আমার_ভুল,৫,৬

0
517

#আমার_ভুল,৫,৬
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫

পড়াশোনায় আমি বরাবরই ভালো। ভার্সিটিতে উঠেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। শত ঝামেলার মাঝেও রোজ পড়তে বসি। এই একটা জিনিসে কখনো আমার মনোযোগের হেরফের ঘটে নি। বলা চলে বেশ কৃতিত্বের সাথেই সাড়ে তিনবছর শেষ করেছি। বাকি আছে শুধু ফাইনাল সেমিস্টার। তারপরই গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট।

সবাই মোটামুটি ধারণা করে নিয়েছে এবছর ডিপার্টমেন্ট থেকে রাষ্ট্রপতি পদক আমিই আনবো। অ্যাভারেজ রেজাল্ট হিসেব করলে আমার রেজাল্টই সবার চাইতে ভালো।

আব্বাকে খবরটা দিলাম। ভীষণ খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলেন বাড়ি যাবো কবে। আমি ঠিকমত কিছু বলতে পারলাম না। সেমিস্টারের পড়া বাকি আছে। পরীক্ষার রুটিনও দিয়ে দিয়েছে।
ইতস্তত করে বললাম,’সেমিস্টার তো এখনো শেষ হয় নি। একটা রিসার্চ আর্টিকেল এর ও কাজ বাকি আছে। সেটা শেষ না করে বাড়ি ফিরতে পারবো না।’
আব্বা আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন পড়াশোনায় যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে।

প্রিন্স ভাইয়ার সাথে সপ্তাহে আমাদের দুটো ক্লাস। মানে সপ্তাহে দুদিন অন্তত উনার সাথে আমার দেখা হয়। প্রথমদিকে আমি বেশ অস্বস্তিতে ছিলাম। ভাইয়া ডাকবো না স্যার ডাকবো এই নিয়ে কনফিউশন। ভাববাচ্যে কথা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে ‘স্যার’ ডাকা শুরুর করি। ক্লাসরুমে ভাইয়া ডাকা নিশ্চয়ই শোভনীয় দেখাবে না।

শানিবার, ডিপার্টমেন্ট বন্ধ।
লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলাম। পরীক্ষার যেহেতু রুটিন দিয়ে দিয়েছে তাই হাতে আর বেশি সময় নেই। পি এল এর সময়টাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে। নইলে ভালো রেজাল্ট এর আশা করা বোকামি। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম অন্য কাজে সময় ব্যয় কমিয়ে দিয়ে পড়াশোনায় সময় বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু মাঝেমাঝে না চাইতেও সময় নষ্ট হয়

ফোন রিংটোনের মৃদু আওয়াজে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। প্রাপ্তির নাম্বার থেকে কল এসেছে।
বান্ধবীদের সঙ্গে আমার আগের মত আর যোগাযোগ নেই। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সবাই। প্রাপ্তির সাথে প্রথম প্রথম কথাবার্তা হতো। কিন্তু প্রিন্স ভাইয়ার ঘটনাটার পর থেকে সে ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে কোন কথা বলে নি। তারপর আস্তে আস্তে আবার যোগাযোগ শুরু করলো। এবার অনেকদিন বাদে ফোন করেছে। ভালো লাগলো।
হাসিমুখে ওর স্বামী সংসারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। প্রাপ্তিও আমার সাথে বেশ হাসিখুশি ভাবে কথা বললো।

কিন্তু ফোন ছাড়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ও হঠাৎ প্রিন্স ভাইয়ার প্রসঙ্গটা তুলে বসলো। আমাদের ইউনিভার্সিটির বাংলা ডিপার্টমেন্টের এক ম্যামের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো প্রিন্স ভাইয়ার। কিন্তু উনি রাজি না থাকায় বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। প্রাপ্তির কন্ঠে আফসোস। নিঃস্পৃহ গলায় বললো,
-‘ভাইয়াটাকে নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তায় আছি রে কিরণ। কি যে হলো ওর। বিয়ের নাম মুখেও আনতে চায় না। বাবা মা কত করে বোঝায়। কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হয় না। ও কি সত্যি সত্যিই আর বিয়ে করবে না?’

প্রাপ্তি যেন প্রশ্নটা নিজেকেই করেছে। ওর কন্ঠে হতাশা, আক্ষেপ আর ভাইয়ের জন্য অপরিসীম ভালোবাসা। প্রিন্স ভাইয়াকে উনার বাসার সবাই ভীষণ আদর করে।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করতেও পারছি না। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,’কেন করবে না? অবশ্যই করবে। তুই দেখিস আল্লাহ উনার জন্য অনেক উত্তম জীবনসঙ্গী নির্ধারন করে রেখেছেন।’

প্রাপ্তি আমার কথায় সায় জানিয়ে ফোন রেখে দিলো। আমি ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম। কিন্তু পড়াশোনার মাঝেও প্রাপ্তির বলা কথাগুলো আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো। নিজেকে অসহায় লাগছিলো।
শেষমেশ মাকে ফোন করে জানালাম। মা ও আফসোস করে বললেন,’তোর আব্বাকে সেদিন বলছিলাম ছেলেটার জন্য আমারও মায়া হয়। এত সুন্দর ছেলে মাশাআল্লাহ। কিন্তু কি করবো বল! তোর বাপ ভাই তো বিয়ের নাম শুনতেও রাজি নয়। তাছাড়া তোর পড়াশোনা তো শেষ হয় নি।’

আমি চুপ করে রইলাম। মায়ের কথা শুনে মনে হলো উনি আস্তে আস্তে প্রিন্স ভাইয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। গলায় আন্তরিক মমতা ঢেলে দিয়ে বারবার আল্লাহর কাছে প্রিন্স ভাইয়ার জন্য একটা উত্তম জীবনসঙ্গী প্রার্থনা করলেন। আমিও মনে মনে তাই দোয়া করলাম।


প্রায় দেড়মাসের মতন আমার পরীক্ষা চললো। ভালোভাবেই গ্র‍্যাজুয়েশন লাইফের ইতি টানলাম। ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম তেমনভাবে। রেজাল্ট বেরোনোর আগ পর্যন্ত মোটামুটি তিনমাসের মত ছুটি। আব্বা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

ছুটির দিনগুলো আমার বাড়িতে বসেই কাটছিলো। এর মাঝেই হঠাৎ একদিন মা খবর দিলেন প্রিন্স ভাইয়ার বাবা আবার ধরেছেন আব্বাকে। আমি চুপ করে রইলাম।

সিনেমায় নায়িকাদের মত শেষমুহূর্তে গিয়ে নায়কের প্রেমে পড়ে বাবাকে অস্বীকার করে এমন কোন ঘটনা আমার সঙ্গে হলো না। আমি শেষমুহুর্ত পর্যন্ত আমার আব্বার বাধ্য ছিলাম। আব্বা নিজের ইচ্ছেতেই আমাকে প্রিন্স ভাইয়ার হাতে তুলে দিলেন।
আসলে প্রিন্স ভাইয়ার জন্য আমার অনুভূতি কি ছিলো সেটা আমি কখনো তলিয়ে দেখতে যাই নি। যতবারই আমার উনার কথা মনে পড়েছে আমি মনকে জোরপূর্বক অন্যদিকে বিক্ষিপ্ত করে নিয়েছি। ভয়ে কখনো নিজের মনকে প্রশ্ন করতে যাই নি উনার প্রতি আমার কোন দুর্বলতা আছে কিনা!
সব কিছুর আগে আমার প্রথমে আব্বার কথা মনে পড়েছে। আব্বা ছেলেমেয়েদেরকে নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করেন। আমরা সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করলে উনি সহ্য করতে পারবেন না। সেইজন্য আমরা তিন ভাইবোনই কোনদিন আব্বার অবাধ্য হই নি।

বিকেল বেলা বাইরে থেকে এসে আব্বাও একই কথা বললেন। প্রিন্স ভাইয়ার বাবা আবার আব্বার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। বারবার করে অনুরোধ করছেন আব্বাকে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের একটাই যুক্তি এখন তো আর আমার পরীক্ষার ঝামেলা নেই। তাহলে এখন রাজি হতে আব্বার সমস্যা কোথায়?

আব্বার কথা শুনে যা বুঝলাম তাতে মনে হলো প্রিন্স ভাইয়ার সঙ্গে বিয়েটা বোধহয় এবার হয়েই যাবে! আর কত ঘোরাবেন! চার বছর! কম সময় তো নয়। আব্বা নিজেও মায়ায় পড়ে গেছেন। প্রসন্ন গলায় আংকেলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার বিস্তারিত বর্ণনা করলেন মায়ের কাছে।

ডাইনিং এ বসে আমিও শুনলাম। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এতদিন বাদে সাহস করে নিজেকে নিজে বলতে পারলাম ঐ মানুষটাকে আমি অবচেতন মনে নিজের করে চেয়েছি। শুধুমাত্র আব্বার সম্মতির অপেক্ষায় স্বীকার করতে পারি নি।
এই সম্মতিটুকু না পেলে হয়ত সারা জীবনেও আমি একথা স্বীকার করতাম না।

একমাসের মাথায় উনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। ডিপার্টমেন্টে ছাত্রী বিয়ে নিষিদ্ধ।একধরণের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের পক্ষ থেকে।

প্রিন্স ভাইয়া আমার মাস্টার্স এর কথা চিন্তা করে চাকরী ছেড়ে দিলেন। বিয়ের আগে তাড়াহুড়ো করে একটা বেসরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলেন। বেকার অবস্থায় তো আর বিয়ে করা যায় না।

আমাদের বিয়েটা একেবারে ঘরোয়াভাবে হলো। আব্বার ইচ্ছা আমার রেজাল্ট বেরোলে একসাথে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করবেন। আংকেলও রাজি হয়ে গেলেন। তাই বিয়ের দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর উনারা বাসায় চলে গেলেন।

পরেরদিন প্রান্ত, প্রাপ্তি আর বেশকয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রিন্স ভাইয়া এলেন। এসেই মা ভাবিদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। আব্বাও আশেপাশে ছিলেন।

উনি যেন আব্বাকে দেখেই ইচ্ছে করে ‘আমার বউ, আমার বউ’ কথাটা বেশি বেশি করে বললেন। হয়ত এতদিন উনাকে ওয়েট করিয়ে রাখার রাগ মেটাচ্ছেন।

আব্বা হাসেন। মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-‘অবস্থা দেখছো? ইচ্ছে করে এমন করেছে। সে কি বোঝাতে চাইছে তার বউয়ের ওপর বাপের কোন অধিকার নেই?’
মা জবাব না দিয়ে মুখটিপে হাসলেন। আমি নিরব দর্শকের মত এদের শ্বশুর জামাইয়ের খোঁচাখুঁচি দেখলাম। ভালোই লাগে। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। যেমন শ্বশুর তেমনি তাঁর জামাই।

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৬

তিনমাস পর রেজাল্ট দেওয়ার কথা থাকলেও দুমাসের মাথায় আমাদের রেজাল্ট বেরিয়ে গেলো। মানে আমার বিয়ের প্রায় পনেরো দিন পর।

আমি ব্যাচের মধ্যে সেকেন্ড হয়েছি। ফার্স্ট হয়েছে আমাদের ক্লাসের আবু বকর নামের একটা ছেলে। ও ভীষণ মেধাবী। পড়েও অনেক। ওর রেজাল্ট থ্রি পয়েন্ট নাইন নাইন। আর আমার থ্রি পয়েন্ট নাইন এইট। ব্যবধান খুবই কম।

এই নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। কারণ অভার অল হিসেব করলে এখনো আমার রেজাল্টই সবার চাইতে ভালো। শুধু ভালো বললে ভুল হবে অনেক ভালো। চেয়ারম্যান স্যার তো বলছেন একেবারে আউটস্টান্ডিং রেজাল্ট!

সবার আগে আব্বাকে সালাম করে খবরটা জানালাম। আব্বা ভীষণ খুশি হলেন। বারবার করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলেন। আমি মিষ্টি হেসে মাকে সালাম করতে গেলাম। মা আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,’আমার মেয়ের চেষ্টা আজকে সফল হয়েছে। আমি খুব খুশি মা। অনেক বড় হ তুই।’
স্মেহের সহিত আমার কপালে চুমু খেলেন। আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ওর শ্বশুরবাড়িতে ফোন করে একটা খবর জানাও। ওদের আসতে বলে দাও। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে হবে তো।’

আব্বাকে আপত্তি করলেন না। সেদিনই প্রিন্স ভাইয়াদের বাসায় ফোন করে উনাদের আসতে বলে দিলেন।

আমার রেজাল্টের খবর শুনে আংকেল মিষ্টি নিয়ে আসলেন একগাদা। উনাদের আত্মীয়স্বজন, প্রিন্স ভাইয়া, প্রান্ত, সবাই এসেছে। আমাদের আত্মীয়স্বজনরাও আছে। সবাই ভীষণ খুশি।

আলোচনা দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হবে। আব্বা প্রিন্স ভাইয়াকে ডেকে উনার পছন্দসই একটা ডেইট জেনে নিলেন। সম্ভবত সেই ডেটটাই ঠিক করবেন।

প্রিন্স ভাইয়া সকাল থেকে আমার সঙ্গে একবারও আলাদা করে কথা বলতে পারেন নি। চারদিকে মেহমানরা ঘিরে আছে। কাজিনরা গোল হয়ে আমার রুমে বসে আছে।
দুপুরের দিকে মা সবাইকে ধমক দিয়ে বের করে দিলেন। ভাবিকে ডেকে বললেন প্রিন্স ভাইয়াকে আমার রুমে নিয়ে আসার জন্য।
জামাই মানুষ দুপুর বেলা খেয়ে একটু রেস্ট নেবে। তার উপায়ও নেই। সব ভীমরুলের চাকের মতন রুম দখল করে আছে। এসব বলে কাজিনদের সবাইকে একধাপ ঝাড়লেন।

আমি মায়ের রুমে বসে ছিলাম। মা আমাকেও ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। ধমক দিয়ে বললেন,’জামাই ঐ রুমে একা একা বসে থাকবে? তুই যা রুমে। ওর কি লাগে দেখ।’
আমার মন চাইছিলো মাটি খুঁড়ে তার ভেতরে ঢুকে যাই। এত লজ্জা লাগছিলো। লজ্জায় আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। তবুও উনি আসার আগে চুপচাপ রুমে গিয়ে বসে রইলাম।

উনি ভেতরে ঢুকে আরাম করে আমার পড়ার চেয়ারে বসলেন। চারপাশে চোখ বুলিয়ে আমার রুমটা দেখলেন। আমি মিথ্যে কাজের বাহানায় উল্টোদিকে ঘুরে বই পুস্তক নাড়তে শুরু করলাম। উনি প্রথনে জিজ্ঞেস করলেন আমি লাঞ্চ করেছি কি না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন বিয়ের অনুষ্ঠান বাইশ তারিখ হলে আমার কোন সমস্যা হবে কিনা।

আমি দুটো প্রশ্নের উত্তরই মাথা নাড়িয়ে দিলাম। প্রথমটাতে উপরে নিচে মাথা নাড়ালাম। আর দ্বিতীয়টাতে ডানে বামে। উনি সামান্য হাসলেন। মুচকি হাসি। উনাকে আমি কখনো উচ্চশব্দে হাসতে দেখি নি। প্রাপ্তির বিয়েতেও না।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ফের প্রশ্ন করলেন,’তুমি কি আমকে দেখে লজ্জা পাচ্ছো? উল্টোদিকে ফিরে আছো কেন?’

আমি জবাব দিলাম না। আমার চেহারায় স্পষ্টত লজ্জা ভেসে উঠেছে। জীবনে আমি এই অদ্ভুত রকমের লজ্জা আমি কারো সামনে পাই নি। আগেই বলেছি আমার লজ্জা কাউকে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে দুর্বল করে দিক সেটা আমি কখনো চাই নি। তাই লজ্জা প্রকাশের ক্ষেত্রে সবসময় সংযত থেকেছি। কিন্তু উনার সামনে এই সংযম বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না। সৃষ্টিকর্তা একেবারে লজ্জার ঘড়াসহ ঢেলে দিলেন। লজ্জার উনার দিকে ফিরতে পর্যন্ত পারলাম না।
প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে বললাম,’চা খাবেন?’
এই দুপুরবেলা ঘুমের সময় চা খাওয়ার প্রস্তাবটা কতটা যুক্তিসংগত আমি জানি না। তবুও আমি নিঃসংকোচে বলার জন্য এই একটা কথাই খুঁজে পেলাম। উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন,’না। এখন চা খাবো না।’
-‘তাহলে কফি বানিয়ে দেই?’
-‘না। কফিও খাবো না।’

এরপরে আমি আর কোন শব্দ খুঁজে পেলাম না। সৌজন্য মূলক কথাবার্তাও মুখ দিয়ে বেরোলো না। চা, কফি এগুলো ছিলো উনার সামনে থেকে নিস্তার পাওয়ার বাহানা। কিন্তু উনি খাবেন না বলায় বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কি করবো সেটাও বুঝতে পারছি না। উনি বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। স্মিত হেসে বললেন,’এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে কিন্তু আমি যাবো না। আজকে এখানে থেকে যাবো।’

আমার মনে হলো এভাবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অভদ্রতা দেখায়! তাই আমি সামনে ফিরে সবে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম এমন সময় হঠাৎ পাশের রুম থেকে আতসবাজি ফুটে উঠার মতন উচ্চশব্দে বেজে উঠলো,’ড্যাডি মাম্মি হ্যায় নেহি ঘার্ পে, পিছলে কামরে মে ঘুসকে, কুছ তো কারেঙ্গে ছুপকে মিল যারা…!’
কোন বেয়াদবে যেন গান ছেড়ে দিয়েছে।

ইজ্জতের আর কিছু বাকি রাখলো না! আব্বা ড্রয়িংরুম থেকে জোরেসরে গলা খাঁকারি দিলেন। বোঝাই যাচ্ছে গান বন্ধ করতে বলছেন। কিন্তু বেয়াদবের দল গান বন্ধ করতে পারছে না। বোধহয় রিমোট কাজ করছে না। উপায়ান্তর না পেয়ে আব্বা আমার ছোটভাই কনকের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। ভেতরে মুরুব্বিরা সবাই বসে আছে। কি বেইজ্জতি কারবার! এমন রক্ষণশীল পরিবারের ছেলেমেয়েরাও কিনা এসব গান শোনে!

প্রিন্স ভাইয়া হাতের মুঠোয় ঠোঁট চেপে ধরে আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি লজ্জায় তাড়াতাড়ি উনার সাথে কথা শুরু করতে চাইলাম যাতে গানের লিরিক্স উনার কানে না যায়। কিন্তু পারলাম না। কোন কথাই মুখে এলো না। ব্যক্কল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি অনেক চেষ্টা করলেন হাসি চেপে রাখার কিন্তু পারলেন না। আমার অবস্থা দেখে হেসে দিলেন। উঠে গিয়ে আমার জানালার গ্রিল ধরে নিঃশব্দে শরীর দুলিয়ে হাসতে শুরু করলেন।

কনক দৌঁড়ে গিয়ে টিভির প্লাগ খুলে দিলো। রিমোট খারাপ হয়ে যাওয়ায় কাজিনরা হঠাৎ কি করবে বুঝতে পারছিলো না। সবাই মিলে রিমোট নিয়েই গুঁতোগুঁতি করছিলো। গান শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্লাগটা খুলে দিলে এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এছাড়া আর কি করার আছে! মানইজ্জত তো সব ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রিন্স আমার ব্যক্কলের মতন চেহারাটা দেখে নিয়েছেন।

ড্রয়িংরুম থেকে আংকেলের হাস্যরত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আব্বা বিব্রত হয়েছেন বুঝতে পেরে উনি আব্বাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। ভরাট হেসে বললেন ,’বোনের বিয়ের খুশিতে ভাইবোনেরা আনন্দ করছে ভাইসাহেব। খেয়াল করে নি। আপনি এত রাগ করবেন না।’
আংকেলের কথা শুনে আব্বা শান্ত হলেন। নইলে আজকে আমার কাজিনদের সবার খবর ছিলো।

প্রিন্স ভাইয়া যতক্ষণ আমার রুমে ছিলেন আমি দূরে থেকেই উনার সঙ্গে কথা বলেছি। লজ্জায় কাছে যেতে পারি নি।
অবশ্য কাছে যাওয়া তো বহুদূরের কথা ঠিকমতো তাকাতেও পারি নি। কখনো মাটির দিকে তাকিয়ে, কখনো দরজার দিকে তাকিয়ে, কখনো বা নিজের হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বলেছি।
উনার সামান্য কোন কথাতেই অনেক বেশি লজ্জা লেগেছে। উনি যাওয়ার সময় আমাকে কাছে ডাকলেন। দুষ্টু হেসে বললেন,’এদিকে এসো কিরণ! তোমাকে আমি খেয়ে ফেলবো না। তারজন্য দিন ঠিক করা হচ্ছে। আমার অতো তাড়া নেই!’

আমি তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি পকেট ফোন বের করে আবার ডাকলেন,’এদিকে এসো তোমার একটা ছবি তুলি। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।’
আমার ইচ্ছে হলো বলি,’না আসবো না। মুখ দিয়ে যেই বোমা বিস্ফোরণ করেছেন তাতেই লজ্জায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর কাছে গেলে কি করবেন সেটা আল্লাহই জানে।’ কিন্তু বলতে পারলাম না। সসংকোচে দাঁড়িয়ে রইলাম।

উনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রান্তর নাম ধরে ডাক দিলেন। প্রান্ত ড্রয়িংরুমে আংকেলের সাথে বসে ছিলো। ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে উঠে এলো। আমাদের দুজনকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,’জি ভাইয়া?’
-‘তোর ফোন থেকে তোর ভাবীর কয়েকটা ছবি তোল। আমার ফোনে চার্জ নেই।’

প্রান্ত ওর ফোন বের করে আমার বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। উনি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রান্ত উনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’তুমিও ভাবীর পাশে গিয়ে দাঁড়াও ভাইয়া। তোমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিই।’

উনি চট করে আমার দিকে চাইলেন। মনে হলো সম্মতি চাইছেন। আমি সলজ্জ হাসলাম। প্রান্তর সামনে কোন এক্সট্রা ছেলেমানুষি করলাম না।
উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে প্রান্ত আমাদের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলো। ছবি তুলে দিয়ে ও বেরিয়ে যাচ্ছিলো। উনি বাধা দিয়ে বললেন,’কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া। ভাইয়াও যাবো।’

প্রান্ত দূরত্ব বজায় রেখে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ও সরে গেলে উনি আমাকে উদ্দেশ্য মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন,’কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার ওয়াইফ। ইউ হ্যাভ মেইড আ ভেরি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট! আই ফিল সো প্রাউড অফ ইউ। ইউ ট্রুলি ডিজার্ভ দিস হ্যাপিনেস।’

তারপর হাসিমুখে বেরিয়ে গেলো দুইভাই। যাওয়ার সময় প্রান্ত মিষ্টি হেসে বললো,’ভাবী আসি? ট্রিট টা কিন্তু পাওনা রইলো।’
আমিও মুচকি হেসে ওর কথায় সায় জানালাম। ওরা চলে গেলে চুপিচুপি ড্রয়িংরুমের দিকে চাইলাম। উনি আংকেলের পাশে গিয়ে বসেছেন। হঠাৎ করেই একধরণের ভালোলাগা কাজ করছে ঐ মানুষটার প্রতি। উনার বলা কথাগুলোর প্রতি। উনার হাসিহাসি স্নিগ্ধ সুন্দর মুখখানার প্রতি। মনে হচ্ছে আমি একমুহূর্তেই ভীষণরকমভাবে উনার প্রেমে পড়ে গেছি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here