মৃগতৃষ্ণা-২২,২৩

0
734

#মৃগতৃষ্ণা-২২,২৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
২২

★বলুন ভাবি আপনি মেরেছেন নাঈম কে?

–না না পঙ্খি তুমি ভুল বুজছ আমাকে। আমি কাউকে মারিনি।

–তাহলে আপনার দুল এখানে কি করে এলো? আর এটা নেওয়ার জন্য আপনি এমন চোরের মতো কেন এসেছেন? ঘটনা কি ভাবি? সত্যি সত্যি বলুন কি হয়েছে? নাহলে কিন্তু আমি সবাইকে ডাকবো।

কনিকা ভয়ার্ত কন্ঠে আকুতি মিনুতি করে বললো।
–না না পঙ্খি এমন করোনা। তোমার সামনে হাত জোর করছি আমি কাউকে কিছু বলোনা।

–ঠিক আছে তাহলে সত্যি টা বলুন আমাকে।

–বলছি। আগে এখান থেকে চলো। কেউ দেখে ফেলবে। ছাঁদে চলো সব বলছি।

কনিকা পঙ্খিকে নিয়ে ছাঁদে এলো। ছাঁদে এসে পঙ্খি বললো।
–এখন বলুন।

কনিকা একটু দম নিয়ে বলা শুরু করলো।
–আসলে পরশুদিন রাতে আমি কোন কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। বাইরে থেকে যখন ফিরি তখন দেখতে পাই নাঈম তিনতলা থেকে নামছে। আর আমিও সিড়ি বেয়ে উঠি। দুজন মুখোমুখি হয়ে যাই। দুজনেই অনেক টা ঘাবড়ে যাই। তখন আমিই প্রথমে বলে উঠি, “নাঈম তুমি এতোরাতে তিনতলায় কেন গিয়েছিলে? বাবা সবাইকে ওখানে যেতে মানা করেছে।” তখন নাঈম উল্টো আমাকে বললো, “তার আগে আপনি আমাকে বলুন আপনি এতরাতে কোথায় গিয়েছিলেন” নাঈমের প্রশ্নে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। কি বলবো বুঝতে পারিনা। নাঈম আবার বলে, “কি হলো বলুন কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? আর জুবায়েদ ভাই জানে আপনি বাইরে গিয়েছিলেন? দাঁড়ান আমি এখুনি বলছি ভাইকে” কথাটা বলে নাঈম জুবায়েদ কে ডাকার জন্য উদ্যত হয়। আমি প্রচুর ভয় পেয়ে যাই তখন। ঘাবড়ে গিয়ে নাঈমের হাত ধরে ওকে টেনে ওর নিয়ে আসি। তারপর ওর সামনে হাত জোর করে আকুতি মিনতি করে বলি। তখন নাঈম বললো “ঠিক আছে বলবোনা। তবে আপনিও কাওকে আমার তিনতলায় যাওয়ার কথা বলবেন না।” আমি নাঈমের কথায় রাজি হয়ে যাই। তারপরই ওখান থেকে চলে আসি আমি। কিন্তু ওইসময়ই হয়তো আমার কানের এখানে পড়ে যায়। আজ সকালে সেটা খেয়াল করি আমি। ওটা পুলিশের হাতে যাওয়ার ভয়ে সেটা খোঁজার জন্যই এসেছিলাম আমি। বাচ এতটুকুই। আর কিছু না সত্যি বলছি।

–ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু আপনি সত্যিই এতরাতে কোথায় গিয়েছিলেন? কি লুকাচ্ছেন আপনি?

–সেটা আমি এখন বলতে পারবোনা পঙ্খি। শুধু এতটুকু বলবো আমি কোন খারাপ কিছু করছিলাম না। প্লিজ আমার ওপর ভরসা কর। সময় হলে তোমাকে আমি সব খুলে বলবো।দয়া করে এখন তুমি কাওকে কিছু বলো না।

–কিন্তু ভাবি পুলিশকে তো এসব ইনফরমেশন দিতে হবে। তাহলে হয়তো উনাদের কেস সল্ভ করতে সুবিধা হবে।

–না না পঙ্খি পুলিশকে বললে তখন একথা জানাজানি হয়ে যাবে। আমার জীবনে ঝড় শুরু হয়ে যাবে তখন। তোমার পায়ে পড়ি তুমি কাউকে কিছু বলো না দয়া করে ।

–আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না। আপনি চিন্তা করেন না। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আপনার সাথে যখন নাঈমের দেখা হয়েছিল তখন কয়টা বাজে?

–এইতো রাত একটা বা তার একটু বেশি হবে।

পঙ্খি ভাবতে লাগলো, তখন চুমকি বললো ও যখন নাঈমকে তিনতলায় যেতে দেখে তখন বারোটার আশেপাশে হবে। আর কনিকা ভাবির কথা অনুযায়ী নাঈম একটার পর তিনতলা থেকে নেমে আসে। তারমানে তিনতলার ওই বন্ধ রুমে ওকে কেউ কিছু করেনি। ও ওখান থেকে ঠিকঠাক চলে এসেছিল। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী খু,ন দুইটা থেকে তিনটার মাঝে হয়েছে। তারমানে তিনতলা থেকে আসার পরে কেউ ওকে মেরেছে। কিন্তু কে?
___

এরমাঝে আরও চারদিন পার হয়ে গেছে। সবকিছু একটু একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। নাঈমের শোক কিছুটা কেটে উঠেছে সবাই। যদিও জাহানারার শোক কোনদিন কমার নয়। তবে আগের থেকে একটু স্বাভাবিক হয়েছে সে। কথায়ই আছে “সময় সব জখমের মলম দিয়ে দেয়।” তবে নাঈমের মার্ডা,রের ইনভেস্টিগেট এখনো জারি আছে।

রান্নাঘরে কাজ করতে নিয়ে শান্তি পাচ্ছে না পঙ্খি। পাবে কিভাবে? রান্না ঘরে আসাথেকেই বারবার ইন্ধন রুম থেকে ডেকেই যাচ্ছে ওকে। তাও অযথা। প্রতিবারই অযথা কাজের জন্য ওকে ডাকে। কখনো তাঁর মানিব্যাগ পায়না, কখনো ঘড়ি পায়না তো কখনো তাঁর চশমা পায়না। অথচ সবকিছুই ড্রেসিং টেবিলের সামনে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে এসেছে সে। তবুও শুধু শুধু পঙ্খিকে ডেকে বিরক্ত করছে ইন্ধন। এদিকে রান্নাঘরে শাশুড়ির সামনে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে ওকে। চুমকি তো দাঁত কেলিয়ে বলেই দিলো,
–ভাবি ভাইজানের মনে হয় আপনেরে ছাড়া ভাল্লাগে না। হেইজুন্যি তো বারবার ড্যাকতাছে আপনেক হি হি।
শাশুড়ী রাবেয়ার সামনে চরম লজ্জায় পড়ে গেল পঙ্খি। ইন্ধনের ওপর রাগ হচ্ছে তার। সেই রাগে চুমকিকে এক রাম ধমক মেরে দিলো সে। তবে চুমিকির ওপর ধমকের কোনো প্রভাব পড়লো বলে মনে হলো না। বরং সে আরও লাজুক হেঁসে বললো,
–আরে লজ্জার কি আছে ভাবি? জামাই রা তো এমন হরবোই। আমার কলিমও এরাম হরে। আমাক এল্লাও ছাইড়বার চায়না। খালি আঁচল টাইনা ধরে।
পঙ্খির মন চাচ্ছে এই চুমকির মুখে সুপার গ্লু আঠা লাগিয়ে দিতে। বলদি একটা। ওইদিকে ইন্ধন আবারও গলা ফাটিয়ে ডেকে যাচ্ছে পঙ্খিকে। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে পঙ্খির। রাবেয়া তখন বললো।
–পঙ্খি তুমি যাও দেখো গেদা কি কয়। রান্না আমি দেখছি।

পঙ্খি সবজি কাটছিলো। রাগের মাথায় সে হাতের চাকুটা রেখে যাওয়াও ভুলে গেল। চাকু হাতে নিয়েই ধুপধাপ করে নিজের রুমে গেল সে। ইন্ধন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখনো মনের আনন্দে পঙ্খিকে ডেকেই যাচ্ছে। পঙ্খি দাঁতে দাঁত চেপে ইন্ধনের দিকে তেড়ে আসলো। চাকু ওয়লা হাতটা ইন্ধনের সামনে ধরে তেজি সুরে বলতে লাগলো।
–কি? কি? কি হয়েছে হ্যাঁ? সমস্যা কি আপনার হ্যাঁ? এভাবে ষাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছেন কেন? কতোবার ডাকবেন? আর কি লাগবে আপনার? সবতো আপনার চোখের সামনে দিয়ে গেছি।তাও এমন গলা ফাটাচ্ছেন কেন? নিচে মায়ের সামনে আমাকে কতো লজ্জায় পড়তে হয়েছে আমাকে জানেন? আপনি কি ছোট বাচ্চা? এতো জালাচ্ছেন কেন হ্যাঁ?

পঙ্খিকে এভাবে চাকু নিয়ে তেড়ে আসতে ইন্ধন এমনিতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। তারওপর পঙ্খির এমন মুখের ওপর চাকু ঘুরানো দেখে ইন্ধন বেচারা ভয়ে পেছনে ড্রেসিং টেবিলের সাথে চেপে গেল। পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে নিয়ে ভীতু স্বরে বললো।
–আরে আরে কি করছ? এই সামান্য ব্যাপারে এতো রাগের কি আছে যে,একেবারে মা,র্ডার করতে চলে এসেছ? তোমাকে তো সহজসরল মেয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি কথায় কথায় স্বামীকে খু,ন করে ফেলবে৷ আমার তো এখন ভয় লাগছে। নাজানি কবে খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে যাই। আজকের তাজা খবর, “জালিম বউয়ের হাতে অবলা স্বামী খু,ন”।লোক সকালের চায়ের সাথে এই তরতাজা খবর পড়বে। ভাবতেই আত্মার পানি শুঁকিয়ে আসছে।এই স্বাধীন গনতান্ত্রিক দেশে একজন স্বামী আজ এতো অত্যাচারীত আর অসুরক্ষিত কেন? এ কেমন বিচার?

ইন্ধনের কথায় পঙ্খি কপাল কুঁচকে ফেললো। তারপর ওর হাতের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারলো ইন্ধন কেন এসব বলছে। চাকু ওর হাতে ছিলো এটা তো সে খেয়ালই করেনি। তবে ইন্ধনকে এভাবে ভয় পেতে দেখে মজাই লাগছে পঙ্খির। মনে মনে ভাবলো আরেকটু মজা নেওয়া যাক। পঙ্খি মিথ্যে রাগের ভঙ্গিতে বললো।
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন? আপনি আসলে জানেনই এই পঙ্খি কতো ভয়ংকর। আমাদের আশেপাশের গ্রামে যখন কারও বাচ্চা রাতে কাঁদত তখন মায়েরা বলতো,কাঁদিস না নাহলে পঙ্খি চলে আসবে। ব্যাস, সাথে সাথে বাচ্চা কান্না বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তো। ভাবেন কতো ত্রাস আমার। তাই জানের ভয় থাকলে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমার মাথা গরম হয়ে গেলে আপনার কি অবস্থা করবো তা আমি নিজেও জানি না। তাই সবসময় ভদ্রলোকের মতো শান্তশিষ্ট হয়ে থাকবেন বুঝতে পেরেছেন? এখন চুপচাপ লক্ষী ছেলের মতো তৈরি হয়ে খেতে আসুন।

কথাগুলো বলে পঙ্খি উল্টো ঘুরে দাঁড়াল। ঠোঁট টিপে হাসছে সে। আজতো ভীষণ মজা লাগছে উনাকে ভয় দেখিয়ে। হাসিমুখে যেতে নিলেই আটকা পড়ে গেল। ইন্ধন পেছন থেকে পঙ্খির হাত ধরে ফেললো। এক টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো পঙ্খিকে। পঙ্খির পিঠ গিয়ে ঠেকলো ইন্ধনের বুকে। ইন্ধন পেছন থেকে পঙ্খির পেট জড়িয়ে ধরলো। পঙ্খির কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর কন্ঠে বললো।
–আচ্ছা তাই? তা মৃ,ত ব্যাক্তিকে আর কতবার মারবে শুনি? তোমাতে মরণ তো সেই কবেই হয়ে গেছে। এখন তো আমাতে আমি বলতে কিছুই নেই। আর চাকুই বা চালাবে কোথায়? তোমার নামে চলতে থাকা এই হৃৎস্পন্দনে? নাকি তোমার বসতবাড়ি করা এই বুকে? সবখানেই তো তোমার কবজা। তাহলে চাকু চালাবে কোথা? তবুও তুমি চাইলে হাজার বার তোমার হাতে মরতে পারি।

ইন্ধনের শেষের কথায় পঙ্খি চমকে তাকালো ইন্ধনের পানে। মুহূর্তের ব্যবধানে চোখে জমে গেল পানির ভীড়। কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–কি বলছেন এসব আপনি? আমিতো শুধু মজা করছিলাম।

ইন্ধন মুচকি হেঁসে বললো।
–কিন্তু আমি মোটেও মজা করিনি। তোমার হাতে মরতে পারাও আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় তা জানো তুমি?

পঙ্খি হালকা ফোঁপাল। ইন্ধন কে ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগলো সে। ইন্ধন বুঝতে পারলো বউ তাঁর রাগ করেছে। হয়তো ওর কথায় খারাপ লেগেছে। ইন্ধন দৌড়ে এসে পঙ্খিকে আবারও পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো। পঙ্খি ইন্ধনের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে লাগলো। কান্না গলায় চেপে বললো।
–ছাড়ুন আমাকে। কাজ আছে আমার।

ইন্ধন আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো।
–আচ্ছা সরি সরি ভুল হয়ে গেছে আমার। আর কখনো এমন কথা বলবোনা। মাফ করে দাওনা বউ।

–সরি বলার কি আছে ? ছাড়ুন, আমার সত্যিই কাজ আছে।

–সরি তো। এখন কি কান ধরে উঠবস করবো? আচ্ছা তুমি বললে তাও করবো। শুধু বাইরে কাউকে যেন বলোনা হ্যাঁ? নাহলে প্রেজটিজ পানচার হয়ে যা…

ইন্ধনের কথার মাঝেই পঙ্খি আচমকা ঘুরে উঠে ইন্ধনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। পঙ্খির শরীরের কাঁপুনি বলে দিচ্ছে কাঁদছে সে। কান্নার শব্দ না এলেও ফুঁপানোর আওয়াজ আসছে। ইন্ধন বলে উঠলো।
–একটু ভুলের জন্য কি এখন এতবড়ো শাস্তি দিবে আমাকে?

কিছুক্ষণ পর পঙ্খি একটু শান্ত হয়ে এলে ইন্ধন পঙ্খির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
–তুমি কিন্তু রুলস ভঙ্গ করেছ। কান্না যে তোমার জন্য মানা মনে নেই? এখন প্যানালটি দিতে হবে কিন্তু। আমিও একটা ভুল করেছি, তুমিও একটা ভুল করলা। তো ভুলে ভুলে শোধবোধ হয়ে গেল এখন। তাই এখন কান্না বন্ধ। আর একটা মতিও যেন নিচে না পড়ে। এমনিতেও অনেক গুলো মতি অপচয় করে দিয়েছ তুমি। আর আমার জিনিসের এমন অপচয় আমি মোটেও মেনে নেবোনা।

পঙ্খি মাথা নিচু করে এখনো নাক টানছে। ইন্ধন এবার বাঁকা হেঁসে বললো।
–বুঝতে পেরেছি তুমি চুমু নিয়েই মানবে তাইতো? তো এটা বললেই তো হয়। এরজন্য এতো কান্নাকাটি করার কি আছে? আসো যতগুলো ইচ্ছে নিয়ে নাও।

কথাটা বলে ইন্ধন পঙ্খির অধরপানে এগুতে লাগলেই পঙ্খি চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠলো।
–এই না না, আমি মেনে গেছি তো। এই দেখেন আমি হাসছি হি হি.. এখন আমি যাই আমার কাজ আছে।

–আরে বললেই হলো নাকি, চুমু তো তোমাকে নিতেই হবে।

পঙ্খি আর উপায় না দেখে ইন্ধন কে ছাড়িয়ে দিলো এক দৌড়। ইন্ধন পেছন থেকে হাসতে লাগলো। বউটা ওর এত্তো কিউট কেন।
__

ছায়া ওর মায়ের রাজহাঁস গুলোকে খাবার দিচ্ছিল। তখনই পাশের বাড়ির হাফিজা এলো ওখানে। ছায়া ওকে দেখে হাসিমুখে বললো।
–আরে হাফিজা, কেমন আছিস তুই? বিয়ার পরে একেবারে ভুলেই গেছিস আমাদের। তা কবে আসলি?

–এইতো কালই আসলাম।

–দুলাভাই এসেছে?

হাফিজা লাজুক ভঙ্গিতে বললো।
–আইছিলো। আজ চইলা গেছে। এইজন্যই তো আসতে পারলাম তোর সাথে দেখা করতে।

–কেন? দুলাভাই কি তোরে কোথাও যেতে দেয়না?

–আরে না তা কেন হইবো? আসলে নতুন নতুন বিয়া হইছে তো। বুঝবারই তো পারস।

ছায়া ভ্রু কুঁচকে বোকার মতো বললো।
–কি বুঝবো? নতুন বিয়ে হলে কি বাইরে যাওয়া মানা? নাকি বাইরে গেলে নতুন বিয়ে পুরাণ হয়ে যায়?

–আরে ছেড়ি তুই এতো বলদ কেন? বুঝছ না কেন কি কইবার চাই? আসলে উনি আমাকে ছাড়তেই চায়না। সবসময় ধরে রাখে।

–কেন? তোর জামাইর কি হাত পা লুলা নাকি যে,সবসময় তোরে ধরে থাকতে হয়?

হাফিজা এবার মহা বিরক্ত হয়ে বললো।
–ধুরর, তুই আসলেই একটা বলদি। তোর সাথে কথা কওয়াই বেকার। যাই আমি গিয়া একটু চাচির সাথে দেখা করে আসি।

কথাটা বলেই হাফিজা বাড়ির ভেতর চলে গেল।বেচারি ছায়া বুঝতে পারলো না সে কি এমন বললো? তখনই পেছন থেকে পুরুষ কন্ঠে কেউ বলে উঠলো।
–ঠিকই তো বলেছে হাফিজা। তুই একটা ইন্টারন্যাশনাল বলদি। আচ্ছা একটা কথা বলতো, তুই কি জন্ম থেকেই বলদি? নাকি কোন স্পেশাল কোর্স করেছিস?

ছায় পেছনে ঘুরে দেখলো এটা শাকিল। সে তেতে উঠে বললো।
–এই এই খবরদার! বলদ বলবেননা আমাকে।

শাকিল এগিয়ে এসে বললো।
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস তোকে বলদ বলাটা বলদেরও অপমান। তারা তাও কাজের আছে। তুই তো তাদের চেয়েও অধম। নাজানি বিয়ের পর আমার কপালে কি আছে?

–আরে আজব,এখানে আপনার বিয়ের কথা কোথাথেকে আসলো? আপনার বিয়ের পর কি হবে সেটা জেনে আমি কি করবো? সেটা গিয়ে আপনার বউকে জিজ্ঞেস করুন।

শাকিল দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–এটা বুঝতে পারলে তো কথাই ছিলো। দুঃখ টা তো এখানেই। শালা যার জন্য আমি অনাহারে আছি, তাঁর কিনা এখনো টিউবলাইটই জ্বললো না। কবে সংসারের সুখ পাবো উপরওয়ালাই জানে।

–ও আচ্ছা তো এই কারণ? আগে বলবেন না? আগে বলতেই আমি সব ঠিক করে দিতাম।

শাকিল উৎসুক কন্ঠে বললো।
–তারমানে তুই বুঝতে পেরেছিস?

–হ্যাঁ, অনেক ভালো করে বুঝতে পেরেছি।

–তাহলে তুই রাজি আছিস?

–হ্যাঁ হ্যাঁ আমি রাজি। আমি কালই গিয়ে আপনার মাকে বলবো, চাচি আপনার ছেলে বিয়ে করতে চায়। আর আমাকে সেই কথা বলতে পাঠিয়েছে। আপনারা জলদি তারজন্য মেয়ে দেখা শুরু করুন। কি খুশিতো?

শাকিলের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। সে চোয়াল চিবিয়ে বললো।
–তোকে না,, মনটায় চায় একেবারে এনকাউন্টারে উড়াই দি তোরে। তুই একটা দুনিয়ার বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। বলদির নানি বলদি।

কথাটা বলে শাকিল বাসার ভেতর চলে গেল। বেচারি ছায়া আবারও ভাবনার সাগরে ডুবে মাছ হাতানোর মতো হাতড়িয়ে খুঁজতে লাগলো সে কও এমন বোকামি করলো। অতঃপর আবারও সব ফাঁকাই পেল।

শাকিল বাড়ির ভেতর এসে সবাইকে ডাক দিলো। সবাই এক এক করে বসার এসে জমা হলো। ইন্ধন বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার শাকিল? কেসের কোন আপডেট পেলি?

শাকিল নললো,
–হ্যাঁ সে কারণেই এখানে আসা। আমাদের হাতে একটা ক্লু লেগেছে। আপনাদের সবার ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে একটা ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচ হয়েছে, যা নাঈমের জামার ওপর ছিলো। হতে পারে সেই আসল খু,নি।

সামছুল মজুমদার বলে উঠলো।
–কে সে?

–সে আর কেউ না, “জুবায়েদ মজুমদার”।

শাকিলের কথায় সবাই হতবাক হয়ে গেল।

চলবে…..

#মৃগতৃষ্ণা—২৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সবার মাথায় যেন এক প্রকার বাজ পড়লো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সবাই জুবায়েদের দিকে। জুবায়েদের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান। ভয়ে মাথা ঘেমে গেছে তাঁর। সামছুল মজুমদার ছেলের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন।
–জুবায়েদ,শাকিল কি বলছে এসব? তারমানে তুমি? তুমি তোমার নিজের ভাইকে মেরেছ? কেন?

জুবায়েদ ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–না না বাবা আমি নাঈমকে মারিনি। সত্যি বলছি। আমি নিজের ভাইকে কেন মারতে যাবো? বাবা বিশ্বাস করো আমি মারিনি ওকে।

শাকিল বলে উঠলো।
–কিন্তু আপনার হাতের ছাপ তো পাওয়া গেছে। সেক্ষেত্রে সন্দেহ আপনার ওপরেই যায়। এখন সত্যি সত্যি বলুন কেন মেরেছেন নাঈম কে। দেখুন ভালোই ভালোই বললে আপনারই ভালো। নাহলে আমাদের বলাতে বাধ্য করলে সেটা খুব একটা সুখকর হবেনা আপনার জন্য। তাই নিজের অপরাধ বয়ান করুন। বলুন কেন মেরেছেন নাঈম কে?

জুবায়েদ এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো।
–শাকিল আমি সত্যি বলছি আমি নাঈমকে মারিনি। আমি আমার ভাইকে কেন মারবো?

–তাহলে আপনার হাতের ছাপ কিভাবে এলো ওর শার্টে? শুধু তাই নয়। ওর শরীরে হালকা আঘাতের লাল দাগও আছে। তারমানে তো এই দাঁড়ায় যে,আপনি ওর কাছে গিয়েছিলেন। আর হয়তো ওকে মারতে গিয়ে ওর সাথে কোন প্রকার হাতা পাই করেছেন। তখনই আপনার হাতের ছাপ লেগেছে।

–হ্যাঁ মানছি,আমি গিয়েছিলাম ওর কাছে। তবে ওকে খু,ন করতে যাইনি।

–তো কি করতে গিয়েছিলেন?

জুবায়েদ ভীতু গলায় বললো।
–আ আসলে আমি ওকে পেপার সই করাতে গিয়েছিলাম।

সামছুল মজুমদার কপাল কুঁচকে বললেন।
–কিসের পেপার?

–আমাদের পূর্ব পাড়ার ওই দুই বিঘার বড়ো জমিনের কাগজটায়। যেটা ছোটবেলায় আমাদের সুন্নাতে খাতনার সময় দাদা আমাদের দুই ভাইয়কে উপহার দিয়েছিল। ওই জমিনটায় আমার একটা ফ্যাক্টরি করার ইচ্ছা। কিন্তু দুইজনের নামে থাকায় সমস্যা ছিল। যেহেতু নাঈমকে সবাই মৃত ভেবে নিয়েছিলাম তাই আর সমস্যা থাকতো না। তবে হঠাৎ ওর ফিরে আসায় আবারও ওই চিন্তা থাকে। তাই আমি সুযোগ বুঝে রাতে ওর কাছে ওই পেপার নিয়ে যাই সই করাতে। ওকে বুঝিয়ে বলি সবটা। তবে ও বেঁকে বসে। সইতে করতে রাজি হয়না ও। আমার অনেক বলার পরও রাজি হয়না ও। কথায় কথায় রাগ উঠে যায় আমার। তখন ওর সাথে একটু হাতাহাতি হয় আমার। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তখন চলে আসি ওর কাছ থেকে। ব্যাচ এতটুকুই হয়েছিল। আর কিছু না। সত্যি বলছি।

সামছুল মজুমদার হঠাৎ এগিয়ে এসে জুবায়েদের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে দিয়ে বললো।
–লজ্জা করে না তোর? এতো লোভ তোর? ছেলেটা ফিরতে না ফিরতেই তুই নিজের কার্য সিদ্ধি করতে গেছিস? তোর সাহস কি করে হলো এতবড় বেইমানি করার?

জাহানারাও ছেলের এমন কাজে আহত হলেন। দুঃখ প্রকাশ করলেন খুব । শাকিল আবার বললেন।
–আচ্ছা তখন টাইম কতো ছিলো?

–রাত ১২ টার আগে হবে।

–হুম ঠিক আছে। আপাতত আপনার কথা মানলাম। তবুও থানায় এসে আপনাকে একটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট দিতে হবে। আজকের মতো আসি তাহলে। দরকার হলে আবার আসবো।
__

আরও একটি সপ্তাহের ইতি ঘটলো। নাঈমের কেসে আর তেমন নতুন কোন আপডেট হয়নি। ধীরে ধীরে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। জাহানারাও এখন অনেক টা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যদিও তার ক্ষত কখনো পুরণ হবার নয়। তবুও সময়ের সাথে সবকিছু সয়ে যায়।সেও সংসার জীবনে নিজেকে ব্যাস্ত করতে শুরু করেছে।

পঙ্খি তৈরি হচ্ছে কলেজে যাওয়ার জন্য। আজ পরিক্ষার সাজেশন দেওয়ার কথা আছে। তাই আজ কলেজে যাচ্ছে সে। যদিও এখন তার কলেজে যাওয়া নিয়ে আর কোন শর্তের বেড়াজালে থাকতে হয়না। এখন যে সে আর আগের জীবনে নেই। সে এখন ইন্ধনের রাজরানী। ইন্ধন বলে দিয়েছে, পঙ্খি চাইলে রোজই কলেজে যেতে পারে। এখন আর কোন বাঁধা নেই তাঁর। তবুও পঙ্খি রোজ যায়না। শুধু জরুরি কিছু হলেই যায়। তৈরি হয়ে বাইরে রাস্তায় এসে সিএনজি দাঁড় করানো দেখতে পেল। ইন্ধনই ওর জন্য ঠিক করে দিয়ে গেছে। সিএনজির দিকে যেতে নিলেই হঠাৎ পঙ্খি সেই বয়স্ক মহিলাকে আবারও দেখতে পেল। সামনের বটগাছের পেছন থেকে ওদের বাড়ির দিকে উঁকি দিচ্ছে। আজ তো এই মহিলাকে ধরেই ছাড়বে সে।পঙ্খি চুপিচুপি অন্য দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে মহিলার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পেছন থেকে খপ করে মহিলার হাত চেপে ধরলো। মহিলাটি চমকে উঠে পেছনে ঘুরে তাকালো। পঙ্খির কাছ থেকে ছোটার চেষ্টা করলো সে। পঙ্খি শক্ত করে ধরে থেকে বললো।
–আজ পালাতে পারবেন না আপনি। আগে বলুন কে আপনি?আর এভাবে চোরের মতো এখানে এসে কি দেখেন? কি করতে চান আপনি? সত্যি করে বলুন।নাহলে কিন্তু পুলিশে দিবো আপনাকে। বলুন আপনার উদ্দেশ্য কি? দেখুন আমি এই বাড়ির বউ। আর আমি থাকতে এই বাড়ির কোন ক্ষতি হতে দেবনা আমি।

পঙ্খির শেষের কথায় মহিলাটি বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে বললো।
–বউ? তুমি এই বাড়ির বউ? কার বউ?

–জহির মজুদারের ছেলে,ইন্ধন মজুমদারের বউ আমি ।

পঙ্খির কথায় মহিলাটির মুখভঙ্গি কেমন বদলে গেল। কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো সে পঙ্খির পানে। চোখের ভাষায় কেমন মায়া দেখতে পেল পঙ্খি। মহিলাটি এক হাত পঙ্খির গালে আলতো করে রেখে বললো।
–তুমি জহিরের বেটার বউ? হত্যি কইতাছাও?

–জ্বি। কিন্তু আপনি বলুন এখানে রোজ রোজ কি করতে আসেন আপনি? আর ডাক দিলে পালিয়ে যান কেন? উদ্দেশ্য কি?

মহিলাটি মলিন হেঁসে বললো।
–ভয় পাইও না। আমি এহেনে চুরি করতে আসিনাই।

–তাহলে কেন আসেন?

–সেডো তো কইবার পারমু না আমি। তয় তোমাক একখান কথা কই ভালো কইরা হুইনা রাহো। তোমার স্বামীর উপর অনেক কালো ছায়া ভর করে আছে। হের আশেপাশে শত্রুর মেলা। এই শত্রু কোন বাইরের কেউ না। নিজেরই কেউ। ওঁৎ পাইতা বইসা আছে। সুযোগ পাইলেই তোমার স্বামীরে মাইরা ফালাইবো। তুমি চোখ কান খোলা রাইখো।কারোর ওপর বিশ্বাস করবা না। তোমার স্বামীর সুরক্ষা তোমার হাতে। নিজের স্বামীরে রক্ষা করো।

মহিলাটির কথায় থমকে গেল পঙ্খি। সে বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–কি বলছেন এসব? কে মারবে তাঁকে?

–এডো তো কইবার পারমু না। তুমি সময় হইলেই জইনা যাইবা।

হঠাৎ পেছন থেকে সিএনজি ড্রাইভার পেছন থেকে ডেকে উঠে বললো।
–ভাবি যাইবেন না? দেরি হইয়া যাইতাছে তো।

পঙ্খি পেছনে তাকিয়ে বললো।
–এইতো আসছি। আর পাঁচ মিনিট দাঁড়ান।
কথা শেষ করে সামনে তাকাতেই দেখলো সেই মহিলা আর নেই। চমকে গেল পঙ্খি। ভুতের মতো মুহুর্তেই কোথায় চলে গেল সে? আর কি বলছিল এসব? উনার জীবনের ওপর সংকট আছে? কেউ উনাকে মেরে ফেলতে চায়? কথাগুলো ভাবতেও যেন হৃদয় থমকে যাচ্ছে পঙ্খির। মহিলা কি সত্যি বলছিল? কিন্তু কে মারতে চায় উনাকে? মহিলাটি তো নাম বলে গেলনা। এসব যদি সত্যি হয় তাহলে কি করবো আমি? কিভাবে রক্ষা করবো উনাকে? ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল পঙ্খির।মহিলাটির কথা বারবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।ইন্ধনের কিছু হলে বাঁচবে কিভাবে ও? না না ইন্ধন কে ও কিছু হতে দিবেনা। কিছু না।

সিএনজিতে বসেও মাথায় শুধু ওই মহিলার বলা কথাই চলছে। মন অশান্ত হয়ে উঠছে পঙ্খির।হঠাৎ ইন্ধনের চিন্তায় মন ভারী হয়ে উঠছে। আজ সকাল সকালই বের হয়েছে সে। বললো নির্বাচনের জন্য প্রচার সবামেশ আছে আজকে। যাওয়ার পর আর একবারও ফোন করেন সে। এই সাধারণ ব্যাপার টাও যেন কেমন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল পঙ্খির কাছে। সে দ্রুত ফোন বের করে ইন্ধনের নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু ইন্ধনের ফোন রিসিভ হলোনা। ভয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। অশান্ত মনে এলোমেলো দুশ্চিন্তা এসে হানা দিতে লাগলো। বারবার মহিলার কথাই মনে পড়তে লাগলো। ওর রাজপুত্র ঠিক আছে তো? ফোন কেন ধরছে না? কিছু হলো নাতো?

ভাবনার মাঝেই হঠাৎ পঙ্খি দেখলো রাস্তার পাশে স্কুল মাঠে বিশাল সমাবেশ। ইন্ধনের সমাবেশ তো এখানেই হওয়ার কথা। কথাটা মনে আসতেই পঙ্খি দ্রুত চালককে সিএনজি থামাতে বললো। সিএনজি থামলে পঙ্খি চালককে বললো।
–চাচা আমি দুই মিনিট পরেই আসছি। আপনি একটু অপেক্ষা করেন।

পঙ্খি দ্রুত পায়ে ভীড়ের দিকে এগিয়ে গেল। ইন্ধনকে সহিসালামত না দেখা পর্যন্ত ওর শান্তি হবে না। তাই ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল সে। ভীড় ঠেলে কিছুদূর এগুতেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তির দেখা পেল সে। বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো পঙ্খি। হ্যাঁ ওর ইন্ধন সহিসালামত আছে। ওইতো মঞ্চে মাইকের সামনে ভাষণ দিচ্ছে সে। কতো সুন্দর হাসিমাখা মুখটা তাঁর। সকালে পঙ্খির দেওয়া কালো পাঞ্জাবি টা পড়েছে। পাঞ্জাবির বোতাম গুলো নিজের হাতে লাগিয়ে দিয়েছিল সে। তাঁর সুদর্শন স্বামী টা এই পাঞ্জাবিতে আরও সুদর্শন লাগছে। কতো সুন্দর করে বক্তৃতা দিচ্ছে। গ্রামবাসীর নানান উন্নয়নের কথা বলছে সে। জনসমাগম দেখে বোঝা যাচ্ছে তাকে লোকজন অনেক পছন্দ করছে। করবেই নাই বা কেন। সে যে মানুষ টাই এমন। পঙ্খি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে দেখছে তাঁর রাজপুত্রকে। পঙ্খি ভাবছে ইন্ধন হয়তো ওকে দেখেনি। তবে তার ধারনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিলো ইন্ধনের পরবর্তী কাজে। ইন্ধন বক্তৃতা প্রদানের মাঝেই সুকৌশলে পঙ্খির দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপ মেরে দিলো। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো পঙ্খি। লাজুকভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো কেউ দেখেছে কিনা। তবে ইন্ধনের এই দুষ্টুমি পঙ্খি ব্যাতিত কেউই ধরতে পারেনি। পঙ্খি মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো। লোকটা সত্যি খুব দুষ্টু।

ইন্ধন কে দেখে পঙ্খির মনের অশান্তি অনেক টা কমে গেছে। এবার সে শান্ত মনে আবারও ফিরে যেতে লাগলো। ভীড় এড়িয়ে বাইরে আসতে নিলেই হঠাৎ কারোর উচ্চস্বরে আওয়াজ শুনতে পেল। কেউ একজন ভীড়ের মাঝ থেকে কেু বলে উঠলো।
–আরে ভাই এতো মেহনতের কি দরকার? আমাদের সব ভোট আপনার। শুধু বদলে আপনার বউকে এক রাতের জন্য আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন।

এমন বিশ্রী কথা শুনে থমকে গেল পঙ্খি। পেছনে ঘুরে ইন্ধনের দিকে তাকাতেই ওর আত্মা উড়ে গেল ওর। ততক্ষণে ইন্ধন ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। চোখে মুখে রক্ত জমে গেছে তার। সে স্টেজ থেকে এক লাফে নিচে নেমে এলো। দৌড়ে তেড়ে গেল সেই কুকথা বলা ছেলেটার দিকে। ছেলেটাও পালানোর চেষ্টায় দৌড় দিলো। কিন্তু ইন্ধনের থাবা থেকে বাঁচতে পারলোনা সে। ইন্ধন ভীড়ের মাঝেই দৌড়ে গিয়ে ছেলেটিকে ধরে ফেললো। তারপর আর কি! মাথায় রক্ত উঠে যাওয়া ইন্ধনের হাত থেকে এখন ছেলেটাকে আর ছাড়ানো অসম্ভব।অনেক লোক মিলেও ইন্ধন কে সরাতে পারছেনা। এদিকে কিছুলোক ভীড়ের মাঝে এসে সবার সাথে মারপিট শুরু করে দিলো। মুহুর্তেই যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হলো জায়গাটা। দুই দলের মাঝে তুমুল দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। পঙ্খির ভয়ে হাত পা জমে গেল। হঠাৎ যেন বোধশূন্য হয়ে পড়লো সে। মাথায় শুধু ইন্ধনের চিন্তা তাঁর। সে দাঙ্গার মাঝে পাগলের মতো ইন্ধন কে খুঁজতে লাগলো। মারামারির মাঝে সে কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। অন্য দলের লোকেরা এলোমেলো ভাবে ইট পাটকেল আর কাচের বোতল ছুঁড়ে মারছে। পঙ্খির হাত পা থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঘুরছে তাঁর। কোথায় ইন্ধন? ওর কিছু হলো নাতো? এই ভাবনাগুলোই মেরে ফেলছে তাঁকে। সংঘর্ষের মাঝেই ছুটছে ইন্ধনকে খুঁজতে। একটু পরে দেখতে পেল ইন্ধন কে। সে এখনো ওই ছেলেটাকে উন্মাদের মতো মেরেই যাচ্ছে। র,ক্তে জর্জরিত হয়ে গেছে ছেলেটার পুরো শরীর। পঙ্খি উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে বললো।
–ইন্ধনননন…………

ইন্ধনের হাত এবার থামলো। চমকে তাকালো সে পঙ্খির পানে। এই দাঙ্গার মাঝে পঙ্খিকে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। ওতো ভেবেছিল পঙ্খি চলে গেছে। চারদিক থেকে কাচের বোতল ছুঁটে আসছে। ইন্ধন এবার ছেলেটাকে ফেলে পঙ্খির পানে দৌড়ে এলো। পঙ্খির কাছে এসে অস্থির কন্ঠে বললো।
–তুমি এখনো এখানে কি করছ? যাওনি কেন?

পঙ্খি অতিরিক্ত ঘাবড়ে যাওয়ার দরুন কিছু বলতেই পারছেনা। ইন্ধন দেখলো পঙ্খির দিকে কেউ কাচের বোতল ছুঁড়ে মারলো। ইন্ধন দ্রুত বেগে পঙ্খিকে টান দিয়ে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়লো। যার ফলে বোতল টা এসে ইন্ধনের পিঠে লাগলো। পঙ্খির হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল।সে আতঙ্কিত হয়ে দুই হাতে ইন্ধনের মুখ ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–কককি হয়েছে আপনার?

–কিছু হয়নি আমার। ঠিক আছি আমি। আগে চলো এখান থেকে বের হই।

পঙ্খি ইন্ধনের পিঠে হাত লাগাতেই দেখতে পেল পিঠ র,ক্তে ভিজে গেছে। ওর হাতের সাথে র,ক্ত লেগে আছে। র,ক্ত মাখা হাতের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠলো পঙ্খি। হাতটা তাঁর থরথর করে কাঁপছে। কণ্ঠনালী যেন চিপে ধরেছে কেউ। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে বললো।
–র র র,ক্ত….

ইন্ধন পঙ্খিকে শান্ত করার জন্য বললো।
–রিলাক্স পঙ্খি। এটা কিছুই না। আগে আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে।

পঙ্খির কানে যেন কোন আওয়াজ ঢুকছে না। কেমন যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়লো সে। শুধু তাঁর হাতে লাগা ইন্ধনের র,ক্তের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ইন্ধন পাশ থেকে হাতে একটা লাঠি উঠিয়ে নিলো। এক হাতে পঙ্খিকে আগলে নিলো,আরেক হাতে লাঠি নিয়ে সামনের সব আক্রমণকারীকে প্রতিহত করে ধীরে ধীরে সংঘর্ষের মধ্য থেকে বেড়িয়ে এলো তাঁরা।

দূর থেকে এসব দেখে বিশ্ব জয়ের হাসি দিলো জুবায়েদ। সে পরিকল্পনায় সফল হয়ে গেছে। এবং সামনেও যা প্ল্যান করেছে তাই হবে। ইন্ধন কে তো পরাজিত করেই ছাড়বে সে।
__

বিছানায় শুয়ে আছে ইন্ধন। ডাক্তার এসে তাঁকে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গেছে। তার শিয়রে দুই পাশে দুই রমনী অশ্রু বিসর্জন করে নদী নালা বানিয়ে দিচ্ছে। একজন জননী, আরেকজন তাঁর স্ত্রী। ইন্ধন এদের কান্ড দেখে মুচকি হেঁসে বললো।
–তোমাদের দুজনের মাঝে কান্নার কোন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে? মানে যে যতো বেশি কাঁদতে পারবে সে ফাস্ট প্রাইজ পাবে? এমন কিছু হলে বলে দাও। তোমাদের দুজনকেই বিজয়ী ঘোষণা করে দিলাম। শুধু বিজয়ী না।একেবারে গোল্ড মেডেল দিয়ে দিলাম। তবুও দয়া করে কান্না বন্ধ করো। এই সামান্য আঘাতের চেয়ে তোমাদের চোখের বন্যাতেই তো আমাকে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে।

রাবেয়া আঁচলে নাক মুছে বললো।
–সবকিছুই তোর কাছে মজা তাইনা? তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করতাম? তুই ছাড়া আর কে আছে আমার? মায়ের কান্না তোর কাছে বন্যা মনে হয়?

–আচ্ছা বাবা হয়েছে তো। এখন একটু থামোনা প্লিজ। আমি ঠিক আছি তো।

–আচ্ছা তুই আরাম কর। আমি তোর খাওয়ার জন্য কিছু নিয়ে আসি।

রাবেয়া চলে গেলেন। ইন্ধন এবার পঙ্খির পানে তাকিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো। পঙ্খি কাল বিলম্ব না করে ইন্ধনের বুকে আলতো করে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো। ইন্ধন পঙ্খির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
–তুমি কিন্তু রুলস বারবার ভেঙেই যাচ্ছো। এটা কিন্তু ঠিক না পঙ্খি।

পঙ্খি জানে ইন্ধন এসব ওর মন ভালো করার জন্য বলছে। কিন্তু ওর মন যে এসবে ভুলছে না। ওর মাথায় চলছে ওই মহিলার কথাগুলো।আজকের এই ঘটনার পর যেন ওই মহিলার কথাগুলো আরও বেশি অশান্ত করছে ওঁকে। ওর ইন্ধনের ওপর কি সত্যিই কোন কালো ছায়া আছে? আমি কিভাবে সেই ছায়া দূর করবো?

হঠাৎ নিচ থেকে উচ্চস্বরে কেউ ইন্ধনের নাম ধরে ডাকলো। ডাক শুনে দুজনেই একটু হকচকিয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে ইন্ধন পঙ্খিকে নিয়ে বাইরে এলো। বাইরে শাকিলকে দেখে ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কিরে তুই হঠাৎ?

–আসলে যে ছেলেটাকে তুই মেরেছিস তার পরিবার তোর নামে কেস করেছে। ছেলেটার অবস্থা ক্রিটিকাল। তোকে আমার সাথে যেতে হবে।

শাকিলের কথায় যেন পঙ্খির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। রাবেয়াও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ইন্ধন ওদের শান্ত না দিয়ে বললো।
–আরে কাঁদছ কেন? রাজনীতি করতে গেলে এসব হবেই।তোমরা চিন্তা করোনা। কিছু হবেনা আমার।

ইন্ধন এগুতে নিলেই পঙ্খি হাত টেনে ধরলো। ইন্ধন তাঁকেও চোখের ইশারায় শান্তনা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল শাকিলের সাথে। পঙ্খি ধপ করে নিচে বসে পড়লো। তার ইন্ধনের ওপর যে সত্যি কালো ছায়া নেমে এসেছে। এখন কিভাবে সে বাঁচাবে তাঁকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here