রিস্টার্ট,০৩,০৪

0
1132

#রিস্টার্ট,০৩,০৪
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৩

সামাদ রহমান ও আয়শা রহমানের বড় ছেলে নাহিয়ান সামাদ অংশু। তার জন্মের প্রায় পাঁচ বছর পর নাদিয়ার জন্ম আর নাদিয়ার এক বছর দুই মাস পর রাহু। প্রথম দিকে খুব শখ করে বাচ্চাদের ভালো নাম আর ডাক নাম রেখেছিলেন। কিন্তু একদিন কোথায় যেন শুনলেন বাচ্চাদের যদি ভালো নাম ধরে ডাকা হয় তাদের ব্যক্তিত্ব ফুঁটে উঠে। তারা অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় দায়িত্বশীল হয়। সেদিন থেকেই তিনি তাদের ভালো নাম ধরেই ডাকেন। তবে তার স্ত্রী আর অন্যান্য সদস্যরা ডাক নামেই ডাকে। নাদিয়া সবার থেকে ভিন্ন, ও পারলে ওর অরনী নামটা কখনোই রাখে না। অরনী নামটা ওর খুবই চাইল্ডিশ মনে হয়। যেন কোনো স্টুপিড নভেলের নেতিয়ে পড়া নায়িকা। ও স্ট্রং। ওর সাথে শুধু নাদিয়া যায়। না দি য়া। বলতেই দাঁত ভেঙে আসে। কিন্তু নাদিয়া নামের অর্থ নরম, নমনীয় বা দুর্বল। ওর বাবা ওকে স্ট্রং করে তৈরী করেছে যাতে ওকে কখনো কারো কাছে মুখাপেক্ষী না হতে হয়। যে ওকে মজবুত করে গড়ে তুলেছে আজ সেই ওকে ভাঙতে চাইছে। ও ডিভোর্স দিতে চাইছে তা শুনে ওর বাবাই ওর সাথে বেশি খারাপ ব্যবহার করেছে। তাছাড়া ওর মা ভাই ভাবি ও আছে। এই কয়দিনে বহু আপনজনের আসল চেহারা দেখা হয়ে গেছে। সামনে আরো দেখতে হবে।

জাহিদ আর ওর ফুপু এসেছে নাদিয়াদের বাসায়। স্কুল থেকে ফিরে এই দৃশ্য দেখে নাদিয়া স্তব্ধ। ওরা কেন এসেছে? ভেতরে গিয়ে দেখে ওর বড় খালা আর চাচা ও এসেছে। সবাই এখানে বসে এখন একটা আলোচনা করবে কীভাবে ওদের সম্পর্ক টা টিকিয়ে রাখা যায়। নাদিয়ার কাছে বিষয়টা অনেক বিব্রতকর মনে হলো। ওর পার্সোনাল ব্যাপারে সবাই এভাবে কী করে নাক গলাতে পারে। একটু পরেই সালাম ভাই আর মোহনা ভাবি এলেন। ওনারা জাহিদের বড় ভাই আর ভাবি। নাদিয়া ওর ঘরে গিয়ে বসে আছে। ওর শাড়ি বদলাতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু এখন তা সম্ভব না। সবার দিকে রুদ্রমুর্তি হয়ে তাকানোর ইচ্ছেটাও নেই। ইগনোর ও করা যাচ্ছে না। পুরো বাসা ভর্তি লোক। আজ সবাই মিলে ওকে বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বে। ওর ঘরে ওর বড় খালা আর আর ফুপু শাশুড়ি এসেছেন। ওর ফুপু শাশুড়ি ওকে খুবই পছন্দ করেন। ওদের বিয়ের পর ফুপুই ওদের বাসায় থেকে ওদের ঘর গুছিয়ে দিয়েছিল। শাশুড়ির দায়িত্ব টা উনিই পালন করেছেন। নাদিয়া ও ওনাকে পছন্দ করেন। তাই ওনার সাথে চোখ মেলাচ্ছে না। আর ও জানে উনি কষ্ট পেয়েছেন। জাহিদের পরিবারে শুধু উনিই গুরুজন। সবার অভিভাবক উনি। ওনার কষ্ট হওয়ার ই কথা। নাদিয়া ওনাকে সালাম করল।

– ছোট বউ,
– জ্বী ফুপু।
– কেমন আছ?
– ভালো।

নাদিয়া গলা নিচু করে বলল। উনি নাদিয়ার গাল ধরে বললেন,
– মনে তো হচ্ছে না। জাহিদ কী কিছু বলেছে?
নাদিয়ার কান্না পাওয়ার উপক্রম। তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছে। সবাই শুধু একটা কথাই বলে, “জাহিদ কী কিছু বলেছে?” কথা টা শুনলেই ওর কেমন যেন লাগে। কারণ জাহিদ তো কিছু বলেই না।

– না।
– তো সমস্যা কোথায় ?
– সমস্যা অন্য কিছু, আমি বলতে চাই না।
– সমস্যা না বললে সমাধান হবে কী করে?
– এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না।

ঐদিকে ছেলেরা সবাই জাহিদকে বোঝাচ্ছে। জাহিদ মানুষ টা শান্ত একটা মানুষ। বরাবরই ও কম কথা বলে। পরিবারের ছোটরা যেমন হয় ও একদমই তেমন না। নাদিয়ার বাবার ওর জন্য এমনই কাউকে চাইছিলেন। নাদিয়ার জন্য একদম পারফেক্ট। প্রথম সাক্ষাতেই জাহিদ বাবা মেয়ের মন জয় করে নিয়েছিল। বাবা আজ ও তেমনই ভালোবাসে, কিন্তু মেয়ের মন এখনই মরে গেছে।

বসার ঘরে নাদিয়ার ভাইয়েরা বলছে নাদিয়ার জন্য তারা লজ্জিত, আর জাহিদের ভাইয়েরা বলছে জাহিদের জন্য তারা লজ্জিত। আসলে কোনো মানুষকে তার সহোদর ছাড়া আরে কেউই বোধহয় ভালো চেনেনা।

– তোকে আমি কত বলেছি একটা দুইটা হিন্দি সিনেমা দেখ। একটু রোমান্টিক হ। এরকম পানশা হলে কেউ থাকবে না।
– ভাইয়া চুপ করেন।
– তুই একবার ও ভেবেছিস, নাদিয়া যদি চলে যায় আমাদের কী হবে? আমরা তো তোকে সবসময় একা থাকতে দিতে পারি না।

জাহিদ চুপচাপ আছে। নাদিয়ার ভাই অংশু এবার বলে,

– ভাইয়া জাহিদের দোষ দেবেন না। ও ছেলে মানুষ, তার উপর চাপা স্বভাবের। অনেকের দ্বারা এসব হয় না। অরনী তো অ্যাডজাস্ট করতে পারত। বাবা আমাদের ই দোষ, ওকে আমরা কিছুই শিখাইনি।
– আহ! নাহিয়ান, বড়রা কথা বলছে।

জাহিদের বড় ভাই হা করে ভাবছে এই অরনী আবার কে? নাদিয়ার চাচা বললেন,
– ভাইয়া, দোষটা তোমার। এই অরনীকে তুমিই নষ্ট করেছ। তুমি তোমার মেয়ে কে স্ট্রং ইন্ডিপেন্ডেন্ট করতে গিয়ে এই শিক্ষা দিয়েছ। আমি মানছি মেয়েদের স্ট্রং হতে হবে, কিন্তু দেখলে তো। এখন নিজের দুধ কলা দিয়ে পালা নারীবাদের কামড় এবার নিজেই খাও।
– চুপ করো!!! কাজের কাজ কিছু করছ না শুধু একে অন্যকে দোষারোপ!!!
নাদিয়ার বাবার চিৎকার বসার ঘর থেকে নাদিয়ার ঘর পর্যন্ত এলো। ও ওর বাবার অবস্থা টা বুঝতে পারছে, কিন্তু ওর অবস্থাটাও তো বুঝতে হবে। নাদিয়াকে ওনাদের জন্য চা করতে বলা হলো। নাদিয়া চা বানিয়ে নাস্তা সহ বসার ঘরে দিয়ে আসে। সেখানে ওর জাহিদের সাথে আবার দেখা হলো। কী একটা বেচারা চেহারা নিয়ে বসে আছে। সেখানে উপস্থিত সকল পুরুষের দৃষ্টি দেখে নাদিয়া বুঝল বরাবরের মতো ও ই ভিলেন। ও গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। সব মহিলারা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া ও ওদের দিকে তাকালো। ওর কাছে মনে হচ্ছে সবাই যেন কোনো এক গুহায় আটকে ছিল, ও ই প্রথম ওদের বাঁচাতে ঢুকেছে। একমাত্র ও ই পারে ওদের এই বিপদ থেকে বাঁচাতে। সঙ্গে সঙ্গে রাহু এসে বলে,

– অরনী, বাবা তোকে ব্যাগ গোছাতে বলেছে।
– কেন?
– এখনই যেতে হবে তোকে।
– কোথায়?
– কোথায় আবার, তোর বাসা।
– বাবাকে বলে দে আমি যাচ্ছি না।
– বেয়াদপি করবি না একদম! বাবা এমনিতেই তোর জন্য অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
– তবুও আমি যাচ্ছি না।

নাদিয়া এ কথা বলে ভেতরে চলে যাচ্ছিল। তখন ওর মা এসে ওকে আটকে দেয়।
– মা, একটু অ্যাডজাস্ট কর। জাহিদ ভালো ছেলে। একটা চান্স দে। ঝগড়া কাদের মধ্যে হয়না?
– আমাদের কোনো ঝগড়া হয় নি মা।
– তাহলে কী সমস্যা?
– আমাদের মধ্যে অনেক দূরত্ব। এত কাছাকাছির একটা সম্পর্কে এত দূরত্ব থাকলে সম্পর্ক টা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।
– একটা বাচ্চা নিয়ে নে। আবার শুরু কর। দেখবি বাচ্চা আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
– মা!!!
– বাচ্চা আসলে সব দূরত্ব মিটে যায়। আবার শুরু করা যায়।

নাদিয়ার মাথাটা ভন ভন করছে। বাচ্চা! বাচ্চা কোথা থেকে আসবে? এখন ও শুধু ও একা, বাচ্চা আসার পর ও আর বাচ্চা একা। কিন্তু বাচ্চা টা কোথা থেকে আসবে? নাদিয়ার খালা আর ফুপু শাশুড়ি ও শুরু করল “একটা বাচ্চা! একটা বাচ্চা নিয়ে নে! একটা বাচ্চা সব ঠিক করে দেবে!” নাদিয়ার খুব অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। ও ওদের আওয়াজ বন্ধ করে দিতে চাইল। কিন্তু এবার ওর আর জাহিদের ভাবিরাও শুরু করল, ” একটা বাচ্চা নাও! বাচ্চারা আল্লাহ্ এর আশীর্বাদ! বিয়ে টা টিকে যাবে!” নাদিয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ও আর নিতে পারছে না।
” যখন দুজন মানুষের মধ্যে নূন্যতম কথাও হয় না , হাত ও ধরে না তখন বাচ্চা কী করে আসবে! বাচ্চা কী খেলার পুতুল? আমি দোকান থেকে কিনে আনবো বাচ্চা???”

খুব জোরে জোরে চিৎকার করে কথা গুলো বলল নাদিয়া। জাহিদ ও চলে এসেছে। সবাই থ হয়ে তাকিয়ে আছে। কী বলছে ও! রাহু বিব্রত হয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় দেখল জাহিদ ও আছে। নাদিয়া ও জাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহু লজ্জিত হয়ে নাদিয়া কে বলল,

– তুই ভেতরে যা।
– ভেতরে কেন যাব? কথা যখন শুরু হয়েছে আমি বলব! আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এই লোকটার সাথে। সে দিনে একটা কথাও বলে না। রোবট ও ভালো ওনার থেকে। অন্তত পক্ষে কারো কথা মতো কাজ করে! উনি কোনো কথাই বলে না আমার সাথে! আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে, পরে বলিস।
– না! এখনই শোন! তোমরা যে বলছ একটা বাচ্চা নিতে, কী করে বাচ্চা হবে? বিয়ে করলেই বাচ্চা হয়ে যায়? এক ছাঁদের নিচে একই বিছানায় দুজন দুই ধারে। আমার তো অন্য কিছুর দরকার নেই, আমি চাই উনি একটু কথা বলুক অন্তত। আমি এটুকুও জানি না উনি আমাকে ঘৃণা করেন কিনা! আচ্ছা আমি কী ঘৃণা করার মতো মানুষ?
– না তুই অনেক ভালো, এখন ভেতরে যা।
– তুই চুপ রাহু! ফুপু, আমার মনে হয়ে ওর কোনো প্রেমিকা ছিল, আপনারা তার সাথে বিয়ে দেন নি তাই উনি ইচ্ছে করে আমাকে ইগনোর করছেন। কারণ উনি মুক্তি চান। আর আমি কারো বোঝা হতে পারব না। জাহিদ, আপনি যেখানে খুশি যান, যাকে ইচ্ছা বিয়ে করুন।

জাহিদ হালকা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাদিয়ার চোখ লাল হয়ে আছে। ওর কান্না আটকে রাখার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে। যদি সে ক্ষমতা না থাকতো তবে আজ এখানে গঙ্গা যমুনা বয়ে যেত। জাহিদ সে জিনিস টা বুঝতে পারছে। ও বোধহয় জানে ব্যাপার টা। নাদিয়া জাহিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আপনি মুক্তি চান? আমি মুক্তি দিলাম। আমাকেও মুক্তি দিয়ে দিন। তোমরাও আমাদের মুক্তি দিয়ে দাও। আমাদের পক্ষে একসাথে থাকা আর সম্ভব না!
– প্লিজ, আপনি একটু শান্ত হন।

জাহিদ মাথা নিচু করে এই কথাটুকু বলল। জাহিদের কথা শুনে নাদিয়া কেমন শান্ত হয়ে গেল। রাহুর এখন রাগ হচ্ছে। তবে কী এই সাদাসিধা গঙ্গাধর ভেতরে ভেতরে অনেক বড় শয়তান? ওর কী সত্যি সত্যি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে? ও কী কোনো ভাবে অরনী কে ধোঁকা দিচ্ছে। আজ এক ভাইয়ের পরীক্ষা। যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকবে ওর বোনের কাছে।

– এক মিনিট জাহিদ ভাই, আপনার কী কোনো পছন্দ আছে?
– জ্বী?
– আপনার গার্লেফ্রন্ড আছে?
– না।
– ছিল? পছন্দ করতেন? আপনাকে জোর করা হয়েছে?
– না, না , না। (ধীরে ধীরে)

ওর উত্তর শুনে রাহুর কেমন যেন লাগছে। ” না, না, না।” আসলেই কেমন লোক! জাহিদের বড় ভাই সাথে সাথে বলে,
– ওর পছন্দ নেই নাদিয়া। ও অনেক আনরোমান্টিক আমরা জানি। আমরা ওকে অনেক বার বলেছি কাউকে পছন্দ করতে, ওর কেউ পছন্দ ছিল না। তাই তো ফুপু তোমাকে দেখল। ও এমন ছেলে না। ফুপু বলেন।
– হ্যাঁ নাদিয়া, বিশ্বাস কর মা। আমার জাদু এমন না।

নাদিয়া আস্তে আস্তে জাহিদের দিকে তাকায়। ও এখনো নীচের দিকে তাকিয়ে। নাদিয়ার চাচা আর বাবা ও দেখছে এই কাণ্ডকারখানা। নাদিয়া ভাবছে তবে কী কারণে উনি এমন? ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড ও নেই, তবে কীসের জন্য এমন করছে? ততক্ষণে জাহিদ বলল,

– ফুপু, ভাইয়া ভাবি, এখন বাসায় চলুন।
– কিন্তু, (জাহিদের বড় ভাই)
– আমি চাই না আর কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে। থাক, পরে কথা হবে।

জাহিদ বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা কেমন ঘেঁটে গেল না? মিষ্টি ঘোমটা দিয়ে ঘরে চলে গেল। নাদিয়া আর জাহিদের বেডরুমের ব্যাপার এভাবে খোলামেলা আলোচনা। ছি! ছি! আসলেই বিব্রতকর। জাহিদ আর ওর পরিবার চলে যাওয়ার পর নাদিয়া দৌঁড়ে ওর পুরনো বারান্দায় যায়। সেখান থেকে জাহিদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। গাড়িটা চলে যাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখেই ও বারান্দায় বসে পড়ে। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছে এখানে বসে কিছুক্ষণ কাঁদতে। এই বারান্দাটা কেমন যেন ওর আপন। এই বেল গাছ টা ওর বন্ধু। দু ফোঁটা চোখের জল ফেলার স্থান। হঠাৎ করে দেখল পেছনে রাহু দাঁড়িয়ে।
– যেতেই পারতি।
– কী?
– এতই যখন ইচ্ছে ছিল , যেতেই পারতি। তুই আমাকে খুলে বল, তুই কী ওকে কারো সাথে কথা বলতে দেখেছিস? মানে কোনো অন্য নারী? সন্দেহজনক কিছু?

নাদিয়া ঠোঁট কামড়ে বসে আছে। ওর কান্না পাচ্ছে, রাহুর সামনে কাঁদা যাবে না। নরম হওয়া যাবে না।

– কী হলো ? বল।
– ও কারো সাথে কথা বলে না। আসলে ও, কোনো কথাই বলে না। আমি ওর কন্ঠ শোনার জন্য বসে থাকি, ও কিছুই বলে না।
– কী বলিস!
– ওর সাথে কথা বলার জন্যে আমি ওকে রাতের বেলা অনেকদিন খাবার দেইনি। উপোস ছিল, সকাল বেলা ও দেইনি। বাসার সব খাবার দাড়োয়ানকে দিয়ে দিয়েছি। তাও কিছু বলেনি। মুখ থেকে একটা শব্দ ও বের করেনি।
– কিছুই খায় নি!
– একদিন উপোস করে বাইরে থেকে খেয়েছে। তাও কিছু বলেনি।
– আর এই কারণেই ও তোর সাথে কথা বলতে ভয় পায়।

নাদিয়া রুদ্রমুর্তি হয়ে তাকালো। রাহু ভয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। নাদিয়া তারপর ওর ঘরে চলে গেল। ওর খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। ওর একটি বারের জন্য মনে হয়েছিল চলে যাবে। কিন্তু সত্যি এটাই যে, এই সম্পর্কে জাহিদের তরফ থেকে কিছুই নেই। উল্টো আজ ও যা যা বলেছে দুজনের ই অপমান হয়েছে। বাবা শুনেছে, চাচ্চু শুনেছে, ভাইয়েরা শুনেছে। আর মিষ্টি ভাবিও। ওর মান সম্মান ও নিজেই নষ্ট করেছে। তাই কাল সকালে কেউ দেখার আগে বের হতে হবে। সবার থেকে কিছুদিন দূরত্ব রাখলে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হলে হতেও পারে। তবে ওর জীবন আর স্বাভাবিক হবে না। কখনো কারো জন্য নাদিয়া এত দুর্বল হয়নি, জাহিদের জন্যই কেন? আচ্ছা জাহিদ কী ভাবে না ওর কথা? ওর কী মন কাঁদে না?

(চলবে)

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৪

জাহিদ তখন স্ট্যান্ডার্ড সেভেনে পড়ত যখন ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে ‘ও’ লেভেলে ওঠার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ওর সব ভাইদের মধ্যে শুধু জাহিদ ই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। সে খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। তাই জাহিদের বাবা চাইত ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুক। তাহলে পরে বিদেশ যেতে পারবে। খুব কষ্ট করে ওর খরচ জোগাতেন। ওনার অবর্তমানে জাহিদের বড় ভাই পরিবারের হাল ধরেন। তিনি অনেক কষ্ট করে বিসিএস পাস করে সরকারি চাকরি করেন। এভাবেই ছোট দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নেন। জাহিদের সাথে ওর বড় ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য প্রায় চৌদ্দ বছর। পিতৃসম ভাইকে জাহিদ খুবই সম্মান করে। ওর বড় ভাই সবসময় ওকে সন্তানের চোখে দেখেছেন। ও জীবনে সফল হোক তাই তিনি চান। কিন্তু বিগত কয়েক বছর জাহিদ আর তাকে খুব একটা বিরক্ত করেনি। তিনি চিন্তা মুক্তই ছিলেন। আজ ওর ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে, সেই চিন্তা ওনাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখে।

জাহিদের শারীরিক জটিলতার জন্য ওর বউয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো না তাই ভেবে অফিসে তার দিন যায়। তিনি পত্রিকায় নানা বিজ্ঞাপন দেখেন, দেয়ালে দেয়ালে নানা পোস্টার দেখেন। অবশেষে কলিকাতা হার্বালে ফোন দিয়ে পুরুষের শক্তি বর্ধক এক ঔষধ অর্ডার করলেন। এই ঔষধ তাকে কীভাবে দেবে তা ভেবেই তার অস্বস্তি হচ্ছে। সত্যি বলতে সবসময় তো ওকে ছেলেই ভেবেছে, সেরকম ভাইয়ের মতো সম্পর্ক নেই। তিনি তাই তার মেজ ভাই সাহিদ কে কল করে এনে সব বললেন। বড়ই লজ্জার বিষয়। সালাম ভাইয়ার দুটো মেয়ে, সাহিদের তিনটে ছেলেমেয়ে আর তাদেরই ছোট ভাইয়ের বিয়ে কিনা এই তুচ্ছ কারণে ভাঙছে। তাই দুই ভাই মিলে জাহিদের বাসায় গেল। প্রথমে জাহিদ ছিল না। পরে ওকে ফোন করে আনল।

– আপনারা?
– তোর বাসায় আসতে আমাদের দাওয়াত লাগবে?
– না।

ওনারা ঢোকার পর জাহিদ দরজা বন্ধ করে দিল। সালাম ভাই আর সাহিদ ভাই নিজেদের মধ্যে টেপাটেপি করছে কীভাবে তুলবে বিষয় টা।

– কিছু বলবেন?
– না তো। মানে হ্যাঁ। তুই আমাদের আপন ছোট ভাই। তুই আমাদের আপনি করে কেন বলিস? (সালাম ভাই )
– সম্মান করে।

সাহিদ ভাই এবার বললেন,
– সবসময় এত মেপে মেপে বলিস কেন? তোর কথা বলতে কী টাকা কাটে?
– না।
– আরে!!! এই কারণেই তোর বউ যাবে। যতটা বিয়ে করবি ততটা বউ যাবে।

জাহিদ কিছু বলে না। সাহিদ এবার অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

– আমার তো বিশ্বাস ই হয় না তোর বিয়ে হয়েছে! মানে মেয়েটা তোকে অ্যাপ্রোভ কী করে করল? তুই নাদিয়াকে কী বলেছিলি?
– কিছুই না।
– ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা! তোকে কী বলছি? একটু কথা বল। শুধু কথার উত্তর দিস না! আর দিলে কয়েক শব্দে বল। বাড়িয়ে বল। উপমা, তুলনা, উদাহরণ ব্যবহার করবি।

জাহিদ কোনো পাল্টা উত্তর করল না। সালাম ভাই বলল,

– কথা ঠিক। জাহিদ তো তিন নাম্বার বাচ্চা। তারমানে তুই মা বাবা কে ছাগল বললি? অইইই!!!
– আমি কখন বললাম। আমি তো উদাহরণ দিলাম।

দুই ভাই হালকা বিবাদে জড়িয়ে গেল। জাহিদ ওনাদের থামানোর চেষ্টা করছে।
“এই জন্যই আমি যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলি। আপনি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা টা না বলতেন, এই ভুল বোঝাবুঝি হতো না।”

ওর দুই ভাই বিবাদ ছেড়ে আসল কাজে লাগলেন। সাহিদ ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে বললেন,
– নাদিয়া সত্যি অসাধারণ। ও তোর সাথে আটমাস ছিল।
– সাতমাস।
– তোদের বিয়ের আটমাস না?
– প্রায়। তবে উনি দুই সপ্তাহ হলো এখানে থাকেননা।
– আর আসবে ও না।
– জানি।
– আসবে না তাই আনবি না?
– উনি এখানে ভালো থাকবেন না। ওনার যেখানে ভালো লাগে উনি সেখানে থাকুক।

সালাম এবার মন খারাপ করে বললেন,

– মেয়েটা আসতে চায়।
– না।
– চায়।
– উনি না বলেছেন।
– মেয়েরা যা বলে তার উল্টো হয়।
– ওনার কথার একটাই মানে।
– তুই কী ওকে ভালো রাখতে চাস না? ওকে নিয়ে আয়।

জাহিদ কফি বানাতে থাকে। সাহিদ এবার ঐ ঔষধের প্যাকেট নিয়ে জাহিদের কাছে যায়।

– এই যে দেখ।
– কী?
– ভালো রাখার জিনিস।

জাহিদ প্যাকেট টা দেখে। “কলিকাতা হারবাল। পুরুষের শক্তি বর্ধক। এক ফাইলই যথেষ্ট। ” এরপর ও জিনিসটা ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দিল। সাহিদ সেটা আবার তুলে পরিষ্কার করে আনল।

– একটা বার ট্রাই করে দেখ। দেখবি, এবার খুশি ও হবে আর বাচ্চা ও হবে।
– দরকার নেই।
– কী দরকার নেই! খুশি না বাচ্চা? খুশি থাকার পাশাপাশি বাচ্চা ও দরকার। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার তিনটা দেখ কী সুন্দর বাড়ি আলো করে রাখে।
– আপনারা আসল ব্যাপারটা জানেন না। তাই এ ধরণের উল্টো পাল্টা ধারণা না করাই ভালো।
– তো তোর জটিলতা নেই? আমরা তো জানতাম তোর শারীরিক জটিলতা।
– কে বলেছে?

জাহিদ খুবই বিরক্তির সুরে বলল। ওর চেহারা দেখে সালাম বলল,
– ও যে বলল, দূরত্ব। বিছানার দুই ধারে দুজন।
– সেটা অন্য দূরত্ব। এসব কোনো ব্যাপার আসছেই না। আপনারা প্লিজ,

সাহিদ এবার জাহিদের সামনে এসে বলল,

– তুই ভার্জিন?
– কী!!!
– তুই কী ভার্জিন? তুই এখনো কিছুই করিস নি!
– আপনারা কোনো প্রয়োজনীয় কথা না বললে আসতে পারেন। আমি এ ধরণের কথা পছন্দ করি না।
– আমার সন্দেহ হয় তুই কী আমাদেরই ভাই কিনা! ভার্জিন জাহিদ!
– আপনি একটু কম কথা বললে ভালো হয়।

রাতের বেলা মিষ্টি ওর মেয়ে অর্ষা কে ঘুম পাড়াচ্ছে। অংশু আসার পর মিষ্টি বলল,
– তোমার কী সত্যিই মনে হয় জাহিদ অরনী কে পছন্দ করে না।
– আমি জানি না।
– দেখ অরনী কিন্তু এতটা ও সুন্দর না। মানে ফেস কাটিং ভালো, চুলের গোছা, হাইট মোটামুটি। কিন্তু ওর গায়ের রং একটু ময়লা। জাহিদ ভাই কী এজন্য?
– কার গায়ের রং ময়লা? অরনীর?
– না তো কী? ওর গায়ের রং ময়লা তাই আমার মেয়ে টা ওর পিপিমণির গায়ের রং পেয়ে বসে আছে। নইলে আমি তুমি অনেক সাদা।
– দেখো, আমার সামনে বলেছ তাও চলছে, যদি এটা অরনীর সামনে বলো তো ও তোমার নামে বর্ণবাদের কেস করে দেবে। অর্ষার হাতে লিখে দেবে আমার মা বর্ণবাদী।
– যাহ!
– অরনীর রাগ দেখার দুর্ভাগ্য তোমার হয়নি। সাপের লেজে পা দিও না।

মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল,
– এখন বুঝলাম।
– কী বুঝলে ?
– ব্যাপারটা অন্য। তোমার বোন ভাব বাড়াতে বোধহয় জাহিদ ভাইয়ের সামনে রাগ দেখিয়ে বসেছেন। আর তাই সেও কম না। লৌহমানব! অরনী পাথরে গড়া হলেও জাহিদ ভাই লৌহমানব। রাগ দেখাচ্ছেন। খাপে খাপ। মূলত এই কারণে জাহিদ ভাই ও কথা বলছে না তোমার বোনের সাথে।
– তুমি এসব গবেষণা বাদ দাও। অরনীকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। ওকে আমরা বোঝাব। আমরা দেখব ব্যাপার টা।

পরদিন অর্ষা কে স্কুলে দিয়ে আসার সময় মিষ্টি একটা খেলনার দোকানে ঢুকে। সেখান থেকে কী হাবিজাবির কিনে বাড়ি ফিরল। নাদিয়া বাসায় ফিরতেই ওর এক্সট্রা খাতির যত্ন করতে লাগল। ব্যাপারটা অনেক অদ্ভুত। মিষ্টির এমন রং নাদিয়া আগেও দেখেছে। মিষ্টির বিয়ের পর মিষ্টির নিজের ঘর থেকে নাদিয়ার ঘর পছন্দ হয়েছিল। তাই ও তখন বলেছিল নাদিয়ার ঘর টা ওর চাই। বড় ঘর, বড় বারান্দা, আলো বাতাসপূর্ণ। সামনে একটা গাছ ও আছে। পিওর অক্সিজেন। তারপর বাথরুম টা তো সেই। বাথটাব, শাওয়ার চেম্বার। মিষ্টি এসব শুধু টিভি সিরিয়ালেই দেখেছিল। তাই বলে ওর টা একদম যে বাজে ছিল তা নয়। ওর ও একই সুবিধা, তবে পেছনের দিকে। শুধু তাই নয়, নাদিয়ার ড্রেসিংরুম ওর ড্রেসিংরুম থেকে পুরো বিশ সেন্টিমিটার বড়। আর ওর বাথরুমে তখন বাথটাব ও ছিল না। যদিও সেটা পরে হয়েছে। তাই তখন নাদিয়ার খুব খাতির যত্ন করছিল, ও যদি এই দিকটা ওকে ছেড়ে দেয়। তখনও নাদিয়া দেয়নি। বিদেশে যাওয়ার সময় ও এমন করেছিল। নাদিয়া চরম হুমকি দিয়ে গিয়েছিল, তাই ওর ঘরটা সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু ওর বিয়ের পর সেটা রাহুকে দিয়ে দেয়। তবে মিষ্টি এখন এমন কেন করছে? ঘরটা তো রাহুর। খুব সম্ভবত ওর বাজে ব্যবহার করার কথা। কারণ বাজে ব্যবহার করলেই নাদিয়া রেগে যাবে, আর এরপর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

মিষ্টি কিছুক্ষণ পর ওর কাছে সেই জিনিসগুলো আনলো। একে একে সব বের করছে। নাদিয়া সব কিছু দেখছে। নাদিয়ার মা ও এলো।

” শোনো অরনী, এগুলো হচ্ছে স্ট্রেস বল। এগুলো চাপলে স্ট্রেস কমে। যখনই তোমার রাগ উঠে কিছু না কিছু ভাঙতে ইচ্ছে করে, ঠিক? তাই তুমি রাগ উঠলে এগুলোর উপর ঝাড়বে। এই দেখ।”
মিষ্টি বল গুলো চাপতে শুরু করল। নাদিয়ার খুব হাসি পাচ্ছে। মিষ্টি এমন কেন করছে? নাদিয়ার মা মাথায় হাত দিয়ে সেখান থেকে চলে যাচ্ছেন। কারণ একটু পর এখানে কিছু হলে তিনি দায়ী নন।

– কিন্তু এগুলো কেন ভাবি?
– রাগ কমানোর জন্য।
– আসল কারণ টা জানতে চাই।
– আসল কারণ টা রাগ।
– আরেকটা কারণ।
– বলব? রাগবে না তো?
– আগে শুনি?
– আমার কেন যেন মনে হয় জাহিদ তোমার সাথে তোমার রাগের জন্য কথা বলে না। তুমি যে বদমেজাজি।

নাদিয়ার চেহারা পাল্টে গেল। এরপর ও একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল,

– আমি, ওর সাথে, কখনো রাগারাগি করিনি।
– তো ও তোমার সাথে কথা বলে না কেন? আমার তো মনে হয় ও তোমাকে ভয় পায়।
– তুমিও তো আমাকে ভয় পাও। কখনো কী কথা বলা ছেড়ে দিয়েছ? ওর সাথে রাগ করা, শোনো, কেউ একটা কথা বলবে তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ রাগ দেখাবে। এই যে তুমি, এত বিরক্তিকর ফালতু কাজ করো সারাদিন। এগুলো আমার ভালো লাগে না। তাই আমি রাগ করি। কিন্তু তবুও তুমি চুপ করো না।
– তুমি আমাকে এই কথা গুলো বলতে পারলে?
– পারলাম। কারণ তোমরা আমার অবস্থান জান না। আর না জেনেই এই সব উদ্ভট জিনিস দিচ্ছ।

নাদিয়া এরপর সেখান থেকে উঠে চলে আসল। কিছু দূর আসার পর আবার গেল। গিয়ে একটা স্ট্রেস বল নিল।
” ধন্যবাদ। বল গুলো সত্যি মজার। আর মনে কষ্ট নিয়ে থাকলে স্যরি। পরের বার থেকে শুধু আমাকেই না, না জেনে কাউকে এ ধরণের জিনিস দেবে না। দিলেও নিজের ধারণা অনুযায়ী কথা বলবে না। কারণ তুমি তার জায়গায় নেই।”

এখন তো মিষ্টির ই রাগ হচ্ছে। তাই ও নিজেও একটা স্ট্রেস বল নিল। আর আজ সন্ধ্যায় ছাঁদে বাবা মা আর ছেলেরা নাদিয়ার ব্যাপারে কথা বলছে। ওনাদের যা মনে হলো নাদিয়া আর জাহিদের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ। দুজনের মধ্যে কেউই খারাপ না। একটু কথা বলে নিলে নিজেরাই সামলে নিবে। ওদের বিয়ে এভাবে ভেঙে গেলে পরিবারের বদনাম হবে। তাই তারা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিল। কাল সকালে,

” তুমি আজ এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।”

বাবার মুখে এমন কথা শুনে নাদিয়া আশ্চর্য হয়নি। তাই ও বলল, ” চিন্তা করবেন না, কিছুদিন সময় দিলেই চলে যাব।”

সবার মুখে আশার হাসি ফুটল। ও তবে বাড়ি ফিরে যাবে। নিজের সংসারে। মাথা তবে ঠান্ডা হয়েই গেছে।

” নিজের বাসায়, জাহিদের বাসা না। আমি চাকরি করি। আমি একটা বাসা নিয়ে চলে যাব।”

রাহু আর অংশু তাকিয়ে আছে। এটা তো আউট অফ সিলেবাস। মানে ও সত্যি সত্যি এখন এমনই করবে। একবার যদি এমনটা হয় তবে ডিভোর্স টা আটকানো যাবেই না। নাদিয়া নাস্তার টেবিল থেকে চলে গেল। অংশু টেবিলে ঘুষি মেরে বলল,

” বাবা, ওকে সময় দেওয়া যাবে না।”

ওদের বাবাও এবার ভাবছে। বিকেলে নাদিয়া বাড়ি ফেরার পর অংশু ওর লাগেজ গুলো ফেলে দিল।

– গেট আউট!
– এটা আমার ও বাসা!!!
– চিৎকার করবি না! আওয়াজ নিচে! এটা আমাদের প্রাইভেট প্রপার্টি।
– তোমার যতটুকু, আমার ও ততটুকু! আর আমরা কেউই এখনো মালিক না। সো সরে যাও!
– ওকে। তাহলে মালিক থেকে শোন।

নাদিয়ার বাবা এসে বলল,
– আমার বাড়ি, আমি ডিসাইড করব কে থাকবে।
– বাড়িটা মায়ের নামেও। মা, তুমি বলো।

নাদিয়ার মা বলল,

– বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি মেয়েদের আসল বাড়ি। বাবার বাড়িতে তারা গেস্ট।
– দেন গেস্ট।
– যথেষ্ট থেকেছ।
– কে বলল? মা, আমার বিয়ের আটমাস। মানে নরমাল বিয়ে হলে আমি এতদিনে প্রেগনেন্ট থাকতাম। তখন তো এমনিতেও থাকতে হতো। সেই হিসেবে আমার কোটা এখনো বাকি।

নাদিয়া একপেশে একটা হাসি দিল। যুক্তিতর্কে ওর সাথে পারা কঠিন। তবুও মা তো মা।

– দেন প্রেগনেন্ট হয়ে এসো, এরপর যত ইচ্ছে তত থেকো।
– মা!!!

সত্যি ওর এখন পুরো বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। শেষ পর্যন্ত মা ও। কেউ সাপোর্ট করবে না। রাহু? রাহুও হাসপাতালে। থাকলেও ঐ পক্ষে থাকতো। এত ডেসপারেট হওয়ার কী আছে? ঘরের চেয়ে পর ভালো। ওর কী অভাব আছে নাকি। ও লাগেজ উঠিয়ে চলে গেল। ওর মা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি এসে ধরল ওনাকে। অনেক সাহস লাগে এমন একটা কাজ করতে। উনি মিষ্টির হাত ধরে ভেতরে গিয়ে বসলেন। রাহুর কাছে ও খবর চলে গেছে এতক্ষণে। ও ভাবছে, এটা কী সত্যি অন্যায় হলো না? কিন্তু সপ্তর্ষি সেদিন দেখা করে বলেছে ওর বাবা বিয়েটা ভেঙে দিতে চায়। উনি কার কাছে যেন শুনেছেন রাহিয়ানের বোনের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। ডিভোর্সি ননদ থাকলে তিনি তার মেয়ে কে দেবেন না। এখন ও তো এসব মিথ্যে বলে সামলে নিয়েছে। সত্যি যদি জানে তবে বিয়ে টা আর হচ্ছে না।

নাদিয়া দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিল। এরপর আফরা কে একটা কল করল।

– কী ব্যাপার? মাত্রই তো গেলি বাসায়।
– হুম। বের করে দিয়েছে।
– কী!
– হ্যাঁ।
– এখন কোথায়?
– রাস্তায়।
– কী করবি?
– তোর বাসায় আসব। কিছুদিন থাকতে দে। সাব্বির ভাইয়া কে বল ওনার আপত্তি আছে কিনা। কয়েকটা দিন, এরপর আমি নিজেই বাসা নিব।
– কিন্তু,
– কিন্তু কী?
– আমার শাশুড়ি আসবে রে।
– কবে? সে আসার আগেই আমি চলে যাব।
– এখনই আছে।
– আজকে বলিস নি তো?
– একটু আগেই আসলো।
– বাহ! সম্পর্ক ভালো হয়ে গেছে তবে।
– হ্যাঁ। ঐ নানি শাশুড়ি মারা গেলেন না, এরপরই নরম হয়ে গেছে।
– মা বলে কথা।
– হ্যাঁ। মেয়ের মন।
– ওকে। ওকে।
– তুই রাগ করিস না। অন্য কোথাও যা।
– ঠিক আছে।
– কোথায় যাবি?
– তোর শ্বশুর বাড়ি। তোর শাশুড়ি তো তোর বাসায়। ওটা তো খালি থাকবে।
– যা বলিস না। হাহাহা!!!

নাদিয়া আর ওর বোকার মতো হাসি শোনার অপেক্ষা করল না। ফোনটা কেটে দিল। এই আফরা ভার্সিটি লাস্ট ইয়ারে পালিয়েছিল। ওর শ্বশুর শাশুড়ি মা বাবা কেউ মানেনি। থাকার জায়গাও ছিল না। রাতারাতি কোনো নব বিবাহিত যুগল কে কেউ ভাড়া দেয় না। তখন নাদিয়া ওর বড় খালা কে বলে তাদের একটা বাড়ির চিলেকোঠা ভাড়া করে দিয়েছিল। আজ সেই আফরা ওর খালার আরেক আলিশান ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। আর ও এখন আফরার সাহস দেখে অবাক হয়। মিথ্যা কথা বলার সময় গলাও কাঁপে না। ওর নানি শাশুড়ি যে মরেছিল সে ওর শাশুড়ির খালা ছিল। মা না। আফরা নিজেই বলেছিল। আর সেইখানে আফরা আর সাব্বির গিয়েছিল আর বাজে ভাবে অপমানিত হয়েও এসেছে। সেই অপমানে নাদিয়ার কাঁধেই জল ফেলেছে। ঐ কাহিনীর পর ওর শাশুড়ি তো অবশ্যই ওর সামনে বসে নেই। আফরার সামনে বসে চা খাচ্ছে নাদিয়ার বড় খালা। চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ পিরিচে রাখতেই তিনি বললেন,

– আমি ঠিক ছিলাম, ও তোমার কাছেই আসবে।
– আর তো কেউ নেই ওর ভরসা করার মতো।
– এই মেয়ে আমি গেলে ওকে একটা কল ও করবে না। যদি ওর ভালো চাও স্বার্থপরের মতো আচরণ করো।
– জ্বী খালামণি। ওর জন্য আজ আমি আর সাব্বির সংসার করতে পারছি। ওর সংসার আমি ভাঙতে দেব না।
– আর শোনো, ওর আর জাহিদের মধ্যকার সমস্যা গুলো ওর কাছ থেকে জেনে আমাকে বলবে, বাড়ি ভাড়া দুই হাজার কম রাখব।
– ছিছি খালামণি! আমি এরকম না। আমার বান্ধবীর সংসার আমিও ভালো রাখতে চাই।
– মন খারাপ করেছ?
– না খালামণি। আপনারা তো আপন লোক।
– এখন বলো আর কার কার কাছে যেতে পারে ও।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে নাদিয়ার রাস্তায় বসে। হোটেল গুলো ওর ভালো লাগছে না। মানুষ গুলো ও কেমন। বাড়ির দিকে ও আর যাবে না। মিনা, সূচি ওরা কেউ ফোন ধরছে না। এরমধ্যে হুট করে বৃষ্টি ও শুরু হলো। এখন কে ওকে সাহায্য করবে? আচ্ছা,

– হ্যালো জাহিদ।
– জ্বী।
– আমি কী আজ রাত আপনার বাসায় থাকতে পারি?

জাহিদ সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
– জিজ্ঞেস করার কী আছে? পারেন।
– ধন্যবাদ। আপনি কী আসতে পারবেন?
– কেন?
– বাড়িটা খুলে দিতে?
– আপনার কাছে তো চাবি ছিল।
– চাবি টা ফেলে দিয়েছি। ভেবেছিলাম তো আর আসব না।
– এখনই আসছি।
– একটু জলদি আসুন না। বৃষ্টি হচ্ছে। আমি রাস্তায়।
– আপনি রাস্তায় কেন? আপনি বললে আমিই আপনার বাসায় আসতাম।
– আমি বের হয়ে গেছি বাসা থেকে। যত তাড়াতাড়ি আসা যায় আর কি।
– জ্বী। আপনি বাসার কাছে আসুন। আমি বাসায় ই আসছি।

জাহিদ চাবি নিয়ে জলদি জলদি বের হলো। বাসার কাছে এসে নাদিয়া কে একটা কল করল। ও পাশের একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। একদম ভিজে গেছে। জাহিদ গাড়ি থেকে একটা ছাতা নিয়ে নাদিয়ার কাছে যাচ্ছে।পাশে চায়ের দোকান। বৃষ্টি পড়ছে। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। ভিজে ভিজে চা খাওয়াতে হয়তো অনেক রোমাঞ্চ আছে। পাশে রেডিও চলছে।

” আজ ঢাকা শহরটা ভিজে গেছে। অনেক অপেক্ষার ছিল এই বৃষ্টি। এই বৃষ্টি হয়তো কোথাও কোনো প্রেমিকাকে কাঁদাবে। অনেকদিন পর হয়তো তারও আজ বাইরে বেরোনোর কথা। বৃষ্টি আসায় তা ভেস্তে গেল। আবার কোনো স্বামী হয়তো স্ত্রীর কাছে আবদার করছে গরম চা আর পাকোড়ার। কিন্তু স্ত্রী তো ক্লান্ত, মানা করবে কীভাবে জানেনা, যদি তিনি রাগ করেন? তবে কোথাও কোনো সাহসী প্রেমিক যুগল আজ ভিজতেই বের হয়েছে। আর কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে মানা না করে একসাথেই হয়তো পাকোড়া বানাচ্ছে। আর সেই ধারায় তারা আরো কাছাকাছি চলে আসছে। বৃষ্টি কখনো কোনো আপনজনকে দূরে সরায় না। বৃষ্টি সবসময় সবাইকে কাছে নিয়ে আসে। যদি কেও আজ অভিমান করে প্রিয় মানুষটা থেকে দূরে থাকছেন, কাছে চলে আসুন। হয়তো ঢাকার রাস্তার জমা বৃষ্টির পানির মতো রাগ জমে আছে, কিন্তু সেই পানিও বৃষ্টি থামলেই নেমে যাবে। আপনার রাগটাও নেমে যাবে। আচ্ছা, তাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন? সেই তো আসল মানুষ। এখন একটা সুন্দর গান শুনিয়ে আমি আরজে ঐশী বিদায় নিচ্ছি। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। কাল আবার আসব , ইনশাআল্লাহ। ততক্ষণ পর্যন্ত থাকুন প্রিয় মানুষটার সাথে। ”

জাহিদ গিয়ে নাদিয়াকে ছাতা ধরল।

“যাবি কোথায় ছেড়ে বল
চারিদিকে তোর অথৈ জল
ভয় হয়, ও.. ভয় হয়।

ভেসে থাকা যাদের নয়
তাদের ডুবেই যেতে হয়
ভয় হয়, ও.. ভয় হয়।

যাবি যদি যাস রে তুই
আর কটা দিন পর
প্রেম বাদে তো এই পৃথিবীর
সবই নশ্বর..”

– আপনি ভেতরে গিয়ে বসতে পারতেন।
– কী বলতাম , ওরা যখন জিজ্ঞেস করত উপরে যান। তারপর কী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম?
– তাই করতেন, অন্তত ভিজতেন না।

ওরা দুজনেই একসাথে বাড়ি ফিরল। অনেকদিন পর নাদিয়া জাহিদের বাসায়। জাহিদ ওর জন্য তোয়ালের ব্যবস্থা করল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here