এক_শহর_প্রেম?,১০,১১

0
792

#এক_শহর_প্রেম?,১০,১১
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০

মারসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আঁখিজোড়া তার মলিন। বদ্ধ ছাদের দিকে নজর সরিয়ে মুদন করে নেয় নয়নযুগল। তারপর হতাশ কন্ঠে বলে,

–আমি আপনাকে আপডেট জানাবো ভাই। আই নিড সাম টাইম টু থিংক।

ভিপি আশিক লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মারসাদের মুখোমুখি দাঁড়ায় তারপর মারসাদের কাঁধে হাত রেখে বলে,

–টেক ইউর টাইম। সময় এখনও আছে। ভেবে চিন্তে যা ভালো মনে হয় জানাও।

মারসাদ ও আহনাফ বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। কিছু দূর এসে ওরা দুইজনে মাঠের ঘাসের উপরে বসে। মারসাদ ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়ে কপালে হাত ঘষতে ঘষতে বলে,

–মা*থা ব্যাথাতে ছিঁড়ে যাচ্ছে। স্লিপিং পি*ল লাগবে কয়েকটা।

আহনাফ বিরক্ত হলো মারসাদের কথায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,
–সবকিছুতে তোর স্লিপিং পি*ল না নিলে হয় না? তুই তো এ*ডিক্টেড হয়ে যাচ্ছিস এটাতে। মাথাব্যথা দূর করার অনেক ইফেক্টিভ উপায় আছে। লো ডোজের পেইনকি*লারও নিতে পারিস।

মারসাদ হতাস কন্ঠে বলে,
–ওই তিক্ত স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে ঘুম জরুরী আমার। দিন রাত পরে পরে ঘুম জরুরী। ইট হার্টস মি ভেরি ব্যাডলি। যতোদিন ওই জানো*য়া-র গুলোকে নিজেদের আসল জায়গা দেখাতে পারবো ততোদিন আমার এই অস্থিরতা নির্মূল হবে না। সবে তো শুরু ওদের ব*র্বাদীর!

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মারসাদের সবটাই তার জানা। মারসাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলেও সে বারবার শিউড়ে উঠে। কিছুক্ষণ বসে থেকে ওরা ক্যান্টিনের উদ্দেশ্য যায়। পরের ক্লাসটা মারসাদ করবে না তবে আহনাফ করবে। মারসাদ কিছু খেয়ে হোস্টেলের দিকে যেতে থাকে। পথিমধ্যে দেখে মাহি, আদিরা সাথে আরও দুটো মেয়ে সাবিহা ও রিন্তি বসে বসে হেসে হেসে লাঞ্চ করছে। মারসাদ আলতো হেসে চলে গেলো। সে খাবারের পরপরই দুইটা স্লিপিং পি*ল খেয়ে নিয়েছে। রিন্তি মারসাদকে যেতে দেখে মাহিকে ডাক দিয়ে বলে,

–দোস্ত তোর ভাই!

মাহি তাকিয়ে দেখে মারসাদ বাঁক ঘুরে চলে গেছে। মাহি বলে,
–দাভাইয়ের তো এখন ক্লাস থাকার কথা। আহনাফ তো তাই বলেছিল। হঠাৎ কি হলো?

সাবিহা মাহির কথাতে পিঞ্চ করে বলে,
–সে যাইহোক কিন্তু আহনাফ ভাইয়ার সাথে না তোর শ*ত্রুতা? তাহলে এতো কিসের যোগাযোগ? তাও নিজের ভাইয়ের তথ্য ভাইয়ের বন্ধুর থেকে! কুছ কুছ তো হ্যায় মেরি জান!

সাবিহার কথায় আদিরা ও রিন্তি হেসে উঠলো। মাহি সাবিহার পিঠে কিছু উত্তম-মাধ্যম দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,

–কী শুরু করেছিস তোরা? সকাল থেকে এসবই করছিস। আমার মনে ওসব কিছু নেই যা তোরা মিন করছিস। ওকে!

আরেকদফা হাসির রোল পড়লো। মাহি এবার মুখ ফুলিয়ে রাগ করে উঠে চলেই গেলো।

_________

–ভাই! ভাই! মারসাদ ভাইরে দেখলাম আশিক ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেছিলো।

সুমন নামের এক ছেলে সাগরকে দৌঁড়ে এসে হড়বড়িয়ে খবর জানালো। সাগর ছেলেটার মুখ নিঃসৃত বুলি শুনে রেগে ছেলেটার গালে কষে এক চ ড় বসিয়ে দিয়ে বলল,

–তুই এই খবর আমাকে এখন দিচ্ছিস!

সাগর ছেলেটাকে কিছুক্ষণ অশ্রাব্য গালাগাল করে। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সবটা সহ্য করে নিলো। সাগর ছেলেটিকে আবার বলল,

–কী বিষয়ে কথা হয়েছে কিছু জানতে পেরেছিস?

সুমন ছেলেটা ঐ অবস্থায়ই ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। সাগর রেগে আরেকটা চ ড় বসিয়ে দিয়ে রেগে বলল,

–অর্ধেক খবর নিয়ে আসিস কেনো অকর্মা গুলো? আমার সামনে থেকে দূর হ। নয়তো তোর রক্ষে নেই।

ছেলেটা তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে স্থান ত্যাগ করে। সাগর রাগে সামনের বেঞ্চ ধা*ক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তারপর রাগে কটমট করে বলে,

–মারসাদ! মারসাদ! মারসাদ! এই ছেলেটা আমার পথের কাঁ*টা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সেচ্ছায় ভিপি নির্বাচন থেকে সরে গিয়েও এর বেষ্টফ্রেন্ডকে রেখে গেছে। একে পুরোপুরি ক্ষমতাহীন করতেই হবে। আমার সকল কর্মকান্ডে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সে। কিছু একটা করতেই হবে। নিলয় এদিয়ে আয়।

নিলয় এগিয়ে আসলে সাগর বলে,
–তোর কাজ কতটুকু? পরিকল্পনা মোতাবেক চলছে তো?

নিলয় শ*য়*তানি হেসে বলে,
–নো টেনশন দোস্ত। পাখি খাঁচার ভিতরে অলরেডি ঢুকে গেছে। এখন পাখিকে আরও দুর্বল করতে হবে। এতোটাই দুর্বল যে পাখি আমার ইশারায় সব করতে রাজি হয়ে যায়। আমি এখন তার কাছে খুব ভালো একজন মানুষ। তোর বন্ধু হয়েও যে আমি এতো ভালো তা তাকে বিশ্বাস দিতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয় নি বস!

সাগর বিশ্রি হাসলো। তারপর বিশ্রি ভাবে বলল,
–তা সাধুপুরুষ কী পাখির রূপের সুধা পান করবে না?

নিলয় কুৎসিত হেসে বলে,
–আরেকটু সবুর করতে হবে যে। নিলয় নিজের ইম্প্রেশন নষ্ট করবে না এখনই।

আরেকটা ছেলে এসে সাগরদের বলল,
–ভাই, সামিরা আপু আসছে।

সাগর সামিরাকে ভেতরে আসতে দিতে বললে সামিরা ভেতরে এসেই সাগরের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

–তুমি না বলেছিলে আদিরার ব্যাবস্থা করবে? কী হলো সেটার? সে এখনও ফিট এন্ড ফাইন! হোয়াই?

সাগর সামিরার চারপাশে ঘুরে সামিরার কাঁধ জরিয়ে বলে,
–কুল সামিরা বেবি। ওই মেয়েকে আপাততো বাদ দেও। ওই পুচকে মেয়েকে যেকোনো সময় ধরাশায়ী করা যাবে। তুমি এটা বলো, মারসাদের কারও সাথে তুখড় শ*ত্রুতা আছে?

সামিরা সাগরের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে কপাল কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বলে,

–তা জেনে তোমার কী কাজ?

সাগর বাঁকা হেসে বলে,
–আমরই তো কাজ। মারসাদকে দুর্বল করতে পারলে তোমারও লাভ। তুমি ইজিলি তোমার পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে পারবে। মারসাদ তখন কোনো বাঁধা দিতে পারবে না।

সামিরা ভাবলো। মারসাদকে তার পদতলে দেখতে তারও ভালো লাগবে। কথায় কথায় অপমানে জর্জরিত করা থামবে তখন মারসাদ নিজে এসে তার কাছে ধরা দিবে। সামিরা বাঁকা হেসে বলে,

–মারসাদদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু এমপি রুহুল শিকদার ও তার দুঃসম্পর্কের ভাতিজা রাদিব। রাদিব হচ্ছে মারসাদের বড়ো বোনের হাজবেন্ড। রাদিবের ট*র্চারের কারণে মারসাদের বড়োবোন আজ পৃথিবীতে নেই। মারসাদ রাদিব ও রুহুল আমিনকে সহ্য করতে পারে না। তবে রাদিব গা ঢাকা দিয়ে আছে কোনো একটা দেশে। কেউ বলে ইন্ডিয়াতে আছে রাদিব। মারসাদ রাদিবকে পেলে আর ছাড়বে বলে মনে হয় না। রাদিবের নামে থানায় মা*র্ডা*র কেসের মা*মলা চলছে।

সাগর সামিরা হাতে চু*মু দেয়। সামিরা সাগরের কাজে রেগে সাগরকে ধা*ক্কা দিয়ে নিজের সামনে থেকে সরায় তারপর বলে,

–আমাকে বাজে টাচ করার চেষ্টাও করবে না। আই এম নট ইউর টয়!

সামিরা সেখান থেকে চলে গেলে সাগর অট্টহাসিতে ফেটে পরে।
–ইউ আর জাস্ট এ টয় সামিরা বেবি। আমার হাতের পুতুল তুমি। নিজের অজান্তেই তুমি আমার কথায় সব করো।

সাগরের সাথের সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠে।

________
কয়েকদিন পর,,

আদিরা ক্লাসে একা বসে বসে পড়ছে। আজ একটা ক্লাস টেস্ট আছে। খাতায় যা লেখা সেগুলো পড়ছে। পুরো ক্লাসে কেউ নেই। পড়তে পড়তে সামনের দিকে নজর গেলে দেখে টিচারের লেকচার টেবিলে মারসাদ কনুইতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঝুলছে বাঁকা হাসি আর চোখে রম্যতার ছাঁপ। আদিরা একটু অবাক হলো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। মারসাদ রম্য স্বরে বলে,

–কী খুঁজছো মনোহারিণী!

আদিরা মারসাদের সম্বোধনে চমকে গেলো। মারসাদ আদিরার দিকে এগিয়ে এলো। তারপর আদিরার দিকে ঝুঁকে বলল,

–অবাক হচ্ছো? হতে পারো। তোমার তো স্বভাব এটা। আমি কিছু পরীক্ষা করতে এসেছি এখানে।

আদিরা মারসাদের ঝুঁকে আসা দেখেই তৎক্ষণাৎ পেছোনে মাথা সরিয়ে নিয়েছিল। মারসাদের দিকে জিজ্ঞাসু নয়নে চাইলো। মারসাদ প্রতিউত্তরে চমৎকার হেসে বলল,

–সবাই আমার মন পড়তে পারে জানো? সবাই বলে আমি তোমাতে মন হারিয়েছি। আদৌতেও কী তা সত্যি? সেটাই পরীক্ষা করতে এসেছি। আমি যদি সত্যি তোমাতে মন হারিয়ে বসি তবে আমার হারানো মন সুদে-আসলে ফেরত চাই। বুঝতে পেরেছো? তখন কার্পণ্য করলে কিন্তু চলবে না! মারসাদ ইশরাকের মন নিজের কাছে রাখার দায়ে তোমাকে হা*জতেও যেতে হতে পারে মেয়ে!

আদিরা হতবাক হয়ে বোকার মতো মারসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখাবয়বের অভিব্যক্তি দেখে যে কেউ বলতে পারবে, মারসাদের বলা প্রতিটা শব্দ ও বাক্য তার মস্তিষ্কের উপর দিয়ে গেছে। তার যে কিছুই বোধগম্য হয় নি তা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট। মারসাদ আদিরার থুতনিতে হাত দিয়ে ঠেলে মুখের অল্পবিস্তর ফাঁকা জায়গা বন্ধ করে দিলো। আদিরা আরও দূরে সরে যায়। মারসাদ হেসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

–ক্লাসের পর মিনারের কাছে চলে আসবে। একটুও যেনো দেড়ি না হয়। নয়তো তুলে নিয়ে আসবো। তুমি আমাকে যতোটুকু চিনো তাতে আমার কাজ সম্পর্কে তোমার ধারণা থাকার কথা।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

#এক_শহর_প্রেম?
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
মারসাদ শিস বাজাতে বাজাতে পকেটে হাত গুঁজে চলেও গেছে কিন্তু রেখে গেছে হতভম্ব আদিরাকে। আদিরা চোখ বড়ো বড়ো করে সম্মুখপানে চেয়ে আছে। কয়েকমিনিটের মধ্যে ক্লাসে স্টুডেন্ট আসতে শুরু করেছে। মাহি ও রিন্তি এসে আদিরাকে অন্যমনষ্ক দেখে ওর দুই পাশে দুইজন বসে। রিন্তি আদিরাকে বলে,

–দোস্ত পড়া কতোটুকু শেষ করলি? কম্পিলিট তোর? প্রিপারেশন কেমন?

আদিরার থেকে কোনো জবাব পেলো না বিপরীতে। রিন্তি মাহির দিকে তাকিয়ে আদিরাকে দেখিয়ে ইশারা করে। মাহিও কিছু জানে না এই ব্যাপারে। এবার আদিরার হাতে ঠেলা দিলে আদিরার হুঁশ ফিরে। রিন্তি জিজ্ঞেস করে,

–কী-রে? কোথায় হারিয়েছিস? তোর সাথে কথা বলছি আর তোর কোনো ভাবান্তর নেই!

আদিরা অপ্রস্তুত হয়। অপ্রতিভ কন্ঠে বলল,

–কিছু না। এমনিতেই। তুই পড়তে থাক। আমার একটু মাহির থেকে কিছু জানার ছিল।

আদিরা আর কোনো বাক্যব্যয় না করে মাহির হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলো। মাহি আদিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। আদিরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বলল,

–দেখ মাহি, কিছু মনে করো না। তোমার দাভাই কেমন উদ্ভট ভাবে কথা বলে। আমাকে কী বলে আমি বুঝে উঠতে পারি না। আর অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছু বলে যা কখনোই সম্ভব না।

মাহি অবাক হয়। মাহি জানে তার দাভাই কারো সাথে অহেতুক অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলে না। তার দাভাই কেমন তা তার জানা। মাহি সন্দিহান কন্ঠে বলে,

–কী বলে দাভাই?

আদিরা আবারও অপ্রস্তুত হয়। মারসাদ যাওয়ার পর মারসাদের বলা কথা গুলো পুনরায় পর্যালোচনা করে তার এটাই বোধগম্য হয়েছে যে, মারসাদ কোনো ভাবে তাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। তাছাড়া বিগত একমাসের বেশি সময় ধরে করা প্রতিটা কাজ ও ঘটনাও আদিরাকে ভাবতে বাধ্য করছে।
এইতো চার দিন আগে মারসাদ সপ্তাহে অন্য দুই দিনের মতো সেদিনও রাতের বেলা আদিরাকে টিউশনের জন্য নিয়ে যেতে এসেছিএ। আদিরার নাম্বারে কল করে আসতে বলার পর আদিরা জানিয়েছিল যে সে দুই দিন রাতে আর দুই দিন দিনের বেলা পড়ায়। মারসাদ এটা শুনে প্রচণ্ড রেগে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। কেনো তাকে না জানিয়ে এটা করা হলো? দিনের বেলা টিউশনির সময় নেওয়ার কী দরকার ছিলো? এসবই উচ্চস্বরে বলেছিল যা শুনতে রুড লাগছিল। আদিরাকে নিজের দিকটা ব্যাখ্যা করার সুযোগটাই দেয় নি সেদিন। রে*গে-মেগে মারসাদ চলে গিয়েছিল।

মাহি আদিরাকে আবারও অন্যমনষ্ক দেখে আদিরার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,

–তোর কী হয়েছে বলতো? অনেকক্ষণ যাবত বেখায়ালি লক্ষ্য করছি। আর দাভাই কী করেছে সেটাও বল।

আদিরা মলিন হেসে বলে,
–পরীক্ষার পর বলি। স্যার চলে আসতেছে।

মাহিও রাজী হয়। ওরা ক্লাসে গিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। পরীক্ষার পর আদিরা ও মাহি, সাবিহা ও রিন্তিকে বলে একটু আলাদা কথা বলতে যায়। গোলাপি সাদা ফুল বোঝাই কড়ই গাছটার নিচে মাহি ও আদিরা দাঁড়িয়ে আছে। আদিরা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

–আমি গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে। কতোটা যু*দ্ধ করে গ্রাম থেকে এই অচেনা শহরে এসেছি আমিই জানি। মা ঋণ করে আমার ভর্তির টাকাটা দিয়েছে। শহরে থাকার মতে জরুরী জিনিসপত্র ক্রয় করার পর হাতে টাকা ছিলো না। বাবা তো চায়ই নি আমি আর পড়ালেখা করি। গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছেও বাবার ঋণ আছে। বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিল কিন্তু মা ও শিক্ষকদের সহায়তায় আজ আমি এখানে। মায়ের স্বপ্ন আমি পূরণ করবোই। কিন্তু এখানে এসে একের পর এক ঝামেলাতে জড়িয়ে যাচ্ছি। কারও কারও চোখের বি*ষে পরিণত হয়েছি। সেই সংখ্যাটা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে যদি তোমার ভাই নিজেকে না থামায়।

মাহি বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে বলল,
–দাভাই কী করেছে?

আদিরা হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার দাভাই নাকি আমাতে নিজের মন হারিয়েছে! এটা কতোটা যুক্তিবহ তুমিই বলো? সে তার প্রেমিকাকে ধোঁকা দিচ্ছে! আর তার প্রেমিকা ভাবছে আমি তোমার দাভাইকে বশ করে নিয়েছি। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করি নি। আর আমি এসবের ইচ্ছে নিয়েও আসি নি।

মাহি জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
–দাভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড কে? আমার দাভাই তো কোনো রিলেশনে জড়ায়ই নি!

আদিরা থমকালো তারপর বলল,
–সামিরা আপু! সে তো তোমার দাভাইয়ের প্রেমিকা। তুমি জানো না?

মাহি বিদ্রূপাত্মক এক্সপ্রেশন দিয়ে বলে,
–কই জানতাম না তো! তা তুই জানলি কী করে? দাভাই বলেছে বুঝি!

আদিরা কনফিউজড হয়ে বলল,
–সবাই তো তাই জানে। সামিরা আপু ও তোমার দাভাইয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে।

মাহি হুট করে হাসতে শুরু করে। পেটে হাত দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ সে। কড়ুই গাছটার গোড়ার কাছে বসে হাসি থামানোর চেষ্টায় আছে সে। আদিরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। হাসির কারণটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। ভাই-বোন দুইটাকেই কেমন অদ্ভুত লাগে আদিরার কাছে। আদিরা মাহির কাছে গিয়ে কনফিউজড হয়ে বলে,

–হাসছো কেনো?

মাহি হাসতে হাসতেই থেমে থেমে বলে,
–তো হাসবো না! একটা কথা আছে জানো? চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে তা পরীক্ষা না করেই চিলের পেছোনে দৌঁড়ানোটা একটা অভ্যাস হয়ে গেছে মানুষের। মানুষ বিচার বিবেচনা না করেই উঁড়ু কথায় এতোটা গুরুত্ব দেয় যে নিজেদের টাইম ও এনার্জি অযথাই নষ্ট করে। আরে ভাই, নিজের কানে হাত দিয়ে তো দেখবে! তোমার কান আছে নাকি গেছে! কার না কার কান গেছে আর সেটার বার্তা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পরেছে আর তুমিও সেটাই সত্য মানতে শুরু করে দিয়েছো!

আদিরার মুখ লটকে তাকিয়ে আছে। মাহি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–আরে সামিরা আপু দাভাইয়ের উপর ক্রাশড। দাভাই ওকে পছন্দ করে না। সামিরা আপু এতো বাড়াবাড়ি করে কারণ সামিরা আপু আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়। দাভাইয়ের স্কুল লাইফ থেকেই সামিরা আপু যেনো দাভাইয়ের পেছোনে আঠার মতো লেগে আছে কিন্তু দাভাই সামিরা আপুকে ততোটা পাত্তা দিতো না। সামিরা আপুর বিহেভিয়ারে সম্মান শব্দটা নেই দাভাইয়ের ভাষায়। এখন একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে সামিরা আপু নিজেকে দাভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিচ্ছে। দাভাই কিন্তু এক বছর আগে সামিরা আপুর প্রচণ্ড রকম বাড়াবাড়িতে ভরা অডিটোরিয়ামের মধ্যে সামিরা আপুকে চ ড় দিয়েছিল।

চ ড়ের কথা শুনে আদিরার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। মাহি হাসতে হাসতে বলল,
–আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম না তবে আহনাফ বলেছিল, সামিরা আপু নাকি ভার্সিটির সবার কাছে রটাচ্ছিল সে ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আর তারা কয়েকবার ডেটিং করেছে। ভাইয়া প্রচুর রেগে গেছিলো এতো বড়ো মিথ্যা শুনে। টিচাররা পর্যন্ত ভাইয়াকে ডেকে বলেছিল যে পার্সোনাল কথা মানে ডেটিং এসব সবার সামনে ঢোল পি*টিয়ে না বলতে। ভাইয়া টিচারদের কাছে প্রিয় তাই তারা ডেকে বলেছিল। তারপরেই দাভাইয়ের একশন। সেসব পুরোনো কথা। সামিরা আপু সেসব নিয়ে কনসার্ন না তাই সে একই কাজ বারবার করে। সামিরা আপু আব্বুর কাছে দাভাইয়ের নামে নালিশও জানিয়েছিল কিন্তু আব্বু তা পাত্তা দেয় নি। ভাইয়া তো আব্বুর নাগালের বাহিরে!

আদিরা শেষের কথাটা ধরে বলে,
–নাগালের বাহিরে কেনো? তাদের মাঝে কী ঝামেলা হয়েছে?

মাহি হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
–আপিলির মৃ*ত্যুর পরোক্ষ কারণ বাবাকে ভাবে দাভাই। কিন্তু বাবা খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছিল তবে আমার মায়ের তাড়াহুড়োতে খুব কম সময়ের মধ্যে বিয়ে দিয়েছিল। কথায় আছে না? হারানো কিছু খুঁজে পাওয়া গেলেও যা স্বেচ্ছায় হারায় তা পাওয়া যায় না! যদি আপিলির শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজেরা কিছু না লুকাতো তবে বাবা সেখানে আপিলিকে কখনওই বিয়ে দিতো না। এতে বাবার দোষ না তবে বাবার খামখেয়ালিপনা পরোক্ষভাবে দৃশ্যমান হয় ভাইয়ার নজরে।

আদিরা মলিন হেসে বলল,
–তার ভাগ্যে এমনটাই লিখা ছিল। নাহলে তো এরকম হতোই না।

মাহি তাচ্ছিল্য হেসে ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–আমার মা যদি আপিলির বিয়ে নিয়ে এতো তোড়জোড় না করতো তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। আপিলির মাস্টার্সের শখ ছিল অনেক। মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল তো। বাবা তো আপিলির জন্য কানাডাতে মাস্টার্সের এপ্লাইও করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত তাড়াহুড়োতে সেসব আর হয় নি।

আদিরা মাহির হাত ধরে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
–মা তো। মায়েদের চিন্তা থাকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাই হয়তো তিনি বিয়ের কথা বলেছেন।

মাহি আদিরার সরল কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসতে থাকে। আদিরা মাহির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাহি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

–হ্যাঁ। খুব চিন্তা হতো তার। আপিলির মাস্টার্সের খরচ, তারপর বিয়ের সময় খরচ এসবের কারণে তো আমার জন্য ভাণ্ডার কম পরে যেতো আর তার লাক্সারিয়াস লাইফের জন্য কম পরে যেতো। আসলে আমাকে তিনি যতোটা ভালোবাসেন, আপিলি বা দাভাইকে তার বিন্দু পরিমানও ভালোবাসেন না। কী করবে বলো? নিজের সন্তান না তো তারা!

আদিরা এতোবড়ো সত্যটা জেনে হতভম্ব হয়ে যায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here