#মৃগতৃষ্ণা-২৭,২৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
২৭
★আবারও নেত্রপল্লব মেলে তাকিয়ে সেই ব্যাক্তিটাকেই দেখতে পেল পঙ্খি। যাঁর চোখে মুখে রাজ্যের ভীতি নেমে এসেছে। পঙ্খির হাত মুঠোয় ধরে নিয়ে আশঙ্কিত হয়ে বসে আছে। কেমন বিধ্বস্ত পাগলের মতো লাগছে তাঁকে। পঙ্খির চোখ মেলে তাকানো দেখেই ইন্ধন উদ্বেগ হয়ে অস্থির কন্ঠে বললো।
–ঠিক আছ তুমি? কেমন লাগছে এখন?
পঙ্খির মনে পড়লো তখনকার কথা। সে ঠাস করে উঠে বসে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–ও ওসব কি ছিল? ওটা কি সত্যিই দেখেছি আমি?নাকি আমি কি কোন স্বপ্ন দেখেছি? বলুন কি হয়েছে আমার সাথে?
ইন্ধন দুই হাতে পঙ্খির মুখটা আগলে নিয়ে বললো।
–হুঁশ হুঁশ, শান্ত হও আগে। আমি বলছি। তার আগে তুমি বলোতো কাল রাতের কথা কি মনে আছে তোমার?
পঙ্খি মনে করার চেষ্টা করে বললো।
–কাল রাতে যখন আমি পানি আনতে বাইরে গিয়েছিলাম। তখন হঠাৎ পিছে থেকে কে যেন আমার মুখে রুমাল চেপে ধরে। তারপর আর কিছু মনে নেই। এরপর যখন চোখ খুললো তখন ওইসব দেখতে পেলাম। আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
–সবটা তো আমিও ভালো করে বুঝতে পারছিনা। আসলে কাল রাত তিনটার দিকে আমার বাথরুমের প্রেসার আসে। তখন ঘুম ভেঙে যায় আমার। কিন্তু বিছানায় তোমাকে না দেখে ঘাবড়ে যাই আমি। ওয়াশরুম, ব্যালকনি কোথাও তোমাকে না পেয়ে মাথা ঘুরে ওঠে আমার। বাইরে এসেও পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে থাকি তোমাকে। বাড়িতে কোথাও তোমাকে না দেখে আরও পাগল হয়ে যাই আমি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কোনকিছু না ভেবে বাইক নিয়ে তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়ে পড়ি। অনেকক্ষণ খোঁজার পর হঠাৎ একটা জঙ্গলের সামনে জুবায়েদ ভাইয়ের গাড়ি দাঁড় করানো দেখতে পাই আমি। তখন সন্দেহ হয় আমার। বাইক থামিয়ে জঙ্গলের ভেতর যাই আমি। কিছুটা যেতেই তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি আমি। তোমাকে ওই অবস্থায় দেখেই হৃৎস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। ছুটে গিয়ে তোমার মাথাটা দুই হাতে তুলে তোমাকে ডাকতে থাকি।মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখি কনিকা ভাবি চা,কু হাতে নিয়ে বসে আছে। আর নিচে জুবায়েদ ভাইয়ের র,ক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। ওসব দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। ভাবির কাছ গিয়ে অনেক বার জিজ্ঞেস করি কিভাবে কি হলো?উনি কেন করলেন এটা? কিন্তু ভাবি সেই তখন থেকেই পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। কিছুই বলছে না। আমি হতবিহ্বল হয়ে তখন বাড়ির লোককে ফোন দেই। তারপর বাড়ির লোক ছুটে যায় ওখানে। ধীরে ধীরে ভোরের আলোও ফুটে ওঠে। লোকজন ভীড় করতে থাকে। খবর পেয়ে শাকিলও পুলিশ নিয়ে চলে আসে। এখন বর্তমানে জুবায়েদের লা,শ বাড়িতে আনা হয়েছে।
সব শুনে থমকে গেল পঙ্খি। এসব কি হচ্ছে ওর সাথে? একের পর এক খু,ন। আর কাল ওকে কে অজ্ঞান করলো? আর ওখানেই বা কিভাবে পৌঁছাল?
__
একটু পরে পঙ্খির শরীর মোটামুটি ঠিক হওয়ায় ইন্ধন পঙ্খিকে ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে এলো। পঙ্খিই আসার জিদ করছিল। আসলে সবকিছু না জানা পর্যন্ত তাঁর শান্তি হবে না। বাইরে আসতেই দেখতে পেল কান্না আর আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। জুবায়েদের লা,শ কাপড়ে মুড়িয়ে উঠোনে রাখা হয়েছে। হাজারো মানুষের ভীড় জমে গেছে এতক্ষণে। এবাড়িতে যেন একের পর এক লা,শ দেখার প্রথা শুরু হয়ে গেছে। জাহানারা তো একটু পর পরই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ছে। এক ছেলের শোক যেতে না যেতেই তাঁকে আরেক ছেলের এমন ভয়াবহ মৃ,ত্যু দেখতে হলো। একজন মায়ের জন্য এরচেয়ে বড়ো ক্ষতি আর কি হতে পারে। খোদেজাও আহাজারি করছে আর কনিকা ভাবিকে অকথ্য ভাষায় গা,লিগা,লাজ করে যাচ্ছে। তবে কনিকা ভাবির কোন প্রতিক্রিয়া নেই। সে পাথরের মতো নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে। শাকিল পুলিশ নিয়ে এসেছে। হয়তো কনিকা ভাবিকে ধরে নিয়ে যাবে। এসব ভাবতেই অন্তর কেঁপে উঠল পঙ্খির। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর। বাড়িতে যেন সত্যিই কোনো কালো ছায়া নেমে এসেছে।
পঙ্খিকে এগিয়ে আসতে দেখে খোদেজা এবার পঙ্খিকেও যা তা বলা আরাম্ভ করলো। তাঁর মতে এই ছেড়িই সব দুর্ভোগের কারণ। সব যেন ওর কারণেই হচ্ছে। তবে পঙ্খি সেসব গায়ে লাগালো না। শোকের সময় যা বলছে বলুক। শাকিল পঙ্খির সামনে এসে বললো।
–ভাবি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।
–জ্বি বলুন।
ইন্ধন, পঙ্খি আর শাকিল ভেতরে এসে সোফায় বসলো। এরপর পঙ্খি শাকিলকেও সবটা খুলে বললো। সব শুনে শাকিল বললো।
–হুম, তারমানে আপনাকে কেউ অজ্ঞান করে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কে নিয়ে গিয়েছিল? জুবায়েদ নাকি কনিকা ভাবি? নাকি অন্য কেউ? এসবের উত্তর তো এখন কনিকা ভাবিই দিতে পারবে। কিন্তু উনিতো মুখই খুলছে না। একদম পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। দেখুন হাজতে নিয়ে গেলে তখন কিন্তু তাঁর মুখ খোলাতে আমাকে না চাইতেও অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তাই ভাবি যদি এখুনি সবটা খুলে বলে তাহলে আমাদের সবার জন্য মঙ্গলকর হবে। একটু পরে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট এসে জুবায়েদের লা,শ নিয়ে যাবে পোস্ট মরটামের জন্য। তারপর কিন্তু আমারও কনিকা ভাবিকে নিয়ে যেতে হবে।
পঙ্খি মিনতির সুরে বললো।
–না না ভাইয়া এমন করবেন না। আমাদের আরেকটু সময় দিন। আমি একটু চেষ্টা করি। দেখি ভাবি কথা বলে নাকি? আমার মন বলছে ভাবি এমন কাজ করতে পারে না। নিশ্চয় এখানে অন্য কোন কাহিনি আছে।
–ঠিক আছে ভাবি। যদিও এটা নিয়মের বাইরে। তবুও আপনাদের জন্য আরও কিছুটা সময় দিলাম। দেখুন কনিকা ভাবির মুখ খোলাতে পারেন কিনা।
ঘন্টাখানিক পর জুবায়েদের লা,শ পোস্ট মরটামের জন্য নিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে বাড়ির ভীড়ও কমে গেল অনেক টা। পরিস্থিতি কিছুটা অনূকূলে আসলে কনিকাকে ধরে বসার ঘরে নিয়ে আসা হলো। সে এখনো অনুভূতিহীন হয়ে বসে আছে। চোখের পলকও যেন পড়ছে না। ধীরে ধীরে পরিবারের বাকি সদস্যরাও এসে বসলো ওখানে। জাহানারাকেও কোনরকমে ধরে ওখানে নিয়ে আসা হলো।শাকিলও সামনের সোফায় এসে বসলো কনিকার বয়ান রেকর্ড করতে। সবাই এখন কনিকার মুখ খোলার অপেক্ষা করছে। পুরো ঘটনা টা জানতে চাইছে সবাই। এতক্ষণ অনেকেই অনেক ভাবে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছে। এননকি হুমকি ধামকিও দিয়েছে তবুও কোন প্রতিক্রিয়া দেখান নি। এবার পঙ্খিই শেষ ভরসা। পঙ্খি আস্তে করে কনিকার পাশে এসে বসলো। কনিকার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। কনিকার মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো পঙ্খি। তারপর মায়াভরা কন্ঠে বললো।
–কি হয়েছে ভাবি? আমাকে বলবেন না? আমিতো আপনার ছোটবোন তাইনা? আমাকে বলুন কি হয়েছে। আমি আছি আপনার পাশে।
কনিকার চেহারায় এবার কিছুটা প্রতিক্রিয়া ঘটলো। সে পঙ্খির পানে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ অস্বাভাবিক সুরে বলে উঠলো।
–আমি কেন মারতে পারলাম না ওকে? ওর মৃত্যু তো আমার হাতে ছিলো তাইনা? তাহলে অন্য কেউ কেন মারলো ওকে?
কনিকার কথায় চমকে উঠলো সবাই। পঙ্খি বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–তারমানে কি আপনি মারেন নি ভাইয়াকে?
কনিকা একইভাবে বলতে লাগলো।
–কেন পারলাম না ওকে মারতে? ওই জানো,য়ার টার মওত তো আমার হাতে লেখা ছিল। ওই সু**** বা**** জান তো আমি কবজ করবো। তাহলে কেন পারলাম না? কেন ওর কলিজা চিঁড়ে জান টা বের করে নিতে পারলাম না আমি? কেন আমার হক টা অন্য কেউ নিয়ে নিলো? কেন? কেন?
কনিকার কথাগুলো সবার মাঝে যেন বিস্ফোরক সৃষ্টি করলো। সবাই কেমন হতবাক হয়ে গেল। মৃত ছেলেকে নিয়ে এমন কথা শুনে সামছুল মজুমদার ক্ষেপে গেলেন। তিনি গর্জে উঠে কনিকার উদ্দেশ্যে বললেন।
–বৌমা… তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। কি আবোল তাবোল বলে যাচ্ছো এসব? নিজের স্বামীর সম্বন্ধে এসব বলতে লজ্জা করে না তোমার?
কনিকা ঠাস করে উঠে দাঁড়িয়ে সামছুল মজুমদারের পানে তাকালো। মুহূর্তেই যেন ভয়ংকর রণচণ্ডী রুপ ধারণ করলো কনিকা। চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। কনিকার এমন চাহুনি দেখে সামছুল মজুমদারও একটুর জন্য ঘাবড়ে গেলেন। কনিকা গলার স্বর উঁচু করে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো।
–লজ্জা? কিসের লজ্জা হ্যাঁ? কিসের লজ্জা? লজ্জাতো আপনাদের করা উচিত। এমন কুলাঙ্গার, নিকৃষ্ট সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য আপনাদের লজ্জা করা উচিত। লজ্জা করা উচিত এমন সন্তানের বাবা মা হওয়ার জন্য।
–বৌমা.. বেয়াদবির একটা সীমা আছে। কি এমন করেছে আমার ছেলে যার জন্য এসব বলছ তুমি?
–কি করেছে? কি করেনি তাই বলেন।আপনারা কখনো খবর রাখেন আপনার ছেলের? কখনো জানার চেষ্টা করেছেন আপনার ছেলে, বৌমা কেমন আছে? তাদের সংসার কেমন চলছে? করেন নি। করলে জানতে পারতেন আপনার ছেলের সব কুকৃত্তির কথা। জানতে পারতেন যে মেয়েটাকে আপনারা আপনাদের ছেলের গলায় বেঁধে দিয়েছেন তাঁর দুর্দশার কথা। আপনারা কি জানেন আপনার ছেলে আমার ওপর কি পরিমাণ শারীরিক আর মানুষিক অত্যা,চার চালিয়েছে? বিনা অপরাধে দিন রাত মারপিট করেছে আমাকে। পশুর মতো নির্যা,তন চালিয়েছে আমার ওপর। সেসব তো কিছুই না। আপনারা জানেন আপনার ওই কুলাঙ্গার ছেলে তিন তিনবার আমার গর্ভপাত করিয়েছে? আমার গর্ভের অনাগত সন্তানকে খুন করেছে সে। আমি কতো তাঁর হাতে পায়ে ধরেছি তবুও দয়া করেনি। শুধুমাত্র সে বাবার দায়িত্ব পালন করতে চায়না সেই কারণে। সে এখনি বাবার পদে যেতে চায়না। নিজেকে সে জোয়ান রাখতে চায় সে কারণে। তাই সে তাঁর নিজের সন্তান কে নিজ হাতে খু,ন করেছে।
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো কনিকা। কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লো সে। পরিবারের সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল কনিকার বয়ানে। পঙ্খি কনিকার কাছে এসে তাঁর কাঁধ ধরে বসে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। সামছুল মজুমদার এবারে বললেন।
–তো তোমার সাথে এতকিছু হয়েছে সেটা তুমি কাওকে বলোনি কেন? না বললে কি করে জানবো আমরা। তোমাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কি চলছে সেটা আমরা কিভাবে জানবো। তুমি কখনো বলেছ কাউকে?
কনিকা চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো ।
–বলার কথা বলছেন? বলেছিলাম না? আম্মাকে জিজ্ঞেস করেন বলেছিলাম কি না? প্রথম প্রথম যখন মারতো তখন আমি আম্মাকে বলেছিলাম। তিনি তার ছেলেকে হয়তো একটু বুঝিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কি হলো? উল্টো তাঁর নির্যাতন আরও বেড়ে গেল। তাঁর অভিযোগ দেওয়ায় সে আরও শাস্তি দিলো আমাকে। তাহলে কি করবো আমি? নিজের মা বাবাকে বললাম, তারা বলে ঘর সংসারে এমন নাকি হয়েই থাকে মানিয়ে নিতে হয়। তাহলে আর কার কাছে যাবো আমি? তাই ধীরে ধীরে তাঁর অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা আমার। আচ্ছা মানলাম আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারে আপনারা জানতে পারেন নি। কিন্তু আপনার ছেলের বাইরের কুকর্মও কি কখনো বুঝতে পারেন নি আপনি? আপনার ছেলে যে জঘন্য একটা চরিত্রহীন, মা,গিবাজ লোক তাও কি কখনো টের পাননি আপনি। সে দিনের পর দিন পরনারীতে মজে থাকে সেটা বুঝতে পারেন নি কখনো। শুধু তাই না। তাঁর কু নজর থেকে তাঁর নিজের ছোট ভাইয়ের বউকেও ছাড় দেয়নি সে।
এই কথার শোনার সাথে সাথে বিরাট একটা ধাক্কা খেল পঙ্খি সহ বাকি সবাই। কনিকা পঙ্খির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো।
–হ্যাঁ পঙ্খি ওই জঘন্য লোকটার কু নজর তোমার ওপরেও ছিলো। সেদিন রাতে তোমাকে যে ছুঁয়েছিলো সেটা ওই নিকৃষ্ট লোকটাই ছিলো। আমি সেদিন দেখে ফেলেছিলাম তাঁকে। কিন্তু সেদিন কিছু বলার সাহস পাইনি। তবে যেদিন আমার তৃতীয় সন্তান কে সে খু,ন করলো সেদিনই আমি মনে পণ করে নিয়েছিলাম ওই লোকের মওত আমার হাতেই হবে। বাচ শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আর কাল সেই সুযোগ টা পেয়ে যাই আমি। কোন কারণে আমি বাইরে আসতেই দেখি জুবায়েদ পঙ্খিকে অজ্ঞান করে ওকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝে যাই সে কি করতে চাচ্ছে। তাই রান্না ঘর থেকে ধারালো ছু,রি টা নিয়ে আমিও বেড়িয়ে পড়ি।
এতটুকু শুনেই যেন শিউরে ওঠে পঙ্খি। সারা শরীর ঘৃণায় গুলিয়ে ওঠে তাঁর। যাকে সে এতো ভালো লোক ভাবছিলো। বড়ো ভাইয়ের মতো সম্মান করতো সেই লোক কিনা এতো খারাপ? আমাকে সে….. ছিহ্হ। পঙ্খির হঠাৎ আধো আধো কিছু মনে পড়লো। কাল কে যেন ওকে বলছিলো, “”এখন কে বাঁচাবে তোকে আমার হাত থেকে? আজতো আমি আমার খা,য়েস মিটিয়েই ছাড়বো।”” এমন আরও কি যেন বলছিলো। হয়তো তখন আধো আধো জ্ঞান ফিরেছিলো পঙ্খির। কিন্তু তারপর কি হয়েছিল সেসব কিছুই মনেই নেই। হয়তো ক্লোরোফমের লেশের কারণে আবারও বেহুশ হয়ে গিয়েছিল সে। তারপর যখম জ্ঞান ফিরে তখন জুবায়েদের মৃত লা,শ দেখতে পায়। কিন্তু এর মাঝখানে কি হয়েছিল? তবে কি ওই জঘন্য লোকটা আমার কোন ক্ষতি করেছে? ভাবতেই যেন অন্তর আত্মা ঝংকার দিয়ে ওঠে পঙ্খির। হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসে তাঁর। সত্যি এমন কিছু হলে সে বাঁচতে পারবে না।এই কলুষিত জীবন নিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না কিছুতেই।
শাকিল কনিকার উদ্দেশ্য বলে ওঠে।
–তারপর কি হয়েছিল ভাবি?
কনিকা বলতে লাগলো।
–জুবায়েদ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলো। আর আমি পায়ে হেঁটে বের হয়েছিলাম। তাই সে আমার অনেক আগেই তাঁর গন্তব্য স্থলে পৌঁছে যায়। আমিও সেই পথ অনুসরণ করে দ্রুত হেঁটে যাই। হেঁটে যেতে যেতে আমার অনেক সময় লেগে। এক দের ঘন্টা হাঁটার পর আমি ওর গাড়ি দেখতে পাই। আমি সেদিকে এগিয়ে যায়। আর গিয়ে দেখি পঙ্খি মাটিতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। আরেকটু সামনে যেতেই দেখি জুবায়েদ মাটিতে পড়ে আছে। নাকের কাছে হাত দিয়ে বুঝতে পারি তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। তখনই যেন ক্রোধে ফেটে পড়ি আমি। ওই জঘন্য লোকটাকে নিজের হাতে না মারার আক্ষেপে পাগল হয় যাই আমি। আমার হাতে থাকা চা,কু দিয়ে এলোপাতাড়ি কো,পাতে থাকি তাকে। তারপর বাকিটা তো সবাই জানেনই।
এতক্ষণ ধরে কনিকার কথা শুনে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কোন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতে পারে না। অতঃপর শাকিল বলে উঠলো।
–তারমানে আপনার কথা অনুযায়ী জুবায়েদ কে আপনি খু,ন করেন নি। দেখুন এটা সত্যি হলেও এই মুহুর্তে আপনাকে আমার গ্রেফতার করতেই হবে। কারণ কোনকিছু না প্রমাণ হওয়া পর্যন্ত আইনের নজরে আপনিই কালপ্রিট। তাই আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে। দরকার পরে জাবিন নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন।
কনিকা আর কিছু বললো না। লেডি কনস্টেবল এসে কনিকাকে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে গেলো। সারাবাড়ি যেন হতবিহ্বল থমকে রয়ে গেল
চলবে…..
#মৃগতৃষ্ণা—২৮ (কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ ?)
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★রুমে এসে পঙ্খিকে না দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো ইন্ধনের। কনিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় ইন্ধনও ওদের সাথে গিয়েছিল। কনিকাকে ছাড়ানোর ব্যাপারে শাকিলের সাথে কিছু কথা বলতে গিয়েছিল সে। বাসায় আসার পর থেকে পঙ্খিকে দেখেনি। এখন রুমে এসেও তাঁর দেখা নেই। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ দেখে বুঝলো পঙ্খি ওয়াশরুমে হয়তো। তাই সে গিয়ে বিছানায় গিয়ে নিজেকে একটু এলিয়ে দিলো। কিন্তু অনেক টা সময় পার হওয়ার পরও পঙ্খিকে বের হতে না দেখে কেমন খটকা লাগলো ইন্ধনের। সে উঠে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করে বললো।
–পঙ্খি? তুমি ঠিক আছ? এতো সময় ভেতরে কি করছ?
কিন্তু ভেতর থেকে কোন প্রতিত্তোর এলোনা। ইন্ধন এবার আরও জোরে নক করে একটু উচ্চস্বরে পঙ্খিকে ডাকলো। তবুও কোন প্রতিক্রিয়া এলো না। ইন্ধনের এবার চিন্তা হতে লাগলো। সে জোরে জোরে দরজায় চাপড় মেরে ডাকতে লাগলো।
–পঙ্খি…পঙ্খি…কথা বলছনা কেন? দরজা খোল। কি হয়েছে তোমার??
নাহ্ কোন জবাব নেই। ইন্ধন অস্থির হয়ে গেল এবার। সে এবার সজোরে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললো।
–পঙ্খি……শুনতে পাচ্ছ আমাকে? দরজা খোল বলছি। নাহলে কিন্তু দরজা ভেঙে ফেলবো আমি।পঙ্খি……
আর থাকতে পারলোনা ইন্ধন। সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে দরজার সিটকালি ভেঙে ফেললো। দরজা খুলে গেল তখন। ইন্ধন দ্রুত ভেতরে ঢুকে দেখলো পঙ্খি শাওয়ারের নিচে বসে থরথর করে কাঁপছে। মুখটা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তাঁর।পঙ্খির এহেন অবস্থা দেখে আৎকে উঠলো ইন্ধন। ছুটে গেল পঙ্খির নিকট। আগে শাওয়ার টা বন্ধ করে দিলো। তারপর পঙ্খিকে ধরতে গেলেই ছিটকে পিছিয়ে যায় সে। কম্পিত স্বরে বলে।
–ছু ছুবেন না আমাকে। আমি আর আপনার উপযোগ্য নেই।অপবিত্র হয়ে গেছি আমি। পঁচে গেছি আমি। এই দেখেন কেমন দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এতো ঘষলাম তবুও যাচ্ছে না ।
ইন্ধন খেয়াল করলো পঙ্খি তাঁর হাত আর শরীর ঘষে চামড়া উঠিয়ে লাল করে ফেলেছে। মুহুর্তেই যেন চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ইন্ধনের। চোখ মুখ ভয়ংকর কঠিন হয়ে এলো তাঁর। ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে চোয়াল চিবিয়ে বললো।
–কি করেছ তুমি এসব?
–আমার শরীরের ময়লা পরিষ্কার করছিলাম। কিন্তু পরিষ্কার হচ্ছে না কিছুতেই। কি করবো আমি?
ইন্ধনের ক্রোধ মাথায় চড়ে গেল।রাগে কপালের রগ ফুলে উঠলো তাঁর। ইন্ধন পঙ্খির চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
–তোর সাহস কি করে হলো নিজেকে এভাবে আঘাত করার? তুই জানিস না তোর সবকিছুর ওপর শুধু আমার অধিকার। তোর সবকিছু আমার। তাহলে আমার জিনিসে তুই ক্ষত করলি কোন সাহসে? আর কি বলছিস? তোর শরীর নোংরা হয়ে গেছে? পঁচে গেছে? কে বললো তোকে হ্যাঁ? কিসের গন্ধ আসছে? তোর শরীরে শুধু আমার শরীরের ঘ্রাণ ছাড়া আর কোন গন্ধ ছুতে পারবে না। কখনো না। আমি থাকতে তোকে কেউ নোংরা করতে পারবে না। কেউ না।
পঙ্খি কাঁন্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–কিন্তু ওই লোকটা….
–কিচ্ছু করতে পারেনি ও। কিচ্ছু না। আরে এতটুকু বোধও কি নেই তোমার? তোমার সাথে তেমন কিছু হয়ে থাকলে কি তুমি নিজে সেটা বুঝতে পারতে না?
ইন্ধনের কথায় এবার যেন পঙ্খি একটু আস্বস্ত হলো।সত্যিই তো, তেমন কিছু হলে তো ও বুঝতে পারতো। তারমানে ওই জঘন্য লোকটা তাঁর ষড়যন্ত্রে সফল হয়নি। নষ্ট করতে পারেনি আমাকে। কথাটা ভেবে আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে উঠলো পঙ্খি। ইন্ধনের ক্রোধ যেন এবার একটু দম নিলো। চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু শান্ত করলো সে। তারপর পঙ্খিকে দাঁড় করিয়ে গায়ের ভেজা শাড়িটা খুলে বালতিতে রেখে দিলো। পাঁজা কোলে তুলে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দিতে লাগলো পঙ্খির। ইন্ধনের চেহারায় এখনো রাগী ভাব দেখা যাচ্ছে। পঙ্খি কেমন সম্মোহিত নজরে তাকিয়ে আছে ইন্ধনের পানে। চোখের পলকও পড়তে ভুলে গেছে। যেন ইন্ধনের মাঝে অজানা কিছু আবিষ্কার করছে সে।দেখছে তো দেখছেই।দেখতে দেখতে হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে ইন্ধনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো সে। আচমকা পঙ্খির কাজে প্রথমে একটু অবাক হলো ইন্ধন। তারপর বললো।
–দেখ এসব করে লাভ হবে না। আমার রাগ কমবে না। ছাড় আমাকে।
পঙ্খি ছাড়লো না। বরং হাতের বাঁধন আরও পোক্ত হলো। আরও নিবিড় ভাবে মিশে গেল ইন্ধনের সাথে। ইন্ধনের গলায় নাক ডুবিয়ে তাঁর শরীরের ঘ্রাণ টেনে নিলো নিজের মাঝে। পঙ্খির এমন আলিঙ্গনে লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল ইন্ধনের। এই প্রথম পঙ্খি নিজে থেকে এভাবে কাছে এলো ওর। নিজেকে শক্ত রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে ইন্ধনের জন্য। অবাধ্য হাত দুটো নিজের মতো করেই পৌঁছে গেল পঙ্খির উন্মুক্ত কোমড়ে। কোমড় পেঁচিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পঙ্খির ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিলো। পঙ্খি ইন্ধনের কানে ফিসফিসিয়ে বললো।
–তোমার দেহের ঘ্রাণ আমার রুহুতে মিশিয়ে দাও। তোমার ঘ্রাণ ব্যাতিত অন্য কোন ঘ্রাণ যেন আমার শ্বসনতন্ত্রে না আসতে পারে। তোমার ঘ্রাণে নিমজ্জিত থাকতে চাই আমি।
পঙ্খির আকুল আবেদনে ইন্ধনের হৃৎস্পন্দন থমকে যাওয়ার উপক্রম। আজ প্রথম পঙ্খি ওকে “তুমি” বলে সম্বোধন করছে। হয়তো পঙ্খি নিজেও টের পায়নি সেটা। প্রিয়তমার আহ্বানে সারা দিতে বিলম্ব করলো না ইন্ধন। পঙ্খির মুখটা সামনে এনে তাঁর অধরে অধর আবদ্ধ করলো। পঙ্খি হাত বাড়িয়ে ইন্ধনের শার্টের বোতাম খুলে শরীর থেকে আলাদা করে দিলো শার্ট টাকে।ইন্ধনের মাঝে বিলীন করলো নিজেকে।ইন্ধনও পঙ্খির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিলো নিজের ঘ্রাণ।
__
সময় বহমান,কারোর জন্য থেমে থাকে না। জুবায়েদের মৃত্যুরও এক মাস গত হয়ে গেছে। পরিবেশ ধীরে ধীরে আবারও স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছে। শুধু জাহানারা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। দুই দুইটা জওয়ান ছেলের শোকে সে এখন চুপচাপ নির্জীব হয়ে গেছে।সন্তান যেমনই হোক তবুও তো নারী ছেড়া ধন। শোক তো হবেই।জাহানারা এখন তেমন কোন কথাবার্তা বলে না। একা একা অনুভূতি শূন্যের মতো বসে থাকে। কাল কনিকাকে হাজত থেকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছে ইন্ধন। পোস্ট মরটামের রিপোর্টে এটা ক্লিয়ার হয়েছে যে জুবায়েদের মৃ,ত্যু ছু,রির আঘাতে হয়নি।তাঁর শরীরে কিছু আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মা,রা হয়েছে। তাই কনিকার জামিন নিতে বেশি সমস্যা হয়নি। যদিও এবাড়িতে তাঁকে দেখে কেউই তেমন খুশি হননি। খোদেজা তো কোনমতেই তাঁকে এবাড়িতে রাখার পক্ষে না। তবে ইন্ধনের দৃঢ়তার সামনে আর কেউ পেরে ওঠেনি। ইন্ধন জোর গলায় সবাইকে বলে দিয়েছে কনিকা ভাবি এবাড়িতেই থাকবে। ভাবি না চাওয়া পর্যন্ত তাঁকে কেউ তাড়াতে পারবে না। সামছুল মজুমদারও ইন্ধনের কথায় সহমত জানিয়েছেন। তাই এই নিয়ে আর কেউ বেশি কিছু বলতে পারেনি।
শরৎ প্রায় বিদায়ের পথে। আর সপ্তাখানেক পরই আশ্বিন মাস চলে গিয়ে কার্তিকের সাথে হেমন্তে আগমন ঘটবে প্রকৃতিতে। গরমের প্রখরতা অনেক টাই কমে গেছে। বাতাসে শীতলতার মাত্রা হালকা বেড়েছে। শরতের এই শীতল বাতাসে নিজেকে একটু সিক্ত করতে বিকালে ছাঁদে আসলো পঙ্খি। ইন্ধন এখনো ফেরেনি। তাঁর এখন সময় কই। নির্বাচনে তাঁর দল বহুমাত্রায় জয়ী হয়েছে। নেতা সাহেব এখন জনসেবা করতে ব্যাস্ত। তাঁর দেখা পাওয়া এখন পূর্নিমার চাঁদের মতো দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয় পঙ্খির। তবে সারাদিন পর লোকটার মুখ দেখলেই সব অভিমান মুহূর্তেই উড়ে যায়। অভিমান বলতে কিছু আছে সেটাই যেন ভুলে যায় তখন। এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের মনেই হাসে পঙ্খি। ছাঁদে আসতেই দেখলো কনিকা ছাঁদের এককোনায় মনমরা হয়ে বসে আছে। পঙ্খি এগিয়ে গেল তার কাছে। কনিকার পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বললো।
–জানি আপনার সাথে যা হয়েছে তা ভোলা সহজ না। তবে কালো অতীতে ডুবে থাকলে ভবিষ্যতের নতুন আলো কিভাবে দেখবেন? তাই অতীত থেকে বের হয়ে ভবিষ্যতের নতুন আলোয় পা রাখুন।
কনিকা মলিন তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–নতুন ভবিষ্যত? আমার আবার কি ভবিষ্যত? যেখানে বেঁচে থাকাটাই শুধু দায়ভার টানা। সেখানে নতুন আলো কোথাথেকে আসবে?
পঙ্খির হঠাৎ সেদিনের কথা মনে পড়লো। পঙ্খি ইতস্ততভাবে বললো।
–ভাবি কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম আপনাকে।
–হ্যাঁ বলেনা।
— বলছিলাম যে আপনার জীবনে কি কেউ আছে? দেখুন সবারই ভালো থাকার অধিকার আছে। আপনিও চাইলে অন্য কারোর সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেন।
কনিকা ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি বলতে চাইছ তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
–আসলে কিছুদিন আগে রাতের বেলা আপনাকে একটা লোকের সাথে চুপিচুপি দেখা করতে দেখেছিলাম আমি। তাই বলছিলাম যে যদি তেমন কেউ থেকে থাকে তাহলে…
–না পঙ্খি ভুল ভাবছ তুমি। তুমি যা ভাবছ তা নয়। আমি যার সাথে দেখা করি সে আমার খালার ছেলে পলাশ ভাইয়া।উনি আমাকে নিজের বোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাই কোন বিপদে আপদে তাকে ডাকি আমি। তারও নিজের পরিবার আছে,দায়দায়িত্ব আছে।তাই চেয়েও সবসময় আমার জন্য লড়তে পারে না। তবে যেকোনো দরকারে ডাকলে সে ছুটে আসে। এবাড়িতে আসতে পারে না। এবাড়িতে বাইরের পরপুরুষ আসা তেমন পছন্দ করে না। তাই আমার খুবই প্রয়োজন হলে লুকিয়ে তার সাথে দেখা করে সাহায্য চাই। সেদিন তুমি যখন জিজ্ঞেস করলে আমি গর্ভবতী কিনা তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। কারণ এর আগে দুটো বাচ্চা নষ্ট করে দিয়েছে জুবায়েদ। তাই নিশ্চিত হতে আমি ওই পলাশ ভাইকে দিয়ে শহর থেকে মেডিকেল কিট আনিয়ে পরিক্ষা করি। আর তাতে পজিটিভ আসে। সেটা দেখেই আমি ভয়ে আৎকে উঠি। আরও একটা সন্তানের অনাগত মৃত্যুর ভয়ে কাঁদতে থাকি আমি। তখন ভাইয়া আমাকে শান্ত না দিয়ে বলেছিল, আমি চাইলে জুবায়েদ কে ছেড়ে দিয়ে তাঁর বাড়ি গিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু আমি জানি সেটা করা যায় না। নিজের গ্লানি অন্যের ঘাড়ে কিভাবে চাপিয়ে দেই। ব্যাস এভাবেই কোন প্রয়োজন হলে তাঁর সাথে দেখা করতাম। আর কিছু না।
সবশুনে পঙ্খি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে কি ভাবছিলো আর কি হলো। তবে কনিকার জীবনে সত্যিই কেউ আসলে ভালো হবে। তাঁর জীবনটাও একটু নতুন রঙে রঙ্গিন হবে। এমনটাই মনে মনে দোয়া করছে পঙ্খি।
__
সন্ধ্যার পর ইন্ধন ফিরলো গৃহে। তাঁকে আসতে দেখেই পঙ্খি চুলোয় কফি বসালো। নেতা সাহেবের আসতেই কফি লাগে আগে। তাই আগে ভাগেই সেটা করছে। কফি বানানোর মাঝেই হঠাৎ বাইরে কি যেন ধুম করে পড়ার শব্দ পেল পঙ্খি। একটু চমকে গিয়ে বাইরে আসলো সে। বাইরে এসে দেখলো রান্নাঘরের বাইরের ফুলদানি টা পড়ে আছে। কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলনা সে। কিভাবে পড়লো তাহলে এটা? পঙ্খি আর বেশি না ঘেঁটে ফুলদানি টা উঠিয়ে ঠিক করে রাখলো। তারপর কফি বানিয়ে মগে ঢেলে নিজের রুমে নিয়ে গেল।
রুমে এসে দেখলো ইন্ধন ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে। পঙ্খি কফির মগটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–আপনার কফি।
ইন্ধন পঙ্খির হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিলো। তারপর পঙ্খির হাত ধরে টান মেরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো তাঁকে। পঙ্খির কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বললো।
–ছাড়ো তোমার কফি। আগে আমার কাছে আসো তুমি। জানো কতদিন তোমাকে একটু মন ভরে কাছে পাইনা। ব্যাস্ততার কারণে তোমাকে একটু ভালো করে আদরও করতে পারিনা।
পঙ্খি লজ্জায় নতজানু হয়ে বললো।
–কি করছেন, কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।
–যাক, ঠান্ডা হয়ে আইসক্রিম হয়ে যাক। কফির চেয়ে বেশি উঞ্চতা তোমার মাঝে আছে। আর আমার তৃষ্ণা এখন কফিতে মিটবে না। তোমাকে পান করলেই মিটবে।
–কি বলছেন এসব…
–আরে কি আপনি আপনি লাগিয়ে রেখেছ? সেদিন তো কি সুন্দর তুমি করে বলছিলে। তারপর কি হলো। গাজনীর মতো।সর্ট টাইম মেমোরি লস হয়ে গেল নাকি তোমার?
সেদিনের কথা মনে আসতেই লজ্জায় একবারে নুইয়ে পড়লো পঙ্খি। সেদিন ওর কি হয়ে গিয়েছিল কে জানে।সেদিন যেন নিজের মাঝেই ছিলোনা ও। আর এই লোকটা সেদিনের কথা বারবার বলে বলে ওকে শুধু লজ্জা দেয়। পঙ্খি ইন্ধনের বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে লাজুক ভঙ্গিতে বললো।
–ছাড়ুন আমার কাজ আছে।
ইন্ধন ছাড়লো না। বরং হাতের বাঁধন আরও শক্ত করলো। পঙ্খিকে লজ্জায় ফেলতে তাঁর ভীষণ মজা লাগছে। তাই পঙ্খির লজ্জার ডোজ আরও বাড়িয়ে দিয়ে দুষ্টু সুরে বললো।
–ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। আসলে সেদিন নিজের কার্য সিদ্ধি করার দরকার ছিলো তাই ওমন করেছ তাইনা? কাজ শেষেই হাত ধুয়ে ফেললে? তুমি তো দেখছি রাজনীতিবিদের চেয়েও ধুরবাজ। কেমন কুটিল ষড়যন্ত্র করে এই মাছুম বাচ্চাকে দিয়ে কার্যসিদ্ধি করে নিলে। আজ একটু বোকা বলে এমনটা করতে পারলে আমার সাথে? ছলেবলে আমার দেহটাকে ভো,গ করে নিলে তুমি? আমার যৌবন এভাবে শুষে নিলে ? এই অবলার সাথে এমন ছলচাতুরী? একটু হট বলে আজ এতো শোষণ চলছে আমার সাথে। কি যেন বলছিলে সেদিন, “তোমার ঘ্রাণ আমার রুহুতে মিশিয়ে দাও, তোমার……
আর শুনতে পারলোনা পঙ্খি। ইন্ধনের মুখে হাত চেপে ধরে বললো।
–দেখুন এসব ফালতু কথা বন্ধ না করলে কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা বলবোনা। আর আপনার সাথেও থাকবোনা। আমি ছায়ার কাছে গিয়ে ঘুমাবো। ছাড়ুন আমাকে।
ইন্ধন পঙ্খিকে আরও শক্ত করে ধরে বললো।
–সাহস থাকলে গিয়েতো দেখাও। একদম ঠ্যাং ভেঙে খাটে বসিয়ে রাখবো।
পঙ্খি অভিমানের সুরে বললো।
–কেন? আমি নাকি আপনার সাথে শোষণ করি। তাহলে আমাকে কি দরকার আপনার?
–হ্যাঁ শোষণ তো করো। বাট আই জাস্ট লাভ দিস কাইন্ড অফ শোষণ। আমিতো এমন শোষণ বারবার চাই। শোষণ করতে করতে আমাকে শেষ করে ফেলো। একেবারে নিংড়ে ফেলো আমাকে।
–ছিহ্হ,, কি ছিড়ি কথা এসব?
–এখনি দেখাচ্ছি কি কথা এসব।
কথাটা বলেই ইন্ধন পাঁজা কোলে তুলে নিল পঙ্খিকে। পঙ্খি লাজুক হেঁসে লুকিয়ে পড়লো ইন্ধনের বুকে।
__
সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলে রোজকার মতোই ইন্ধনের বেড়াজালে আবদ্ধ পেল নিজেকে। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল সে। উঠে দাঁড়াতেই দেখলো কাল রাতের কফির মগটা টেবিলের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে। কফি টেবিলের ওপর নিচ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে। হয়তো কাল রাতে বিড়ালের কাজ এসব। এবাড়িতে বিড়ালের মেলা রয়েছে একেবারে। পঙ্খি আগে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে এসে নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর ভেজা কাপড় নেড়ে দিতে বারান্দায় আসতেই চমকে গেল সে। বারান্দায় একটা বিড়াল কেমন মরার মতো পড়ে আছে। পঙ্খি পাশে থাকা একটা লাঠি দিয়ে খোঁচা মেরে দেখলো নড়ে না। তারমানে সত্যিই মরে গেছে বিড়াল টা। পঙ্খি খেয়াল করলো বিড়ালের মুখের সাথে কফি লেগে চিটচিটে হয়ে আছে। আৎকে উঠলো পঙ্খি। তবে কি বিড়াল টা ওই কফি খেয়েই মরেছে? ভাবতেই অন্তর কেঁপে উঠল পঙ্খির। ওই কফি তো ও ইন্ধনের জন্য এনেছিল। তাহলে কি কফিতে কেউ কিছু মিশিয়েছে? কিন্তু কফিতো আমি নিজেই বানিয়ে আনলাম। তাহলে কে কি মেশাবে? পঙ্খির মনে পড়লো কফি বানানোর মাঝে ও কিছু পড়ার শব্দে বাইরে এসেছিল। তাহলে কি তখনই কেউ কিছু মিশিয়েছে? কিন্তু কে করবে এই কাজ? পঙ্খির হঠাৎ মনে পড়লো সেই বৃদ্ধমহিলার কথা। সে বলেছিলো আমার স্বামীর ওপর কালো ছায়া আছে।ওর জানের ভয় আছে। তবে কি সেই মহিলা সত্যিই বলেছিলো? এই কফি যদি আমার ইন্ধন খেত তাহলে? আর ভাবতে পারে না পঙ্খি। হৃদপিণ্ড থমকে ওঠে কেমন। হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে পঙ্খি।
চলবে…..