#জীবনতরী
#পর্ব_২
লেখনি- Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
অবশেষে সাদিয়াকে ঢাকায় পাঠাতে রাজি হয়েছেন মাহফুজা বেগম। তিনি এখন মেয়ের জন্য ছোটবড় সব দরকারি জিনিস গুছিয়ে দিতে ব্যাস্ত।সিদ্দিক সাহেবের কথামত কোচিং সেন্টারের আশেপাশেই একটা লেডিস হোস্টেলে সিট ঠিক করেছে তমাল। তমাল থাকায় সবকিছু অনেক সহজ হয়ে গেছে, চিন্তা করেন সিদ্দিক সাহেব। তমালের কথা মনে হতেই ফোন করল তমাল।
“স্যার আসসালামুআলাইকুম। ভালো আছেন?”
“এইতো বাবা ভাল। তোমার কি খবর?”
“এই তো স্যার আলহামদুলিল্লাহ। রাতে রওনা দিচ্ছেন তো?”
“হ্যা বাবা, ইনশাআল্লাহ”
“ঠিক আছে স্যার, কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। পৌঁছার ঘন্টাখানেক আগে আমাকে ফোন দিবেন স্যার। আমি কাউন্টারে আসব। ওখান থেকে একসাথে হোস্টেলে যাবো। সব ঠিকঠাক করে কোচিং সেন্টারে চলে যাবো ওখান থেকেই।”
“আরে না না। তুমি আবার কষ্ট করে বাসস্ট্যান্ড আসবে কেন?”
“কষ্টের কিছু না স্যার। আপনি একটু জানাবেন। রাখি তাহলে আজ।”
“আচ্ছা বাবা।”
তমালের সাথে কথা শেষে সাদিয়ার ঘরে আসলেন তিনি। সাদিয়ার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে মাহফুজা বেগম। আরামে চোখ বন্ধ করে আছে মেয়েটা। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল তার। সিদ্দিক সাহেব খুব ভাল মতই জানেন, আজকের পর থেকে সাদিয়া এই বাড়িতে দুই দিনের অতিথি হয়ে যাবে। ভার্সিটি লাইফ, পড়াশুনা, বিয়ে, সংসার, এসবের চক্র শেষ হবে না কখনো। মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে ছুটি কাটাতে আসবে, এই যা।
মাহফুজা বেগম বরং শান্ত আছেন স্বামীর তুলনায়। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তার মনের ভেতরে কি চলছে। মা মেয়ে দুজনেই চুপ। ঘরজুড়ে বিচরণ করছেন অকৃত্রিম নিরবতা। সিদ্দিক সাহেবকে চেয়ার টেনে বসতে দেখেও কেউ কিছু বলল না।
সিদ্দিক সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ” সাদিয়ার মা, আমাকে এককাপ চা দিতে পারো। বড্ড চা তেষ্টা পেয়েছে।”
মাহফুজা বেগম সাদিয়ার চুল বেধে দিতে দিতে বললেন, “এই সময় চা খাবে? আচ্ছা দিচ্ছি।”
স্ত্রী উঠে যেতেই সিদ্দিক সাহেব মেয়েকে শুধালেন, ” গোছগাছ শেষ? আম্মাজান। ”
“হ্যা আব্বা”, ছোট্ট করে উত্তর দিল সাদিয়া।
” মন দিয়ে পড়ালেখা করবে কিন্তু। চান্স তোমাকে পাইতেই হবে আম্মা।”
সাদিয়া মাথা নিচু করে থাকলো। পড়াশুনায় বরাবরই ভালো ও, কিন্তু বাবার কথার ধরনে ভীষণ নার্ভাস লাগছে। মাকে কত কষ্ট করে রাজি করিয়েছেন তাফ বাবা সেটা ওর অজানা নয়। দিনরাত পাড়া প্রতিবেশিদের কটু কথা ও হজম করতে হচ্ছে ওর বাবা মা কে।
” তুমি চিন্তা করো না আব্বা। শুধু দোয়া করো আমার জন্য।”
” মা রে, চিন্তা কি আর ইচ্ছা করে করি? ও এমনিই এসে যায়। নতুন পরিবেশে বিপথে চলে যাসনে যেন। তোর উপর আমার অনেক আশা ভরসা। আর বাবা মায়ের দোয়া তো সবময়ই থাকে”
আদেশ নিষেধের বহর শেষ না হতেই তিন কাপ চা নিয়ে হাজির হলেন মাহফুজা বেগম। স্ত্রীর সামনে বিরূপ কোনও কথা বলার রিস্ক নিলেন না সিদ্দিক সাহেব। কখন হুট করে উলটে যায় বলা তো যায়না।
প্রসঙ্গ ধামাচাপা দিতে তাই বললেন,”সামিয়া কই?ওকে দেখতেছিনা”
“ও তো প্রাইভেট থেকে আসেনি আব্বা।“
“আজকের দিনটা প্রাইভেটে না গেলেই তো পারতো।“
“স্যার নাকি পরীক্ষা নিবে আজকে, যেতে চাচ্ছিল না তোমার আদরের দুলালী। আমি জোর করে পাঠাইছি। এক মেয়েকে বিদ্যাসাগর বানাতে নিয়ে যাচ্ছো, আরেকজন মূর্খ থাকবে ক্যান?”
“আহ সাদিয়ার মা, আজকের দিনটা একটু মুখে লাগাম দাও।”
“লাগাম দিয়েই তো রাখছি। মানুষের কথা তো তোমার হজম করা লাগে না। কিছু বলতেছি আমি?”
সিদ্দিক সাহেব ভীষণ রাগ করলেন। অবশ্য তারচেয়েও বেশি বিরক্ত হলেন।
“তুমি আবার মানুষের কথা টানতে শুরু করলে সাদিয়ার মা? মেয়েটা চলে যাবে আজকে। আর তুমি নাটক শুরু করছো। যত্তসব!!”
আহত দৃষ্টিতে স্বামীর গমনপথে তাকিয়ে থাকলেন সাদিয়ার মা। তিনিও চান মেয়েরা পড়ালেখা করুক, বড় হোক, কিন্তু আগে বিয়ে থা করে থিতু হোক। মেয়ে মানুষের বয়স তো থেমে থাকে না। পাড়া প্রতিবেশীরা কানাঘুষা করে। সেসব ভালো লাগেনা তার। সংসারের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে করছেন বছরের পর বছর। অথচ মেয়ের ভালমন্দের বিষয়ে নাক গলালে সেটা নাটক হয়ে গেলো আজ। আনমনে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছলেন তিনি।
দুহাত বাড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল সাদিয়া। মায়ের শরীর যে কান্নার দমকে কাঁপছে সেটা বোঝে ও। মায়ের মন খারাপ দুহাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় প্রাণপণ।
“আম্মা, তুমি একবার মানা করো, আমি যাবো না ঢাকায়। তাও তুমি রাগ কইরো না।“
“মন দিয়ে পড়াশুনা করিস মা। তোড় আব্বার মুখ উজ্জ্বল কর সেই দোয়া করি। কখনো তো একা কোথাও থাকিস নি। ভয় করে আমার। মায়ের মন, তোরা বুঝবি না।“
“আম্মা আমি তোমাদের দুজনেরই মুখ উজ্জল করব, খালি তুমি দোয়া করো।“
মা মেয়ের কান্নাপর্ব শেষ হতেই হাজির হল সামিয়া। কোচা ভরে কুল নিয়ে আসছে।
“আপা কুল আনছি, আসো ভর্তা করো। একসাথে খাবো।“
“সামিয়া তোর মাথা কি খারাপ। সারারাত বাসে চড়ে ঢাকা যাবে মেয়েটা, পেট খারাপ করে যদি?”
“উফফ… আম্মা কিছু হবে না আমার। চল বুড়ি।“
দুই বোনের পাগলামি দেখে মাথায় হাত মাহফুজা বেগমের। কেউ যদি একটু উনার কথা শোনে। অগত্যা রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন তিনি। রাতের রান্না আগেই হয়ে গেছে। পথে খাওয়ার জন্য কয়টা রুটি বানাতে বসলেন তিনি। মানুষটা বাইরের খাবার একদমই খেতে পারেনা।
সিদ্দিক সাহেব বাড়িতে ফিরে দেখলেন দুইবোন মিলে কিছু একটা খাচ্ছে ওদের শোয়ের ঘরের মেঝেতে বসে। কিছু একটা নিয়ে গল্প করছে আর, হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সাদিয়ার মা এখনো রান্নাঘরে। টিফিনবাটিতে রুটি, সবজি আর মুরগীর মাংস ভরছেন। চুপিসারে স্ত্রীর কাছে গিয়ে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
“মন খারাপ করোনা বউ।“
“ মন খারাপ আর আমি? ক্যান?”
“সাদিয়ারে যে তুমি সামিয়ার চেয়ে বেশি ভালবাসো সেইটা আমি ঠিকই জানি।“
“তাই নাকি? সেইজন্য নাটক করি?”
“ওইটা তো রাগের মাথায় বলছি। রাগ করোনা বউ।“
“হইছে ঢং করা লাগবে না। মেয়েদের খাইতে ডাকেন। আপনাদের যাওয়ার সময় হয়ে আসছে তো। খাওয়ার সাথে সাথে বাসে উঠলে আপনার মাইয়া ভাসায়ে বমি করবে।“
স্ত্রীর তাড়াতে মেয়েদের ডাকতে ছুটলেন তিনি। আসলেই সময় বেশি নাই।
খেতে বসে বারবার চোখে জল চলে আসছে সাদিয়ার মায়ের। ওখানে হোস্টেলে কেমন না কেমন খাবার হবে, মেয়েটা এমনিই খায়না বেশি। মায়ের হাতের রান্না ছাড়া রোচে না তার। চুপচাপ খেলেও একই চিন্তা ভর করে মাস্টারসাহেবের মনেও।
রাত আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া করে তৈরি হয়ে নিল সাদিয়া আর ওর বাবা। যতই ব্যাগ কমানোর চেষ্টা করা হোক বইখাতা, কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে কয়েক পদের আচারের ছোট ছোট বয়াম, খুটিনাটি এটা সেটা নিয়ে বের হওয়ার সময় দেখা গেল জিনিষপত্র মোটেই কম নয়।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নানা আদেশ নিষেধ করলেন মাহফুজা বেগম। বাধ্য মেয়ের মত সব শুনে গেল সাদিয়া। আপাকে জড়িয়ে ধরে একদফা কান্নাকাটি করল সামিয়া।
বাবার হাত ধরে আজন্ম বড় হওয়া গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসলো সাদিয়া। থানা শহর পর্যন্ত অটোরিক্সায় করে যাওয়ার পর ঢাকা বাসট্যান্ডে পৌছালো। বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই যথাসময়ে বাস ছেড়ে দিল। গন্তব্য, জাদুর শহর, ঢাকা।
চলবে…