মৃগতৃষ্ণা-৩১,৩২

0
664

#মৃগতৃষ্ণা-৩১,৩২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
(রহস্য ভেদ–প্রথম অংশ)
৩১

★স্তব্ধ, অলংকারবহুল চোখে তাকিয়ে আছে পঙ্খি তার সম্মুখে থাকা ব্যাক্তির দিকে। চোখ যা দেখছে মন মস্তিষ্ক তা মানতে পারছেনা কোনমতে।মনে হচ্ছে সে নিশ্চয় কোন স্বপ্ন দেখছে। এটা সত্যি হতেই পারে না। উনি কিভাবে ইন্ধনের ক্ষতি করতে পারে? কিভাবে সম্ভব এটা? বিশ্বাস করতে পারছেনা পঙ্খি। ইন্ধনকে যে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে, যার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়েছে ইন্ধন সেই জন্মদাত্রী মা কিভাবে তাঁর সন্তানের জানের দুশমন হতে পারে? পঙ্খি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো।
–মা আপনি? আপনি মারতে চান ইন্ধন কে?

রাবেয়া ঘাবড়ে গেল প্রচুর। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটতে লাগলো তাঁর। তবুও কোনরকমে গলায় জোর আনার চেষ্টা করে বললো।
–ক ককি আবোলতাবোল কথা বলছ তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? আমি কেন আমার ছেলেকে মারতে চাইবো? এটা বলার সাহসও কী করে হলো তোমার?

–মিথ্যে কথা বলে লাভ নেই। আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনাকে কফিতে বিষ মেশাতে। পরশুদিনও আপনিই কফিতে বিষ মিশিয়ে ছিলেন তাইনা?

–তোমার মাথা সত্যিই গেছে। এমন জঘন্য আরোপ কিভাবে লাগাতে পারলে তুমি আমার ওপর? একবারও বুক কাঁপলো না তোমার? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। আরে আমিতো এখানে পানি নিতে এসেছিলাম। দেখলাম কফি উতলে পড়ে যাচ্ছে তাই একটু নেড়ে দিচ্ছিলাম। আর তুমি কিনা এতবড়ো একটা জঘন্য কথা বলছ আমাকে?তোমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসি আর সেই তুমি কিনা।ছিঃ ছিঃ এমন কথা শোনার আগে মরণ কেন হলোনা আমার।

রাবেয়ার ন্যাকা কান্না দেখে পঙ্খি থতমত খেয়ে গেল।মনে মনে ভাবলো আমি কি সত্যিই চিনতে ভুল করলো? তবে কি উনি সেই লোক না? হঠাৎ পঙ্খির চোখ গেল রাবেয়ার হাতের দিকে। চমকে উঠলো পঙ্খি। এটাই তো সেই হাত। সেদিনে এই হাতটাই তো চা,কু ধরে ছিলো। অন্ধকারে মানুষ না দেখা গেলেও হাতটা চোখের ওপর থাকায় হাতের আঙ্গুলের আংটি টা হালকা দেখা যাচ্ছিল। আর এই আংটি টাই ছিলো। তারমানে এখন সম্পূর্ণ পরিস্কার যে রাবেয়াই ইন্ধনকে মারতে চায়। পঙ্খি শক্ত গলায় বললো।
–বন্ধ করুন আপনার এই নাটক। এই মরা কান্না দেখিয়ে আর কোন লাভ হবে না। আপনার সত্যি আমার সামনে চলে এসেছে। তাই নাটক না করে সত্যি করে বলুন কেন করছেন এসব? একজন মা হয়ে নিজের সন্তান কে কেন মারতে চান আপনি? আপনি না বলেন ইন্ধনের মুখ দেখেই আপনি বেঁচে আছেন? ইন্ধনই আপনার সব। তাহলে সেই সন্তানের জানের দুশমন কেন হয়েছেন আপনি? আপনার অন্তর কাঁপল না এমন কাজ করতে? আপনি মানুষ নাকি অমানুষ?আরে মায়েরা তো নিজের জীবন দিয়ে সন্তানকে রক্ষা করে। কোনো পশুও তার সন্তানের ক্ষতি হতে দেয়না। অন্যান্য পশুদের থেকে আগলে রাখে। আর আপনি কিনা ছিহ্। আপনাকে আমি কতো শ্রদ্ধা করতাম। এই বাড়িতে আপনাকেই সবচেয়ে ভালো মানুষ মনে করেছিলাম। কিন্তু আপনার মুখোশের আড়ালে যে এমন কুৎসিত চেহারা আছে তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি আমি।

রাবেয়া এবার তেজী সুরে বলে উঠলো।
–বাচ,অনেক বলেছ মেয়ে। সত্যি জানতে চাওনা তুমি? ঠিক আছে চলো আমার সাথে।

কথাটা বলে রাবেয়া রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। পঙ্খিও তাকে অনুসন্ধান করলো। রাবেয়া পঙ্খিকে একটা রুমে নিয়ে এলো। রুমটা হয়তো অনেক দিন বন্ধ থাকায় কেমন ভ্যাপসা গন্ধ। রুমের দেয়ালে ঈশিতা আর ইন্ধনের একসাথে তোলা ছবি টানানো দেখে বুঝতে পেরেছ এটা হয়তো ঈশিতার রুম। রাবেয়া এবার পঙ্খির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক সুরে বললো।
–হুমম, তো ধরে যখন ফেলেসই তাহলে আর কোন ভঙ্গিমা করে কি লাভ? হ্যাঁ তোমার ইন্ধন কে আমিই মারতে চাই।

পঙ্খির ওপর বিস্ফোরণ ঘটলো। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–কিন্তু কেন? নিজের সন্তানকে কেন মারতে চান আপনি? মা হয়ে কিভাবে আপনার ছেলেকে মারতে পারেন আপনি?

রাবেয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে গর্জে উঠে বলতে লাগলো।
–কিসের ছেলে হ্যাঁ? কিসের ছেলে? ও আমার কিচ্ছু না। আমার শুধু একটাই সন্তান। আমার মেয়ে, ঈশিতা। ওই ইন্ধন আমার কিছুই না। ও শুধু আমার জীবনের কাল ছাড়া আর কিছুই না।

আরও এক দফা ঝটকা খেল পঙ্খি। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো।
–মানে??

–মানে ও আমার ছেলে না। ও হলো ওই জহির মজুমদারের নাজায়েজ সন্তান। ঈশিতা জন্ম নেওয়ার দুই বছর পর আমার জরায়ুতে টিউমার হয়। সেটার অপারেশনের সময় ডক্টর বলে আমার গর্ভধারণের রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। নাহলে পরবর্তীতে সমস্যা হবে। তাই আমার অপারেশনের সময় আমার গর্ভধারণ ক্ষমতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটা নিয়ে আমার তেমন কোন আপসোস ছিলো না। কারণ আমার ঈশিতাই আমার কাছে যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু এই মজুমদার দের জন্য তা যথেষ্ট ছিলোনা। সামছুল মজুমদার জহির মজুমদারকে পরামর্শ দেন। এভাবে নাকি চলবেনা। ঘরে ছেলে সন্তান না আসলে নাকি বংশের প্রদীপ নিভে যাবে। পিতার নাম বাঁচিয়ে রাখার কেউ থাকবেনা। তাই যে করেই হোক একটা ছেলে সন্তান জন্ম দিতেই হবে। ভাইয়ের পা চাটা কু,কুরের মতো জহির মজুমদারও তার কথায় রাজি হয়ে যায়। আর ছেলে সন্তান জন্ম দিতে সে অন্য এক মহিলাকে ভাড়া করেন। তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে তাঁর গর্ভে নিজের সন্তান দেন। সেই সময় জহির আমাকে আর ঈশিতাকে এখান থেকে দূরে চট্টগ্রামে নিয়ে রাখেন। নয়মাস পর সেখান থেকে আমাকে নিয়ে এসে আমার কোলে ইন্ধনকে দিয়ে বলে, এটা তোমার সন্তান।তুমি ওর মা। আজ থেকে সবাই জানবে এটা আমাদের ছেলে। আমি অনুভূতি শূন্য পাথরের মতো তাকিয়ে থাকি বাচ্চাটার দিকে। কিন্তু কিছুতেই তাঁর প্রতি আমার মমতা জাগেনা। জাগে শুধু একরাশ আক্রোশ আর ঘৃণা। কারণ এই সন্তানের জন্য আমার স্বামী অন্য মহিলার সাথে লিপ্ত হয়েছে। যতবার ওর দিকে তাকাই ততবার শুধু জহির মজুমদারের দেওয়া আঘাত মনে পড়ে আমার। ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠে আমার সারা শরীর। ঘৃণা হয় জহির মজুমদারের ওপরও। খু,ন করতে ইচ্ছে হয় তাঁকে। কিন্তু নিজের আক্রোশ নিজের মনেই চেপে রাখি আমি। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওই ইন্ধনকে সন্তানের মতো মানুষ করতে থাকি আমি। কিন্তু সময়ের সাথে আমার মনের আক্রোশও জমে জমে পাহাড় হতে থাকে। ইন্ধনের যখন বারো বছর বয়স তখন একদিন উঠোনে ক্রিকেট খেলছিল। ওর ক্রিকেটের বল গিয়ে লাগে ঈশিতার মাথায়। মাথা ফেটে গলগল করে র,ক্ত বের হয় মেয়েটার। হাসপাতালে নিয়ে চারটা সেলাই দিতে হয় ওঁকে। আমার মেয়ের ওই অবস্থা দেখে সেদিন প্রথম আমার আক্রোশ বাইরে বেড়িয়ে আসে। ক্রোধের আগুনে ফেটে পড়ি আমি। লাঠি নিয়ে ইন্ধনের রুমের দিকে যাই ওকে আঘাত করতে। কিন্তু তার আগেই জহির মজুমদার আঁটকে দেয় আমাকে। সেদিন জহির মজুমদার আমার ক্রোধ দেখে ঘাবড়ে যায়। ছেলের সুরক্ষার জন্য ওঁকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।

এই পর্যায়ে পঙ্খি বুঝতে পারে ইন্ধন কে কেন জোর করে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। রাবেয়া আরও বলতে থাকে।
–এভাবেই চলতে থাকে দিন। আমার মনের ঘৃণা আক্রোশ এক বিন্দুও কম হয়না। ঈশিতার বয়স তখন ১৯ বছর। মজুমদার রা জানতে পারে ঈশিতা একটা ছেলের সাথে প্রেম করছে। ছেলেটা নিচু জাতির। এই নিয়ে মেয়েটাকে অনেক বকাঝকা করে রুমে আঁটকে রাখে ওকে। মা হয়ে আমি চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনা। মেয়েটা আরেকটা ভুল করে বসে। পালিয়ে যায় সেই ছেলেটার সাথে। ব্যাস সেদিন থেকেই রায় হয়ে যায় ঈশিতা এই বাড়ির জন্য মৃ,ত। আমার মেয়ে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। কেড়ে নেয় এই মজুমদাররা। সেদিন থেকেই আমি পণ করেছি। এই মজুমদার দের আমি একদিন তাদের উচিত শিক্ষা দিবোই। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ইন্ধন ফিরে এলো। তাঁকে দেখেই আমার মনের আক্রোশ আবারও জেগে উঠলো। কিন্তু যখন দেখলাম ইন্ধন ওর বাপ জহির মজুমদারকে ঘৃণা করে তখন আমার ভালোই লাগলো। মনে হলো এভাবেই শাস্তি দিবো জহির মজুমদারকে। ছেলের সামনে ওঁকে খারাপ বানিয়ে।তাই আর ইন্ধনের কোনো ক্ষতি করিনা আমি। আমার বোন তুশিকে বিয়ে দিতে চায় ইন্ধনের সাথে। আমিও ভাবলাম বোনের মেয়েকে নিজের কাছে আনলে আমার মেয়ের খালি জায়গা টা একটু হলেও পূরণ হবে। ওরা।ও বললো ওর নাকি গার্লফ্রেন্ড আছে। আমি তখন কিছু বললাম না। ভাবলাম দেখি কোনভাবে বিয়েটা করিয়ে দেওয়া যায় নাকি।কিন্তু অনেক সেই আশাও ধ্বংস করে দিলো। তোমাকে বিয়ে করে এনে। প্রথমে ভাবলাম হয়তো পরিস্থিতিতে পড়ে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে তোমাকে। কিন্তু তুশি সেদিন যখন বললো, ইন্ধনের তো গার্লফ্রেন্ড ছিলো তাহলে এই বিয়ে এতো খুশিখুশি কিভাবে মেনে নিলো? তখন আমারও সন্দেহ হলো। আর আমি বিষয় টা খতিয়ে দেখলাম। আর জানতে পারলাম এইসব কিছুই ইন্ধনেরই পরিকল্পনা। বুঝতে পারলাম ইন্ধনের কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমাদের সাথে ছলচাতুরী করেছে। ব্যাস আমার সব ধৈর্য সেদিন ভেঙে গেল। ঘৃণা, আক্রোশে মস্তিষ্ক ফেটে পড়লো আমার। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো। আর ইন্ধনের হ,ত্যার পরিকল্পনা করলাম। কারণ এতেই আমার সব প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যাবে। ইন্ধনও মরবে, আর জহির মজুমদারও শোকে পাগল হয়ে যাবে। সেদিন থেকেই ইন্ধন কে মারার পরিকল্পনা করছি আমি। সেদিন কফিতে আমিই বিষ মিশিয়ে ছিলাম,পরশু রাতে আমিই মারতে গিয়েছিলাম ওকে। আর কাল রাতে কারেন্টের তারও আমিই লিক করেছিলাম। কিন্তু ও বারবার বেঁচে যায়।

সব শুনে পঙ্খি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। পঙ্খির সাথে আরও একজন ব্যাক্তি যে তাদের এই কথপোকথনের সাক্ষী হলো তা জানলো না ওরা।দরজার অগোচরে সবকথা শুনে সেই ব্যাক্তি চলে গেল।

পঙ্খি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে উঠলো। –বুঝলাম আপনার কথা। কিন্তু এতে ইন্ধনের কি দোষ? তাঁকে কেন শাস্তি দিচ্ছেন। আরে ইন্ধনের জন্য তো আপনিই সব। মা বলতে পাগল ইন্ধন। আরে আপনি চাইলে ও হাসিখুশি নিজের জান এমনিতেই আপনার হাতে তুলে দিবে। আর সেই ছেলেকে আপনি মারতে চান? কেমন মহিলা আপনি? আরে মানুষ একটা পশুও পাললেও তাঁর প্রতি মায়া জন্মে যায়। আর ইন্ধনের এতো ভালোবাসাও কখনো আপনার মন গলাতে পারলোনা? আপনার মন এতো পাথর কেন? মানলাম সে আপনার সন্তান নয়। তাই বলে তাঁর আপনার প্রতি এতো ভক্তি কি একটুও নাড়ায়নি আপনাকে? তাঁকে মারতে একবারও হাত কাঁপল না আপনার?

–না কাঁপল না। কেন কাঁপবে? আজ ওর জন্যই আমি সব হারিয়েছি। স্বামী সন্তান সবকিছু।

–আর বাকিরা? তাদেরও কি আপনি মেরেছেন?

–নাহ। তাদের আমি মারিনি। আর কে মেরেছে তাও জানি না। কিন্তু আমি এই সুযোগ টাই কাজে লাগাতে চাচ্ছিলাম। আমি যদি এখন ইন্ধন কে মারি। তাহলে সবাই ভাববে ওই অজানা খু,নিই ওকেও মেরেছে। আমাকে কেউ সন্দেহ করতো না। কিন্তু ও বারবারই বেঁচে যাচ্ছে। এতবার মারার চেষ্টা করার পরও বারবার বেঁচে যায় ও।

–হ্যাঁ বাঁচবে। আপনি ওর কিচ্ছু করতে পারবেন না। এই পঙ্খি বেঁচে থাকতে আপনি ওর একটা পশমও ছুঁতে পারবেননা। আমি এখুনি গিয়ে ইন্ধন কে সব বলে দিবো। দরকার হলে পুলিশকেও জানিয়ে দিবো। অ্যাটেম টু মার্ডার কেসে জেলে ঢুকিয়ে দিবো আপনাকে।

রাবেয়া হঠাৎ হো হো করে হাসলো। তারপর বললো।
–বলে দিবে? যাও বলে দাও। এখুনি যাও। কিন্তু কি বলবে? যে আমি তাঁকে মারতে চাই? তোমার কি মনে হয় তুমি বলবে আর ইন্ধন মেনে নিবে তোমার কথা? আরে তুমিতো দূরের কথা, আমি নিজে গিয়েও যদি ওকে বলি তবুও ও মানবে না।এতটা ভক্ত ও আমার। তাও চলো তোমার খুশির জন্য নাহয় মানলাম তুমি ইন্ধনকে বিশ্বাস করাতে পারলে এই কথা। তারপর? তারপর কি হবে ভেবেছ? তোমার ইন্ধন যখন জানবে সে একটা নাজায়েজ সন্তান তখন তাঁর মনোভাব কি হবে বুঝতে পারছ? নিজের ওপরই ঘৃণা হবে তাঁর। একেবারে ভেঙে পড়বে সে। আত্মসম্মান ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। নিজের জীবন মুহুর্তেই মিথ্যা হয়ে যাবে তাঁর কাছে। তখন কি করবে তুমি? কিভাবে সামলাবে তাঁকে? এমনও হতে পারে তোমাকেও সে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে পারে। তখন?

রাবেয়ার কথার কোনো জবাব দিতে পারলোনা পঙ্খি। সে সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। ইন্ধন নিজের সম্পর্কে এমন সত্য জানলে সত্যিই সইতে পারবেনা।পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। পঙ্খির দমে যাওয়া চেহারা দেখে রাবেয়া সয়তানি হেঁসে বললো।
–কি পারবেনা তো? তাই আমাকে ভয় দেখাতে এসোনা। তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবেনা। কারণ মজুমদাররা নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে কখনো এই কথা বাইরে আসতে দিবেনা। তাই তোমার কথাও কেউ শুনবেনা। এইজন্য আমাকে এসব হুমকি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। যাও পারলে যা খুশি তাই করো। আমার কিছুই করতে পারবেনা তুমি।

কথাগুলো বলে রাবেয়া চলে গেল রুম থেকে। পঙ্খি কতক্ষণ হতবিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াল তার রুমের দিকে। রুমে এসে দেখলো ইন্ধন উল্টো দিকে কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। পঙ্খি বিছানায় গিয়ে আস্তে করে ইন্ধনের পাশে শুলো। পেছন থেকে ইন্ধনকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা এলিয়ে দিলো। বুকের মাঝে হু হু করছে পঙ্খির। নীরবে চোখের নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।মন মস্তিষ্ক তুমুল ঝড় চলছে। ওর ইন্ধন কে কিভাবে বলবে সে এসব কথা? সত্যি টা জানলে ইন্ধন কিভাবে সহ্য করবে? পুরোপুরি ভেঙে পড়বে সে। আমি কিভাবে হতে দিবো তা? কিন্তু না জানালেও তো ওর জীবনের ওপর থেকে এই কালোছায়া সরবেনা। কি করবো এখন আমি? ওই কাল নাগিনীর কাছ থেকে কিভাবে বাঁচাব আমার ইন্ধন কে? ইন্ধন কে সত্যি টা না জানিয়ে কিভাবে বাঁচাব তাঁকে? না না কিছু একটা তো করতেই হবে। একবার সকাল হোক, তারপর ভেবে দেখা যাবে কি করা যায়। কারোর না কারোর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতেই হবে। ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করতে হবে। বাচ এখন শুধু সকালের অপেক্ষা। বাচ আমার ইন্ধনের যেন কোনে ক্ষতি না হয়।

দুশ্চিন্তা করতে করতেই একসময় ইন্ধনকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পঙ্খি। কিন্তু সে কখনো কল্পনাও করেনি আজকের সকাল টা আবার নতুন এক ভয়ংকর রুপ নিয়ে আসবে। যা পুরো পরিবারকে কাঁপিয়ে তুলবে। রাতে যে ব্যাক্তির কাছ থেকে ইন্ধন কে বাঁচানোর দোয়া করছিলো পঙ্খি সকালে সেই ব্যাক্তির মৃ,ত লা,শ দেখতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। বাড়ির পাশের আমবাগানে রাবেয়ার র,ক্তা,ক্ত লা,শ পড়ে থাকতে দেখে পঙ্খিসহ পুরো পরিবার আতঙ্কে শিউরে ওঠে। থমকে য়ায় সবাই।

চলবে…..

#মৃগতৃষ্ণা—৩২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★মজুমদার বাড়ি যেন এক মৃ,ত্যু,পুরীতে পরিণত হয়েছে। একের একের পর এক মৃ,ত্যুর মিছিলে ভৌতিক এক আতঙ্কিত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কালো ছায়ায় যেন ঘিরে ফেলেছে পুরো বাড়ি। এখন তো বাইরের লোকজনও এবাড়িতে আসতে ভয় পায়। সবার মাঝে আতঙ্কের পীড়ন। ভেবে পাচ্ছে না কেন ঘটছে এসব ঘটনা।আর কেই বা করছে এই খু,ন গুলো।নাঈম,তুশি,জুবায়েদ এখন আবার রাবেয়া। নাজানি এরপর কার পালা আসবে সেই ভয়ও হানা দিচ্ছে মনে। রহস্যের আধারে ডুবে যাচ্ছে সবাই।

রাবেয়ার লা,শ পোস্ট মরটামের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকিদের মতো তাঁকেও চা,কু দিয়ে খুবই নির্মম ভাবে হ,ত্যা করা হয়েছে। তাঁর লা,শ দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠে সবাই। এবার কান্না করতেও ভুলে গেছে যেন সবাই। পঙ্খি কেমন মনোভাব প্রকাশ করবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা। এবাড়িতে আসার পর থেকে সে রাবেয়াকেই প্রথম আপন মানুষ ভেবেছিল। সে ভাবতো রাবেয়াই এবাড়ির সবচেয়ে ভালো মনের মানুষ। কিন্তু কাল রাতে তাঁর সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হয়। সে জানতে পারে রাবেয়াই সেই ব্যাক্তি যে কিনা তাঁর সর্বোচ্চ কেঁড়ে নিতে চায়। তাঁর ইন্ধনের জান নিতে চায়। সেই ব্যাক্তির এমন অনাঙ্ক্ষিত মৃ,ত্যুতে কি মনোভাব প্রকাশ করা উচিত তা ভেবে পাচ্ছেনা সে। শত্রু মারা যাওয়ায় খুশি প্রকাশ করবে? নাকি পরিবারের একজন সদস্যের এমন নির্মম মৃ,ত্যু,তে শোক প্রকাশ করবে? তবে আপাতত ওর চিন্তার বিষয় শুধুই ইন্ধন। যখন থেকে রাবেয়ার লা,শ দেখেছে তখন থেকেই একেবারে নিশ্চুপ পাথরের মতো হয়ে গেছে সে। কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। ইন্ধনের এই অবস্থা দেখে বেশি ভয় পাচ্ছে পঙ্খি। নাজানি ইন্ধনের ভেতরে কি চলছে? ইন্ধনের কাছে তাঁর মা-ই সবকিছু ছিলো। হঠাৎ তাঁর এমন মৃ,ত্যু ইন্ধনকে থমকিয়ে দিয়েছে।তার জন্য এটা কতটা শোকার্ত তা বুঝতে পারছে পঙ্খি। ইন্ধন যেন নিজেকে সামলে নিতে পারে সেই দোয়াই করছে পঙ্খি।

বাড়ির উঠোনে এককোনায় বসে অপেক্ষা করছে পঙ্খি। বাড়ির ছেলেরা মর্গে গিয়েছে রাবেয়ার লা,শ নিতে। ওখান থেকে বের করে কবর দিয়েই বাড়ি ফিরবে তাঁরা। মেইন গেটের দিকে নজর গেড়ে বসে আছে পঙ্খি। হঠাৎ কিছু একটা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো তাঁর। কালো চাদরে মুড়ে কেউ একজন গেটের বাইরে উঁকি দিচ্ছে ভেতরে। পঙ্খির সন্দেহজনক লাগলো বিষয় টা। সে ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো এটা সেই বয়স্ক মহিলাটাই, যে সেদিন ওঁকে বলেছিল ইন্ধনের ওপর কালো ছায়া আছে। কেউ তাঁর জান নিতে চায়। মহিলাটিকে চিনতে পেরে চমকে গেল পঙ্খি। সে দ্রুত উঠে এগিয়ে গেল সেদিকে। মহিলাটির কাছে ছুটে এসে মহিলাটির হাত ধরে তাঁকে টেনে নিয়ে গেল বাড়ির পেছনের এককোনায়। পঙ্খির এহেন কাজে মহিলাটি ভীষণ ঘাবড়ে গেল। ভীতু গলায় বললো।
–কি হইলো? আমাক এহেনে আইনছেন ক্যা? ছাড়েন আমাক।

পঙ্খি বলে উঠলো।
–ছাড়া পাবেন। তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমাকে বলুন আপনি সেদিন ওসব কি বলছিলেন? আর আপনি এসব জানেনবা কি করে? সত্যি করে বলুন আপনি কে? আর মজুমদারের পরিবারের ব্যাপারে আপনি কিভাবে জানেন?

–কি কইতাছেন এইসব? আমি আবার কবে কি কইলাম? আমিতো চিনিই না আপনেক। ছাড়েন আমাক। যাইবার দেন।

পঙ্খি শক্ত গলায় বললো।
–দেখুন আমার সামনে নাটক করে লাভ হবেনা। আমি জানি আপনার সব মনে আছে। তাই এসব পাগল সেজে লাভ হবে না। ভালোই ভালোই বলুন কে আপনি? আর কি চান? মজুমদার পরিবারকে কিভাবে জানেন? আপনিই তো মারেন নি জহির মজুমদারের স্ত্রীকে? সত্যি করে বলুন নাহলে এক্ষুনি পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিবো আপনাকে। বলুন দিবো?

মহিলাটি ভয়ে মিনুতির সুরে বললো।
–না না এব্যা হরবেন না। আমাক পুলিশে দিয়েন না। আমি কিচ্ছু হরিনাই। হত্যি কইত্যাছি। আমিতো খালি ওক দেইখপ্যার আছিলাম।

পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ওক? ওক মানে কাকে দেখতে এসেছেন আপনি? কার কথা বলছেন আপনি? সত্যি করে বলুন সবকিছু।নাহলে কিন্তু এখুনি পুলিশকে ডাকবো আমি। বলুন কি লুকাচ্ছেন আপনি?

–না না পুলিশেক ডাইকেন না। আমি কইত্যাছি সব।

–ঠিক আছে বলুন সব। আপনি কাকে দেখতে এসেছেন এখানে?

–আমি ইন্ধন মজুমদার কে দেইখপ্যার আছি।

পঙ্খি চকিত কন্ঠে বললো।
–কেন? ইন্ধন কে কেন দেখতে এসেছেন আপনি? ওকে কি করে চিনেন আপনি?

–ও ও আমার ছেলে।

মহিলাটির কথায় বড়সড় একটা ধাক্কা খেল পঙ্খি। বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–কিহ?? সত্যি বলছেন আপনি?

–হ হত্যি কইত্যাছি। ইন্ধন আমার পেট থেকেই জন্ম নিছে। আমার নাম জাবেদা। টেহার বদলে জহির মজুমদার আমার পেটে তাঁর বাচ্চা দিছিলো। আমি মেলা গরিব মানুষ। মাইনষের বাড়ি কাম হইরা খাইতাম। তাই মেলা টেহা পাইয়া আমিও রাজি হইয়া গেছিলাম। বাচ্চা হওয়ার পর নিয়া নেয় তাঁরা। আমারে কইয়া দেয় আমি যেন এই কথা কোনোদিন কাউরে না কই। আর তাগারে হামনেও যেন কোনোদিন না আসি। আমিও হেই কথা রাখছি। কোনোদিন কাউরে কইনাই। তাগারে হামনেও কোনোদিন আসিনাই। যে টেহা পাইছিলাম তাই দিয়া আমি অন্য জায়গায় গিয়া বিয়া বসি। কিন্তু বিয়ার পর আমার আর কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নাই। গতবছর আমার জামাইও মইরা যায়। তাই আমি আবার এই গ্রামে আসি। তহন হঠাৎ ইন্ধনরে দেহি। জানতে পারি ও আমার হেই ছওয়াল। ওরে দেইহা আমার খুব মায়া হয়। তাই মাঝে মইধ্যে চুরি কইরা একটু দেখতে আসি ওরে। তাছাড়া আর কিছু না। হত্যি কইতাছি।

–আচ্ছা ঠিক আছে মানলাম আপনি সত্যি বলছেন। কিন্তু সেদিন আমাকে ওসব কেন বললেন যে, “ইন্ধনের ওপর কালো ছায়া পড়ে আছে। চারিদিকে তাঁর শত্রু। কেউ তাকে মারতে চায়।” কেন বলেছিলেন এসব। বলুন?

–মাঝে মধ্যে আমি চুরি কইরা ইন্ধন রে দেখতাম। হঠাৎ একদিন রাবেয়া আমাক দেখে ফালায়। সে আামকে চিনে ফালায়। আমাক দেইখা হে মেলা রাইগা যায়। আমাক হুমকি দিয়া কয় তোর পেটের ওই নাজায়েজ ছওয়াল বেশিদিন বাঁচব না। যত দেখা লাগে দেইখা নে। তাঁর কথা হুইনা আমি ভয় পাইয়া যাই। ভাইবা পাইনা কি হরমু। আমি কাউরে কইলে এই কথা কেউ বিশ্বাস কইরবোনা। তাই হেদিন যহন জানলাম তুমি ইন্ধনের বউ। তাই তোমারেই কইছিলাম। রাবেয়ার নাম কইনাই কারণ তুমি বিশ্বাস কইরতা না। তাই খালি শত্রুর কথা কইছলাম । যাতে তুমি একটু সতর্ক হয়ে যাও। আর নিজের স্বামীরে বাঁচাইতে পারো। কিন্তু আজকে যহন রাবেয়ার মরার কথা হুনি তহন চমকে যাই। তাই দেইখপার আসিলাম যে ইন্ধন ঠিক আছে নাকি? ব্যাস এইডাই। আর কোনোকিছু না।

সব শুনে পঙ্খি আস্বস্ত হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
–ইন্ধনের কিছু হয়নি। কে বা কারা যেন রাবেয়াকে কাল রাতে খু,ন করে রেখে গেছে। এখন সবাই মর্গ থেকে ম,র,দে,হ আনতে গেছে। ইন্ধনও ওখানেই আছে।

–ও আচ্ছা তাইলে আমি এহন যাই। আর দয়া করে আমার কথা কাউরে কইও না। নাইলে মুসিবতে পইরা যাইব্যা।

মহিলাটি চলে যেতে নিলে পঙ্খি তাঁর হাত ধরে বলে উঠলো।
–দাঁড়ান,আসলে আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই আমি। আপনি আমাকে সতর্ক না করলে আমি আমার স্বামীকে রক্ষা করতে পারতাম না। আর হয়তো কখনো সত্যিটাও জানতে পারতাম না। আপনি অনেক বড়ো উপকার করেছেন আমার। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আপনার।

–এইগুলা কি কন, ইন্ধন আমার পেটের সন্তান। টেহার বদলে জন্ম দিলেও হেতো আমারই রক্ত। তাক হয়তো ছওয়ালের মতো মানুষ করিনাই। কিন্তু তাঁর প্রতি আমার মনে মমতা ঠিকই আছে। তার ক্ষতি হওয়া দেইহা আমি কেবো হইরা চুপ কইরা থাকমু।

–আপনি দেখতে চান আপনার ছেলে কে?

–হ দেইখপ্যার তো চাই। এল্লা দেহার জুন্যিই মাঝে মাঝেই আসি। কোনোদিন দূর থেহে দেহা পাই, কোনোদিন আবার পাইনা।

–আমি যদি আপনার ছেলেকে সামনে থেকে দেখাতে পারি তাহলে দেখবেন আপনি?

জাবেদা চকিত নজরে তাকিয়ে বললো।
–কি কও? হত্যি দেহাইবা আমাক?

–হ্যাঁ দেখাবো। তবে আজ না। আজ আপনি চলে যান। তিন-চর দিন পর আসেন। আমি কোনো ব্যবস্থা করে আপনাকে আপনার ছেলের সামনে নিয়ে যাবো। ঠিক আছে?

জাবেদা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো।
–তোমাক কি কয়া যে ধন্যবাদ দিমু। তুমি হত্যি আমাক অনেক বড়ো একটা উপহার দিলা।

–ধন্যবাদ বলতে হবে না। সত্যি টা ইন্ধন কে বলতে পারবোনা। কারণ আমার ইন্ধন সইতে পারবেনা। কিন্তু এক মাকে তাঁর ছেলেকে ভালো করে দেখার সুযোগ তো করেই দিতে পারি।

–আচ্ছা, তাইলে আমি এহন যাই।

–ঠিক আছে যান।

জাবেদা আবার নিজেকে আড়াল করে চলে গেল ওখান থেকে। পঙ্খিও বাড়ির উঠোনে এলো। একটু পরেই ইন্ধনসহ বাকিরা ফিরে এলো। মাটি দেওয়ার কাজ হয়তো সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। পঙ্খির দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু শুধুই ওর ইন্ধন। ইন্ধনের শোকার্ত মুখখানা আর র,ক্ত,লাল চোখ জোরা দেখে পঙ্খির বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো। হাজার মন ওজনের হাতুড়ির আঘাতের ন্যায় পীড়া হলো তার হৃদপিণ্ডে। পঙ্খি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ইন্ধনের নিকট। কিন্তু ইন্ধন পঙ্খির দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। না কোনো কথা বললো। পঙ্খিকে পাশ কাটিয়ে সে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলো পঙ্খি। লোকটা যে নিজেকে আর নিজের কষ্টকে ওর কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে তা ভালোই টের পাচ্ছে পঙ্খি। কিন্তু কেন করছে এমন? আমি কি উনার পর? তাহলে আমার সামনে কেন নিজেকে আড়াল করছেন উনি? কিন্তু আমি উনাকে আড়াল হতে দিবোনা। কিছুতেই না।

পঙ্খি ছুটে এলো নিজের রুমে। রুমে এসে দেখলো ইন্ধন বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখ মুখের মনোভাব যেন কঠিন পাথরের মতো হয়ে আছে। ইন্ধনকে এভাবে দেখে ভয় লাগছে পঙ্খির। ভেতরের মনোভাব বাহির না করলে দম বন্ধ হয়ে যাবে উনার। পঙ্খি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ইন্ধনের কাছে। ইন্ধনের পাশে বসে তাঁর এক হাত জড়িয়ে নিলো। ইন্ধননের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে একইভাবে বসে রইলো। পঙ্খি নিজের এক হাত ইন্ধনের গালে রেখে ইন্ধনকে নিজের দিকে ঘুরালো। ইন্ধন কেন যেন তাকাতে পারলোনা পঙ্খির চোখের দিকে। সে পঙ্খির হাত সরিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিলো। কিন্তু পঙ্খি দিলোনা তাঁকে যেতে। পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কন্ঠে বললো।
–এমন করবেন না প্লিজ। সইতে পারছিনা আমি। আমার কাছ থেকে নিজেকে কেন আড়াল করছেন আপনি? আমাদের মাঝে এই দ্বিধা, আড়াল কবে থেকে আসলো? আমরা তো একজনের আরেকজনের পরিপূরক। একজন আরেকজনের মনের আয়না। তাহলে কেন লুকাচ্ছেন নিজেকে আমার কাছ থেকে? প্লিজ নিজের মনে কষ্ট চেপে রেখেন না। ভেতরের সব ভাপ বের করে দিন। নাহলে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন না আপনি। তাই নিজের ভেতরের সব মনোভাব বের করে দিন। অশ্রুর সাথে ভাসিয়ে দিন তাদের।

পঙ্খি এবার ইন্ধনের হাত ধরে বিছানার উপর নিয়ে এসে বসালো। তারপর নিজে বিছানার ওপর উঠে বিছানার মাঝামাঝি গিয়ে পা দুটো একসাথে জোরা করে সামনের দিকে টান করে দিয়ে বসলো। এরপর দুই হাত বাড়িয়ে ইন্ধনকে আহ্বান জানালো তাঁর কোলে মাথা রাখতে। ইন্ধন বিনা বাক্য ব্যায় করে বাধ্য ছেলের মতো পঙ্খির কোলে তাঁর মাথা এলিয়ে দিলো। পঙ্খি বরাবরের মতোই পরম যত্নে ইন্ধনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইন্ধনের শক্ত হয়ে থাকা মুখমন্ডল যেন ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো। ইন্ধন পঙ্খির দিকে কাত হয়ে শুয়ে দুই হাতে পঙ্খিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। পঙ্খি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কান্না জড়ানো গলায় বললো।
–নিজেকে আর ধরে রেখেন না প্লিজ। ভেতরের সব বের হয়ে আসতে দিন। সব কষ্ট অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসতে দিন।

এবার আর ইন্ধন নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলোনা।হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে পঙ্খির পেটে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলো সে। কান্নার শব্দ তেমন না হলেও ইন্ধনের শরীরের কাঁপুনি বলে দিচ্ছে কতটা শোকাহত সে। পঙ্খির হৃদয় টা ভেঙে আসছে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সেও ইন্ধনের সাথে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ থাকলো ওরা জানা নেই। জানতেও চায়না পঙ্খি। ইন্ধনের জন্য দরকার হলে সে সারাজীবন এভাবে বসে থাকতে পারবে। বাচ ওর ইন্ধন যেন ঠিক থাকে আর কিছু চাইনা ওর।
__

সময়েরও একটা গুণ আছে। বহমান সময় যাওয়ার সময় মানুষের কিছু মনোভাবও সাথে করে নিয়ে যায় । তাইতো সময়ের সাথে সাময়িক কষ্টের ছাপটাও অনেক টা ধুয়ে নিয়ে যায়। তবে কিছু অক্ষত দাগ থেকেই যায়। যা হয়তো মনের গহীনে আটকা পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে তা উঁকি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানানা দেয়। মানুষ সেই ক্ষত নিয়েই বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। রাবেয়ার মৃ,ত্যু,র আজ দুই সপ্তাহ গত হলো। অন্যগুলোর মতো এটারও কোনো প্রমাণাদি এখনো পেলনা পুলিশ। তবে ইনভেস্টিগেশন জারি আছে। পরিবারের সবাই কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আগের মতো পুরোপুরি ভাবে কেউই স্বাভাবিক হতে পারছে না।সবার মাঝেই এক অজানা ভীতি কাজ করছে। একের এক খু,ন দেখে সবাই এক আতঙ্কের মাঝে আছে। তবে পঙ্খির চিন্তা শুধু ইন্ধন কে নিয়ে। ইন্ধন নিজেকে সামলে নিলেও কেমন যেন হয়ে গেছে সে। ঠিকমতো কথা বলে না, কেমন রুষ্ট হয়ে থাকে সবসময়। পঙ্খি ভাবে হয়তো মায়ের মৃ,ত্যু,র শোক এখানো কাটিয়ে উঠতে পারেনি তাই এমন করছে। এটা ভেবে সে নিজেকে শান্তনা দেয়। তবে তাঁর মাঝে মাঝে কেন যেন মনে হয় ইন্ধনের মাঝে অন্য কিছু চলছে। যেন শুধু মায়ের মৃ,ত্যু,ই ওর এই পরিবর্তনের একমাত্র কারণ না। তবে এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়না পঙ্খি। নিজের মনের ভুল ধারণা ভেবে উড়িয়ে দেয়।

খাবার টেবিলে সকালের নাস্তা পরিবেশন করছে পঙ্খি। একে একে সবাই এলো খেতে। ইন্ধনও এলো। হাতে মোবাইল টিপতে টিপতে সে বাইরের দিকে যেতে লাগলো। সেটা দেখে পঙ্খি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

ইন্ধন দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো।
–আমার কাজ আছে বাইরে যাচ্ছি।

–হ্যাঁ তো নাস্তা করে যান। না খেয়ে কেন যাচ্ছেন?

–আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। পরে বাইরে কিছু খেয়ে নিবো।

–দেখুন যাই বলুন। না খেয়ে যেতে দিবোনা আপনাকে। আগে নাস্তা করবেন তারপর যেখানে খুশি যান।

ইন্ধন আবার কিছু বলতে নিলে তার আগেই জহির মজুমদার বলে উঠলেন।
–ঠিকই তো বলছে বৌমা। নাস্তা করে তারপর বের হও। না খেয়ে কাজে যাওয়া ঠিক না।

ইন্ধন আর কিছু বললো না। বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ এসে চেয়ার টেনে বসলো। এই দৃশ্য দেখে পঙ্খি একটু অবাকই হলো। এই প্রথম জহির মজুমদারের কথা বিনাবাক্যে মেনে নিলো ইন্ধন। অন্যসময় তো জহির মজুমদারের কথা সে কখনো গ্রাহ্যই করেনা। পঙ্খি আর এই নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে সবাইকে খাবার বেড়ে দিলো। খাওয়া শেষে জহির মজুমদার উঠে দাঁড়াতেই কেমন মাথা ঘুরে পড়ে যেতে লাগলো সে। পড়ে যাওয়ার আগেই ইন্ধন ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে ধরে ফেললো। জহির মজুমদারকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চিন্তিত সুরে বললেন।
–ঠিক আছেন বাবা? কি হয়েছে আপনার?

ছেলের মুখে এতবছর পর বাবা ডাক শুনে ছলছল চোখে তাকালেন জহির মজুমদার। তাঁর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। বাকিরাও অনেক অবাক হলো ইন্ধনের এই হঠাৎ পরিবর্তনে। পঙ্খি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। ইন্ধনের হঠাৎ তাঁর বাবার প্রতি এমন পরিবর্তন দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে গেল সে। আবার ভাবলো হয়তো মায়ের মৃ,ত্যু,র কারণে তাঁর মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে। ইন্ধন আবারও ওর বাবার উদ্দেশ্যে বললো।
–কি হলো বলুন কি হয়েছে?

জহির মজুমদার নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো।
–ও কিছু না। ওই প্রেশার টা বুঝি আবার লো হয়েছে। একারণে এমন হয়েছে।

–আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি এখানে সোফায় এসে বসুন। আমি ডাক্তার কাকাকে ফোন করে আসতে বলছি।
ইন্ধন ওর বাবাকে সোফায় এনে বসিয়ে দিলো। তারপর পঙ্খিকে বললো একটা স্যালাইন গুলিয়ে আনতে। ডাক্তারকেও ফোন দিয়ে আসতে বললো। একটু পরে ডাক্তার এসে জহির মজুমদার কে চেকআপ করে ঔষধ দিয়ে গেল।ইন্ধন ওর বাবকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো ঔষধ গুলো যেন ঠিকমতো খায়। জহির মজুমদার নিজের জন্য ছেলের এমন উদ্বেগ দেখে তাঁর অসুখ যেন এমনিতেই সেরে গেল। এতদিন পর তাঁর ছেলের এমন যত্নে সে খুশিতে ভরে উঠেছে।

একটু পরে জহির মজুমদার কে তাঁর কক্ষে আরাম করতে দিয়ে এলো ইন্ধন। বসার ঘরে এসে সোফায় বসে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিলো। তখনই পঙ্খি জাবেদাকে নিয়ে এলো সাথে। জাবেদা ওড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে রেখেছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। পঙ্খি জাবেদাকে নিয়ে এসে অন্য সোফায় বসিয়ে দিলো। পঙ্খির সাথে অপরিচিত কাউকে দেখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো ইন্ধন। পঙ্খি তখন বললো।
–উনি আমার খালা হন। অনেকদিন পর আমাকে দেখতে এসেছেন।

ইন্ধন “ওহ” বলে ভদ্রতাসূচক সালাম দিলো জাবেদাকে। তারপর আবার ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আর জাবেদা মন ভরে দেখলো ইন্ধন কে। পঙ্খিরও মনে একটু শান্তি লাগছে। বাচ এখন শুধু একটাই দোয়া। ওদের জীবনে যেন আর কোনো বিপদ নেমে না আসে।সব যেন ঠিক থাকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here