রিস্টার্ট,০৮,০৯

0
909

#রিস্টার্ট,০৮,০৯
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৮

প্রতিদিনের মতো স্কুলে লাঞ্চের পর গল্প করছে নাদিয়া ও তার সহকর্মীরা। আফরা আজ কেক এনেছে।

– এটা সাব্বির এনেছে। উউউউউ! চকলেট! ডার্ক চকলেট অন কেক। একটা বাইট নিয়ে দেখ। মুখের ভেতর যেন আনন্দের বোমা ফুটছে! উমমমমমম!
– কালকে না বললি তোর ডায়েট চলছে।
– আগামী কাল থেকে আবার শুরু করবো। সাব্বির বলল, আমি নাকি শুকিয়ে যাচ্ছি। ওর ভালো লাগছে না আমি ঘাস লতা পাতা খাচ্ছি। তাই কেক আনলো। খেয়ে দেখ। মনে আনন্দ চলে আসবে।
– আমি কেক পছন্দ করি না। জানিস না?
– যাহ! ঢং!

অন্য কলিগেরা আফরার কেক দেখে সাবাড় করে দিল। আফরার মন খারাপ হয়ে গেল। এত কিছুর মাঝে সুলোচনা ম্যাডাম বললেন,
– নাদিয়া, ইজ এভ্রিথিং অলরাইট নাও?
– ইয়াপ!
– তোমার বরের কী খবর? স্যরি বলে এখন?
– হুম।

ফাহিমা ম্যাডাম আড়চোখে চেয়ে বললেন,

– এখনো কিছু চলছে।
– আপনি তো অনেক কিছু জানেন। বলুন দেখি, কী চলছে?
– তোমার মুখে একটা স্যাডনেস আছে।
– কীসের?
– সেটা তুমিই ভালো জানো। ইউ ক্যান শেয়ার। আমরা আইডিয়া দিতে পারি।
– আপাতত অন্য একজন থেকে আইডিয়া নিচ্ছি। আপনাদের দরকার হলে পরে জানাবো।

আফরা এতক্ষণ দোয়া দরূদ পড়ছিল। কারণ নাদিয়া যদি একবার রেগে যেত, তবে শেষ। বাড়ি ফেরার সময় নাদিয়ার হঠাৎ বেকারিতে চোখ গেল। আজ যেহেতু চেনা জানা কথা হবে তো কেক খেতে খেতেই কথা বলা যাবে। জাহিদ কে ও একবার কেক খেতে দেখেছিল। ওর বোধহয় পছন্দ। কেক কিনে বাড়ি আসার পর মনে হলো ও কী করছে! ওর চুল গুলো সব সামনে, টেবিলে কেক রাখা। ও এসব কেন করছে? ও এত ডেসপারেট কেন? ও জাহিদ কে এত দাম দেয় কেন? কেক! ও জীবনে শুধু আফরার জন্য কেক কিনেছে, তাও আফরা বলত তাই। রাহু বা অংশু ভাইয়া কেও কখনো এত দাম দেয় নি। অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। এই কারণেই জাহিদ বেশি ভাব দেখায়। নিজেকে এখন আফরার বর সাব্বিরের মতো লাগে।

বাইরের পোষাক বদলে ও যখন একটা কুর্তি পরছিল তখন ও সবচেয়ে সুন্দর নীল কুর্তি টা পরলো। আজ তো প্রথম কথা হওয়ার কথা। রেডিও শুনতে শুনতে তৈরী হচ্ছিল নাদিয়া। রেডিও তে বাঁজছে, ” এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার। ” নাদিয়া গুনগুন করছে। আজকে আরজে ঐশী পুরনো দিনের গান বাজাচ্ছে। পুরোটা শুনতে পারবে না হয়তো। যদি জাহিদ তাড়াতাড়ি আসে? ঐ যে, জাহিদের আগমন। আজকেও তাড়াতাড়ি! বাহ!

– আপনার সমস্যা না থাকলে কী আমরা এখন কথা বলতে বসতে পারি?
– এখন! একটু ফ্রেশ হয়ে আসি?
– অবশ্যই। এখন মানে এখনই তা নয়। আপনি আসুন, আমি নাস্তা দিচ্ছি। এরপর। মানে তাড়া নেই। আস্তে ধীরে আসুন।

জাহিদ অবাক হচ্ছে। অরনী সম্পর্কে ও যা যা জানত তা সব ঠিক। এত বছর পরে ও সব একই। ও সবসময় ওর স্পেশাল দিনে নীল রংটাই পরে। আজও তাই। অরনী খুব সিরিয়াস মেয়ে। ও সব কিছুতেই সর্বোচ্চ এফোর্ট দেয়। জাহিদ ওর পোষাক বদলে ট্রাউজার আর টিশার্টে নাদিয়ার সামনে। জিনিসটা একদম যাচ্ছে না। নাদিয়া ফিটফাট, জাহিদ সদরঘাট। মানে ঘরের পোষাক। মেয়েরা একটু বেশি করে এটাই তার প্রমাণ। নাদিয়ার খারাপ লাগছে কারণ মনে হচ্ছে ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। যেন কোনো আত্মমর্যাদা নেই ওর। তবুও মুখে হাসি নিয়ে জাহিদকে কেক আর কফি এগিয়ে দিলো। জাহিদ কেক দেখে ভাবছে, ‘কেক! আজকে কী ওনার জন্মদিন? কাল পিপি সাহেব বলল আর উনি হাসলেন। এটাই কারণ ছিল?’ এখন কী বলবে?

– খেয়ে দেখুন।
– জ্বী। আসলে,
– কী?
– স্যরি।

নাদিয়ার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। ‘তো উনি এখন কেক ও খায় না। সেদিন তো খাচ্ছিল। আজকে আমি আনলাম তাই?’ নাদিয়া মুখে হাসি নিয়ে বলল,

– সমস্যা নেই।
– আমি আসলে জানতাম না।
– না, না। আমি জানতাম না। আমার ভুল হয়েছে।
– আমরা দুজনেই জানতাম। কাল পিপি স্যার বললেন ও।
– পিপি কখন বলল?
– আপনি হাসলেন না? আমি আপনার জন্মদিন জানি না?

নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাসতে লাগলো। জাহিদ বুঝতে পারছে না হচ্ছে টা কী। তাও বলল,

– উইশিং ইউ আ বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে। আই মিন বার্থডে কী এখনো চলছে?
– জাহিদ! আমার বার্থডে আসতে এখনো দেরি আছে। আর এটা আমার বার্থডে কেক না।
– তো?
– এমনি কিনলাম। ভাবলাম আপনি খাবেন। মানে সন্ধ্যা বেলা গল্প করতে করতে।
– ও!

কী বোকা জাহিদ! লজ্জা লাগছে। একটু কেক মুখে দিয়ে হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল। চকলেট! ডার্ক চকলেট! মুখের ভেতর যেন আনন্দের বোমা ফুটছে! উমমমমম! খুবই অকওয়ার্ড লাগছে। আনন্দে মুখ থেকে আওয়াজ না বেরিয়ে যায়। তাহলে আরো লজ্জা পাবে।
– তো আপনার চকলেট কেক পছন্দ?
– হুম! না! না! একদম না।
– ওওও!

নাদিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। পছন্দ না। তাই জোর করে খাচ্ছে। মুখে হাত দিয়ে রেখেছে যাতে ও বুঝতে না পারে ওর খারাপ লাগছে।

– বেশি খারাপ লাগলে খাওয়ার দরকার নেই।
– না না। আমার পছন্দ চকলেট কেক।

জাহিদ ভাবছে পছন্দ না বলে ফেলল কেন? এখন তো সত্যি বললেও বিশ্বাস করবে না। গাঁধা জাহিদ! নাদিয়া মনে মনে বলল, “মিথ্যেবাদী।” মুডটাই নষ্ট করে দিল। তাও কথা তো বলতে হবে।

– আপনার বার্থডে কবে জাহিদ ?
– আমার বার্থডে?
জাহিদ কেক মুখেই বলছিল কথা টা। এরপর মুখে আবার হাত দিয়ে শেষ করে বলল,

– চলে গেছে।
– কবে ছিল?
– গত মাসের চার তারিখ।
– মানে?

নাদিয়া হিসাব করে দেখল। ড্যাম ইট! ও যেদিন ওকে উপোস রেখেছিল সে রাত ই। মানে জন্মদিনের রাত ও না খেয়ে ছিল।

– আ’ম রিয়েলি স্যরি জাহিদ! আমি জানতাম না। জানলে এমন কাজ করতাম না!
– কী কাজ?
– আপনি সেদিন না খেয়ে ছিলেন।
– ও! সমস্যা নেই। আমার অভ্যাস আছে। আপনি কেক খাচ্ছেন না কেন?
– আসলে, আমি কেক পছন্দ করি না। মিষ্টি জিনিস ভালো লাগে না।
– ও আচ্ছা।

নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

– তো পরিচিতি পর্ব।
– কেমন?
– শুরু থেকে।

জাহিদ কেকটার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর আরেকটা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। থাক। ফ্রিজেই থাকবে। উনি তো কেক খান না। পরে খাওয়া যাবে।

– আমি ভলান্টিয়ার করছি। হাই! আমি নাদিয়া সামাদ। একজন স্কুল শিক্ষক।
– আমি জাহিদ আহমেদ। জেনারেল ম্যানেজার, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল।
– আপনি কোথায় থাকেন?
– হুম?

নাদিয়া নিজেই হাসতে থাকে। কোথায় থাকে প্রশ্ন টা একটু বেশি বেশি করে ফেলেছে। এইটা তো জানে।

– স্যরি স্যরি। আপনার দেশের বাড়ি কোথায়? (হাসতে হাসতে)
– আমার দেশের বাড়ি কুমিল্লা।
– ও!

নাদিয়া চুপ করে থাকে। খুবই অকওয়ার্ড একটা অবস্থা। জাহিদ ইতস্তত করে বলল,
– আপনাদের?
– চাঁদপুর।
– ওকে।

জাহিদ মাথা নাড়তে নাড়তে ভাবলো একদম ঠিক যা শুনেছিল। অরনী চন্দ্রবিন্দু টা খুব সুন্দর করে উচ্চারণ করে। “চাঁদপুর, পাঁচ, কাঁচামরিচ। ” আগেও খেয়াল করেছিল।

– উহুম উহুম! এরপর? পরিবার পরিচিত।
– ওকে।
– আমি? ওকে আমি ভলান্টিয়ার করছি। আমার পরিবারে মা বাবা, দুই ভাই, একটা ভাবি আর ভাতিজি। একটা ভাই আমার বড়, অংশু। একটা ভাই ছোট, রাহু। ভাবির নাম মিষ্টি আর ভাতিজি অর্ষা। আপনার?
– মা বাবা নেই। আমরা মোট তিনভাই। আমি ছোট। ভাইদের নাম সালাম আর সাহিদ। বড় ভাবি মোহনা আর ছোট ভাবি সানিয়া।
– বাচ্চারা?
– ও। বড় ভাইয়ের দুই মেয়ে , ছোট ভাইয়ের একটা মেয়ে দুইটা ছেলে। যমজ।
– ওদের নাম কী জানতে পারি?
– ওদের নাম?

জাহিদ চিন্তা করে ওদের নাম কী যেন? বিধি না, বিথী?

– কী হলো?
– বলছি, বড় ভাইয়ার মেয়ে বিথী আর বিন্তি। ছোট ভাইয়ার মেয়ে রি, হৃদি।
– আর ছেলেরা?
– ওদের নাম। কী যেন।
– আপনি ওদের নাম,
– সি, সি, আ।
– জাহিদ!
– সিয়াম!
– জাহিদ!!!

অরনী হঠাৎ হাসতে শুরু করল। জাহিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কী হলো!

– আমি বুঝতে পারছি না, আমি কী হাসবো না কাঁদব?
– মানে?
– আমি এতদিন ভাবতাম আপনি শুধু আমার ব্যাপারে অমনোযোগী। কিন্তু না।
– আমি ভুলে গেছি একজনের নাম। স্যরি।
– শুধু একজনের ই নাম ভোলেননি।
– জ্বী?
– ওটা বিন্তি না বিন্নি। বিন্নি একটা ধানের নাম। আর হৃদি না, রিদ্ধি। ওরা তো তাও মেয়ে। চাচা হিসেবে আপনার তো ভাতিজাদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কথা। তার উপর ওরা যমজ।
– ওদের নাম ও ভুল?
– হ্যাঁ। ও সিয়াম না, সিয়ান আর ওর ভাই ইয়ান। আশ্চর্য! আপনার ওদের কে কোলে নেওয়ার মুহূর্তও মনে নেই?

জাহিদ চুপ করে আছে। নাদিয়া কপালে হাত দিয়ে বসে আছে।
– আপনি ওদের কোলেই নেননি?
– নিয়েছি। আসলে ওরা খুলনা ছিল যখন হয়েছিল। পরে নিয়েছি।
– কবে?
– বিয়ের সময়।
– ও মাই গড! চেঞ্জ দ্য টপিক। স্কুল।
– আমার?
– জ্বী। নাকি স্কুলের নাম ও ভুলে গেছেন। চাকরি কীভাবে করেন! ও হ্যাঁ, এখন তো শুধু চাকরি সম্বন্ধীয় ডেটা আপনার মাথায়।
– মনে আছে।
– কোনটা?
– ইস্ট ওয়েস্ট গ্রামার স্কুল।
– ইংলিশ মিডিয়াম?
– জ্বী।
– পশ!
– জ্বী?
– না মানে একটা তেই পড়েছেন? আর কোনো স্কুল নেই?

জাহিদ নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখলো। ‘ বলা যাবে না। বাকিটার নাম বলা যাবে না। বললে আর কিচ্ছুর উত্তর দেওয়া যাবে না। চুপ। মিথ্যা না বলে অন্তত চুপ। জাহিদ, সেদিন অরনীর হাত ধরে কাহিনী তুমিই বাড়িয়েছ। যেমন চলছে চলতে দাও।’

– কী হলো? ওকে। আমি কয়টা তে পড়েছি বলতে পারব না। প্রথমে অগ্রণী কিন্ডারগার্টেন। আসলে তখন থেকেই অরনী নামটা বাদ দিতে চাইতাম। সবাই আমাকে অগ্রণী ডাকতো তাই। এরপর মা যেটাতে টিচার ছিল, ধানমন্ডি ল্যাব। রাহু আর আমি ততদিন এক সাথে ছিলাম। তারপর মতিঝিল আইডিয়াল ফাইভ পর্যন্ত । এরপর সিক্সে রাহু আদমজী ক্যান্টনমেন্ট, আমি শহীদ আনোয়ার গার্লস। দুটো পাশাপাশি আর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাই চাচ্চু বলেছিল এইটা বেস্ট। আর্মিদের স্কুল, আর্মি দের নিয়ম। নাইনে ভিকারুননিসা। এবার চাচ্চু বলল এইটা বেস্ট। কলেজে হলি ক্রস, বাবা বলল এটা বেস্ট।
– শেষ?
– হ্যাঁ।
– ছয়টা।

নাদিয়া হাসতে লাগলো। জাহিদ গুনেও ফেলেছে। জাহিদ ও মুচকি হাসলো। ও পড়েছে মাত্র দুইটা স্কুলে। আরেকটা বলা যাবে না।
– ভার্সিটি?
– ডিইউ আইবিএ, বিবিএ, আর ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন।
– নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ এ অনার্স, দেন মাস্টার্স ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টো।

জাহিদ নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কথা গুলো বলার সময় নাদিয়া চেহারাতে খুব কষ্টের ছাপ দেখা যাচ্ছে। ওর তো ইংলিশ পড়ার কথা ছিল না। জাহিদের খুব জানতে ইচ্ছে করছে ও হঠাৎ মেডিকেলে না পড়ে ইংলিশ কেন পড়ল। এমন তো ছিল না যে ও পড়াশুনাতে ভালো করেনি। ও তো সবসময় ফার্স্ট হতো। কী হয়েছিল ওর সাথে? যদি জিজ্ঞেস করে তবে আবার পাল্টা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে যে ও এত কিছু কী করে জানে? জাহিদ যে অরনীর ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে তা নাদিয়া জানে না। ওর জানা উচিত না।

– আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিল স্কুলে? বা ক্রাশ?
– না।
– কাউকে ভালো লাগে নি?
– না।
– আর। আর কী বলব?
– আজকে থাক। পরে।
– ওকে।

জাহিদ এরপর ওর অফিসের কাজ করতে বসে। কাজ করতে করতে ও হঠাৎ ও অতীতে চলে যায়। ও লেভেলে জাহিদ যখন ওর স্কুল বদলায় তখন। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর ওর স্কুলের খরচ সালাম ভাইয়ার কাঁধে চলে আসে। সেই মুহূর্তে সেই খরচ জোগাতে না পেরে জাহিদ স্কলারশিপে একটি প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়। খুব কম স্কুলে স্কলারশিপ দেওয়া হয়। তার মধ্যে এটা বেস্ট ছিল। সেখানে বাংলাদেশের সব ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ছেলেমেয়েরা পড়ত। দুই একজনকেই শুধু স্কলারশিপ দেওয়া হতো, যদিও তারা এই স্কুলে টিকতে পারত না। মাত্রই জাহিদের এক স্কলারশিপ প্রাপ্ত সহপাঠী টিসি নিয়ে চলে গেছে। আর বাকি সবাই জাহিদকে একঘরে করে দিয়েছে। সবাই অপেক্ষা তে ছিল ও কখন ছেড়ে যাবে সে স্কুল। তখনই ওর জীবনে আসে একটি মেয়ে, সারা। স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী আর পপুলার ছিল সে। ওর বাবা প্রচুর বড়লোক। কিন্তু ও বাকি সবার মতো ছিল না। ও ছিল দয়ালু, জাহিদের পাশে বসতো। ওর সাথে অংক করত। ওরা একসাথে লাঞ্চ করত। তবে অনেকেই সেটা পছন্দ করতো না। তাই সেটা সারার বাবার কানে পৌঁছে দিল। তৎক্ষণাৎ তিনি জাহিদের স্কলারশিপ ক্যান্সেলের ব্যবস্থা নিলেন। জাহিদ অনেক ভয়ে ছিল, কারণ ওর স্কলারশিপ ক্যান্সেল করলে ও এই মুহুর্তে কোথায় যাবে? ওর ভাইয়ার পক্ষে মায়ের চিকিৎসা আর ওর পড়াশুনা একসাথে সম্ভব না। এই স্কুল থেকে বের করে দিলে আর কোনো ইন্সটিটিউটই ওকে জায়গা দেবে না।

– জাহিদ, আপনি কী আজ ঘুমাবেন না?
– আরেকটু কাজ বাকি আছে। আসছি।
– ওকে।

পরদিন সকালে নাদিয়া স্কুলে চলে গেল। লাঞ্চ টাইমে ঐ কেক গুলো ওর সহকর্মীদের খাইয়ে দিল। বাসায় যখন কেউ কেক খায় না তাহলে রেখে কী করবে। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে জাহিদ ফ্রিজে কেক গুলো খুঁজে দেখেছে। ফ্রিজে কেক নেই। হতাশ হয়ে লাভ ও নেই। নাদিয়া হয়তো দাঁড়োয়ানকেই দিয়ে দিয়েছে। আহ ! কেক! জাহিদের ফোন জ্বলে উঠলো। ড. পিপি কাল সন্ধ্যায় কথা বলতে চায়।

(চলবে)

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৯

” প্রিয়ম!!!”
“প্রিয়ম!!”
“প্রিয়ম!!!!!!!”

“আমাকে ছেড়ে যাস না। আমাকে নিয়ে যা।”

ঘুমের ভেতর নাদিয়া এভাবেই বলছে। ও হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। জাহিদ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর খুব ভীত অবস্থায় বসে এই দৃশ্য দেখছে। ওর গলা শুকিয়ে আসছে। প্রিয়ম নামটা শুনলেই ওর ভয় হয়। ওর শরীর কাঁপতে থাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অচল হয়ে যায় ও। নাদিয়া কে কী জাগিয়ে দেবে? ওর সহ্য হচ্ছে না আর। ঘামে ভিজে গেছে জাহিদ। অনেক সাহস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে পানি পান করল। পানি পান করার পর চেয়ারে বসে শ্বাস নিচ্ছে। ঠিক এই কারণেই ও চায় না নাদিয়ার সাথে থাকতে। প্রিয়ম!!!

পরদিন পিপি আর নাদিয়া বসে আছে পিপির চেম্বারে।

– কেমন আছ নাদিয়া?
– ভালোই।
– ভালোর সাথে যখন একটা ই যোগ হয় তখন কিছু একটা তো ভালো থাকে না।
– কথা বলেছিলাম ওনার সাথে।
– কী বলল?
– খুবই ভয়ানক।
– কী হলো বলো। আমি কিন্তু আগে তোমাকেই ডেকেছি। কারণ জাহিদ সাহেবের মুখে তো কেউ পিঠে গুঁজে দিয়েছে।
– হাহা! সাধারণ পরিচয় পর্ব হচ্ছিল। কার পরিবারে কী ব্লাহ ব্লাহ। ওনাকে ওনার ভাতিজা ভাতিজির নাম জিজ্ঞেস করলাম। আর যা বলল।
– কী বলল?
– উনি একজন বাদে আর সবার নাম ভুল বললেন।

নাদিয়া হেসেই চলেছে। পিপি তার খাতায় এটা নোট করলেন।
– ভুল তুমি কী করে বুঝলে?
– আমি ওদের নাম জানি তো। ওরা অনেক মিষ্টি বাচ্চা। আমার ও ভাতিজি আছে। ওনার যমজ ভাতিজাদের সমবয়সী।
– যমজ বাচ্চাদেরও নাম ভুলল?
– বলল।
– আর?
– আর, স্কুল কলেজ।
– এক্স?
– জিজ্ঞেস করেছিলাম।
– কী বলল?
– বলল ছিল না।
– ওওও। তোমার?
– জিজ্ঞেস করেননি।
– আর কিছু জানতে পেরেছ?
– হ্যাঁ। ওনার জন্মদিন।
– কখন?
– গত মাসের চার তারিখ। লজ্জা লাগছে।
– কেন?
– কারণ খুব বাজে একটা কাজ করেছিলাম আমি।
– কী?
– ওনার জন্মদিনের রাত ওনাকে উপোস রেখেছি।
– তুমি তো জানতে না। কিন্তু উপোস কেন?
– কারণ, স্কুলের সহকর্মীরা বলেছিলেন স্বামী কে না খাইয়ে রাখলে স্বামী সোজা হয়ে যায়।
– সোজা তো হয়নি, না?
– না। হাহাহাহ! এরপর ই বাবার বাসায় চলে আসি।

পিপি আবার খাতায় লিখলেন।

– এখন কী করবো?
– আজ চলে যাও। কাল ওকে নিয়ে এসো। রেজাল্ট আর নতুন টাস্ক পেয়ে যাবে।
– ধন্যবাদ।

জাহিদের বড় ভাই ফোন দিয়ে ওর হালচাল জিজ্ঞেস করলো। এখন নাদিয়া এসেছে কিনা। কথা শেষে ও পিপির চেম্বারে গেল।

– কেমন আছ?
– ভালো।
– আজ দিন কেমন গেল?
– ভালো।
– গতকাল?
– ভালো।
– আগামীকাল?

জাহিদ পিপির দিকে তাকায়।
– আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার কথা শুনছ না।
– শুনছি।
– নাদিয়ার সাথে কী কথা বলেছিলে?
– এই যে, পরিচয়।
– যেমন?
– কী করেন, পরিবার। এইসব।
– তুমি নাকি তোমার পরিবারের ছোট সদস্যদের নাম ভুলে গেছ?

জাহিদ লজ্জা পেয়ে যায়। পিপি মুচকি হাসে।
– লজ্জা পেও না। আমি তোমাদের ডাক্তার ই বলতে পার। ডাক্তার থেকে কিছু লুকাতে হয় না।

জাহিদ মাথা নাড়ল।

– তোমরা প্রাক্তন নিয়ে কথা বলনি?
– উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন।
– কী বলেছিলে?
– নেই।
– আসলেই?
– জ্বী।
– তুমি জিজ্ঞেস করনি ওর প্রাক্তন ছিল কিনা?
– না।
– কেন?
– প্রয়োজনীয় কোনো কথা ছিল না।
– তুমি কী প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলো না?
– না।

পিপি তার খাতায় তা আবার নোট করলেন।

– জাহিদ, তোমরা কয় ভাইবোন?
– তিন ভাই।
– তুমি কত নম্বর?
– তিন।
– মানে ছোট?
– জ্বী।
– তুমি জানো, বাংলাদেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, “দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।” তুমি নিজেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত।

জাহিদ পিপির দিকে তাকালো। পিপি তার টেবিলের পেপার ওয়েট ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

– মন খারাপ করেছ?
– না।
– তুমি তো কর্পোরেট?
– জ্বী।
– বিয়ে টা কোনো ডিল না। এখানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসগুলোই বেশি প্রয়োজন। স্ত্রীর সাথে সময় কাটানো, তার প্রশংসা করা, তার সম্পর্কে আগ্রহ রাখা অনেক অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কিন্তু সুখী জীবনে এসবই বেশি প্রয়োজন। কোটি কোটি টাকা তোমাকে পাঁচটা মিনিটের মনোযোগের আনন্দ দেবে না।

সেদিনের সেশন শেষে বাড়ি ফেরার সময় জাহিদ ভাবছে, পিপি কী জানে ওর ব্যাপারে? ও কেন জিজ্ঞেস করেনি তার কারণ নাদিয়ার প্রতি অমনোযোগ নয়। এর কারণ ও জানে অরনীর ব্যাপারে। অনেক কিছু, যা অন্য কেউ জানে না। পরদিন পিপির চেম্বারে নাদিয়া টাস্ক জেতার পাঁচ হাজার টাকা গ্রহণ করছে। জাহিদ টাকাটা ওর ফোনে পাঠিয়ে দিয়েছে।

– নাদিয়া, তুমি একশ তে একশ পেয়েছ। আর জাহিদ মাইনাস পঁচিশ।
– হাহাহাহাহাহ! মাইনাস পঁচিশ!
– জ্বী। ও ওর পরিবারের ছোট সদস্যদের নাম ভুলে গেছে, আবার প্রশ্ন ও করেনি। আর কথাও কম বলে।

নাদিয়ার খুব জোরে জোরে হাসি পাচ্ছে। জাহিদ নীচের দিকে তাকিয়ে আছে।

– নেক্সট টাস্ক। অ্যাজাম্পশন!

নাদিয়া আগ্রহ নিয়ে তাকালো। জাহিদ নীচের দিকে তাকানো তাই পিপি টেবিলে আঘাত করে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

– তোমরা একে অপর সম্পর্কে ধারণা পোষণ করবে।
– মানে?
– মানে, ধরো আমার ধারণা নাদিয়া স্কুলে সবসময় ক্লাস মনিটর ছিল।
– ঠিক!
– আর জাহিদের ফোন সাইলেন্ট মোড এ থাকে।

জাহিদ ফোনের দিকে তাকায়। সাইলেন্ট মোড।

– আমি তোমাদের এত ক্লোজ না যে অন্য কিছু বলব। কিন্তু, তোমরা স্বামী স্ত্রী। তোমরা একে অপরের জন্য বিভিন্ন ধারণা রাখতেই পার। আজে বাজে ভালো, সব!
– মানে?
– যে কোনো ধরণের গেস। ওয়াইল্ড হওয়া চাই। প্রথমে সাধারণ থেকেই শুরু করো। এক সপ্তাহ সময়। অনেক ধারণা হওয়া চাই। বেস্ট অফ লাক।

এই টাস্ক টা নাদিয়া বুঝছে না। কী ধারণা করবে? ও সিটে হেলান দিয়ে জাহিদের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহিদ গাড়ি চালাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর জাহিদ খেয়াল করল নাদিয়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ইগনোর করার পর বলল,

– কী?
– আমার ধারণা আপনি চশমা ছাড়া কিছু দেখেননা।
– ঠিক।

নাদিয়া এবার ওর দৃষ্টি নামিয়ে ওর নাকের দিকে আনে। অনেক সুঁচালো নাক। একপাশ থেকে বেশি সুন্দর লাগছে।

– নাকটা কী প্লাস্টিক সার্জারি?
– না।
– এমনিই এত সুঁচালো কী করে? সার্জারি করে নায়ক নায়িকারা এমন করে।

গাড়ি জ্যামে থামানোর পর জাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনিও কী সার্জারি করেছেন?
– কোথায়?
– নাকে?
– মাথায় করেছি।

জাহিদ গাড়ি চালাতে লাগলো। নাদিয়ার অপমান লাগছে। ওর জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল কেন সার্জারি করিয়েছিল। নাদিয়া এখনো ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে। ওর দাঁড়িগুলো সবসময় সুন্দর লাগে।

– আপনার কী দাঁড়ি বড় হয় না?
– হয়।
– কী করেন?
– ট্রিম করি।
– একদম একই সাইজ?
– হুম।

এবার নাদিয়া তাকিয়ে আছে জাহিদের ঠোঁটের দিকে। ওর ঠোঁট অনেক সুন্দর। ওর ঠোঁটের দিকে তাকাতেই ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সাথে সাথে ওর ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসি ফুঁটলো। ওভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নাদিয়া। এই ঠোঁট সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা করার ভাষা নেই। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি থেমে গেল। জাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
– নামুন!
– জ্বী?
– চলে এসেছি।

নাদিয়া গাড়ি থেকে নেমে বাসায় আসলো। ওর খুব অপমান বোধ হচ্ছে। জাহিদ ওকে একটুও পাত্তা দিচ্ছে না কেন? ওর কী সত্যি নাদিয়ার প্রতি একটুও আগ্রহ নেই? নাদিয়া বেডরুমে যেতেই জাহিদ বসার ঘরে বসে। ও আস্তে আস্তে ভাবতে থাকে আগের কথা। যখন ও অরনী কে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করত। অরনীর দিকে তাকানোর আগেই ও লুকিয়ে যেত। বারবার ও শুধু অরনীর পেছনের দিক টাই দেখেছে। ওর চুল দেখেছে। দুই বেণী দেখেছে। তখন ও ভাবত অরনী কী কখনো ওর দিকে এত মনোযোগ দিয়ে দেখবে? বিয়ের এত মাসে নাদিয়া ওকে অনেকবার দেখেছে। আর ও নিজেও আগের মতোই পেছন থেকেই দেখেছে। কখনো ওর চোখে চোখ রাখার সাহস করেনি। সেই সাহস টা ওর নেই।

পরদিন অফিস থেকে আসার পর নাদিয়া আবার ওকে কথা বলতে ডাকে।

– এভাবে বসে আছেন কেন?
– আপনি ডেকেছেন।
– হ্যাঁ। কিছু বলুন।
– কী বলব?
– ধারণা। ধারণা করুন।
– কোন ধরণের ধারণা?
– যেকোনো ধরণের। দেখুন, এই টাস্কগুলো শেষ হলে আমরা বুঝতে পারব আমরা একসাথে থাকার যোগ্য কি না। আমি শুধু তাই জানতে চাই। আমি জানি যোগ্য না, কিন্তু পরে যাতে মানুষের কথা শুনে আফসোস না হয়।
– এখন আমি কী ধারণা করতে পারি?
– যেকোনো কিছু।
– আপনার মিষ্টি পছন্দ না।
– এটা ধারণা নয়। আমি অনেকবার বলেছি আমার মিষ্টি পছন্দ না।

জাহিদ চিন্তা করতে থাকে। এরপর বলে,
– আপনার মিষ্টি ভাবি কে ও পছন্দ না।
– ঠিক। কিন্তু আপনার অন্য রকম ধারণা করা উচিত।
– আপনিই বলে দিন কী ধরণের ধারণা করা উচিত?
– আমিই বলব?

নাদিয়া অত্যন্ত অভিমানের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর সম্পর্কে ধারণাটাও ওকেই বলে দিতে হবে।
– যেমন এক্স।
– আপনার কোনো এক্স ছিল?
– ছিল।

জাহিদ অবাক হয়ে যায়। ওর জানা অনুযায়ী অরনীর কোনো এক্স ছিল না। ওর এক্স ছিল!

– কখন?
– ভার্সিটি তে।

ওহ! ও যতটুকু জানত তা ছিল স্কুল পর্যন্ত। ভার্সিটি তে থাকতেই পারে। নর্থ সাউথে পড়ত, থাকতেই পারে।

– আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না?
– আর কী? এক্স থাকতেই পারে। আপনি তো নর্থ সাউথে পড়তেন।
– জ্বী। কিন্তু এটা কী নেগেটিভ কিছু?
– না। নরমাল। খুবই স্বাভাবিক।
– আমার এক্স সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা নেই?
– না।

একদম মুখের উপর না? ওর সত্যিই কোনো ফিলিংস নেই।

– আপনার কী মনে হয়, আমার এক্স কী হতে পারে?
– মানে?
– প্রফেশন?
– জানি না।
– কিছু একটা?
– কোনো ধারণা নেই।
– আপনি তার ব্যাপারে শুনলে অবাক হবেন।
– কেন?
– কারণ সে একজন স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার।

জাহিদের একটু জ্বলছে কিন্তু ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না।

– ওর নাম ছিল, শাখাওয়াত শুদ্ধ।

শুদ্ধ! শুদ্ধ নাম টা শুনে জাহিদ চমকে উঠল। শুদ্ধ! এটা কী আদৌ বাস্তব কিছু? নিয়তি কেন এমন? শুদ্ধ!

– না,না। শুভ্র।
– আপনি আপনার এক্সের নাম ভুলে গেছেন?
– ওকে আমি শাখাওয়াত ডাকতাম তাই। আমি আপনার মতো না। শুভ্র, এই নামটার চেয়ে শাখাওয়াত ওর পার্সোনালিটিতে বেশি যেত। ও দেখতেও ওর নামের মতোই লম্বা ছিল। শাখাওয়াত ….
– সে এখন কোথায়?
– বিদেশে। ওর কোনো ফিল্মের শ্যুটিং চলছে। শেষ হলেই ঢাকা ফিরবে। ওর একটা ছবি সম্প্রতি বুসানে পুরস্কৃত হয়েছে। বুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ওর আরো ছবি আরো অনেক জায়গায় পুরস্কার পেয়েছে।
– তার জন্য শুভকামনা।

আশ্চর্য! শুভকামনা! ও তো ওর বউয়ের এক্স। ওর জিজ্ঞেস করা উচিত কীভাবে পরিচয় এসব। আর ও কিনা শুভকামনা দিচ্ছে!

– ধন্যবাদ। আমাদের পরিচয় কোথায় জানেন?
– ইউনিভার্সিটিতে?
– ঠিক। ও তখন ছবি তুলত। একটা ফেস্টিভ্যাল এ ও আমার ছবি তুলেছিল। এরপর ও পিছুই ছাড়ছিল না।আফরা আর বাকিরা বলল শাখাওয়াত আমাকে খুব পছন্দ করে। আমার ওর প্রপোজাল এক্সেপ্ট করা উচিত।
– হুম।
– এরপর আমরা কাপল ছিলাম অনেকদিন। ফেমাস ক্যাম্পাস কাপল। কিন্তু ভার্সিটির সবচেয়ে পপুলার ছেলেকে ডেট করা খুবই কষ্টকর। হাজার হাজার মেয়ের আনাগোনা। ও তো অর্ধেক মেয়ের ক্রাশ ছিল।
– সে চলে গিয়েছিল?
– হাহাহ! না, আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনেক রিকোয়েস্ট করেছিল আর একটা চান্সের জন্য।
– রিকোয়েস্ট রাখেননি?
– না। সবার রিকোয়েস্ট রাখি না। আপনার সাথে তো বিয়ে হয়েছে, তাই রিকোয়েস্ট টা রেখেছি।
– ও।
– শাখাওয়াত আমাদের বিয়েতেও এসেছিল।
– তাই? কোথায়?
– ঐ যে, চুল বড় বড় কোকড়া। ও ছিল। আর আমার ঐ ছবিটা ওর দেওয়া গিফ্ট। আমাদের মধ্যে এখন আর তেমন এত ভালো সম্পর্ক নেই। তবে আমরা এখন ক্যাজুয়াল ফ্রেন্ডস।

এই কথা বলে নাদিয়া এক গাল হাসি নিয়ে তাকালো। জাহিদ ওর অনুভূতি শূন্য চেহারা নিয়ে ভাবছে, অরনী কী সুন্দর করে হাসে, তাই না? হাসলে ওর আঁকাবাঁকা দাঁত গুলো আরো সুন্দর লাগে। বিশেষ করে গেজ দাঁত টা। কিন্তু এই কথা গুলে শুনে ওর একদম ভালো লাগছে না। একটু কান্না পাচ্ছে। কী করা উচিত এখন? ব্রেক নেওয়া উচিত?

– আর কোনো ধারণা নেই আপনার ?
– না। কোনো ধারণা নেই। আজকের মতো শেষ করতে পারি?
– না। তবে আমার একটা আছে। সেইটা শুনে যান।
– কী?
– আপনি স*মকামী।
– কীহ!!!
– জ্বী, আমার ধারণা। আমার মনে হয় আপনি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন না!
– আশ্চর্য!
– জ্বী।
– কেন মনে হলো? কী কারণে!
– হতেই পারে। আপনাকে দেখলে মনে হয়।

জাহিদ অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর রাগ কমিয়ে বলল,

– ভুল ধারণা।
– আপনিই তো বলেন আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, ছিল না।
– তাই বলে আমি স*মকামী!
– রাগ হওয়ার কিছু নেই। একবিংশ শতাব্দী। আপনি তো বিদেশেও ছিলেন। হতেই পারে। থাকতেই পারে। বাই দ্য ওয়ে, কোনো বয়ফ্রেন্ড্ ছিল?

এই কথা শুনে জাহিদ চেয়ার থেকে উঠে চলে আসে। আজ ও খুব অপমানিত হয়েছে। একে তো এতক্ষণ ওর এক্সের গুণ গাইলো, এরপর এত বড় কথা। ভালো ছেলেদের আসলেই কোনো দাম থাকেনা। নাদিয়া চেয়ারে বসে আছে। একদম বদলা নিয়েছে।

শাখাওয়াত ওর এক্স ছিল এবং শাখাওয়াত ওর একমাত্র বয়ফ্রেন্ড্। তবে তা মাত্র তেইশ দিনের জন্য ছিল। বাকিদের মতো শাখাওয়াতেরই ওকে পছন্দ হয়েছিল। তাই ওকে প্রপোজ ও করেছিল। আফরাদের চাপে আর অন্য একটা কারণে এক্সেপ্ট করেছিল। কারণটা এমন যে ওর নামের শুরু “S” দিয়ে। প্রিয়ম বলেছিল। একটা গেইম খেলে ওর জন্য “S” ই আসে। প্রায় তেইশ দিন টিকেছিল সেই প্রেম। তেইশ দিনে ও বুঝেছিল এইসব “S” দিয়ে শুরু জিনিস একদম ভুয়া। প্রেম করা অনেক ঝামেলার বিষয়। বিশেষ করে শাখাওয়াতের মতো পপুলার ছেলের সাথে। ওর হাজার অনুরাগী। তার উপর ওকে কী একটা নামে ডাকতো। নিরুপমা। পরবর্তীতে দেখতে পেল ওর ছবির নায়িকার ও সেই নাম। শাখাওয়াতের অনেক রিকোয়েস্টের পরেও নাদিয়া ব্রেক আপ করে ফেলে। যাওয়ার সময় শাখাওয়াত বলেছিল,

” আমি তোমাকে আর সব ব্যর্থ প্রেমিকের মতো অভিশাপ দেব না। তোমাকে শুভ কামনা দেব, তোমার সত্যিকারের ভালোবাসা কে খুঁজে পাওয়ার। সে ও তোমাকে ভালোবাসবে। তুমি তাকে যতটা বাসবি তার থেকেও বেশি। তবে তাকে খুঁজে পেতে যাতে তোমার কষ্ট হয়। ঋষির মতো যাতে হাজার বছর তপস্যা করতে হয়। যেন কঠিন সাধনা করতে হয়। তবেই তুমি বুঝবে ভালোবাসায় কত যন্ত্রণা। তবেই তুমি এর আসল মূল্য বুঝবে।”

নাদিয়া পেছনে ফিরেও তাকায়নি তখন। এত কঠিন শব্দ ওর মাথায়ও ঢোকেনি। শাখাওয়াত সহ নাদিয়ার অন্য ব্যর্থ প্রেমিকদের অভিশাপ গ্রাস করেছে ওর জীবন। আজ ও টের পাচ্ছে, ভালোবাসা পেয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার ফল। আজ এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য হাহাকার করছে ও। ওর এই সব কাহিনী যদি ওর দ্বারা রিজেকশনের শিকার লোকেরা জানে, তবে অনেক শান্তি পাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here