আমার_ভুল,৭,৮

0
440

#আমার_ভুল,৭,৮
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭

সাধারণত মেয়ের বিয়ের সময় বাবারা লুকিয়ে নিরবে কাঁদেন। কাউকে দেখাতে চান না। কেউ কেউ হয়ত সামনাসামনিও কাঁদেন। কিন্তু আমার আব্বার মত এত কান্না আমি খুব কম মানুষকেই কাঁদতে দেখেছি।

আমার বিদায়ের দিন আব্বা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সমস্ত ধরণী কাঁপিয়ে কাঁদলেন। আব্বার কান্নায় পুরো বিয়ে বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। আব্বাকে সচরাচর কেউ-ই এত কাঁদতে দেখে নি। মেহমানরা সবাই হতবাক হয়ে গেলো। মেয়ের বাবার এত কান্না! এই মেয়ে নিশ্চয়ই বড় আদরের!

আব্বা আমার হাতটা একবার প্রিন্স ভাইয়ার হাতে আরেকবার আমার শ্বশুর মহাশয়ের হাতে তুলে দিয়ে অসহায়ের মতন আচরণ করছিলেন। কান্না যেন থামেই না।

গাড়িতে উঠার সময়ও প্রিন্স ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমার হাতটা উনার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,’এই আমার রত্ন। আজ থেকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা। আমার কলিজার টুকরা আমার এই মেয়ে। ওকে তুমি কখনো কষ্ট দিও না। আমার কলিজায় কখনো আঘাত করো না। বড় আদরের আমার এই মেয়ে।’

বলতে বলতেই ফের কেঁদে ফেললেন আব্বা। প্রিন্স ভাইয়া যেন একটা ছোট্ট শিশুকে বোঝাচ্ছেন এমনি করে আব্বাকে বোঝাতে শুরু করলেন। মনে হলো উনি পিতা আর আব্বা উনার ছেলে।
আব্বা উনাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত আব্বার কান্না থামলো উনি গাড়িতে উঠলেন না। আব্বার কান্না থামলে তারপর আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।

আমি গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিলাম। উনি একহাতে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। সারারাস্তা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন।

শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে আমি প্রথমে আমার শ্বাশুড়ির জিম্মাদারিতে পড়লাম। চারদিকে মেহমানদের প্রচন্ড ভিড়। চারবছর ধরে প্রিন্স ভাইয়া কার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন এই নিয়ে সবার মাঝেই একটা কৌতূহল বিরাজ করছিলো ! আমার শ্বাশুড়ি তাড়াহুড়ো করে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাকে প্রিন্স ভাইয়ার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।
শুরু হলো আমাদের মধুর বসন্ত! ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিলেন উনি আমাকে…!


তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিনমাস! আমার মিষ্টিমধুর সংসার জীবন চলছে নিত্যকার নিয়মে। রোজ উনার প্রেমে হাবুডুবু খাই। ভদ্রলোক ইচ্ছে করে হাবুডুবু খাওয়ান। এত সুন্দর করে কথা বলেন, এত সুন্দর করে তাকান যে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি না।

উনাকে দেখলে এখনো আমার লজ্জা লাগে। মা ভাবিরা হাসেন। বিয়ের তিনমাস কেটে গেলো অথচ আমার লজ্জা কাটে না।
উনাকে দেখলে সেই প্রথম দিনের মতনই লজ্জা লাল হয়ে যাই। বুক দুরুদুরু করে। জড়তায় কথা গুলিয়ে ফেলি।

উনি বাইরে থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলে আমি কখনো পারি না আচঁল দিয়ে উনার মুখটা একটু মুছে দিতে। আমার লজ্জা লাগে। উনি নিজেই আমার আঁচল টেনে ধরে তাতে মুখ মুছেন। আমার কি যে ভালো লাগে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারি।

আবার কখনো, রাতে খেতে বসেছি। উনি টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করলেন আমি খেয়েছি কিনা। বলতে পারি না খাই নি। আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি। লজ্জা লাগে। মিথ্যে বাদীর মত মাথা নাড়িয়ে বলি খেয়েছি।

তারপর ধরুন,বাবার বাসায় দুদিনের জন্য বেড়াতে গেলাম। রাতে উনি কাজ সেরে আমাদের বাসায় এলেন। আমার তখনও ভীষণ লজ্জা লাগে। উনাকে দেখে লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে যাই। উনি রুমে ঢুকলে আমার ছুটে পালিয়ে যেতে মন চায়। আমাকে বিব্রত হতে দেখে উনি খাটে বসে চুপচাপ হাসেন।
ভীষণ অদ্ভুত মানুষ। কখনো বলেন না আমার কাছে তোমার এত লজ্জা কিসের? আমি কি তোমার পর?
উল্টে মিটিমিটি হাসেন। যেন আমার লজ্জা পাওয়ায় খুব উপভোগ করছেন।

শুক্রবার, ইউনিভার্সিটি বন্ধ। উনি আলমারি খুলে কিসব দলিলদস্তাবেজ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলেন। আমার শ্বশুর মহাশয়ের সঙ্গে গ্রামে যাবেন। জমিজমা ভাগ হবে বোধহয়।
আমার শাশুড়ি বাসায় নেই। প্রীতিকে নিয়ে উনার বোনের বাসায় বোনের মেয়েকে দেখতে গেছেন।

বাকি রইলো প্রান্ত আর প্রাপ্তি। ওরা বাসায় আছে। প্রান্ত গতকাল এসেছে। ওর ছুটি কম। তাই কালই আবার চলে যাবে। প্রাপ্তি এসেছে আজকে। ওর বর এসে দিয়ে গেছে। কিছুদিন থাকবে।

রান্নাবান্না সকালেই শেষ। হাতে কাজ না থাকায় তিনজনে বসে মুভি দেখছিলাম। মুভির নাম ‘লা লা ল্যান্ড’। নায়ক নায়িকার পরিচয় পর্ব চলছে এমন সময় প্রান্ত হঠাৎ প্রাপ্তিতে খোঁচা মেরে বললো,’বলোতো আপু ভাইয়ার প্রিয় নায়িকার নাম কি?’

আমি উনার দিকে চাইলাম। উনি আলমারি থেকে কাগজপত্র বের করে চেক করছেন। প্রান্তর কথায় বিশেষ হোলদোল হলো না।
আমার একবার মনে হলো প্রান্ত প্রশ্নটা আমাকে উদ্দেশ্যে করে করেছে আবার মনে হলো নাহ্,প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্যই করেই করেছে। কারণ এই তিনমাসে আমি অনেকবার দেখেছি ওরা দুইভাইবোন একত্র হলেই প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। কে উনার বেশি কাছের সেটা প্রমাণের প্রতিযোগিতা!

আমি চুপ করে রইলাম। এই তিনমাসে উনার পছন্দ, অপছন্দ, প্রিয়, অপ্রিয় সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জেনেছি। কিন্তু প্রিয় নায়িকার নাম এখনো জানা হয় নি।
এদিকে প্রান্ত প্রাপ্তিকে তাড়া দিয়ে মেরে ফেলছে নামটা বলার জন্য। কিন্তু প্রাপ্তি মনে করতে পারছে না। মস্তিষ্কে জোর চাপ প্রয়োগ করছে সে। কিন্তু নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। শেষে প্রান্তর অত্যাধিক তাড়া খেয়ে বললো,’মনে ছিলো আমার। হলিউডের একটা নায়িকা। চোখগুলো বিড়ালের মতন। কিন্তু নাম মনে করতে পারছি না।’
প্রান্ত হেসে উঠে বললো,’বিড়ালের মত চোখ তো অনেকেরই আছে। বলিউডের কারিশমা কাপুরেরও আছে।
প্রাপ্তি প্রতিবাদ জানিয়ে বললো,’না ও হলিউডের নায়িকা।’
প্রাপ্তি নাম মনে করতে পারবে না বুঝতে পেরে প্রান্তর মুখে হাসি বড়সড় ফুটে উঠলো। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে বললো,’মেগান ফক্স’। সি ইজ দ্যা কুইন। আই জাস্ট লাভ হার আইজ!’
ও বলার সাথে সাথে প্রাপ্তিও চেঁচিয়ে উঠলো,’ হ্যাঁ। হ্যাঁ। মেগান ফক্স। নামটা মনে আসছিলো না আমার। তুই বলার পর মনে পড়েছে। ওকে তো ভাইয়া ওকে দশে দশ দিয়েছিলো। তাই না ভাইয়া?’

কথা শেষ করে সে জবাবের অপেক্ষায় উনার মুখের দিকে চাইলো। উনি কাগজপত্র গোছাচ্ছিলেন। বোনের কথার জবাবে উপরে নিচে মাথা দোলালেন। মুখে স্মিত হাসি।

কে এই মেগান ফক্স! আমি জীবনে এর নামও শুনি নি। মনে মনে এর প্রতি তীব্র হিংসা অনুভব করলাম ওর প্রতি। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে! বলে কিনা দশে দশ দিয়েছে!
আমার চিন্তাভাবনার মাঝখানে প্রাপ্তি হঠাৎ হেসে উঠে বললো,’ভাবীকে কত দেবে ভাইয়া?’
উনি আলমারির চাবি বন্ধ করছিলেন। সেটা বন্ধ করে চাবি তুলে রাখতে রাখতে বললেন,’একশো।’
মুখে সেই আগের মতই স্মিত হাসি।

প্রান্ত আর প্রাপ্তি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আমি লজ্জায় মাথা তুলতে পারলাম না। এত অসভ্য লোক!

প্রাপ্তি আমাকে খোঁচা মেরে বললো,’ভাবী লজ্জা পেয়েছে ভাইয়া।’

উনি চুপচাপ কাগজ গুছিয়ে নিতে নিতে বললেন,’তোর ভাবী সবকিছুতেই লজ্জা পায়।’

হাতের কাগজ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। আমি এই নিয়ে রাতে উনার সঙ্গে দুষ্টুমিষ্টি বোঝাপড়া করবো বলে তখন আর প্রতিউত্তর করলাম না। চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
কিন্তু রাতে উনাকে কাছে পেয়ে সব ভুলে গেলাম! একবারও মনে পড়লো না সকালে উনাকে ধরবো বলে মনে মনে অনেক কথা গুছিয়ে রেখেছিলাম। শুধু মনে হলো উনার সান্নিধ্য না পেলে আমার চলবে না। এই সান্নিধ্য আমার সারাজীবন চাই।

এভাবেই চলছিলো আমার সহজসুন্দর,সাদামাটা সংসার জীবন। তারপর আমি মাস্টার্স শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলাম। সেখান থেকেই সূচনা হলো আমার পরিবর্তনের!

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

আমার স্বভাব চরিত্র বিশ্লেষণ করলে কেউ কোনদিন বলতে পারবে না আমি আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন ভুল করেছি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে ‘ম্যাচিউর’ প্রকৃতির বলেই জানে।

কিন্তু সত্যিটা হলো আমি ভুল করেছি। আবেগের বশবর্তী হয়েই ভুল করেছি। অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্যি, সচরাচর ভুল না করা মানুষগুলো হঠাৎ এমন এক ভুল করে ফেলে যা তাঁরা নিজেরাই কখনো কল্পনা করতে পারে না।

সাধারণ মানুষ ভুল করে আবার সামলে নেয়। কিন্তু আমি ভুল করে সামলাতে পারি নি। আমি একবার ভুলে করে, বারবার ভুল করেছি।
কেন করেছি সেসব এখন থাক। আগে আমার কর্মজীবন সম্পর্কে একটু আলোচনা করি।

ভালো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ডিপার্টমেন্টের সব স্যার ম্যামেদের কাছে আমি বেশ পরিচিত মুখ। চেয়ারম্যান স্যার আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। তারওপর প্রিন্স এখানকার শিক্ষক ছিলেন। উনার দিক থেকেও পরিচিতিটা বেশ ভালো।

ডিপার্টমেন্টের স্যার ম্যামদের সহযোগিতা, নিজের মেধা আর পরিশ্রমের কারণে শিক্ষকতার চাকরিটা আমি মোটামুটি সহজভাবে পেয়ে যাই। যদিও এর জন্য আমাকে প্রায় বছর খানেকের মত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। তবুও অন্যদের তুলনায় সেটা অনেক কম। কেউ বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও চাকরি পায় না।

প্রিন্স ভীষণ খুশি হলেন। আমার জয়েনিং এর খুশিতে সবাইকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে ট্রিট দিলেন। তিনদিনের ট্রিপে আমরা কক্সবাজার গেলাম। সেখান থেকে ফিরে বেশ হাসিখুশি একটা মুড নিয়ে আমি ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করি।

কিন্তু জয়েন করার পর বুঝতে পারলাম শিক্ষকতা পেশাটায় আসলে নতুনত্ব বলে কিছু নেই। রোজ একই কাজ করতে হয়। একই বাঁধাধরা নিয়ম। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস করিয়ে বাসায় ফেরা, বাসায় ফিরে আবার ওদের জন্য নতুন ক্লাস লেকচার তৈরী করা। ক্লাসে যাওয়ার আগে নিজে একটু প্রিপারেশন নিয়ে যাওয়া। এসবই! ঘুরেফিরে এসবই করতে হয়।

মাঝেমধ্যে ছাত্রছাত্রীদের সাথে মজা করার সুযোগ থাকলেও আমি করি না। কারণ কম বয়সী ম্যাডাম দেখলে ছাত্ররা মাথায় উঠে বসে। তাই যথাসম্ভব ওদের সামনে কঠোর ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করি।

সকালে উনি কলেজে যাওয়ার সময় আমাকে ইউনিভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যান। আবার ফেরার সময় রিক্সা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করেন। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঐসময়টুকুতে আমার অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। রিক্সায় পাশাপাশি বসে হাওয়া খেতে খেতে বাড়ি ফিরি দুজনে। মাঝেমধ্যে সংসার জীবন নিয়ে টুকটাক আলাপ আলোচনাও করি।


আমার ডিপার্টমেন্টে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষিকারাই পিএইচডিধারী। দুচার জন যারা বিদেশে আছেন তারাও পিএইচডি করার জন্যই বিদেশে গেছেন।
আমি পিএইচডি করার বিষয়ে এখনো কিছু ভেবে দেখে নি। সেই সময়ও হয়ে উঠে নি। স্টুডেন্টদের ক্লাস নেওয়া আর সংসার জীবন সামলাতে সামলাতেই আমার দিন কেটে যায়।
কিন্তু চেয়ারম্যান স্যার বিষয়টা নিয়ে বেশ জোর দিলেন। পিএইচডি করতে না পারলে সহজে প্রমোশন মিলবে না। সারাজীবন লেকচারার হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। তাই আমাকে যত দ্রুত সম্ভব পিএইচডির জন্য এপ্লাই করার পরামর্শ দিলেন। উনার পছন্দমত কয়েকটা ইউনিভার্সিটির নামও বললেন। সবশেষে এই বিষয়ে প্রিন্স এর সাথে আলাপ করার পরামর্শ দিলেন।

রাতে প্রিন্সের সাথে বিষয়টা আলাপ করলাম। উনি প্রথমে না করে দিলেন। একা একা আমাকে কিছুতেই দেশের বাইরে যেতে দেবেন না। তিন চারবছরের ব্যাপার!

আমি উনাকে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলাম। রোজ রাতে উনার গলা জড়িয়ে ধরে একই আবদার করি। অনুনয় বিনয় করি। কিন্তু উনি আমার চাইতেও এক ডিগ্রী উপরে। উল্টো ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে বুঝ দিয়ে দেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। আমি না পারি কিছু বলতে না পারি কিছু করতে। উনি যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না সে আমি বুঝি।

তবুও আমি আকুতি মিনতি জারি রাখলাম। শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই উনি রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিয়ে দিলেন। বাসায় রাজি না হলে আমি মন খারাপ করতে পারবো না। চুপচাপ উনার কথা মেনে নিতে হবে।

আমি সম্মতি জানিয়ে দিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার টেনশন হচ্ছিলো। কারণ বাড়ির বউ একা একা পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে যাবে এটা স্বামী মেনে নিলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন মানতে রাজি হবে না। সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি এই সবকিছু উনাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে।

প্রিন্স আমার শ্বশুর মহাশয়ের সঙ্গে বিষয়টা আলাপ করলেন। আমার শ্বশুর নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির মানুষ। উনি এই বিষয়টা নিজের ছেলের ওপরেই ছেড়ে দিলেন।

কিন্তু আমার শাশুড়ি মাকে মানালো গেলো না। উনার ঘোরতর আপত্তি। বিয়ে হয়েছে তিন বছরের বেশি। এখনো আমাদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয় নি। এই অবস্থায় তিন চারবছরের জন্য স্বামী ছাড়া উনি কিছুতেই আমাকে একা থাকতে দেবেন না। রাগ করে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করে দিলেন। উনার এক কথা। যেতে হলে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে যাবে। কিন্তু একা বাড়ির বউকে উনি কিছুতেই বিদেশে যেতে দেবেন না।

আব্বার সাথেও যোগাযোগ করলেন প্রিন্স। আব্বাও রাজি হলেন না। মোট কথা আমাকে দেশের বাইরে একা একা ছাড়তে কারোরই সম্মতি নেই।

পরিস্থিতি বুঝতে পারলেও আমি প্রথমে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে সামলে নিই।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স চেষ্টার কোন কসুর বাকি রাখেন নি। নানারকম কথাবার্তা বলে আমার শ্বাশুড়ি মাকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু শাশুড়ি মা নিজের সিদ্ধান্তে অটল।

শেষে আমি নিজেই প্রিন্সকে ডেকে নিষেধ করে দিলাম। শ্বাশুড়ি মা রাগ করে বললেও কথাগুলো একেবারে ভুল কিছু বলেন নি। যেতে হলে দুজনের একসঙ্গেই যাওয়া উচিৎ। নইলে উনাকে ছাড়া একা একা এতদূর গিয়ে আমি নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবো না।

কিন্তু এরজন্য প্রিন্স এর ইউনিভার্সিটিতে চাকরী হওয়াটা ভীষণ জরুরী। উনার চাকরী হলেই আমরা একসাথে পিএইচডির জন্য প্রিপারেশন নিতে পারবো। উনিও আমার কথায় সম্মতি জানালেন। উনার চাকরী না হওয়া পর্যন্ত পর্যন্ত ধৈর্য ধরার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটালাম।

এই মাঝে আমি কনসিভ করলাম। সারাবাড়ি জুড়ে আনন্দের রোল পড়ে গেলো। বংশের প্রথম প্রদীপ! সবাই ভীষণ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন আমার প্রিয় মানুষটা! খুশি যেন উনার চোখেমুখে ধরে না। হৈচৈ করে সারাবাড়ি একাই মাথায় তুলে রাখেন। কি আহ্লাদ আমাকে নিয়ে! আমার শ্বশুর শাশুড়িও ভীষণ খুশি। বাড়ির পরিবেশ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো।

কিন্তু এই খুশি বেশিদিন রইলো না। তিনমাসের মাথায় আমার মিসক্যারেজ হয়ে গেলো। হতাশায়, যন্ত্রণায় আমি একেবারে মুষড়ে পড়লাম। প্রথম সন্তান! অনেক আশাভরসা ছিলো! একনিমিষেই সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রিন্স ধৈর্য হারালেন না। উনি বারবার করে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমি পারি না। যতবারই ধৈর্য ধরে নিজেকে বোঝাতে চাই ততবারই কান্নায় বুক ভেঙ্গে আসে। শরীর উইক থাকার কারণে খুব তাড়াতাড়ি আবার বেবিও নিতে পারবো না। ডাক্তার নিষেধ করেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here