বে না।’

সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। তার দেখাদেখি সামান্তা আপুও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। গাড়ির ভেতরে এসি চলছে। ভেতরে শীত শীত। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা কত নির্বিকার। এদিকে আমার নাজেহাল অবস্থা। হয়তো আমার এসি তে থেকে অভ্যাস নেই বলে! গায়ের ওড়নাটা ভালো মতো পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

___________

বহুদিন পর রাফি ভাইয়ের সাথে দেখা। স্কুল থেকে ফেরার পথে। তাকে দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। কি যে ভালো লাগল। রাফি ভাই রাস্তার বিপরীত পাশে ছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। বললো,

‘তোর সেজো আপা কেমন আছে?’

‘ভালো আছে রাফি ভাই। আপনি কেমন আছেন?’

আমার উৎসাহী কন্ঠের বদৌলতে রাফি ভাই শান্ত, স্নিগ্ধ সুরে বললো,

‘ভালো আছি।’

বলে সে অপেক্ষা করলো না। হাঁটা ধরলো। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। হুট করে পেছন ঘুরে তাকালো। চোখের পলকে কাছে এসে কিছু একটা বললো। আমার বোধগম্য হলো না। বার বার জিজ্ঞেস করলাম আমি। সে আর উত্তর দিল না। হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন।

ধপ করে চোখ খুললাম। ঘুম উধাও হতে বুঝলাম যে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। কি যে মন খারাপ হয়ে গেল! দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে আমার বামপাশের ব্যক্তি নড়েচড়ে উঠলো। চমকে গেলাম আমি। ছিটেফোঁটা ঘুম যা ছিল ছুটে গেলো মুহূর্তে। বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার মাথাটা রাজ ভাইয়ার কাঁধে রাখা। এক লাফে সোজা হয়ে বসলাম। সরলরেখার মতো সোজা! ভয়ে ভয়ে সমস্ত গাড়িতে নজর বুলালাম। কেউ দেখে ফেলেনি তো? না! কেউ দেখেনি। লতিফ আঙ্কেল, সামান্তা আপু এখনো ঘুমায়। জাকারিয়াও ঘুমিয়ে পড়েছে। তার সম্পূর্ণ ভর আমার কাঁধের উপর। আড়চোখে রাজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। অবশেষে চিন্তার ঝড় একটু থামলো। যাক, রাজ ভাইয়া এই দুঃসাহস খেয়াল করেনি। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে সহজ হয়ে এলাম। হঠাৎ কানে ভেসে এলো অত্যন্ত ক্ষীণ এক সুর।

‘এতদিন আমি মেয়েদের বুকে ঘুমিয়েছি। আজ প্রথম উল্টো হলো। উঠলে কেন জুঁইফুল? কাঁধে মাথা রাখো, বুকে ঘুমাও। ভালোই তো লাগছে।’

কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। আস্তে আস্তে শরীর জমে এলো। নিজের অসাবধানতার জন্য নিজের উপর প্রচন্ড রাগ উঠলো। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হলো।
________

গাড়ি এসে থামলো ঝলমলে এলাকায়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কমিউনিটি সেন্টারে। রাজকীয় ভাবে সেন্টার সাজানো হয়েছে। হরেক রঙ লাইট, ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আমি। আগে কত কিছু জানতাম না। এই শহর মানুষ চিনিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই শহরে কত রঙ্গিন জিনিস দেখলাম।

সামান্তা আপুর সাথে সাথে ভেতরে ঢুকলাম। রাজ ভাইয়া, জাকারিয়া ভেতরে ঢুকে আলাদা হয়ে পড়লো। বিশাল বড় হলরুম। ভেতরে প্রচুর মানুষ। মেয়েগুলো এতো সুন্দর সুন্দর জামা পড়েছে! জীবন্ত পুতুল মনে হচ্ছে সবাইকে। আমি মুগ্ধ হয়ে সব দেখতে লাগলাম। সামান্তা আপু দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ। কাকে যেন দেখে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। খানিক বাদে আপু আমায় বললো,

‘জুঁই, ও তনুকা। আমার বেস্টফ্রেন্ড। তোকে ওর কথা কত বলেছি।’

আমি সালাম দিলাম। তনুকা আপুর নাম অনেক শুনেছি। ছবিতে একবার দেখেছি। তার সাথে সামান্তা আপুর বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন। দুজন এখন একই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তনুকা আপু কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। সাথে সামান্তা আপুও। আমি এক কোণায় চেয়ারে বসে রইলাম। সামান্তা আপু ফলের জুস আরো কি সব খাবার দিয়ে গেছে। জুস খেতে খেতে আমি চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছিলাম। দক্ষিণ দিকে বড় স্টেজ সাজানো। বেলুন দিয়ে ভর্তি। সেখানে বছর দশেকের এক ছেলে বসে। আমি আন্দাজ করলাম এটা আলতাফ মামার ছেলে। মামাকে কোথাও দেখছি না। একটু স্বস্তি পেলাম। হলরুমে গান বাজছে। সুমধুর! ভাষা অজানা আমার। তবে সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পাশে চেয়ার টানার শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি রাজ ভাইয়া এসে বসে পড়েছে। ভয়ানক বিরক্ত হলাম আমি। কিন্তু আমার এই লুকোনো বিরক্তি তাকে স্পর্শ করলো না। সে আমার সামনের টেবিলে থাকা অর্ধ গ্লাস জুস কাছে টেনে নিল। তাতে মুখ দিয়ে বললো,

‘কেমন লাগছে? বোর হচ্ছো না?’

‘হচ্ছি না। ভালো লাগছে।’

ক্ষীণ স্বরে বলে চুপ হয়ে গেলাম। বড় মা রাজ ভাইয়াকে আমার পাশে দেখলে রেগে যাবে। এ বাড়ির ছেলেগুলো আমার পিছু লাগে কেন? একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না! প্রচন্ড রাগ হলো। রাজ ভাইয়া তাড়া দিল।

‘কথা বলছো না কেন?’

আমি তবুও চুপ রইলাম। এবারে বললো,

‘আমি কি এতই তুচ্ছ যে কথা বলা যাবে না? আচ্ছা এক কাজ করো। তোমার প্রিয় ব্যক্তি নিয়ে কথা বলি। ফাইজানের ব্যাপারে বলো।’

আর সহ্য করা যাচ্ছে না। বাড়ির কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উঠে দাঁড়াতে রাজ ভাইয়া হাত চেপে ধরলো। কান্না পেয়ে গেলো আমার। মোচড়ামুচড়ি করতে সে একটানে পূর্বের জায়গা বসিয়ে দিলো। সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো,

‘আমি দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকতে পারি না বুঝেছ। এখানে কথা বলার মানুষ পাচ্ছি না। সেজন্য তোমায় জোর করছি।’

বরাবরের মতো আমার নিরুত্তর তার উৎসাহ কমাতে পারলো না। সে ফলের জুসে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,

‘আচ্ছা তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?’

‘কোনো লক্ষ্য নেই।’

‘ভেরি গুড। লক্ষ্য ছাড়া জীবন সবচেয়ে সুখের। যখন যা ঘটবে মেনে নিবে। ব্যস! লাইফ বিন্দাস! এরচেয়ে শান্তির জীবন নেই। লক্ষ্য থাকা মানে তুমি অস্থির ইলেকট্রন। যতদিন না তোমার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে ততদিন তোমার মনে শান্তি নেই। তুমি স্থির হতে পারবে না।’

‘আপনার জীবনের লক্ষ্য কি?’

প্রশ্নটা করেই ফেললাম। রাজ ভাইয়া কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলো। তারপর বললো,

‘নির্দিষ্ট একজন কে অসুখী করা। আমার কাছের একজন, আপন একজন মানুষকে অসুখী করা। মানুষটা বড় পাপ করেছে বুঝলে! কিন্তু তারপরও দিব্যি সুখে রয়েছে। এটা একদম সহ্য হচ্ছে না আমার।’

রাজ ভাইয়ার চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। চেহারা জুড়ে তীব্র ঘৃণা। ভীত হয়ে গেলাম আমি। কাকে অসুখী দেখতে চায় সে? কার প্রতি এতো ঘৃণা জমিয়ে রেখেছে?

আমাকে উঠতে হলো না। রাজ ভাইয়া নিজে উঠে চলে গেল। হঠাৎ করে আলতাফ মামাকে চোখে পড়লো। গেস্টদের অ্যাপায়নে ব্যস্ত তিনি। এতো এতো নামী-দামী মানুষের ভিড়ে আমাকে চোখে পড়ার কথা না। তবুও নিজেকে যথা সম্ভব লুকিয়ে রাখলাম।

টেবিল জুড়ে সুস্বাদু খাবার। সবাই নিজের ইচ্ছে মতো খাচ্ছে। সন্ধ্যার পর নাকি কেক কাটা হবে। আলতাফ মামার বউকে দেখলাম। খুবই সুন্দর! সদ্য ভার্সিটিতে পড়ুয়া তরুণীদের মতো লাগে। অথচ দুই বাচ্চা তার। আমার ভাবনার মাঝে কোথা থেকে যেন বড় মা এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

‘খেয়েছিস জুঁই?’

‘হ্যাঁ! খেয়েছি।’

‘বসে থাক তাহলে। হারিয়ে যাবি। কোথাও যাস না!’

‘ঠিক আছে।’

বড় মা চলে গেলেন। আমি সামান্তা আপুকে খুঁজলাম। আপু কোথাও হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। হুট করে আমার বড্ড একা লাগতে লাগলো। বিষণ্ণ একা! মনে হলো এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। সত্যি নেই!

__________

চারিদিকে গান বাজছে। গানের তালে তালে কেউ কেউ নাচছে। আমার মাথা ধরে গেছে। সেই যে কেক কাটার পর গান শুরু হয়েছে। এখনো থামছে না। নিজের সিদ্ধান্তের উপর রাগ হলো। আফসোস হলো। কেন যে আসতে গেলাম। এসব আমার জায়গা না। একদম না! বাড়ি যাওয়ার জন্য মন উতলা হয়ে উঠলো।

ওয়াশরুমে যেতে হবে একটু। কিন্তু একা যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। সামান্তা আপুকে দ্বিতীয় বার খুঁজলাম। ব্যর্থ হলাম। এতো বিশাল হলরুমে কোথাও খুঁজে পেলাম না। হুট করে রাজ ভাইয়া এসে কাছাকাছি দাঁড়ালো। বললো,

‘কিছু লাগবে? কাউকে খুঁজছো?’

‘সামান্তা আপু। আপুকে একটু দরকার ছিল।’

‘ও ব্যস্ত আছে। আমায় বলো।’

আমি চুপ হয়ে গেলাম। মাথা নেড়ে বুঝালাম কোনো দরকার নেই। হঠাৎ করে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘ওয়াশরুমে যাবে? এসো আমার সাথে।’

কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলাম। একসময় তার পিছু পিছু গেলাম। বেশিদূর গেল না সে। দূরে দাঁড়িয়ে বললো,

‘আমি এখানে আছি। যাও, ভয় নেই।’

তার ভয় নেই শব্দটা শুনে বিশেষ ভালো লাগলো। মনের বিষণ্ণ ভাব অনেকটা কমে গেলো। হাতমুখ ধুতে মিনিট কয়েক সময় লেগে গেলো। ওয়াশরুম হতে বের হয়ে দেখি রাজ ভাইয়া নেই। যেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটা খালি। আশপাশে এক নজর দেখে চলে গেলাম।

সেন্টারে এসে কিছুটা হালকা হলাম। গান বন্ধ হয়েছে। এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সামান্তা আপু ছুটে এলো। চিন্তিত মুখে বললো,

‘তোকে কখন থেকে খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’

‘ওয়াশরুমে গেছিলাম একটু। বাড়ি যাবেন না আপু? রাত বেড়ে যাচ্ছে যে!’

‘হ্যাঁ যাবো। বড় আম্মু বোধ হয় থাকবে। রাজ ভাইয়া কে দেখেছিস?’

‘এদিকে ছিল। কিছুক্ষণ আগে দেখেছিলাম।’

‘জাবির ফোন দিয়েছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করলো।’

‘ওহ্!’

‘ওদিকে চল। তোকে একটা জিনিস দেখাবো। একটা ছেলে অনেকক্ষণ হলো ফলো করছে আমাকে। কিন্তু কিছু বলছে না। চিনি না ছেলেটাকে। আয় তোকে দেখাই।’

আমার অনিচ্ছা সত্বেও টেনে নিয়ে চললো সামান্তা আপু। ছেলে অবধি পৌঁছাতে পারলো না। তার আগে সেন্টার থেকে এক নারী কন্ঠের চিৎকার ভেসে এলো। থমকে গেল সমস্ত হলরুম। মানুষজন একে অপরের মুখপানে তাকালো। প্রায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক মেয়ে অগোছালো ভাবে দৌঁড়ে ওয়াশরুমের দিক থেকে বের হলো। কাছে আসতে দেখি তনুকা আপু। চমকে গেলাম আমি। সামান্তা আপু দৌঁড়ে গিয়ে তনুকা আপুকে জড়িয়ে ধরলো। জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে রে তনুকা? এমন করছিস কেন?’

তনুকা আপুর পেছন পেছন ওয়াশরুম থেকে বের হলো রাজ ভাইয়া। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন ততক্ষনে জড়ো হয়েছে। সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কি জানার আগ্রহ সবার। তনুকা আপুর বাবা-মা সম্মুখে এলেন। মেয়েকে কাছে টেনে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

‘কি হয়েছে? বল মা?’

রাজ ভাইয়ার বাবা আজাদ আঙ্কেলও চলে এলেন। সান্ত্বনা দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে? কিছু দেখে ভয় পেয়েছ মা?’

তনুকা আপু মুখ খুলল। চোখ মুখ মুছে রাজ ভাইয়ার দিকে আঙুল তুলল। বললো,

‘ওই ছেলেটা আমার সাথে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করেছে।’

হলরুমে ছোট খাটো বাজ পরে গেল যেন। সবাই আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকালো রাজ ভাইয়ার দিকে। আমিও বিমূর্ত হয়ে চেয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়া বরাবরের মতো নির্বিকার। পূর্বের জায়গা দাঁড়িয়ে ঘন ঘন মাথার চুলে আঙ্গুল বুলাচ্ছে। যেন কিচ্ছু হয়নি।

হুট করে কয়েকজন তরুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মুখ দিয়ে বিশ্রী কিছু বলে তেড়ে গেল। রাজ ভাইয়া অবধি পৌঁছাতে পারলো না। তার আগে কয়েকজন থামিয়ে দিল। একজন বললো,

‘ও আজাদ আঙ্কেলের ছেলে।’

রাজ ভাইয়া দীর্ঘদিন হলো বিদেশে বলে অনেকে তাকে চিনে না। তনুকা আপুও হয়তো চিনে না। এসব কিছুর মধ্যে আমি আজাদ আঙ্কেলের দিকে তাকালাম। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার। কপালের রগ ফুটে উঠেছে। এতো সম্মান, পরিচিতি তার। ছেলের সামনে গিয়ে দাঁত চেপে বললেন,

‘এসব কি শুনছি? মেয়েটা কী বলছে এসব?’

রাজ ভাইয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। বেশিক্ষণ সে হাসি ধরে রাখতে পারল না। ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দিলো আঙ্কেল। দ্বিতীয় বার হাত উঠানোর আগে রাজ ভাইয়া কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তবে দাঁড়ালো না। শিস বাজাতে বাজাতে বের হয়ে গেল।

পুরো সেন্টার জুড়ে গুঞ্জন। রাজ ভাইয়ার নাম ধামাচাপা পড়ে আজাদ আঙ্কেলের নাম মুখে মুখে উচ্চারিত হলো। আঙ্কেল লজ্জা আর রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। এক সময় তনুকা আপুর কাছে গেলেন। তার বাবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলেন। বললেন,

‘খুবই দুঃখিত। ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে। ছোটবেলা থেকে বিদেশে বড় হয়েছে। ক্ষমা করবেন ভাই সাহেব।’

অনুষ্ঠান আর জমলো না। ছোট্ট একটা ঘটনা সুর কেটে দিয়ে গেছে। আঙ্কেল আর এক মুহুর্ত দেরি করলেন না। সবাইকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা করলেন। ফেরার পথে কারো মুখে রা নেই। বড় মা এখনো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। তার অতি আদরের সন্তান এমন জঘন্য কাজ করবে মেনে নিতে পারছে না। আমিও মেনে নিতে পারছি না। একটা মানুষের কতটা অধঃপতন হলে এমন কাজ করে?

________

সেদিন রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেল আমার। কান্নাকাটির শব্দে। সালেহা খালাকে জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিলাম। খালা হুড়মুড় করে উঠলো।

‘কি হইছে রে? ডাকাত পড়ছেনি?’

‘খালা কে যেনো কান্না করছে। দ্রুত বাইরে বের হও।’

খালা বাইরে বের হলো। তার পেছনে পেছনে আমি। বের হতে ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। বড় মা সিঁড়ির কাছে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। সবাই উঠে এসেছে। খালা গিয়ে বড় মাকে আগলে নিল। ধরাধরি করে তাকে সোফায় বসিয়ে দিলাম। দৌঁড়ে গিয়ে পানি আনলাম। জুলি আন্টি, সামান্তা আপু সবাই নিচে নেমেছে। আজাদ আঙ্কেল বিচলিত হয়ে ফোনে কথা বলছে। পর পর কয়েকজনের সাথে। সামান্তা আপুর আব্বু নামলো একটু পর। ঘুম ঘুম চোখে আঙ্কেলের পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে ভাই?’

‘রাজকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। থানা থেকে ফোন দিয়েছিল।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here