#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন,৩,৪
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৩
দেখতে দেখতে চোখের পলক ঝপকানোর মতো করেই মূহুর্তে কেটে গেছে ১ সপ্তাহ। প্রথম ৪ দিন কতো শতো বিজ্ঞাপন, প্রচার করা হলো পূর্ণময়ীর নিখোঁজের খবর। কেও এলো না, ফোন করলো না যাকে বিশ্বাস করা যায়। অসৎ অনেক মানুষ অবশ্য পূর্ণময়ীর রুপ দেখে পূর্ণময়ীকে ক্লেইম করেছে। কিন্তু পূর্ণময়ী তাদের দেখে অজানা মানুষদের মতো ব্যবহার করেছে। আর রায়ানও খোঁজ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়নি বলে যেতে দেয়নি। পূর্ণময়ীই শেষে একদিন খেলার ছলে জানিয়ে দিলো নিজের ব্যাপারে।
৪র্থ দিন রাতে,
পূর্ণময়ী রায়ানের সাথে ছাদে বসে আছে। রাত বাজে ১ টা। সবাই ঘুম। রায়ান ঘুম আসছে না বলে ছাদে এসে দেখে পূর্ণময়ী বসে আছে। সে এগিয়ে আসতে যাবে। তখনই কানে এলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে গানের সুন্দর স্বর,
– তুমি যাও, পরিচিত কোনো ডাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে
দিবস রজনী তোমাতে সজনী
বাড়িঘর মাখামাখি
ব্যাকুল বাসরে
যে আলো দুঃখ
সে আলোতে আমি থাকি
তুমি যাও, যে শুধু তোমারই থাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।
আকাশে ঘনালে মেঘ,
বাকি পথ হেঁটে এসে
শেষ হয়েও পড়ে থাকে অবশেষে
নিভিয়ে দিয়েছি, ফুরিয়ে গিয়েছি
ডুবিয়েছি কতো ভেলা
প্রেমিক নাবিক জানেনা সাগর
একা রাখা অবহেলা।
তুমি যাও, যে শুধু তোমারই থাকে
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।
গানটা পুরোটা শুনে চমকালো খুব রায়ান। এতো সুন্দর গান গাইতে পারা মেয়েটা কি আসলেই অটিজমে ভুগছে? পূর্ণময়ীর মাঝে কি রহস্যের গন্ধ শুধুই রায়ান পাচ্ছে? রায়ান সিদ্ধান্ত নিলো এক্ষুনি সব জিজ্ঞাসা করবে পূর্ণময়ীকে। সে গিয়ে পা ফেলে পূর্ণময়ীর পাশে বসতেই চমকে উঠলো পূর্ণ। তারপর রায়ানকে দেখেই ধুপ করে রায়ানের কোলে ট্রান্সফার করলো নিজের সিট। রায়ানের গলা ধরে রায়ানের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। রায়ান মৃদু হাসলো হাসবে না চেয়েও। পূর্ণ যে তাকে আস্তে আস্তে নির্ভরশীল করে ফেলেছে কিছু ছোট ছোট কাজে। যেমন প্রতিদিন সকালে রায়ান বের হবার সময় পূর্ণ দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ণ রায়ানের পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দিলে রায়ান যেতে পারে। তারপর রায়ান না থাকলে রায়ানের ঘর গুছায় এলোমেলো হাতে। রায়ান ফিরে এসে আগে পূর্ণকে কোলে নেবে। তারপরই রায়ান উপরে নিজ রুমে যেতে পারবে। পূর্ণকে খাইয়ে দেওয়া, পূর্ণর সাথে বসে আড্ডা দেওয়া এসবই এখন রায়ানের অভ্যেস। রায়ান মুচকি হাসলো।
এরপর পূর্ণর হালকা বাদামী কেশরাশীর মাঝে আঙ্গুল ডুবিয়ে প্রশ্ন করলো,
– পূর্ণময়ী? পরিবার নিয়ে কিছু বলো।
এভাবে কখনোই পরিবার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়নি পূর্ণময়ীকে। পূর্ণর মুখে অমাবশ্যার অন্ধকার ছেয়ে গেলো যেন। রায়ান আবারও বললো,
– কে কে আছে পরিবারে?
পূর্ণ মুখ কালো করে রায়ানের বুকে মাথা রেখে বললো,
– বাবা, মা, মামা, মামী। সব পঁচা। বাবা, মা, আমি নতুন বাসা। বাবা, মা আসে না আর। আমি একা ২ দিন। বাবা মা খুঁজি, পঁচা ভাইয়া আসে। পঁচা ভাইয়া, পঁচা কাজ, পঁচা ছোঁয়া। আমি গাড়ি ঘুম।
পূর্ণময়ীর এমন আধো আধো কথাতেই রায়ান বুঝে নিলো সবটা। মেয়েটা নিজের বাবা মা ও মামা মামীর সাথে থাকতো। বাবা মা-ই মেয়েটাকে ফেলে চলে গেছে। দুইদিন একা থেকেও বাবা মাকে না পেয়ে মেয়েটা হারিয়ে ফেলেছে রাস্তা। রায়ানের খুব ঘৃণা হলো মানুষের উপর। মানুষ এর মাঝে মানবতা নেই কেন আজকাল?
পূর্ণ এরপর কোনো খারাপ ছেলের খপ্পরে পড়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পালাতে গিয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট। রায়ানের হাত মুঠো হয়ে এলো রাগে। পরমূহুর্তেই খিলখিল শব্দে হাত শিথিল হয়ে এলো। মুগ্ধতা নিয়ে পূর্ণময়ীর দিকে তাকাতেই দেখলো নিজের লম্বা চুলের একগাছি রায়ানের ঠোঁটের উপরে গোঁফের মতো ধরেছে। হেসে ফেললো রায়ান নিজেও। পূর্ণময়ী রায়ানের বুকেই শুয়ে পড়লো সে রাতে। ভোর হতেই পূর্ণকে পূর্ণর রুমে দিয়ে রায়ান নিজের রুমে চলে গেলো। কেন যেন রায়ানের পূর্ণময়ীকে মনে হয় না কোনো অটিজম রোগী। যদিও হ্যাঁ এটা ঠিক যে মানসিক ভাবে অটিস্টিক মানুষদের মাঝে প্রায়শই বিভিন্ন অত্যাশ্চর্য গুণ দেখা যায়। কিন্তু রায়ানের মন মানছে না এই মেয়েকে অটিজম ভিক্টিম হিসেবে। রায়ান সিদ্ধান্ত নিলো অতি দ্রুত মেয়েটিকে একটি ভালো ডাক্তার দেখাবে।
.
.
সে রাতের পর আর খোঁজ করা হয় না পূর্ণর বাবা মায়ের বা কারোর। রায়ান নিজেই সবাইকে জানিয়েছে পূর্ণর কথা সবটা। তবে এই একসপ্তাহে হয়ে গেছে অনেক কিছু। কোনো এক কারণে রায়ান বাবার সাথে বসে খাবার খেতেন না। আয়ান সাহেবের সামনে যেতেন না। কিন্তু পূর্ণর জন্যে সে অদৃশ্য অলিখিত নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। খুব বেশি ফ্রি না হলেও আয়ান সাহেবের আর রায়ানের অবস্থা ভালো হয়েছে। পূর্ণ বলতে পাগল রেহানা আর অনুবিকা হোসেন। রায়ানের হাত ছাড়া অবশ্য খাওয়া দাওয়া করানো কষ্টকর হয়ে পড়ে তাদের জন্য৷ আর পূর্ণ রায়ান পাগল। আয়ান সাহেবও পূর্ণকে পেয়ে যেন বাচ্চা হয়ে যায়। সারাদিন পূর্ণর রুটিন হলো শুধুই ঘুম থেকে উঠে রেহানাকে সঙ্গ দেওয়া, রায়ানের হাতে তিন বেলা মেপে খাওয়ার খাওয়া, অনুবিকার সাথে খেলাধুলা, অনুবিকা পড়তে বসলে তার টেবিলে রায়ানের রুম থেকে নেওয়া ইংলিশ উপন্যাসের বই নিয়ে বসে থাকা। যদিও অনুবিকা আর রেহানা ভালোই জানে এই মেয়ে অনুবিকাকে নকল করতেই বসে থাকে। তবে রাতের ঠিক ৮ টায় সে সোফায় পা গুটিয়ে ভদ্রমেয়ে হয়ে বসে থাকে রায়ানের অপেক্ষায়। রায়ান বেল বাজাতেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে রায়ানকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। এরপরেই রায়ান ঢুকতে পারে। ঘরের সবাই পূর্ণকে নিয়ে অনেক খুশী।
.
.
রাত ৮ টা বাজে। পূর্ণ সোফায় বসে আছে। আজ সকালে রায়ানের বাইরে যাওয়ার পর থেকে সে অস্থির হয়ে আছে। রায়ান গেছে আজ একটা সভায়। পূর্ণর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। রেহানা আর অনুবিকা বিষয়টি দেখে বুঝবার চেষ্টা করলেও কিছু বুঝে আসেনি তাদের সারাদিনে। এদিকে ৮ টা পেরিয়ে বাজলো ১০টা। রেহানা আর অনুবিকা বিষয়টা স্বাভাবিক ভেবে রাখলো। কিন্তু পূর্ণ হঠাৎ কি অজানা কারণে কান্না করে দিলো। পূর্ণর কান্নার কারণ অনেক কষ্টে জানতে পেরেছেন আয়ান সাহেব, রেহানা আর অনুবিকা। কান্নার কারণ তার ভয় লাগছে। কেন ভয় লাগছে জিজ্ঞেস করলেই শুধু রায়ানের নাম নিচ্ছে। সবাই যখন পূর্ণর কান্না থামাতে ব্যস্ত। তখন রেহানার মোবাইল বেজে উঠলো। রেহানা ব্যস্ত হাতে তা রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে যা শুনলো তা শুনে সে মূহুর্তের মাঝে নিজ স্থানে জমে গেলো। অনুবিকা আর আয়ান অনেক করে জিজ্ঞেস করতেই কাঁপা কন্ঠে বললো,
– রায়ান হাসপাতালে।
পূর্ণর কান্নার দমক বাড়লো। রেহানাও যুক্ত হলো সাথে। অনুবিকা নীরবে কাঁদতে কাঁদতে সবাইকে সামাল দিয়ে নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আয়ান সাহেব ভাবতে লাগলেন পূর্ণর কান্না নিয়ে। মেয়েটা কি তাহলে মনে মনে আন্দাজ করে ফেলেছিলো রায়ানের ক্ষতি?
.
.
সবাই হাসপাতালে পৌছাতেই শুনলো রায়ানের অবস্থা এতোটাই ক্রিটিকাল যে ডাক্তাররা অপারেশন করতে ভয় পাচ্ছে। একটা কাঁচ খুব বাজে ভাবে ঠিক এমন স্থানে ঢুকেছে, যেখানে একটা ভুল হলেও ব্রেইনের উপর থাকা পর্দা ছিড়ে যেতে পারে। অনুবিকা নিজেই ছুটাছুটি করছে। তখন পূর্ণ ছুটে গেলো ডাক্তারদের কাছে,
– Can i invite Mr.Henrik? You people must have knowledge about his popularity. Plz approve my decision. ( আমি কি মিস্টার হেনরিক কে আমন্ত্রন জানাতে পারি? আপনারা নিশ্চয় তার খ্যাতি সম্পর্কে জানেন। দয়া করে আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিন)
অনুবিকা, রেহানা আর আয়ান চমকে তাকালো পূর্ণর দিকে। পূর্ণ এবার ছোটাছুটি শুরু করলো। হাসপাতালের রিসিপশন থেকে কল লাগালো তার হেন আংকেলকে। আর অনুবিকা, রেহানা ও আয়ান ভাবতে লাগলো কিভাবে সম্ভব একটা অটিস্টিক রোগীর পক্ষে আচমকা এতো ভালো ভাবে ইংলিশ বলা। অনুবিকার তখনই মনে আসলো একটি কথা। পূর্ণর বাংলাগুলো কেমন যেন ভাঙ্গা, চুলের রঙটাও স্বাভাবিক কালো নয়, বাদামী ধরনের। আর পূর্ণ কখনো তার টেবিল থেকে বাংলা সাহিত্যের কোনো বই নেয়নি। সবসময় ইংলিশ বই নিয়েছে। কিন্তু অনুবিকা, রেহানা ভেবেছিলো অনুবিকাকে নকল করতে এমন করতো পূর্ণ। আচমকা চোখের সামনে ছোটাছুটি বাড়তে দেখে সে ভাবনায় ইতি টানলো অনুবিকা। মিস্টার হেনরি ফ্লাইট নিয়ে আসতে লেইট হয়ে যাবে। তাই সে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অপারেশন থিয়েটারে লিড করবেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা খুব অবাকই হলো। একটা সামান্য মেয়ের কথায় মিস্টার হেনরি রাজি হবেন তা ধারণা ছিলো না তাদের। তবুও তারা নিজেদের বেস্ট প্রুভ করতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলো। যদিও ডাক্তাররা জানিয়ে গেছেন অপারেশনে ঝুঁকি বেশি।
চলবে,,
#পূর্ণময়ীর_বিসর্জন
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৪
অপারেশন থিয়েটারের সামনে চাতক পাখির মতো বসে রইলো ৪ টি মানুষ। প্রায় ২ ঘন্টার কাছাকাছি শ্বাস রুদ্ধকর মূহুর্ত। অনুবিকা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাইটাকে সে বড্ড ভালোবাসে। ভয় পায় ঠিকই, কিন্তু ভালোও কম বাসে না। রেহানা আয়ান সাহেবের বুকে মাথা হেলিয়ে বসে আছেন। দু’জনের মাঝেই ছেলে হারানোর ভয়। প্রথম সন্তান তো সকলের বড্ড মায়ার হয়। ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন। আর পূর্ণ সে করিডোরের এক মাথায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এই মেয়েকে শান্ত করা যাবে না বুঝতে পারলো অনুবিকা ও রেহানা। তাই তারা চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। ডাক্তাররা বের হয়ে আসলো খানিক বাদেই। পূর্ণ ছুটে গেলো। এরপর ছুটে গেলো অনুবিকাও। রেহানা আর আয়ান নিজ নিজ জায়গায় বসেই আকুল হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদা এপ্রোন পড়া মানুষ গুলোর দিকে। ডাক্তারদের মাঝে যে অপারেশন লিড করছিলেন, ডাক্তার হানিফ। তিনি এগিয়ে আসলে এক পা। পূর্ণ আর অনুবিকার দিকে তাকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,
– ফার্স্ট টাইম এতো ক্রিটিকাল অপারেশন আমরা এক্সিকিউট করেছি। থ্যাংক্স টু গুড এন্ড ডাক্তার হেনরি যে আমরা সফল হয়েছি। পেশেন্ট আউট অফ ডেঞ্জার। কিন্তু এখনো জ্ঞান আসেনি। এনেস্থিসিয়া কাটতে সময় লাগবে। আপনারা স্পেশাল কেবিনে দেখে নিতে পারবেন পেশেন্টকে।
শব্দ করেই কেঁদে উঠলো পূর্ণ। অনুবিকার চোখেও সুখের অশ্রু। মাথা নিচু রেখে সে পূর্ণকে আগলে নিলো বুকে। সব ডাক্তাররা চলে যাচ্ছিলেন। তখনই ডাক্তার হানিফ দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফিরে আসলেন পূর্ণর কাছে। এরপর কৌতুহলী ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
– ডাক্তার হেনরি কে কিভাবে রাজি করলেন?
পূর্ণ জলভরা চোখে নাক টেনে বোকা বোকা ভাবে তাকিয়ে রইলো। ডাক্তার তখনই ইংলিশে প্রশ্ন করলো আবারও,
– how did you manage him to stay connected? ( তুমি তাকে কিভাবে সাথে থাকতে রাজি করালে?)
পূর্ণ মৃদু হেসে বললো,
– He is my uncle.. He loves me more than his life. He was my neighbour in london. ( সে আমার আংকেল হয়। সে আমাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। লন্ডনে সে আমার প্রতিবেশী ছিলো)
ডাক্তার হানিফ মৃদু হেসে পূর্ণর মাথায় হাত রাখলেন। এরপর চলে গেলেন। অনুবিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিজ সিটে বসে থাকা আয়ান আর রেহানাও তাকিয়ে রইলো। লন্ডন? ইংলিশ? এসব পূর্ণর সাথে যেন যাই না। পূর্ণ দ্রুত এগিয়ে গেলো অপারেশন থিয়েটার থেকে স্ট্রেচার করে বের করে স্পেশাল কেবিনে নিয়ে যেতে থাকা রায়ানের দিকে। মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে তার। পূর্ণর যেন বুক ফেঁটে কান্না আসছে। তবুও চুপ থাকলো। একদল ওয়ার্ড বয় আর নার্সের পিছন পিছন সেও দৌড়ে ছুটতে লাগলো স্পেশাল কেবিনের দিকে। আর মৃদু পায়ে অবাক হয়ে হেঁটে আসতে লাগলো অনুবিকা আর রেহানা-আয়ান।
.
.
পাক্কা ৩ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো রায়ানের। অনেকক্ষন চোখ বন্ধ রাখার কারণে বা অন্য কারণে মাথা ভাড় আর চোখে ঝাপসা লাগতে লাগলো সব। অনুভব করলো কেও তার হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদছে। রায়ান শুকনো একটা ঢোক গিলে কয়েক বার চোখের পলক ঝাপকে নিলো। এরপর ঘাড় ঘোড়াতে গিয়ে বুঝলো মাথাটা একটু বেশিই ভাড় লাগছে তার। তবুও কোনোমতে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো পূর্ণ রায়ানের হাত ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে চোখের সাথে ধরে। রায়ানের মুখে ব্যাথাতুর একটি হাসি ফুটলো। একদিকে মেয়েটিকে কাঁদলে কোনো ঘন রহস্যমন্ডিত বনের মায়াবিনী রাণির মতো লাগে। আবার বুকের কোথাও ছুড়িকাঘাত ও হয় যেন। রায়ান কিছু বলতে যাবে। তখনই বুঝলো তার শরীর অতিরিক্ত মাত্রায় দূর্বল বোধ করছে। কানে এলো দরজা খুলার আওয়াজ। আলতো করে মাথা ফিরিয়ে দেখলো অনুবিকা, আয়ান সাহেব আর রেহানা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। রেহানা দ্রুত পায়ে ঢুকলেন রুমে। রায়ানের বুকে আলতো করে মাথা রেখে কেঁদে ফেললেন যেন। অনুবিকার চোখেও জল চিকচিক করছে। আয়ান সাহেব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তার শুকনো মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে ছেলের এই অবস্থায়। রায়ান আলতো করে স্যালাইন চলতে থাকা ডান হাত তুলতে গিয়ে ” আহ ” করে আওয়াজ করে উঠলো। পূর্ণ ঝট করে মাথা তুলে তাকালো। দ্রুত চোখ মুখ মুছে সে উঠে দাঁড়ালো। রায়ানের দিকে রেগে মেগে তাকিয়ে বললো,
– আই হেইট ইউ রায়ান। আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ।
এই তিন বাক্যের কথাটা বলতে গিয়ে যেন কান্না আরো উপচে এসেছে পূর্ণর গলা দিয়ে। রায়ান অবাক হয়ে পূর্ণর এতো মোলায়েম ভাবে ইংলিশ বলার বিষয়টিতে তাকিয়ে থাকলো। হচ্ছে টা কি এসব? মাথা ঘুড়িয়ে অনুবিকার দিকে তাকাতেই অনুবিকা ইশারায় আশ্বস্ত করে বললো সব পরে জানাবে। রায়ান তবুও যেন শান্ত হতে পারলো না। তার মাঝে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো আগের সেই রহস্যের গন্ধ।
.
.
গতকালকে রায়ানের জ্ঞান ফেরার পর আবারও তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। রেহানা আর আয়ান রুমের বাইরে অপেক্ষা করেছে আর অনুবিকা আর পূর্ণ রুমের ভেতর। আজকে সকালে ১২টার দিকে রায়ানের জ্ঞান ফিরার পর রেহানা ছেলেকে ধরে অনেকক্ষন কাঁদলেন। ঘুমটার পর কিছুটা ভালো অনুভব করলেও শরীরে অদ্ভুত এক দুর্বলতা আর মাথার হালকা ভাড় ভাবটা কাটেনি রায়ানের। তবুও মৃদু হাসি মুখে রেখে সে মাকে সামাল দিয়েছে। শত হোক মায়ের আবেগ যে সন্তানকে ঘিড়ে বেশিই হয় তা রায়ান বুঝে। আয়ান সাহেব চুপচাপ কিছুক্ষন ছেলের পাশে বসে ছিলেন শুধু। এরপর ছেলের মাথায় হাত রেখে উঠে গেলেন। রায়ান হয়তো অনেক কিছুই বলতে চাইছিলো আর আয়ান সাহেবও হয়তো বলতে চাইছিলেন অনেক কিছু। কিন্তু বলা হলো না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রত্যেকটা সন্তান মায়ের কাছাকাছিই থেকে যেতে পারে। কোনো এক কারণে দূরত্ব চলে আসে সারাজীবন নিজের মনে বেস্ট হিরো ভেবে আসা “বাবা ” নামক মানুষটির সাথে। কিন্তু ভালোবাসা আড়ালে আবডালেই রয়ে যায়।
অনুবিকা রায়ানকে খাইয়ে দিচ্ছে স্যুপ। একটু আগে রেহানা আর আয়ানকে একপ্রকার ধরে বেঁধে বাসায় পাঠানো গেলেও পূর্ণকে এই রুমের বাইরেই নেওয়া যায়নি। সে নিষ্পলক ভাবে রায়ানের দিকে তাকিয়ে রায়ানের মুখোমুখি এক সোফায় বসে আছে গালে হাত দিয়ে। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। নাকে একটু পর পর ঘষছে, কান্নার কারণে সর্দির মতো হয়ে গেছে বুঝা যাচ্ছে। রায়ানের খবরটা শোনার পর একগ্লাস পানিও খায়নি সে।অনুবিকা খেয়াল করলো তার ভাইয়ের একটানা নজর পূর্ণর দিকে স্থির। অনুবিকা আলতো কাশলো। রায়ান দ্রুত চোখে সড়িয়ে নিলো পূর্ণর থেকে। অপ্রস্তুত হাসলো অনুবিকার দিকে তাকিয়ে। অনুবিকা না চাইতেও ফিক করে হেসে ফেললো। এরপর বললো,
– জানিস ভাইয়া? কাল তুই সকালে বের হবার পর পূর্ণ খুব অস্থির অস্থির করছিলো। আমরা অনেক চেষ্টা করেও সামাল দিতে পারিনি। তোর আসার সময় পার হয়ে যাবার পর সে কি কান্না মেয়েটার। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলাম তোর কল না ধরা আর দেরিতে আসা ব্যাপারটাকে। পূর্ণই বুঝে গেছিলো কিছু একটা হয়েছে। যখন শুনলো তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে। মা কি কাঁদবে, পূর্ণই সব ভাসিয়ে দিতে চাইলো যেন কেঁদে কুটে। হাসপাতালে এসে ডাক্তার জানালো অপারেশন করতে হবে কিন্তু তারা করবে না। কারণ অনেক ক্রিটিকাল অবস্থা ছিলো তোর। গাড়ির কাঁচ এমন বাহবে মাথায় গেঁথেছিলো যে একটু ভুল হলে হয়তো ব্রেইনে…
অনুবিকার চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়লো। রায়ান ডান হাত কোনোমতে উঁচিয়ে বোনের চোখের জল মুছিয়ে দিলো হাসিমুখে। অনুবিকাও নিজেকে সামলে নিলো। ভাইয়ের সামনে কেঁদে ভাইকে উত্তেজিত করতে চায় না সে। অনুবিকা এরপর হাসি মুখে বললো,
– আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম।তখনই বাচ্চাদের মতো পূর্ণ ছুটে গেছিলো ডাক্তারদের কাছে। বিখ্যাত ডাক্তার হেনরিক ফেয়োলকে ডাকানোর জন্য পারমিশন চাইলো। ডাক্তাররা হয়তো ভেবেছিলো পূর্ণ ঠাট্টা করছে। তাই পারমিশনও দিয়েছিলো। পূর্ণ ঠিকই হাসপাতালের রিসিপশন থেকে কল করলো ডাক্তার হেনরিককে। ডাক্তার হেনরিক নিজের পার্সোনাল কাজ ফেলে তোর অপারেশন থিয়েটার ভার্চ্যুয়াল ভাবে লিড করেছে। আর ফিজিক্যালি ডাক্তাররা অপারেশন করেছে। অপারেশনে অনেক ঝুঁকি ছিলো। তবুও সফল হয়েছে শুকরিয়া আল্লাহকে।
রায়ানের ভ্রু কুঁচকে রইলো। পূর্ণর এসব কাজ সে কোনোভাবে নিতে পারছে না। তাহলে কি এতোদিন পূর্ণ এতোদিন তাদের সাথে নাটক করে গেছে? এতোটা খারাপ কি হবে এই মায়াবিনী? রায়ান খুব অসহায় বোধ করতে লাগলো হঠাৎই। ঘাড় ঘুড়িয়ে মুখোমুখি বসে থাকা পূর্ণর দিকে তাকিয়ে দেখলো সোফাতেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রয়েছে সে অগোছালো ভাবে। অনুবিকাও ভাইয়ের নজর অনুসরণ করে তাকালো একবার। নিজের ভাইয়ের চোখে সে পূর্ণর জন্যে বিশেষ জায়গা দেখে এসেছে সবসময়। আজ সেখানে সন্দেহ দেখতে পেয়ে একনজরেই তাকিয়ে রইলো।
চলবে,