রিস্টার্ট,পার্ট_২২

0
701

#রিস্টার্ট,পার্ট_২২
#পিকলি_পিকু

নাদিয়া সেই ফুলের বাগানে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে, খেলছে। একটা দোলনা ও আছে সেখানে। দোলনা চড়তে চড়তে ও প্রিয়ম কে দেখলো। ও প্রিয়ম কে ওর কাছে আসতে বলল। সে কাছে এসে দাঁড়ালো।

– আবার কেন করলি?
– আমার মনে হচ্ছিল ম*রে যাই। তাই মরে গেলাম।
– ম*রার জন্যেই করেছিলি?
– না, মানে হ্যাঁ।
– বারবার এমন কেন করিস? কী লাভ তোর?
– ভাইয়া এমন কেন করল?
– ভাইয়াকে শিক্ষা দিতে?
– না!
– তুই না জাহিদ কে প্রমিস করেছিলি মর*বি না। এখন কেন করছিস এমন?
– আমি জানি না কেন। সেই মুহূর্তে এটাই মনে হয়েছিল। সামলাতে পারিনি।
– কাঁদতে পারতি তো। কাঁদিস না কেন? তোর কী মনে হয় এভাবে মর*লে সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে? এরপর আমাকে দেখতে পাবি? পাবি না! আমি আর দেখা করব না।
– এভাবে বলিস না।
– তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি আমার মৃ*ত্যুর কারণ জানবি। সেটার কী হবে যদি তুই ম*রে যাস?

প্রিয়ম রেগে গেল। নাদিয়া দোলনা থেকে নেমে বলল,

– আ’ম স্যরি! আর হবে না। আসলে আমি তো, তখন আমার মন বলছিল।
– মন? মন এখন কী বলছে? আমি এখানে আছি?
– হ্যাঁ।
– তাও এই নীল কুর্তি পরে? আমি তো নীল কুর্তি কখনো পরতামই না। এইটা তোর বানানো কাহিনী! আমি কী তোর সামনে? তোর মন তোকে বোকা বানায় আর তুই বোকা হয়ে যাস। এসব তোর মনের ভুল। আমি এখানে নেই। এগুলো তোর ভ্রম! আজ থেকে আমি আর আসব না।
– প্রিয়ম!
– যতক্ষণ না আমাকে জাস্টিস দিবি, আমি আর আসব না!

” প্রিয়ম!” “প্রিয়ম!!” বলে নাদিয়া জেগে উঠল। চোখ খুলে দেখল জাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে। ও কাকে যেন ডাকছে। ডাক্তার এসে ওকে চেক করলো। তাহলে এবার ও বেঁচে গেছে। ও বারবার বেঁচে যায় কেন?

– আপনার কেমন লাগছে?
– ভালো। ঘুম পাচ্ছে।
– ঘুমান। আমি পাশে আছি।

জাহিদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাহুও আসলো একটু পর। সকাল হতেই বাকি সবাই।

– রাহিয়ান , ওকে কখন ছাড়বে?
– আর দুই তিন দিন। তাও রেস্টে থাকা লাগবে।
– আমাদের বাসায় নিয়ে যাব। জাহিদের যদি আপত্তি না থাকে।

জাহিদ তাকিয়ে আছে। ওর কেন আপত্তি থাকবে, আপত্তি তো নাদিয়ার থাকার কথা। নাদিয়া খুব রাগান্বিত হয়ে বলল,

– আমার আপত্তি আছে। আমি যাব না।
– তোমার কোনো আপত্তি শুনছি না।
– আমি তোমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না!
– তুমি বিশ্রাম নাও, কোনো কথা বলবে না।

জাহিদ এগিয়ে এসে বলল,

– ওনার কথা বলার অধিকার আছে। উনি যেখানে ইচ্ছা যাবেন।
– কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন? এগুলো কী পাগলামি!

অংশু নাদিয়ার কাছে গিয়ে হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমি দোষ করেছি। ক্ষমা করে দে। না করলেও করিস না। কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন, এটা কেমন কথা? আমি একটা থাপ্পড় দিয়েছি। আমার জন্য পুরো পরিবার কেন?
– তুমি সেদিন থাপ্পড় দিয়েছ। ভুলে গেলে চলবে না, বাবাও দিয়েছিল। তোমরা সেদিন কেউ আমার জন্য প্রোটেস্ট করোনি। উল্টো তুমি তার ই প্রতিফলন করলে। আমি কেন সম্পর্ক ছিন্ন করব না?
– আমি সেই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইছি। আর আমি আগেও কী করেছি এমন? আর করব না।
– তুমি এর আগেও আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলে।
– কখন?
– তোমার বিয়ে ভাঙার পর। প্রিয়ম মারা যাওয়ার পর। এমন ভাব করেছিলে যেন আমার জন্য ভেঙেছিলে। আমি তখনো কিছু বলিনি। তুমি কী করে ভাবলে ভাইয়া, আমি মিশানের কাছে যাব? তার মানে তুমি ও কী বিশ্বাস করো আমি ঐদিন মিথ্যা বলেছিলাম?
– একদম না। চাচ্চু বলল তাই।
– চাচ্চু বেশি? এত তাড়াতাড়ি আমাকে অবিশ্বাস করলে? দরকার নেই।

রাহু ওর অন্য পাশে বসে বলল,

– ঠিক কথা। ভাইয়া তুমি সরো। এরকম ভাইয়ের দরকার নেই।
– রাহু! তুই ও সর!
– কেন?
– তুই অনেক বড় স্বার্থপর আর সুবিধাবাদী।
– আমি?
– জ্বী। তোর মতো ভাই আল্লাহ কাউকে না দিক।
– আমি কী করলাম?
– তুই আমাকে জোর করেছিস, বলেছিস আমি বিয়ে না করলে সপ্তর্ষির বাবা তোর সাথে ওর বিয়ে দেবে না। দিন শেষে তোর কাছেও আমার মূল্য শূন্য। তুই এ ও বলেছিলি যে আমার কারণে তোর প্রিয়ম মারা গেছে। তোর প্রিয়ম? আমার কারণে ভাইয়া মিষ্টি ভাবি কে হারাতো, আর এখন তুই সপ্তর্ষি কে হারাবি। আমার মতো বোন ভাইদের জন্য অভিশাপ।
– মজা করে বলেছিলাম। তুই রাজি হচ্ছিলি না তাই।
– কিন্তু আমি সিরিয়াস। আমাকে এই পরিবার থেকে বাদ দিয়ে দেবেন। আজ থেকে কেউ আমার খোঁজ নেবেন না। ভাববেন আপনাদের মেয়ে সেদিন সুই*সাইড করে মারা গেছে।
– অরনী! চুপ কর!
– বের হয়ে যান। এত সব অপরিচিত ভিজিটর আমি এলাও করব না। জাহিদ আপনি ওনাদের চলে যেতে বলুন।

জাহিদ সবাইকে আস্তে আস্তে বের করে দিল। ও সবাইকে বোঝালো পরে সব ঠিক হবে। আপাতত ওর অভিমান বুঝতে হবে। সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে জাহিদ ভেতরে যেতেই দেখে নাদিয়া কাঁদছে। জাহিদ কে দেখে ব্যান্ডেজ করা হাতে চোখ মোছার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। জাহিদ এসে ওর অল্প ব্যান্ডেজ করা হাত দিয়ে টিস্যু নিয়ে নাদিয়ার চোখ মুছে দিচ্ছে।

– থাক। লাগবে না।
– কাঁদুন।
– না।
– একটু কান্না করুন।
– আমি কারো সামনে কাঁদতে পারি না।
– চেষ্টা করুন।

নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকায়। ওর আপনাআপনি কান্না চলে আসে। জাহিদ ওকে সান্ত্বনা দিতে ওর পিঠে হাত রাখতেই নাদিয়া ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে কান্না করার পর ক্লান্ত হয়ে গেল।

– ভালো লাগছে?
– একটু।
– সেদিন এভাবে একটু কাঁদতে পারতেন। এটা না করলেও পারতেন।

নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকায়। এখন জাহিদ ও কাঁদতে থাকে।

– আমি ভয় পেয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন, আপনি এমন পাগলামি করবেন না!
– স্যরি!
– আপনি একটা অনেক বড় মিথ্যাবাদী! ফ্রড!
– স্যরি। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।
– এখন বুঝলেন তো আমি কেন চিন্তা করতাম। আপনি নিজেও জানেন না।

নাদিয়া জাহিদকে জড়িয়ে ধরল। এখন জাহিদ কিছুক্ষণ ওকে ধরে কান্না করলো। দরজার বাইরে থেকে পিপি লক্ষ্য করল। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে সে। নার্স ঢোকার আগে তিনি বারণ করলেন। ইশারায় বললেন ভেতরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু হচ্ছে। নার্স ফেরত চলে গেল। জাহিদ বাইরে আসতেই পিপির সাথে দেখা।

– এখন কেমন আছে?
– ভালো। উনি না, ওনার পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন।

পিপি অবাক হলেন। নিজের চশমা ঠিক করে বললেন,

– এখন কথা বলা যাবে?
– জ্বী।

পিপি ভেতরে গেলেন। নাদিয়া পিপির সাথে চোখ মেলাচ্ছে না।

– এখন কেমন আছ?
– ভালো।
– তাকাচ্ছ না কেন?
– এমনি।
– তুমি যে এমন কিছু একটা করবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আচ্ছা, তুমি এত প্রগ্রেসিভ, ডাক্তার দেখাও নি কেন?
– কীসের জন্য?
– মনের জন্য। তুমি যে সুই*সাইডাল, এর আগেও চেষ্টা করেছ তা কী তুমি জানতে না?
– আমি ভেবেছি আর হবে না।
– তুমি জানো তুমি কত বড় ভুল করেছ? তুমি বলেছিলে তুমি ওকে ঠিক করবে। উল্টো ওর সামনেই এই ভয়ানক কাজটা করলে। ধরো তুমি সারভাইভ করতে পারলে না। এই মানুষটার কী হতো?

নাদিয়া নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই তো!

– তুমি নিজেই যখন ঠিক না, তখন কী করে অন্য কে ঠিক করবে?
– আমি কী করে জানবো আমি ঠিক না।
– তুমি জানতে! শুধু ডিনাই করে গেছ। আচ্ছা, মিশান যে তোমাকে অ্যাবিউস করতে চেয়েছিল তা কেন বলনি?

নাদিয়া হকচকিয়ে যায়। পিপি স্যার কী করে জানলো?

– আপনাকে কে বলেছে?
– জাহিদ। তোমার ছোট ভাই ওকে বলেছে, আর ও আমাকে। আচ্ছা, আমরা ভাবছিলাম জাহিদ অ্যাবিউস হয়েছে। কিন্তু তখন তুমি ব্যাপার টা ওকে কেন বলনি? বলেছ প্রিয়মের মৃ*ত্যুর পরের ঘটনা। আগেরটা কেন না?
– কারণ সেটা আমার মাথায় ছিল না। থাকলেও খুব ঝাপসা ছিল। এর পরপরই প্রিয়ম মা*রা যায়। কিন্তু, প্রিয়মের কথা কী করে জানেন?
– জাহিদ। বেচারা কখনো কথা বলে না, কিন্তু তোমার জন্য হেল্প চাইতে এসেছিল। আচ্ছা, মিশানের কথা।
– প্রিয়মের মৃ*ত্যুর পর আমি ব্যাপার টা ভুলে যাই।
– ভুলে যাও?
– মনে করতে চাই না।
– তুমিই যখন তোমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে করতে চাও না, তখন তুমি কী করে ভাবলে জাহিদ তোমাকে ওর ঘটনা বলবে?

নাদিয়া মাথা নীচু করে ওর ব্যান্ডেজ করা হাত গুলো মুঠ করে আছে। পিপি ওর হাতে আলতো করে হাত রাখে। নাদিয়া ওনার দিকে তাকাতেই স্নেহের দৃষ্টিতে তাকায়। এই দৃষ্টিতে আস্থা আছে।

– তুমি ব্যাপার টা ভুলোনি। শুধু ঝাপসা হয়ে ছিল। আচ্ছা, সেইদিন মিশান কী কিছু বলেছিল?
– হুম।
– কী?
– আজেবাজে কথা।
– আর সেটাই তোমার ট্রমা ট্রিগার করল। তারপর তোমার বড় ভাই ভুল বুঝল।
– হ্যাঁ।
– নাদিয়া, তোমার ভেতর সেই মনস্টার টা এখনো আছে। তোমার ট্রমা থেকে জন্ম নেওয়া সেই মনস্টার। তোমার এখনো হয়তো মনে হচ্ছে তুমি এ ধরণের কাজ আর করবে না। কিন্তু আরেকটা আঘাত পাও, তুমি আবার করবে।

নাদিয়া চুপ হয়ে আছে।
– তুমি কান্না করো না কেন?
– কান্না করা তো দুর্বলতার লক্ষণ।
– না, এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
– আমি পারি না।
– একটু আগে তো করছিলে। আমি দেখেছি। ইমোশনকে কন্ট্রোলে রাখা ভালো। এতটাও না। নইলে সময়ে অসময়ে এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটবে।
– আমি কী করবো?
– তুমি এই বিয়ে বাঁচাতে চাও। জাহিদ কে বাঁচাতে চাও। আর ওর সাথে থাকতেও চাও, তাই না?
– হুম।
– একটা স্বাভাবিক সুখের সংসার। একটা ছোট বাচ্চা, তোমার আর জাহিদের। তোমার আর পাঁচজন বান্ধবীর মতো।
– হুম।
– ভিত্তি টা মজবুত করতে হবে। নইলে বারবার ভেঙে পড়বে। যতই চেষ্টা করো, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বেই। ফিক্স ইওরসেল্ফ ফার্স্ট। পরে জাহিদ কে ঠিক করতে পারবে। তুমি একবার ঠিক হও, পরে সব হবে। ছেলেটা কত ট্রমাটাইজড ছিল জানো? কোনো দোষ ও ছিলনা। না জানি কত লোক ওকে দোষারোপ করছে।
– আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি করতে চাইনি। কেন করলাম জানি না। (কাঁদো কাঁদো গলায়)
– আই নো। এই যে কার্ড টা রাখো।
– কী?
– থেরাপিস্ট। শরীরের আঘাত সেরে যাবে। আগে মনকে সারানো দরকার।

পিপি সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। জাহিদ বাইরে অপেক্ষা করছে।

– সময় হলে আসবে চেম্বারে? খুব জরুরী কথা আছে।
– ওকে।

নাদিয়া কে আফরার কাছে রেখে জাহিদ পিপির কাছে যায়।

– আর ইউ অলরাইট?
– হুম।
– এখনো কী ভয় লাগছে ?
– একটু একটু।
– মানুষ কী বলছে?
– বলছে, নাদিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত হয়নি।
– হাহাহ! তোমার ফ্যামিলি?
– ভাইয়া বকেছে। ফুফু ও বকেছে।
– কী বলেছ?
– একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
– আসল কারণ বলোনি?
– না।
– দোষারোপ করায় কী তোমার খারাপ লাগছে না?
– একটু লাগছে। তবে বেশি না। উনি ভালো থাকলেই হলো। সবাই আবার যদি ভুল বুঝে? সবাই তো আর সব জানে না।
– তুমি দেখলে তো নাদিয়ার অবস্থা। ও এই কাজটা করে ফেলল। নিজেকে লুকিয়ে তোমার সাহায্য করতে চাইছিল। উল্টো কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
– হুম।

জাহিদের হঠাৎ মনে হলো কীসের সাহায্য?
– আসলে মানুষের সবচেয়ে বড় সাহায্য মানুষ নিজেই করতে পারে। তোমাকেও নিজেকে সাহায্য করতে হবে।
– আমাকে কীসের সাহায্য?
– ডোন্ট লাই। এখন আর লুকিয়ে কিছু হবে না। তোমার সাথে কী হয়েছিল খুলে বলো। তোমাদের ভালোর জন্যই।
– আমার সাথে কিছু হয়নি।

পিপি মুচকি হাসছে। আবার একই কথা।

– নাদিয়াও ঠিক এভাবেই সুই*সাইডাল ব্যাপার টা ডিনাই করত। করো করো। তুমিও করো।
– কোনো ডিনাই না, এটাই সত্যি!
– এর পরিণতি জানো? এভাবেই বারবার ভেঙে পড়বে। এই ঘর যত যত্নেই গড় না কেন, ভেঙে পড়বে। তোমার সমস্যার কথা আমাকে বলো। আমি কথা দিচ্ছি, কাউকে বলব না।
– আপনি বুঝতে চেষ্টা করছেন না কেন, আমার কোনো সমস্যা নেই! (রেগে)
– নেই? তবে সেদিন ইন্টিমেট মুহূর্তে নাদিয়া কে সরিয়ে দিলে কেন?

জাহিদ খুব রাগে ফুঁসছে। এর উত্তর বের করতে হবে।

– তোমার ছোটবেলায় কিছু হয়েছিল? নিজেকে ছোট মনে করো না। খুলে বলো। তুমি এত চুপচাপ কেন?
– সবার ছোটবেলা ভালো হয় না। আমার ছোটবেলা বাকি বাচ্চাদের চেয়ে একটু অভাবে ছিল। তাই আমি এমন!
– অভাব! অভাবের কারণে তুমি নাদিয়া কে কাছে আসতে দাও না?
– রাবিশ!
– ওকে। কাম ডাউন! তুমি কী নিজেকে ঘৃণা করো?
– খুব। তবে করতাম। কিন্তু ইদানিং করছি না। অনেক কষ্টে আমি নিজেকে বুঝিয়ে একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলাম। আবার নিজেকে ঘৃণা করতে চাই না।
– সেই কারণ টা তো বলো। দেখলে তো, নাদিয়া নিজের অজান্তেই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো। আর তুমি কী ওকে হারাতে চাও?
– না চাই না। চাই না বলেই বলছি না। বাবা মা প্রিয়মের মতো ওনাকেও হারাতে চাই না। প্লিজ বাদ দিন এসব!
– তাই তো বলছি আমাকে সব বলো। এক মিনিট!

পিপি থেমে গেলো। প্রিয়ম! জাহিদ ওকে চেনে!

– প্রিয়মকে তুমিও চেনো?

জাহিদ হকচকিয়ে যায়। পিপি কী করে জানলো!

– তুমি বললে, প্রিয়মকে হারিয়েছ।

জাহিদ ঢোক গিলে সামনে রাখা পানির দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু পানি খায়না। মনে মনে নিজেকে বলে, ” জাহিদ স্বাভাবিক! পিপি সব নোট করে!”

– রিলেক্স। কীভাবে চেনো?
– আমি চিনি না।
– বললে তো, হারিয়েছ।
– হারিয়েছে। নাদিয়া হারিয়েছে।

পিপি মুচকি হেসে ল্যাপটপ থেকে একটু আগের রেকর্ডিং প্লে করে। জাহিদের কথা জাহিদ শুনতে পারছে। হতবাক জাহিদ দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে থাকে। পিপি হাত দিয়ে ইশারা করে পানি খেতে বলে। জাহিদ অনেক নার্ভাস। ও আবার ঢোক গিলে বলে,
– স্লিপ অব টাং!

এইটা বলার সময় ওর ঠোঁট কাঁপছিল। পিপি এবার জোরে জোরেই হাসলো।

– আমার সন্দেহকে তুমি ধীরে ধীরে বিশ্বাসে পরিণত করছো।
– আপনার ভুল হচ্ছে।
– তুমি অনেক ভালো মিথ্যা বলতে পারো। তবে তুমি কি এটা জানো আমাকে হিউম্যান লাই ডিটেক্টর বলা হয়। আমি ডিজিএফআই এর সাথে অনেক স্পেশাল কেসে কাজ করেছি। অপরাধীদের সাইকোলজিতে আমি খুব এক্সপার্ট। কিন্তু আমার বিবাহিতদের সাইকোলজি তে বেশি ইন্টারেস্ট ছিল। তাই এই কাজ টা করি।
– কী বোঝাতে চাইছেন?
– তোমাকে আমার স্বাভাবিক মনে হয় না। তুমি কিছু একটা জানো, যা জানা উচিত না। সেটাই বলতে পারছ না। আর তাই সেই ভার বয়ে যাচ্ছ এখনো।
– অনেক সুন্দর গল্প বলেন।
– সত্যি টা বলো।
– সত্যি এটাই, আমি প্রিয়ম নামের কাউকে চিনি না।
– তোমাকে এতদিন অনেক হাতে পায়ে ধরেছি। অনুনয় বিনয় করেছি, কিন্তু এখন তোমার গলায় হাত দিয়ে সেই সত্যি টা বের করার দায়িত্ব আমার।
– আপনি একটা ভ্রমে আছেন।
– জাহিদ, তুমি কী ভাবছ প্রিয়ম আর তোমার কানেকশন জানতে পেরে নাদিয়া কষ্ট পাবে? ট্রাস্ট মি, আমি কাউকে বলব না। এই যে আমি রেকর্ড বন্ধ করছি।
– কিন্তু আপনি ওনার কথা আমাকে আর আমার কথা ওনাকে তো ঠিকই বলেন। আমি এখন আসছি। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জাহিদ উঠে হেঁটে চলে আসছে। পিপি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত কিছু একটা অনেক বড় গন্ডগোল আছে।

– দাঁড়াও জাহিদ। তুমি যদি মনে করো এ ধরণের ব্যবহার করে তুমি নাদিয়া কে আর এই সম্পর্কে বাঁচিয়ে নেবে তবে তুমি ভুল। লেটস টক এন্ড ডিসকাস দ্য প্রবলেম। একটা না একটা সমাধান বের হবেই। ট্রাস্ট মি!

জাহিদ স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে এসে ওর গাড়িতে বসলো। গাড়িতে বসেই ও ভেঙে পড়ছিলো। চিৎকার করতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু পারছিল না। কেন মুখ দিয়ে প্রিয়মের নাম বের হলো? অতিরিক্ত কথা বলার দরকার কি ছিল! পিপি যখন একবার আঁচ করেছে আর বসে থাকবে না। এখনই কিছু একটা করতে হবে।

হাসপাতালে যেতেই জাহিদ মিঠাই আর আফরা কে দেখলো। আজ রাত ওরা থাকতে চায়। কিন্তু ওর যা প্ল্যান তা অনুযায়ী নাদিয়া কে একা থাকতে হবে। জাহিদ ওর মিষ্টি হাসি দিয়ে মিঠাই আর আফরা কে বশ করে নিল যেমন টা ও ওর কাজের ক্ষেত্রে করে থাকে। “জাদুর জাদু।” নাদিয়া ও অবাক! এত ভালোবাসা! রাতের খাবারের পর নাদিয়ার ঔষধ খাইয়ে গেছে নার্স। আর আধা ঘন্টা পর ই ঘুম আসবে ওর। এরপর ই কাজ টা করতে হবে। এখন নাদিয়ার পাশে বসে আছে জাহিদ। নাদিয়ার তন্দ্রা আসছে, জাহিদ আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

– আমি না আজ একটা কাজ করেছি।
– কী?
– স্কুল খুলে যাচ্ছে।
– এত তাড়াতাড়ি?
– অ্যাডমিশন নিয়ে কাজ হবে।
– তো?
– আমি তাই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।
– ছুটি নিতেন।
– এমনিতেও ছাড়তাম। অন্য জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছি।
– ভালো। কিন্তু বিশ্রাম ও তো দরকার।
– দেরি আছে।
– কোথায় করলেন?
– একটা বড় স্কুলে। অনেক বড়। চিনবেন নাম বললে? আচ্ছা সারপ্রাইজ।

এসব বলতে বলতে নাদিয়া ঘুমিয়ে পড়ল। জাহিদ ওর মাথায় হাত বুলোতে থাকে। নাদিয়া যখন গভীর ঘুমে তখন ওর ফোনটা বের করে। এই ফোনটা এখন ফেলে দিতে হবে। জানালা দিয়ে ফোনটা ফেলার আগে মনে হলো ও কিন্তু তো ল্যাপটপ ও চালায়। পিপি কিছু বললে ওখানেও আসবে। তাই ওর ফোন খোলার চেষ্টা করে। ওয়ালপেপারে জাদু। নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেও ফোনটা খোলার চেষ্টা করে। ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া এখন সম্ভব না। প্যাটার্ন দিয়ে করতে হবে। বিভিন্ন প্যাটার্ন ট্রাই করে। N , S, A, P. সম্ভাব্য কিছুই কাজে আসছে না। ব্লক হয়ে যাচ্ছে। কোড ট্রাই করেও পারছে না। এবার একটা অনুমান ট্রাই করল যা হওয়ার কোনো চান্স নেই। “J ” । লক খুলে গেছে ! জাহিদ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নাদিয়ার দিকে। J!!! J FOR JAHID!!! এরপর ওয়ালপেপারে চোখ যায় ওর। সূর্যাস্তে হাসিমুখের সেই জাহিদ। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তাও কাজটা করতে হবে। নাদিয়ার মেইল অ্যাকাউন্টে গিয়ে পিপিকে স্প্যামে রেখে আসে। পিপির নাম্বার ব্লকে রেখে দেয়। অর্থাৎ সব যোগাযোগের উৎস বন্ধ করে দেয়। পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ওকে ডিসচার্জ করে বাড়ি নিয়ে যায়। অনেকটা পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু এইটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

– জাহিদ, পিপি স্যার কাল কী বলেছিল?
– বলেছে আগে পুরোপুরি সুস্থ হতে। এরপর যেতে।
– কেন?
– দুটো একসাথে সম্ভব না।
– কথাও বলতে পারব না?
– হ্যাঁ। আপাতত না। ফুল ফোকাস অন রিকভারি!
– ওকে।

এদিকে পিপি নাদিয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু পারছেন না। হাসাপাতালে গিয়েও পেলনা। তার আর বোঝার বাকি নেই এইটা কার কাজ।

” জাহিদ, তুমি এই সম্পর্কটাকে টক্সিক বানাবে না, প্লিজ! সত্যি থেকে যতই পালাও, সত্য ঠিকই তোমার কাছে চলে আসবেই।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here