আমার_ভুল,১১,১২

0
500

#আমার_ভুল,১১,১২
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১

জীবনটা গল্প উপন্যাসের মত হলে প্রিন্স হয়ত আমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই অনেক বড় কিছু হয়ে যেতেন। কিন্তু বাস্তবতা গল্পের মতন নয়। এখানে সফল হতে হলে সংগ্রাম করতে হয়, নিজের সময় ব্যয় করতে হয়। অনেক দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বহু ছেলেমেয়েরা এখনো চাকরির আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে।
তাই যোগ্যতা থাকলেও ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে হুট করে আবার বড় কোনো ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করা কিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিলো। তারওপর প্রিন্স ঢাকার বাইরে যেতে চাইছিলেন না। হাতের কাছে অন্যকোনো চাকরি না পেয়ে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই আমাদের বিয়ের আগে কলেজে জয়েন করেছিলেন।

নতুন কলেজ। ওদের তখন ভালো মতন পরিচিতি গড়ে উঠে নি। তাই ভালো শিক্ষকের প্রয়োজন ছিলো। অভিভাবক মহলে আস্থা অর্জনের জন্য নিজেদের এডুকেশন ফ্যাসিলিটি বেস্ট দেখাতে চেয়েছিলেন। সেখানে ইউনিভার্সিটির একজন টিচার কলেজের সঙ্গে যুক্ত আছে জানলে অভিভাবক মহল কলেজের প্রতি আগ্রহী হবেই এটাই স্বাভাবিক। কলেজ কর্তৃপক্ষের পপুলারিটি এবং পাবলিসিটি দুটোই বাড়বে।

প্রিন্সও সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করলেন না। কিন্তু চাকরিটা যত সহজভাবে হওয়ার কথা ছিলো তত সহজভাবে হয় নি। বিয়ের আগে প্রিন্সের চাকরির দরকার ছিলো। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ উনাকে চাকরী দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছিলো। ওদের ভয় ছিলো উনি সুযোগ পেলে আবার কোনো ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করে ফেলবেন। উনার সার্টিফিকেট যোগ্যতা অনুসারে এখানে বেশিদিন থাকার মানুষ উনি নন। তাই উনার সঙ্গে তিনবছরের একটা অগ্রিম চুক্তি করে নিয়েছিলেন। এই তিন বছর উনি চাকরী ছাড়তে পারবেন না।

প্রিন্স ভেবেছিলেন তিন বছর দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। এই ফাঁকে আমার মাস্টার্সও হয়ে যাবে। তারপর দুজনে একসাথে শুরু করবো। তাই আপত্তি করেন নি। তাছাড়া কলেজের স্যালারিটা ভালোই ছিলো।

কিন্তু এই তিনবছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো। উনার চুক্তি শেষ হলো। কিন্তু উনি চাকরি ছাড়লেন না। ঢাকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি গুলোতে ট্রাই করলেন। সেখানকার কোনো একটা হয়ে গেলে তারপর চাকরি ছাড়বেন। কিন্তু কবে হবে সেটাও নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। একবছর লাগতে পারে। আবার একমাসেই হয়ে যেতে পারে।

এসব আমি জানতাম। কিন্তু তবুও কেন যে এত অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলাম আমি নিজেও জানি না। এক একটা সেকেন্ড যেন আমার কাছে এক এক বছরের সমান হয়ে উঠেছিলো।

আজ আমি মন খুলে বলতে পারি উনাকে আমি অনেক উঁচুতে দেখতে চেয়েছিলাম। নিজের পাশে উনার ক্ষুদ্র সত্ত্বাটা সহ্য করতে পারছিলাম না। পাশাপাশি উনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে নিজেদের সাফল্যের দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে চাইছিলাম। সবাইকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমরা একে অপরের কতটা যোগ্য।

কিন্তু সেদিন আমি ধৈর্য ধরতে পারি নি। অস্থির, উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন। ঐ সময়ের আগে কিচ্ছু ঘটবে না। আমি হাজার মাথা খুঁড়ে মরলেও না। তাই ধৈর্য আর সন্তুষ্টিকে ভালো থাকার মূলমন্ত্র ধরে নিয়ে জীবনকে সুখি করতে হয়।


সেদিনের ঝগড়ার পর আমি রাগ করে ঐ বাসা থেকে চলে এসেছিলাম। তারপর প্রায় দুমাস উনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করি নি। কয়েকবার ভেবেছিলাম উনি করবেন। কিন্তু উনিও করেন নি। খারাপ লাগে।

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এখন আর কাউকে রিক্সা নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখি না। শূন্যতা অনুভব করি। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম উনি নিতে না এলে আমিও যাবো না। কেন যাবো?

এইসব ভাবতে ভাবতে সপ্তাহ কেটে গেলো। ছাত্রছাত্রীদের সেমিস্টার ফাইনাল নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
রবিবার ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পর মা এসে জানালেন প্রিন্স এসেছিলেন। মায়ের কাছে একটা খাম দিয়ে চলে গেছেন। মা আমার টেবিলের ওপর থেকে সাদা একটা খাম এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,’জামাই দিয়ে গেছে।’

মায়ের চোখেমুখে সন্দেহ। কিন্তু আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। এইদুমাসে মা যতবারই আমার কাছে প্রিন্সের ব্যাপারে কিছু জানতে চেয়েছেন আমি এড়িয়ে গেছি।
এরজন্য আব্বা, মা দুজনেই যে আমার ওপর বিরক্ত সেটা আমি বুঝি। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে মন চায় না।

রুমে গিয়ে খামটা খুললাম। ভেতরে চিঠিপত্র কিছু নেই। আমার চেক বই আর জরুরী কিছু কাগজপত্র। আমি মনে মনে অবাক হলাম। এগুলো ফিরিয়ে দিতেই এসেছিলেন? আর কিছু না?

আমার বুকের ভেতর কেমন জ্বলে উঠলো। উনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না। তবে এই দুমাস কি করে ছিলেন। কেন আমার চেক বই আর কাগজপত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন?
ভয়ে বুক কাঁপছিলো। আর একমুহূর্তও বসে থাকতে মন চাইছিলো না। ভাবলাম কাল সকাল হলেই বাসায় ফিরে যাবো। আর অভিমান রাখবো না। নতুন করে আবার শুরু করবো।

সত্যি কথা বলতে সেদিনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার এতটুকুও আফসোস হয় নি। আমার মনে হয়েছিলো আমি জেদের খেলা খেলছি উনার সঙ্গে। হার উনাকেই মানতে হবে। ভুল উনাকেই স্বীকার করতে হবে। নইলে আমি যাবো না। কিন্তু সেদিন রাতে আমার চোখের সামনে এক এক করে নিজের করা ভুলগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করলো।

বিগত কয়েকমাসে আমি কবে উনার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেছি আমার মনে নেই। সারাক্ষণই চাপা গম্ভীরতা ভর করে থাকতো আমার চোখেমুখে।
উনি কত বেহায়াপনা করেছেন আমার কাছে আসার জন্য! রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে গেলে আমি সন্তর্পণে গায়ের ওপর থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়েছি উনি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকতেন, উনি যে আমার স্বামী সেটা প্রকাশ করতে হীনমন্যতা বোধ করেছি। দিনরাত নিজের আচরণ দ্বারা উনাকে ছোট প্রকাশ করেছি।
এনিভার্সারির দিন উনার দেওয়া গিফটের কথা মনে পড়ে গেলো। সাদা একটা জামদানি আর একটা চিরকুট দিয়েছিলেন। চিরকুটে লিখা ছিলো,’আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি কিরণ!’

আমি সারারাত একফোঁটাও ঘুমাতে পারলাম না। চোখের পানিতে বুক ভিজে গেলো! এত অবহেলা করেছি আমি মানুষটাকে! বুকে বালিশ চেপে ধরে নিরবে কাঁদলাম। অসহ্য বেদনায় ছটফট করলাম।

সকাল বেলা কিছুতেই ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারলাম না। ফোন করে ছুটি নিয়ে নিলাম। আমার শুধু মন চাইছে ছুটে গিয়ে উনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। জড়িয়ে ধরে বলি আমি আপনাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না।

উনি কলেজ থেকে বাসায় ফেরেন সাড়ে চারটায়। আমি পৌনে পাঁচটায় বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। ভেতরে ঢুকতে ভয় লাগছিলো। তবুও সাহস করে ঢুকে পড়লাম।
বাসার পরিবেশ শান্ত। আমার শ্বাশুড়ি ডাইনিং রুমে বসে প্রাপ্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। চোখে পানি। একটু পরপরই আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।
প্রান্ত আর আমার শ্বশুর মহাশয় সোফায় বসা। আমার শ্বশুর মহাশয়েরও মুখ কালো। আমি কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন।
উনি সালাম নিলেন কিন্তু জবাব দিলেন না। শ্বাশুড়ি কাছে গিয়েও একই অবস্থা। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি নয়।

আমি অধৈর্য হয়ে প্রান্তর হাত ধরে টেনে ওকে আমাদের রুমের সামনে নিয়ে এলাম। অনুরোধের সুরে বললাম,’কি হয়েছে ভাই? তোমার ভাইয়া কোথায়? এখনো বাসায় ফেরেন নি?’

প্রান্ত শান্ত ভঙ্গিতে আমার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’ভাইয়া স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে ভাবী। তুমি চলে যাও। তোমাদের বাসায় ফিরে যাও। আমরা আর তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না।’

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রান্তর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। এসব কি বলছে প্রান্ত! সম্পর্ক রাখতে চায় না! আমার মনে হচ্ছিলো আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো।

প্রান্তর চোখে আমার জন্য কোন সহানুভূতি নেই। ও ভাইয়ের শোকে কাতর। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললো,’ভাইয়া খুব কেঁদেছিলো ভাবী। খুব কেঁদেছিলো। তুমি ঠিক করো নি আমার ভাইয়ার সঙ্গে। অন্যায় করেছো।’

প্রান্ত চলে গেলো। যাওয়ার সময় আমার দিকে একরাশ ঘৃণা নিক্ষেপ করে গেলো। আমি কখন কাঁদতে শুরু করে দিয়েছি নিজেও জানি না। টুপটুপ করে পানি পড়ছিলো আমার চোখ বেয়ে। খাটের পাশে উনার ছবিটার দিকে তাকিয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠলাম। এতবড় শাস্তি দিয়ে গেলেন আমাকে!

#আমার_ভুল
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২

‘তুলনা’ এই শব্দটার অপরনাম হওয়া উচিৎ মৃত্য। তুলনার কারণে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা আত্মার মৃত্যু ঘটে, সন্তুষ্টির মৃত্যু ঘটে। মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে, সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। আত্মতৃপ্তি হারিয়ে ফেলে। খুব জঘন্য রকমভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
কাছের মানুষ অভিমানে চুপটি করে দূরে সরে যায়। তখন শুধু আফসোস আর গ্লানি নিয়ে জীবন কাটাতে হয়।

আমার জীবনের এই ভয়াবহ দুর্বিপাকে তুলনার কতটুকু ভূমিকা ছিলো আমি জানি না। তবে জানি আফসোস আর গ্লানি ছাড়া চোখের সামনে কিছুই দেখতে পাই না।
চোখের পানিতে আমার বুক ভিজে যায় তবুও উনার দেখা পাই না। উনার গায়ের জামা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি, উনার ছবি জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করি, উনার দেওয়া উপহার সঙ্গে নিয়ে বসে থাকি কিন্তু তবুও কারো মন গলে না। কেউ আমাকে উনার খবর দেয় না। উনার শূন্যতায় দিনে দিনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো মৃত্যু যন্ত্রণাও এর চাইতে সহজ।

প্রিন্স সবার আদরের ছিলেন। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি বড় ছেলে বলতে দিশেহারা। প্রান্ত আর প্রাপ্তি তো ভাই ছাড়া কিছু বোঝে না। ওদের সেই ভাইকে আমি কষ্ট দিয়েছি, আঘাত করেছি এটা জানার পর ওরা কেউ আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে রাজি নয়। দুজনেই আমার নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলে দিলো। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িও আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলেন।

আমি দিশেহারা হয়ে আব্বার কাছে ছুটে গেলাম। ভেবেছিলাম আব্বা কিছু করতে পারবেন। কিন্তু আব্বাও ব্যর্থ হলেন। আমার কান্নাকাটি দেখে আব্বা আমার শ্বশুর মশাইয়ের কাছে উনি ফোন করেছিলেন। ঠিকই কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি। আমার শ্বশুর ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। বেশি কিছু না বললেও উনারা যে আমার ওপর অসন্তুষ্ট একথা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

আব্বা আমার শ্বাশুড়ি সঙ্গেও কথা বললেন। উনি প্রথমে চুপ ছিলেন। কিন্তু আব্বা উনাদের ওপর অসন্তুষ্ট হচ্ছেন বুঝতে পেরে একে একে সব ঘটনা বর্ণনা করা শুরু করলেন।

আমি ভেবেছিলাম চিৎকার চেঁচামেচি না করলে বোধহয় কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি আমি কতটা বোকা ছিলাম। এক বাসায় থেকে উনারা আমার আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবেন না এটা ভাবা নেহায়েত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার শ্বাশুড়ি সব খেয়াল করেছেন। আব্বার কাছে নিজমুখে সেকথা স্বীকার করলেন। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’এতদিন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলাম ভাইসাহেব। কিন্তু এখন যখন সেই ছেলেই অভিমান নিয়ে দেশ ছেড়েছে তখন আর এই সম্পর্কের কি মূল্য আছে! এই মিথ্যে সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে কষ্ট তো বাড়ানোর দরকার নেই।’

এসব শুনে আব্বা হতবাক হয়ে গেলেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। নিজের রত্নের এমন অধঃপতন উনি সহ্য করতে পারছিলেন না!

হাহাকার করে বললেন,’তুই কি করেছিস কিরণ? কি করেছিস? নিজের সংসার কেউ এমন করে ভাঙ্গে?’

আমি কথা বলতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার কান্না দেখে আব্বা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কঠিন করে কিছু বলতে পারলেন না। শুধু মাথা দুলিয়ে আফসোস করে বললেন,’ভুল করেছিস। মস্তবড় ভুল! যেই ছেলে তোকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে চারবছর অটল থাকতে পারে সেই ছেলে তোকে ত্যাগ করার ক্ষেত্রে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে একথা কেন তোর একবারের জন্যেও মাথায় এলো না!’

আমি কাঁদতে কাঁদতে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’কেন এলো না আব্বা! কেন এলো না! আমি তো মরে যাচ্ছি।’

আমার জীবন থমকে গেছে। সব আনন্দ নাই হয়ে গেছে। উনি ছিলেন। আমার সুখ ছিলো। উনি নেই। আমার সুখও নেই। আমি নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারি না। সারাক্ষণই উনার কথা মনে পড়ে। কেঁদে বুক ভাসাই। আব্বা হতাশ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু কিছু করতে পারেন না।

মানুষ হারিয়ে চেনে। আর আমি চিনে হারিয়েছি। এতিদিনে বুঝতে পারলাম নিজের সম্পর্কে আমার সমস্ত ধ্যানধারণা, হিসেব নিকেশ ভুল ছিলো।


দেখতে দেখতে তিনমাস কেটে গেলো। অথচ আমি উনার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারি নি। কত চেষ্টা করেছি প্রাপ্তির কাছ থেকে উনার নাম্বার জোগাড় করার জন্য। কিন্তু প্রাপ্তি আমার গলা শুনলেই ফোন কেটে দেয়।

আমি পাগলের হয়ে যাচ্ছিলাম। উনার কথা মনে হলে দমবন্ধ হয়ে আসে। আর কিছু ভালো লাগে না। ইউনিভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছে করে না। যখন তখন কেঁদে ফেলি।

দিনের বেলা তবুও ক্লাস করিয়ে সময় কাটাই। কিন্তু রাতের বেলা আর পারি না। রাত হলেও বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া শুরু হয়। কষ্ট বুক ফেটে যায়। চোখের পাতায় ঘুম আসে না! সারারাত বিছানায় ছটফট করি। সবই আছে। শুধু উনি নেই! আমার নিজের মানুষটা নেই!
আমাকে প্রচন্ডরকমভাবে ভালোবাসায় মুড়িয়ে দেওয়ার মানুষটা নেই!

আব্বা প্রথম প্রথম আমার ওপর রাগ ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে নরম হতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে রাগটা গিয়ে প্রিন্সের ওপর পড়লো। যত যাই হোক মা কেন মেয়ের কান্না দেখলে কোন বাবা সহ্য করতে পারেন না। আব্বা নিজের অজান্তেই প্রিন্সকে বকাবকি শুরু করলেন।

জোর করে আমাকে দিয়ে স্কলারশিপ এর আবেদন করালেন। জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অল্পকিছু দিনের মধ্যেই ডাক এসে গেলো।
কিন্তু আমি আগ্রহ পাই না। কি লাভ স্কলারশিপ দিয়ে! কি হবে এসব দিয়ে! জীবনের কোনো মানেই তো খুঁজে পাই না।

মা আমাকে বোঝালেন এভাবে কেঁদে কেটে জীবন নষ্ট করার কোন মানে নেই। জীবনে অনেক উত্থান পতন আসবে। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। কপালের লিখন তো কেউ খন্ডাতে পারে না। আর কেউ পাশে না থাকলেও আব্বা, মা আছেন।

এই কথাগুলো সঙ্গে মায়ের স্নেহ এবং রাগ দুটোই জড়িত আছে। আব্বা, মা দুজনেই প্রিন্সের ওপর রাগ। এতদিন হয়ে গেলো অথচ প্রিন্স আমার কোনো খবর নিলো না। কিন্তু আমার রাগ হয় না! উনার সঙ্গে আমি কি কি করেছি তা তো কেবলই আমি জানি।

নিজের জীবনের ইতিহাস আমি সাদা খাতার মত মেলে ধরেছি। এখানে কোন অন্যায়, কোন ভুলের কথা বাদ রাখি নি। কিন্তু কিছু কিছু কথা আছে যা চাইলেও কাউকে বলা যায় না। লজ্জায় বলতে পারি না। এমনকি নিজের মাকেও না।

কতদিন উনি কাছে আসার মুহূর্তে আমি উনাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি! উনার আকুতিভরা চাহনি উপেক্ষা করে দূরে সরে গিয়েছি, উনার বুকভরা ভালোবাসাকে আদিখ্যেতা বলে উপহাস করেছি।
শুধু তো অবহেলায় নয়, লজ্জায় অপমানে দূরে সরে গেছেন উনি! এসব ভাবলেই আমার চোখ ভিজে যায়! যন্ত্রণায় আমি মরে যাই।

এখন মনে হয় সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু একটাবার উনাকে দেখতে পারলেই আমার শান্তি। কিন্তু সেদিন আমি বুঝতে পারি নি। আজ আমার তৃষিত নয়নজোড়া বড় ব্যাকুল উনাকে দেখার জন্য কিন্তু যখন চোখের সামনে ছিলেন তখন ক্রমাগত অবহেলা করেছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here