#রিস্টার্ট,পার্ট_৪২
#পিকলি_পিকু
সকালবেলা জাহিদ প্রিয়মের ঠিকানা খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো। ওরা আর নাদিয়াদের বাসার কাছে থাকে না। তবে ওরা শহরের অপর পাশে চলে গেছে। প্রিয়মের কবরস্থানে গিয়ে খোঁজ পেয়েছে। বেলা বাড়তে বাড়তেই পিপি আর জাহিদ সেদিকে বেরিয়ে পড়লো। আজ বেনজির ফার্স্ট এইড বক্সে আইস প্যাক ও দিয়েছে। সেদিন রাহুর মার খেয়ে বেঁচে গেলেও আজ হয়তো রূপমের মার খেয়ে বাঁচবে না।
বলতে বলতে ঠিক দুপুর বেলা পৌঁছে গেল ওরা। প্রথমত প্রিয়মের মা ওকে চিনতে পারেনি। আর জাহিদের ও মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না। পিপি ই বলল, “আমরা কী ভেতরে এসে কথা বলতে পারি?”
ভিতরে আসার পর জাহিদ আর পিপি সোফায় বসলো। ভেতর থেকে প্রিয়মের বাবা আসলেন। পিপি বলল,
– শুধু কী আপনারা?
– আমরা দুজন ই।
– আপনাদের ছেলে রূপম?
– রূপম আলাদা থাকে। কী দরকার?
– উনি থাকলে ও ভালো হতো আরকি।
– কী জন্যে?
পিপি জাহিদের দিকে তাকালো। জাহিদ অনেক টা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে প্রিয়মের মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রিয়মের ব্যাপারে। ” কথাটা শুনেই তারা দুজন আকাশ থেকে পড়লো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর প্রিয়মের বাবা বলল,
– কী?
– ওর মৃত্যু,
– আত্ম*হ*ত্যা ছিল।
– কিন্তু কারণ।
– জানা নেই।
– বলতে এসেছি।
– শুনতে চাই না। আসতে পারো।
তিনি তাদের চলে যেতে বললেন। কিন্তু জাহিদ এখনো বসে আছে। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাও নিজেকে শক্ত করে বলল,
– ওকে ধ*র্ষণ করা হয়েছিল,
– চুপ!!!
প্রিয়মের বাবা একটি গর্জন করে উঠলেন। পুরো ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। প্রিয়মের মা ওনার হাত চেপে ধরলেন। এরপর তিনি নিজেকে শান্ত করে বললেন,
– কার কাছ থেকে শুনেছ?
– দেখেছি।
– অর্থাৎ?
– আমার সামনেই,
– এত বছর পর কেন?
জাহিদ ভয়ে চুপ হয়ে রইল। প্রিয়মের বাবা আবার গর্জন করে উঠলেন,
– এত বছর পর কী হলো হঠাৎ!
– আমি জাস্টিস চাই।
জাহিদ খুব ভয়ে ভয়ে বলল। প্রিয়মের বাবা সোফা থেকে উঠে জাহিদ কে ইশারায় দরজা দেখিয়ে দিলেন। পিপিও তাই জাহিদ কে নিয়ে আর বসে রইলো না। তারা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর প্রিয়মের মা তাদের পেছনে দৌঁড়াতে লাগলো, “দাঁড়াও! দাঁড়াও!” তার ডাক শুনে পিপি আর জাহিদ থেমে গেল। পিছনে ফিরতেই তিনি বললেন, “তুমি কী শুদ্ধ?”
একটি পার্কে জাহিদ, পিপি আর প্রিয়মের মা বসে আছেন।
– শুদ্ধ, তোমার কথা বলছিল ও সেদিন।
– কোনদিন?
– যেদিন মা*রা যাচ্ছিল।
– মানে?
– তুমি একটা কথা এতদিন গোপন রেখেছ। আমরাও রাখছি। কেউ জানে না।
প্রিয়মের মায়ের গলা ভেঙে আসছে। তিনি চোখ নীচের দিকে নামিয়ে রেখেছেন। জাহিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে,
– আন্টি, কী গোপন করছেন?
– ও আত্ম*হ*ত্যা করেনি।
– তো?
– মিসক্যারেজ।
জাহিদ আকাশ থেকে পড়লো। মিসক্যারেজ! কী করে? ও বলেছিল সাবধান থাকবে।
– সেদিন স্কুল থেকে আসার পর ওর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল। কষ্টে মেয়েটা কাতরাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারিনি, সাধারণ মাসিক ভেবেছিলাম। ডাক্তারের কাছে নিতে বলছিল। এক পর্যায়ে হাত জোড় করে বলল ও গর্ভবতী। ওর বাবা আর আমি ভেঙে পড়েছিলাম। এত রাতে নিজের অবিবাহিত কিশোরী মেয়ের গর্ভপাত! কে এই বাচ্চার বাবা? ওকে বিয়ে কে করবে? এসব ভাবতে ভাবতে ও সব বলল। ওর সাথে কী হয়েছিল। শুদ্ধের সাথে কী হয়েছিল। আর এখন শুদ্ধ আর ও কী করতে যাচ্ছে…
“বাবা, প্রমাণ আছে। কাল শুদ্ধ ভিডিও আনবে। আমি কেস করবো। এই বাচ্চা এর বড় প্রমাণ। ওকে বাঁচাতে হবে বাবা।”
প্রিয়মের বাবা ক্ষোভে তাকে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন। প্রিয়মের ভাই প্রিয়মকে ছাড়িয়ে নেয়।
“চুপ, এই বাচ্চা চলে যাক। এরপর তোকে দরকার হলে বিদেশে পাঠিয়ে দেব। কোনো লড়াই, কোনো কেস না।” রূপম এই কথা বলে প্রিয়মকে তার ঘরে দরজা বন্ধ করে দেয়।
“বাবা, ওকে হাসপাতাল নেওয়া যাবে না। ওকে এখানেই একটা ডাক্তার এনে ব্যবস্থা করতে হবে।” এই বলে রূপম বেরিয়ে যায়। আর প্রিয়ম এদিকে অরনীকে ফোন করেই যাচ্ছে। সে ফোন ধরছে না। শেষ পর্যন্ত প্রিয়ম সেখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ওর আরো একবার জ্ঞান এসেছিল, মধ্যরাতে। তখন একজন ধাত্রী এসেছিল। প্রিয়মের মা তার পাশে ছিল।
“মা, একবার শুদ্ধকে বলো। ও প্রমাণ আনতে যাবে। মা, আমরা যুদ্ধে জিতব। মা, আমার সন্তানকে মেরো না।”
ততক্ষণে ওর সন্তান ছিল না। তবে কিছুক্ষণ পর প্রিয়ম ও ছিল না। প্রিয়ম আর ওর সন্তান আল্লাহর কাছে চলে গেছে। পৃথিবীর মতো নিকৃষ্ট জায়গাতে এত সুন্দর ফুল থাকে না। প্রিয়মের নিথর দেশটির পাশে রূপম আর ওর মা বসেছিল। ওর বাবার সাহস হয়নি। তিনি সেদিন দু ফোঁটা চোখের জল ও ফেলেন নি। কারণ তখন তার কাছে বাড়ির সম্মান বাঁচানো টা বড় ছিল। তিনি ধাত্রী কে টাকা দিয়ে বিদায় করে তার ছেলে কে নিয়ে একটি নাটক সাজালেন। আত্ম*হ*ত্যার নাটক। কারণ তার মেয়ে একজন ধ*র্ষিতা, তার উপর আঙুল তুলবে সবাই। ক্ষমতাধর লোকগুলো তার এত দিনের গড়া মান কেড়ে নিবে। এর চেয়ে আত্ম*হ*ত্যা অনেক সম্মানের।
পরদিন তারা পুলিশ ডাকেননি। পোস্ট মর্টেমও হয়নি। এমনিই দাফন হয়।
– আন্টি, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?
– করো।
– আপনি সেদিন অরনীকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন কেন?
– কিশোরী মেয়ে আমার। ওর সব কথা স্বাভাবিকভাবেই ওর বেস্টফ্রেন্ড জানবে। তখন আমি ভেবেছিলাম অরনী জানে। ও আমাকে বলতে পারতো। আমি কিছু করতাম। তখন রাগের মাথায় করেছিলাম।
– কিন্তু অরনী তো জানতো না।
– পরে জেনেছি। ওর অ্যাক্সিডেন্টের পর। রাহু বলেছিল ও নাকি আত্ম*হ*ত্যা করতে গিয়েছিল। খারাপ লাগছিল তখন। মনে হয়েছিল আমার একটা থাপ্পড় ওকে বাধ্য করেছিল। তাও কিছুই বলতে পারিনি। ও যদি এসব জানতে পারে, তখন ও কী করবে জানিনা। তাই পরেও আর বলিনি। সাহস হয়নি।
– ও জানে।
– তুমি কী করে জানো?
– আন্টি, আপনি জানেন, প্রিয়ম বলতো ওর বান্ধবী অরনীর সাথে আমাকে বিয়ে দেবে। পরিচয় করিয়ে দিতে চাইত। আরো অনেক কিছু। আমাদের তখন পরিচয় হয়নি। পরে না জেনেই অ্যারেঞ্জ মারেজ হয়েছে। বিয়ের পরপরই বুঝেছি ও সেই অরনী।
– কী!
– হ্যাঁ। সবই কাকতালীয় না নিয়তি আমি তা জানি না। তবে কাল ও জেনে গেছে সব। আমি প্রিয়মের বন্ধু এসব গোপন ছিল। প্রিয়মের সাথে ঘটা ঘটনা সব জেনে গেছে।
– তোমার কথা বলনি?
– বলেছি।
– ও কী বলেছে?
– চলে গেছে।
– মানে?
– আমরা আর একসাথে নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। আন্টি, বাদ দিন। আমার অনেকদিন লেগেছে সত্যের মুখোমুখি হতে। আমি ভয় পেতাম। এখন আমি আর ভয় পাব না। এখন আমি জাস্টিস চাই।
– কী করে? পাগল তুমি! ওরা কারা তুমি তো জানো। যদি অরনী বলতো বুঝতাম।
– আমি জানি ওরা কারা। তবে আমি আমার সাধ্যমত শেষ চেষ্টা করবো।
– কী চেষ্টা করবে? কোনো প্রমাণ নেই। শুধু শুধু আমার মৃত মেয়েটার চরিত্র বিশ্লেষণ হবে।
– আন্টি আপনি মা হয়ে বলছেন! ওর তো দোষ ছিল না।
– জানি। এ দেশের মানুষের কাছে আমার মেয়ে অনেক কটু কথা শুনবে। আমি চাই ও কবরে শান্তি পাক।
– ও পাচ্ছে না। ও আমার স্বপ্নে আসে, ও শাস্তি চায় ওদের।
– আর তা সম্ভব না। এক কাজ করো শুদ্ধ, বাড়ি ফিরে যাও। অরনী হয়তো তোমাকে ভুল বুঝছে। আমি নিজে ওর সাথে কথা বলব। তোমার যে দোষ নেই তা ওকে বোঝাব। তোমরা আবার শুরু করো।
– আন্টি, আমি যা করেছি এরপর ও আর আসবে না। সম্ভব না আমার সাথে থাকা। আমি দিনের পর দিন মিথ্যা বলেছি। ও যে না জেনে কষ্ট পাচ্ছিল, স্বার্থপরের মতো ওকে কষ্ট পেতে দেখছিলাম। কিন্তু কিছুই বলিনি। এসবের পর ও আর আমার কাছে আসবে না।
– ভেঙে পড়োনা। আর পাগলামি করো না। ওরা তোমার ক্ষতি করতে পারে।
– আমার আর হওয়ার মতো কোনো ক্ষতি নেই। আমি এখন এমন পর্যায়ে যে হারাবার মতো কোনো কিছু নেই।
– তাও। মাথা ঠান্ডা রাখো।
জাহিদ সেখান থেকে চলে আসার সময় ওর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিল, মিসক্যারেজ টা হলো কী করে? এতে কী ওদের কারো হাত আছে? যাই হোক, আজ একদিন পর বাসায় আসলো জাহিদ। বাসা টা ফাঁকা ফাঁকা। এখনো নাদিয়ার লিপস্টিকটাও ড্রেসিং টেবিলে আছে। ওর বালিশটাও একই জায়গায়। ওর সব কিছুই আছে আগের মতো। শুধু ও নেই। ও আর জাহিদের কাছে ফেরত আসবে না। সম্পর্ক টা শেষ হয়ে গেছে। এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই জাহিদ নাদিয়ার স্থানে শুয়ে ওর অস্তিত্বকে অনুভবের চেষ্টা করে। যদি জানতো এটাই শেষ তো আরেকবার শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরতো, চুমু খেত। তারপর বিদায় জানাতো ওর প্রিয়তমা কে।
পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে কিছু কাজ করে জাহিদ পুলিশ স্টেশনে যায়। ইন্সপেক্টর ওর কথা শুনে হাসতে থাকে।
– কীসের কমপ্লেইন?
– বুলিং আর রেই*প।
– আপনাকে রে*ইপ?
– আমাকে না। আমার বন্ধুকে।
– কোথায় উনি? দেখছি না তো।
– মা*রা গেছে।
– হুম। সো স্যাড। কবে?
– অনেক বছর আগে।
– তাহলে তো হবেনা। আচ্ছা, আপনার আর কোনো প্রমাণ আছে?
– নেই।
– শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন কেন?
– সময় নষ্ট না। আমি বিচার চাই।
– ম্যাগনেফিসেন্টের লোকদের চেনেন? মানুষ প্রমাণ নিয়ে পারে না আর এনার হাওয়াই বুলি। এই ওনাকে বের কর। আমাদের আরো কাজ আছে।
এই কথা বলে জাহিদ কে ওরা বের করে দেয়। এখন ও কোথায় যাবে? কাউকে তো বলা জরুরি। কেউ তো থাকবে ওকে সাহায্য করার মতো। এদিকে ফাইয়াজ ওরফে রোহান নাদিয়াকে ফোন করেছে,
– কী হয়েছে? আর আসবে না?
– না। আমি সত্যি জেনে গেছি।
ফাইয়াজ জানে। তাও খুব আগ্রহ নিয়ে বলল,
– কী সত্যি? বলো।
– প্রিয়মই ছিল।
– তো তোমার স্বামী জানতো না?
– জানতো। ওরা বন্ধু ছিল।
– তাও চুপ ছিল? তুমি কী শিওর ও জড়িত নয়?
– ও যদিও ভিকটিম। তাও বলেনি কিছু।
– তুমি এখন কী করবে বলে ঠিক করেছ?
– জানিনা।
– আর তোমার স্বামী?
– ও নাকি জাস্টিস দেবে। কী করে দেবে? জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না! আমার হয়তো এ সত্যি জানাই উচিত হয়নি।
– এভাবে বলছ কেন? আচ্ছা, তুমি তো আর আসছ না?
– না।
– আশা করি তুমি এই শক থেকে বের হতে পারবে।
– জানিনা।
– তুমি কী তোমার স্বামী কে ক্ষমা করবে?
– এখনো ঠিক করিনি।
– করো না। ও চুপ ছিল কেন? আচ্ছা, কেন জানি মনে হচ্ছে ও পুরো সত্যি ও বলেনি। এখনো বাকি। তুমিই চিন্তা করো ও যদি দোষী না হয় তবে এতদিন কেন চুপ ছিল? কীসের ভয় যদি ও নিজেই ভিকটিম?
– ওরা নাকি ওর পরিবারের ক্ষতি করবে বলেছে,
– আরে রাখো এসব! ও কী কচি খোকা ছিল? আর ধরলাম ছিল। এত বছর পর ও ওর হুঁশ আসেনি? যাই হোক, জাস্টিস চাওয়াটাও হয়তো লোক দেখানো। তুমি দুর্বল হয়ো না। শক্ত থাকো। ও এখন অনেক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল এর চেষ্টা করবে।
– আচ্ছা পরে কথা বলি।
– ঠিক আছে।
ফাইয়াজ ফোন রেখে একটু হাসলো। ওর কাছে একটা মেসেজ আসলো জাহিদ পুলিশ স্টেশনে গিয়েছে। এখন ওর কী করা উচিত ও জানে। একটু পর ফারাজ আসলো ওর কক্ষে,
– স্কলারশিপ ছেলেগুলো কী করছে?
– এখনো পড়ে আছে।
– একটা ছোট কাজ ও পারিস না। তোর জন্য আমার আবার আসা লাগলো।
– ভাইয়া, ঐ নতুন টিচাররা কোথায়?
– ওরা ওদের জায়গায়। তুই স্টুডেন্ট দেখ।
জাহিদ পরদিন ভোরে প্রিয়মের কবরস্থানে গেল। সবসময় ভোরেই যায়। এত ভোরে কেউ আসে না। তাই কেউ চিনতো না ওকে। কিন্তু নাদিয়ার সাথে বিয়ের পর আর আসেনি এখানে। আজ এতদিন পর এসে কবর জিয়ারতের সময় কেঁদেই ফেলল। ইদানিং প্রিয়ম আর স্বপ্নেও আসে না। রাগ করেছে? সত্যি তো নাদিয়া জেনেই গেছে। এখন তো খুশি হওয়ার কথা। যাওয়ার পথে আবার রাহুর সাথে দেখা হয়ে গেল। রাহুর রাগ দেখে জাহিদ চোখ নামিয়েই চলে আসলো। অফিসে গিয়ে বসার পর একটা মেইল আসলো জাহিদের কাছে। মেইল টা পড়ে অবাক হলো না। এটাই আশা করেছিল। ওকে চাকরি থেকে ডিসমিস করা হয়েছে। কাজ গুলো ওর ফরিদ সাহেবকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এখনো বিচারের লড়াইটা শুরুই করলো না, আর ওরা এসব শুরু করেছে। সবাই খুব রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এই মাসটা ওর এখানে শেষ মাস। এইসব হোক না হোক সারা করাচ্ছে। বলতে না বলতেই সারার কল ও কলে আসলো।
– কী চাও এখন?
– কিছু না। খোঁজ নিচ্ছি।
– কী খবর চাও?
– এই যে, কেমন চলছে।
– কথা না ঘুরিয়ে আসল কথায় আসো। তুমি শুনতে চাচ্ছ সেই রাতে পরে কী হয়েছিল? সেই রাতে অরনী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর একটু আগে আমার জবটাও চলে গেছে। এখন বলতে গেলে আমার কাছে আর কিছুই হারানোর মতো নেই। আমি নিঃস্ব। তবে জেনে রাখো পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ হচ্ছে সেই যার কোনো দুর্বলতা থাকে না, যার হারানোর মতো কিছু নেই। আমার এই মুহুর্তে জীবনটা ছাড়া আর কিছু নেই। আর এই জীবনের দোহাই, তোমাদের সবাইকে শাস্তি দিয়েই ছাড়বো!
এই কথা বলে জাহিদ ফোন রেখে দিলো। সারা ভাবতে লাগলো এইসব ফাইয়াজের কাজ। ও নিশ্চয়ই ওর চাকরি ডিসমিস করে দিয়েছে। কিন্তু সারা চাইতো জাহিদ নত হোক ওর সামনে। ও জাহিদকে যা বলবে, সে তা শুনবে। কোনো উপায় থাকবে না জাহিদের কাছে। জাহিদকে অসহায় দেখতে ওর ভালো লাগে। কিন্তু উল্টো তার সাহস দেখে অবাক হয়েছে।
বেলা বারোটার সময় নাদিয়াদের বাসায় একটা বেল বাঁজলো। দরজা খুলেই নাদিয়ার মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কতদিন পর প্রিয়মের মা এসেছে। তবে তাকে দেখে নাদিয়ার বুঝতে বাকি রইল না জাহিদ ও সেখানে গিয়েছিল। তিনি বাড়তি কোনো কথাই বললেন না। যেমন এটা আত্মহ*ত্যা ছিল না। কারণ তখন নাদিয়ার মন আরো ভেঙে যাবে। তিনি নাদিয়া কে জাহিদ কে বোঝাতে বললেন,
– শুদ্ধ ছেলেটা ওদের সাথে পারবে না। ওরা অনেক ক্ষমতাধর।
– আমি কী করবো?
– তুমি ওকে বলো ফেরত আসতে। ওর কোনো দোষ নেই।
– তুমি কী করে ওর জন্য মায়া করছো আন্টি?
– কারণ প্রিয়মের জন্য ও আমার মায়া হয়। যদি প্রিয়মের জন্য হয় তো শুদ্ধ কেন না? শুদ্ধ আর প্রিয়ম তো ভিকটিম ই।
– তবে ও আমাকে কিছু কেন বলেনি? লুকিয়েছিল কেন? মিথ্যেবাদী! ওর যদি দোষ ই না থাকে,
– ভিকটিম ব্লেমিং। আজ যদি আমি রাস্তায় বের হই আমার মেয়ের বিচার চাইতে, তো মানুষ আমার মেয়েকে খারাপ বলবে। ঠিক যেভাবে তুমি শুদ্ধ কে খারাপ ভাবছো, সেভাবেই। ভেবে দেখ, ও আগে বললেও তুমি ওকে দোষারোপ করতে। এ কারণেই ও বলেনি। এসব কারণে ভিকটিমরা মুখ খুলে না। কিন্তু এখন দেরি হয়ে গেছে। তাই ওকে বোঝাও। আমরা বিচার পাব না। শুধু শুধু ও হারিয়ে যাবে।
নাদিয়া আন্টির কথা ভেবে দেখল। আন্টি যাওয়ার পর নাদিয়া জাহিদকে ফোন করতে চাইলো। কিন্তু রাহু বারণ করলো।
– ও গিয়ে বুঝিয়েছে আন্টি কে। ইনোসেন্ট ফেস, সবাই ধোঁকা খেয়ে যায়। আমার ওকে চেনা হয়ে গেছে। সেদিন প্রিয়মের কবরেও গিয়েছিল।
– কী?
– হ্যাঁ। প্রিয়মের কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করছিল। ঢং যত্তসব! এতদিন তো দেখিনি। সব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল!
নাদিয়া আর জাহিদ কে ফোন করল না। তবে ওয়াসি ও ওর খবর নিচ্ছে না। ওকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে জানানো দরকার।
অফিসে জাহিদের কাজ ছেড়ে আসতে হলেও অনেক কাজ করা লাগবে। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা। এত রাতে লিফ্ট বন্ধ আছে তাই সিঁড়ি দিয়েই উঠল। সিঁড়ির বাতি ও নেভানো কারণ রাত বারোটার পর সব বাতি এমনিতেই নিভে যায়। জাহিদ বাড়ি ফিরে ভাবছে একদিন ওর ভাইদের সাথে বসে সব খুলে বলবে। আর একজন উকিল দেখা লাগবে। এই বাসা ছেড়ে ছোট বাসায় উঠতে হবে। একটা অন্য চাকরি দেখতে হবে। অনেক কাজ বাকি। সেই ভেবে বাড়ির প্রতিটা সুইচ জ্বালিয়ে দেখছে। বিদ্যুৎ ই নেই! তাই অন্ধকারেই এসে বসলো সোফায়। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে একটা আওয়াজ আসলো। প্রথমে জাহিদ বিষয়টা এত পাত্তা দেয় নি। কারণ এই বাসায় একা থাকার অভ্যাসটা ওর চলে গিয়েছে। কিন্তু ওর মনে পড়লো এই বাসায় তো এখন ও ছাড়া আর কেউ নেই। তবে নাদিয়া ফিরে এসেছে? এই কথা ভাবতেই জাহিদের ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি ফুঁটে উঠলো। এখন নাদিয়া সহ এই লড়াই করা যাবে। কিন্তু ও লক্ষ্য করলো ওর ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। একই নাম্বার থেকে আরো কিছু মেসেজ আছে কিন্তু ও পড়েনি।
” বাঁচতে চাইলে বাসায় যেও না। অন্য কোথাও যাও।”
” পিপির বাসায় আজ রাত আশ্রয় নাও। ভুলেও বাসায় যাবে না।”
” উপরে উঠবে না। ভেতরে কেউ আছে।”
” এই মুহূর্তে কোনো শব্দ না করে বাসা থেকে বেরিয়ে আসো। বাঁচতে চাইলে এটাই করো। তোমার বাসায় এই মুহুর্তে একজন কিলার আছে। ”
জাহিদ ঘাবড়ে গেল। ও ফোন বন্ধ করে আস্তে আস্তে সেখানে থেকে উঠলো। তখনই ভেতরে কারো ফোন বেঁজে উঠলো। আর জাহিদ দরজা খুলতেই ওর পেছনে ধারালো কিছুর আঘাত অনুভব করলো।
সাতদিন পর….
পিপি নাদিয়া কে ফোন করছে। নাদিয়া রাগ করে তুলছে না। অবশেষে পনের বারের সময় তুলল,
– কী বলতে চান? আমি ওর ব্যাপারে কিছু শুনব না।
– না শুনতে হবে। সাতদিন ধরে ওর কোনো খোঁজ নেই। আর তোমার কোনো খোঁজ নেওয়া লাগবে না। ওর ভাইদের নাম্বার দাও আমি নিচ্ছি।
– ওর অফিসে নিয়েছেন?
– ওর চাকরি শেষ। ওভার। এটা শেষ মাস ছিল তবে ওর খোঁজ নেই। সাতদিন আগে শেষ দেখা গিয়েছিল ওকে।
– কোথায় আছে? (কাঁপা কাঁপা গলায়)
– জানি না। সেজন্যই বলছি। ওর ভাইয়ের নাম্বার দাও।
– আমিই জিজ্ঞেস করছি।
নাদিয়া জাহিদের ভাইদের ফোন করেও কোনো খবর পেল না। উল্টো তারা বিচলিত হলেন। ঢাকা এসে খুঁজতে চাইলেন। নাদিয়া তাদের মানা করে দিল। এরপর ও রাহুকে নিয়ে জাহিদের বাসায় গেল। দাড়োয়ান ও ওকে এই সাতদিন দেখেনি। এই কথা শোনার পর নাদিয়ার একটু ভয় লেগে উঠলো। তারপর এক্সট্রা চাবি দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো বসার ঘরটা একটু অগোছালো আর মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে আছে। মেঝেতে পড়ে থাকা শুকনো রক্ত দেখে নাদিয়া হাত পা ছেড়ে দিল। ওর মাথা একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। নাদিয়াকে এই অবস্থায় দেখে রাহু ওকে ধরে সোফায় বসালো। এরপর সে খুব ভয়ে ভয়ে ভেতরের দিকে গেল। নাদিয়ার আর সাহস হলো না ভেতরের দিকে যাওয়ার। ও খুব খারাপ টা কল্পনা করে ফেলেছে। সেই কল্পনাটাকে সত্যি হতে দেখতে চায় না। ভেতরে কে আছে, কী আছে, ও কিছুই দেখতে চায়না।
(চলবে)