#রিস্টার্ট,পার্ট_৩২
#পিকলি_পিকু
নাদিয়াকে নিয়ে জাহিদ তাড়াতাড়ি বের হয়। ভয়ে গাড়ি না বের করেই সিএনজি তে উঠে। ওর হাত পা কাঁপছে। যাওয়ার আগে দাঁড়োয়ানকে বলল কেউ ওদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতে ওরা এখনো বাসায় আসেনি। সিএনজি তে ওঠার সময় ও একটা মাইক্রোবাস আর সামনে পেছনে দুটো বাইক দেখে। বাইকের ওপর দুজন করে লোক। এরাই হয়তো সানির লোক। জাহিদ সিএনজি ওয়ালাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলে।
– হয়েছে টা কী?
– সানি! সানি লোক পাঠাচ্ছে! ফোন সুইচ অফ করতে হবে।
– কেন?
– তোমার টা ও করো!
– আমরা কেন ভয় পাব?
– চুপ করো !!! বোকা মেয়ে! খুব হিরো হওয়ার শখ! হিরো হওয়ার আগে সামনের লোকটাকেও দেখতে হয়!!! (চিৎকার করে)
– যদি বলি সামনের লোকটাকে তুমিই বেশি শক্তিশালী মনে করো। বাস্তবে সে একটা কাপুরুষ ছাড়া কিছুই না!
– তুমি জানো না তাই বলছ! ও আমাদের গায়েব করে দিতে পারে।
– পারবে না। এতই সোজা?
ওরা দুজন শেষ পর্যন্ত নাদিয়াদের বাড়িতে আসলো। সবাই অবাক! এত রাতে ওরা এখানে! তাও আবার নাদিয়া এই পোষাকে। ওরা কিছুই বলছে না। বললে এখন সবার কাছেই বকা খাবে। অনেক জিজ্ঞেস করার পর বলল,
– ওর অফিসে সমস্যা হয়েছে। একটা লোক ওকে হুমকি দিলো।
– কী?
– জ্বী!
জাহিদ হকচকিয়ে গেল। এবার কী মিথ্যা বলছে! অংশু ও ফোন বের করে বলল,
– তুই শুধু বল! পুলিশের আইজি আমার পরিচিত। এখনই সব ব্যবস্থা হবে!
– না। আমরা এখানে শুধু আজকে রাত থাকবো। কাল সমাধান হবে।
– কী করে? আমাদের বল। আমরা পুলিশকে বলছি।
– আমরা বলেছি।
নাদিয়া জাহিদের রেকর্ডিং টা অজ্ঞাত পরিচয়ে সুসময় টিভির সাংবাদিক নুসরাতকে পাঠিয়ে দেয়। নুসরাত এটা শুনে বলে, “এটা তো টি আরপির খনি!” নুসরাত এই অডিও ক্লিপ টা ভাইরাল করে দেয়। টিভি চ্যানেল আর সোস্যাল মিডিয়ায় চুল চেরা বিশ্লেষণ হয়। উপর মহলে এই খবর যায়। বিরোধী দলের সমালোচনায় সরকার সোচ্চার! সানির বাবা এসব দেখে সানিকে চড় মারলেন।
– আস্ত গর্দভ! এসব এভাবে বলে! এখন তোকে কে বাঁচাবে? তোকে বাঁচাতে কোটি টাকা এত লোককে দিলাম এখন সব জলে গেল। সবাই আমার বিপক্ষে!
– ফাইয়াজ! ফাইয়াজ পারবে।
– এখন ফাইয়াজ ও পারবে না!
সানি ফাইয়াজের নাম্বার খুঁজে যোগাযোগ করল,
– আমাকে বাঁচা!
– গাঁধার গাঁধা ই রয়ে গেলি।
– আমি কী জানি লুজার এমন করবে?
– কোন লুজার?
– ঐ যে লুজার। ওর আসল নাম জাহিদ! ও প্রিয়মের বদলা নিচ্ছে।
– তোর এই গাঁধামির জন্য আমরা সবাই ফাঁসবো। এই সবে প্রিয়ম কোথা থেকে আসলো? একটা টানলে দশটা বের করে দিস। কে বলেছিল তোকে ওকে ফোন করতে!!!
– ভুল হয়ে গেছে দোস্ত। আমাকে বাঁচা।
– আরেকটু আগে করলেই হয়তো বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু এখন আর সম্ভব না।
– কেন?
– নিউজে দেখ।
“ব্রেকিং নিউজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাইয়্যিদ আহমেদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অভিযুক্ত সানি কে কানাডিয়ান পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবেন।”
সানি ফোনটা আছাড় মারল। এ কী হয়ে গেল!
– বাবা তুমি জাহিদ কে ছেড় না! ও আমার এ অবস্থার জন্য দায়ী।
– আমি কথা দিচ্ছি, ওকে আমি জাহান্নামেই পাঠাবোই!
” ব্রেকিং নিউজ: অভিযুক্ত সানির বাবা, সাবেক মন্ত্রীর ছেলের উপর দুর্নীতির অভিযোগ। তাকে গ্রেফতার ও তার সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ। এতে জনগনের স্বস্তি প্রকাশ।”
– এখন তুই আর আমি গাড়িটা নিয়ে বর্ডারের দিকে চলে যাই।
– বর্ডার?
– ইন্ডিয়াতে আমার বন্ধু আছে। কিছু দিন ঘাপটি মেরে থাকতে হবে।
– বাবা ইন্ডিয়া কোথায়?
– আপাতত শহর না। ঝাড়খণ্ডের গ্রামের দিকে একটা খুব ভালো লুকানোর জায়গা আছে। আমার তোকে সেখানেই পাঠানো উচিত ছিল।
– ঝাড়খণ্ড না বাবা। গ্রামের দিক না।
– আগে জীবন বাঁচাই।
ওরা বের হওয়ার আগেই পুলিশ ওদের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। ওদের আর শেষ রক্ষা হলো না। এদিকে রাহুর ঘর অর্থাৎ নাদিয়ার প্রাক্তন ঘরেই ওদের ঠাঁই হলো। সারারাত জাহিদ ঘুমালো না। পরদিন সকালে পত্রিকাতে দেখল সানির বাবা জেলে, সানিকেও কানাডায় জেলে পাঠাচ্ছে। ওর মুখে হালকা হাসি ফুটলো। কিন্তু কল রেকর্ড ফাঁস! জাহিদ ওর ফোন অন করে দেখল সমস্ত সোস্যাল মিডিয়া তে ওদের কল রেকর্ড। নাদিয়ার ওপর ওর খুব রাগ হচ্ছে। এভাবে ও জানে না ঠিক কোন বিপদ ডেকে আনছে।
– দেখলে তো, কে শক্তিশালী?
– তুমি যে ঠিক কী বিপদ ডেকে আনছো তুমি তা জানো না। ও আবার ছাড়া পাবে, ওর বাবা ছাড়া পাবে।
– কিছুই করতে পারবে না।
– তুমি ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখো না। হয়তো এখন ওরা অপজিশনে তাই। কিন্তু ওদের আমাদের মশার মতো পিষে ফেলতে সময় লাগবে না। তার বদলে মশা একটা কামড় দিয়ে উল্লাস করার কিছু নেই।
– মশার কামড়ে ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া হয়ে বছরে হাজার হাজার লোক মারা যায়। এতে মানুষের ও উল্লাস মানায় না। নমরূদ আর মশার কাহিনী জানো? মশা ও কম না।
জাহিদ বুঝতে পেরেছে ওর সাথে কথায় পারবে না। ভোরে ভোরেই ওরা বাসায় এসে পোষাক বদলে যে যার কর্মস্থলে যায়। কিন্তু নাদিয়ার বাবা বলল কিছুদিন ওদের বাড়িতে থাকতে। জামা কাপড় নিয়ে চলে আসতে।
– তুমি কিছু কিছুদিন বাবার বাড়ি থাকো। সেফ এ থাকবে।
– আর তুমি?
– আমার এখানে সমস্যা নেই।
– প্রটেকশন আমার না, তোমার দরকার। তুমি একটা আস্ত ভীতু! ওরা এখন জেলে। ওদের এখন নিজের জান নিয়ে টেনশন, ওরা কিনা আমাদের পেছনে পড়বে।
– বেশি বোঝ না!
– তুমি বেশি বোঝ না! একা একা এ বাসায় তুমি থাকবে? ভয়ে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকবে। আম্মা! আম্মা! এক কাজ করো, তুমি থাকো বাবার বাসায়, আমি এ বাসায় একা থাকি।
– আচ্ছা, তুমি কোত্থেকে সানি কে পেলে? আর ওর সাথে ঠিক করেছ? ও এত বাজে কথা কেন বলল?
– পেলাম। আর সেটা তোমার বিষয় না। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, তোমার কী ভালো লাগছে না ওকে শাস্তি পেতে দেখে?
জাহিদ চুপ করে রইল। সত্যি বলতে ভালো তো লাগছে। তবে ওর মৃত্যু দন্ড হলে আরো ভালো লাগতো। অরনী জানেই না যে ও কাদের শাস্তি দিচ্ছে। অরনী মানে সত্যিই শনি।
নাদিয়া ম্যাগনেফিসেন্টে কাজে গিয়েছে। যাক, অন্তত জাহিদ একটু শান্তি পাবে। যতই ভয় পাক সানি শাস্তি পাচ্ছে। এখন আবার প্রিয়মে ফেরা যাক। নাদিয়া আবার খোঁজ খবর নিচ্ছে। কোথাও কোনো ক্লু নেই। সেই খড়ের গাদায় ই যেতে হবে। নাদিয়া লুকিয়ে স্টোর রুমে ঢুকলো। সে এবার এমন ব্যবস্থা করল যাতে দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ না হয়। পা টিপে টিপে সবগুলো কাগজের সাল চেক করছে। আস্তে আস্তে নাদিয়া সেখানে অন্য একজনেরও উপস্থিতি টের পেল।
– ওয়াসি!!!
– নাদিয়া!!!
– তুমি আবার এখানে?
– তুমি কেন এখানে? ঘুরতে?
ওরা দুজনেই বুঝতে পেরেছে ওরা দুজন অন্য উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে। ক্লাস শেষে ওয়াসি নাদিয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। নাদিয়া ওকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে,
– প্লিজ উঠো। আমাদের কথা বলা দরকার।
– আমি কোনো কথা বলতে চাই না।
– আমি চাই। প্লিজ আসো।
ওরা নাদিয়ার বাসার কাছে একটি ক্যাফে তে বসলো।
– তুমি এখানে পড়াতে আসনি?
– তুমি কেন এসেছ?
– আমি যতটুকু জানি, আমি পড়াতেই এসেছি।
– তো স্টোর রুমে?
– কিছু তথ্যের জন্য।
– কীসের তথ্য?
– তুমি কার জন্য এসেছ?
নাদিয়া নার্ভাস, কিন্তু তা বুঝতে দিচ্ছে না। ওয়াসি কী করে জানলো ও কারো জন্য এসেছে?
– আমি যে কারো জন্য এসেছি এ বিষয়ে তুমি কী করে নিশ্চিত হলে?
– কারণ মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু করে না যতক্ষণ না নিজের আঁতে ঘা লাগে।
নাদিয়া ওয়াসির দিকে তাকিয়ে রইলো। ও কী বিশ্বাস করবে ওকে?
– তোমার আঁতে কেন ঘা লাগলো?
– কারণ আমি একজন ভিকটিম!
– তুমি?
– হ্যাঁ। আমি এই ম্যাগনেফিসেন্টেই পড়তাম। ও লেভেলে, স্কলারশিপ স্টুডেন্ট। কিন্তু আমার সাথে এত নিকৃষ্ট আচরণ করা হয় যে আমি এই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হই। পরবর্তীতে আমার থেরাপির প্রয়োজন হয়। এরপরও আমি অন্য স্কুলে পড়তে যাই, আর পরে প্যারিস। সেখান থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা নেই আমি এই স্কুলে ফিরে আসবো। সুস্থ করে তুলব এর পরিবেশ!
– তুমি ধরা পড়নি ?
– কেন?
– নাম? আগে যে এখানে পড়তে?
– ম্যাডাম, আমার কোনো রেকর্ডে ম্যাগনেফিসেন্ট নেই। আর আমার নাম? আমার পুরো নাম সালমান খান। ডাক নাম ওয়াসি। এই নামটাই এখানে আমাকে মজার খোরাকে পরিণত করেছিল। পরবর্তীতে আমি আমার নাম পরিবর্তন করে সালমান ওয়াসি করি। তাই ধরা পড়িনি।
– ওদের ইনভেস্টিগেশনেও না?
– না। অদ্ভুত! বোধহয় টিসি নেওয়ার কারণে আমাকে পুরোপুরিই মুছে দিয়েছে। কিন্তু তুমি কে? তোমার পরিচয় বলো।
– তুমি কত বছর আগে পড়তে?
– চৌদ্দ।
– তুমি কী প্রিয়ম কে চিনতে? ও এ লেভেলে এসেছিল।
– আমি এখানে শুধু তিন মাস ছিলাম। আমি কোনো প্রিয়ম কে চিনতাম না। আমার তো আমার সাথে যারা অন্যায় করেছে তাদের ও পরিচয় মনে নেই। শুধু একটা ছেলেকে মনে আছে। আমার মতোই ছিল। ওর ও স্কুল ছাড়ার কথা ছিল। সেই ছেলের নাম প্রিয়ম ছিল না। তবে ওর নাম টা আমার মনে নেই।
– প্রিয়ম মেয়ে ছিল। স্কলারশিপ স্টুডেন্ট।
– কোনো মেয়ের কথা মনে নেই।
– ও! আমি প্রিয়মের বন্ধু। ও এখানে পড়তো। ও সুই*সাইড করেছিল। কারণটা অজানা। সুই*সাইডের আগে ও আমাকে বারো বার কল করেছিল। কিছু বলতে চেয়েছিল। একটা কারণে আমি ধরিনি। জানতে পারিনি কারণটা কী। সবাই আমাকে দোষারোপ করেছিল। আমি জানতে চাই আসল কারণ টা কী?
– তো কী করছ তুমি?
– আমি পুরনো শিক্ষার্থীদের তথ্য জোগাড় করছি। ওদের জিজ্ঞেস করবো কী হয়েছিল।
– তুমি মনে করো ওরা বলবে?
– কেন বলবে না?
– কারণ ওরা একেকটা ডেভিল আর ম্যাগনেফিসেন্ট একটা হেল! জঘন্য জায়গা এই ম্যাগনেফিসেন্ট! এখানে যারা টর্চার করে ওরা টর্চার করে মজা নেয়। বাকি রা চুপচাপ তা দেখে মজা নেয়। কারণ সুযোগ পেলে তারাও এমনটাই করত।
– তোমার সাথে কী হয়েছিল?
– থাক।
– বলো। আমি শুনতে চাই।
– তুমি সেদিন যা দেখলে, ঐ স্ল্যাপ প্র্যাকটিস। এছাড়া নানা মেন্টাল আর ফিজিক্যাল টর্চার। মানা করলে আরো জঘন্য সাজা দেওয়া হতো। মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দেওয়াই ছিল ওদের লক্ষ্য!
ওয়াসি একদম উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। নাদিয়া ওকে সান্ত্বনা দিল। ও ভাবতে লাগলো জাহিদ ও তো এমন কিছু দিয়ে গেছে। বেচারা এসব কী করে ভুলবে? আর প্রিয়মকে ও কী করা হয়েছিল? এসব ই হয়তো ও সহ্য করতে পারে নি। আজ যখন জাহিদ অফিস থেকে আসে নাদিয়া ওর গাল ধরে দেখে। ওকে কী ওরা ওভাবেই চড় মারতো ?
– কী হয়েছে?
– এমনি। আজ ভয় লেগেছে?
– না। তবে আমাকে পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন করা হয়েছিল।
– কেন?
– ওনারা আমাদের প্রটেকশন দিতে চায়।
– ওনারা কী করে জানলেন?
– কী জানি? পুলিশ তো। খুঁজে বের করেই ফেলে। লোকেশন জানতে কতক্ষণ। এরপর সব ইনফরমেশন ওদের হাতে। তাই বলল আমাদের এখন প্রটেকশন দরকার কি না।
– কী বললে?
– মানা করে দিয়েছি।
– তুমি যা ভীতু! নিয়ে নিতে। আগে একটা কনেস্টবল, পিছে একটা কনেস্টবল। হাহাহাহ!!! ভীতুর ডিম জাদু!
জাহিদের কথাটা খারাপ লাগলো। নাদিয়ার এই ডেয়ারিং স্বভাবটাই ওর ভালো লাগে, আবার ভয়ও লাগে। ও মিথ্যা বলেছে যে ওর ভয় লাগেনি। লেগেছে, তবে নাদিয়ার জন্য। ও জানে না সানি হচ্ছে চুনো পুটি। এখনো সব আসল শয়তান বাকি। ওরা যখন পেছনে পড়বে তখন আর নিস্তার নেই ওদের। আঠারো কোটি জনসংখ্যায় একটা দম্পতি গুম হয়ে গেলে আর এমন কী? বলাও যায় না ফাইয়াজ নাদিয়ার সাথে প্রিয়মের মতো কিছু করলো! এসব আজেবাজে চিন্তা থামানো উচিত।
জাহিদ ওর খাটে বসে বই পড়ছে। বেনজির বলেছে ওভারথিংকিং কমাতে একটা ভালো বই পড়তে। নতুন এই বই ওকে পিপি দিয়েছে। বই পড়ার সময় নাদিয়া ওর পাশে বসে বলল,
– টেনশন হচ্ছে?
– না।
– জানি হচ্ছে।
– তো কী করবো?
– আসো ছবি দেখি।
– এই সময়ে ছবি?
– হ্যাঁ! ছবি দেখলে স্ট্রেস কমে।
– কী ছবি?
– বাংলা ছবি।
– কার? হুমায়ূন আহমেদের ছবি দেখবে? না পুরনো সাদাকালো? চলো না দুই দুয়ারী দেখি।
– ময়ূরী বা মুনমুনের ছবি দেখব!
– ছি!
– ছি বলার কী আছে? সেসব ছবি দেখা আরো মজা। তোমরা ইংলিশ মিডিয়ামের পশ বাচ্চারা কী জানবে বিচ্ছিরি বাংলা ছবি দেখার মজা।
– আমি তো শুনেছি ওসব সফ্ট প*র্ণ। অশ্লীল!
– ওগুলো অনেক ফানি হয়। যেমন নায়িকার শ্বাসটাও অনেক উদ্ভট। যদি কেউ শুধু শব্দটা শোনে, বুঝতে পারবে না ওটা শ্বাস না অন্য কিছু।
– আর এগুলা তুমি দেখো!
জাহিদ নাদিয়ার দিকে জঘন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া ওর সামনে হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে বলল,
– আমি হলে গিয়ে দেখেছি।
– কী!!!
জাহিদ রীতিমতো লাফিয়ে উঠলো। নাদিয়া হলে গিয়ে সি গ্রেড বাংলা ছবি দেখেছে!
– এতটা আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?
– একা গিয়েছ?
– না। আমি আর প্রিয়ম বাজি ধরেছিলাম। ও হারার পর আমি যা বলব তাই করতে হবে এটা শর্ত ছিল।
– পরে?
– আমি বললাম আমার সাথে সিনেমা দেখতে যেতে হবে।
– মানে? ও সহ দেখেছ!
– রাহু বডিগার্ড ছিল। আমরা গিয়েছিলাম সাভার নন্দন পার্ক। আমার এসএসসির পরপর। সেখান থেকে একটা থার্ড ক্লাস সিনেমা হলে। আমি জানতাম ওখানে শুধু থার্ড ক্লাস ছবি চলে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, আমি রাহু আর প্রিয়ম। হলে আমরা তিনজন ছাড়া আর সাত আটজন! সিনেমা শুরু হলো। আমরা তখনো জানি না কোন ছবি শুরু হচ্ছে। আন্দাজে তিনটা টিকিট কিনেছিলাম। ছবির নাম আসলো। টিটিটি টিং! টিঠিশ টিং!
– কী নাম?
– “নষ্টা নারী!”
জাহিদ লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল যেন ও আর নাদিয়া হলেই আছে। হলে অরনী, প্রিয়ম আর রাহুর পেছনে বসেই দেখছে,
– হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই প্রিয়ম চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।
– আর রাহু?
– হাত দিয়ে চোখ ঢেকে তার ফাঁক দিয়ে দেখছিল।
– তারপর?
– ছবি শুরু হলো নায়িকার এক হাত লম্বা ক্লীভেজ দিয়ে। সাথে সাথে বাকি দর্শকের হাতে তালি দিতে লাগলো। এটা দেখেই প্রিয়ম সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য আঁকুপাকু করছিল। ওর জন্য রাহুও চলে আসতে চাইছিল।
– তুমি তখনো বসেছিলে?
– হ্যাঁ। আমি কাহিনী জানতে চাই। নষ্টা নারী নষ্ট কেন হলো?
– পৃথিবীতে জানার জন্য অনেক কিছুই আছে। তারপর ও তোমার এসব জানতে হবে!
– এরপর কী হলো শোনো, ভিলেন আর সাইড চিকের অশ্লীল আনসেন্সরড গানের দৃশ্য শুরু হয়। এটা ভিলেনের ইন্ট্রো ছিল। ওরা গোসল করছিল।
– ছিইইই! আর তুমি দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে নিয়ে এই দৃশ্য দেখছিলে?
– আমিও বাচ্চা ছিলাম।
– বের হচ্ছিলে না কেন? লজ্জা করছিল না?
– আমি শেষ টা দেখতে চেয়েছিলাম। মানুষ কেন এসব দেখে?
– তো জানতে পেরেছিলে?
– আর পারলাম কোথায়? হলের ভেতরেই এই উত্তেজক দৃশ্য দেখে এক পুরুষ দর্শক তার বিশেষ অঙ্গ প্রদর্শন,
– থাক! থাক!
– হাহাহাহাহাহাহ! তুমি থাকলে কী হতো আমি তা বুঝতে পারছি।
– বের হয়েছ কি না বলো!
– প্রিয়ম যা কান্না শুরু করলো। এরপর আমরা বের হলাম। কিন্তু টাকার ব্যাগ রাহুর কাছে ছিল। আর তিনি তা হলেই রেখে আসেন।
– তারপর?
– একটাই ফোন ছিল, আর সেটা আমার। ফোনের চার্জ ও আমরা সারাদিন রেডিও শুনে শেষ করে দিয়েছিলাম।
এরপরের কাহিনী টা জাহিদ জানে। প্রিয়ম কাহিনী এখান থেকে বলেছিল। এত ইন্টারেস্টিং কাহিনী বাদ দিয়ে শুধু পরের অ্যাডভেঞ্চার বলেছে। এইজন্যই প্রিয়ম অরনীর এত ফ্যান ছিল। আর শুদ্ধকেও ওর ফ্যান বানিয়ে ফেলল। এতটুকু কাহিনী শুনে শুদ্ধের ও ইচ্ছে হয়েছিল ইশ! যদি ওর সুপারহিরো অরনীর সাথে ঘুরতে যেতে পারতো। ভাগ্য ভালো ও এখনো ওকে নিয়ে হিরো আলমের ছবি দেখতে যায়নি। তবে অরনীর কাহিনী শুনে মনে হচ্ছে ওরা সেখানেই ওদের সাথে বাড়ি ফিরছে,
– এরপর?
– আমি বুদ্ধি করে একটা গাড়ি ধরাই বাসা পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো টাকা নেই। ড্রাইভার যদি জানতো আমার কাছে টাকা নেই আর ফোন ও নেই, আমরা খুব বিপদে পড়তাম।
– ভয় করছিল না?
– না। ভয় পেলে ফেরত আসতে পারতাম? এরপর প্রতি দশ মিনিট পরপর বাড়ি তে ফোন করার নাটক করি। আমরা এখন এখানে, এই রাস্তায় ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ! তারপর বাড়ি পৌঁছাই। বলো তো কয়টা বাজে বাসায় আসি?
– সাড়ে বারোটা।
– ইক্জেক্টলি! কী করে জানলে?
– অনুমান। বাড়ির লোক কেমন বকলো?
– অনেক। আমাকেই বকেছে। আমি নাকি ওদের লীডার। ঐ শয়তান দুটো বাড়ি গিয়েই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলো। তাই ওদের কেউ বকেনি। সব দোষ আমার হলো।
– তোমারই তো! ঐ বাজে সিনেমা না দেখতে গেলেই হতো।
– তোমাদের মতো ভীতু হলে দুনিয়াতে আর কিছুই সম্ভব না। ভীতু কোথাকার! এক প্রিয়ম ভীতু, আরেক তুমি।
– প্রিয়ম ভীতু ছিল?
– হ্যাঁ। ছোটবেলায় সারাদিন কাঁদতো। কত বলেছি স্ট্রং হতে। দুদিন স্ট্রং তো পরদিন পুরনো প্রিয়ম। নতুন স্কুলে যখন গিয়েছিল বলেছিলাম সেই স্কুলের সবচেয়ে স্ট্রং মেয়েটি না হলে আর আমার সামনে আসবি না। জানি না পেরেছিল কি না? নাকি ছিল সেই আগের মতো।
জাহিদ মনে মনে ভাবছে, হয়েছিল সে সবচেয়ে স্ট্রং! কিন্তু অশুভ শক্তির সাথে পেরে ওঠা সম্ভব না।
– ও আমাকে প্রায় বলতো, আমার কপালে নাকি ওর চেয়ে বড় ভীতুর ডিম আছে। তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
– আমি বুঝি ভীতু?
– ভীতুদের দেশের রাজা। দুশমন জেলে আর এখনো ভয় পাচ্ছে। আমি বুঝি না তোমরা কেন এত ভয় পাও? এত ভয় কোত্থেকে আসে? আমি তো কখনো ভয় পাই না। এত ভয় পাওয়ার কী আছে? যা হওয়ার হবে,
জাহিদ আচমকা নাদিয়াকে বিছানার বিপরীতে চেপে ধরলো। নাদিয়া হকচকিয়ে তাকিয়ে আছে। কী হলো আবার? জাহিদ আর নাদিয়া মুখোমুখি।
– আমরা ইচ্ছে করে ভয় পাই না। ভয় পাওয়ার একটা কারণ থাকে। নইলে এখন তুমি ভয় পেতে না। তুমি যেমন সবসময় ভয় পাও না, আমরাও পাই না।
– ভয় পেলে ভয়কে জয় করতে হয়।
– তবে তুমি কেন মিশান ভাইয়ার সামনে অবশ হয়ে যাও? কিছু বলো না কেন? তোমার শাড়ি টেনে ধরে, হাত চেপে ধরে, বাজে কথা বলে তখন?
– আমি ঝামেলা করতে চাইনি। মিঠাই আপুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কী ভাবতো ?
– হ্যাঁ, এটাই ভয়। এই ভয় ই আমরা অন্য রূপে পাই। আমাদের সবার ভয়ই একই। মান হারানোর বা জান। সবই এক। কিন্তু তোমার আর আমার পরিস্থিতি ভিন্ন বিধায় তুমি আমার ভয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করছো। হাসিঠাট্টা করছো। একটি বার আমার জায়গায় এসে দেখ, বা নিজের জায়গা কে আমার জায়গা ভেবে দেখ। অন্যরকম লাগবে।
নাদিয়া নিঃশ্বাস আটকে জাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা দুজনের চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছে না। ভয়? ভয় হচ্ছে দুজনেরই। দুজনেই তা একে অপরের চোখে দেখতে পারছে।
– আমার উদ্দেশ্য তোমাকে ভয় লাগানোর নয়, ভয় বোঝানোর ছিল।
– হুম। (কাঁপা কাঁপা গলায়)
– বুঝতে পেরেছ?
– জ্বী।
নাদিয়া এখনো সেই স্থানে হাত মেলে শুয়ে আছে। জাহিদ ওর জায়গায় এসে শুয়ে পড়ে। নাদিয়ার পা বরাবর ওর মাথা। নাদিয়া ভাবতে থাকে, ওর উদ্দেশ্যও হাসিঠাট্টা করা ছিল না। ওর উদ্দেশ্য ছিল জাহিদ কে ওর মতো সাহসী করে তোলা। উল্টো জাহিদ ওকে বুঝিয়ে দিল নাদিয়া নিজেও জাহিদের মতোই আরেকটা ভীতু।
পরদিন ম্যাগনেফিসেন্টে নাদিয়া ভাবতে লাগলো ওর কী সত্যিই কোনো ভয় আছে? ও যদি ধরা পড়ে যায় তবে খুব বেশী কী হবে? ও জানতে পারবেনা কী হয়েছিল ওর প্রিয়মের সাথে। কিন্তু ও যদি সফল হয় তো ওর লক্ষ্য পূরণ হবে। লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়ার সময় নাদিয়ার চোখ ওয়াসির দিকে যায়। ওয়াসি ও ওর দিকে তাকায়। কে ওয়াসি? ও কী চায়? ও কী ওয়াসিকে প্রিয়মের কথা বলে ভুল করেছে? এরপর ওয়াসি নাদিয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে। নাদিয়া ওর গাড়িতে উঠতেই ওয়াসি বলল,
– টিম?
– কীসের?
– আমি তোমাকে সাহায্য করবো প্রিয়মের সাথে কী হয়েছিল তা জানতে।
– আর আমি কী করবো?
– তুমি আমাকে এখানকার অনিয়মের প্রমাণ এনে দেবে।
– কীভাবে?
– কোনো প্রতিবাদ করবে না। শুধু প্রমাণ জোগাড় করবে।
– কী করে?
– পরে বলব। এভাবে হুটহাট স্টোর রুমে বা অন্য কোথাও যাওয়া বন্ধ করো। ধরা পড়ে গেলে এসব নিউজ চ্যানেল সোস্যাল মিডিয়া ও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।
নাদিয়া মাথা নাড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই ওর সন্দেহ হলো।
– হাউ ডু ইউ নো?
– কী?
– নো। মানে সোস্যাল মিডিয়ার কথা যে বললে। নাথিং।
ওয়াসি একটু থেমে গেলো। পরে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– এভাবে কেউ হারিয়ে গেলে তার পরিবার সোস্যাল মিডিয়া বা নিউজ চ্যানেলের কাছেই যায়। আল্টিমেটলি যারা গুম হয়, তারা ফিরেই আসে না। কারণ তাদের প্রথমেই খুন করে দেওয়া হয়।
– ভয় দেখাচ্ছ?
– না। তোমাকে সাবধান করছি। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটলেও এদিক ওদিক দেখতে হয় কিছু আছে কি না। এভাবে এতটা ফিয়ারলেস থাকাও উচিত না।
নাদিয়া কে নামিয়ে দেওয়ার পর নাদিয়া ওয়াসিকে বাড়ি আসতে বলল। কিন্তু ও আসলো না। জাহিদ ও তখন বাড়ি ফিরছিল। ছেলেটাকে ও চিনলো না। নাদিয়া কেন যে এত অপরিচিত লোকদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। ওর কী একটুও ভয় হয় না?
(চলবে)