রিস্টার্ট,পার্ট_৩৫

0
649

#রিস্টার্ট,পার্ট_৩৫
#পিকলি_পিকু

ফারাজের হাতে স্ট্রেস বল। ফারাজ নাদিয়ার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কিন্তু নাদিয়ার ও তার অনুভূতি কে লুকানোর একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে।

– মিস, এটা কী?
– স্ট্রেস বল বলে এটাকে।
– আপনার?
– না।
– দাঁড়ান। এই জিমি, এইটা কেটে দেখ তো এটার ভেতর কী? এর ভেতর থেকে লাইট জ্বলছে কেন?

নাদিয়ার চেহারার রং একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। “এখনই ওয়াসি কে এস ও এস পাঠানো দরকার। কী করে পাঠাবো। ফোন হাতে এখন মেসেজ পাঠালে আরো সন্দেহজনক মনে হবে। আর ওয়াসি এই বলে লাইটই বা কেন লাগালো!”

নাদিয়ার সামনে জিমি স্ট্রেস বলটাকে ছেঁড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেটা অনেক চাপ সহায়ক বিধায় পারল না। পরবর্তীতে ফারাজ ফার্স্ট এইড বক্সের কেঁচি দিয়ে বলটা কাটতে লাগলো। নাদিয়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। আজকে ধরা পড়লেই সব শেষ। তবে ও ওয়াসির নাম বলবে না। কিন্তু ফারাজের কাটা বলের ভেতর থেকে একটা লাইট বের হলো। এইটা মুলতো স্ট্রেস বলটাকে চাপার কারণে জ্বলে উঠে। এইটা একদম ই
ওয়াসির ক্যাম বল না। এটা কোনটা? নাদিয়া সেখান থেকে হেঁটে চলে আসে। আজ ধরা পড়তে পড়তে বাঁচলো। ফারাজ ও নাদিয়াকে কিছু বলল না। তবে ও অনেক সন্দেহজনক। “ভাইয়া কে বলতে হবে ওর ব্যাপারে।”

– ওয়াসি!!! অনেক কাহিনী হয়েছে।
– কী? আস্তে নাদিয়া ম্যাডাম। আমরা টিচার!
– হ্যাঁ। কিন্তু শোনো আজকে অনেক বড় বিপদে পড়তাম।
– বাইরে গিয়ে শুনবো।

ওয়াসি আর নাদিয়া বাইরে বসে এ ব্যাপারে আলোচনা করলো,
– আশ্চর্য! বলটা গেলো কোথায়?
– আমি জানি না। কিন্তু আমি ওটা আগেও চেক করেছি। ইভেন বাকি গুলোও ঠিক ঠাক শুধু বলটাই। আ’ম স্যরি! আই উইল পে ,
– আরে থাক থাক! ভালোই হয়েছে ওটা নেই। নইলে তুমি শহীদ।
– এভাবে বলোনা। তবে গেল কোথায় স্ট্রেস বল সাহেব?

স্ট্রেস বল সাহেব জাহিদ সাহেবের সাথে ব্যবসায়ীক ভ্রমণে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে জাহিদ সাহেবের সাথে চলমান কাজের গতি পর্যবেক্ষণ করলেন। কাগজপত্র সব দেখলেন না, তবে জাহিদ সাহেব দেখলেন। আগামী সাতদিন ওনার এখানেই থাকতে হবে। মাঝ দরিয়ায় গিয়ে যত কাজ জাহিদ সাহেবের। তবে বউয়ের আবদার কয়েকটা ছবি পাঠাতেও ভুললেননা। রাতের বেলা হোটেলের কামড়ায় স্ট্রেস বল সাহেবকে নিজের হাতের তালু আর আঙুলের মাঝে চাপ প্রয়োগ করে করে ক্যামেরা অন আর অফ করছেন। তার সাথে সাথে এক, তিন, পাঁচ, করে গুণে যাচ্ছে। সব স্ট্রেস বল সাহেব নিজের মধ্যে ধারণ করছেন। এক প্রকার গলাধঃকরণ করছেন। ভেতরে এসডি কার্ড মহাশয়ার ধারণ ক্ষমতা ও প্রচুর। তাই হালকা বিরতিতে ক্ষণে ক্ষণে চলছে। আর সাথে ভেতরের আলোটা ও জ্বলছে আর নিভছে।

এসব কিছুর মধ্যে নাদিয়া লং ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপের হালকা স্বাদ ও পাচ্ছে। ওর এমনিতেও বাড়িতে ভালো লাগে না। জাহিদ ছাড়া আরো খারাপ লাগছে। আর এই নাদিয়াই কিনা ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চলে এসেছিলো। রাহুর ঘরটা সত্যিই খারাপ। তাই বসার ঘরের সোফায় গিয়েই রাত্রি যাপন করছে। কখন কাটবে এই সাতদিন? না জানি জাহিদ ঠিক করে ঘুমাতে পারছে কিনা?

জাহিদ সত্যিই ঘুমাতে পারে না। ওর হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় ঐ ইউটিউবের লোক গুলো আজফারের লোক। একজন ওভারথিংকারের পক্ষেই টিকটিকিকে ডাইনোসর বানানো সম্ভব। তাই ওর কাছে এখন সবাইকেই আজফারের লোক মনে হয়। কিন্তু না, সকাল থেকে সবাই সত্যি সত্যি আজফারের কথা বলছে। জাহিদকে ওর এক কলিগ ডাকতেই ও স্বাভাবিক হলো। তবুও বিকাল হওয়ার পর ও সবাই একই কথা বলছে। হোটেলে ও বলছে। এখন ওরা ওকে মেরে ফেলবে না তো। হঠাৎই নাদিয়ার ফোন আসে,

– হ্যালো।
– তাড়াতাড়ি ফোন চেক করো। আজফারের ভিডিও ট্রেন্ডিং এ।
– কবে দিলো?
– আজ সকালেই। সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। শুধু আমরাই ভিকটিম না। এমন আরো আছে। আমরা তো ভিডিওতে মাত্র তিন মিনিট। বাকিদের জবানবন্দি আর আমাদের ভিডিও। খুব দারুণ এক্সপোজ হয়েছে। চেক করো।

জাহিদ ভিডিও টা দেখলো। ওদের আগের অনেক প্রজেক্টের দুর্নীতি আর এমন চাঁদাবাজি সব আছে। ওর মতো ভুক্তভোগী ও অনেক। ওদের ব্যবসার অবস্থার মন্দা কাটাতে ওরা অনেক ঋণ নিয়েছিল। অনেক টাকা বাবা ছেলে বিদেশি পাচার করেছে। আর টাকা হাতাতে এবার তারা এই মেগা প্রজেক্ট হাইজ্যাক প্ল্যান করে। সব ফাঁস হয়ে গেছে। কিন্তু আজফারের কী অবস্থা? জাহিদ আজফারের অবস্থা জানতে সার্চ করে দেখে। সরকার ওদের সাথে চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর দুদক ওদের বিরুদ্ধে মামলা করবে। আরো অনেক ব্যাংক ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। খুব শীঘ্রই ওদের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এসব দেখে জাহিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ফোন রেখে পাশে রাখা স্ট্রেস বল টা চাপতে থাকে। অনেক ভালো লাগছে। আজফার খুব ভালো ভাবে ফেঁসেছে। তবে একটা জিনিস, ওর সেই বন্ধুরা কেউ ওর পাশে নেই। নাদিয়ার ফোন আসতেই জাহিদ কাঁদতে থাকে।

– থ্যাংক ইউ!!
– আমাকে থ্যাংক ইউ কেন?
– তুমি না থাকলে আমি কখনো এই দিন দেখতাম না।
– তাই বলে আমি থ্যাংক ইউ পাওয়া লোক? আই নিড আ গিফ্ট।
– কী?
– জাদু!
– না সত্যি কী চাও?
– অনেক গুলো জাদু।
– সিরিয়াসলি বলো।
– আমার জাদুর মুখে হাসি।
– এগুলো যে ওখান থেকে বলছ কেউ শুনছে না?
– কে শুনবে? আমি লুকিয়ে বলছি। রাহু বাসায় নেই, আমি আমার আগের ঘরে। তো, জাদুমণি, সোনা জাদু! এবার হাসো তো!
জাহিদ খিলখিল করে হাসলো। কিন্তু সাথে পেছন থেকে আরো দুটো হাসির আওয়াজ। নাদিয়া ওর পুরনো বারান্দায় বসে কথা বলছিল। রাহু আর মিষ্টি লুকিয়ে সব শুনছে। নাদিয়া রেগে ওদের বের করে দিল আর ফোনটা ও কেটে দিলো। জাহিদ হাসতে লাগলো। এরপর হোটেলের আয়নার দিকে তাকালো। যেন ও পুরনো শুদ্ধ কে দেখছে।

” শুদ্ধ, অনেক দিন পর তোমাকে দেখলাম। কতদিন তোমার সাথে কথা হয় না। ভালো আছ? দেখলে তুমি, তুমি লুজার না। তুমিও সাহসী। সেদিন ও তুমি লুজার ছিলে না। তবে একটু শক্তির অভাব ছিল। নাদিয়া, স্যরি স্যরি অরনী। তুমি তো অরনী হিসেবেই চিনতে। অরনী থাকলে আমরা ঠিক পারতাম। প্রিয়ম ও বেঁচে থাকতো। ও ওরকম কিছু করতো না। এই আজফার আজকে না, সেদিন ই জেলে যেত। ঐ ফাইয়াজ অর্ঘ্যদীপ সবাই! জানো, আমি না একটা বাচ্চা মেয়ে কে স্বপ্ন দেখি। আমার মনে হয় সেটা প্রিয়মের বাচ্চা। প্রিয়মের মতো এখন বাচ্চা টাও আমার স্বপ্নে আসে। আমি যখন তোমার মতো ছিলাম, ভাবতাম ও আমাকে মামা বলে ডাকবে। শুদ্ধ মামা। আচ্ছা ও থাকলে কী অরনীকে খালামণি ডাকতো? কী সব বলছি! আজকে শুদ্ধ অনেক খুশি। অনেক!!! তবে শুদ্ধ বেশিক্ষণ খুশি থাকতে পারে না। এটা শুদ্ধের সাথে যায় না। আমিও হ্যাপি থাকতে চাই, আর সবার মতো। আমিও অরনীর সাথে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই। আমিও একটা ফ্যামিলি করতে চাই। কিন্তু অরনী যদি জানে আমি আর প্রিয়ম বন্ধু ছিলাম তো কখনো আমাকে ক্ষমা করবে না। ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি কী করে থাকবো? আমি কী আমার জীবন থেকে ম্যাগনেফিসেন্ট কে পুরোপুরি মুছে দিতে পারি না?”

নিজের কিশোর সত্তা কে জাহিদ মন উজাড় করে সব বলতে থাকে। আর শুদ্ধ চুপ করে সব শুনে। যেন দুজন আলাদা ব্যক্তি। শুদ্ধ যেসব জিনিস স্বপ্নে দেখত সেসব জাহিদের কাছে। তবে দুজনের কারোরই মানসিক শান্তি নেই।

শেষ দিন নাদিয়া জোর করেই জাহিদকে তার মেজ ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়েছে। কারণ সে এতটা সামাজিক না। জাহিদের আজ ও মনে নেই ওর যমজ ভাতিজাদের নাম। নাদিয়া তাই মেসেজ করে দিলো। সব তো ভালোই যাচ্ছে। যাওয়ার সময় একটা নাদিয়ার জন্য উপহার ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরল। বাসার নীচে আসতেই নাদিয়া ওকে ডাকলো। ” জাহিদ!!! জাহিদ!!!” জাহিদ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে ওর কাছে গিয়ে ওকে সেই ফুল গুলো দিয়ে নাদিয়ার হাত ধরল। নাদিয়া লজ্জা পেয়ে বলল,” যাহ! ওয়াসি দেখছে।”

জাহিদ অবাক হয়ে পেছনের ছেলেটার দিকে তাকায়। ছেলেটাও ওর দিকে সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটার তো ঝাঁকড়া চুল। হালকা কোকড়া। ওর চেহারাও ওয়াসির মতো না। ও কে?

– ওয়াসি, ও আমার হাসবেন্ড। আর জাহিদ ও আমার কলিগ।
– এক মিনিট, ও তোমার হাসবেন্ড?

জাহিদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওয়াসি কী চিনে ফেলেছে? কিন্তু ওকেই তো ওয়াসি মনে হচ্ছে না।
– হ্যাঁ।
– আ’ম স্যরি। ঐদিন তোমাকে আরেকজনের সাথে ক্যাফে তে দেখে ভেবেছিলাম উনি তোমার বর।
– কোনদিন?
– প্রথম দিকে।
– ওটা হয়তো আমার কাজিন ছিল।
– তোমাদের মধ্যে সব ঠিক?
– মানে?
– আ’ম স্যরি! আ’ম রিয়েলি রিয়েলি স্যরি!
– না বলো।
– টিচার্স রুমে ফারহিন ম্যাম বলল যে তুমি নাকি,
– ডিভোর্স নেব?
– হ্যাঁ! স্যরি!
– ইটস ওকে। নেওয়ার কথা ছিল। বাট আর নেব না। সর্ট করে নিয়েছি। আর এটা আবার স্কুলে বলো না।
– ওকে তাহলে আসি।
– ভেতরে আসো।
– না না থাক!

জাহিদ নাদিয়ার হাত ধরে টানলো। ওয়াসি বুঝতে পারল জাহিদ ওকে পছন্দ করছে না। তাই ও চলে গেল। নাদিয়া ভেতরে এসে বলল,
– এত অভদ্রতা কেন করলে?
– আমি? কখন?
– এই যে কিছুই বললে না। ভেতরেও আসতে বললে না।
– আর তুমি! স্কুলে গিয়েও বললে আমরা ডিভোর্স নিচ্ছি। আমরা তো নিচ্ছি না।
– স্যরি, তখন পরিস্থিতিই এমন ছিল যে,
– কী পরিস্থিতি? নাদিয়া, ততদিনে আমাদের ডিভোর্স স্থগিত ছিল। তাও বললে? আমি কিন্তু কাউকে বলিনি। যখন হচ্ছিল তখন ও না। এসব খুবই পার্সোনাল! বাইরের মানুষকে ধরে বলে বেড়াচ্ছ!
– আশ্চর্য!

নাদিয়া আর কথা বলতে চাইলো না। কিন্তু জাহিদের এই বিষয় টা খুবই অপমান লেগেছে। ও টাই খুলতে খুলতে বলে,

– আর কোন কাজিন?
– জাহিদ!
– মিশান ভাইয়া? তুমি আবার ওর সাথে দেখা করেছ?
– চুপ করো জাহিদ! বেশি বলছ!
– হ্যাঁ, আমি চুপ থাকি। আমি চুপ ছিলাম তখন ডিভোর্স চাইছিলে। বলছি তো চুপ থাকো। তোমার যা ইচ্ছা তুমি করো। সবাইকে বলে বেড়াও আমরা ডিভোর্স নিচ্ছি! আর তুমি মিশান ভাইয়ার সাথে বারবার দেখা করো কেন!
– চুপ জাহিদ! লেট মি স্পিক! এত দিন পর এসে এসব কী বলছ! কী হয়েছে? এত রাগার কী আছে?
– কী আছে! আমরা ডিভোর্স নিচ্ছিলাম তাও ঐ বাইরের লোকটা জানে। না না! পুরা স্কুল জানে।
– এর কারণ ইন্টারভিউ তে আমি ম্যরিটাল স্ট্যাটাস উল্লেখ করতে পারিনি। ভুলে গিয়েছিলাম। তখন তৎক্ষণাৎ একটা উত্তর দিয়েছিলাম যে আমি ডিভোর্স নিতে পারি। আর যদি তখন আমি বলতাম আমার স্বামী আছে, আমি তার সাথে সুখে আছি। তারপর ওরা তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতো। আরো দেরি হতো।
– আর মিশান ভাইয়া?
– ও আমার সাথে শেষ দেখা করতে চেয়েছিল!
– কী বলেছে?
– কিছু না।

নাদিয়া ক্ষীণ স্বরে এই কথা বলে ওর চোখ লুকাচ্ছে। জাহিদ বুঝতে পারছে কিছু একটা বলেছে। জাহিদ ওর বাহু জোরে টেনে ধরে বলে,
– কী বলেছে বলো!!!
– জাহিদ ছাড়ো! কী করছ এসব!
– কিছু তো বলেছে। আমি দেখতে পারছি!
– তুমি আমাকে সন্দেহ করছো!

জাহিদ নাদিয়াকে ছেড়ে দিল। এরপর নিজের মাথা ঝেড়ে বলল,
– সন্দেহ! আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না। আমি করতে পারি না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি যে ও তোমাকে আর আজে বাজে কী বলেছে?
– কিছু না।
– বলো! কী বলেছিল?
– বললে কী করবে?
– হাত পা ভেঙে ঝুলিয়ে রাখবো!
অত্যন্ত কর্কশ স্বরে জাহিদ এই কথাটা বলল। ওর আওয়াজ যেন পুরো ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। নাদিয়া জাহিদের চোখ দেখে ভয়ে ভয়ে বলে,
– বাদ দাও না।
– কোন দিন? দাঁড়াও, যেদিন তুমি আমার কাগজ দেখতে চাইছিলে?
– না। আসলে,
– নাদিয়া তুমি আমাকে ঐ মিশানের কথা ধরে সন্দেহ করছিলে!
– সেটা ছিল না। অন্য কারণে।
– আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। আমার তো মনে হয় তুমি আমাকে বিশ্বাস ই করো না!

এই কথা বলে অত্যন্ত রাগের সাথে জাহিদ ভেতরে চলে আসছিল। কিন্তু এখন নাদিয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। ও চিৎকার করে বলে,” তোমার সমস্যা কী!!! এতদিন পর এসে এসব ঝামেলা কেন করছ!” নাদিয়ার কথা শুনে জাহিদ পেছনে তাকিয়ে জোর গলায় বলে,

– আমি ঝামেলা করছি না, তুমি করেছ।
– ইউ নো জাহিদ, আ’ম সিক অফ ইউর মুড সুইংস!

নাদিয়া ওর হাতের সবচেয়ে কাছের জিনিসটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। জাহিদ তাকিয়ে থাকে। ও বুঝতে পারে এতদিন পর এসে ঝামেলা টা ও নিজেই করেছে। তাই ভাঙা কাঁচ গুলো নিজেই পরিষ্কার করে। কোথাও না কোথাও এই সম্পর্ককে নষ্ট করার দ্বারপ্রান্তে আনতে জাহিদ ই দায়ী। তাই ক্ষমাও তার ই চাওয়া উচিত। ভাঙা কাঁচ গুলো ফেলে ভেতরের ঘরে যায় জাহিদ,

– আ’ম স্যরি। আমার এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি।
– আবার ও জাহিদ! প্রতিবার তুমি ঝামেলা করো আর স্যরি বলে ভিকটিম সাজো। আর এটা ঠিক না।
– আমি কখন বললাম আমি ভিকটিম?
– এই যে, এই চেহারা করো। আই হেইট দিস! সব দোষ সবসময় তোমার ই থাকে। আর বারবার সবার সামনে আমাকেই ভিলেন বানাও।
– আমি কখন বললাম! আর দোষ সব আমার? নাদিয়া, তোমার কী একবার ও মনে হয়নি মিশানের সাথে দেখা করা উচিত না।
– হয়েছে। আর মানাও করেছি। কিন্তু ও আমাকে প্রমিস করেছে ও আর কখনো আমার সাথে দেখা করবে না।
– আর তুমি তা বিশ্বাস করলে। আবার আমাকেই সন্দেহ করলে। আমার কাগজ পত্র দেখলে। তুমি আমাকে কী মনে করো!
– কিছুই না। তবে এটাও সত্যি তুমি আমাকে কিছুই খুলে বলো না। অনেক লুকোচুরি করেছ এর ও প্রমাণ আছে। আমি সব মেনে নিয়েছি। জেনেও না জানার ভান করেছি। চোখ বন্ধ করে রেখেছি। এক প্রকার অন্ধ হয়ে আছি।
– কী বলতে চাও?
– তোমার একটা ছবি আছে, ব্র্যান্ডেনবার্গ গেইটে। আর সেটা কোথায় তা তুমি নিশ্চয়ই জানো।

জাহিদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নাদিয়ার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। নাদিয়াকে কাঁদতে দেখে জাহিদ সাথে সাথে ওর সামনে এসে বসে পড়লো। নিজের চোখে পানি বুঝতে পেরে নাদিয়া চোখ মুছতে থাকলো,

– ছবি টা আগেই আমি তোমার ল্যাপটপে দেখেছিলাম। কিন্তু এটা কোথায় তখন আমি জানতাম না, আর জিজ্ঞেস ও করিনি। মনেই হয়নি কখনো। এটা সামান্য ব্যাপার। কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখি এটা জার্মানে। আর সেদিন তোমার পাসপোর্ট খুঁজে আমি ভুল করিনি। কারণ আমি তোমার স্ত্রী। আমার জানার অধিকার আছে আমি কার সাথে থাকি। এইটা সন্দেহ নয়। তবে তুমি মিথ্যা বলো। প্রচুর মিথ্যা।
– না! প্লিজ!
– আবার মিথ্যা। জাহিদ, মিশান ভাইয়া আমাকে সব বলেছে। মারামারি টা নাকি ও করেছে আগে। তবুও তুমি মিথ্যা বলছ কেন? তুমি ওর ফোন ও ফেলে দিয়েছ।
– সব বলছি।
– এখন আর শুনতে চাই না। এভাবে সব জানার পর তোমার কাছ থেকে জানার আর আগ্রহ থাকে না।
– আমার কোনো দোষ নেই।
– তোমার কোনো দোষ না থাকলে তুমি কেন এত লুকোচুরি করো? নিশ্চয়ই দোষ আছে। এমনটা ভাবাটাই স্বাভাবিক।
– তোমার মিশান ভাইয়া আমার কলিগকে হ্যারাস করেছিল। তাই মেরেছিলাম। হুমকি দিচ্ছিল আমাকে দেখে নেবে। তাই জার্মানের ব্যাপার গোপন করি। আর আমি অফিসের কাজে গিয়েছিলাম।
– এটা তে কী দোষ? এই কথা টা আমাকে বললে কী হতো?
– আমি তোমাকে আমার রাগী রূপ দেখাতে চাইনা। তুমি যদি জানতে আমি ওকে খুব মেরেছি,
– দেখিয়েছ তো। সরাসরি দেখিয়েছ।
– ওটা পরে। মিশান আসার পরে। আমি চাই না তুমি ভয় পাও আমাকে।
– আমি ভীতু না। তবে এটা করে আমাকে রাগী রূপ না দেখালেও মিথ্যেবাদী রূপ টা নিশ্চয়ই দেখিয়ে দিয়েছ।

“সম্পর্কে এ ধরণের ছোট বড় বাকবিতণ্ডা থাকবেই। ঝগড়া করলে নাকি প্রেম বাড়ে। এসব ছোট খাটো ঝগড়া বড় হয়ে গেলে সম্পর্কে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। প্রেম সংঘাত জীবনেরই অংশ। তবে সবকিছুর ই মাত্রা আছে।”

পিপির কথা শুনে জাহিদ নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর টেবিলের ওপর হাত রেখে বলে,
– ঐ নতুন ছেলেটা, ও দায়ী এসবের পেছনে।
– অন্য কে দায়ী না করে নিজের দোষ টা দেখো। এই অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা কথা টা না বললে আজ তোমার এই অবস্থা হতো না।
– আমি তো ওটা বলতে চাই নি। তখন আমার ভালো লাগছিল। ও সিমপ্যাথি দেখালেও না আমার ভালো লাগে। ও আমাকে অনেক মায়া করে। এমন করে কেউ করে না। ও রেগে কথা বললে ভালো লাগে না।
– ঐ ছেলেটা কে হিংসে হচ্ছিল?

জাহিদ গাল ফুলিয়ে বসে আছে। পিপি হাসতে লাগলো।

– জেলাসি। অনেকে এটাকে মিষ্টি ভাবে, কিন্তু এটা একটা পয়জন। সায়নাইড। সায়নাইড নাকি মিষ্টি, ঠিক তেমন।
– আমি জেলাস না।
– সব জেলাস ব্যক্তিরাই একই কথা বলে।
– কিন্তু আমার ওকে সন্দেহ হয়। ও বলেছে ও এই স্কুলে পড়তো আর এই স্কুল কে শুধরাবে। ও স্কুলের পেছনে না থেকে নাদিয়ার কাছে এত কী কাজ? আর ও আমার সাথে পড়া সেই ওয়াসি নয়।
– কী করে বুঝলে?
– আমি বুঝতে পারি।
– এত বছর আগের। নাদিয়াকে ও তো চিনতে পারোনি।
– নাদিয়া কে দেখিনি তাই চিনতে পারিনি। কিন্তু ওয়াসি আর আমি বন্ধু ছিলাম। যতটুকু সময়ই হোক। ওর চুল গুলো কখনো কোকড়া ছিল না। এই ওয়াসির চুল কোকড়া।
– হয়তো পার্ম করেছে।
– আর ওয়াসি শ্যামলা ছিল। ফর্সা হলো কী করে?
– ফেয়ার এন্ড লাভলী মেখে। এত ওভারথিংকিং ভালো না।
– না, এটা সেই ওয়াসি না। ওয়াসি কখনো টিচার হতে চাইতো না। ওয়াসি ওর বাবার মতো আর্কিটেক্ট হতে চাইতো।
– নাদিয়াও লক্ষ্য বদলেছে।
– কিন্তু আমার মন মানছে না।
– ও মিথ্যা কথা কেন বলবে?

নাদিয়া ওয়াসির গাড়িতে ওকে ওর স্ট্রেস বল ক্যামেরা টা ফেরত দিলো।
– ফেরত দিচ্ছ যে?
– আরে এটা আমাকে অলমোস্ট মেরেই ফেলছিলো। এইটা আমি আর ইউজ করছি না। আর এটাতে লাইট কেন ছিল?
– এই বল গুলো সুন্দর লাগার জন্য। আমি তো ইন্ডিকেটর হিসেবে ইউজ করেছিলাম।
– আমার বাসায় ও এমন একটা ছিল। আমি খেয়াল করিনি দুটো এক রকম।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

বাড়িতে এসে ওয়াসি এর ভেতরের এসডি কার্ড চেক করতে লাগলো। কিছু থাকলে ও নিয়ে রাখবে। ভিডিও টা চালাতেই দেখলো অন্ধকার ফুটেজ। ফাস্ট ফরোয়ার্ডে চলছে। এটা কোথাকার ফুটেজ ও জানে না। তাই কফি খেতে খেতে দেখছে। যার হাতে ক্যামেরা বেচারা অনেক চাপাচাপি করেছে বল টা কে। মানসিক রোগী নাকি। কত সব আজে বাজে ফুটেজ ও দেখতে হয়। আশেপাশে হাত দিয়ে রেখেছে। তার জন্য এটা কার হাতে বোঝা যাচ্ছে না। নাদিয়া এটা কাকে দিয়েছিল? এই অন অফ কাহিনী তে ওয়াসির মাথা ধরেছে। এই লোকটা কে? তাকে সামনে পেলে আচ্ছা করে পে*টাবে। সাইকোপ্যাথের মতো চেপেই যাচ্ছে। অবশেষে চাপাচাপি বন্ধ। লোকটা কার সাথে যেন কথা বলছে। আওয়াজ টা খুব একটা পরিষ্কার না। এটাকে ঠিক করতে হবে। আর দেখে কী লাভ আছে? কেটে দেওয়ার সময় দেখলো ছেলেটা নাদিয়ার স্বামী। কার সাথে কথা বলছে? একা একা তো। ওয়াসি বাকি ক্যামেরা গুলোর ভিউ চেক করলো। আশেপাশে কেউ নেই। পাগল নাকি? পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার? নাকি ভূত প্রেত? ওয়াসি বসে বসে পুরোটা শুনলো। পুরোটা শোনার পর ওর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। নাদিয়ার স্বামী জানতো প্রিয়মের ব্যাপারে! আর বাচ্চা! কার বাচ্চা? ওর নাম শুদ্ধ! শুদ্ধ নামটা খুব পরিচিত। নাদিয়া কোথায় যেন শুনেছে। মনে পড়েছে, তার মানে ও সেই লোক যাকে ওয়াসি খুঁজছে! ওয়াসি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here