বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায় #পর্ব_০২,০৩

0
688

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০২,০৩
#সুমাইয়া মনি।
০২

‘ভিক্ষুকের অভিনয় করে দেখাতে হবে। সামিম ক্যান্টিন থেকে একটি বাটি নিয়ে আয়।’ কাঠ কাঠ কন্ঠে কথাটি বলে উঠে আবির।

সামিম আবিরের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যান্টিনের দিকে দৌঁড়ে যায়। আবিরের দিকে তাকিয়ে শুঁকনো গলায় পুনোরায় ঢোক গিলে বিভা। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আছে তার। দূর থেকে কিছু ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। সামিম ফিরে আসে একটি বাটি নিয়ে। আবির হাতে নিয়ে বিভার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,
‘শুরু করো অভিনয়।’
বিভা দৃষ্টি নত রেখে বলল,
‘আমি পারব না।’
‘না বলার পরিনতি কিন্তু ভয়ানক হবে মিস… নাম কি তোমার?’ পাল্টা প্রশ্ন করে আবির।
‘বিভা।’
‘বিভা হও বা টিভা, অভিনয় শুরু করো।’
অসহায় হয়ে আবির সহ ওর বন্ধুদের দিকে একবার তাকায়। সে চাইলেই প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু আপুর কথা ভেবে চুপ আছে।
‘কি হলো…আহ!’ আবিরের পুরো কথা শেষ করার আগেই একজন মহিলা এসে আবিরের কান মলে দেয়। তাকে দেখে ভয়তে সকলে জড়োসড়ো। আইরিন ম্যাম এই কলেজের টিচার এবং আবিরের নিজের মা। তার ছেলের কর্মকাণ্ডে তিনি ভীষণ ক্ষেপে আছে। প্রতিদিনই স্টুডেন্ট রা তার কাছে আবিরের নামে যার্গের বিচার নিয়ে হাজির হবে। আজও এক স্টুডেন্ট তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। তিনি রাগী কণ্ঠে বলে,
‘তোমাকে বহুবার বলা হয়েছে স্টুডেন্টদের যার্গ-টার্গ না দিতে।
কথা শুনছো না। তুমি কলেজের স্টুডেন্ট নও। ভার্সিটির থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তাহলে তুমি কীভাবে কলেজের স্টুডেন্টদের যার্গ দেও? এখন মেয়েদের সঙ্গে মিসবিহেভ করছো। না জানি কখন সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে।’
আবির ভীরু গলায় বলল,
‘আম্মু আমি এমনটা কখনোই করব না…’
‘থামো! এটা কলেজ। আমাকে ম্যাম বলে সম্বোধন করবে আম্মু নয়। তোমার বন্ধুদের নিয়ে যাও এখান থেকে। কোনো ক্লাসরুমে যেন না দেখি তোমাদের। ক্লাসরুম তোমাদের আড্ডা দেওয়ার স্থান নয়। ফারদার যার্গের কাহিনী যেন না শুনি।’

আবির তার বন্ধুদের নিয়ে চলে যায়। বিভা অবাক হয়ে আইরিন ম্যামকে দেখছে। ফর্সা চেহারার সুন্দর গঠনের দেহ তার। চুল গুলো পরিপাটি করে বাঁধা। গায়ে খয়েরী রঙের শাড়ি। দেখতে ভীষণ সুন্দর তিনি। আইরিন ম্যাম বিভার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
‘কলেজে নতুন?’
‘জি ম্যাম।’
‘কোন গ্রুপের?’
‘সায়েন্স।’
‘ওহ! কিছু মনে কোরো না।’
নেতিবাচক মাথা দুলায় বিভা।
‘যাও ক্লাসে।’ বলে তিনি চলে যায়।
বিভা নিজের ক্লাস রুমে আসে। সবাই একবার বিভাকে দেখে। পরক্ষণে নজর সরিয়ে নেয়। বাকি সবার মতো বিভা এতটা স্মার্ট, স্টাইলিশ ছিল না। পরনে ছিল ঢিলাঢালা কালো রঙের থ্রিপিস। মাথার চুল গুলো বেনী করা। শ্যামলা গায়ের রং। অতি সুন্দর না হলেও, নজরে পড়ার মতো।
পিছনের বেঞ্চে এসে বসার পর একটি মেয়ে তার পাশে এসে বসতে বলে। বিভা বসে। মেয়েটি মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি বোধহয় নতুন?’
‘হুম।’
‘আমিও নতুন। দু তিনদিন হয়েছে মাত্র। এখনো কারো সঙ্গে পরিচিত হতে পারিনি। তোমার নাম?’
‘বিভা। তোমার?’
‘মোহনা।’
দু’জনের বাক্যবিনিময়ের মাধ্যমে স্যার আসে। ক্লাস আরম্ভ হয় ওদের। অর্ধেক ক্লাস শেষ হবার পর তারা ক্যান্টিনে আসে। চিকেন রোল নিয়ে আসে মোহনা। নিজেই বিভাকে ট্রিট দিবে। খেতে খেতে গল্প করে। তখন সেখানে আবির তার বন্ধুদের নিয়ে উপস্থিত হয়। অনেকেই ওদের দেখে সিট ছেড়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়। মোহনা আবিরের উপস্থিতি টের পেয়ে বিভাকে নিয়ে চলে যেতে চাইছিল। তবে বিভা খাবার শেষ করে যাওয়ার আর্জি জানায়। খাবার রেখে যাওয়া মানে নষ্ট করা। বিভা সেটা পছন্দ করে না। চুপচাপ বসে খাচ্ছে তারা।

আবির এক চেয়ারে বসে অন্য চেয়ারে পা উঠিয়ে বসেছে। ওর মধ্যে কেমন গুন্ডা গুন্ডা ভাব দেখা যাচ্ছে। জামিলা সেলফি তুলছে। সামিম, মারুফ কোল্ড কফির মজা নিচ্ছে। আবির আলস্য ভঙ্গি ভেঙে সামিমকে বলল,
‘দুইটা কফি নিয়ে আয় সামিম।’
‘কোল্ড, হট দু’টোই?’
‘হ্যাঁ!’
‘এক সঙ্গে দুইটা খাবি নাকি?’ জামিলা কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে।
‘মোটেও না! চেটেচেটে তোদের মুখে ছুঁড়ে মারব।’ বিরক্ত স্বরে বলল আবির।
‘ওয়াক ছিঃ!’ নাক ছিটকায় জামিলা।
‘ঝামেলা কোথাকার।’ বিড়বিড় করে বলে আবির। জামিলা ঠিক শুনেছে কথাটি। বলল,
‘একদম আমাকে ঝামেলা বলবি না আবির।’ আঙুল তুলে বলে জামিলা।
‘ভুল কোথায় বললাম। তুই তো আসলেই একটা ঝামেলা।’
জামিলা রাগে ফুঁসছে। ছোঁ মেরে সামিমের হাত থেকে কফি নিয়ে ছুঁড়ে মারে আবিরের উদ্দেশ্যে। আবির দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে। যার দরুন মোহনার মুখে কফিটি লাগার আগেই বিভা প্লেট দিতে ঢেকে ফেলে মোহনার মুখমণ্ডল। আকস্মিক ঘটনায় তারা বাদে উপস্থিত সকলে বিস্মিত! এমনটা হবে কেউ বুঝে নি। পাশাপাশি সিট ছিল ওদের। দূরত্ব ছিল দু তিন হাত। বিভা ওদের কথপোকথন শুনলেও, মোহনা বকবক করার দরুন কিছু শুনে নি। মোহনা অবাক নজরে বিভাকে দেখছে। যদি কফিটা গায়ে লাগতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। সেটির হাত থেকে বিভা ওঁকে রক্ষা করেছে। বিভা প্লেট রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আবিরদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে,
‘এমন কোনো রাগ বা দুষ্টুমি করবেন না। যার ফলে অন্যদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।’
‘স্যরি।’ জামিলা নিচু স্বরে বলে।
কিন্তু আবির ক্ষেপে উঠে দাঁড়ায়। বিভার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোমার কাছ থেকে জ্ঞান নিতে প্রস্তুত নই।’
‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোটদের কাছ থেকে জ্ঞান নেওয়া উত্তম বলে মনে করি।’
‘নট ইন্টারেস্টেড!’
‘ইচ্ছে! জোর করে চাপিয়ে দওয়া হচ্ছে না।’ বলেই মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আবির বিভার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগী নিশ্বাস ত্যাগ করে।
_____
ববি একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। এখন সে কর্মস্থানে আছে। একটি শার্ট সেলাই করছিল তখন সেখানে মেনেজার আকবর আলির আগমন ঘটে। বয়স অনুমান ৫৫-৫৬ হবে। চুলে ক্লব দেওয়া। পান খেয়ে ঠোঁট লাল টকটকে করে রেখেছে। ববির একটু কাছে ঘেঁষে হাত ধরে বললেন,
‘এই ভাবে করো বেবি।’
‘ববি আমার নাম আঙ্কেল।’ হাত ছাড়িয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল ববি।
‘থুক্কু! মনেই থাকে না। খালি ভুইল্লা যাই।’ লাল টকটকে দাঁত গুলো দিয়ে হেসে বললেন তিনি।
ববি বিরক্ত প্রকাশ করে৷ মুখে কিছু বলে না। ববি এখানে জয়েন্ট হবার পরপরই আকবর আলি কু নজর পড়েছে ওর ওপর। ববির গায়ের রং কালো হলেও দেখতে মন্দ না। কাজ দেখানোর বাহানায় গায়ে হাত দেওয়ার বাহানা খুঁজে আকবর আলি। শুধু ববি নয়। সুযোগ পেলেই এখানে অনেক মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলেন তিনি। বলা যায় এটা তার অভ্যেস। চাকরি যাওয়ার ভয়ে কেউ নালিশ দিতে পারে না। আকবর আলি পুনোরায় হাত ধরতে গেলে ববি হাত সরিয়ে নেয়। এতে সে কিছুটা অপমান বোধ করে। ক্ষোভ নিয়ে তার ডেকে চলে আসে।
ববি কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। মুঠোফোনটি বের করে মায়ের কাছে কল দেয়। জিজ্ঞেস করে বিভা কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরেছে কি-না। বিভার কাছে ফোন নেই। বাসায় আসেনি শুনে কল কেটে দেয়। ববি ভাবে বিভাকে একটি ফোন কিনে দিবে। তাহলে হয়তো একটু হলেও চিন্তামুক্ত থাকতে পারবে।
_______
রাতে….

‘তোর তো প্রাইভেট পড়তে হবে তাই না বিভা?’
‘হ্যাঁ! আপু।’
‘কলেজে এমন কেউ আছে, মানে ভালো শিক্ষক?’
‘আছে আফিন স্যার। তিনি সায়েন্সের স্টুডেন্টদের পড়ায়। মোহনও তার কাছে প্রাইভেট পড়বে বলেছে।’
‘কত কি টাকা নিবে আলাপ করে কাল আমাকে জানাস।’
‘জি আপু।’
‘বলছিলাম কি, প্রাইভেট না পড়লে হয়না। এত টাকা ..’
‘টাকা নিয়ে ভেবো না মা। আমি ওভারটাইম করে নিবো। বিভার প্রাইভেট খুব জরুরী। সায়েন্সের স্টুডেন্ট বলে কথা।’
‘তোর কথা একবার ভাব ববি।’
‘সেই ছোট থেকে সব ভেবে নিয়েছি মা। এখন আর নতুন করে ভাবার নেই কিছু।’
‘আপু তোমার ওভার টাইম করতে হবে না। আমি পড়ব না।’
‘চুপ! কাল গিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলে আসবি। প্রাইভেট পড়বি ব্যস!’
ববির কথার উপর আর কিছু বলল না তারা। দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলেন বিলকিস বানু।
.
কলেজ শেষ করে প্রাইভেটের জন্য কথা বলতে শিক্ষক কক্ষে যায় বিভা, মোহনা। তারা ধীরে ধীরে একে অপরের সঙ্গে অনেকটা ক্লোজ হয়েছে। তুই করে সম্মোধন করে।
ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে মোহনার ফোন বেজে উঠে। বিভাকে ভেতরে যেতে বলে মোহনা বাহিরে থেকে যায়।
মনে কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সে।
উল্টোদিকে মুখ করে চেয়ারে হেলান নিয়ে ফোন টিপতে মগ্ন আবির। তাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না সে। বিভা ওর মুখ দেখনি। তাকেই আফিন স্যার ভেবে নেয়।
দ্বিধাবোধ ফেলে বলে,
‘স্যার আপনার সঙ্গে কথা ছিল?’
আবির মেয়েলী কণ্ঠের স্বর শুনে, না ফিরেই ফোন লক করে উঁচু করে ধরে স্ক্রিকে বিভাকে দেখে বাঁকা হাসে। সে বুঝতে পেরেছে বিভা ওঁকে স্যার মনে করেছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘বলো?’
‘আমি ও মোহনা আপনার কাছে প্রাইভেট পড়তে চাই। বেতন কত নিবেন? বাসায় পড়াবেন নাকি কলেজে বললে ভালো হতো।’
‘প্রথমত, আমি প্রেমের পাঠ পড়াতে জানি। দ্বিতীয়, আমার সঙ্গে প্রেম করলে ফ্রি-তে পড়াবো। তৃতীয়, কলেজ, বাসায়, পার্কে, রেস্টুরেন্টে এক স্থানে প্রেমপাঠ পড়লেই হবে।’

উত্তর শুনে বিভার চোখমুখ ঘুচে আসে। তীব্র রাগের আভা দেখা যাচ্ছে আদলে। তেড়ে এসে আবিরের সামনে দাঁড়ায়। ওঁকে দেখে রাগ যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আবির মুচকি হাসে বিভাকে দেখে। মুখ খুলে কিছু বলতে নিলে আবির পূর্বে বলে উঠে,
‘আরে ভাবী’যে তুমি না-কি।’
‘সাট-আপ! আমার নাম বিভা। আর আপনি এখানে কেন। শিক্ষক কক্ষকেও নিজের আড্ডা স্থান বানিয়ে ফেলেছেন।’
আবির চট করে উঠে দাঁড়ায়। বিভার ধমকে নাকে তীব্র রাগ দেখা যায় তার। কাঠিন্য কন্ঠে বলে,
‘সাহস হয় কি করে আমাকে ধমক দেওয়ার।’
‘আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে প্রেমের পাঠ শিখানোর কথা বলার।’
‘তুমি আমাকে…’
‘এখানে কি হচ্ছে শুনি?’ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বলল আফিন।
‘কিছু না।’ কথাটি বলে জায়গা প্রস্থান করে আবির।
বিভা কিছুটা অবাক হয়। আফিন বিভাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু বলতে চাও তুমি?’
‘জি।’
‘বলো?’
.
.
#চলবে?

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৩
#সুমাইয়া_মনি

‘আম্মু আমার ব্লু রঙের টিশার্ট কোথায়?’ আবির চিল্লিয়ে আইরিন বেগমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল।
রুম থেকে তিনি হাঁকিয়ে বলেন,
‘ময়নার মা’কে বলেছি। ইস্ত্রি করে নিয়ে যাচ্ছে, একটু ওয়েট কর।’
‘ধ্যাত! এখনো ইস্ত্রি করা হয়নি।’ বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াতে লাগলো আবির৷ হঠাৎ-ই আয়নার ভেতরে বিভার এক ঝলক প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। বিভা এক প্রকার দৌঁড়ে তার রুমের সামনে থেকে গিয়েছে এমনটা মনে হচ্ছে আবিরের। উন্মুক্ত গায়ে বাহিরে বের হয়ে কাউকে দেখতে পায় না। মনের ভুল মনে করে আবির। তবে হঠাৎ বিভাকে দেখার কারণ সে আদৌও বুঝতে পারছে না। হতে পারে এটা তার হ্যালোসিনেশন! কিছুক্ষণ বাদে ময়নার মা টিশার্ট দিয়ে গেলে সেটি পড়ে তার ওপর জ্যাকেট পড়ে। বাহিরের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। জানুয়ারি মাস বলে কথা। সিঁড়ি বেয়ে হল রুমে আসে। হল রুমের পাশের একটি গেস্ট রুমে আফিন ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে কিছু স্টুডেন্টদের পড়ায়।
কলেজ ছুটির পর পড়ার টাইম ফিক্সড করেছে। কিছু একটা মনে করে আবির এগিয়ে যায় সেই রুমের দিকে। ভেতরে প্রবেশ করতেই আফিন অঙ্ক বুঝানো থামিয়ে দেয়। বাকিদের নজরও আবিরের উপর পড়ে। আবির বিভাকে দেখতে পায় সেখানে। সে বুঝে যায় একটু আগে সত্যি বিভাকে দেখেছিল। হ্যালোসিনেশন ছিল না। বিভা আবিরকে দেখেও না তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। রাগ হয় আবিরের। এই মেয়েটা কিসের এহ দাম দেখায় বুঝতে পারে না সে।

‘কিছু বলবি আবির?’ আফিন প্রশ্ন করে।
‘নাহ! ভাইয়া।’ বলে আবির বেরিয়ে আসে রুম থেকে।

হল রুমের সোফায় বসে। আপাতত বিভার কথা মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। বন্ধুদের মাধ্যমে খোঁজ লাগিয়ে বিভার সম্পর্কে সব জানতে পারে। বাবা নেই। বড়ো বোন, মা আর বিভা। মধ্যবিত্ত পরিবারের বলা চলে। তবে বিভার ভাব, স্বভাব দেখে তার মোটেও ভালো লাগে না। সে কি শুধু তার সামনেই এমন ভাবের মধ্যে থাকে নাকি সবার সামনেও একই রূপে থাকে দেখায়। এতটুকু ভাবার পর সামিমের ফোন আসে। আবির বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

কলেজ ছুটির পর বিভা, মোহনা সঙ্গে আরো কিছু স্টুডেন্ট রা আফিনের কাছে পড়তে আসে। বাড়ির সামনে এসে বিভা কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে যায়। রাজ প্রাসাদের চেয়ে কম নয় বাড়িটি। আফিন আসার আগে বাড়িটি ঘুরে দেখার জন্য মোহনাকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে যায়। ওপরে পাঁচটি কামরা আছে। ডান পায়ে এডজাস্ট বড়ো বারান্দায়ও রয়েছে। মোহনা বারান্দায় যায় না। সিঁড়ির বগলে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভা একাই যায়। এতবড়ো বারান্দা দেখে বিভা মুগ্ধ হয়। পাশে ছোট ছোট টপে ফুলের গাছও রয়েছে। তখনই আবিরের কণ্ঠের স্বর শুনতে পায়। বাহিরে বের হয়ে পা টিপে আবিরের কামরার দিকে উঁকি দিতেই সরে যায় ওঁকে দেখে। প্রথমে তো ভাবে আবির এখানে কেন? পরক্ষণে আইরিন ম্যামের কণ্ঠ শুনে পায়। এক প্রকার দৌঁড়িয়ে মোহনার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় বিভা। আর তখনই আবির বিভার প্রতিবিম্ব দেখতে পায় আয়নাতে। সেখানের স্টুডেন্টদের কাছে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারে। আবির, আফিন দুই আপন ভাই। আফিন বড়ো, আবির ছোট। বোন নেই তাদের৷ শুনে বিভার মাথায় যেন বাজ পড়ার অবস্থা হয়।

‘আগে যদি জানতাম আবির পাঠা আফিন স্যারের ছোট ভাই, তার কাছে পড়তে আসতাম না। স্যার, আর ম্যাম কতটা ভালো বিনয়ী মানুষ। আর এট পাঠা তো চরম বেয়াদবের হাড্ডি। তাদের মতো যে কেন হলো না।’ মনে মনে কথা গুলো বলে আফিনের দিকে তাকায় বিভা। দুই ভাইয়ের চেহারায় একটুআধটু মিল খুঁজে পায় সে। দেখতে ফর্সা, লম্বাচওড়া। চোখে চশমা পড়ে আফিন। শোভন আচরণে যে কেউ মুগ্ধ হবে। মায়ের মতো সেও একজন টিচার। তাও একই কলেজে।
________
সেলাই মেশিন চালানোর সময় হঠাৎ একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ধরাধরি করে ববি সহ আরো কিছু মেয়েরা তাকে নিয়ে গার্মেন্টসের মেডিক্যালে আসে। সেখানের ডক্টর মেয়েটির পরিবারের সদস্যকে আসতে বলে। ততক্ষণে ববি মেয়েটির কাছে থেকে যায়। এক স্থানে পাশাপাশি কাজ করার সুবাধে অনেক আগেই মেয়েটিকে ববি চিনতো। নাম সাথী। ববির চেয়ে বয়সে ছোট । সাথীর মা আছে, বাবা নেই। মা কিছুক্ষণ বাদে সেখানে হাজির হলে ডক্টর আলাদা ভাবে তাকে চেম্বারে ডাকে। ববিও যায় সাথীর মায়ের সঙ্গে।
ডক্টর সাথীর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আপনার মেয়ের একটি কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে।’
সাথীর মা যেন কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। সে কেঁদে ফেলে। ববির মনও খারাপ হয়ে যায়। তাকে শান্তনা দেয়।
ডক্টর আবার বললেন,
‘আপনি এত টেনশনে করছেন কেন? এটা তো নতুন কিছু নয়। এখানে অনেক বিবাহিত, অবিবাহিত মেয়েদের চিকিৎসা জন্য কোম্পানি থেকে সাহায্য পায়। আপনার মেয়ের অপারেশনের দায়িত্ব পুরো কোম্পানির। আপনাকে এক টাকাও দিতে হবে না।’
সাথীর মায়ের চোখ যেন চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। তিনি হাত জোর করে বললেন,
‘বাঁচাইয়া রাখুক তাগো। আমার মাইয়াডা নতুন জীবন পাইবো।’
‘কার রাতে অপারেশন হবে।’
‘আইচ্ছা।’

কথপোকথন শেষ করে ববি সাথীর মা’কে নিয়ে সাথীর কেবিনে আসে। সাথীর সবে মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সাথীর মা সত্যিটা বলে দেয়। সাথী কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ববি ওঁকে আশ্বাস দেয়। ভয় পেতে নিষেধ করে। সাথীর বয়স সতেরো। এতটুকু বয়সে অপারেশন কথা ভেবে ববি নিজেও আশংকার মধ্যে থাকে।
.
বিভা বই পড়ছে। বিলকিস বানু হাতে কাঁথা সেলাই করছে। সন্ধ্যার দিকে ববি ওভার টাইম সেরে তবেই বাড়িতে ফিরে।
সঙ্গে কিছু কাঁচা তরকারিও কিনে নিয়ে আসে। একটু জিরিয়ে তারপর গোসল করতে যায়। গোসল সেরে তিন মা মেয়ে এক সঙ্গে গল্পগুজব করে। তাদের খুনসুটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সংসারে অভাব-অনটন আছে। যেমন আছে, যেই পরিস্থিতিতে আছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করে বিলকিস বানু।
______
সকালে যথাসময়ে কলেজে আসে বিভা। ক্লাস শুরু হতে আরো পাঁচ মিনিট বাকি। মোহনার সঙ্গে মাঠের একটি গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মোহনা বার বার ফোন দেখার কারণে বিরক্ত হয়ে বিভা ফোনটি কেঁড়ে নেয়। মোহনা ফোনটি নেওয়ার জন্য জোরাজোরি করছে। ফোন নিয়ে টানাটানির এক পর্যায় সামিম এসে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতি বোঝায়। থেমে গিয়ে দু’জনে দৃষ্টি ফেলে তার দিকে । সামিম বিভার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘পাঁচতলা ভবনে এগারো নাম্বার রুমে আবির তোমাকে ডেকেছে।’
কথাটি শুনে বিভার মুখ বেঁকে আসে। বলল,
‘তার যদি আমাকে দরকার হয়, তাকে গিয়ে বলুন পাঁচতলা ভবনের এগারো নাম্বার রুম থেকে যেন আমার কাছে আসে।’
‘মানে তুমি যাবে না?’
‘নাহ!’
‘ভেবে দেখো?’
‘ভাবছি, এখন আপনি আসতে পারেন।’
সামিম অপমান বোধ করে। ফিরে যায় সেখান থেকে।
সময় ফুরিয়ে যায়। ছুটির পর এক সঙ্গে দুই বান্ধবী হেঁটে হেঁটে প্রাইভেটের জন্য যাচ্ছিল। মেইন রাস্তা ছাড়িয়ে আসার পর রিকশা নিয়ে আফিনের বাড়িতে আসে। আজ হল রুমে আবিরকে দেখতে পায় তারা। বিভা, মোহনা ইনগোর করে।
মাথা ঠান্ডা রাখে আবির। সে নিজেও চায় বিভাকে ইগনোর করতে। কিন্তু বিভার আচার-আচরণ, চালচলন দেখে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না তাকে। বিষয়টি এমন হয়, যেন গরম তেলে কেউ ইচ্ছাকৃত পানির ছিটা দিচ্ছে। একে একে আরো স্টুডেন্টরা সেখানে উপস্থিত হয়। আফিনও রীতিমত চলে আসে। পড়ানো আরম্ভ করে সে। হঠাৎ আফিন বাহিরে বেরিয়ে আসে। আবিরকে হল রুমে ফোন টিপতে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল,
‘আবির আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে। তুই ওদের বাকি পড়া গুলো পড়িয়ে দে।’
আবির কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
‘আচ্ছা দিচ্ছি, তুমি যাও।’

আফিন চলে যায়। আবির ঘাড় ডানে-বামে কাত করে উঠে দাঁড়ায়। সেই কক্ষে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর উঠে বসে। সকলে ওঁকে দেখে একটু অবাক হয়। আবির চেয়ার টেনে পা রেখে বলল,
‘ভাইয়া একটা কাজে গিয়েছে। বাকি পড়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে।’

কথাটা শুনে বিষয়টি সকলে স্বাভাবিক ভাবে নিল। কিন্তু বিভা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। চোখমুখ ঘুচে আসে তার। বিভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তাহলে বাকিটা কালই পড়বো।’
‘বোসো চুপচাপ। কোনো কথা হবে না। আমি পড়াবো তোমরা মনোযোগ দিবে।’
বিভা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বসে যায়। আবির বইটি হাতে নিয়ে ঘেটেঘুটে বন্ধ করে পুনোরায় পাশে রেখে দেয়। একটু ঝুঁকে বলল,
‘একটা প্রশ্ন বলছি। উত্তর তোমরা দিবে। শোনো তাহলে। একটি ঘরে একটিমাত্র বিড়াল বসবাস করে। বিড়ালটি এক গ্লাস দুধ টেবিলের ওপর রেখে বাহিরে গিয়েছে আরো কিছু খাবার জোগাড় করতে। খাবার জোগাড় করে সে যখন ফিরে আসে, তখন টেবিলের উপর গ্লাস দেখতে পায়, তবে তার মধ্যে দুধ ছিল না। গ্লাসটি পুরো খালি ছিল। এখন প্রশ্ন হলো বিড়ালের দুধ কে চুরি করে খেয়েছে? ঘরে তো বিড়াল ব্যতীত আর কেউ থাকে না। বলো বিভা?’
সকলে বিভার দিকে তাকায়। মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায় বিভার। একে তো পড়া বাদ দিয়ে ফালতু প্রশ্ন করেছে। তার উপর ওর কাছে উত্তর চাইছে। বিভা দাঁড়িয়ে চটজলদি উত্তর দেয়,
‘আমি জানি না।’
‘আচ্ছা তুমি ইচ্ছে করে ঢেকুর তুলতে পারো নিশ্চয়?’
‘পারি। তো?’
‘একটা ঢেকুর তুলে দেখাও তো।’
‘কেন?’
‘তার মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে।’
‘কীভাবে?’
‘আগে দেখাও না।’
না চাইতেও বিভার ঢেকুর তুলে। আবির চেঁচিয়ে বলে উঠে,
‘এই যে বিড়ালেরর দুধ চোর। চুরি করে দুধ খেয়ে ঢেকুর তুলছে, দেখো সবাই বিড়ালনীকে।’

সকল স্টুডেন্ট বিভার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। মোহনা মুখে হাত রেখে হাসছে। বিভার মুখ হা হয়ে যায়। আবির যে বুদ্ধি খাঁটিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকেই চোর বানাবে সে ভাবে নি। আবির হেসে নিচের ঠোঁট হালকা কামড়ে বাঁ দিকের ভ্রু উঁচু করে বিভার দিকে তাকায়। মানে এটা ছোট প্রতিশোধ ছিল সেটি আঁকার ইঙ্গিতে বুঝায় তাকে। সকলের সামনে হাসির পাত্রী বানিয়ে দিল। বিভা রেগে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রয় আবিরের দিকে। নিজেও প্রতিশোধ নিবে ভেবে নেয়।
.
.
.
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here