#ভালোবাসারা_ভালো_নেই,২৪,২৫
#অজান্তা_অহি
#পর্ব__২৪
তৃতীয় বার কবুল বলার সময় প্রথম কানে আসলো যাকে স্বামী বলে স্বীকার করে নিলাম সে সোহরাব নামের কেউ। অবশেষে সবাই খুশি হলো। বয়স্ক কাজীর সুরে সুর মিলিয়ে কয়েকজন আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করলো। তারা বের হয়ে যেতে জুলি আন্টি নড়েচড়ে উঠল। এতক্ষণ আমায় আটকে রাখা তার হাতটা ঢিলে হয়ে এলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। যেন বড়ো কোনো ঝামেলা ঘাড় থেকে নামলো। বড় মাকে কি যেন বলে বের হয়ে গেল সে।
বিয়ের কাগজ পত্রের কী ব্যবস্থা করলো জানলাম না। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘর খালি হয়ে গেল। সম্পূর্ণ ফাঁকা! আমি ঝাপসা চোখে এদিক সেদিক তাকালাম। বার বার সেজো আপার কথা মনে পড়ছে। আপা নিশ্চয়ই দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। আমার দুঃখ দেখে! আমার চেঁচিয়ে তাদের ডাকতে ইচ্ছে হলো। সে রাতে কেন মরণ হলো না আমার? তাহলে তো এই দুঃখের সাগরে জীবন তরী আটকে যেতো না। নিজের অনিচ্ছ্বায় কবুল বলতে হতো না! আমার পড়াশুনা না জানা মা তবুও বিয়ের সময় সেজো আপার মতামত জিজ্ঞেস করেছিল। বড় আপার বিয়ের সময় আপা রাজি কি না জানতে চেয়েছিল। অথচ এতো এতো শিক্ষিত মানুষজন একটি বারের জন্য আমার মতামতের প্রয়োজন অনুভব করলো না। আমার জীবন এমন হলো কেন?
ডাইনিং এ খানাপিনা চলছে। আমার ঝাপসা চোখ জোড়া রুমের দেয়ালে আটকা রইলো। দেয়ালের একপাশে ছোটখাটো একটা জানালা আছে। দেড়-দুই হাত লম্বা জানালা। তা দিয়ে বাহিরের আলো তেমন প্রবেশ করে না। তবুও আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা। প্রায় রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। উদাস দৃষ্টি ঘুরপাক খেতো বাহিরের অন্ধকারে! পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। আমার কতশত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী এই জানালা।
সেই জানালার ওপাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে কুকুরের ডাক! প্রায়ই ওপাশে একটা একটা নেড়ি কুকুর দেখতাম। আজ কী ওর মন খারাপের দিন? কেমন আকুল হয়ে ডাকছে। বিষণ্ণ সে কণ্ঠ থেকে দুঃখ ঝরছে। মনে হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে কাদঁছে। চারিদিক নিঃস্তব্ধ! সেই নিঃস্তব্ধতার পর্দা চিঁড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। খালা দরজার বাহির থেকে ছুটে এলো। এসে বুকে আগলে নিল। তাকে জড়িয়ে আমি মরা কান্না কাঁদলাম। আমার স্বপ্ন মরে গেছে! ভালোবাসা মরে গেছে। এতগুলো বছরের সাজানো সংসার মরে গেছে! আমি বাঁচবো কী নিয়ে!
তখন সন্ধ্যা হয়নি। কয়েকজন মিলে আমার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল। এতটুকু স্মৃতিচিহ্ন রাখলো না। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। বড় মা একসময় বললেন,
‘ওরা বের হয়ে পড়েছে জুঁই। চল!’
বড় মায়ের ভেজা গলা। আমি প্রতিত্তরে কিছু বললাম না। আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম। তাদের পিছু পিছু এসে বড়সড় এক মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। সালেহা খালা কাছে এলো না। আমি টের পেলাম দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে সে। আমি মনে মনে তার থেকে বিদায় নিলাম। খুব করে বুঝতে পারলাম এ বাড়িতে আমার আর ফেরা হবে না। কোনোদিনই না!
গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তে বাড়িটার দিকে তাকালাম। কতশত স্মৃতি এই বাড়িতে জমা রয়ে গেল। এরা কী মনে রাখবে আমায়? এ বাড়ির ইট পাথর কখনো কী স্মরণ করবে? আমার কথা ভেবে দুঃখ পাবে? পাবে না! বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া পৃথিবীতে কেউ কাউকে চিরদিন স্মরণ রাখতে পারে না। দিনশেষে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাছে সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। এ বাড়ির সমস্ত স্মৃতি পায়ে পিষে রেখে এগিয়ে চললাম। শুধু ছাদের এক কোণে পড়ে রইলো মৃতপ্রায় জুঁই ফুলের চারাটা। গাছটাতে কেউ এখন পানি দিবে?
শেষ বেলায় মঈন চাচার কথা মনে পড়লো। চাচা সামান্তা আপুর বৌভাতের অনুষ্ঠানে গেছে। গাড়ি নিয়ে। সে জানলো না এপাশে কি হয়ে গেল।
গাড়ি চলা শুরু করেছে। মাইক্রোবাসের পেছনে ছয়জনের বসার মতো জায়গা। আমি বাদে আরো তিনজন বসেছে। জায়গা অনেক ফাঁকা রয়েছে। জানালা ঘেঁষে বসা আমি। আমার বামপাশে বসেছে সেই মধ্য বয়স্কা মহিলা। রান্নাঘর থেকে যাকে দেখেছিলাম। আমি তখনো নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি। তিনি হাত চেপে ধরে বললেন,
‘কান্না করে না মা! কী নাম তোমার?’
আমি রুদ্ধ গলায় জবাব দিলাম,
‘জুঁই!’
‘বাহ! সুন্দর নাম। যাদের ফুলের নামে নাম হয় তারা মানুষও ফুলের মতো নরম হয়। পবিত্র আর সুন্দর হয়। এইটা কিন্তু কথার কথা না! একশো ভাগ সত্যি কথা।’
পরক্ষণে তিনি বললেন,
‘ওহ্ হো। আমার পরিচয় বলা হয় নাই। আমি সোহরাবের ফুপি। একমাত্র ফুপি। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জের উত্তর দিকের এক স্কুলে শিক্ষকতা করি।”
ফুপি থামলেন। আমাকে উৎসাহহীন দেখে চুপ হয়ে গেলেন। খানিক বাদে আমায় রেখে নিজেদের মধ্যে কথার আদান প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি বিমূঢ় হয়ে বাইরে তাকালাম। কাচের ওপাশে একটা সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি চলছে। অস্তগামী সূর্য কমলা রঙের হয়ে গেছে। এই ভরা সন্ধায় এরা কোথায় নিয়ে চলেছে আমায়? এই বিধিলিপিতে আর কী কী লেখা আছে?
________
কতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম হিসাবে নেই। গাড়ি যখন থামলো ততক্ষনে চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। অন্ধকারের গভীরত্ব দেখে বুঝতে পারলাম রাত ঢের হয়েছে। সদ্য নতুন পরিচয় পাওয়া ফুপি পাশ থেকে উঠে পড়লেন। আগে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। আমার দরজার এপাশে এসে খুলে দিলেন। বললেন,
‘গাড়ি থেকে নামো তাইলে।’
আমি নামলাম। তিনি হাত ধরে এগিয়ে চললেন। পেছন ঘুরে একবার বললেন,
‘সোহরাব ব্যাগ গুলো উপরে নিয়ে আয়।’
তখনো আমি সোহরাব নামের মানুষটিকে দেখিনি। ফুপুর সাথে গেট অবধি পৌঁছাতে একটা মেয়ে ছুটে এলো। আধুনিক বেশভূষা। অন্ধকারে বয়স ঠাওর করতে পারলাম না। সে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
‘আমি নাহার। সোহরাবের বড় বোন।’
আমি ধরা গলায় তাকে সালাম দিলাম। সে কাছে টেনে নিল। বলল,
‘ভেতরে চলো। রুমে গিয়ে কথা হবে। ফুপি চলো তো!’
লম্বা মতন এক ছেলে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। এসে ঝরঝরে সুরে বলল,
‘আপা। উপরে চলো। গেটের সামনে এভাবে কেউ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে? আশপাশের বাসা থেকে সবাই উঁকি দিচ্ছে। ভেতরে গিয়ে কথা বলো।’
বলে সে আমাদের আগে আগে গেল। আমি পেছন থেকে এক নজর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তাহলে এই ছেলেটির সাথে আমার বাকি জীবনটা কাটাতে হবে? এমন অচেনা, অজানা একজনের সাথে পথ চলতে হবে? কেমন হবে এ চলা?
ছোট্ট একরুমে বসে আছি। জায়গা কম হলেও গুছিয়ে রাখা। বিছানা পত্র চকচকে। রুমের সাজসজ্জা না থাকলেও প্রয়োজনীয় সব জিনিস দেখা যাচ্ছে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম সব। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কাল এই সময়ে সামান্তা আপুর সাথে ছিলাম। আপু একটু পর পর কান্না করছিল। তার চোখের জল সযত্নে মুছে দিচ্ছিলাম। এখন আমার চোখের জল মুছে দেওয়ার কেউ নেই। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জীবনে কতবড় ঘটনা ঘটে গেল। বিয়ে করে নিয়েছি আমি! কারো বউ এখন আমি। স্মরণ হতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।
নাহার আপু রুমে এলো। বড় হাসিখুশি চেহারা। এবারে সে একা নয়। তার সাথে বাচ্চা এক মেয়ে। মেয়েটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আশা তোমার মামী। নতুন মামী এটা!’
ভদ্রতা সুলভ মেয়েটাকে কাছে টানলাম। কাছে এলো না সে। হাত থেকে ছুটে দূরে সরে গেল। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। তার বড়বড় চোখ দুটো অবাক হয়ে আমায় দেখছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার পুতুলের কথা মনে পড়ে গেল।
‘জুঁই। খিদে পায়নি? চলো ভাত খাবে।’
আমি মাথা নাড়লাম। ভাত গলা দিয়ে নামবে না। ক্ষুধা লেগেছে কি না তার অনুভব শক্তি নেই। নাহার আপু জোর করলো। বলল,
‘চলো কয়েক লোকমা খাবে। আশা তোমার মামীকে ডাকো তো। বলো, চলো মামী। ভাত খাই!’
আশার মধ্যে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আগের মত বড়বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। বিস্ময় নিয়ে দেখছে নতুন অতিথিকে। নাহার আপু হঠাৎ দুঃখ নিয়ে বলল,
‘আশার আব্বু অসুস্থ। অ্যাকসিডেন্ট করে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। মাথায় চোট পেয়েছে। পাঁচটা স্টিচ দিতে হয়েছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। তাকে এই অবস্থায় রেখে তোমাদের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলাম না। তবুও গতকাল সাথে থেকে কিছু শপিং করেছি।’
খটকা লাগলো আমার। গতকাল বিয়ের বাজার-ঘাট করে রেখেছে? তার মানে সবটা পরিকল্পিত। আজাদ আঙ্কেল হয়তো সোহরাবকে আমার ব্যাপারে অনেক আগে থেকে বলে রেখেছে। মনঃক্ষুণ্ণ হলো আমার। দৃষ্টি নত করে রইলাম।
‘চলো ভাত খাবে।’
‘আমি কিছু খাবো না আপা।’
ভেজা গলায় উত্তর দিলাম। নাহার আপা টেনে দাঁড় করাল। বলল,
‘আচ্ছা না খেলে। জোর করছি না। চলো, আশার আব্বুর সাথে দেখা করে আসো।’
তার সাথে যেতে হলো আমায়। কয়েক হাত ড্রয়িং রুম। সেখানে সোফায় ফুপি বসে ছিল। বিশ্রাম করছে। আমি আপার পিছু পিছু বড় ঘরটাতে ঢুকলাম। ক্ষীণ সুরে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর এলো সঙ্গে সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি একের পর এক প্রশ্ন করলো। আমি দম বন্ধ রেখে তার কৌতূহল মেটালাম। একসময় সে প্রশ্ন পর্বে বিরতি নিল। আমায় ফুপি রুমে নিয়ে এলো। তার থেকে যতটুকু শুনলাম তাতে বুঝলাম আমি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আছি। তিন রুমের এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া করা। সোহরাব অনেক আগে থেকে তার বড় বোনের সাথে থাকে। বিয়ে করে বউ নিয়ে সেই বোনের ফ্ল্যাটেই উঠেছে!
বিছানার পায়ের কাছে জানালা আছে। একপাশের কাচ সরানো। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। তিন তলার উপর থেকে রাতের শহর দেখা যাচ্ছে। সেই শহরের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। এমন একটা শহরে রাফি ভাইয়ের সাথে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। তা আর হলো কই! এ শহর বড্ড বেঈমান। এ পৃথিবী বেঈমান। ঝাপসা দৃষ্টিতে দুঃখ ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সফল হলাম না।
রুমে আমি ব্যতিত আর কেউ নেই। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগ গুলো এনে মেঝেতে রাখা হয়েছিল। ছোট ব্যাগটা হাতড়ে ফোন খুঁজলাম। পেয়ে গেলাম দ্রুত। অনেক রাত হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ও বাড়িতে সবার জানার কথা। কেউ ফোন দেয়নি? খোঁজ নেয়নি আমার? অন্তত মঈন চাচার খোঁজ নেওয়ার কথা। চাচা আজাদ আঙ্কেলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না। চাকরি চলে যাবে। মাস শেষে যে মোটা অংকের মাইনে পায় সেটা আর থাকবে না। তবে কিছু না বললেও মনে মনে খুবই দুঃখ পাবে।
ফোন বন্ধ ছিল। কে কখন বন্ধ করেছে খেয়ালে নেই। পাওয়ার বাটন চেপে ধরে চালু করলাম। কল লিস্ট গিয়ে কল করতে থমকে যেতে হলো। সিম কানেক্টেড হচ্ছে না। হয়তো সিম ঢিলে হয়ে গেছে। ফাইজান ভাই তখন ফোন তুলছিল না বলে ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। তখন হয়তো ঢিলে হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ব্যাটারি খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ফোনে সিম নেই। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। নিশ্চয়ই কেউ একজন ফোনের সিম খুলে নষ্ট করে ফেলেছেন। যাতে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারি! চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জল গড়িয়ে পড়লো। হাঁটু ভাঁজ করে মাথা রাখলাম। ও বাড়ির সাথে তাহলে আমার সব সম্পর্ক শেষ। সত্যি সত্যি শেষ!
‘ওভাবে মেঝেতে বসে আছেন কেন?’
পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো। উষ্মদায়ক সুর! ভেতরের শীতলতা খানিক হ্রাস পেল। হাঁটু থেকে মাথা তুললাম আমি। সামান্য ঘাড় ঘুরাতে পুরুষ অবয়ব ভেসে উঠলো। বাল্বের পরিপূর্ণ সাদা আলোয় অবশেষে মানুষটাকে দেখলাম। কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলেও আমি বুঝতে পারলাম ইনি সেই সোহরাব। স্কুলে একবার ম্যাডাম সোহরাব-রুস্তমের গল্প শুনিয়েছিল। শাহনামা! মহাবীর রোস্তমের সাহসী পুত্র সোহরাব। যে কি না বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল। একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। মনে অহেতুক প্রশ্ন জাগলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই সোহরাব কতটা সাহসী? সে কি আমায় ভালো রাখার যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে?
‘বিছানায় গিয়ে বসুন। ঠান্ডা লেগে যাবে।’
দ্বিতীয় বার উষ্মতা ছড়িয়ে বলে উঠলো সে। আমি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কোনো প্রতিত্তর না করলেও তার অবাধ্য হলাম না। মেঝে ছেড়ে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলাম। বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। এমন অপরিচিত একজনের সাথে কী করে ঘর করবো!
তখনো নিঃশব্দে কাঁদছিলাম আমি। ভেজা গাল শুষ্ক হওয়ার ফুরসত পাচ্ছে না। তার আগেই আবার ভিজে উঠছে। আমার কান্না দেখে সে কিছু বললো না। আমার পাশ দিয়ে আলনার কাছে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে কাপড় চোপড় নিয়ে বের হয়ে গেল।
গায়ে ভারী কাজের একটা শাড়ি আমার। বিয়ের সাজ বলতে পরণের এই শাড়িটুকু চিহ্ন। আর ছিটেফোঁটা সাজ নেই। উল্টো কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। মুখ তেল চিটচিটে। গতকাল রাতে মাথা ব্যথা ছিল বলে হাতের তালু বোঝাই করে তেল দিয়েছিলাম চুলে। মা যখন বেঁচে ছিল তখন মাথা ধরলে মা তেল দিয়ে দিতো। চুলে তেল মালিশ করতে করতে সূরা পড়ে ফু দিতো। অলৌকিক ভাবে কিছুক্ষণ পড়ে ব্যথা কমে যেতো।
গায়ের ভেতর কুটকুট করছে। কেউ এসে শাড়ি পাল্টাতে বললো না। একসময় আমি নিজে থেকে কাপড় পাল্টে একটা তাঁতের শাড়ি পড়লাম। এই শাড়ি সালেহা খালার। কোন ফাঁকে ব্যাগে পুড়ে দিয়েছে জানি না। কিন্তু শাড়িটা খালা আমাকে সাথে নিয়ে কিনেছিল।
বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলাম। চোখের ভেতর জ্বালা করছে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঘষা দিচ্ছিলাম। এমন সময় দ্বিতীয় বার সোহরাব ভেতরে ঢুকলো। ফিটফাট পোশাকের সোহরাবকে দেখে আমার সন্দেহ হলো। এই ফ্ল্যাট, এই বাড়ির মানুষজন, সোহরাব এদের সবাইকে দেখে মোটামুটি উচুঁ পরিবারের মনে হচ্ছে। তারা কেন আমার মতো কাজের লোককে বিয়ে করে আনলো? তারা কী জানে না আমি ও বাড়িতে কাজ করতাম! নাকি লোভে পড়ে?
দরজা বন্ধ করে সোহরাব এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে বলল,
‘তোমার নাম জুঁই, না? তোমায় প্রথম দেখেছিলাম কয়েক মাস আগে। আজাদ ভাই একটা কাজে ডেকেছিল। কাজ শেষ করে আসার সময় ড্রয়িং রুমে চোখ পড়েছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখা। তুমি খেয়াল করনি। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে টিভি দেজছিলে। ওই প্রথম কাউকে এতো মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখতে দেখলাম।’
শেষ করে সোহরাব হেসে ফেললো। তার কথাবার্তা যে তুমিতে চলে এসেছে হয়তো সে খেয়াল নেই। কিংবা আছে! ইচ্ছে করে তুমি বলছে। আমি বরাবরের মতো নিশ্চুপ। তবে এতটুকু বুঝলাম এই ছেলে আজাদ আঙ্কেলের পেছন পেছন ঘুরঘুর করে। টুকটাক রাজ’নীতিতে যুক্ত আছে হয়তো। এমন ছেলেরা আজাদ আঙ্কেলকে ভাই বলে ডাকে। সেই ভাইয়ের জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়!
আমার ভাবনার মাঝে সোহরাব অকপটে পাশে এসে বসল।
(চলবে)
#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_২৫
সোহরাব এসে অকপটে আমার পাশে বসল। জমে স্থির হয়ে রইলাম আমি। এতটুকু নড়াচড়া করলাম না। শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম যেন! সে বলল,
‘কান্না করছো কেন? কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখের কী হাল করেছ!’
তার বলার ভঙ্গি খুবই আন্তরিক। মনে হয় বহুদিনের চেনা। বহু আগের পরিচয়। কিঞ্চিৎ অবাক হলাম আমি। তার কণ্ঠে কেমন অধিকার বোধ ফুটে উঠেছে। মোটা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে নিতে বাঁধা দিল সে। চোখের ইশারায় অপেক্ষা করতে বললো। উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে এলো। আস্ত বক্সটা কোলের উপর দিয়ে বলল,
‘আগে থেকে কিনে রেখেছিলাম। আমি জানতাম কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলবে। ধরো, আজ রাতের জন্য আমার পক্ষ থেকে এটাই উপহার।’
বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে সে নিজেই গাল মুছে দিল। নিজেকে আড়ষ্ঠতায় আরো গুটিয়ে নিলাম। সোহরাব ফের বলল,
‘কি আশ্চর্য! কখন থেকে শুধু আমি বকবক করছি। তুমি কিছু বলো! তোমার কণ্ঠ শুনে ধন্য করি নিজেকে।’
হ্যাঁ। আমার কিছু বলা দরকার। তার সাথে কথার আদান প্রদানের দরকার। সুস্থ একটা সম্পর্কের দরকার। কথাবার্তা না এগোলে তা হবে কী করে? দুজন দুজনকে বুঝবো কী করে! চিনব কী করে! কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। আমি বিচলিত হয়ে বললাম,
‘কিছু মনে পড়ছে না!’
সোহরাব সশব্দে হেসে উঠলো। দৃষ্টি নত আমার। কান খাড়া করে তার হাসির শব্দ শুনলাম। বুঝতে পারলাম এই মানুষটা আকাশ ভাইয়ার মতো। কারণে অকারণে হাসে!
‘আমার নামটা জানো নিশ্চয়ই!’
‘জানি।’
বলে চুপ হয়ে গেলাম। সে বসে আছে আমার খুব কাছে। শরীরে স্পর্শ না করেও খুব করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তার গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। হাসির ঝংকার শরীরে মৃদু আলোড়ন তুলছে। অন্য এক আবহে আকৃষ্ট করে তুলছে। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। ক্ষীণ আওয়াজ তুলে বললাম,
‘ঘুমিয়ে পড়ি আমি? মাথা ব্যথা করছে!’
‘হ্যাঁ অবশ্যই! কেন নয়?’
সোহরাব সহজ ভঙ্গিতে রাজি হয়ে গেল। নিজে উঠে বিছানাপত্র ঠিক করলো। শিথানে বালিশ সাজানো ছিল। একটার উপর আরেকটা। সে বালিশ দুটো দুই পাশে রাখলো। ফিটফাট করে বলল,
‘ওকে! দেয়ালের ওপাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। এপাশ থেকে রাতের বেলা নিচে পড়ে হাত পা ভাঙলে আরেক মুশকিল হয়ে যাবে।’
কেমন সহজ সাবলীল কথা বলার ভঙ্গি। মন অনেকখানি হালকা হয়ে গেল। জড়োসড়ো হয়ে দেয়ালের পাশটাতে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজতে সোহরাব প্রশ্ন করলো,
‘লাইট বন্ধ করে দেই জুঁই? নাহলে আলো চোখে লাগবে।’
‘জ্বি, ঠিক আছে।’
মুখে বললাম ঠিক আছে! কিন্তু ভয়ে দুরুদুরু বুক কাঁপতে লাগলো। মনকে প্রবোধ দিলাম। এই মানুষটা আমার স্বামী। তার সাথে এক জনমের বন্ধন পড়ে গেছে। অনিবার্য নিয়তিতে বাঁধা পড়ে গেছি দুজন। চাইলেই সে সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবো না। যত সহজ হওয়া যায় তত ভালো। হয়তো এটাই আমার জন্য উত্তম।
সে বাল্ব বন্ধ করলো। তবে রুম সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো না। জিরো বাল্বের ক্ষীণ সবুজ আলো জ্বলছে। তাতে বেশ খানিকটা অন্ধকার দূর হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। মাথার ভেতর ধপ ধপ করছে। কপালের শিরদাঁড়া যন্ত্রণা দিচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে পড়ে রইলাম। কয়েক মুহূর্ত গত হতে আচমকা কপালে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। ধপ করে চোখ খুললাম। শরীরে বারংবার কাঁটা দিয়ে উঠলো। লাফিয়ে উঠতে নিতে সোহরাব বাঁধা দিল। মুখ খুলে বলল,
‘উঁহু! ঘুমিয়ে পড়ো। মাথা ব্যথা করছে না? ঘুমিয়ে যাও।’
শান্ত হয়ে এলাম আমি। শীতল হাতের স্পর্শ কপাল জুড়ে ঘুরপাক খেতে লাগলো। কখনো বা তৈলাক্ত চুলের ভাঁজে বিচরণ করলো। আবেগে কণ্ঠ বুজে এলো আমার। এই পৃথিবীতে আমার একান্ত আপন কেউ ছিল না। কাছের কেউ ছিল না। অবশেষে শুধু আমার বলে কেউ এলো? বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে সরু এক জলধারা গড়িয়ে পড়লো। ভাগ্যিস আবছা অন্ধকার বলে সোহরাব টের পেল না।
___________
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। এতক্ষণে অবসর পেয়ে ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুপুরবেলা থেকে কিছু পেটে পড়েনি। জিদ ধরে না খেলেও এখন ঘুম আসছে না। আচমকা মস্তিষ্ক খোলাসা হলো। চোখ খুলতে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ পেলাম। আবছা আলোয় অষ্পষ্ট এক পুরুষ অবয়ব। বিস্ময় নিয়ে তার পানে তাকিয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময় ভাব কেটে গেল। মনে পড়লো আমি বিবাহিত। বুকের গহীনে ঝড়ের সৃষ্টি হলো। সংবিৎ ফিরতে পুরুষ স্পর্শ গুলো শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। সমস্ত কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা গলায় এসে আটকে গেল যেন। দমবন্ধ অবস্থা। শ্বাস আটকে আসছে। উসখুস করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাব মুখ খুললো। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
‘নড়াচড়া করছো কেন জুঁই? এভাবেই থাকো।’
‘আপনি ঘুমান নি?’
অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। কথা বলা ঠিক হয়নি। সোহরাব মুখের সাথে সাথে এবারে চোখ খুললো। আবছা অন্ধকারে তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আমার আঠারো-উনিশ বছরের জীবনে এত কাছে কেউ আসেনি। এমন অনুভূতি হয়নি। এভাবে কারো বাহুডোরে থাকা হয়নি। নিজেকে গুটিয়ে নিতে সোহরাব বলল,
‘মাথা ব্যাথা আছে এখনো?’
আমি ডানে-বায়ে মাথা নাড়লাম। ক্ষীণ সুরে বললাম,
‘না!’
সে কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলো। তারপর গাঢ় অন্ধকার মেখে হঠাৎ বলল,
‘ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি অদ্ভুত টান আমার। কবিতার পংক্তিগুলো ভীষণ করে টানতো। সেই ভালো লাগা থেকে স্কুল, কলেজে প্রায়ই আবৃত্তি করতাম। একটা কবিতা শুনবে?’
মাঝরাতে কবিতা শোনার ইচ্ছে ছিল না। তবুও তার আগ্রহ দেখে চুপিসারে মাথা নাড়লাম। সে আবেগ ভরা সুরে বলল,
‘তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনো।
না না বলে ফিরিয়ে দিলেই
ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়!
সুসজ্জিত ঘরবাড়ি
সখের বাগান
সভামঞ্চে করতালি
জয়ধ্বনি পুষ্পার্ঘ্য ইত্যাদি
সব ফেলে
তোমার পায়ের কাছে অস্তিত্ব লুটিয়ে দিয়ে
তোমাকে না পেলে, জানি
যে পায়, সে পায়
কি অমূল্য ধন।’
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম। সোহরাব কখন থেমে গেছে টের পাইনি। কবিতা শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেছে চারপাশে। সে প্রশ্ন করলো,
‘এটা কার লেখা জানো?’
কখনো কবিতা পড়া হয়নি। বলতে গেলে সময় হয়নি। কবিতার প্রতি ভালোবাসা সবার আসে না। যারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যায় তাদের কবিতা পড়ার সময় হয় না। কবিতার প্রতি ভালো লগ জন্মায় না। তবে সোহরাবের বলা কবিতা ভালো লেগেছে। মুগ্ধতা এখনও কাটেনি। আমি বিমুগ্ধ সুরে বললাম,
‘জানি না। কার লেখা?’
‘আহসান হাবীব। আমার পছন্দের একজন।’
আমার দৃষ্টি তার আবছা অবয়বের পানে ছিল। আচমকা সে নড়ে উঠলো। বাহুডোর শক্ত করে আরো কাছে টেনে নিল। চমকে যাওয়া ছাড়া কিছু করতে পারলাম না আমি। চোখের পলক ফেলার আগে সোহরাব অঘটন ঘটিয়ে ফেললো। তার অধর যুগল আমার তেল চিটচিটে কপাল স্পর্শ করলো। দ্বিতীয় চুমুটা ঠোঁটে পড়লো। কিয়ৎক্ষনের জন্য বোধবুদ্ধি হারালাম। মনের পর্দায় রাজ ভাইয়ার চেহারা ভেসে উঠলো। এক সন্ধায় সে ঝড়ো হাওয়ার মতো কাছে এসে চুমু খেয়েছিল। এমন লুকোনো চুমুর ক্ষত কী সবার থাকে? সবাই কী এমন দু চারটে গোপন অনুভূতি, গোপন দুঃখ এভাবে লুকিয়ে রাখে? হয়তো!
সোহরাবের স্পর্শ গুলো গভীর হচ্ছে। বাঁধা দেওয়ার অবকাশ পেলাম না। চোখজোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এলো আমার। বন্ধ হতে দু চোখের কিনার বেয়ে সরু এক জলের ধারা কান স্পর্শ করলো।
____________
এর মধ্যে দুদিন কেটে গেছে। সোহরাব আজ সকাল সকাল কাজের জন্য তৈরি হয়ে গেল। স্যুট-বুট পরে। কিন্তু সে কী কাজ করে তা অজানা আমার। জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পিছিয়ে এলাম। তার সাথে সহজ করে কথা বলা হয়ে উঠেনি। সে আমার চারপাশে স্বস্তির বাতাস ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবুও আমি সহজ হয়ে উঠতে পারি না। এতগুলো দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে, সবার হুকুম মেনে চলতে চলতে নিজেকে অনেক ছোট করে ফেলেছি। সংকীর্ণ করে ফেলেছি। সবকিছুতে এখনও তার ছাপ রয়ে গেছে। সারাক্ষণ তটস্থ থাকার অভ্যাস যায়নি। সোহরাব সামান্য নাম ধরে ডাক দিলেও সতর্ক হয়ে যাই। চমকে উঠি। মনে হয় এই বুঝি ধমক দিবে।
মানিব্যাগ পকেটে পুড়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো সোহরাব। হঠাৎ কাছে এসে বলল,
‘ফেরার পথে কিছু নিয়ে আসবো?’
ফোনের জন্য একটা সিম লাগবে। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। কিন্তু বলার সাহস হলো না। সোহরাব নিজে থেকে যখন ফোনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে তখন নিশ্চয়ই বলবে। আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,
‘লাগবে না।’
‘জানো জুঁই! পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ একটা প্রশ্ন আছে। পরিচিত, অপরিচিত সচরাচর সবাই জিজ্ঞেস করে। অথচ এতো সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ কখনো সহজ করে দিতে পারে না। সারাক্ষণ মিথ্যে বা ভুল উত্তর দেয়! বলো তো কী প্রশ্ন?’
কিছুক্ষণ ভাবলাম আমি। মাথায় খেললো না।
‘জানি না!’
‘কেমন আছো বা কেমন আছেন! এই সহজ প্রশ্নের উত্তরে মানুষ সবসময় মিথ্যে বলে। তোমায় যদি কখনো এই প্রশ্ন করি কখনো মিথ্যে বলবে না। অন্তত আমার কাছে না।’
মাথায় হাত ছুঁইয়ে সোহরাব বের হয়ে গেল। ভালো লাগার স্নিগ্ধ এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো দেহ জুড়ে!
রুমে কাপড় গুছিয়ে রাখছিলাম। নাহার আপা ডাক দিল। আমি ড্রয়িং রুমে এগিয়ে গেলাম। আপা মাথার চুলে চিরুনি করছিল। বলল,
‘আজ জিমনেশিয়ামে যাবো আমি। কয়েকদিন যাওয়া হয়নি। আশাকে রেখে যাচ্ছি। দেখে রেখো।’
‘ঠিক আছে।’
‘তোমার দুলাভাই পানি চাইলে বা কিছু লাগলে দিয়ো।’
‘আচ্ছা আপা।’
নাহার আপা একটা চাকরি করে। মেয়েদের জিম শেখানোর চাকরি। এ ব্যাপারে এতকিছু জানি না। শুধু জানি ব্যায়াম শেখায় মেয়েদের। তবে তার বেশভূষা অতি আধুনিক! এমন মানুষ চাক্ষুষ দেখিনি কখনো। মাঝে মধ্যে টিভির পর্দায় দেখতাম। এখন একত্রে বসবাস করতে হচ্ছে। সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তার বলা মুশকিল।
আপা চুল খোঁপা করে ক্লিপ দিয়ে আটকালো। কাঁধে ব্যাগ চেপে অবশেষে বের হলো। দরজার কাছে এসে আমি নত সুরে বললাম,
‘আশা কাঁদবে না তো আপা?’
‘কাঁদবে না। ওর আব্বু আছে তো। ভীষণ বাবা ভক্ত মেয়ে। তুমি শুধু সময় মতো খাইয়ে দিয়ো!’
‘হুঁ!’
আপা জুতা পায়ে গলিয়ে হাঁটা ধরলো। সিঁড়ি দিয়ে যতক্ষণ নামার শব্দ কানে এলো ততক্ষণ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শব্দ মিলিয়ে যেতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ছিটকিনি লাগিয়ে সরে আসলাম। ঘরে এসে আবার কাপড় গুছানোতে মনোযোগ দিলাম। ও ঘরে আশা খেলছে। খানিক বাদে বাদে খিলখিল করে হেসে উঠছে। তার হাসির ঝংকার ফ্ল্যাটে আলোড়ন তুলেছে। আশার বয়স চার চলছে। শান্ত স্বভাবের মেয়ে। সোহরাব খুবই ভালোবাসে পিচ্চিকে। সে যতক্ষণ বাড়ি থাকবে আশা মামা মামা বলে গলা জড়িয়ে ধরে থাকবে। দেখতে বড্ড ভালো লাগে।
ঘন্টা খানেক পরেই বাহিরের কলিং বেল বেজে উঠলো। এখন তো কারো আসার কথা নয়। নাহার আপা দুপুরের পর আসবে। আর সোহরাব বলেছে তার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতে ওপাশের মানুষটিকে দেখে ভয়ানক চমকে গেলাম। সামান্তা আপু দাঁড়িয়ে আছে! লম্বা শাড়ির আঁচলে তাকে কেমন বউ বউ লাগছে। বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে এলো আমার। বিস্ফারিত কণ্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে এলো,
‘আপু!’
আপু হাসলো। হেসে উবু হয়ে পায়ের জুতা খোলার চেষ্টা করলো। আমার দুচোখে ততক্ষণে অশ্রুরা ভিড় জমিয়েছে। আপু সোজা হয়ে দাঁড়াতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম।
‘আহা! কান্নাকাটি কেন? ভেতরে চলো তো।’
এতক্ষণে মঈন চাচার উপর নজর গেল। চাচা দু হাত বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাস্যোজ্বল মুখ। আমি আপুকে ছেড়ে দিলাম। চোখের জল মুছে বললাম,
‘চাচা কেমন আছেন?’
‘আমি বেশ ভালো আছি। ভেতরে চলো।’
সামান্তা আপুর হাত ধরে ভেতর ঘরে এলাম। বসতে দিলাম তাদের। আপুর দৃষ্টি ছলছল করছে। স্বযত্নে নিজেকে লুকিয়ে মুখ খুললো সে। বলল,
‘কেমন আছিস রে জুঁই?’
সোহরাব এই প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলতে বারণ করেছে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম। সত্যি সত্যি কেমন আছি আমি? মনে হয় ভালোই আছি। পরিবার পরিজন ছাড়া ইয়াতিম একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! মানুষ কত দুঃখে কষ্টে রয়েছে। এই শহরের অলিতে গলিতে কত অসহায় মানুষ পড়ে আছে। কারো পেটপুড়ে খাবার নেই, মাথার উপর চালা নেই, পরণে ঠিকঠাক কাপড় নেই। আরো কতশত অপূর্ণতা! সেখানে আমি বলতে গেলে রাজরানীর মতো আছি। একটা কাজের মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো কখনই হতে পারে না। আমি আপুর পাশ ঘেঁষে বসে পড়লাম। বললাম,
‘ভালো আছি আপু! আপনার কথা বলেন। ও বাড়ির সবার কী খবর? সালেহা খালা ভালো আছে? খালা আসলো না কেন?’
(চলবে)