#শখের_সাদা_শাড়ি,18,19
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
১৮.
মেঘনা কাতর চোখে তাকালো। উর্মির বলা প্রতি টা কথা শুনতে পেয়েছে। নেত্র যুগল বাঁধাহীন অশ্রু ঝড়ায়। এক সময় পেট চেপে ধরে বসে পরে। আর্তনাদ শুরু হয়। উর্মি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আপা কে। সৌজন্য নিজের রুমে বসে শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলো সিলিং এর পানে। উর্মির চিংকারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে। মেঘনার পেইন দেখে বুঝতে পারে হসপিটালে নিতে হবে। প্রথমে চেষ্টা করে মেঘনা কে কোলে নেওয়ার। রোগা পাতলা বোন টা খুব ভারী হয়ে গেছে। একা নেওয়ার মতো শক্তি নেই শরীরে। পরমুহুর্তেই মনে হলো এই দায়িত্ব টা এক ভাইয়ের। আর ভাইয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তার রহমত ছিলো বোধহয়। মুটিয়ে যাওয়া বোন টা কে কোলে তুলে ফেললো সে। উর্মি আর্তনাদ এর স্বরে বলল–
” ভাইয়া তুমি পারবে না। ”
” পারবো। ”
কথা শেষ না করেই ছুটতে থাকে সৌজন্য। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে উর্মি। তার বউ সোহাগি ভাই টা আজ বোন সোহাগি। এই ভাইয়ের দেহে কোনো পাপ নেই আর না আছে কোনো সংকোচ।
হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে মানুষ গুলো। সবাই মেঘনার নিজের লোক। বড় ভাবি বড় ভাইয়া ছোট ভাইয়া অন্তু আর ওর মা সম বোন উর্মি। প্রতি টা মানুষ আজ এখানে উপস্থিত কেবল ভালোবাসা নিয়ে। বড় ভাবি লোভী হলে ও মেঘনার খবর টা পেয়ে ছুটে এসেছেন আজ। গত কয়েক দিন বাবার বাড়ি তে থেকে শিক্ষা হয়ে গেছে। বিয়ের পর বাবার বাড়ি যে অবহেলার স্থান হয়ে যায় সেটা খুব ভালো টের পেয়েছেন।অপরাধবোধ হয়েছে এতোদিন। আজ একে বারে সব ছেড়ে চলে এসেছেন। খুব করে বলে এসেছেন ভাই ও তাদের বউ দের বাঁচি মরি সব স্বামীর বাড়ি তে। রাস্তায় থাকলে স্বামী সন্তান ননদ দেবর দের নিয়ে এক সাথে থাকবো। তবু তোমাদের মতো হবো না আর। উর্মি এতো কষ্টের মধ্যে ও সুখ পেল। বহু দিন ধরে এমন পরিবার পায় নি সে। অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে আজ আলোর দিশা পেয়েই গেল। উর্মি কে বুকে টেনে ধরলো জোৎস্না। কয়েক বার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকাতেই উর্মি বাধা দিলো। সে শুধুই বাবা মায়ের গড়ে তোলা শখের পরিবার টা কে দেখতে চায়। লাল বাতি টা নিভে গেল। কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। প্রতি টা মানুষ ছুটে এলো। ডাক্তার গম্ভীর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন
” মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ”
প্রতি টা চোখ ছলছল করে উঠলো। ছেলে মেয়ে নিয়ে কখনোই হিংসে ছিলো না কারো মনে। সুস্থ এক বাচ্চা চেয়েছে কেবল। উর্মি ভেতরে যেতে চাইলে ডাক্তার বললেন পরে যেতে। রোগীর রেস্ট এর প্রয়োজন।
একটু সুস্থ বোধ হতেই মেঘনা বাবু কে দেখতে চাইলো। পাশ থেকে নার্স বললেন বাবু কে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মেঘনা উঠে বসার চেষ্টা করে। ঠিক তখনি ডাক্তার এসে আটকে দেয়। স্পর্শ টা এতো টা কোমল যে মেঘনার নারী মন কেঁপে উঠে। স্পষ্ট অনুভব করে ডাক্তার এর হাত কাঁপছে। ডাক্তার বলে
” উঠো না এখন। ”
কন্ঠ টা ঠিক চেনে না মেঘনা। তবে চেনা লাগে। অচেনা কন্ঠের স্বর টা মাক্স পরে থাকায় মুখ টা দেখা যাচ্ছে না। মেঘনার শ্বাস কেমন ঘন হয়। ডাক্তার দ্রুত অক্সিজেন লাগিয়ে দেন। মেঘনা চোখ বন্ধ করতেই মাথায় হাত বুলায়। মেঘনা মৌন থাকে। তারপর হঠাৎ করেই কেঁদে উঠে। জীবন তাকে কি পরীক্ষায় ফেললো?
নর্মাল ডেলিভারী। এতো সময় যাওয়ার পর ও রোগীর সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। বাবু কে নিয়ে আসা হয়েছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা। তুলতুলে দেহ টা উর্মি কে কেমন দায়িত্বশীল করে তুলে। মনে হয় এই মাংসপিন্ড টা ওর নিজের শরীরের। খুব সুন্দর কপাল টা। এই কপালের দিকে তাকিয়েই সমীর এর কথা মনে হয়েছে। এই সময়ে ছেলে টা কে বিরক্ত করতে চায় না উর্মি। এমনি তে ও অনেক করেছে ওর জন্য। উর্মি কেবিন এর দিকে আগায়। দরজা খুলে যে দৃশ্য দেখে এতে করে ও নিজেই কেঁপে উঠে। দ্রুত প্রস্থান করে। হাত পা শীতল ঠেকে।
আলিদের বুকের ঠিক মাঝ খান টায় মাথা ছিলো মেঘনার। এই ছেলেটা কে জীবনে সব থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে সে। বাবার সাথে কমিশনারের মৌন বিবাদ ছিলো। আলিদ কে ভালোবাসা সত্তে ও অনুভূতি গুলো কে লুকিয়ে রেখে ছিলো মেঘনা। সব টা উজাড় করে ভালোবেসেছে নয়ন কে। আলিদ কে ভুলেই গিয়েছিলো এক প্রকার। সেই আলিদ আবার ফিরে এলো ওর জীবনে। মেঘনা সচকিত হয়। আলিদ এর থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। ছেলেটা যেন কষ্ট পায়। মেঘনা চোখ মুছে।
” আমি আসলে স্যরি মেঘনা। ”
” স্যরি তো আমার বলার কথা। ”
” তুমি কেন স্যরি হবে তাই না। দোষ তো আমার কপালের। ”
ঠোঁট কামড়ে উত্তর করে মেঘনা
” আমিই অভাগি। যেখানে যাই কপাল পুরে যায়। ”
” ছিই ছিই কি সব বলছো! ”
” ভুল কি বললাম বলো। জীবনে সব থেকে বড় পাপ ছিলো তোমার মতো মানুষ কে ফিরিয়ে দেওয়া। আমি কখনোই তোমার যোগ্য ছিলাম না। অথচ সেই আমি টাই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। ”
” প্লিজ মেঘনা এসব বাদ দাও। ”
” বরাবর ই আমার দোষ লুকাও তুমি। ”
কথা বলার সময় চোখ হাসে মেঘনার। আর তারপর ই মেঘনার রক্তে রক্তে ছেঁয়ে যায় বিষন্নতা। আলিদ এর মুখ টা এক বার দেখে নিয়ে বুঝে জীবন অনেক এগিয়ে চলেছে। আলিদ যেটা বলতে চায় সেটা সম্ভব না। দ্বিতীয় বারের মতো ছেলে টাকে ফিরিয়ে দিল মেঘনা।সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আজ ফিরিয়ে দিলো আলিদ এর ভালো ভেবে। আজ ওর কষ্ট নেই শুধু আফসোস হলো কেন সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলো সুদর্শন এই প্রেমিক পুরুষ কে? কি হতো বাবার অবাধ্য মেয়ে হলে। কত শত এলোমেলো চিন্তা করলো মেঘনা যার সৃষ্টি আছে তবে সমাধান নেই। বিচিত্র এ জীবন নিয়ে যতোই ভাবে ততোই অবাক হয়। শখের জিনিস গুলো বড্ড দামী হয় নতুবা হয় নিষিদ্ধ।
সৌমেন এর অসুস্থতা যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভাঙচুর হয়ে গেছে নিত্য অভ্যাস। ডাক্তার রা সমাধান দিতে পারছে না। মানসিক ডাক্তার রা ভয়ে কাছে আসে না। উর্মি দূর থেকে এসব দেখছিল। ভয় লাগে কেমন। আচমকা একটা শো পিস ছুড়ে মারে সৌমেন। যার আঘাতে হাত কেঁটে যায় উর্মির। মেয়েটার আর্তনাদে সবাই ঘুরে তাকায়। এমন কি সৌমেন নিজে ও ঘুরে তাকায়। হাতের রক্ত দেখে দ্বিগুন আর্তনাদ করে। উর্মি বেরিয়ে আসতেই সৌমেন ওর দিকে ছুটে আসে। বেশ ভরকে যায় উর্মি। সৌমেন খপ করে ওর হাত টা ধরে ফেলে। রাগি ভাব টা এখনো যায় নি। উর্মির দিকে লাল চোখে তাকায়। উর্মি শুকনো ঢোক গিলে।
” এখানে কি করো তুমি? ”
” আমি তো এমনিই এসেছি স্যার। ”
” ফাঁকি বাজ হয়ে গেছে তুমি। যাও এখুনি কাজে যাও। ”
” জী স্যার। ”
উর্মি কিছু দূর যেতেই সৌমেন আবার ডাকে। উর্মি আসে। সৌমেন বলে–
” হাতে কি? ”
” কিছু না তো। ”
” লাল তরল কেন? ”
” একটু আগে আপনি– ”
” আমাকে ব্লেম দিচ্ছো তুমি? সাহস তো কম না। ”
” স্যার আমি সেটা বলি নি। ”
” চুপ। ”
উর্মি একদম স্থির হয়ে যায়। সৌমেন ঘুরে ঘুরে দেখে উর্মি কে। মাথা চুলকিয়ে বলে
” আমি তো মজা করছিলাম। ”
উর্মি এবার মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবে যেন। সৌমেন খিটমিটে হাসে। যাওয়ার জন্য আগাতেই সৌমেন রাগি কন্ঠে বলে
” আমি যেতে বলেছি তোমায়? ”
” নো স্যার। ”
” তাহলে যাচ্ছো কেন। ”
” স্যরি স্যার। ”
” আই ডোন্ট নিড ইউর স্যরি ওকে। গো ”
” ওকে স্যার। ”
উর্মি আবার এক পা আগায়। ওমনি সৌমেন ডাক দেয়। মাথা ভনভন করে উর্মির। সৌমেন কেমন যেন করছে। এই এখনি সিরিয়াস তো এখনি ফানি। মূলত ওর ব্রেনের নার্ভ গুলো কাজ করছে না ঠিক ঠাক। ছোট বেলা আর বড় বেলার এক টা মিলন ঘটেছে। এর ফলে দুটো বিষয় নিয়েই চলছে। হঠাৎ করেই আবার মাথা ব্যথা শুরু হয়। মাথা চেপে ধরে সৌমেন। লুটিয়ে পরে মেঝে তে।
সব ঘটনা শুনে দুঃখ প্রকাশ করে সমীর। উর্মি এ পান্ত থেকে বলে
” মানুষের জীবন কেমন যেন। ”
” কেমন? ”
” কি জানি। ”
” অদ্ভুত তো। ”
” ভালো লাগে না আমার। মনে হয় সব টা ভস্ম করে চলে যাই। ”
” আপার ডিভোর্স এর কি অবস্থা? ”
” ঐ আর কি। টাকার খেল। নয়ন ভাই ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আর কোর্ট এর রায় ছিলো বেবি আসার পর। ”
” আর তুলি ভাবির বিষয় টা? ”
” জানি না কি হবে। পনেরো লাখ টাকা জোগাড় করা সহজ না। কোর্ট এ রায় চলছে। ”
” সে সব তো বুঝলাম। কিন্তু তুলি ভাবির সাথে নয়ন ভাই এর কি সম্পর্ক? ”
” এটা আমার কাছে ও পরিষ্কার নয় সমীর। সব টা ঘোলাটে। ”
ভাইব্রেশন হয় সমীর এর ফোন। মা ফোন করেছেন। উর্মির কল রেখে মায়ের ফোন রিসিভ করে সে। ওপাশ থেকে মিষ্টি মৃধার গলা শোনা যায়।
” এক টা কথা বলবো? ”
” বলো না। এতো আড়ষ্টতা কেন মিষ্টি মা? তোমার ছেলে আমি। ”
” তোর বাবার ছবি দিবি একটা। কিংবা ভিডিও কলে দেখাতে পারবি একটু। ”
মিষ্টি মৃধার কন্ঠে কেমন লজ্জা কাজ করে। সমীর উত্তর করে না। কল কেটে ভিডিও কল দেয়। আর তারপর ব্যলকনি তে গিয়ে বাবার বরাবর দাঁড়ায়। ব্যথাতুর দৃষ্টি টা মিষ্টি মৃধার চোখ এড়ায় না। ভদ্র লোক জীবনে ভুল করলে ও একটা সময় এসে ভুল বুঝতে পেরেছেন। তবে একজন বাবা সর্বদাই বাবা। সন্তান বৈধ হোক কিংবা অবৈধ। এসকল চিন্তায় বাবার সাথে মিলমিশ করবে বলে স্থির করেছে সমীর। যদি ও সব টা কেবল মা ভাইয়ের কথা ভেবে। হয়তো কখনোই বাবা কে ক্ষমা করতে পারবে না তবে চেষ্টা করবে। অন্তত মায়ের জন্য এই চেষ্টা টা করবে সে। জীবনের শেষ কটা দিন ভালো থাকার এক প্রচেষ্টা করবেন মিষ্টি মৃধা।
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
#শখের_সাদা_শাড়ি
১৯.
অনুজের কথা টা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছেন মাহফুজ সাহেব সহ সকলে। সৌমেন এর সাথে ওর পি এ মাইশার যে দীর্ঘদিনের প্রণয়। মাইশার ব্যক্তিগত জীবনের জন্যই এই কথা টা সকলের অগোচরে ছিলো। এসব কথা শুধু মাত্র অনুজ ই জানে। সৌমেন কোনো কথাই পেটে রাখতে পারে না। অনুজ কে বলা চাই ই চাই। অনুজ তার ওয়াইফ কে বলে কিছু ছবি পাঠাতে। যেখানে সৌমেন আর মাইশা খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে। ছবি গুলো দেখে মাহফুজ সাহেব তেমন কিছু বুঝেন না। তবে অনুজ গত এক সপ্তাহে অনেক কিছু বুঝে নিয়েছে। মাইশা যে লাপাত্তা হয়ে গেছে সেটা সকলের ই জানা। তবে বিষয় টা ঘাটায় নি কেউ। অনুজ প্রথমে সমস্ত সি সি টিভি ফুটেজ চেইক করেছে। ওর সন্দেহ টাই ঠিক ঠেকে। কোনো ফুটেজ ছিলো না। মাইশা কায়দা করে সরিয়ে ফেলেছে সব। অনুজ তারপর ই খোঁজ করেছিল অফিসের আর কেউ লাপাত্তা কি না তখন জানতে পারে কল্লোল নাকি কিছু দিন যাবত টানা আসছে না অফিসে। সন্দেহ জাগে খুব। সমস্ত ফাইল ঘেটে তথ্য গুলো চেইক করে অনুজ। ফলাফল দেখায় শূন্য। কারণ এখানে মাইশা আর কল্লোল এর সব ডিটেলস ভুয়া। মাইশা বলেছিল সে এতিম। সেই জন্যেই বোধহয় কোনো কিছু চেইক করে নি সৌমেন। আর কল্লোল এর ডিটেলস চেইক করেছে মাইশা। সেই জন্য ধরা পরার ও চান্স নেই। খুব সুন্দর করে গেইম খেলেছে এরা। তবে এদের উপর মহল টা খুব প্রভাবশালী বোঝা যায়। ধরা মুশকিল। অনুজ শেষ চেষ্টা করে একবার। সৌমেন বুদ্ধিমান ছিলো। সব সি সি টিভি ফুটেজ এর বাহিরে ও গোপন কিছু ছোট ক্যামেরা লাগানো থাকতো। অনুজ মনে মনে প্রার্থনা করে যাতে করে এই বিষয় টা মাইশার না জানা থাকে। বই এর ভেতর থেকে ক্যামেরা বের করে অনুজ। ল্যাপটপ এ পেনড্রাইভ লাগিয়ে চেইক করে। সবাই এখন নীরব দৃষ্টি তে। সমীর এর অসুস্থ হওয়ার দিনের ফুটেজ দেখে অনুজ। স্পষ্ট দেখা গেল মাইশা কে। মাইশা সি সি টিভি এর কাছে এসে ফিক করে হাসলো। আর তারপর পর ই বলল
” কি প্রয়োজন বল তো তোর? এই যে তোকে টাকা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। তুই তো কোনো কাজেই এলিই না। তোকে তো আমি অফ করেই রোজ কাজ করি তাই না। ”
মাইশা এবার হাসতে হাসতে সৌমেন এর লাঞ্চ এ একটা তরল মিশালো। তারপর বাটি টা উপরে তুলে বলল
” প্রিয় সৌমেন। আজকের খেলা টা খুব মজার হবে। ”
খাবার রেখে মাইশা ফিচেল হাসলো। তারপর লকার গুলো থেকে কিছু ফাইল আর নগদ টাকা বের করে নিয়ে বেরিয়ে পরলো। ধীরে ধীরে আগের ফুটেজ গুলো ও দেখলো সবাই। কিছু অপ্রত্যাশিত দৃশ্য সামনে এলো। সৌমেন এর অগোচরে মাইশা আর কল্লোল কেবিনে এসে নোংরা সব কান্ড করতো। এখানে বুঝাই যায় এদের মাঝে সম্পর্ক রয়েছে। উর্মির চোখে ভাসে রিসোর্ট এ মাইশা আর কল্লোল কে চুম্বনে লিপ্ত হতে দেখেছে। তারপর সেদিন সৌমেন ও ফিরে এসেছিল। উর্মি বুঝতে পারে মাইশা আর সৌমেন এর এক সাথে যাওয়ার কথা ছিলো। তবে মাইশা মাঝে ফ্যাসাদ করে বসে। সেই কারনেই কষ্ট পেয়ে ফিরে আসে সৌমেন। উর্মির এখন নিজের চুল নিজে ছিড়তে ইচ্ছে হয়। কেন সে এসব আগে বুঝতে পারলো না। কোনো মতে যদি সৌমেন কে বলা যেতো মাইশার কথা টা। তাহলে সৌমেন এর এই অবস্থা হতো না। উর্মি কেবল ভাবে আর ভাবে। ওর ভাবনার শেষ নেই আজ।
দীর্ঘ সময় নীরব থেকে সমীর বলল
” সত্যি বলতে মাইশার সাথে আমার তেমন যোগযোগ ছিলো না। কেন যেন ভালো লাগে নি ওকে। অনেক গুলো মাস সৌমেন ভাই এর সাথে কাজ করছি অথচ অচিরে ও বুঝি নি এই মাইশা একজন আততায়ী। সৌমেন ভাই এর জন্য খারাপ লাগছে। ”
” হুম সেটাই। আমি ও খুব একটা শান্তি পাচ্ছি না। স্যার এর অবস্থা দেখলেই গলা ধরে আসে। ”
” তবে উর্মি এটা আমি মানতে পারছি না সৌমেন ভাই এর মতো বিচক্ষণ মানুষ কে ঐ দু পয়সার মাইশা গোল খাইয়ে দিলো। এটা আমার মাথায় ক্যাচ করছে না। ”
” ভালোবাসায় অন্ধ হয়েছিলেন সৌমেন স্যার। হয়তো এটাই ছিলো ভাগ্য। ”
” সেই। ভাগ্যের বেশি কে দিবে। এখন বলো তো বাবুর কি নাম রাখলে। ”
” বাবুর নাম তো রাখা হয় নি এখনো। ”
” একটা কথা রাখবে? ”
” হ্যাঁ বলো না। ”
” বাবুর নাম আমি রাখবো প্লিজ। ”
হেসে ফেললো উর্মি। বেডের সাথে উবু হয়ে শুয়ে বলল
” এই কথায় আবার অনুমতি চাচ্ছো? ”
” উহু। আপু কে বলার জন্য বলেছি। আপু যদি পারমিশন দেয় তবেই নাম রাখবো। ”
” আপু দিবে পারমিশন। এতো ভেবো না তো। ”
” হুম। খেয়েছো? ”
” না। খাবো খাবো বলে খাওয়াই হলো না।”
” কি কথা উর্মি! এখন রাত এগারো টা বাজে। এখনি যাবে। ”
” না পরে। এখন আমি তোমার সাথে গল্প করবো। ”
উর্মির কন্ঠে দুষ্টুমি। হাসে সমীর। পরক্ষণেই বলে
” হচ্ছে না মিস। এখন আপনি খেয়ে দেয়ে ঘুম দিবেন। শরীর এর প্রতি যে যত্ন। ”
” কথা বলবো আমি। ”
” লক্ষী মেয়ে। এখন খেয়ে ঘুমাও প্লিজ। কাল কে তো আপা আর বাবু কে নিয়ে ক্লিনিকে যাবে। ”
” ও হ্যাঁ তাই তো। একদম ই খেয়াল ছিল না। আসলে সৌমেন স্যার এর ঘটনা টা এতো টাই আবেগী করে তুলেছিল যে ”
” হয়েছে মিস। এখন আপনি প্লিজ খাবার শেষ করেন। না হলে কিন্তু খুব বকা খেতে হবে। ”
হাসলো উর্মি। কল কাঁটার পূর্বে শব্দ করে চুমু খেল মেয়েটি। আর তারপর ই টুট টুট শব্দ শোনা গেল। সমীর নিশ্চল দেহ টা কে বেডে এলিয়ে দেয়। এদিকের ঝামেলা টা যেন ওকে চেঁপে ধরেছে। কিছু তেই কুল কিনারা পাচ্ছে না।
প্রবীণ এর সাথে কথা বলছিল উর্মি। কেস নিয়ে ছেলেটা নানা ভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে। উর্মি প্রথম দিকে হতাশ হয়েছিল। তার ই সাথে নিজের ভুলের জন্য নিজেকে দোষারোপ করছিল। তবে প্রবীণ জানায় তুলি আর নয়ন এর ঘনিষ্ঠতার প্রমানে তেমন কিছুই প্রুভ করা যেতো না। এতে অবশ্য উর্মির মন খারাপ কমে নি। সে যে ভুল করেছে এটাই সত্য। নয়ন আর তুলি সেদিন খুব রেগে গিয়েছিল তার ই সাথে থ্রেট করেছে। এসবে হয়তো যায় আসে না উর্মির। তবু ও আপা আর বাচ্চা টি কে নিয়ে ভয় পায় সে। পাশের টেবিলে মেঘনা আর বাবু কে দেখে বুক ভারী হয়। অশান্ত হয়ে উঠে উর্মির নারী সুলভ মন। মাতৃত্ব জাগে অন্তকর্নে। বাচ্চা টি কে কোলে তুলে নেয়। তুলতুলে নরম ছানা টির দিকে এক রাশ মায়া নিয়ে চেয়ে থাকে। এক পর্যায়ে অশ্রু সিক্ত নয়নে বলে
” পৃথিবী উল্টে গেলে ও তোর ক্ষতি হতে দিবো না বাবু। তোকে আমি সবার থেকে আড়ালে রাখবো। ”
মেঘনার চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু নেমে পরে। উর্মির হাত চেপে ধরে বলে
” আমার সাথে আমার মেয়ের ও মা হয়ে উঠেছিস বোন। তোর ঋণ কি করে শোধ করবো বল? ”
” আপা! এমন কথা বলে আমাকে ঋণী করিস না প্লিজ। আমি ওর মা না হলে ও মায়ের চেয়ে কম কি। ”
দু বোনের মাঝে মৌন ঝরে। কেউ উত্তর করতে পারে না। প্রবীণ সব দেখে ভাবে এদের কে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে।
চোখ মুছে উর্মি। প্রবীণ এর নিকটে এসে বলে ” স্যরি। আমরা আসলে হুটহাট আবেগে জড়িয়ে যাই। ”
সামান্য হাসে প্রবীণ। হাটতে হাটতে উত্তর করে
” আবেগ ছাড়া মানুষ আছে? আর এটা তো গর্বের কথা। তোমরা দুই বোন হচ্ছো শক্তি। রুখে দাঁড়িয়েছো অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সেটার জয় পরাজয় পরের কথা তবে তোমরা নারী হিসেবে জয়ী। ”
শ্রদ্ধায় ছেয়ে গেল উর্মির হৃদয়। আপা বাচ্চা টি কে নিয়ে আবার বসে পরেছে। বাচ্চার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন কলিজা খুলে চোখ বুলায়। উর্মি মনে মনে স্থির হয়। তার আপার বাচ্চা কে সব থেকে বেশি ভালোবাসা দিয়ে বড় করবে। ভাবনার অতলে যখন বুদ উর্মি তখন চট জলদি প্রবীণ বলল
” আমি তাহলে যাচ্ছি আজ। তোমরা দেখে শুনে বাসায় যেও। ”
” আচ্ছা। সমীর ফোন করলে জানাবেন আমি বাবু কে নিয়ে চেকাপ করাতে যাচ্ছি। ”
” হুম। নিজেদের খেয়াল রেখো। ”
মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানায় উর্মি। প্রবীণ এর চোখে কিছু একটা লক্ষ্য করেছে সে। এতো টা স্বচ্ছ ছিলো চোখের মনি যা ওকে ভেতর থেকে সম্মান জাগাতে বাধ্য করে। সমীর এর সাথে নিয়মিত কথা বলার সুযোগ হয় না আজকাল। কাজের প্রেসার কম দেখালে ও মূলত কাজ বেড়েছে বহু গুন। যা পুরোপুরি জুড়ে বসেছে উর্মির ঘাড়ে। না জানি সৌমেন স্যার কি করে সামাল দিতেন।
চলবে…….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ