জীবনতরী #অন্তিমপর্ব

0
797

#জীবনতরী
#অন্তিমপর্ব

বাড়িতে আসার পর থেকে সাদিয়াকে ঘুম রোগে পেয়েছে। সন্ধ্যারাতে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমায়। ভোরে উঠে কোনমতে নামাজ পড়ে আবার ঘুম। সকালে উঠে নাস্তা করে আরেক ঘুমে ভর দুপুর। গোসল করে কোনমতে নামাজ, খাওয়াদাওয়া সেরে ভাতঘুম, একদম আসরের ওয়াক্ত পর্যন্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দায় বসে ঝিমায়, মা বাবা কিছু জিজ্ঞাসা করলে হু হা করে উত্তর দেয় শুধু। সন্ধ্যাইয় সামিয়া ফিরলে বোনের সাথে হুটোপুটি করে ঘন্টাখানেক। তারপর আবার সেই খাওয়া ঘুম। এই চক্র চলছে বিগত এক সপ্তাহ ধরে। সাদিয়ার মা অনেকবার মেয়ের কপালে হাত দিয়ে ঠাওর করার চেষ্টা করেছেন যে জ্বরটর আসছে কি না। তারপর নিজেকে বুঝিয়েছেন যে মেয়েটা অনেক ক্লান্ত। একটু রেস্ট নিক।
পাশের বাড়ির ভাবিরা এটা সেটা নিতে বা গল্প করতে আসলে সাদিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করে। দিনদুপুরে ঘুমানোর কথা শুনে ফোড়ন কাটে অনেকেই,
“মাইয়া মানুষ এত ঘুম কিন্তু ভালো না বইন। শউরবাড়ি যাইয়া কথা শুনোন লাগবো কিন্তুক।“
জবাবে উনি শুধু বলেন,
“মেয়েটা পড়াশুনার চাপে ছিল বোন। কটাদিন একটু ঘুমাক নাহয়।“
“হ । একদম শুকায়ে কাঠি হয়ে গেছে, সেদিন দেখনু। বেশি বেশি খাওনদাওন করাও বইন। এমন চেহারা হইলে বিয়া দিবিন ক্যানকে।“
সাদিয়ার মা হু হা করেন। কথা বললেই কথা বাড়বে। চুপ থাকাই ভাল তার চেয়ে। পাত্তা না পেয়ে চলে যান পাশের বাড়ির ভাবি।

অন্য দিনের মতই সন্ধাবেলায়ই খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে গেছে সাদিয়া। সামিয়া পা টিপে টিপে ঘরে এসে বই নিয়ে মায়ের ঘরে চলে যায়। সাদিয়ার ঘুমের কোনরকম ব্যাঘাত ঘটানো নিষিদ্ধ করেছেন সিদ্দিক সাহেব। যাওয়ায় সময় ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যায় সামিয়া।
প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে স্থানুর মত বসে আছে সাদিয়া। অতিরিক্ত টেনশনে ব্ল্যাকআউট হয়েছে ওর। কোনও প্রশ্নের উত্তর মনে করতে পারছে না। অথচ প্রিপারেশন মোটেও খারাপ না। পরীক্ষার হলে ঢুকার আগে তমাল বার বার করে বলে দিয়েছে ঘাবড়ে যাওয়া যাবে না কোনও মতেই। দুহাতে চোখ দুটো চেপে ধরে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিল সাদিয়া। মনে মনে বলল “আমি পারব। পারতে তো হবেই আমাকে।“ তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করল উত্তর দেওয়া। পুরো প্রশ্নর চিন্তা ভুলে গিয়ে শুধু বর্তমান প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামালো ও। এতে ভালই কাজ হল। একে একে সব মনে পড়ছে। মাঝে কয়েকবার মনে হল যে সময় পাবে তো শেষ করার? কিন্তু প্রাণপনে সে চিন্তা সরিয়ে দিয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভুত করল ও। এমন সময় ঢং ডং ডং করে ঘন্টা বাজা শুরু হল। কিছুতেই আর বৃত্ত ভরাট করতে পারছেনা ও। সময় শেষ। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় তো ঘন্টা বাজে। ঘন্টার শব্দটা বাড়ছে তো বাড়ছেই। কেউ খাতা নিতেও আসছে না।
চোখ বন্ধ করেই সাদিয়া বুঝলো ওর ফোনটা বাজছে প্রাণপণে। ঘুম নষ্ট করার জন্য তমালের উপর খুব রাগ হল সাদিয়ার। কলটা কেটে ফোন সাইল্যান্ট করল ও। ফোন রাখার আগেই আবার স্ক্রীণে ভাসছে তমালের নম্বর।
“ হ্যালো।“
“বুড়ি তোর রোল নম্বরটা টেক্সট কর তো। হারায়ে ফেলছি।“
“আচ্ছা।“
ফোন কেটে রোলটা এসএমএস করেই ফোন রেখে দিল সাদিয়া। আবার হারিয়ে গেল ঘুমের জগতে। ঘুমকুমারীর ঘুম ভাংলো আরো ঘন্টাখানেক বাদে। মনে পড়ল তমাল ভাইয়া ফোন করেছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ত্রিশটা মিসড কল। ইনবক্সটা লাফালাফি করছে নতুন টেক্সট নিয়ে। টেক্সটা দেখেই একটা চিৎকার দিল সাদিয়া। রাতদুপুরে বড়াপার চিৎকারে লাফিয়া উঠল সামিয়া।
“আপু কি হইছে?”
“এই আপু?”
“ভয় পাইছো?”
সাদিয়া কিছু বলতে পারছে না।
সিদ্দিক সাহেব সস্ত্রীক মেয়েদের রুমে হন্তদন্ত করে এসে দেখলেন সাদিয়ার হাতপা থরথর করে কাঁপছে।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হইছে আম্মাজান? স্বপ্ন দেখছো?”
স্বামীকে থামিতে ইশারা করে মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন মাহফুজা বেগম। সময় দিচ্ছেন যাতে মেয়েটা একটু ধাতস্থ হয়।
সাদিয়ার দুচোখ বেয়ে মুক্তোদানারা গড়িয়ে পড়ছে।
“আব্বা, আম্মা,”
“আমি চান্স পাইছি।“
“আমি, আমি চান্স পাইছি।“
মেয়ের সাফল্যে দুজনেই আলহামদুলিল্লাহ বললেন সমস্মরে। মেয়েকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন মাহফুজা বেগম। অশ্রুসজল হয়ে উঠল তার চোখও।
“এটা তো ভাল খবর আম্মা। কান্দো কেন? সাদিয়ার মা, ফ্রিজে মিস্টি আছে? সামিয়া মা নিয়ে আয় তো।“
সামিয়া দৌড়ে চলে গেল মিস্টি আনতে। রাতদুপুরে মিষ্টি খাওয়া মানা এই বাসায়। আজকে তার ব্যাতিক্রম হবে কারন বড়াপা ডাক্তার হবে। কিন্তু সবাই কান্নাকাটি করছে কেন এই কঠিন বিষয়টা বুদ্ধিমতি পিচ্চি সামিয়ার মাথায় আসছে না কিছুতেই।
সাদিয়া বলল, “ আমার সিরিয়াল কত আসছে জিজ্ঞাসা করবা না? কোথায় চান্স পাবো?”
সিদ্দিক সাহেব দীর্ধশ্বাস ফেলে বললেন, “ মা রে তুমি ডাক্তার হবা। মানুষের সেবা করবা। এইটা আমার স্বপ্ন ছিল। তুমি অনেক পড়াশুনা করছ, চেষ্টা করছ, তাতেই আমি খুশি। চান্স না হলেও খুশিমনে আমি তোমারে আবার চেষ্টা করতে বলতাম। তোমার আম্মাকে আমি এই কথা বলছি আগেও।“
“হ্যা মা। তোর বাবা খুব চিন্তা করতেছিল যে তোকে অনেক বেশি চাপ দিয়ে ফেলছে হয়তবা।“
“আব্বা আমার সিরিয়াল আসছে ১০৮। আম্মা , ইনশাল্লাহ আমার ঢাকায় চান্স হয়ে যাবে।“
মেয়ের অভাবনীয় রেজাল্ট শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না সিদ্দিক সাহেবও। তার আদরের মেয়েটা কতটা পরিশ্রম করে এই অবস্থায় এসেছে চিন্তা করতে স্নেহের আতিশয্যে তার হৃদয় বিগলত হল।
গভীর রাতেও সাদিয়াদের বাড়িতে উৎসব লেগেছে। এমন সুখবর পাওয়ার পরে সবার ঘুম উড়ে গেছে। সিদ্দিক সাহেব ঘোষনা দিয়েছেন আজ রাতে তার মেয়েরা যা আবদার করবে তাই রান্না করে খাওয়াবেন তিনি। সাদিয়া সামিয়া শলাপরামর্শ করে বলেছে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ধোয়া ওঠা গরম ভাত খাবে। একথা শুনে সিদ্দিক সাহেবের মাথায় হাত। কারন ইলিশ মাছ তিনি বেশ কিছুদিন হল আনেননি। আজকেই চিন্তা করছিলেন যে এই শুক্রবার গঞ্জে গিয়ে বড় বড় ইলিশ কিনবেন দুইটা। মাহফুজা বেগম অভয় দিয়ে বললেন ফ্রিজে চার টুকরো ইলিশ মাছ আছে। বউএর কথা শুনে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন সিদ্দিক সাহেব।
ঘন্টাখানেক ধরে এ বাড়ির কর্তা রান্নাঘরে। এই রাত দুপুরে জীবনে প্রথমবারের মত রান্নাবান্না করতে গিয়ে তুমুল যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছেন সিদ্দিক সাহেব। স্ত্রীর সাহায্য আজ তিনি নেবেন না কোন মতেই। রান্নাঘরে কারও অনুপ্রবেশ আজ নিষিদ্ধ, তাই স্ত্রীকন্যারা বসে আছে রান্নাঘর সঙ্গলগ্ন ঘরে। প্রতিবার ঘটিবাটি পতনের শব্দে কেপে কেপে উঠছেন মাহফুজা বেগম। আগামীকাল সকালে তার রান্নাঘর কি অবস্থায় পাবেন সে চিন্তায় সন্দিহান তিনি। সবকিছু ছাপিয়ে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে ইলিশের সুঘ্রাণ। এই সুঘ্রাণে মিশে আছে মেয়ের প্রতি এক মধ্যবয়সী বাবার অকৃত্তিম ভালবাসা আর আগামী জীবনের শুভকামনা।

জীবতরী গল্পটা এখানেই শেষ। কিংবা হয়ত এখানেই শুরু, জীবনযুদ্ধের এক নতুন উপাখ্যান। এমন হাজারো সাদিয়া আমাদের আশেপাশেই আছে। কেউ হয়ত সফল। কেউ হয়ত জীবনযুদ্ধে হোঁচট খেয়ে ভাবে তার জীবনটা হয়ত এখানেই শেষ। সেই সাদিয়াদের বলছি, জীবন অনেক বড়। সাময়িক ব্যার্থতায় হতাশ হয়ো না। লেগে থাকো, পরিশ্রম কর, কে জানে জীবন হয়ত আরো বড় কোনও সাফল্যের ঝুলি নিয়ে তোমার অপেক্ষায় আছে। সে পর্যন্ত টিকে থাকো। আলো আসবেই। 🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here