ভালোবাসা
৩০তম_পর্ব
#মৌসুমি_চৌধুরী
দুবাই ফিরে যাবার পর থেকেই কেমন জানি খালি খালি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো যে…বন্ধু পরিজন, পাড়াপ্রতিবেশি এমনকি গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটাকেও যেন মিস করতে লাগলাম। বিদেশ চলে আসার পর থেকে তাই মন লাগছিলো না কাজে, মাস তিনেক বহু কষ্টে পার করে আমি ভাবছিলাম দেশে ফিরে যাবো।
অফিসে জয়েন করেই প্রথম একবার দোকান থেকে কল দিলেও পরে অরু আমায় আর কল দিলো না। শেষবার যখন কথা হলো সবই ছিলো তার জব আর অফিস রিলেটেড। তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শুনে আমার মনে পড়লো যে ফেরার দিন ওর তাড়াহুড়োয় আমি তাকে কংগ্রাচুলেশনস বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটা জানাতেই সে লাজুক স্বরে বললো…এখন রাখছি রে, তুই ভালো থাকিস।
অরুর ফোনের অপেক্ষায় থেকে থেকে পাগল হবার উপক্রম হলো যেন আমার। তাই আর অপেক্ষায় থাকতে না পেরে একদিন ফোন দোকানদার থেকে ঠিকানাটা নিয়ে নিলাম আর ভাবলাম যে এবার ফিরে গেলে সেখানে গিয়ে তার খোঁজ করবো।
কারোকে কিছু না জানিয়ে অবশেষে চুপচাপ দেশে ফিরে এলাম। আনমনে ভাবতে লাগলাম, আন্দাজে কোথায় কোথায় খুঁজবো অত বড় শহরে…আর তাই তার পুরনো স্কুল কলিগদের থেকে জানতে চাইতেই তারা বললো অত তো মনে নেই, ওর বান্ধবী সীমা জানতে পারে কিছু। ফের সীমাদের বাড়িতে যেতেই সীমা তাকে জানালো যাবার আগে অরু বলেছিলো অফিসটা কোথায় আর কি তার নাম।
শহরে গিয়ে সেই ঠিকানা ধরে অফিসটা খুঁজে বের করতেই যেন বিজুর ঘাম ছুটে গেলো। তবুও সে হাল না ছেড়ে সেই ঠিকানায় দাঁড়িয়ে থেকে একদিন অরুকে দেখতে পেয়ে তার পিছু নিলো। ওর বিল্ডিং এলে পরে সিড়ি টপকে ফ্ল্যাট পর্যন্ত যেয়ে হুট করে দরজার সামনে এসে বললো, আমায় ফাঁকি দিয়ে এভাবে পালিয়ে গেলি কেন বলতো?
অরু এভাবে আমার অকস্মাৎ আগমনে ভড়কে গিয়ে দ্রুত চাবি দিয়ে দরজা খুলতে যতই চেষ্টা করছিলো ততই যেন তার হাত কাঁপতে লাগলো। আমি সেদিকে লক্ষ্য করে তার হাত থেকে চাবি বলতে গেলে প্রায় একপ্রকার টান মেরে নিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। সে ভেতরে ঢুকতেই আমিও ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে তার দু’হাত দেয়ালে চেপে ধরে আমার মুখ তার মুখ বরাবর নামিয়ে আনতেই সে বলে উঠলো, বিজু প্লিজ এমন করিসনা…ছেড়ে দে আমায়। আমি তার ঠোটে আমার ঠোট চেপে ধরে গভীর চুম্বনে হারিয়ে গেলাম। আমার উষ্ণ ভালোবাসায় সে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। তার নিঃশ্বাসের শব্দ যেন আমায় আরো জাগিয়ে তুলছিলো।আমি তার গালে গাল ঘষতে লাগলাম, আমার ঠোট দিয়ে তার সারা মুখে চুম্বন একে দিলাম।
অরু মুখে না বললেও আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে সেও আমাকে চায়। আমার ভালোবাসার ডাকে তাই তার শরীর ও যেন সাড়া দিচ্ছে। তার হাত আমার হাতের মুঠোয় বন্দি।
খুব ধীর স্বরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আমি তাকে বললাম…ভালোবাসি অরু, ভীষণ ভালোবাসি।
সে চোখ বন্ধ করে ফেলে, যেন তার ঠোট কিছু বলতে নিলেও গলায় স্বর আসছেনা। তার ঠোট কাপছে আর সে পালাতে চাইলে আমি তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে অনুভব করতে লাগলাম। একসময় বুঝলাম অরুও আমায় জড়িয়ে ধরেছে আর খুব কাঁদছে। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিলো আমার কাঁধে।
আমি বাঁধন আলগা করে তাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, এখনো কি কিছু বলবি না আমায়?
অরু মাথা নত করে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পায়ের আঙুলে আঁকিবুঁকি কাটছে।
আমি ফের বললাম, অরু তোর এই চুপ থাকা যে আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। ভগবানের দোহাই লাগে, এবার তো কিছু বল।
সে কিছু না বলে আমার থেকে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে ফের চোখের দিকে তাকাতেই টপটপ করে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।
আমি তার কাঁধে দু’হাত রেখে বললাম, আমি কি কোন অন্যায় করেছি? তোকে কষ্ট দিয়েছি…বল? তবে আমার ভালোবাসাই কি তোর বেদনার কারণ! কিন্তু আমার মন যে বলে, তুই ও এখন আমায় ভালোবাসিস আর তাই বুঝি এভাবে গা ঢাকা দিলি?
খানিকক্ষণ চুপ থেকে একসময় অরু বলে উঠলো, তুই কেন আরো আগে বুঝলি না রে বিজু? কেন বিয়ের আগেই আমায় ভালোবাসলি না?
এই প্রশ্নের কোন জবাব ছিলো না আমার কাছে। তাই অপরাধীর ন্যায় নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অরু ফের বললো, আমি যে তোকে সেই মাধ্যমিকের আগে থেকে ভালোবাসতাম…কোনদিন কেন তা বুঝলি না?
বিজু অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলো অরুর দিকে।
অরু একটানা বলে যেতে লাগলো, বয়সন্ধির সেই সময়টায় যখন প্রথম কারো প্রতি একটু অন্যরকম অনুভূতি জেগে ওঠে মনে তখন আমার আশেপাশে তো তুই ছাড়া কেউ ছিলো না তাই হয়তো মনের মধ্যে নিজের অগোচরে যে আবেগের জন্ম হয়েছিলো তাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তুই সেসব অনুভব সম্পর্কে তখন ও অজ্ঞাত, আর তাই নিজেরই যেন নিজেকে বেশ খারাপ মনে হতো। কখনো কখনো ভাবতাম, বিজুটা কত ভালো আমায় শুধুই বন্ধু ভাবে আর আমি কিনা…ছিঃ ছিঃ কিসব উল্টোপাল্টা ভাবি। তোর সাথে পড়ালেখা করতে করতে অনেক দূর গেলে হয়তো তুই বুঝতিস কিংবা ভাবতিস আমার কথা, এই ভেবে সেসময় চেপে যাই। পরে মা যেদিন থেকে আমায় বিয়ের জন্যে চাপ দিতে লাগলেন আর বললেন কিছুতেই অতদূর পড়াতে পারবেন না, তখন যেন আমি চোখে অন্ধকার দেখতে পেলাম। তোকে আর বলে কি হবে এই ভেবে সব ভুলে পাত্রী সেজে পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসলাম। কিন্তু সেখানেও তুই….আমি শুধু তোকে দেখেই বিয়েটা মানা করে দিতে চাইলাম কারণ তোর সামনে থেকে অন্য কারো সাথে ঘর করা আমার জন্যে বেশ কঠিন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানিস…সেই তুইই যখন খুব করে চাইলি তোর দাদাকে বিয়ে করে তোদের বাড়িতেই যেন আজীবন থাকি, তখন আর না করতে পারলাম না। মনে হলো বিজুর খুশিতেই আমার খুশি। চোখের দেখাতো অন্তত দেখতে পাবো, আর বিজুওতো সেটাই চায়।
তুই জানিস…সেই যে দীঘার সৈকতে তোকে সাগরের ঢেউয়ে আছড়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তারপর কেন আর সহজভাবে কথা বলতে পারছিলাম না তোর সাথে? কারণ আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব, নিজেকে কিছুতেই সেই পুরনো আবেগে ভেসে যেতে দিতে চাইছিলাম না। তোকে নিয়ে আমার ভয় ছিলো নারে, ভয় ছিলো নিজেকে নিয়ে।
একসময় সব ভুলে যেতে নিজেকে আবার পড়ালেখা আর সংসারের মায়ায় জড়িয়ে ফেললাম। তোর দাদার সাথে সম্পর্কে মনোযোগী হয়ে গেলাম যাতে করে খুব তাড়াতাড়ি বিবাহিত জীবনটাকে মেনে নিয়ে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারি। আমি, তোর দাদা, বাবা-মা, আর তুই সবাই মিলে অনেক সুখে থাকবো এমনটাইতো চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো…তোর দাদার স্বার্থপরের মতো আমাদের ফেলে চলে যাওয়া, তোর পড়ালেখা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব মিলে যেন খুব অন্যরকম লাগছিলো আমার।
তারপর যখন দেখলাম আমার প্রতি সব দায়িত্ব করতে করতে একসময় তুই ও যেন কেমন আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিস, তখন মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম জানিস…ভাবতাম, কেন বিজু? এখন কেন?
আমি নাহয় একাই তোর প্রেমে পড়েছিলাম কোন এক সুদূর অতীতে, কিন্তু এই ভুল সময়ে তুই কেন রে পড়তে গেলি বলতো! ভগবানের প্রতি আমার ভীষণ রাগ হতো জানিস…মনে হতো, সে কি আমায় কোনদিন আর শান্তিতে থাকতে দেবে না?
দাদাকে যে তোর খুব হিংসে হতো সেও যেন আমি অনুভব করতে পারতাম, আর তাই তোর পাগলামো দিনদিন বেড়ে যেতে লাগলো…কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে হঠাৎ যেন খুব শান্ত হয়ে গেলি। তোর সেই নিস্তব্ধতায় মনে হতো যেন বাবা-মার মতো বিজুও কোথাও হারিয়ে গেছে। তোকে ফিরিয়ে আনতে আমি তোর যা কিছু ভালো লাগে সব করতে লাগলাম। কিন্তু মা চলে যাবার পর নিজ থেকেই দূরে সরে যেতে চাইলি যেন আর তাই আমরা যাওয়ার আগেই তুই দেশ ছেড়ে গেলি। সব বুঝতে পেরেও আমার কিছু করার ছিলো না, স্বামী যেখানে স্ত্রী ও সেখানে থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক নিয়মে জীবনের।
আগে কেন বলিসনি আমায়? স্কুলে থাকতে বলতে তো পারতিস…বলে যেন চিৎকার করে উঠলো বিজয়।
তুই কি ভাবতিস আমায়…খারাপ ভেবে যদি বন্ধুত্ব না রাখতিস?
তোকে খারাপ ভাববো আমি!
আমাকে তোর পছন্দ হলে তো আগেই বলতিস, আমি মেয়ে হয়ে কিভাবে…আর আমার গায়ের রং ও তোর চেয়ে ময়লা।
আমি কিচ্ছু মনে করতাম নারে অরু। তুই যদি সেসময় বলতিস আমায়, তাহলে এই অনর্থটা ঘটতো না আমার দ্বারা…বলে দু’হাতে নিজের মাথার চুল মুঠো পাকিয়ে টানতে থাকে বিজু।
ফের সে বলে উঠলো, আমি তো জানতামই না তখন তোর জন্যে আমার মনে যে ভাবনা তাকে ভালোবাসা বলে। তুই মেয়ে হয়েছিস তাই শুধু শুনেই যাবি? আরে আমাদের ছেলেদের কি কখনো কারো ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না? কারো মুখে ভালোবাসি কি শুধুই মেয়েরা শুনতে ভালোবাসে! আমার গায়ের রং যদি তোর ভালোবাসা পেতে বাঁধা হয়, তোকে দ্বিধায় ভুগতে বাধ্য করে তবে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে পুড়ে ছাই হতেও রাজি আছি।
অরু কিছুটা সময় পর ইতস্তত করতে করতে বলে, কিন্তু…কিন্তু সবাই জানলে ভাববে আমরা বুঝি একই ঘরে থেকে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। এখন আর তা সম্ভব নয়, এসব জটিলতার মাঝে সংসার হয় নারে বিজু।
কেউ কিচ্ছু জানবে না, আমরা এখানেই নাহয় বাকিজীবন থেকে যাবো। আমি নতুন করে একটা কিছুর বিজনেস শুরু করবো, বেশ চলে যাবে আমাদের। শুধু তুই আর আমায় ফিরিয়ে দিস না…আমাদের পবিত্র ভালোবাসার সাথে অন্যায় আচরণ করিস না।
ফের আমায় ভালোবাসে যে সেটা মেনে নিয়ে বিয়েটা করতে অরুর সম্মতি দিতে আর দেরি হয় না। বিয়ের পর তার আড়ষ্ট ভাব দেখিয়ে দূরে দূরে থাকতে চাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে আমি বলতাম, দেখ অরু বন্ধু তুই চিরকাল ছিলিস আর থাকবিও কিন্তু এমন আর কতদিন…সে ঘুমুতে এসেও একহাত দুরত্বে থেকে পারলে খাট থেকে পড়ে যায় এমন ভাবে থাকতো। আমি তার হাত টান মেরে তাকে বুকের ওপর ফেলে বলতাম, এখানটায় তোর জন্যে জায়গা রেখেছি বুঝেছিস। অনেক থেকেছিস দূরে আর আমি সইবো না। সে লজ্জায় আরক্তিম বর্ণ ধারণ করে বল তো, তোর সাথে পারবো না…পারতে যে তোকে হবেই বলে আমি মৃদু হাসি দিয়ে ডুবে যেতাম অরুর ভালোবাসায়।
অফিস থেকে জরুরি কাজে একটা মিটিং সারতে গিয়ে আজ একটু তাড়াতাড়িই যেন বেরুতে পারলো অরু। বিজুর অপেক্ষায় না থেকে তাই সারপ্রাইজ দিতে নিজে নিজেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলো সে। হঠাৎ ফুটওভার ব্রীজের বিপরীত দিক থেকে আসা মলয়ের সাথে চোখাচোখি হতেই…খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে শুধালো, কেমন আছো অরু?
প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো অরু, তা দেখে মলয় তার সাথে সাথে হেঁটে আসতে লাগলো। বাড়ি পর্যন্ত এসে দরজার সামনে সিনক্রিয়েট হবে বিধায় সে ধীর স্বরে বললো, এক গ্লাস জল দেবে অরু?…বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
অরু তার জন্যে ডাইনিং টেবিলের ওপরে রাখা জগ হতে গ্লাসে জল ঢেলে নিয়ে এসে দেখলো সে জুতো খুলে রেখে বসার ঘরে গিয়ে বসেছে।
জলের গ্লাসে চুমুক দিয়ে এক ঢোক গিলে নিয়ে মলয় বললো, বিয়ে-থা করেছো নাকি একাই আছো?
কেন আমার বৈবাহিক নিদর্শনের সাজগোজ কি তুমি চোখে দেখতে পাওনি?…অরুর গলায় যেন তেজ উঠে আসলো।
লোকের কথা থেকে বাঁচতেও অনেকে সেসব পড়ে থাকে….বললো মলয়।
কেন? ডিভোর্স হয়েছে বলে আমার কি আর বিয়ে হতে নেই? নাকি ডিভোর্স হওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে অমন ভাবনা রাখ তুমি?
আমি শুধু সত্যটাই জানতে চেয়েছি অরু?
নাহ…তুমি ভেবেছো তোমার শোকে, তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় সিথি সাজিয়ে বছরের পর বছর বসে আছি নির্লজ্জের মতো।
আমি সেরকম কিছু কি বলেছি অরু? তুমি ঠিক আছো কিনা শুধু সেটাই জানার ইচ্ছে হলো।
আমি বেশ ভালো রকমের ঠিক আছি আর জব ও করছি ভালো পজিশনে।
বাচ্চার খেলনার দিকে চোখ পড়তেই মলয় হাসিমুখে বললো, আমাদের সন্তান হয়েছে অরু?
তোমার সন্তান! এত বছর পর এসব দাবি করতে লজ্জা করছেনা? সংসার, স্বামী, সন্তান সব আছে আমার…তবে তোমার কি আছে জানা নেই আর জানতে চাইও না।
শুনে ভালো লাগলো অরু, ভালো থেকো…বলে মলয় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
বিজু মনে মনে ভাবে, আজও যখন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই অরুর মুখটা দেখি তখন যেন এক ধরনের প্রশান্তি আমায় ঘিরে রাখে। প্রায়ই মাঝরাতে ছোট্ট অজয়কে একপাশে সরিয়ে রেখে আমি অরুর সাথে যেন একাত্ম হয়ে মিশে যেতে চাই। চোখ মেলতেই আমায় তার মুখের উপর ঝুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরু মুচকি হেসে বলে, কি অত দেখিস বলতো…আমিতো তোরই আছি, রোজ রোজ এতো দেখলে বোর হয়ে যাবি।
আমি তার নাকে নাক ঘষে বলি, তোকে চিনি সেই ছোটবেলা থেকে তাও প্রায় বিশ বছরের বেশি সময় ধরে…এতদিনে যখন বোর হইনি আগেও হবো না দেখিস।
সে মৃদু হেসে বলে, সে দেখা যাবে ক্ষণ…তারপর বিছানা থেকে উঠতে নিতেই আমি তার হাত টান মেরে তাকে আমার বুকের ওপর এনে ফেলি আর বলি, তোর প্রতি আমার ভালোবাসা যে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে…সামাল দিতে পারবি তো?
সে কপট অভিমানের স্বরে বলে, ভালোবাসা না ছাই…এ হলো ভালোবাসার নামে অত্যাচার।
তারপর বলে উঠে, যেতে দে আমায়…অনেক কাজ পরে আছে, স্নান করে…রেডি হয়ে…নাস্তা বানিয়ে…তোদের খাইয়ে ফের অফিস যাবো।
আমি বলে উঠলাম, সপ্তাহে একদিন কেন যে ছুটি হয়…মধুর অত্যাচারে আরো বেশি জ্বালাতে মন চাইছে তোকে, আজ না গেলে হয় না?
সে বললো, অজয় উঠে পড়েছে এবার তো ছাড় আমায়।
অজয় চোখ কচলাতে কচলাতে, আমি এপাশে এলাম কি করে মা? বাবা তুমি ফের আমায় ধোকা দিয়ে মার পাশে ঘুমিয়েছো না! মাকে শুধু আমি জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো বুঝলে…যেন ধমক দিয়ে বললো।
অরু ঠোট চেপে হাসি আটকে চলে যেতেই আমি অজয়কে টেনে নিয়ে কোলে বসিয়ে বললাম, বাবার ও তো মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় না…তাই স্যাড ফিল করছিলাম দেখে তোমার মার কাছে গিয়ে কান্না করছিলাম।
এরপর থেকে তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদবে কেমন…মা শুধু আমার, বুঝলে?
ওকে ওকে…এখন তুমি বরং দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ফেলো, ফের তোমায় আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি।
অজয়কে রেডি করিয়ে তার স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে অরুর সাথে আমিও হাত লাগালাম কিচেনে। সে বলে উঠলো, তোর কিছু করা লাগবেনা…আমি করছিতো।
আমি হেসে বললাম, তোর সাথে যেটুকু সময় পাই তার একটুও হারাতে যে মন চায় না আমার…কি করবো বলতো!
আমরা নাস্তা করে রোজকার নিয়মে একসাথে বেরিয়ে পড়ি। অজয়কে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আমি আমার বাইকটা বের করে অরুকে পেছনে বসিয়ে বলি শক্ত করে আমায় ধরে বসতে। অরু বুঝেও না বোঝার ভান করে আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, ধরেছি…এবার স্টার্ট দে। আমি বুঝতে পারি যে, সে আমায় জ্বালিয়ে বেশ মজা নিচ্ছে। আর তাই তার দু’হাত টেনে নিয়ে কোমরে আটক বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিতেই সে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হয় আমায় আর বলে উঠে, বিজু স্পিড কম কর…আমার খুব ভয় করছে।
তখন আমি বলি, ভয় না পেলে কখনো কি কাছ ঘেষে বসতিস…তোর জন্যে ভয়ই সই। তারপর অনুনয় বিনয়ের পর স্পিড কমালে যেন গায়ের সাথে লেপ্টে থাকে আমার, তখন নিজেকে খুব সুখী মনে হয়। তারপর তাকে তার অফিসে নামিয়ে আমি যাই আমার কাজে। দুবাই থেকে আনা টাকায় একটা মোটর পার্টসের দোকান দিয়েছি, ভগবানের কৃপায় বেশ ভালোই চলে।
সারা সপ্তাহ ব্যস্ততার পর ছুটি-ছাটার দিনগুলোতে ধারেকাছে বেড়ানো আর বছরে একবার কি দু’বার দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া…এমনভাবেই যখন বেশ কেটে যাচ্ছিলো দিন, ঠিক তখনই একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর আমি রোজকার মতো অজয়কে গোসল করিয়ে ফের দু’জনে লাঞ্চ করে ওকে সাথে নিয়ে দোকানে যাবার পথে পেছন থেকে কে যেন আমায় বিজু বলে ডাকলো।
এখানে সবাই আমায় বিজয় নামেই ডাকে, আর তাই তার কন্ঠ শুনে চমকে পেছনে তাকাতেই দেখি দাদা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। আমি ফিরে তাকাতেই হাসিমুখে বললো, তুই দুবাই থেকে কবে ফিরলি?
আমি তার আকস্মিক আগমনে চমকে গিয়ে আর কিছু বলতে পারছিলাম না।
উনি তোমার কে হন বাবা?…অজয় হঠাৎ বলে উঠলো।
তার কথায় সম্বিৎ ফিরতেই আমি দেখলাম, দাদা তাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বললেন…আমি তোমার জ্যেঠু হই।
জ্যেঠু কি জিনিস?…সেটা জিজ্ঞেস করতেই দাদা হেসে বললো, বাবার দাদাকে জ্যেঠু বলে বুঝলে।
দাদা ফের আমার দিকে চেয়ে বললেন, তুই বিয়ে করলি কবে?
আমি আনমনে বলে ওঠলাম, পাঁচ বছর হলো।
কি নাম রেখেছিস ছেলের?
অজয় ওর নাম।
বাহ…বেশ সুন্দর নাম তো, বিজয়ের ছেলে অজয়।
অজয়কে দোকানের সেলসম্যান মনীশের কাছে রেখে, অরুর অফিস ছুটির পর তাকে আনতে যাই রোজ। আজ যেন সব কেমন গোলমেলে ঠেকছে। আর তাই কিভাবে দাদার সামনে থেকে যাবো সেকথাই ভাবতে লাগলাম।
তোর বাড়ি কি এদিকেই? হঠাৎ করে জানতে চাইলেন দাদা।
দোকান এদিকে, আমি বাড়ির প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলাম যেন।
তুমি কবে এলে? ফের জানতে চাইলো বিজু।
এসেছি প্রায় সপ্তাহখানেক হবে।
থাকবে এখানেই?
কি যে বলিস…কোন এক ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে সেমিনারের ইনভাইটেশন ছিলো। আমি ফিরে যাবো ক’দিন পরেই।
তারপর ঘড়ি দেখে বললেন…আমার একটা জরুরি মিটিং আছে, তোর দোকানের এড্রেসটা দে নাহয় পরে যাবো একসময়।
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও কার্ড বের করে দিলাম।
ছেলের নামেই রেখেছিস নাম, ভালো তো…বলে কার্ডটি পকেটে রেখে আর দাঁড়ালেন না।
সেদিন দোকানে ফিরে গিয়ে আমার যেন আর মন বসছিলো না,৷ তাই অজয়কে রেখে ঝড়ের বেগে বাইক চালিয়ে অরুর অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অরু এসে দাঁড়িয়ে আমায় দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে নিতেই আমি বাইকটা তার সামনে নিয়ে ব্রেক কষে বললাম, এত ধীরে চলছিস কেন? তাড়াতাড়ি উঠে বস।
সে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকে বললো, কি হয়েছে তোর বলতো?
আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাকে নিয়ে গোটা পথ চুপচাপ বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম।
মনীশ দোকান বন্ধ করে হিসাব বুঝিয়ে রোজকার মতো অজয়কে দিতে এলে আজ আর কিছুই মাথায় ঢুকছিলো না। আমায় অন্যমনস্ক দেখে সে জানতে চাইলো কোন সমস্যা হয়েছে কি-না…আমি শুকনো হেসে না বোধক মাথা নাড়লাম।
অজয়কে ঘুম পাড়িয়ে অরু শুতে এলে রাতে, আমি তাকে বুকে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম যেন…সে কি বুঝলো কে জানে! ধীর স্বরে বললো, কি হয়েছে তোর বলতো?
আমি তার কপালে চুমু খেয়ে বললাম, কিছু না…তুই এভাবেই আমার সাথে থাকিস চিরকাল।
সে হেসে বললো, তাতো আমি আছিই…তারপর মাথা উচু করে আমার চোখে জল দেখে বলে উঠলো, এই পাগল…কাঁদছিস কেন রে তুই! বলে তার শাড়ির আঁচলে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে আমায় আদরে আদরে যেন ভরিয়ে দিতে লাগলো।
তারপর একসময় শেষরাতে অরু ভাবছিলো, মলয়ের সাথে দেখা হবার খবরটা সে কিছুতেই আর বিজুকে দেবে না।
বিজু অপরপাশে জেগে থেকে ভাবতে লাগলো, অরুর সাথে যেন দাদার দেখা না হয়।
বাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজন কারো সাথে যোগাযোগ না থাকলেও বন্ধু সুজন আর আজাদ সবটাই জানে। আর তাই সে পরদিন সুজন কল দিতেই সবটা বলে ফেললো। তার ভয় পাওয়া কন্ঠ শুনে সুজন বললো, বৌদি তোকেই ভালোবাসে রে…তুই অযথাই টেনশন করছিস। আর এখন তো অজয় ও আছে, তোদের ভালোবাসার প্রতীক স্বরুপ।
রুখসানা আর আজাদ তাদের মেয়ে মুন্নীকে নিয়ে গতবছর ও বেরিয়ে গেছে। সে কল দিতেই, রুখসানা সবটা শুনে বললো, ভাবীর ভালোবাসা নিয়ে তুমি মনে কোন সন্দেহ রেখো না…স্বামী হিসেবে মেনে নেয়া ভালোবাসা ছিলো যার সাথে, তারচেয়ে বরং তোমার সত্য প্রেম আর তার প্রথম অনুভূতির মিলন যে বিয়েতে ঘটেছে সেটার অস্তিত্ব বেশ জোরদার।
অরুর বাবা-মা মিরুর বিয়ের পর সবটা জানতে পেরে তরুসহ এসে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন সব ভালোই চলছিলো তখন দাদা এসে যেন দমকা হাওয়ার মতো মনের সব শান্তি উড়িয়ে দিচ্ছিলো।
টেনশন ভুলতেই ছুটির দিনে আমি, অরু আর অজয়কে নিয়ে কাছেপিঠে থাকা এক সী-বীচে গেলাম। অরু, বিজু আর অজয় এই মিলেই পরিবার। সেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু দাদা ফিরে আসার দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস যেন ফেলতে পারছিলাম না।
বাইরে বেরুলেই অরু যেন বাচ্চাদের মতো করতে থাকে। তার ছেলেমানুষী আবদার আমার বেশ ভালো লাগে। বিজু চল, গোলা খাই, ভেলপুরি না খেয়ে কিন্তু বাড়ি ফিরবো না মাথা দুপাশে নেড়ে… আরে ফুচকা! বলে ভো দৌড়, সবটাই যেন অরুকে মানায়।
আজ ও সে গোলা খেতে ব্যস্ত আর অজয় যথারীতি আমার কোলে। আমি মুগ্ধ চোখে তার দ্রুততার সাথে খাওয়া দেখছিলাম।
সূর্য অস্ত যাবার প্রাক্কালে সে দৃশ্য আরো একজন দেখছিলো দূরে দাঁড়িয়ে…সে আর কেউ নয় মলয়।
অবচেতন মনে যেন বলে উঠলো, অরু আর বিজয়ের ছেলে অজয়। কেন তার একবারও মনে হলো না! কি করে সে অত বড় ভুল করলো? বিজু নাহয় অবুঝ ছিলো কিন্তু সে ম্যাচিওরড পার্সন হয়েও তার আবেগটাকে লক্ষ্য করলো না কি করে! ফের মনে হলো, বিধাতার বোধহয় এমনই মর্জি ছিলো… আর তাই সেসময় বিজুর অরুকে পাওয়া সম্ভব হতো না দেখেই, তার সাথে বিয়ে দিয়ে অরুকে ওর কাছাকাছি রেখে হারিয়ে যেতে দিলেন না। অরুণিমার সব বিপদাপদ, ভালো-মন্দ সময়ে তাই হয়তো পাশে ছিলো বিজয়।
কি যে নির্মল আনন্দ লাভ হয় তাদের দু’জনকে এভাবে দেখে। হাসিখুশি, প্রাণচাঞ্চল্য আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর হয়ে যেন জীবনে বেঁচে থাকার সুখ প্রকাশ করা যায় কিভাবে সে শিক্ষা দেয় এমন কিছু মূহুর্তের সাক্ষী হলো। ওদের দু’জনকে খুব মানিয়েছে। অরু তো বিজুরই ছিলো, সে-ই না মাঝে এলো। আর তাদের ছেলে অজয়সহ যে সুখী পরিবারের চিত্র সে এখন দেখছে তাতে ভালোলাগায় তার চোখে জল এসে গেলো। কিন্তু ওরা বোধহয় চাইবে না সে তাদের সামনে যাক, বিলেতফেরত মলয়ের কাছে দীর্ঘ প্রবাস জীবনে দেখে যেটা সহজে গ্রহণযোগ্য…সেটাই ওদের কাছে হবে অস্বস্তিকর। সে যে তাদের একসাথে দেখেছে আর ওদের বিয়ের কথাটা জানে সেটা বরং তাদের অজ্ঞাতই থাকুক। কারো প্রতি অভিযোগের আঙুল না তুলে, সে জানে যা সহজাত তাতো ঘটবেই প্রকৃতির নিয়মে।
মলয় আপনমনে ভাবতে লাগলো। এক টুকরো হাসির রেখা যেন দেখা গেলো তার ঠোটের কোণে। ওরা ভালো থাকুক দু’জনে…এই কামনায় সে এয়ারপোর্টের দিকে ফিরে যাবার লক্ষ্যে হোটেলে যাবার ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো। আজ রাতের ফ্লাইট ধরতে হবে তাকে, আর কখনো দেশে ফিরবে কিনা সে জানে না তবে না ফেরাই বোধহয় ভালো সকলের জন্যে। নিজের সকল অপরাধবোধ থেকে আজ যেন পুরোপুরি মুক্ত হলো, অরু আর বিজয়ের ছেলে অজয়ের জন্যে আশীর্বাদ করলো প্রাণভরে।
#সমাপ্ত
কপি করা নিষেধ, লেখা অন্যত্র ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষেধ।