#সোনাবউ,৭,৮
মোর্শেদা হাবিব
৭
গত কয়েকদিন ধরে বারান্দায় স্বর্ণাকে দেখা যাচ্ছেনা।সে একদমই আসেনা।আলিফকে দেখা যায় মাঝে মাঝে,বুয়াকে ঘর মুছতে দেখা যায় কিন্তু স্বর্ণাকে না।দরোজা জানালায় ভারী পর্দা দেয়া থাকে বলে ঘরের ভেতরটা দেখা যায়না।
মেরাজ ড্রয়ার খুলে বাইনোকুলারটা বের করল।গতকাল এটা কিনে এনেছে।চোখে লাগিয়ে রেঞ্জ -লেংথ সব সেট করে নিলো।মনটা আনন্দে নেচে উঠল।
বাইনোকুলারটা চোখ থেকে সরিয়ে তাকাল,কিছুই দেখা যাচ্ছেনা কেবল বাতাসে দরোজার পর্দা পতাকার মত উড়ছে।কিন্তু বাইনোকুলার চোখে লাগালেই পর্দার সামান্য ফাঁকা দিয়েও স্বর্ণাকে মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।মেরাজ জুম করে স্বর্নার ফেসটা ক্লোজ করায় মনে হলো স্বর্ণা ওর এক হাত দুরে বসে আছে,চাইলেই ধরা যাবে।প্রাণভরে স্বর্ণার নিষ্পাপ মুখখানি দেখে মেরাজ সিদ্ধান্ত নিলো, যে কোনো মূল্যেই হোক স্বর্ণাকে আবার তার হ্রদয়রাজ্যের শূন্য সিংহাসনে রাণীর আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।তাতে যা করা দরকার মেরাজ সব করতে প্রস্তুত।
……
আলিফের আজ কলেজ খুলেছে।ওকে নাস্তা খাইয়ে বিদদায় দিয়ে দুপুরের রান্না বসিয়েছে স্বর্ণা।এমন সময় বেল বাজলে আই হোল দিয়ে দেখে দরোজা অল্প খুলে বলল-“কে? কাকে চান?
-“ভাবী..আমিইই..ময়নার মা..চিনছেন গো ভাবীই…?”
স্বর্ণা গেটটা পুরোটা খুলে দিয়ে বলল-“ওহ্..ময়নার মা..কেমন আছেন?তা এদিকে কি মনে করে?”
-“কি মনে কইরা আহুম গো মা…আমগো মিরাজ বাইয়ের মনে কি যে অশান্তি…আহ্হা,চোখে দেইখা সহ্য হয়না।এই বউটা হেরে ফালাইয়া থুইয়া গেছেগা!”
স্বর্ণা মনে মনে চমকে উঠল,’মেরাজের বৌ জেসমিন চলে গেছে?”তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
.-“কি বলতে এসেছেন,সেটা বলেন ময়নার মা…আমার কাজ আছে!অন্যের খবরে আমার দরকার কি!””
-“ও.ও…..তা আপনার শাউরি কো?”
-“ঘুমিয়ে…কেন ডাকবো?”
-“আরে..না..না..না..না..আমি আপনের কাছে আইছি।”
বলে শাড়ীর আড়াল থেকে একটা খাম বের করে স্বর্ণার হাতে দিয়েই”যাইগা ভাবী” বলেই পগারপার।
স্বর্ণা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই খামের মুখ ছিড়ে বের করলো এক বিশাল পাতার চিঠি।
..
বুকটা ধ্বক করে উঠলো স্বর্ণার।এ যে দেখছি মেরাজের হাতের লেখা!ভুল দেখছে না তো?
প্রথম লাইনটা দেখল স্বর্ণা-“আমার সোনা বউ”দিয়ে শুরু করেছে।স্বর্ণা চিঠিটা না পড়ে একেবারে শেষ লাইনে চলে গেল দেখার জন্য যে চিঠিটা মুলতঃ কার! যা ভেবেছিলো তাই…শেষ লাইনে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-“অপেক্ষায় থাকবো!”তোমার মেরাজ!”
……
…..
স্বর্ণার বুকে হাতুড়ীর বাড়ী পড়া শুরু হলো যেন।মনে হচ্ছে হাতে কোনো জাহান্নামের আগুনের তৈরী পাতা ধরে রেখেছে।ছি..ছি..সে অন্যের বিবাহিতা।আর এটা অনেক বড় গুনাহ যে সে পরপুরুষের লেখা পড়ছে।স্বর্ণার ভেতরে মেরাজের প্রতি অনুকম্পার চেয়ে আল্লাহভীতিটাই প্রবল হয়ে উঠল।সে যদি এই চিঠির একটি লাইনও স্বেচ্ছায় বা কৌতুহলবশতঃ পড়ে তবে সে পরকীয়ার মত ভয়াবহ পাপ এবং একজন জেনাকারীর গুনাহে লিপ্ত হয়ে যাবে।
যার দুনিয়াবী শাস্তিই হলো রজম।আখেরাতে তো আছেই!
স্বর্ণা দ্রুত হাতে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে দিলো!চিঠিটা ফেলার পর মনটা হালকা লাগলেও চিঠির প্রথম আর শেষ দুটো লাইন হ্রৎপিন্ডে আঘাত করতে লাগল।স্বর্ণার ভয় করতে লাগল,মেরাজ কি শুরু করেছে এসব!একজীবনে নিজের ঘরে কষ্ট দিয়েছে,আজ যখন সে সুখে স্বামীর সংসার করছে তখন সে কালবোশেখীর কালো মেঘের মত ওর জীবনাকাশে ঝড়ের পূর্বাভাস হয়ে এসেছে।স্বর্ণা সারাদিন ঠিকমতো কোনো কাজেই মন বসাতে পারলোনা!বুকের ধুকপুকানী এতটুকু কমেনি!
…..
….
মেরাজ ভোরে তো বটেই..রাতের অন্ধকারেও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে একটি নজর স্বর্ণাকে দেখার আশায়।কিন্তু ইদানীং ও বারান্দায় আসা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে।বিশেষ করে চিঠিটা পাঠানোর পর থেকে।মেরাজ ভাবনায় পড়ল,নাহ্..অন্য ফন্দি বের করতে হবে।
একা মনে বিড়বিড় করতে লাগল সে’-“তোমাকে না পেলে আমার জীবন মরুভূমিই থেকে যাবে সোনা…তুমি চলে আসো.. প্লিজ!”দুচোখ বন্ধ করে বিয়ের পরপরের দিনগুলির কথা ভাবতে লাগল মেরাজ।আহা!কি সুন্দরই না ছিলো সেই দিনগুলি!”
…..
আজ অনেক বছর পর মেরাজ শুক্রবারেরর জুম’আ পড়তে বেরিয়েছে।হঠাৎই ইচ্ছে হলো।নামাজ শেষে বেরিয়ে আসার পথে আলিফের সাথে দেখা হলো,আলিফ আরেকজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।মেরাজের অন্তর্দাহ বাড়ল-‘আমার শান্তির পায়রাটাকে নিয়ে গিয়ে নিজে সুখে বিভোর হয়ে আছিস,অথচ সে তো আমারই ছিলো..ভুল করে তোর কাছে চলে গেছে,আমার জিনিস আমার ফেরত চাই’ মনে মনে যখন এসব ভাবছে মেরাজ তখন আলিফকে চলে যেতে দেখে ধ্যানভঙ্গ হলো।দ্রুত পা চালিয়ে ওকে ধরল-“কি রে,একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছিস দেখি,দেখাই পাওয়া যায়না,তা আছিস কেমন?”
আলিফ সামান্য হেসে বলল-“ভালো!”
-“একদিন তোর বাড়ী যাবো ভাবছি..তোর বউর হাতে চা খেয়ে আসবো..কি বলিস!নিজে থেকে তো শালা ডাকবি না!”
-“চা খেতে ইচ্ছে হলে বল্,এখনি খাওয়াই,মানা তো করিনি..!” আলিফ সুচতুরভাবে উত্তরটা দিলে মেরাজ কিছুটা হকচকিয়ে গেল।তারপর বলেই বসল-“তবু বাড়ীতে নিবি না,বউ’র হাতে চা খাওয়াবিনা?”
আলিফ বুঝতে পারছে মেরাজ কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছে তাই সে অফেন্সকেই এখানে ডিফেন্স হিসেবে ব্যবহার করাটা ঠিক মনে করল,মেরাজের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে বলল-বন্ধু,তোর তো মাশাআল্লাহ..অনেক টাকা পয়সা,তুই কি সেগুলো জনে জনে ডেকে সিন্দুক খুলে দেখিয়ে বেড়াস?'”
-“নাহ্..তা কেন করবো..এটা কেউ করে নাকি?”
-“কেন করেনা,তা তো জানিস?”
-“অবশ্যই,জানবো না কেন? মানুষের কুদৃষ্টি পড়বে, লোভ জাগবে,বাড়ীতে চোর আসবে,হিংসুক তৈরী হবে…এটা না জানার কি আছে!আসলে এসব বলে তুই কি বোঝাতে চাচ্ছিস বুঝলাম না…!”
আলিফ মেরাজের হাতটা তখনো ধরে রেখেছে।এবার বাম হাতটাও ওর কাঁধে রেখে বলল-“প্রত্যেক মুসলমানের কাছে সবচে উত্তম সম্পদ হলো তার দ্বীনদার স্ত্রী’এটা আমার কথা না এটা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা।তাই আমার এত দামী সম্পদকে আমি জনে জনে দেখিয়ে বেড়ানো পছন্দ করিনা,সেটাকে সিন্দুকে লুকিয়ে রাখাটাই নিরাপদ মনে করি।আর কেউ সেটার দিকে নজর দিলে তার চোখ উপড়ে ফেলতেও দ্বিধা করবোনা!” বলে সামান্য হেসে বলল-“যাই রে,অনেক কথা বললাম,মনে কষ্ট নিস না”!বলে আলিফ চলে গেলে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল।
….
শুয়ে বসে কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছেনা স্বর্ণা।কথাটা আলিফকে জানাবে কিনা তাও বুঝে উঠতে পারছেনা।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে এসেছে তখনি কপালে চুমুর স্পর্শে চোখ মেলে দেখল আলিফ চলে এসেছে।মাথা থেকে টুপি খুলে তা একপাশে রেখে দিয়ে বলল-“কি ব্যপার অসময়ে শুয়ে আছো যে?”
-“না..এমনিই!”
এমন সময় আলিফের মোবাইলটা বেজে উঠল।আলিফ ফোন ধরে সালাম দিয়ে স্বর্ণাকে ইশারায় জানালো যে ‘বাবা’ ফোন করেছেন!স্বর্ণা উৎসুক হয়ে বসে রইল।ফোন রেখে স্বর্ণার দিকে তাকালো-“বাবা ফোন করেছিলেন!”
-“হমম…বুঝলাম,কিন্তু কেন করেছিলেন তা তো বললেন না!”
-“তোমার ফুপাত বোনের বিয়ে,সামনের বৃহঃবার যেন তোমাকে নিয়ে দিয়ে আসি সেজন্য অনুমতি চাচ্ছিলেন!”
-“ওওহ্..তা আপনি কি বলেন,যাবো? ”
-” যেতে তো হবেই..আত্মীয়ের বিয়ে না? কিন্তু ঐ যে তোমাকে দুদিন আগে রেখে আসতে বলছে,ঐটাতেই তো সমস্যা!”
-“সমস্যা কেন?”
-“জানোই তো…তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা “!আলিফ স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল!স্বর্ণা মুখ নিচু করে ফেলল।
-“থাক্,একবারে বৃহঃবারেই রাতে যাবো,আগেভাগে যেয়ে কাজ নেই!”
-“বাসায় ওরা মাইন্ড করবেনা?”
-“করলে করুক,আপনাকে একা রেখে কোথাও যাবোনা..!”
-“প্রমিজ?”
স্বর্ণা আলিফের কাঁধে মাথা রেখে বলল-“প্রমিজ”!
আলিফ ঘাড় ফিরিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল-“চলো,ভাত দেবে,খুব খিদে পেয়েছে!”
-“ওহ্..স্যরি,স্যরি,চলুন!”
……
মায়ের ফোন পেল মেরাজ।ফোনেই মায়ের মুখে শুনল বৃহস্পতিবার মুনিয়ার বিয়ে।বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল মেরাজের।মনে পড়ল মুনিয়া স্বর্ণার ফুপাত বোন।ওর আর স্বর্ণার বিয়েতে মুনিয়ারা এসেছিলো। তারমানে স্বর্ণাদের পরিবার এ বিয়েতে থাকবে,জোর সম্ভাবনা স্বর্ণাও থাকবে।এইতো মোক্ষম সুযোগ মিলেছে।
এই দাওয়াত কিভাবে মিস করতে পারে মেরাজ?
……
চলবে.
#সোনাবউঃ
৮ম পর্বঃ
মোর্শেদা হাবিবঃ
***************
মেরাজ আর স্বর্ণা পরস্পর সম্পর্কে দুরসম্পর্কের আত্মীয় হওয়াতে মুনিয়ার বিয়েতে দুজনই দাওয়াত পেয়েছে।মেরাজ খুব আগ্রহ করেই বিয়েতে এসেছে এবং তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলো স্বর্ণা।
সে নিজেকে স্বর্ণার ব্যপারে অধিক হকদার মনে করে এবং তার বিশ্বাস স্বর্ণা তাকে এখনো ভালোবাসে।
প্রথম স্বামী,প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোবাসা মানুষ ভুলতে পারেনা।কারন তারা শূন্য হ্রদয়ে এসে জায়গা করে নেয় বলে তাদের চলে যাবার পরও শক্ত ছাপ রেখে যায়।মেরাজের স্থির বিশ্বাস,স্বর্ণা ওকে ভোলেনি,মেরাজের বোকামীর ভুলে বেচারীকে অন্যের ঘর করতে হচ্ছে।মেরাজ শিঘ্রই ওকে সসম্মানে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনবেই আনবে।মেরাজের এমনটিই বিশ্বাস।
…..
……
বিয়ের দুতিনদিন আগে থেকেই মেরাজ মুনিয়াদের বাড়ীতে প্রচুর গিফট আর নাস্তাসহ আসলো।মুনিয়ার আম্মুতো যথেষ্ট খুশী মেরাজের এই বাড়তি আয়োজনে।কিভাবে মেরাজকে আপ্যায়ন করবে তিনি ভেবে পাচ্ছেননা।
মেরাজ স্বেচ্ছায় বিয়ের কিছু দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলো।বরকে আংটি সে দিবে বলে মুনিয়ার মা’কে জয় করে নিল।
এতসব করার কারন একটাই এ বাড়ীতে তার প্রভাব বিস্তার করা।স্বর্ণার সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেতে হলে এবাড়ীতে তার একটা ইমেজ তৈরী করতে হবে, তারপর দরকার পরিবেশ!
..
মুনিয়াদের বাড়ীর প্রত্যেকটা সদস্য মেরাজের ব্যপারে তটস্থ হয়ে উঠল।সুযোগ বুঝে একদিন মেরাজ মুনিয়ার মায়ের কাছে স্বর্ণার প্রসঙ্গ তুলল।বিভিন্ন ভাবে নিজের দোষটাকে ভুলের মোড়কে ঢেকে নিজেকে ইনোসেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করার পূর্ণ চেষ্টা করল।সে নিজের ইচ্ছায় স্বর্ণাকে তালাক দেয়নি।একটা বাজে মেয়ের পাল্লায় পড়ে..এবং মেয়েটি তার সম্পত্তির লোভে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে….ইত্যাদী নানান কথার ভাজে নিজের উগ্র-বদরাগী চরিত্রটাকে লুকিয়ে নিল মেরাজ।সে একথা বারবারই উল্লেখ করলো যে, তারই একটা ছোট্ট একটা ভুলের কারনে স্বর্ণা আজ নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজন গোঁড়া ধার্মিকের ঘর করতে বাধ্য হচ্ছে।তার স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই,বোরকার ঘেরে বন্দী তার জীবন।মেরাজের এসব দেখে সহ্য হয়না।তাই স্বর্ণাকে সে স্বাধীন জীবন দান করতে চায়!
সব কথার শেষে বিনীত অনুরোধ জানালো,স্বর্ণাকে যেন তার সাথে একটিবার কথা বলবার মত পরিবেশ তৈরী করে দেয়া হয় যেন সে স্বর্ণাকে বোঝাতে পারে!
মুনিয়ার মা দুনিয়াবাদী মানুষ।ন্যায় -অন্যায়ের চেয়ে লাভ-লোকসানের হিসাবটা একটু বেশীই বোঝেন।তিনি এতে কোনো দোষের কিছু দেখলেন না,দুজনে কথা বলবে সমস্যা কি?
…..
বিয়ের দিন মেয়ের বিয়ে পড়ানো পর্যন্ত মুনিয়ার আম্মু খুব ব্যস্ত ছিলেন।বিয়ে পড়ানো হয়ে যাবার পর তিনি স্বর্ণাকে আড়ালে ডেকে বললেন-“একটু সাহায্য করতে পারবি মা?”
-“জ্বী,বলুন?”
-“মুনিয়াকে সাথে দেবার জিনিসগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে উঠতে পারছিনা,তুই আর সানিয়া মিলে একটু বাক্সটা গুছিয়ে দিতে পারবি?
-“খুব পারবো..!” বলে স্বর্ণা মুনিয়ার আম্মুর সাথে মুনিয়া সানিয়ার রূমে গেল।যাবার পথে আলিফের সাথে দেখা হলে ওকে জানালো সে মুনিয়ার লাগেজ গোছাতে সাহায্য করবে।আলিফ ওকে তীক্ষ্মচোখে জরিপ করে বলল-“বাইরের দিকে যেওনা কিন্তু…!”
-‘”বাইরে কি?আর তাছাড়া আমি বাইরে যাবো কেন?”
-“তা ঠিক,তবে তোমাকে দেখে আমারই মাথা ঘুরাচ্ছে..আমি চাইনা আর কারো ঘুরাক…আমি বাইরে আছি,লাগলে ফোন দিও!”
-“দেবো..!”
যাবার আগে আলিফ নিজের গালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ইশারা করলো-“হবে নাকি একটা?”
স্বর্ণা চোখ পাকিয়ে তাকালে আলিফ হেসে সরে গেল।যেতে যেতে বলল-“আঁচল ঠিক করো!”
স্বর্ণা আঁচলটা খুব ভালো করে টেনে মুনিয়ার ঘরে ঢুকল।সানিয়া বড় লাগেজ আর একগাদা সাজসরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে।স্বর্ণাকে দেখেই হাফ ছেড়ে বলল-“উফ্,আমি সব গুলিয়ে ফেলছি স্বর্ণাপু..তুমি গুছাও!”
স্বর্ণা হেসে ঘোমটা সরিয়ে আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে বিছানায় উঠে পড়ল।বাম হাতের মোবাইলটা একপাশে রেখে দিল।তারপর হাঁটুগেড়ে উপুড় হয়ে সব জিনিসপত্র নিজের দিকে টেনে নিলো।তখনি খুট শব্দ হতেই তাকিয়ে মাত্র বলতে নিল-“সানিয়া,তুমি এগুলো আমার সামনে এনে দাও..কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল।ওর সমস্ত শরীর যেন হিম হয়ে আসল।গোটা দরোজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেরাজ।স্বর্ণা যে বেরিয়ে যাবে তার কোনো ফাঁকফোকড়ই সে রাখেনি।
স্বর্ণা মনে মনে রবকে ডেকে চলল-“ওগো,মাবুদ..তুমিই সম্মান দাও,তুমিই অপদস্থ করো।আজ এই গুনাহগার তোমার কাছে সম্মান ভিক্ষা চায়!তারপর বাম হাতে হাতড়ে মোবাইলটা তুলে নিলো হাতে।মেরাজ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল-“মাই গড….তুমি এতো সুন্দর হলে কি করে সোনা?”
স্বর্ণা ঝট করে আঁচল কোমড় থেকে ছুটিয়ে দ্রুত বড় করে ঘোমটা দিয়ে ঘুরে মেরাজের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালো।বাম হাতে কাঁপতে কাঁপতে আলিফের নম্বরটা হাতড়াতে লাগল।নম্বরটা এসেও মিলিয়ে গেল।পেছন থেকে মেরাজ বলছে-“দুচোখ ভরে তোমাকে দেখতেও দেবেনা?”
তখনই আলিফের নম্বরটা এসে যাওয়ার সাথে সাথে সেন্ড বাটন পুশ করল স্বর্ণা আর মনে মনে বলতে লাগলো,আল্লাহ্,ও যেন দ্রুত ধরে….! ”
স্বর্ণা মোবাইলটাকে সাবধানে শোকেসের ওপরে রাখল।তারপর মেরাজকে বলল-“সরুন,আমাকে যেতে দিন!”
-“তোমার সাথে খুব জরুরী কথা ছিলো জান্..!”
-“আপনি আমার জন্য পরপুরুষ,আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারেনা!”
স্বর্ণা ঘোমটার আড়াল থেকেই চারদিক তাকাল,মেরাজের ভাবগতিক ভালো না,আত্মরক্ষার জন্য কিছু একটা হাতে থাকা দরকার।মেরাজের এগোনোর শব্দে চট করে লাগেজ থেকে নেইল কাটারটা তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-“খবরদার,আর এক পাও এগোবেন না..ভালও হবেনা,আল্লাহকে ভয় করুন।খবরদার বলছি..!” স্বর্ণার দুচোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে আসছে।
বাম হাতে ঘোমটা ধরে রেখেছে ডান হাতে নেইলকাটার।মেরাজ ওর বালখিল্যতা দেখে হাসলো-“তুমি এখনো সেই মিষ্টি মেয়েটিই রয়ে গেছো!”!
-“চুপ করুন,দরজা ছাড়ুন,আমি যাবো,আমাকে যেতে দিন!”
-“হেই..হেই..তুমি আমাকে রেপিষ্ট ধরে নিয়েছো নাকি? আই উওন্ট টাচ্ ইউ আ সিঙ্গেল মুমেন্ট।তোমার সাথে এমনটা আমি করতে পারিনা,জান্,আমি তো তোমার সাথে দাম্পত্য খেলা খেলতে চাই,প্লিজ, আমার কাছে ফিরে এসো,ঐ আলিফ তোমার উপযুক্ত না,তোমার দরকার আমার মত…!”
-“খবরদার”আমার স্বামীর নামে একটা বাজে উচ্চারন করবিনা,তুই তার নখেরও যোগ্য নস..!দরোজা..খোল্,বলছি!”
-“রিল্যাক্স,এতো এক্সাইটেড হয়োনা, দরজা তো খুলবোই।তার আগে গোটা বিয়ে বাড়ী জানুক যে,তুমি আমার সাথে এক কামরায় দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ ছিলে।তোমার সংসার ভাঙ্গার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট,তারপর তোমার জন্যে তো আমিই আছি!”
স্বর্ণা কাঁদছে।এমন সময় দরোজায় টোকা পড়লে মেরাজ হাসিমুখে দরোজা খুলতে গিয়েও নিজের চুলগুলোকে দুহাত দিয়ে এলোমেলো করে নিল।তারপর দরোজা খুলে সরতেও পারলোনা তার আগেই চোয়াল বরাবর প্রকান্ড মুগরের বাড়ী পড়লো যেন।মেরাজ পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখল আলিফ ঘরে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে দিচ্ছে।স্বর্ণা দৌড়ে গিয়ে আলিফের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।আলিফ ওকে এক হাতে ধরে ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল-“একটু সরে দাঁড়াও,জানোয়ারটাকে আগে একটু শায়েস্তা করে নেই..!”
-“না..আলিফ..প্লিজ চলো এখান থেকে!”
আলিফ মেরাজের দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে স্বর্ণার মোবাইলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ফোন কেটে দিয়ে বলল-“জীবনে মানুষ হলিনা..!সারাজীবন স্বর্ণার কাছে পশুরূপে বেঁচে থাকবি।নিজের সম্মানটা নষ্ট করলি।তোর ভাগ্য ভালো এটা বিয়েবাড়ী নইলে আমার বউয়ের দিকে কুনজর দেবার জন্য তোর চোখ আমি ঠিকই উপড়ে ফেলতাম,কুলাঙ্গার কোথাকার।”
বলে স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে গেল আলিফ।মেরাজ মুখে নোন্তা স্বাদ লাগায় দাঁতে হাত দিয়ে দেখলো হাতে রক্ত।…
…
চলবে.