#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন,পর্ব_২
#মৌমি_দত্ত
পূর্ণ চোখে জল নিয়ে ঠোঁট উলটে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তার থুতনি কাঁপছে যা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে এক্ষুনি কেঁদে দেবে। তা দেখে রায়ান এসে বসলো পূর্ণর পাশে। রায়ানকে দেখেই গতরাতের কথা তার মনে পড়লো। গতরাতে তাকে কিভাবে দুটো ছেলে অশ্লীল ইঙ্গিত দিচ্ছিলো আর সবশেষে পাকড়াও করেছিলো। তাকে কেমন গা ঘিনঘিনে ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। তাই তো সে পালিয়ে আসতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে। রায়ানকে পাশে বসতে দেখে পূর্ণ নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের দুই চোখ ঢাকলো। আর মিনমিনে স্বরে বলতে লাগলো,
– শু, শু, শু।
রায়ানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। সে মোবাইল বের করে কল লাগালো দেলোয়ারকে। অপরপাশ থেকে দেলোয়ার কল রিসিভ করতেই তাকে বাসায় আসতে বলে সে কল কেটে দিলো। প্রয়োজনের বাইরে আলাপ জমানোর মানুষ রায়ান রায়জাদা মোটেও না। এরপর মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে পুরে রায়ান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটের উপর পাটি দিয়ে নিচের পাটি ঠোঁট চেপে ধরে ভাবলো কিছুক্ষন। এই যুবক এমন অবস্থার সম্মুখীন আগে হয়নি। একটা শ্বাস ফেলে পূর্ণর হালকা কাঁপতে থাকা হাত দুটো ধরে চোখের থেকে নামিয়ে দিলো। পূর্ণ পিটপিট করে প্রথমে এক চোখ খুলে চোরের মতো দেখে নিলো রায়ানকে। এরপর দুই চোখ খুলে দেখলো রায়ান এতোক্ষনেও তাকে কিছু করেনি। তাই এক আঙ্গুল বাড়িয়ে রায়ানের হাতে পরপর দুইবার ছুঁয়ে দেখলো। এরপর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো,
– ভালো ?
রায়ান হেসে ফেললো পূর্ণর এমন কাজে। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললো,
– হুম ভালো।
পূর্ণর মুখে হাসি ফুটলো। সে আরেকটু কাছে এসে রায়ানের হাত ধরে হাসিমুখে বসলো। রায়ান নিজের হাতের উপর রাখা পূর্ণের হাত ডান হাত দিয়ে ধরে বললো,
– নাম কি তোমার?
পূর্ণ ড্যাবড্যাব করা চোখ বারবার পিটপিট করে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট করে তাকে দেখছে। ফুলকো গাল গুলো খুবই লোভনীয়। রায়ানের মন বললো একবার টেনে দেবে। আবার ভাবলো এখন না। পূর্ণ বাচ্চাদের মতো রায়ানের হাতের আঙুল নিয়ে খেলতে লাগলো। রায়ান হালকা বিরক্ত হলো। তবুও আবার বললো,
– নাম কি?
পূর্ন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
– পূর্ণময়ী।
রায়ান এবারে মৃদু হাসলো। তখন পূর্ণও বাচ্চাদের মতো খিলখিলিয়ে হাসলো। মাথা নাড়িয়ে হাসির মাঝে হঠাৎই মাথা চেপে ধরলো ” আহহ ” শব্দ করে। রায়ান কাছে এসে পূর্ণর হাত সড়িয়ে দিলো মাথার ব্যান্ডেজ থেকে। পূর্ণ ঠোঁট উলটে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
– ব্যাথা।
রায়ান মৃদু হেসে বললো,
– কমে যাবে।
পূর্ণ হাসি মুখে আবারও বললো,
– সত্যি?
রায়ান মাথা নাড়িয়ে বললো,
– হুম সত্যি।
পূর্ণতা হেসে মাথা নিচু করে রায়ানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো,
– আদর আদর?
রায়ান হতভম্ব হয়ে গেলো। হালকা অস্বস্তিতেও পড়লো। মেয়েটা অতো ছোট না। এভাবে তাহলে কিভাবে বলছে কথা? হালকা অস্বস্তি নিয়েই রায়ান কোনোমতে ব্যান্ডেজে ঠোঁট ছুঁইয়ে ছিটকে দূরে সড়ে আসলো। পূর্ণার সেসব দিকে খেয়াল নেই। সে মুখ ভরা হাসি নিয়ে রায়ানের আঙ্গুল নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। তখনই রুমে ঢুকলো রেহানা, অনুবিকা, দেলোয়ার। দেলোয়ারকে দেখেই রায়ান উঠে আসতে চাইলো। রায়ান উঠে যাচ্ছে দেখে পূর্ণ হাত ধরে ফেললো খপ করে। রুমে এতো মানুষ দেখে ভয়ই লাগছে তার একটু। সে রায়ানের হাত টেনে নিজের বুকে ধরে বললো,
– যায় না, যায় না।
উপস্থিত সবার ভ্রু কুঁচকে এলো এমন কাজে। রায়ানের কিছুই হলো না। সে যা বুঝবার বুঝে গিয়েছে। তাই মৃদু হেসে বললো,
– ডাক্তার আংকেল না দেখলে, ঔষধ না দিলে ব্যাথা যাবে না। ডাক্তার আঙ্কেল দেখুক একবার মাথাটা? আমি এখানেই আছি। ওকে?
পূর্ণতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বললো রায়ান। পূর্ণটা ঠোঁট উলটে হালকা বিরক্তি নিয়ে ছেড়ে দিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। রায়ান উঠে এসে দেলোয়ারকে বসতে দিয়ে একটি দূরে দাঁড়িয়ে বললো,
– হয়তো তার অটিজম আছে। নাম পূর্ণতা।
দেলোয়ার কথাটা রায়ানের দিকে ফিরে শুনে পূর্ণতার দিকে তাকালো। এরপর হেসে এক হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেকের জন্য। পূর্ণতা প্রথমে কোনা চোখে রায়ানের দিকে তাকালো। এরপর রায়ান চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত করতেই একগাল হেসে হাত এগিয়ে দিলো নিজেও।
– হ্যালো পূর্ণতা। আমি ডাক্তার কবির দেলোয়ার।
পূর্ণতা একগাল হেসে খপ করে স্টেথেস্কোপ নিয়ে ফেললো ডাক্তারের। এরপর সেটা দিয়েই খেলতে লাগলো। দেলোয়ার পূর্ণতার মাথার ঘাঁ দেখলো আগে পর্যবেক্ষন করে। টুকিটাকি কথাবার্তা হলো দু’জনের মাঝে। এরপর সবটা বুঝে, দেখে দেলোয়ার সাহেব উঠে গেলো। রায়ান এসে পাশে বসলো।
পূর্ণ একগাল হেসে এবার রায়ানের কাছে এসে রায়ানের কোলে বসে পড়লো ধপ করে। তা নিয়ে রায়ান পড়লো অস্বস্তিতে। রেহানা আর অনুবিকা অবাক হলো। রায়ান একবার হালকা অস্বস্তি নিয়ে মা ও বোনের দিকে তাকালো। কিন্তু পূর্ণতার সেসবে খেয়াল নেই। সে পাঞ্জাবির একেকটা বোতাম খুলছে। আবার লাগাচ্ছে। দেলোয়ার তখনই বলে উঠলো,
– ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না। রায়ান ঠিক ভেবেছো।হয়তো ও মানসিক প্রতিবন্ধী। বা হতে পারে শারীরিক বয়সের বিকাশ হলেও ওর বুদ্ধি এখনো ছোট বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেছে। সব তার কাছে স্বাভাবিক লাগবে। তাই বিশেষায়িত ডাক্তার দেখাতে হবে।
রেহানা আর অনুবিকার মায়া হলো অনেক। অনুবিকা এগিয়ে এসে পূর্ণতার মাথায় হাত রাখলো। পূর্ণ মাথা ঘুরিয়ে অনুবিকাকে দেখে ঠোঁট উলটে অভিমানী সুরে বললো,
– পঁচা পঁচা আপু। পঁচা পঁচা আপু, পালায় পালায়।
অনুবিকা খাটে বসে গাল টেনে দিলো পূর্ণর। পূর্ণ অভিমান ভুলে গেলো। দেলোয়ার রেহানাকে সাথে নিয়ে চলে গেলো তার সাথে কথা বলতে বলতে পূর্ণকে নিয়ে। পূর্ণ কখন পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে তা নিয়ে কথা বলেছে তারা। সময় লাগলেও দ্রুত শুধার আসতে পারে যত্ন নিলে। ওর সিচ্যুয়েশন আসলে কি তা বুঝাতে লাগলো।
রুমে থেকে গেলো রায়ান, তার কোলে পূর্ণ যে অনুবিকার সাথে খেলায় ব্যস্ত। অনুবিকা বারবার হাত এগিয়ে দিচ্ছে তাই ধরে বিজয়ীর হাসি হাসছে পূর্ণ।
রায়ান ভাবছে এমন একটা মেয়েকে সে পরিবারের কাছে কিভাবে পৌছাবে? পরক্ষনেই সিদ্ধান্ত নিলো বিজ্ঞাপন দেবে। তবে তার আগে জানার চেষ্টা করতে হবে মেয়েটার সম্পর্কে। অনুবিকা ভাইকে চিন্তায় দেখে পূর্ণর গালে হাত রেখে বললো,
– চলো ফ্রেশ হবে।ওকে?
পূর্ণ ভালো মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো অনুবিকাকে নিয়ে। আর চলে গেলো ওয়াসরুমে দু’জনেই। রায়ান একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে নিচে নেমে এসে দেখলো দেলোয়ার সাহেব কোথাও নেই। ড্রয়িং রুমে মনমরা হয়ে বসে আছে রেহানা। রায়ান সেদিকেই এগিয়ে গেলো।
– মা?
রেহানা মুখ তুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন। এরপর বললেন,
– মেয়েটার এখন কি করবি?
– তাই ভাবছি। ভাবছি মেয়েটার থেকে ফ্যামিলি নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা করবো। এরপর বিজ্ঞাপন দেবো।
উত্তর দিলো মায়ের পাশের সোফায় বসতে বসতে রায়ান। রেহানা ছেলের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হয়ে বললো,
– মেয়েটার খুব যত্নের প্রয়োজন। যতোদিন কাওকে পাচ্ছিস না মেয়েটার, ততোদিন এখানে থাকুক। প্রচন্ড মায়াবী দেখতে মেয়েটা।
রায়ান মৃদু হাসলো। মায়ের কথা আসলেই সত্য।
চলবে……