শ্যামাবতী পর্ব: ৫

0
1010

#শ্যামাবতী
পর্ব: ৫
লাবিবা

দুপুর ১ টা বাজতে যাচ্ছে এখনো বেগুন ভাজি, চিংড়ি মাছ ভুনা দুটোই বাকি। ভাজির জন্য বেগুনে হলুদ মাখিয়ে কেবল তেলে দিবো ঠিক তখনই রাহাত এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তার হঠাৎ এমন করায় প্রথমে চমকে গেলোও পরবর্তীতে লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। লোকটা আমাকে যতবারই ছুঁয়ে দেয় ততোবারই যেন লজ্জা মিইয়ে পড়ি আমি। তার কাছে পাশে থাকতে খুবই লজ্জা লাগে আমার। সে এক হাতে চুলার আচ বন্ধ করে দিয়ে আমাকে তার দিকে ঘুরিয়ে নিল অতঃপর আমার থুতনি ধরে মুখটা আলতো করে উঁচু করে আমার শাড়ির আচল দিয়ে কপালে জমে থাকা বিন্দুবিন্দু ঘামের কণাগুলো খুব সন্তর্পনে মুছে দিল। বেশ কিছুক্ষণ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই তার ওষ্ঠ দুটো আমার কপালে আলতো করে ছুয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে প্রস্থান করলো। তার হুটহাট এমন কাজ গুলো আমাকে বড্ড লজ্জায় ফেলে দেয়।

——————–

বিছানার উপর গোল হয়ে বসে আছি। আমার সামনেই রাহাত অসহায় মুখ করে বসে আছে। এখন মধ্যরাত। এই মধ্যরাতে আমার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করছে। এবং এই ইচ্ছা যে সে ইচ্ছা না আমার বিরিয়ানি খেতেই হবে। এই রাত তিনটার সময় তো আর কোন রেস্তোরা খোলা নেই যে রাহাত সেখান থেকে আমাকে বিরিয়ানি এনে দেবে। এখন উপায় একটাই সেটা হলো রান্না করা। কিন্তু রাত তিনটার সময় বিরিয়ানি রান্না? মানে এটাও সম্ভব? কিন্তু কিছু করার নেই। রাহাত কে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এবার আমি কেঁদে দিলাম। আমাকে কাঁদতে দেখেই সে দ্রুত আমাকে এই বলে শান্ত করলো যে সে আগামী এক ঘন্টার মধ্যে বিরিয়ানি রান্না করে এনে দিবে। এক ঘন্টায় বিরিয়ানি রান্না সম্ভব? কিন্তু এই অসম্ভব টাকেই সম্ভব করতে হবে রাহাতকে এখন। সে এক ঘন্টার ভেতর বিরিয়ানি আনতে না পারলে আজ আমি এলাহি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবো। খেতে কি আমি চেয়েছি নাকি? খেতে তো চেয়েছ আমার পেটের ভিতর থাকা ছোট্ট বেবিটা। আমার বেবি খেতে চাইবে আর আমি যদি না দেই তাহলে কি হয়? মা হিসেবে তো বাচ্চার সব খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার তাই না?

আমার প্রেগনেন্সির বয়স ৫ মাস। আজকাল বড্ড মুড সুইং হয় এর সাথে হুটহাট করে শুধু খেতে ইচ্ছা হয়। রাহাত কে তো আমি জ্বালাতেই থাকি। কখনো আইসক্রিম, তখনো চকলেট, কখনো আচার যখন যা মন চায়। কখনো কখনো দেখা যায় মাঝ রাতে উঠে বায়না করি পেস্ট্রি কেক খাওয়ার জন্য। এমন অত্যাচার চালাচ্ছি আমি রাহাতের উপর।
রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। তারমানে রাহাত রান্না শুরু করে দিয়েছে। বসে বসে ভাল লাগছিল না তাই ফোন নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকে ছবি দেখতে শুরু করলাম। প্রেগনেন্সির রেজাল্ট জানার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে পিক তুলি নিজের পরিবর্তন দেখার জন্য। পিক দেখতে দেখতে চোখ আটকে যায় প্রথম সপ্তাহের পিকের দিকে। যেখানেই রাহাতে হাস্যজ্জল মুখ স্পষ্ট। পিক টা দেখে আমার মনে পড়ে যায় প্রথম দিনের কথা যেদিন জানতে পারি আমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারে। বেশ কিছুদিন ধরে শরীর খারাপ যাচ্ছিল। প্রথমদিকে দুর্বলতা ধরে নিলেও পরবর্তীতে আমার সন্দেহ হয়। খাবারের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না। আগে যে সকল খাবার পছন্দ করতাম না এখন সে সব খাবারই বেশি ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে বমি হয়। খুব বেশি টাইম দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। তাই সেদিন নিজের সন্দেহ দূর করতে প্রেগনেন্সি কিট কিনে নিয়ে আসি। রেজাল্ট পজিটিভ দেখে থমকে গিয়েছিলাম। খুশিতে না পারছিলাম কিছু বলতে না করতে পুরো যেন জমে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে ফোন হাতে নিয়ে রাহাত কে কল করতে যাই কিন্তু পরক্ষণে মতামত চেঞ্জ করে ফেলি। রাহাতের সকল পছন্দের ডিস বানিয়ে শাড়ি পড়ে সুন্দর করে সেজেগুজে রাহাত এর আসার অপেক্ষা করি। রাহাত আসার পর যখন ওকে সারপ্রাইজ টা দেই তখন ওর খুশি দেখে কে। আমাকে কোলে করে পুরো ঘর ঘুরেছিল সেদিন। সেদিন রাতেই আমার শাশুড়ি থেকে শুরু করে সকল কে কল করে সুখবরটা দিয়ে দেওয়া হয়। মামা মামি শুনে অনেক খুশি হয়েছিল। তারপরের দিন সন্ধ্যা নাগাদ আমার শাশুড়ি এসে হাজির হন আমার দেখাশোনা করার জন্য। দিনের বেলা যেহেতু রাহাত থাকতে পারে না সেহেতু আমার দেখাশোনা করার জন্য কারো দরকার ছিল। তবে প্রায় রাতেই যে আমি খাবারের জন্য বায়না করি এগুলো আমার শাশুড়ির কান অবদি যায়না। অবশ্য রাহাত চান না এই মাঝরাতে তাকে জালাতে।
প্রায় এক ঘণ্টা পর রাহাত প্লেটে করে আমার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে হাজির হলো। প্লেটে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া। এটা বিরিয়ানি? রাতে খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট ভাত এবং মুরগির মাংস একসাথে মিক্স করে নিয়ে এসেছে। আমি রাহাত এর দিকে তাকাতেই সে চোখ গরম দিয়ে বুঝালো আমাকে এটাই খেতে হবে এখন। আমিও বাধ্য হয়ে ওটাই খেয়ে নিলাম। স্বাদ অবশ্য খারাপ ছিল না।

—————

দেখতে দেখতে আমার ডেলিভারি টাইম চলে আসলো। আজ আমার ডেলিভারি। সকাল থেকে রাহাতকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় সকলেই উপস্থিত আমার রুমে শুধু রাহাত ছাড়া। আমার চোখ জোড়া বারবার রাহাত কে খুঁজছে। কি জানি আজকের পর আর কখনো তাকে দেখতে পাবো কিনা। এটাও তো জানি না আজকের পর আমি আর চোখ খুলে তাকাতে পারবো কিনা। আচ্ছা আমার বেবিটা দেখতে কার মতো হবে? রাহাতের মত নাকি আমার মত? আমি যদি মারা যাই তাহলে কি রাহাত তার শ্যামাবতীকে ভুলে যাবে? আমি খুব করে চাইছি বেঁচে থাকতে। আমি আমার বাচ্চাটাকে দেখতে চাই, নিজ হাতে বড় করতে চাই, মা ডাক শুনতে চাই। দেখতে চাই রাহাত আর তার বাচ্চার খুনসুটি। মাঝেমধ্যে অভিমান করে রাহাতকে বলতে চাই,
‘আপনি আমাকে এখন আর আগের মত ভালবাসে না রাহাত। মেয়েকে পেয়ে তো আমাকে একদম ভুলেই গেছেন।’
অনেকক্ষণ হয়ে গেল তারপরও যখন আমি রাহাত কে দেখতে পেলাম না তখন আমি বাধ্য হয়ে শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম তার কথা। প্রতি উত্তরে তিনি আমাকে বললেন রাহাত ভোরে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম আর ফেরেননি। বুঝলাম তিনি হয়তো এখন আল্লাহর দরবারে তার স্ত্রীর ও বাচ্চার জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন….।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here