#জীবনতরী
#পর্ব_১
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
পাহাড়তলি গ্রামে এই সন্ধাবেলায়ই রাত নেমে এসেছে। রাস্তাঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার। গরমের দিনগুলোতে লোডশেডিং এখানে নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। সিদ্দিক সাহেব যখন বাড়িতে প্রবেশ করলেন তখন তার পরনে একটা স্যান্ডু গেঞ্জি আর পায়জামা। সদর দরজা খুলেই বাবাকে এই অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠল উনার বড় মেয়ে সাদিয়া। অষ্টাদশী সাদিয়ার স্পষ্ট মনে আছে, সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও উনার পরনে ছিল শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবী আর পায়জামা।
উদ্বেগ জড়ানো কন্ঠে সাদিয়া জিজ্ঞাসা করল, “আব্বা তোমার এই অবস্থা ক্যান? পাঞ্জাবি কই?”
মেয়েকে আশ্বস্ত করে সিদ্দিক সাহেব বললেন, “কিছু হয়নাই আম্মাজান, পরে শুইনো।”
বাবার কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল সাদিয়া।
“মা.. ও মা… এদিকে আসো।”
” আহ, সাদিয়া.. কি করছিস মা? কিছু হয়নি তো।”, বললেন সিদ্দক সাহেব।
উনার নিষেধে অবশ্য খুব একটা কাজ হল না। কারন সাদিয়ার চেঁচামেচিতে এর মধ্যেই ওর ছোট বোন সামিয়া এসে পড়েছে।
“আব্বা তুমি খালিগায়ে বাজারে গেছিলা?”, পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ুয়া সামিয়ার সরল জিজ্ঞাসা।
মাহফুজা বেগম রান্না করছিলেন। মেয়েরা ইলিশ মাছ খেতে চেয়েছে। দুই মেয়ের চিতকার চেঁচামেচি শুনে খুন্তি হাতে ছুটে এসেছেন তিনি। স্বামীর অবস্থা দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সিদ্দিক সাহেবের দিকে।
ছোট্ট একটা ব্যাপার নিয়ে মা মেয়েরা মিলে তুলকালাম অবস্থা করবে ভাবেননি সিদ্দিক সাহেব। যারপরনাই বিব্রতবোধ করছেন তিনি এখন। সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কেউ ছাড়বে না দেখে মুখ খুললেন তিনি।
” রূপগঞ্জ বাজার থেকে আসার সময় এক পাগলা ভিখারি বলল ভাইজান একটা পাঞ্জাবি দেন আল্লাহ আপনারে মেলাকিছু দিবে। টাকা দিতে চাইছিলাম। কিন্তু সে পাঞ্জাবিই চায়।”
” তুমি রূপগঞ্জ থেকে এই অবস্থায় আসছো আব্বা? মানুষ দেখলে তো বলবে সিদ্দিক মাস্টার পাগল হয়ে গেছে। আর এই কথাটা এতক্ষণ বললে কি হত? জানো কত চিন্তা হচ্ছিল?”, অনু্যোগের সুরে বলল সাদিয়া।
“মা রে, ডান হাতে করা দান খয়রাতের কথা বা’হাত রে ও জানতে দিতে নাই। তোমরা তুলকালাম না বাজাইলে তো আমি গোপন রাখতাম বিষয়টা”, বললেন সাদিয়া-সামিয়ার বাবা।
চিন্তার রেখা সরে গেছে মাহফুজা বেগমের কপাল থেকে। পরক্ষনেই মনে পড়ল, চুলার আঁচ কমিয়ে আসেননি।
” তোমাদের বাপ মেয়ের পাল্লায় পড়ে আমার তরকারি পুড়ে গেল মনে হয়। আমি যায়। সাদিয়ার আব্বু, হাত মুখ ধুয়ে আরাম কর, আমি সামিয়াকে দিয়ে চা পাঠাইতেছি।”
” আহা আম্মা ওইটুকু পিচ্চির হাতে গরম চা পড়লে কি হবে বল তো? আমি আসতেছি।”
” এই আপু, আমাকে পিচ্চি বলবি না। আমি এখন ফাইভে পড়ি।”
” ওলে আমাল বুলি লে, ভা ভাগ…”
দুই বোনের খুনসুটি দেখে চোখে পানি চলে এলো সিদ্দিক সাহেবের। তাই দ্রুত মেয়েদের সামনে থেকে সরে গেলেন, চোখের পানি আড়াল করতে।
সামিয়া হওয়ার পরে তার স্ত্রীর কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। আর কখনো মা হতে পারবেন না তিনি। তাই মেয়ে দুটোকে জানপ্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন দুজনে মিলে। কখনো কিছুর অভাব রাখেননি। এই দুই মেয়ে হাসি, আনন্দে, খুনসুটিতে ঘরটা আলো করে রেখেছে। বড় মেয়েটার চলে গেলে ঘরটা খালি হয়ে যাবে একদম।
সাদিয়া আঠারোয় পড়ার পর থেকেই বাড়িতে রুস্তম ঘটকের আনাগোনা বেড়েছে খুব। বিভিন্ন পাত্রের বায়োডাটা নিয়ে হাজির হয়। সবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটা। সিদ্দিক সাহেবের মন টানেনা এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতে। সামনে এডমিশন টেস্ট। তার খুব ইচ্ছা, মেয়েটা ডাক্তারি পড়বে। দেশ দশের সেবা করবে। পড়াশুনার পাট গুছিয়ে ফেললে নাহয় বিয়ে দেওয়া যাবে। সাদিয়ার মা আবার বিয়েশাদি না করে পড়াশুনার পক্ষে না। গ্রামে সাদিয়ার বয়সী মেয়েরা বিয়ে করে এক বাচ্চার মা হয়ে গেছে। প্রতিবেশী মহিলারা বলে মাস্টারসাহেব মেয়েকে ঘরে বসিয়ে আইবুড়ো করছে। এসব কটুকথা উনার ভাল লাগে না। স্বামীকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।
সিদ্দিক সাহেব চিন্তা করেছেন, মেয়েকে ঢাকায় পাঠাবেন। অনেক ভালো ভালো কোচিং সেন্টার আছে ঢাকায়। উনার এক প্রাক্তন ছাত্র আছে ঢাকা মেডিকেলে পড়ে, নাম তমাল। ওর কাছে ফোন করে আজ খোঁজ নিয়ে শুনেছেন কোন কোচিং সেন্টারটা ভাল। তমাল বলেছে, কোচিং সেন্টারগুলোতে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে পরীক্ষার পরপরই। তমাল এ ও বলেছে, সাদিয়াকে নিয়ে যদি তিনি ঢাকায় আসেন, তাহলে ও আগেই হোস্টেলে সিট বুকিং দিয়ে রাখতে পারবে। উনিও কোনও চিন্তা না করে তমালকে বলেছেন সব ব্যাবস্থা করতে। এ সপ্তাহেই তিনি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে যাবেন সাদিয়াসহ। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মাহফুজা বেগমকে এসব জানাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি। মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে স্বামীর এত আদিক্ষ্যেতা পছন্দ না তার।
” মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে আর উনি আসছেন মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে পড়াবেন। এসব করলে লোকে কি বলবে সাদিয়ার আব্বা? এই তল্লাটে সাদিয়ার সমান কোনও আবিয়াইত্তা মেয়েমানুষ আছে বল তো দেখি?”
” তোমার মেয়ে ডাক্তার হলে এই লোকেরাই বাহাবা দিবে দেখো। তুমি আর বাগড়া দিয়ো না তো।”
” ও আমি বাগড়া দেই না? মেয়েগুলারে বুকে করি আমি মানুষ করছি, আমি…। তুমি তো সারাদিন ইস্কুল আর ছাত্র নিয়েই ছিলে। আমি মা, আমি কি সাদিয়ার খারাপ চাই? ”
” আমিও তো খারাপ চাইনা বউ। একটু চিন্তা করো। মেয়েটা আমার মেলা মেধাবী। হেসেল ঠেলার জন্য ওর জন্ম হয়নি। ”
” হ আপনার মেয়ে তো ব্যারিস্টার হবে। ”
” উহু.. ডাক্তার.. ”
” যা খুশি করো তো। আমি গেলাম। অসহ্য। ”
চলবে..