#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৩৩
#লেখনীতে:সারা মেহেক
হাতের পার্সেলের মধ্যকার জিনিসগুলো দেখে সাবিহার পায়ের তলা হতে যেনো মাটি সরে গেলো। সে এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তার হাতের পার্সেলে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালের বেশ কয়েকটি ছবি এবং প্রত্যেক ছবিতে তার বাবা ও রাগীবের চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। প্রথম তিনটি ছবির পরের ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে রাগীব তার আফসার সাহেবের দিকে পি’স্ত’ল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে, এরপরেরটায় দেখা যাচ্ছে আফসার সাহেব গু’লি’বিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন৷ এসব ছবি দেখে সাবিহার বুঝতে দেরি হলো না যে রাগীবই তার বাবাকে মেরেছে এবং তার অলক্ষ্যে এক্সিডেন্টের ঘটনা সাজিয়েছে।
সাবিহা বিস্ময়ে হতভম্ব। এ সময়ে ঠিক কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে তা ঠাহর করে উঠতে পারলো না। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে নিষ্পলক ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু মুহূর্তের জন্য যেনো সে ছবিগুলোর মাধ্যমে চলমান দৃশ্য দেখতে পেলো। রাগীব তার বাবাকে মা’রছে! ভাবতেই শিউরে উঠলো সে।
সাবিহা ছবিগুলো নিয়ে ভেতরে চলে এলো। ছবিসহ পার্সেলটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর আচমকা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বিছানা ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
” আমি তোমাকে হারাতে চাইনি আব্বু। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। জানি, তুমি অনেক পাপ করেছো। কিন্তু তুমি একজন ভালো বাবা ছিলে। তুমি সবসময় আমাকে আগলে রেখেছো, স্নেহ দিয়েছো, আমার আবদার শুনেছো। আমি সত্যিই তোমাকে হারাতে চাইনি। আমি রাগীবকে বলেছিলাম আব্বু, ও যেনো তোমাকে না মে’রে ফেলে। কিন্তু তারপরেও ও তোমাকে মে’রে ফেললো। এমনটা তো চাইনি আমি। আমি রাগীবকে ভালোবাসি আব্বু। কিন্তু ও তোমাকে আমার থেকে এভাবে কেড়ে নিবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ওর কাছে আমি আবদার করেছিলাম, বারবার বলেছিলাম যেনো তোমায় না মা’রে। কিন্তু ও আমার আবদার রাখলো না। অথচ বলেছিলো, তোমাকে মারবে না। মিথ্যা বলেছিলো ও। বড় মিথ্যা, আমাকে আড়ালে রেখেছিলো।
হ্যাঁ, এখন বুঝতে পেরেছি, তোমার মৃ’ত্যু এক্সিডেন্টে হয়নি। রাগীব নিজ হাতে তোমার খু’ন করেছো। এসব এক্সিডেন্ট, পু’লিশ, তদন্ত সব নাটক ছিলো। আমার কাছ থেকে সত্য লুকাতে রাগীব এ কাজ করেছে। আমি কখনো ভাবিনি রাগীব, তুমি আমার সব ভালোবাসা মুহূর্তেই এভাবে ঘৃ’ণায় পরিণত করে দিবে। আই যাস্ট হেইট ইউ রাগীব, আই যাস্ট হেইট ইউ। ”
সাবিহা মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে, যেনো তার এ কান্না দরজার ওপারে না পৌঁছায়। গলা শুকিয়ে আসছে তার। চোয়াল দুটো চিনচিনে ব্যাথা করছে। অনেকক্ষণ এভাবে কাঁদার পর সাবিহা কিছুটা স্থির হলো। অতঃপর সাবিহা পুনরায় দৃষ্টিপাত করলো ছবিগুলোর উপর। একাধারে কিয়ৎক্ষণ ছবিগুলোর দিকে চেয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে না আব্বু? রাগীব যখন তোমাকে গু’লি করলো, পচিঁয়ে মা’রলো তখন তোমার খুব কষ্ট হয়েছিলো, তাই না আব্বু? রাগীব কি করে পারলো এমনটা করতে? কি করে পারলো তোমাকে এতো কষ্ট দিতে? ও কি একবারো আমার কথা ভাবলো না? ও এতোটা নি’ষ্ঠুর হলো কি করে?
ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, ও একজন মা’ফিয়া। ওর জন্য এসব খু’ন’খা’রাপি কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু রাগীব আমাকে চিনেনি এখনও৷ ও কি ভেবেছে, আমি ওকে ছেড়ে দিবো? এসব সত্য জানার পর তো প্রশ্নই উঠে না৷ তোমাকে এর ফল ভোগ করতেই হবে রাগীব৷ ইউ হ্যাভ টু পে ফর দিস মা’র্ডার।”
শেষোক্ত কথাগুলো বলার সময় সাবিহার চাহনি ও মুখভঙ্গি কঠোর হয়ে এসেছিলো। হাতের মুঠো হয়ে উঠেছিলো শক্ত। সাবিহা এখন যেনো নিজের মধ্যে নেই। বাবার মৃ’ত্যু দেখে সে ভুল সঠিকের পার্থক্য যেনো ভুলে বসেছে৷ ভুলে বসেছে তার বাবার কৃতকর্মের কথা। সে এখন পাগলপ্রায় হয়ে এসেছে। মানসিকভাবে হয়ে গিয়েছে বিপর্যস্ত।
সাবিহা বিছানার উপর ওভাবেই ছবিগুলো রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এরই মাঝে সামাদ রুমে প্রবেশ করলো। সাবিহাকে খুঁজতে এসেছিলো সে, কিছু জরুরি কাজের জন্য। রুমে এসে সাবিহাকে এক ডাক দিতেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো বিছানায় এলেমেলোভাবে রাখা কয়েকটি ছবির উপর। সে যথেচ্ছভাবে একটি ছবি তুলে নিলো। অতঃপর ছবিতে রাগীব ও আফসার সাহেবকে দেখে ধাক্কা খেলো সে। বিস্ময়ে দৃষ্টিজোড়া বৃহদাকার করে কয়েক কদম পিছিয়ে এলো সে৷ সে যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, রাগীবই তার খালুর খু’নি। মুহূর্তেই সে বুঝে গেলো, এক্সিডেন্টের ঘটনাটা পুরোপুরি বানানো ছিলো।
সামাদ কিছুক্ষণের জন্য শূন্য মস্তিষ্কে বসে রইলো। অতঃপর দ্রুত একটি ছবি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা চলে এলো অফিসে। আফসার সাহেবের বিজনেস এখন সামাদ সামলায়৷ আর রাগীব মাঝে মাঝে টুকটাক কিছু সাহায্য করে।
রাগীব আজ অফিসে এসেছে জরুরি কিছু ফাইল চেক করার জন্য৷ সে তার জন্য নির্দিষ্ট করা কেবিনেই বসে ছিলো।
সামাদ সেই ছবিগুলো নিয়ে অকস্মাৎ রাগীবের কেবিনে প্রবেশ করলো। রাগীবের ডেস্কের উপর ছবিটা রেখে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” খালুকে তুমিই মেরেছো, তাই না রাগীব?”
অকস্মাৎ এরূপ প্রশ্ন শুনে রাগীব থতমত খেয়ে গেলো। নিমিষের জন্য ছবির দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বললো,
” এসব কি বলছো সামাদ….উনার মৃ’ত্যু তো এক্সিডেন্টে হয়েছিলো।”
সামাদ টেবিলের উপর থাবা মারলো। কিয়ৎ কঠোর কণ্ঠে বললো,
” মিথ্যে বলো না রাগীব। ছবিতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সব। কি দরকার ছিলো এক্সিডেন্টের মিথ্যে নাটক সাজানোর?”
রাগীব মুহূর্তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” দরকার ছিলো। সাবিহার কাছ থেকে এ সত্য লুকানোর দরকার ছিলো। ও ওর বাবাকে জীবিত দেখতে চেয়েছিলো সবসময়। আমার কাছে এসে এ নিয়ে রিকুয়েষ্টও করেছে৷ কিন্তু ততক্ষণে উনাকে আমি মে’রে ফেলেছিলাম। তবে সাবিহা হাজার রিকুয়েষ্ট করলেও আমি উনাকে মারতাম। কারণ এটা উনার প্রাপ্য ছিলো। আর আমি সাবিহাকে হারাতে চাইনি বলেই এক্সিডেন্টের নাটক সাজিয়েছিলাম । ”
সামাদ কিয়ৎক্ষণ নির্বাক চাহনিতে রাগীবের দিকে চেয়ে রইলো। এ মুহূর্তে ঠিক কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত সে। আফসার সাহেবকে খুব মানতো সে। প্রথম প্রথম আফসার সাহেবের কৃতকর্মের কথা সে মেনে নিতে পারেনি। তার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। তবুও সে মেনে নিয়েছিলো। এরপর যখন আফসার সাহেবের মৃ’ত্যুর কথা সে জানতে পারে তখন সে স্বস্তি না পেলেও কষ্ট পায়নি। পুরো ঘটনায় সে ছিলো এক প্রতিক্রিয়াহীন ব্যক্তি। আজও ঠিক তেমনই হয়েছে। সে বুঝতে পারছে না, আফসার সাহেবের মৃ’ত্যুর জন্য রাগীবকে ধন্যবাদ জানাবে না কি তার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলবে,প্রতিবাদ করবে।
সামাদ রাগীবের দিকে চাইলো। অনেকটা তাচ্ছিল্যের সহিতই বললো,
” কিন্তু সাবিহা তো সব জেনে গিয়েছে। ওর রুম থেকেই ছবিটা নিয়েছি আমি।”
সামাদের হেন কথা শুনে রাগীবের পায়ের নিচ হতে মাটি সরে গেলো যেনো। কয়েক কদম পিছিয়ে এলো সে। মুখে হাত ঠেকিয়ে শঙ্কিত গলায় স্বগোতক্তি করলো,
” যার ভয় ছিলো ঘুরেফিরে সেটাই হলো!”
.
খালের পাশে সুনসান সড়ক ধরে হাঁটছে রাগীব ও সাবিহা। দুজনের মাঝে সবকিছু স্বাভাবিক। সাবিহা এমন ব্যবহার করছে যেনো সে কিছুই জানে না বা রাগীবের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই। তার এ শান্তশিষ্ট ভাবভঙ্গি দুপুর হতেই লক্ষ্য করছে রাগীব৷
সে প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলো যখন শুনেছিলো, সাবিহা তার সাথে আজ সময় কাটাতে চায়৷ সে এ নিয়ে সাবিহাকে নিষেধ করেনি। বিকেলে সাবিহাকে নিয়ে সে বেরিয়েছিলো। সাবিহার পছন্দের খাবার খেয়েছিলো। এখন সাবিহার কথানুসারেই সুনসান নীরব সড়ক দিয়ে তারা হেঁটে চলছে। দুজনের মাঝে চলছে টুকটাক কথাবার্তা। সাবিহার এ স্বাভাবিক আচরণ দেখে রাগীব আর চিন্তিত হয়নি। নিশ্চিন্তে সময় কাটিয়ে যাচ্ছে সাবিহার সাথে।
খালের পাশে সড়কের উপর বসে আছে দুজনে। দু জোড়া পা ঝুলছে খালের পাশে। সাবিহার চেহারা হাস্যজ্জ্বল আর রাগীবের চেহারায় দেখা মিলছে স্বস্তির ছাপ। দুজনে কথা বলছে সিসিলিতে চলে যাওয়ার ব্যাপারে। এ নিয়ে কথা শেষে তারা দুজনেই নীরবে কিছু সময় কাটালো। কিন্তু মধুর এ নীরবতা ভাঙলো তিক্ত এক কথায়। যখন সাবিহা অকস্মাৎ জিজ্ঞেস করলো,
” আমার এতো রিকুয়েষ্টের পরও তুমি আব্বুকে কেনো মেরে ফেললে রাগীব?”
রাগীব সম্মুখে চেয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে নিজ পক্ষের যুক্তি দেখাতে ঘুরে সাবিহার সম্মুখে চাইলো। সে কিছু বলতে নিলেই সাবিহা পরনের ওভার কোট হতে পি’স্ত’ল বের করে মুহূর্তেই রাগীবের মাথায় তাক করে শীতল কণ্ঠে বললো,
” নাও, ইটস ইউর টার্ন মিস্টার রাগীব শাহরিয়ার। ”
#চলবে
(লেখা কিছুতেই আগাচ্ছে না আমার। একে তো পড়ার চাপ, তারপর একটুও ইচ্ছা করছে না লিখতে। কিন্তু গল্প তো শেষ করতে হবে। তাই জোর করে হলেও লিখছি। আপনাদের এতো অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।)