#মৃগতৃষ্ণা– ৩৮ অন্তিম অংশ
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★র,ক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে পঙ্খি। সারা শরীর তাঁর থরথর করে কাঁপছে। নিজের ওপরই ঘৃণার পাহাড় জন্ম হচ্ছে। সে খু,ন করেছে, এতগুলো মানুষের জান তাঁর হাতে গেছে। ভাবনাটাই গলা চেপে ধরছে যেন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। সে কীভাবে করতে পারলো এতবড় পাপ? কীভাবে এতগুলো মানুষকে এমন নির্মম মৃ,ত্যু দিতে পারলো? কতগুলো মায়ের সন্তান কেঁড়ে নিয়েছে ও। এর আগে ওর নিজেরই মৃ,ত্যু কেন হলোনা ওর? আমার মাঝে এমন ভয়ংকর সত্তা আছে আর আমি নিজেই জানলাম না? না না আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আমার মরে যাওয়াই ভালো। পঙ্খি অস্বাভাবিক সুরে কেমন পাগলের মতো বিরবির করে বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ আমার বাঁচার অধিকার নেই। মরে যেতে হবে আমাকে। হ্যাঁ মরতে হবে। নাহলে আমি সবাইকে মেরে দিবো।
পঙ্খির এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ইন্ধন।আরও ঘাবড়ে গেল। বুকে অসহনীয় পীড়া হচ্ছে তাঁর । ইন্ধন হাত বাড়িয়ে পঙ্খির মুখটা ধরতে নিলেই পঙ্খি ছিটকে পিছিয়ে গেল।কাঁপতে কাঁপতে অস্বাভাবিক সুরে বলতে লাগলো।
–ছু ছুঁবেন না আমাকে। দূ দূরে থাকুন, দূরে থাকুন আমার থেকে। নাহলে আমি আপনারও ক্ষতি করে ফেলবো। আপনাকেউ মেরে ফেলবো। তাই আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন। আমি ভালো না।
ইন্ধনের মনে হচ্ছে বুকের মাঝে যেন উত্তপ্ত গরম শিশা ঢেলে দিয়েছে কেউ। হৃদপিণ্ড পুড়ে গলে যাচ্ছে ওর। ভারাক্রান্ত গলায় বললো।
–কী বলছ এসব তুমি পঙ্খি? তুমি কখনো আমার ক্ষতি করতে পারোনা।
–না না আমি পারি। আমার দ্বারা সব সম্ভব। আমার কাছে কেউ সুরক্ষিত না। আপনিও না। এক কাজ করুন, আমাকে আপনি শেঁকল দিয়ে বেঁধে রাখুন সেটাই ভালো হবে। তারপর পুলিশে ধরিয়ে দিন আমাকে। আমার শাস্তি হওয়া উচিত। কঠিন শাস্তি। আপনি না বললে আমি নিজেই গিয়ে পুলিশকে সব বলছি। হ্যাঁ এটাই ভালো হবে। আমি এখুনি পুলিশের কাছে গিয়ে সব বলে দিবো।
কথাটা বলেই পঙ্খি উঠতে নিলো। তবে ইন্ধন আঁটকে ফেললো ওঁকে। দুই হাতে পঙ্খির মুখটা ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–চুপ, আর একটাও কথা না। আর একটা বাজে কথা বললে আমি নিজেই তোমাকে মে,রে ফেলবো। পুলিশের কাছে যেতে চাও তাইনা? ঠিক আছে তাহলে যাওয়ার আগে আমাকে মেরে থুয়ে যাও। কারণ তোমাকে ছাড়া এই ইন্ধন মৃ,ত। তুমি বিনা এ দেহে নিঃশ্বাস চলবে না। তাই নিজের কিছু করার আগে আমাকে মেরে ফেলো। পারবে তো?
হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পঙ্খি। কাঁদতে কাঁদতে ইন্ধনের বুকে ঢলে পড়লো। ইন্ধন আগলে নিলো তাঁর পঙ্খিকে। পঙ্খি কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–কিন্তু আমি যে পাপ করেছি। এই পাপের দায় নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো?
ইন্ধন পঙ্খির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
–কোন পাপ করোনি তুমি। তুমি আমার আগের সেই নিষ্পাপ পঙ্খিই আছ। যা হয়েছে তা তোমার অসুস্থতার কারণে হয়েছে। আর তোমার এই অসুস্থতার জন্যেও তুমি দায়ী নও। দায়ী তোমার পরিস্থিতি তোমাকে যাঁরা কষ্ট দিয়েছে তাঁরা। তাই তোমার কোনো দোষ নেই। যা করেছ তা তুমি সজ্ঞানে করোনি। আর যাদের মেরেছ তাঁরাও কেউ ভালো ছিলোনা। তাঁরা ওটাই ডিজার্ভ করতো। হ্যাঁ শুধু নাঈম নির্দোষ ছিলো। তবে নাঈমকে যদি তুমি নাও মারতে তবুও সামছুল মজুমদার ওকে আবারও মেরে ফেলতো। তাই তোমার নিজেকে দোষারোপ করার কোনো দরকার নেই। তুমি কিচ্ছু করোনি। হ্যাঁ তুমি একটু অসুস্থ। তবে চিকিৎসা করলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তাই সবার প্রথম আমাদের এখান থেকে দূরে যেতে হবে। এই অশান্তি ভরা জায়গা থেকে চলে যাবো আমরা। আমরা তো এমনিতেও চলে যেতে চেয়েছিলাম তাইনা? আমরা এখান থেকে চলে যাবো। তারপর পাসপোর্ট করে আমরা ইউএসএ তে চলে যাবো। সেখানে গিয়ে তোমার উন্নত ডক্টর দ্বারা চিকিৎসা করাবো। তারপর দেখবে তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আমাদের সুখের একটা জীবন গড়বো। যেখানে তুমি আমি আর আমাদের ছোট্ট একটা পরী আসবে। আমাদের সেই ছোট্ট দুনিয়ার স্বপ্নটা পূরণ করা যে বাকি আছে এখনো।
পঙ্খি এবার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–পরী? আমাদের পরী?
–হ্যাঁ আমাদের পরী। আমাদের লিটল এঞ্জেল। তাঁকে আনতে হবে না দুনিয়ায়?
–সত্যি এমনটা হবে?
–হ্যাঁ হবে। অবশ্যই হবে। তুমি শুধু আমার সাথে, আমার পাশে থাকো। বাকিসব আমি সামলে নিবো। কথা দাও কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববে না।
–কথা দিলাম। আপনিও কথা দিন সবসময় আমার সাথেই থাকবেন। কখনো আমার থেকে দূরে যাবেন না।
–কখনো না। তুমি আছো তো আমি আছি। তুমি নেই তো আমিও নেই। এখন চলো কান্না বন্ধ করো।চলো দুজনে মিলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেই।
পঙ্খি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মাথা ঝাকিয়ে সায় দিলো। দুজন ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকাল সকাল উঠে দুজন যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে গেল। ব্যাগপত্র নিয়ে বাইরে এসে দেখলো সবাই দাঁড়িয়ে আছে ওদের বিদায়ের জন্য। ছায়া এসে পঙ্খি আর ইন্ধন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। পঙ্খিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা। ইন্ধন ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো।
–হইছে হইছে এমন ভাবে কাঁদছিস যেন তোর বিয়ের বিদায় হচ্ছে আজ।
ছায়া হালকা অভিমান দেখিয়ে বললো।
–ভাইয়া,,
–কি ভাইয়া,আমি মোটেও মজা করছিনা। তোর বিদায়ের ব্যাবস্থা পাকা করে ফেলেছি।
ইন্ধন জাহানারার উদ্দেশ্যে বললো।
–চাচী একটা জরুরি কথা ছিলো। আসলে শাকিল ছায়াকে পছন্দ করে। আর বিয়ে করতে চায়। শাকিলের মাও রাজি। আসলে আমাদের বাড়িতে একের পর এক যে ঘটনা ঘটছিল। এর মাঝে বেচারা প্রস্তাব পাঠানোর সুযোগই পায়নি। তাই আমাকে বলেছে ও। আমি শাকিলকে বলেছি ওর মাকে নিয়ে আসতে, বিয়ের কথা পাকা করার জন্য। আপনারাও আর নামত করেন না। ছেলেটা অনেক ভালো। আমাদের ছায়াকে ভালো রাখবে।
জাহানারা বললো।
–ঠিক আছে বাবা।তুমি যখন বলছ তখন আর আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
জাহানারা পঙ্খির কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো।
–ভালো থেক তোমরা। সুখে থেক।
অপরাধ বোধে ডুবে যাচ্ছে পঙ্খি। তাকাতে পারছেনা জাহানারার দিকে। এই মায়ের সন্তান কে ও কেঁড়ে নিয়েছে। সত্যি টা জানলে হয়তো উনি আশীর্বাদের বদলে আমাকে এখন বদদোয়া দিতো। জাহানারা আস্তে করে পঙ্খিকে বললো,জাকির সে রাতে নিয়ে গেছে এখান থেকে। এখন আর কোনো সমস্যা নেই। যাক এটা শুনে একটু ভালোই লাগলো পঙ্খির। এতকিছুর মাঝে একটা জিনিস তো ভালো হয়েছে। ওই নির্দোষ লোকটা এতদিনের কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়েছে।
সবার কাছ থেকে বিদায় পর্ব শেষে ইন্ধন আর পঙ্খি বাইরের দিকে এগুলো। কিন্তু বাইরে এসে উঠোনে পা রাখতেই হঠাৎ পুলিশের গাড়ি এসে থামলো ওখানে। গাড়ি থেকে শাকিল কয়েকজন পুলিশসহ নেমে এলো। ইন্ধন বলে উঠলো।
–কিরে তুই হঠাৎ?
শাকিল বলে উঠলো।
–হ্যাঁ আমি। আসলে খু,নি,র একটা ক্লু পেয়েছি আমি। সেই অনুযায়ী আজ অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি।
শাকিলের কথায় ভয় পেয়ে গেল ইন্ধন। তবে কি ওরা জেনে গেছে যে পঙ্খিই করেছে এসব? পঙ্খিও ভয় পেয়ে ইন্ধনের হাত চেপে ধরলো। ইন্ধন আমতাআমতা করে বললো।
–কী ক্লু পেয়েছিস? আর খু,নী কে?
–তুই।
শাকিলের কথায় যেন বাজ পড়লো সবার ওপর। ইন্ধন আর পঙ্খি একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ইন্ধন ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মানে?
–মানে আমি যে ক্লু পেয়েছি সেই হিসেবে তোকেই খু,নী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
শাকিল হাতের পলিথিন প্যাকেট টা সামনে ধরে বলল।
–এই দেখ এটা তোরই ব্রেসলেট তাইনা? সামছুল মজুমদারের মার্ডারের জায়গায় এটা পাওয়া গেছে।
ইন্ধন বুঝতে পারলো কাল রাতে পঙ্খিকে।আনার সময় হয়তো ব্রেসলেট টা খুলে পড়ে গিয়েছিল। তাই পুলিশ এখন ইন্ধন কেই খু,নী ভাবছে। এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না ইন্ধন। সত্যি টা বলা যাবে না। নাহলে পঙ্খিকে ধরে নিয়ে যাবে ওরা। যা ইন্ধন কখনই হতে দিবে না। তারচেয়ে বরং যা হচ্ছে হোক। পরে নাহয় কোনো রাস্তা বের করা যাবে। শাকিল বলে উঠলো।
–ইন্ধন তোকে আমার অ্যারেস্ট করতে হবে। পরের প্রসেস হাজতেই হবে। সত্যি টা বলে দিলে ভালো। নাহলে তোকে রিমান্ডে পাঠান হবে। আর এতে আমিও কিছু করতে পারবোনা।
শাকিলের কথায় ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল পঙ্খি। হৃদপিণ্ড কাঁপছে ওর। কি বলছে ওরা? ইন্ধন কে ধরে নিয়ে যাবে? আবার রিমান্ডও দিবে। না না এটা দিবোনা আমি। আমার অন্যায়ের শাস্তি আমি ইন্ধন কে পেতে দিবো না। পঙ্খি ইন্ধনেট হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো।
–না না ইন্ধন কে নিয়ে যাবেন না। ইন্ধন কিছু করেনি। ওকে নিয়ে যেতে দিবোনা আমি। অপরাধ আমি ক…
পঙ্খির কথা শেষ হওয়ার আগেই ইন্ধন ওঁকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললো। কিন্তু পঙ্খি মানলো না। ও বলতে লাগলো।
–না আমি আর চুপ থাকবোনা। আমার চোখের সামনে আপনাকে বিনা অপরাধে শাস্তি পেতে দিবোনা আমি। কিছুতেই না।
–শান্ত হও পঙ্খি। একদম কথা বলোনা। কিছু হবে না আমার। সাধারণ ইন্টারোগেশন হবে। তারপরই আমি আবার চলে আসবে দেখো। তুমি একদম চিন্তা করোনা।
–না না আমি জানি আপনি আমার অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিবেন। শাস্তি হয়ে যাবে আপনার। তা আমি হতে দিবোনা। দোষ আমি করেছি শাস্তিও আমি পাবো।
–চুপ করো পঙ্খি প্লিজ। আর একটা কথাও বলবেনা তুমি।
এদের কথা শুনে শাকিল সন্দেহজনক ভাবে বললো।
–এক মিনিট! কি হচ্ছে এসব? আপনার দোষ মানে? কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?
ইন্ধনের ভয় বেড়ে গেল। সে শাকিলের ধ্যান সরানোর জন্য তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো।
–আরে কিছুই না। তুই তো জানিসই বাঙালী নারীরা কেমন। স্বামীর একটু বিপদ দেখলে তাঁকে বাঁচানোর জন্য নিজেকেই অপরাধী বানিয়ে দেয়। তুই ওর কথায় কান দিস না। আর পঙ্খি তোমাকে চুপ করতে বলেছি। জাস্ট কিপ কোয়াইট। কিছু হবে না আমার, ট্রাস্ট মি।
শাকিল হ্যান্ডকাপ নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো ইন্ধনের কাছে। পঙ্খির কলিজা যেন চিপে আসছে। অনন্ত আত্মা কাঁপছে তার। সে কিছুতেই ইন্ধন কে নিয়ে যেতে দিবেনা। কিছুতেই না। ওর ইন্ধন কে কেঁড়ে নিয়ে যেতে দিবেনা ও। পঙ্খি ইন্ধনের সামনে গিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে ইন্ধন কে আড়াল করে দাঁড়াল। তারপর বলে উঠলো।
–না না উনাকে নিয়ে যাবেন না। উনার কোন দোষ নেই। উনি কিছু করেন নি। সব আমার দোষ। আমি মেরেছি সবাইকে। আমাকে নিয়ে যান।
পঙ্খির কথায় সবাই চমকে গেল। ইন্ধনও।ভীষণ ঘাবড়ে গেল। ধমক দিয়ে বললো।
–শাট আপ পঙ্খি। বলেছি না তোমাকে চুপ থাকতে। এসব মিথ্যে বলে কোন লাভ হবে না। শাকিল তুই ওর কথায় কান দিস না। আমার জন্য ভয় পেয়ে এসব বলছে। তুই আমাকে নিয়ে চল।
শাকিল এগিয়ে এসে ইন্ধনের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো। ভয়ে যেন পঙ্খির মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে সারা শরীর কাঁপছে ওর। সে ইন্ধনের হাত শক্ত করে টেনে ধরলো। সে কিছুতেই যেতে দিবেনা ইন্ধন কে। কেমন অস্বাভাবিক সুরে বলতে লাগলো।
–না না না, যেতে দিবোনা আমি। আ আমার ইন্ধনকে নিয়ে যেতে দিবোনা আমি। ছেড়ে দিন আমার ইন্ধন কে। ছেড়ে দিন বলছি। আমার ইন্ধন কে কেউ নিয়ে যেতে পারবেনা। কেউ না।
পঙ্খির মাঝে ধীরে ধীরে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনোভাব চলে আসছে। চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ওর। ইন্ধন ভয় পেয়ে গেল। রায়ান বলেছিল পঙ্খির মাঝের অন্য সত্তা সবার সামনে চলে এলে আরও ভয়াবহ হয়ে যাবে। পঙ্খিকে নিয়ন্ত্রণ করা তখন মুশকিল হয়ে যাবে। আমাকে নিয়ে যেতে দেখে পঙ্খির সেই রণয়ী সত্তা সবার সামনে না চলে আসে। তখন কী করবো আমি? কীভাবে সামলাবো পঙ্খিকে? ইন্ধন পঙ্খির দিকে মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
–পঙ্খি শান্ত হও প্লিজ। একদম হাইপার হইও না। আই প্রমিজ আমার কিচ্ছু হবে না। আমাকে কেউ কেঁড়ে নিবে না তোমার কাছ থেকে। আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে। ভরসা রাখ আমার ওপর। প্লিজ এমন করোনা।
শাকিল তাগাদা দিয়ে বললো।
–ইন্ধন আর সময় নেই। আমাদের যেতে হবে এখন।
কথাটা বলে শাকিল ইন্ধনের হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু পঙ্খি কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না। সর্বশক্তি দিয়ে হাত টেনে ধরে থেকে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–না না না কিছুতেই না। আমার ইন্ধন কে কেঁড়ে নিয়ে যেতে দিবোনা আমি। কিছুতেই না। ছাড়ুন ইন্ধন কে। ছেড়ে দিন বলছি। ও কিচ্ছু করেনি। সব আমি করেছি। আমাকে ধরে নিয়ে যান।
পঙ্খির আচরণ ক্রমেই যেন অস্বাভাবিক হচ্ছে। চোখের রঙ কেমন বদলে যাচ্ছে। চোখের পলক আর ঠোঁট জোড়া কেমন কাঁপছে। পঙ্খির অবস্থা দেখে ইন্ধনের হৃদয় পুড়ছে। ইন্ধন মনে মনে শুধু দোয়া চাইছে ওর পঙ্খি যেন রণয়ী রুপে না চলে আসে।সে বারবার পঙ্খিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। পঙ্খির পাগলামো দেখে শাকিল দুজন লেডি কনস্টেবল কে ইশারা করলো পঙ্খিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। লেডি কনস্টেবল দুজন এসে পঙ্খির দুই হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনতে নিলো। তাও পঙ্খি ছাড়ছে না। সে সর্বশক্তি দিয়ে হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ইন্ধনের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে আসছে। সে চেয়েও ওর পঙ্খিকে আগলে নিতে পারছেনা। পারছেনা ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে শান্ত করতে। লেডি কনস্টেবল দুজন এবার জোরে টেনে পঙ্খিকে সরিয়ে আনলো। শাকিল ইন্ধন কে নিয়ে যাচ্ছে। পঙ্খি তখন গলা কা,টা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো।
–না……….ছেড়ে দাও আমার ইন্ধনকে। ওঁকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিয়ে যেওনা……ইন্ধননন……
ইন্ধন আর দেখতে পারলো না। কলিজা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ওর।ঢোক গিলে সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই জমে থাকা নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। হঠাৎই বন্দুকের গুলির বিকট শব্দে চমকে উঠলো সবাই। থমকে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো ইন্ধন। আর যা দেখলো তাতে তাঁর হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। এতক্ষণ যে ভয়টা পাচ্ছিল শেষমেশ সেটাই ঘটলো। পঙ্খির ভেতরের রণয়ী সবার সামনে চলে এসেছে। পঙ্খির হাতে গান। সে এক লেডি কনস্টেবলের বন্দুক কেঁড়ে নিয়ে হাওয়ায় গুলি করেছে। পঙ্খির মুখমণ্ডল এখন পুরোই পরিবর্তিত। তাঁর কঠিন চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তাঁর মাঝে আর পঙ্খি নেই। সে এখন পুরোপুরি রণয়ী রুপে চলে এসেছে। ইন্ধনের সামনে যেন পুরো পৃথিবী ঘুরছে। সে বোধশক্তিহীন হয়ে পড়লো। এই মুহূর্তে তাঁর মন মস্তিষ্ক সব শূন্য হয়ে গেল। সে কী করবে বুঝতে পারছে না।
পঙ্খির এই রুপান্তরিত রুপ দেখে বাকিসবও হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো সবাই। পঙ্খি শাকিলের দিকে বন্দুক তাক করে হুমকি দিয়ে বললো।
–ছেড়ে দে আমার ইন্ধনকে। নাহলে সবগুলোকে মেরে ফেলবো। ছেড়ে দে বলছি।
শাকিল বললো।
–পঙ্খি ভাবি কি করছেন এসব? বন্দুক দিয়ে দিন। আইন হাতে তুলে নিয়েন না। এটা কোনো খেলনা না। দিয়ে দিন আমাকে।
বলতে বলতে শাকিল এগিয়ে যেতে নিলেই পঙ্খি শাকিলের পায়ের কাছে মাটিতে ফায়ার করে বললো।
–খবরদার! একদম এগুবি না। নাহলে এবার গুলি তোর বুকে চালাব। ছেড়ে দে আমার ইন্ধনকে।
ইন্ধনের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে রাখায় সে পঙ্খির কাছে যেতে পারছেনা। সে দূর থেকেই পঙ্খিকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো।
–পঙ্খি প্লিজ এমন করোনা। শান্ত হও প্লিজ। দিয়ে দাও ওটা। প্লিজ জান কথা শোনো আমার।
পঙ্খি ইন্ধনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই সুযোগে শাকিল চোরা চোখে লেডি কনস্টেবল কে ইশারা করে পঙ্খির কাছ থেকে গানটা কেঁড়ে নিতে বললো। লেডি কনস্টেবল ধীরে ধীরে অগোচরে পঙ্খির কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। তবে কাছাকাছি আসতেই পঙ্খি ফট করে পাশে ফিরে লেডি কনস্টেবলের পায়ে গুলি চালিয়ে দিলো। লেডি কনস্টেবল আর্তনাদ করে ওখানেই বসে পড়লো। পঙ্খি যেন রণচণ্ডী রুপ ধারণ করেছে। চোখ বড়ো বড়ো করে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
–একদম চালাকি করবিনা আমার সাথে। নাহলে সব কইটাকে পরপারে পাঠিয়ে দিবো। যেমনটা সবাইকে দিয়েছি। হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই মেরেছি সবাইকে। আমিই হলাম আসল খু,নী। যে যে আমার ইন্ধন কে কেঁড়ে নিতে চাইবে সবাইকে মেরে ফেলবো আমি,সবাইকে।
পঙ্খির এই ভয়ংকর কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেল। তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না এগুলো পঙ্খি করেছে। শাকিল ইন্ধনের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো।
–ভাবি কি বলছে এসব ইন্ধন। তারমানে সত্যিই উনিই সবাইকে খু,ন করেছে?
–দেখ শাকিল তুই ভুল বুঝছিস।আসলে পঙ্খি অসুস্থ। এই মুহূর্তে ওর হুঁশ নেই। ও কি করছে তা ও নিজেও জানে না।
–আইন এসব বোঝে না ইন্ধন। আইনের সব অপরাধীই সমান। তাই আজ পঙ্খিকে অ্যারেস্ট করতে হবে আমার। যেহেতু তুই এসব জানা সত্বেও চুপ করে ছিলি তাই তুইও এই অপরাধে যুক্ত। তাই তোদের দুজনকেই ধরে নিয়ে যেতে হবে। তারপর আদালতে যদি পঙ্খি অসুস্থতা প্রমাণ হয় তখন সরকারি ভাবে ওর চিকিৎসা হবে। তবে আজ গ্রেফতার করতেই হবে।
শাকিল এবার নিজের বন্দুক বের করে পঙ্খির দিকে তাক করে বললো।
–পঙ্খি,হাতিয়ার ফেলে দাও। আর নিজেকে আইনের হাতে তুলে দাও। নাহলে গুলি চালাতে বাদ্ধ হবো।
পঙ্খি আচমকা ওর পাশে থাকা কনস্টেবল কে এক হাত পেচিয়ে ধরে তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বললো।
–হাতিয়ার আমি না। তুই ফেল। নাহলে এখুনি এর খুলি উড়িয়ে দিবো। তাই সবাই নিজেদের হাতিয়ার ফেলে দাও। আর ইন্ধনের হ্যান্ডকাফ খুলে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
শাকিল এবার ঘাবড়ে গেল। উপায় না পেয়ে নিজেদের হাতিয়ার ফেলে দিলো। আর ইন্ধনের হ্যান্ডকাফও খুলে দিল। ইন্ধন পঙ্খির কাছে এসে বললো।
–পঙ্খি ছেড়ে দাও ওঁকে। প্লিজ আমার কথা শোনো।
পঙ্খি যেন কোনো কথাই শুনছেনা। পঙ্খি এক হাতে ইন্ধনের হাত ধরলো আর এক হাতে লেডি কনস্টেবলের মাথায় বন্দুক ঠেকানো অবস্থায় ওকে নিয়ে পুলিশের জিপের কাছে গেল। ইন্ধন কে ড্রাইভিং সিটে বসতে বললো। ইন্ধনও আর উপায় না পেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো। পঙ্খি লেডি কনস্টেবলের মাথায় বন্দুক ধরে থেকেই জিপের অন্যপাশে এসে সিটে উঠে বসলো। ইন্ধন কে বললো গাড়ি স্টার্ট দিতে। ইন্ধন গাড়ি স্টার্ট দিতেই পঙ্খি লেডি কনস্টেবল কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। তারপর ওরা জিপ নিয়ে পালিয়ে গেল। ইন্ধনও ভাবলো এখন আর কিছু করার নেই। এটাই একমাত্র উপায় পঙ্খিকে বাঁচানোর। একবার এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই ও যেকোনো উপায়ে পঙ্খিকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে। তারপর আর কোনো ভয় থাকবেনা। ইন্ধন দ্রুত স্পিডে গাড়ী চালাতে লাগলো।
তবে বেশিদূর যেতে পারলোনা ওরা। কিছুদূর আসতেই চার পাঁচ টা পুলিশের গাড়ি ওদের পিছু নিলো। তবুও থামলোনা ওরা। আরও কিছুদূর এগুতেই দেখলো সামনে রাস্তা আঁটকে রেখে পুলিশ দাঁড়িয়ে বন্দুক তাক করে। ইন্ধন তবুও থামলোনা। গাড়ি আসা দেখে পুলিশগুলো লাফ দিয়ে সরে গেল। আর ইন্ধন মাঝখান দিয়ে সব ভেঙে চলে। তবে পুলিশ পেছন থেকে ওদের গাড়ির চাকায় গুলি করলো। এতে করে গাড়ির চাকা পানচার হয়ে গাড়ি থেমে গেল। ইন্ধন এবার গাড়ি থেকে নেমে পঙ্খির হাত ধরে দৌড়াতে লাগলো। তবে এতগুলো পুলিশের গাড়ির সাথে দৌড়ে আর কতদূরই বা যেতে পারতো ওরা। পুলিশের গাড়ি এসে ওদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেললো। গাড়ি থামিয়ে সবাই নিচে নেমে পঙ্খি আর ইন্ধনের দিকে বন্দুক তাক করে ঘিরে দাঁড়াল । এখানে শাকিল নেই। অন্য একজন ইন্সপেক্টর ওদের দিকে বন্দুক তাক করে বলে উঠলো।
–অনেক হয়েছে। এবার আত্মসমর্পণ করো।নাহলে গুলি চালাতে বাদ্ধ হবো।
একজন পুলিশ ওদের এগিয়ে আসতে লাগলেই পঙ্খি তার দিকে গুলি ছুড়লো। নিশানা সঠিক না হওয়ায় গুলি পুলিশের হাতে গিয়ে লাগলো।পঙ্খি বললো।
–খবরদার! কেউ এগুবে না। আমার ইন্ধন কে কেঁড়ে নিতে আসলে সবাইকে মেরে ফেলবো আমি। সবাইকে।
ইন্সপেক্টর এবার একটা কনস্টেবল কে ইশারা করলো পঙ্খির হাতে গুলি মারার জন্য। যাতে ওর হাতের বন্দুক পড়ে যায়।কনস্টেবল গুলি চালাতে নিলেই ইন্ধন সেটা দেখে পঙ্খিকে টান দিয়ে সরিয়ে দিলো। আর নিশানা পেরিয়ে গুলিটা এসে লাগলো ইন্ধনের বুকে। মুহুর্তেই থমকে গেল যেন সবকিছু। হৃদয়ের কম্পন থেমে গেল পঙ্খির।ইন্ধন শরীরের ভর ছেড়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো নিচে। কিছুক্ষণ পর ইন্ধনের নাম ধরে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো পঙ্খি। চোখে মুখে র,ক্ত জমে গেল তাঁর। তাঁকে এইমুহূর্তে কালীমূর্তির মতো দেখাচ্ছে। যে সবার জান কবজ করবে এখন। পঙ্খি এবার বন্দুক উঠিয়ে সেই পুলিশটাকে গুলি করে দিলো।তারপর এলোপাতাড়ি সব পুলিশের দিকে গুলি ছুড়তে লাগলো। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশও এবার গুলি ছুড়তে লাগলো। একের পর এক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল পঙ্খি। র,ক্তা,ক্ত শরীর লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। আহত ইন্ধন পঙ্খিকে নিজের কোলে আগলে নিলো। পঙ্খিকে এভাবে দেখার চেয়ে হাজার বার মৃ,ত্যু যন্ত্রণাও বুঝি বেশি সুখের হবে ইন্ধনের কাছে। পঙ্খি ইন্ধনের মুখপানে তাকিয়ে নিজের র,ক্তে রঞ্জিত হাতটা কাঁপতে কাঁপতে ইন্ধনের গালে রেখে অনেক কষ্টে বললো।
–আ আআমাকে ছেড়ে যাবে নাতো? সবাই খালি কেঁড়ে নিতে চায় তোমাকে আমার কাছ থেকে।
ইন্ধন অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো।
–আর কেউ আলাদা করতে পারবেনা আমাদের। আমরা এই স্বার্থপর দুনিয়া থেকেই চলে যাবো। যেখানে কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। কেউ আমাদের মাঝে আসবেনা। এপারে তো আর আমাদের ছোট্ট দুনিয়ার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। ওপারে গিয়েই নাহয় আমাদের সেই সুখের পৃথিবী গড়ে তুলবো। শুধু তুমি আর আমি। রাজপুত্র আর রাজকন্যা।
ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিলো পঙ্খি।ইন্ধনও পঙ্খির কপালে মাথা ঠেকিয়ে নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। দুজনে একসাথে পারি দিলো ওপারে। দুজন ভালোবাসার মানুষের এই নির্মম পরিণতিতে স্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। অদৃশ্য কান্নায় ছেয়ে গেল প্রকৃতি।
?হৃদয়ের লেনা দেনা এপারেতে আর হবেনা,
তোমার আমার দেখা হবে ওইপারে?
সমাপ্ত।