#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন,পর্ব_১
#মৌমি_দত্ত
-এতো রাতে এটা কাকে নিয়ে এলি তুই?
মিসেস রেহানা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন ছেলেকে। রায়ান সেসবে পাত্তা না দিয়ে কোলের মেয়েটিকে নিয়ে ছুট লাগালো নিজের রুমের দিকে। পিছু পিছু গেলো মিসেস রেহানা, রায়ানের ছোট বোন অনুবিকা আর রায়ানের বাবা আয়ান হোসেন বসে রইলেন সেভাবেই লিভিং রুমের সোফায় । ছেলের সাথে তার কোনো প্রকার সম্পর্ক তিনি রাখেননি গত ৫ বছর ধরে। কারণ ছেলে তার ব্যবসা না সামলে রাজনীতি করছে। ছেলেটা তার বড্ড প্রিয় বলেই যে তিনি এতো রাগ দেখান এই রাজনীতি নিয়ে। তা কেন তার ছেলে বোঝে না এই নিয়ে অভিমান চলছে গত ৩ বছর ধরে।
রায়ান কোলের মেয়েটিকে দ্রুত শুইয়ে দিলো নিজের বিশাল খাটে। মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে আছে। এতোক্ষনে মেয়েটাকে দেখে আতকে উঠলো অনুবিকা আর রেহানা। মেয়েটার মাথার একপাশ চিড়ে গেছে ধারালো কিছুতে গভীর ভাবে। শুধু তাই নয় রক্তে ভিজে গেছে পুরো জামা। রায়ান চিৎকার করে সার্ভেন্টসদের ডাক দিলো। দ্রুত ৩ জন কাজের লোক জড়ো হলো সেই রুমে। এই ঘরে রায়ানের ডাক সব থেকে কার্যকরী। এতো অভিমানের পরেও মাঝে মাঝে খোদ আয়ান সাহেব কেঁপে উঠেন ছেলের ডাকে। ছেলের কন্ঠে, চলা বলায় যেন তিনি তার বাবাকে দেখতে পান। রায়ান সার্ভেন্টদের আদেশ দিলো গরম পানি, স্বচ্ছ টাওয়েল আর ফার্স্ট এইড বক্সের। রায়ান এরপর তার ছোট বোন অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– দ্রুত দেলোয়ার আংকেলকে বাসায় আসতে বল। ইমার্জেন্সি।
রক্তে একধরনের ফোবিয়া আছে অনুর। অনু কথাটা শোনা শেষ হবার আগেই মাথা ঘুরে মেঝেতে পরে গেলো। তা দেখে একটা বিরক্তির শ্বাস ফেলে দৌড়ে গেলো রায়ান ছোট বোনের কাছে। বোনকে পাঁজাকোলে তুলে শুইয়ে দিলো নিজের খাটে। এখন পাশাপাশি অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে দুইটি মেয়ে, একজন পরিচিত আর আরেকজন পরিচয়হীন। নিজেকে হঠাৎই বড্ড অসহায় লাগছে রায়ানের। মাথার চুল একবার অস্থির ভাবে ঠেলে দিলো পিছনে। রেহানা ছেলের অবস্থা দেখে একবার অসহায় মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার একই গর্ভ দুই আলাদা প্রকৃতির সন্তান জন্মালো কিভাবে তা নিয়ে তিনি আজও আফসোসে থাকেন। একদিকে রায়ান তার ২৮ বছর বয়সেও এক টগবগে চিত্তধারী। আর অন্যদিকে অনুবিকা যেন অল্প ফুলের টোকায় মূর্ছা যায়। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। উত্তেজিত অবস্থায় রায়ানের থেকে কোনো কথা বের করা সম্ভব না। রায়ান নিজেই কল লাগালো দেলোয়ারের নাম্বারে।
.
.
ফ্যামিলি ডাক্তার দেলোয়ার এসে আগে ছুটে যেতে চাইলো অজ্ঞান অনুবিকাকে দেখতে। কিন্তু রেহানা বরাবরেই সৎ ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনকারি , যে গুন পেয়েছে বলেই রায়ান ঝুঁকে গেছে রাজনীতিতে। রেহানা অনুবিকার মাথার পাশেই এতোক্ষন বসেছিলো। ডাক্তারকে এদিকে ছুটে আসতে দেখে রায়ান কিছু বলতে যাবে, তার আগেই বলে উঠলো রেহানা,
– দেলোয়ার ভাই, আগে ঐ মেয়েকে দেখুন। ওর অবস্থা খুব করুন।
দেলোয়ার সাহেব এমন মূহুর্তেও রেহানার এমন কাটকাট সত্য কথা শুনে যেন অবাক হলেন। মনে মনে একচোট প্রশংসাও করলেন। তবে মেয়েটার দিকে তাকাতেই সব ফেলে গিয়ে বসলেন মেয়েটার পাশে। রায়ান বললো তখনই,
– ড্রাইভ করে ফিরছিলাম আজগরতলা শর্টকাট রাস্তা দিয়ে। তখনই গাড়ির কাছে দৌড়ে আসে মেয়েটি। আর ধাক্কা খেয়ে মাথা চিড়ে ফেলে এতোখানি। একটু চেক করে জানান প্লিজ আংকেল, সিরিয়াস কিছু নয় তো?
দেলোয়ার এতোক্ষন ক্ষতটা পরীক্ষা করছিলেন। ইতোমধ্যেই ক্ষতটা পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে ক্ষত একটু গভীর হওয়াতে কি করা ঠিক হবে বুঝতে না পেরে রায়ান অপেক্ষা করছিলো দেলোয়ার সাহেবের। দেলোয়ার সাহেব রায়ানের সবটা শুনে বললো,
– স্টিচ লাগবে না। যতোটা গভীর মনে হচ্ছে ততোটাও গভীর না। তবে ভোগাবে অনেক। একটুর জন্যে ভ্রু পেরিয়ে চোখের কাছে আসতে পারেনি এই অনেক।
তিনি দ্রুত হাতে ব্যান্ডেজ করতে লাগলেন। রায়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও রাগে গজগজ করতে লাগলো। আজকালকার ইয়াং ছেলে মেয়েদের এমন অধঃপতন তার একদম সহ্য হয় না। এতো রাতে মেয়েটা ঐ রোডে একা কি করছিলো? আর এমন ছোটাছুটি কে করে রাস্তায়? নিজের রাগ দমাতে রায়ান হাত মুঠো করে বসে রইলো। রক্ত সে আগেই মুছে দিয়েছিলো আর সার্ভেন্ট কে দিয়ে জামাও বদলে দিয়েছিলো। মেয়েটার বয়স দেখে মনে হয় না ১৬ ও হয়েছে। জামা কাপড়ের করুন অবস্থা ছিলো। রাগ অনেকটা দমে এলো রায়ানের। মেয়েটা কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে বেঁচে গেছে এমনও হতে পারে। মেয়েটির জন্য সঠিক পথ্য লিখে অনুবিকার কাছে এসে দাঁড়ালেন দেলোয়ার সাহেব। পালস, হার্টবিট চেক করে বললেন,
– ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। এই নিয়ে ৩য় বার। নিশ্চয় ওর ব্লাড ফোবিয়া আছে আপা। খেয়াল রাখিয়েন।
রেহানা মাথা নাড়িয়েই সায় জানালো। এরপর দেলোয়ার একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলো অনুবিকাকে। তারপর একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,
– আপা একটু বাদেই জ্ঞান ফিরবে ওর।
দেলোয়ার সাহেব সেদিনের মতো নিজের কাজ শেষ করে বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে মেয়েটির জন্য লেখা প্রেস্ক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে গেলেন রায়ানের হাতে। রায়ান মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পেলো।
অনুবিকার জ্ঞান ফিরতে লেগেছিলো ২০ মিনিট। এরপর মায়ের কাছেই শুনলো রায়ানের তখন ডাক্তারের কাছে বলা কথাগুলো। অনুবিকার খারাপ লাগছে মেয়েটির জন্য। খুব আদুরে মুখ, কেমন ঠোঁট উলটে ঘুমাচ্ছে।
.
.
পাখির কিচিরমিচির, সোনালী রোদের হালকা আভা চোখের উপর পড়লো পূর্ণময়ীর। কিছুক্ষন চোখ কুঁচকে সেভাবে থেকেই কয়েকবার চোখের পলক ঝাপকে চোখ খুললো সম্পূর্ন। এরপর চারদিকে চোখ বুলালো শান্ত ভাবে। বুঝতে পারলো না কিছু। সব কেমন নাচানাচি করছে মনে হচ্ছে। দুই হাতের ভরে উঠে বসার চেষ্টা করলো। তিনবার বিফল হবার পর চতুর্থ বারে কেও একটা ওকে ধরে বসিয়ে দিলো। পূর্ণ শান্ত চোখে ড্যাবড্যাব করে কৌতুহল নিয়ে তাকালো। চোখের সামনে অনুবিকাকে দেখে তাকিয়ে রইলো। ফুলকো লালচে গাল, কেমন ঠোঁট উলটে ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে পূর্ণ। তা দেখে খুব কিউট লাগলো অনুবিকার। মেয়েটা বয়সে ওর ছোট হবে ভেবেই মৃদু হেসে গাল টেনে দিলো পূর্ণর। পূর্ণর ভ্রু কুঁচকে এলো। গালে আস্তে করে হাত ঘষলো। চারদিকে পিট পিট করে তাকাতে লাগলো। তখনই দেখলো দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে একটা ছেলে ঘড়ি পড়তে পড়তে। পূর্ণ ড্যাবড্যাব করে তার দিকেও তাকিয়ে রইলো।
রায়ান পূর্ণকে জেগে গেছে দেখে খাটের কাছে এসে দাঁড়ালো। এরপর শান্ত কন্ঠে অনুবিকাকে জিজ্ঞেস করলো ,
– ভয় পেয়েছে?
অনুবিকা মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে জবাব দিলো নাবোধক। পূর্ণ ফোলা গাল বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে বললো,
– পানি।
তীক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো রায়ান পূর্ণকে। ইতোমধ্যে অনুবিকা পাশের টেবিলের জগ থেকে এক গ্লাস পানি পূর্ণর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পূর্ণ খাওয়ার থেকে বেশি গায়ে ফেলেছে গ্লাস সঠিক ভাবে ধরতে না পেরে । এরপর সবার দিকে ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। তা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রায়ান আর অনুবিকা। অনুবিকা দ্রুত পূর্ণর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পূর্ণর দুই গালে হাত রেখে বললো,
– কি হয়েছে বেবি? খারাপ লাগছে? ব্যাথা করছে মাথায়?
পূর্ণ ফোঁপাতে ফোঁপাতে আবারও ঠোঁট উলটে বললো,
– পানি।
তারপর জোড় করে একটা ঢোক গিললো। তা দেখে বুঝে গেলো রায়ান আর অনুবিকা মেয়েটার পানির তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু রায়ান বুঝে পেলো না মেয়েটাকে পানি দেওয়া হয়েছিলো তো! তাহলে না খেয়ে গায়ে ফেললো কেন? দেখে যদিও মনে হয়েছে সে পানি খেতে জানেনা। কিন্তু একটা ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়ে এতোটাও বাচ্চা না যে সে পানি খেতে পারবে না। বুকের কাছে হাত বেঁধে রায়ান সবটা পরীক্ষা করছে। অনুবিকাও অবাক হয়েছিলো। তবুও আবার পানি দিলো। পূর্ণর দিকে গ্লাস এগিয়ে দিতেই সে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, দুই হাত দিয়ে বিভিন্ন ভাবে গ্লাসটা ধরবার চেষ্টা করতে লাগলো। এরপর বিষণ্ণ ভাবে ঠোঁট উলটে আবার বললো,
– আমি পারিনা।
মায়া লাগলো অনুবিকার। কিন্তু কেন পারে না তা মাথায় প্রশ্ন এলো রায়ানের। অনুবিকা নিজ হাতে ঢোকে ঢোকে পানি খাইয়ে দিলো পূর্ণকে। এরপর টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতেই পূর্ণর চোখ গেলো বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকা রায়ানের দিকে। রায়ানের এমন দৃষ্টি দেখে সে অনুবিকার হাত ধরে নিজেকে আড়াল করে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। অনুবিকা অবাক হলো। নিজের ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সে দেখলো তার ভাই বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এতে অস্বাভাবিক সে কিছু পেলো না। এভাবে গুটিয়ে যাওয়ার মানেও বুঝলো না। রায়ান অনুবিকাকে ইশারায় সড়ে আসতে বলে এগিয়ে আসলো কালো পাঞ্জাবির হাতা গোঁটাতে গোঁটাতে কনুইয়ের কাছে এনে। পার্টি অফিসে যাবার জন্য সকালেই রেডি হয়েছে সে। অনুবিকা সড়ে আসতে চাইলেই দেখলো পূর্ণ তার বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলছে,
– না না, না না।
অনুবিকা অসহায় ভাবে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান কড়া চোখে তাকিয়ে ইশারা করলো সোজা ঘরের বাইরে যেতে। রায়ানের রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারনা আছে অনুবিকার। তাই অনুবিকা একবার অসহায় ভাবে পূর্ণর দিকে তাকিয়ে কোনোমতে জোড় করে তাকে ছাড়িয়ে উঠে চলে গেলো রুমের বাইরে।
চলবে,