শখের_সাদা_শাড়ি,16,17

0
750

#শখের_সাদা_শাড়ি,16,17
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
১৬.
সৌমেন এর বেস্টফ্রেন্ড অনুজ। হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলে ও দুই প্রান্তের দুই ব্যক্তিত্ব শুরু থেকেই মিলেমিশে ছিলো একাকার। কেউ কখনো কোনো বিষয় লুকায় নি একে অপরের থেকে। সৌমেন ও নিজের জীবনের এক এক টা খন্ড জানিয়ে রাখতো ভিন্ন ধর্মী এই বন্ধু টি কে। ইতো মধ্যেই সৌমেন এর অসুস্থতার খবর চলে গেছে অনুজের নিকট। অস্ট্রেলিয়া থাকে সে। ভালো ব্যবসা সেখানে। সব কিছু ঠিক থাকায় টিকেট পেতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। তবে স্ত্রী কে সাথে নিয়ে আসতে পারে নি। কয়েক দিন পর সে ও চলে আসবে। বন্ধুর অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে চলে এসেছে বন্ধুর নিকট। উর্মি লোক টা কে দেখে যা বুঝলো এতে করে অন্তরের মধ্য ভাগে এক রাশ ভালো লাগা কাজ করছে। মানুষ টা কতো টা উদ্বিগ্ন বন্ধুর জন্য। সত্যিই বন্ধু শব্দ টির মাঝে লুকিয়ে আছে বিশাল এক মুগ্ধতা। যা ধর্ম বর্ণ সব কিছুর থেকে বহু দূরে। যেখানে শুধু বিশ্বাস রাখা হয় সত্য কে আর গ্রহণ করা হয় মনুষ্যত্ব কে। আত্মিক বন্ধন কে আগলে রেখে তৈরি হয় সম্পর্ক। বেডে শুয়ে থাকা সৌমেন কে দেখে সবাই অনেক টাই স্তব্ধ। তাকে আনা হয়েছে কেবিনে। একে একে সবাই ভীড় করছে দরজার নিকট। সবাই এক ঝলক দেখছে ছেলে টা কে। সবল দেহের জন্য প্রায় সময় কলেজ কিংবা ভারসিটির এনাউল ফাংশন গুলো তে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সৌমেন। আজ সেই মানুষ টা হসপিটালের বেডে! মাহফুজ সাহেব কে বিশেষ ব্যস্ত দেখাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় টা তে বোধহয় নিজেকে খাপ খাইয়ে ফেলেছেন। স্ত্রী কে এখনো জাগ্রত করা হয় নি। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। অনুজ কে দেখে সৌজন্যতার হাসি দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলেন। পরক্ষণেই সেই হাসি টা অশ্রু তে পরিণত হলো। উর্মি এক বার নিশ্বাস ফেললো। প্রতি টা বাবা মা ই চান সন্তান দের ভালো হোক। অনুজ উর্মি কে দেখে চিকন চোখে তাকালো। মেয়েটি কে এর আগে দেখেছে বলে মনে হয় না। ভাবনার মাঝেই ডাক্তার বের হলেন। উর্মি এগিয়ে এলো তবে কিছু বললো না। অনুজ মাহফুজ সাহেব এর কাধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো কিছুক্ষণ। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো হাতেই কিছু নেই। ডাক্তারের সাথে কথা বলে সে। সব শুনে অনুজ শুধালো
” ব্রেন হেমারেজ হয়েছে কি? ”

” এখনো সিউর করে বলা যাচ্ছে না। কথা বললে বোঝা যাবে। ”

” রিপোর্ট কি বলে? ”

চুপচাপ দেখালো ডাক্তার কে। তিনি অনুজ কে সাথে নিয়ে একটু দূরে এলেন। উর্মি নজর ফিরিয়ে নিলো। মাহফুজ সাহেব বসে ছিলেন। সুস্মিতা বেগমের চিৎকারে ছুটে গেলেন। তিনি চেতনা ফিরে পেয়েছেন। ছেলের জন্য এখন পাগলামি শুরু করেছেন। জাপটে ধরলো উর্মি।সোফা তে বসে পরলেন মাহফুজ সাহেব। মস্তিষ্ক চলে না আর। মুখ ঢেকে ফেললেন হাতের তালু তে। উর্মি কোনো মতে মিথ্যে বুঝ দিচ্ছে তবে আদৌ কি সুস্থ হয়েছে সৌমেন?

উর্মি বাসায় ফিরলো রাত একটায়। এই মাঝ রাত্রি তে ফিরতে দিতে চান নি মাহফুজ সাহেব। তবে কাল সকালে কোর্ট এর ডেট পরেছে। নয়ন ডিভোর্স ফাইল করার জন্য কেস করেছে। উর্মি কে কেমন যেন রুক্ষ দেখায়। এপাশ ওপাশ করলে ও ঘুমায় নি মেঘনা। উর্মির মুখের অবস্থা দেখে উঠে পরে। উর্মি সেটা খেয়াল করে নি। ওর মন অন্য স্থানে। ধীর কন্ঠে ডাকে মেঘনা। উর্মি সচকিত হয়ে মেঘনা কে জাপটে ধরে। হাত পা কেমন নিশ্চল দেখায়। মেঘনা বুঝে না কি হয়েছে। উর্মি ফুপিয়ে কাঁদে।
” ছোট ভাইয়ার সাথে ভাবির খুব ঝগড়া হয়েছে রে আপা। ”

” এ আর নতুন কি। এটা তো প্রায় ই হচ্ছে এখন। ঘুমিয়ে পর। ”

” না রে আপা। নিত্য দিনের ঝগড়া না রে। এটা অনেক বড় ইস্যু। ”

” তাতে তোর কি? মনে আছে সেদিন কি বলেছিল ওরা। আমাদের সংসার আমরা বুঝবো। শোন বোন, বড় ভাবি লোভী হতে পারে তবে কখনো অহংকার করে না। ”

একটু থামে মেঘনা। পা টা মেলে দিয়ে আবার বলে–
” তবে ছোট ভাবি অহংকারী। সাথে সাথে আমাদের ভাই টা কে অহংকারী বানিয়ে তুলেছে। আমি ওর সম্পর্কে কিছু শুনতেই চাই না। ”

মেঘনা রাগ করে ঘুমিয়ে পরলো। উর্মি চুপ চাপ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মন টা বড্ড খারাপ। চারদিকে ঝামেলা। সুখ, শখ, আল্লাদ সব কিছু কেমন মলিন। সমীর এর কথা ভীষণ মনে পরে। কল করে উর্মি। সমীর ঘুমিয়ে ছিল। উর্মির নাম দেখেই ধরমরিয়ে উঠে।
” ভালো লাগছে না সমীর। ”

” কি হয়েছে উর্মি? ”

” জানি না। শুধু জানি ভালো লাগছে না। ”

” তুমি ঠিক আছো তো। এমন লাগে কেন কন্ঠ টা? ”

সমীর এর কন্ঠ টা ও চিন্তিত। উর্মি শিউরে উঠে। ব্যথা হয় বুকে। বিশেষ আয়োজন নেই আজ। কোনো রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই বলে উঠে
” আমি তোমাকে ভালোবাসি সমীর। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”

ওপাশের মানুষ টি বোধহয় বিস্মিত। কেঁপে উঠেছে প্রতি টা শিরা। সমীর এর চোখ দুটো ঝাপসা হতে শুরু করলো। উর্মি উত্তরের অপেক্ষায়। সমীর চুপচাপ থেকে মৌনতা ভেঙে বলল–
” আমার একটু সময় প্রয়োজন উর্মি। ”

উর্মি এবার স্তম্ভিত। তবে কি সমীর তাকে ভালোবাসে না? এ কি করে হয়! দুজনের চোখে চোখে বহু বার প্রেম নিবেদন হয়ে গেছে। ভরকায় উর্মি।ভালোবাসার সংকটে হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। সমীর এর কন্ঠ শোনা যায় না। উর্মি বলে–
” আমি এখন তবে রাখছি? ”

” হুম। ”

ফোন হাতে রেখে উর্মি ব্যস্ত হয়ে যায়। কেমন অশান্ত লাগে বুক। চোখ দুটো জ্বালা করছে।

নয়নের সাথে কোর্টে মুখোমুখি মেঘনা। উঁচু পেট টা নিয়ে চলতে কষ্ট হয় খুব। যতো দিন এই বাচ্চা টা পেটে আছে ততো দিন ডিভোর্স দিতে পারবে না নয়ন। সেই জন্যই ছিলো এতো নাটক। তাচ্ছিল্য হাসে মেঘনা। উর্মি কেবল তাকিয়ে থাকে। নয়ন কে দেখলে এখন ঘৃনা হয়। আপার বিয়ের শুরুর দিকে উর্মি মনে মনে গর্ব করতো, এমন একজন ভাই কে পাওয়া তে। তবে কে জানতো সময় স্রোতে ভালোবাসা উঠে যায়।আচানাক সমীর এর কথা মনে পরে উর্মির। অসুস্থ বোধ হয় হুটহাট।

নয়নের সাথে কথা বলে না মেঘনা। শুধুই উঁচু পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে ” বেবি এই দেখ তোর পাপা কে। যে তোকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায় নি। ”

নয়ন চুপ করে শুনলো কথা টা। কেন যেন ভেতর টা ইষৎ আর্তনাদ করে। চরম বিরক্তি প্রকাশ করে মেঘনা। উর্মির হাত ধরে এগিয়ে যায়। খোলা চোখে তাকিয়ে থাকে নয়ন। মেঘনা কে আগে এমন তেজস্বী লাগে নি। খেয়াল করা হয় নি নয় মাসের উঁচু পেটে ঠিক কতো টা সুন্দর লাগে মেয়েটি কে। মায়েরা বোধহয় এমনি সুন্দর হয়।

অন্তু ছুটে এলো মেঘনার কাছে। উর্মি তখন সাওয়ার নিতে গেছে। মেঘনা স্থির চোখে দেখছে অন্তু কে। আজকাল শরীর টা এতো ভারী হয়ে গেছে যে কথা বলতে গেলে ও কষ্ট হয়। অন্তু চার দিকে চোখ বুলায়।
” বড় ফুপি ছোট ফুপি কোথায়?”

” সাওয়ারে গেছে বাবা। কি হয়েছে? ”

” একটু দরকার। ”

কথা শেষ না করেই বাথরুমের দরজায় নক করে অন্তু। ভেতর থেকে উর্মি বলে–
” কি হয়েছে? ”

অন্তু কথা বলার পূর্বেই বিকট শব্দ শোনা যায়। মেঘনার বুক টা ছ্যত করে উঠে। অন্তু শুধু বলে–
” তাড়াতাড়ি আসো ফুপি। ”

অন্তু দৌড়ে যেতে থাকে। মেঘনা বলে
” আমায় ধরে নিয়ে যা তো। ”

তুলির চুল গুলো এলোমেলো। সৌজন্য খুব বেশিই রেগেই আছে। তুলির গায়ে হাত ও তুলে ফেললো। তুলি তখনি জিনিস পত্র ভাঙচুর করতে লাগলো। মেঘনা যেন কিছুই বুঝে না। অন্তু ছোট হলে ও চেহারা টা কেমন বড় দের মতো করে রেখেছে। অমর বাসায় নেই। এদিকে জোৎস্নার কোনো হেলদোল নেই। সে এই ভেজালে যাবে না বলেই স্থির।
” কি হচ্ছে কি এসব? ছোট ভাইয়া। ”

” বোঝা ওরে, অসভ্য হয়ে গেছে। সংসার করে আমার সাথে, আর প্রেম চালায় আরেক জনের সাথে। ”

” কি বলছো কি এসব? ”

” বে ‘ শ্যা হয়ে গেছে। ”

সৌজন্যের গলা চেপে ধরে তুলি। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় সৌজন্য। তুলি আর্তনাদ করে উঠে। উর্মি তখনি ছুটে এসেছে। তুলি কে টেনে তুলে।
” কি হচ্ছে কি ভাইয়া? ভাবির গায়ে হাত তুলতে বারণ করেছি না। ”

” কি হবে। নাটক শুরু হয়েছে। যেই নাটকের শেষ নেই।”

তুলি অশ্রু ফেলে। সৌজন্যের কথা গুলো শুনতে থাকে নিরবের সহিত। সৌজন্য রাগে ফুসতে ফুসতে বের হয় বাসা থেকে। তুলির হাতের কব্জি তে কেটে গেছে। উর্মির বুকে হাহাকার। অন্তু যেন মৌনতা তে সব বুজতে পারে। ব্যান্ডেজ এনে দেয় দ্রুত। উর্মি ব্যান্ডেজ করে দেয় ঠিক ই তবে তুলি কে কোনো প্রশ্ন করে না। কেবল বুক চিরে বের হয় দীর্ঘ নিশ্বাস। মায়ের বানানো শখের সংসার আজ হুমকির মুখে।

চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#শখের_সাদা_শাড়ি
১৭.
তুলি রাগ দেখিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। সৌজন্য দু একবার ফোন করা সত্তে ও তুলির বাবা মুখের উপর সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মেয়ে দিবেন না। আর খুব দ্রুত নাকি ডিভোর্স ফাইল করা হবে।ঝোকের বসে বিয়ে করেছিল সৌজন্য। তাই কাবিন এর টাকা টা বসিয়েছে পনেরো লাখ। তুলি বড়লোকের মেয়ে। সে যখন পনেরো লাখ টাকা কাবিন এর কথা বললো স‍ৌজন্য নিজেকে প্রভাবিত করে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেল। কারণ স্বপ্নে ও ভাবে নি দুজনের ছাড়াছাড়ি হবে। এদিকে সেভিং এর টাকা টা ও করেছিল তুলির নামে। সেটা থাকলে ও কিছু একটা সাহায্য হতো। এতো গুলো টাকা কোনো ভাবেই সৌজন্যের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। কি দিন কাল এলো ভালোবাসার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন টাকার চিন্তা করতে হয়।একবার ভাবলো বাড়ি টা বিক্রি করবে কিন্তু নিজের ভাগের টা বিক্রি করলে ও খুব হলে এই অসময়ে সাত লাখ টাকা আসবে। এর বেশি পেতে হলে অপেক্ষার প্রয়োজন। উর্মি আর মেঘনা নিজেদের অংশ দিয়ে দিবে বলে স্থির করলো। ঠিক তখনি বের হলো বাড়ি টা আটকা পরে আছে ব্যাংক এ। নোটিশ দেওয়া হয় নি ষড়যন্ত্র করে। এতো শতো চিন্তা এসে উদয় হলো যে উর্মি সহ সকলের মাথা খারাপ। বড় ভাবি কান্না জুড়ে দিয়েছেন। স্বামীর বেতন ভালো না। অতি সামান্য ই সেভিং পরে আছে। অন্তুর ভবিষ্যৎ একে বারেই ফাঁকা। মেঘনা খুব ই বিরক্ত। আজকাল এমনি তেই আবেগ এর থেকে মেজাজ চলে বেশি। ব্যক্তি গত জীবনে খুব একটা সুখে নেই যে। উর্মি ভেতরে ভেতরে একে বারেই ভেঙে গেছে তবে বাইরে টা নারিকেলের মতোই শক্ত। জীবনে প্রথম বারের মতো সৌজন্য কেঁদে উঠলো। খুব ছোট সময়ে কাঁদলে ও একটু বুঝ হওয়ার পর থেকে কেন যেন ছেলেটার চোখে কখনো জল আসে নি। কেমন যেন শক্ত ধাঁচের। এটা সত্য তুলি কে খুব ভালোবাসে সে। না হলে স্ত্রী এর কথা তে পরিবার কে কেউ অবহেলা করে? নিজের ভুলে পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ভাইয়া। এসব দেখে উর্মির মনে চলছে নিরব ঝড়। যে ঝড়ে উর্মি কে সঙ্গ দেবার জন্য কেউ নেই। ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরে সৌজন্য। অমর খুব একটা সান্ত্বনা দিতে পারলো না। সঞ্চয় যা আছে এতে করে নিজেদের ই টানাটানি লাগবে। এদিকে ব্যাংক এর লোন বেড়ে গিয়ে হয়েছে বিশ লাখ টাকা। এগুলো পরিশোধ না করলে মাস খানেক এর মাঝে পরিবার নিয়ে বের হতে হবে রাস্তায়। জোৎস্না চোখ রাঙালো। স্বামী সন্তান নিয়ে কেটে পরাই মঙ্গল। তবে অমর আসছে না দেখে তেঁতে উঠলেন তিনি।
” কি শুরু করলে তুমি? এখানে পঁচে গলে মরবে নাকি? আর কার জন্য ঠাই খুঁজো? দুদিন আগে ও যে বউ এর আঁচলের তলা তে পরে থাকতো। ”

” আহ জোৎস্না। ”

” একদম কথা বলবে না। চুপ থাকি বলেই আজ আমাদের কপাল পুরলো। ”

জোৎস্না আবার মরা কান্না জুড়ে দিলো। সৌজন্য ফুপিয়ে উঠে। অমর দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে চলে যায়। মেঘনা বসে আছে সোফা তে। পেটে চেঁপে রাখা হাত। মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বলে। উর্মি ধীরে ধীরে সব কাগজ পত্র ঘাটে। একে একে বের করে সমস্ত ডিটেলস। চোখের সামনে সব যেন ভাসে। বড় আপার বিয়ের জন্য বাবা লোন নিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিলো দুই লক্ষ। এখানে দেখাচ্ছে বারো লক্ষ। একে একে সব কাগজ ঘাটতে লাগলো উর্মি। এই যে লোনের কাগজ পত্র সব ঠিক করেছিল নয়ন ভাই। ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়া তে লোন টা ও খুব সহজেই পেয়ে গিয়েছিল। আর এই কারনেই নয়ন ভাই এর সম্মান ছিলো একটু বেশি। বিয়ের আগে থেকেই এই পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে এটাই ছিলো সকলের ধারণা। উর্মির মাথা টা ভন ভন করছে। একটা ব্রেক দরকার। সে যা ভাবার ভেবে নিলো। শেষ টা যাই হোক না কেন সব টা খোলসা করবেই।

সমীর কে নিয়ে আর্তনাদ চলছে বাড়ি তে। সব থেকে বেশি পাগলামো শুরু করেছেন সুস্মিতা বেগম। একমাত্র ছেলের জন্য প্রাণ যেন বেরিয়ে আসে। ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছে সৌমেন এর। এর কারণ জানা নেই। উর্মি এসেছিল অফিস এর ফাইল নিয়ে। কান্নার শব্দে স্থির হয়ে যায়। অনুজ কিছু একটা ভাবছে। যেন দ্বিধা তে ভুগছে। মাহফুজ সাহেব তীব্র বেগে চিৎকার করে যাচ্ছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন সমীর কে দীর্ঘ দিন ধরে এমন বি ‘ ষ দেওয়া হয়েছে যার ফলে সমীর এর ব্রেনের নার্ভ গুলো শুকিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পুরো দমে পাগল করার জন্য এই মেডিসিন এর ব্যবহার করা হয়। এসব ষড়যন্ত্র কার সেটা জানার জন্যই তিনি পুলিশের কাছে কেস ফাইল করেছেন। উর্মি কে দেখে বাড়ির কাজের লোক সরবত দিয়ে গেলেন। সরবতের তরল গলা দিয়ে নামছেই না।
অনুজ মাহফুজ সাহেব এর সাথে কথা বলে।
” আঙ্কেল আপনার সাথে আমার কথা আছে। ”

” বলো বাবা। আমার ছেলেটার অবস্থা ভালো হবে না তাই না? ”

” ভেঙে পরবেন না। ডাক্তার বলেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

” সান্ত্বনা দিও না বাবা। ”

ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পরলেন। উর্মি মুখ চেপে ধরে আছে। চোখ দুটো কেন যেন ভিজে আসে। অনুজ মাহফুজ সাহেব এর কাধে হাত রেখে ভেতরে চলে গেল। ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে রইলো উর্মি। সমীর এর কল দেখে নিজেকে পরিপাটি করলো। কথা বলতে বলতে বের হলো বাসা থেকে।
” স্যার এর অবস্থা ভালো না সমীর। ”

” সেটাই শুনলাম। সেই জন্য ই তোমায় কল করেছি। ”

” ওও। ”

” তুমি কোথায় এখন? ”

” সৌমেন স্যার এর বাসা থেকেই বের হলাম। ”

” ঠিক আছে। ”

” তুলি ভাবির বিষয় টা? ”

” খোঁজ চালাচ্ছি। আমার এক বন্ধু আছে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। সে দেখবে বিষয় টা। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। ছোট ভাইয়া কে বড় অসহায় লাগে। ভালো লাগে না আর। ”

” তুমি খুব একা ফিল করছো তাই না? ”

” আরে না। একা ফিল কেন করবো। আমি ঠিক ই আছি। ”

উর্মির ভাঙা গলা বুঝতে পারে সমীর। চোখ দুটো ছলছল করছে। উর্মি কে খুব দ্রুত গুড নিউজ দিতে চায় সে। সে জন্যেই এখন চুপ রয়েছে।

” কি করো এখন? ”

ধ্যান ফিরে সমীর এর। গলা টা কেশে নিয়ে জানায় কাজ করছে। তারপর বলে
” আজ সন্ধ্যায় সময় আছে তোমার? ”

” হ্যাঁ। এখন তো অফিসে কাজ ও হয় না। স্যার যাওয়ার পর যা হলো। কি জানি চাকরি টা থাকবে কি না। বাড়ির লোন আর ছোট ভাবির কাবিন এর টাকা। একে বারে পয়ত্রিশ লক্ষ টাকার ধাক্কা। ”

টাকার অংক টা এতো বেশি যে কোথাও থেকে সাহায্য চাওয়ার ও পথ নেই। উর্মি হাসার চেষ্টা করে।
” তবে দেখি কি করা যায়। ”

” হুম। আর শোনো,আজ শৌখিন এর সাথে দেখা করবে সন্ধ্যায়। ও আমার গোয়েন্দা বন্ধুর ব্যপারে খোঁজ দিবে আর তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। ”

” আচ্ছা। ”

অফিস থেকে কাজ সেড়ে শৌখিন এর সাথে দেখা করলো উর্মি। এক টা কেস নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে আধ ঘন্টার মতো লেট হলো প্রবীণের। ছেলেটা খুব করে আশা দিয়েছে উর্মি কে। আর যাই হোক সত্য টা বের করে দিবে সে। এতে করে বেশ ভরসা পেল উর্মি। তবে বাসায় ফিরে দেখলো অবস্থা খারাপ। রান্না হয় নি আজ। মেঘনা কোনো মতে কিচেনের দিকে আগাচ্ছে। উর্মি ছুটে গিয়ে বাঁধা দিলো। তারপর ডাল চাল ফুটিয়ে রান্না করলো। এক পর্যায় মনে হলো আজ তো ডাল ভাত জুটলো কপালে। তবে কাল কি হবে? কে জানে কি আছে কপালে।

তিন দিন পর
তুলি আজ পরেছে ওয়েস্টার্ন ড্রেস। লাল টকটকে লিপস্টিক ঠোঁটে। চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে বসেছে বার এর সব থেকে শেষের টেবিল টা তে। উর্মি কে ফোন করেছে প্রবীণ। লোকেশন পাঠাতেই চলে এসেছে উর্মি। ট্যাক্সির ভাড়া দিয়ে ভেতরে আসলো। কল করতেই প্রবীণ চলে এলো। উর্মি চার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল
” বার এ কেন? ”

” ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবে। ”

” ছোট ভাবির কোনো ইস্যু? ”

” ইয়েস। ”

ব্যস্ত দেখালো উর্মি কে। খুব দ্রুত হাঁটা তে হাত ধরে ফেললো প্রবীণ। উর্মি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
” কি হলো? ”

” ধীরে যাও। না হলে কিছুই দেখতে পাবে না। ”

” ও আচ্ছা। ”

নিস্তব্ধ গতিতে হাঁটতে লাগলো উর্মি। প্রবীণ ক্ষণে ক্ষণে কারো সাথে কথা বলছে। দুটো মাক্স হাতে নিলো। এক টা মাক্স উর্মি কে দিয়ে আরেক টা নিজে পরে নিলো। আর তারপর দুজন এমন ভাবে ভেতরে গেল যেন গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড। উর্মির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। যদি ও সমীর এর খুব ভালো বন্ধু প্রবীণ। তবে ওর জীবনে সমীর ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই। জীবনে কোনো পুরুষের স্পর্শ পাওয়া হয় নি। তবে সমীর এর অনেক কাছাকাছি ছিলো। এক মুহুর্তের জন্য সেই ভাবনায় ডুবে গেল উর্মি। প্রবীণ ইষৎ টান দিতেই ছেলেটার কাছাকাছি চলে এলো। দম বন্ধকর পরিবেশ!

উর্মি হাফসাফ করছে। প্রবীন ওয়াইন এর গ্লাস এগিয়ে দিলো। উর্মি অবাক হয়ে বলল
” আমি এসব খাই না। ”

” আরে আমি ও খাই না। জাস্ট দেখানোর জন্য। ”

” ওও। ”

প্রবীণ এর অনুকরণ করলো উর্মি। দুজন ই মদের গ্লাস টা ঠোঁটের কাছে নিয়ে আবার রেখে দিচ্ছে। দেখে মনে হলো দুজনেই মদ পান করে। উর্মির গা গুলিয়ে আসে। বমি বমি ভাব হতেই ওয়াসরুমের দিকে যেতে নেয়। ঠিক তখনি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে নয়ন। গায়ে টি শার্ট। প্যান্ট এর হাঁটুর দিক টা স্টাইল করে কাঁটা আর ভ্রু তে লাগানো রিং। মাথার ক্যাপ টা পরা তে পুরোপুরি বখাটে লাগে। উর্মির মাথা ঘুরে যায়। বমির কথা ভুলে যায় সে। প্রবীন ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। উর্মি হতবিহ্বল! ইষৎ কাছে আসে প্রবীণ।কানের কাছ টায় ঝুকে বলে
” এখন দেখবে ফিল্ম টা। ”

হাতের আঙুল উপরে উঠিয়ে মৃদু স্বরে কাউন্ট করে প্রবীণ। উর্মি দেখতে পায় নয়ন ধীর পায়ে তুলির দিকেই আগাচ্ছে। এবার যেন উর্মি মাথা ঘুরিয়ে ই পরে যাবে। পায়ের তলা তে মাটি নেই বললেই চলে। প্রবীণ মুখ দিয়ে জিরো উচ্চারণ করার সাথে সাথে নয়ন আর তুলি একে অপর কে জড়িয়ে ধরে! শুধু তাই নয় একে অপর এর সাথে এমন মাখামাখি শুরু করে যে ঘৃনায় জ্বলে উঠে উর্মির চোখ। সব টা পরিষ্কার এখন। উর্মি আর সহ্য করতে পারে না। ছুটে গিয়ে তুলি আর নয়ন এর গালে চড় বসায়। প্রবীণ মাথায় হাত রেখে বলে ” শীট”। আর একটু আগালে ব্যাপার টা অন্য রকম করার একটা চান্স ছিলো। হয়তো বা দুজনের চরিত্রের গুন গুলো নিয়ে কেস ফাইল করা যেতো। তবে এখন দুজনেই সাবধান হয়ে যাবে। বড় ভুল হয়ে গেল!

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here