#রিস্টার্ট,পার্ট_৪৩
#পিকলি_পিকু
রাহু ভেতরে গিয়ে দেখলো খারাপ কিছু হয়েছে কিনা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। সে বাইরে এসে নাদিয়া কে বলল কিছু নেই। নাদিয়া ভয়ার্ত শুকনো মুখ দেখে রাহু বুঝতে পারলো নাদিয়ার এখনো জাহিদের জন্য একটা অনুভূতি আছে। একটু না, অনেকটুকুই,
– পুলিশ স্টেশনে চল রাহু।
– কেন?
– ও সাতদিন মিসিং। এখানে রক্ত। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে ওর সাথে।
– হোয়াট ডু ইউ মিন?
– আন্টি বলল ও হারিয়ে যাবে। ও বোধহয় হারিয়ে গেছে। ওকে মনে হয় গায়েব করে ফেলেছে।
এবার রাহু ও ভয় পেয়ে গেল। ওরা দুই ভাইবোন ওদের বড় ভাইকে ফোন করে নিকটস্থ থানায় গেল রিপোর্ট লেখাতে।
– আপনার স্বামী সাতদিন নিখোঁজ আর আপনি আজ জানলেন?
– জ্বী।
– খোঁজ নেন নি কেন?
– জানতাম না। প্লিজ ওকে খুঁজে বের করুন।
– আপনি শিওর উনি নাটক করছে না?
রাহু রাগ হয়ে বলল,
– আশ্চর্য! নাটক কেন করবে?
– কারণ মনে হচ্ছে আপনার বোন আর আপনার দুলাভাইয়ে সব ঠিক নেই। উনি আপনার বোনকে দুশ্চিন্তায় ফেলে নিজে কোথাও লুকিয়ে আছে। দৃষ্টি আকর্ষণ। মানে আপনার বোনের মনে তার জন্য প্রেম ভালোবাসা চেক করছে।
– আশ্চর্য! ওনার ঘরে রক্ত শুকিয়ে আছে। আর ওনার অনেক শত্রু আছে।
– রং ও তো হতে পারে।
– আমি একজন ডাক্তার।
– টাটকা ছিল?
– না বললাম তো শুকনো।
– লোহার জং হতে পারে। কাঁদা হতে পারে।
– এখন আমি ল্যাব টেস্ট করিয়ে আনবো?
– ওকে, একটা ডায়েরি করে নিচ্ছি। হাসপাতাল মর্গে ছবি পাঠিয়ে দেব।
মর্গ শুনে নাদিয়ার শ্বাস আটকে আসলো। রাহু নাদিয়ার কাঁধে হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দিল। হঠাৎ নাদিয়ার মনে হলো ও অনেক বড় ভুল করেছে। এখন ওর যদি কিছু হয় তো ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। একটু পর সালাম ভাইয়ের কল আসলো। ওরা ডায়েরি করেছে। তবে নাদিয়া অসুস্থ হয়ে গেছে। ও কোথায় আছে? কিছুক্ষণ পর সাতদিনের পুরনো লাশ গুলো মর্গে দেখতে গেল। নাদিয়ার সাহস হচ্ছিল না, তাই রাহুই দেখে আসলো। না না, কেউ জাহিদের আশে পাশেও না। বাইরে এসে নাদিয়াকে বলার পর ও নাদিয়ার শান্তি হচ্ছিল না। সিসিটিভিতে ও সন্দেহজনক কিছু নেই। তবে এক রাতের ফুটেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঐদিন ই কিছু হয়েছে।
ঘটনার আরো একদিন পার হয়ে গেলো। ওর হঠাৎ মনে হলো রাহেলা খালা কে জিজ্ঞেস করা উচিত,
– হ্যালো খালা, জাহিদ কোথায়? ওর কোনো খোঁজ পেয়েছেন?
– কেন? মামায় কই আমি কেমনে জানমু? খালা আপনি আবার বাপের বাড়ি থেইকা কবে আসবেন?
– জানিনা। আপনি কী বাসায় যান না?
– না। মামায় ফোন দিয়া কইসে না যাইতে।
– কবে?
– এক সপ্তাহ হইব।
– আপনি এরপর আর যান নি?
– না। ঢুকার আগে কল দিয়া কইসে এই কয়দিন না কইলে না যাইতে।
নাদিয়া ফোন টা রেখে দিল। তবে ও ফোন দিতে বারণ করেছে। কেন করেছে? নাদিয়ার জাহিদের ওপর সন্দেহ আরো বাড়ে। ওর ফোনের লাস্ট লোকেশন চেক করা হলো। পুলিশ বলল শেষ বার ওর ফোন ছিল সাভারের দিকে। রাহেলা খালার সাথে সেদিন ই কথা বলেছে। ও সাভারের দিকে কী করবে? ওখানে ওর কে আছে? এসব চিন্তা করতে করতে ওর ফোনে সেই চেনা নামে কল আসলো। নাদিয়া ফোন টা তুলতেই সেই চেনা কণ্ঠ বলল, ” আমি ঠিক আছি। আমাকে খুঁজবে না। থানা পুলিশ করার দরকার নেই। আর পারলে নিজের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুলো সেই বাসা থেকে নিয়ে আসো।” এই কথা টা শোনার পর নাদিয়ার খুব রাগ হলো। ও আর পাল্টা কোনো কথা বলল না। রাগে কষ্টে ঘৃণায় নাদিয়া ওর ফোনটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেলল। নিকৃষ্ট জঘন্য লোক! সে আবার ওর অনুভূতি নিয়ে খেলেছে। এখানে ওকে নিয়ে চিন্তা করে নাদিয়া মরে যাচ্ছিল আর সে সাভারে গিয়ে বসে আছে। রাহু বুঝতে পারলো ওর বোন আবার ধোঁকা খেয়েছে।
সেদিন কী হয়েছিল?
মেসেজ গুলো দেখার পর জাহিদ বুঝতে পারল এখানে থাকা আর ঠিক হবে না। ভিতর থেকে ফোনের আওয়াজ আসার শব্দে বের হওয়ার সময় জাহিদ ওর পিঠে আঘাত অনুভব করে। সেই আঘাতের পর জাহিদ বুঝতে পারে ওর জীবন হয়তো এখানেই শেষ হতে চলেছে। তবে শেষ বারে মতো লড়াই ও করবেই। অবশেষে পেছন ফিরে লোকটা কে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে রাস্তায় নেমে আসে। আঘাত খুব একটা বেশি না তবে এই মুহুর্তে হাসপাতালে গেলে এখনো বাঁচতে পারবে। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর মনে হলো ভেতরে গিয়ে দাড়োয়ান চাচাকে জাগিয়ে বললেও তো পারতো। এখন আবার ঐদিকে যাওয়া বিপদজনক। পিপি স্যারকে ফোন করা যেতে পারে। কিন্তু ওর পেছনে যেন কেউ আসছে। জাহিদ পেছনে ফিরে হাত দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতেই ওর উপর এলোপাথাড়ি ছুরির আঘাত আসতে থাকে। সেই আঘাতে ওর হাত বাহু ক্ষত বিক্ষত হয় আর ও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তাক্ত অবস্থায় জাহিদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তবুও সে কিলারের চেহারা দেখতে চায়। কে মারতে এসেছে? কিলার ওর সামনে এসে ওকে শেষ আঘাত করার আগেই কেউ এসে কিলারকে আঘাত করে বসে। কিলার মাটিতে পড়তেই জাহিদ দেখতে পায় এক ছন্নছাড়া যুবককে। যুবকটি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে বললাম না বাসায় না যেতে! এরপর ও কেন ঢুকলেন?” জাহিদ লোকটাকে চিনতে পারল না। সাথে সাথেই পেছন থেকে আরো কয়েকজন সেই কিলার সাদৃশ লোকেদের আগমন ঘটলো। তারা জাহিদ ও সেই ছেলেটিকে আক্রমণ করছে। নিস্তব্ধ এই গলির মধ্যে দুজন মানুষকে চার পাঁচজন মিলে মেরে ফেলছে কিন্তু খুব একটা শব্দ হচ্ছে না। আক্রমণকারী ও রক্ষাকারী উভয়ই খুবই প্রশিক্ষিত।
সেই ছেলেটি এক হাতে সব কিলারদের মারছে আর আরেক হাতে জাহিদ কে বাঁচাচ্ছে। কে এই ছেলে? অবশেষে আক্রমণকারীরা মাটিতে আহত হয়ে পড়ে আছে। আর জাহিদ সেই ছেলেটির হাতে ভর দিয়ে রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসছে। ওর খুব রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অস্পষ্ট উচ্চারণে জাহিদ ছেলেটিকে বলল,
– আপনি কে?
– সময় আসলে জানতে পারবেন।
অবশেষে একটা অ্যাম্বুলেন্স আসলো। সেই অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে দুইজন বের হলো। একজন ওর খুব পরিচিত। সে হলো নকল ওয়াসি। নকল ওয়াসিকে দেখে জাহিদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগলো। ওরা কী ওকে মেরে ফেলবে? ওয়াসি জাহিদ কে জিজ্ঞেস করলো, “ব্লাড গ্রুপ কী?” এটা বলার আগেই জাহিদ জ্ঞান হারালো।
ওয়াসি জাহিদের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতেই ছেলেটা বলল,
– পকেটে আইডি কার্ড আছে বোধহয়। চেক করো।
– জ্বী।
ওয়াসি ব্লাড গ্রুপ চেক করে হেড কোয়ার্টারে বলে দিল রক্ত রেডি রাখতে। অ্যাম্বুলেন্স ছাড়তেই সে বলল,
– AC27 আপনি আসবেন না?
– না। ওর বাসার তালা মারতে হবে। আর ওর ফোন নাও। খোঁজ নিতে হবে ওদের সিঁড়ি কে মুছে। সকাল হওয়ার আগে রক্ত মোছাতে হবে। অনেক কাজ।
– ও হ্যাঁ।
অ্যাম্বুলেন্স ছাড়তেই AC27 ওরফে বুলু আরেকটি গাড়ি দেখতে পেয়ে ওদের ইশারা করে। এরপর রাস্তায় পড়ে থাকা আক্রমণকারীদের তুলে সেই গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সে জাহিদের বিল্ডিংয়ে গিয়ে দেখলো গার্ড ঘুমাচ্ছে। ওর বুঝতে আর বাকি রইলো না তাকে আগেই কাবু করা হয়েছে। উপরে উঠে দরজা লক করে সিসিটিভির ঘরে গিয়ে দেখলো ক্যামেরা বন্ধ। খুবই পরিকল্পিত এই ঘটনা।
পরদিন রাহেলা খালাকে আসতে দেখে একজন সোর্স ওয়াসিকে জানায়। ও সাথে সাথে জাহিদের ফোন খুলে বলে বাসায় না ঢুকতে। এই কিছুদিন সাভারের একটি আন্ডারগ্রাউন্ডে জাহিদের চিকিৎসা চলছিল। জ্ঞান ফেরার পর জাহিদ দেখলো ওয়াসিকে। এরপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
– তুমি! এখানে কী করছ?
– তুমি ঠিক আছো?
– আছি। তুমি আমাকে এখানে কেন এনেছ? আমি কোথায়?
– নিরাপদ জায়গায়। বিশ্রাম নাও। আমি তোমাকে পরে সব বলছি।
– তুমি কে? ওয়াসি তো নও।
এই কথা শোনার পর নকল ওয়াসি জাহিদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে জাহিদ কে দেখে গেল। জাহিদ তার আঘাত গুলো নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। একটু উঠে বসার চেষ্টা করছে। ওয়াসি এসে ওকে সাহায্য করলো। জাহিদ বালিশে হেলান দিয়ে বসে বলল,
– এখন তো বলতে পারো।
– বলছি। আমি ওয়াসি না। ওয়াজির।
– ওয়াজির!
– হুম।
– তবে আসল ওয়াসি কোথায়?
– ওপরে।
এই কথা শোনার পর জাহিদের চেহারা বদলে গেল। তার খুব কান্না পেল। অপরাধ বোধে জাহিদ বলে উঠলো,
– আ’ম স্যরি ওয়াসি!
– কেন?
– ও ওপরে?
– এটা আন্ডার গ্রাউন্ড। ও ওপর তলায়।
– ও বেঁচে আছে?
– মরার মতোই।
– আপনি ওকে চেনেন?
– আমি ওর ভাই, ওয়াজির। সাফওয়ান খান ওয়াজির।
ওয়াসি বুঝতে পারলো ও সেই দত্তক নেওয়া ভাই। কিন্তু ও না গায়েব ছিল?
– তুমি তো গায়েব ছিলে?
– বলতে পার।
– তুমি আমাকে সব খুলে বলতে পারবে?
– বলছি, আমি ওনাদের দত্তক নেওয়া সন্তান, ওয়াসির বড় ভাই। আমাকে আম্মু কুড়িয়ে পেয়েছিল। পরে এডপ্ট করে। কিন্তু তারপরই আম্মু ওয়াসিকে কনসিভ করে। কিন্তু এতে আমার আদরের কোনো কমতি হয়নি। আমি তো অনেকদিন জানতাম ই না আমি বায়োলজিকাল চাইল্ড না। আমার বাবার আর্কিটেক্চার ফার্ম আছে, আর আম্মু একজন আর্টিস্ট। আমার আর্ট এ ইন্টারেস্ট ছিল আর ওয়াসির আর্কিটেকচার। বড়টা মায়ের মতো, ছোটটা বাবার, পারফেক্ট ফ্যামিলি। কিন্তু বাবা বললেন আমাকে ক্যাডেটে পড়তে। বাবার নাকি ইচ্ছা ছিল। আমার ও ইন্টারেস্ট হলো। আমি চলে গেলাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। এর মধ্যে ওয়াসি ও ভালো স্কুলে পড়তো। না জানি কোন অশুভ সময়ে যে বাবা চিন্তা করলো ওয়াসি ম্যাগনেফিসেন্টে পড়বে। সব শেষ হয়ে গেল। তুমি তো শুদ্ধ, তাই না?
– জ্বী।
– কী হয়েছিল? সেদিন কী হয়েছিল?
– একদিন না। প্রতিদিন হতো।
– কী হয়েছিল ওর সাথে?
– অনেক জঘন্য ব্যবহার …
শুদ্ধ আর ওয়াসি এই স্কুলে নতুন টার্গেট। ওদের বিভিন্নভাবে বিরক্ত করা হয়। থাপ্পড় মারার সেই খেলা হোক বা ওদের দিয়ে উপর নীচে পাঠানো। ওয়াসি আর শুদ্ধ সব সহ্য করতে লাগলো। অবশেষে একদিন ওদের ডার্ক রুমে ডাকা হয়। সেখানে ওদের দিয়ে উদ্ভট সব কাজ করাতে বলে ফাইয়াজ। শুদ্ধ রাজি হয়ে গেলেও ওয়াসি প্রতিবাদ করে।
“আমরা পারব না! এসব অন্যায়। তোমাদের নামে কমপ্লেইন করলে বুঝবে কী অবস্থা হবে তোমাদের!”
প্রথম দিন ওয়াসি চলে আসলেও পরদিন ওদের আবার ধরে আনা হয়। সেইদিন ওদের নাকে খত দিতে বলা হয়। শয়তানের মতো একটি মুখোশ পরিহিত ফাইয়াজ ওদের সামনে বসা, শুদ্ধ আর ওয়াসি দাঁড়িয়েছিল। যে আগে খত দিবে সে আগে ছুটি পাবে। শুদ্ধ খত দিতে যাওয়ার আগে ওয়াসি শুদ্ধের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, “আজকে ঝুকলে সারাজীবন ঝুকবি।” শুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর অর্ঘ্যদীপ আর আজফার এসে ওদের দুজনকে থাপ্পড় দিতে থাকে। ওয়াসি পাল্টা আঘাত করলে আজফার আর অর্ঘ্যদীপ দুজনেই ওর উপর চড়াও হয়। “খুব সালমান খান জন্য হওয়ার শখ না!!! নাম সালমান খান হলেই কেউ সালমান খান হয় না।”
এই দৃশ্য দেখে শুদ্ধ ভয়ে নাকে খত দিয়ে ফেলল। কিন্তু ওরা তবুও ওয়াসিকে মারতে থাকলো। শুদ্ধ ওয়াসির পক্ষ থেকেও করলো তবুও ফাইয়াজের মন গলেনি। অবশেষে ওয়াসিকে প্রত্যেকের পায়ের সামনে ঝুঁকে নিজের নাক ওদের পায়ে লাগাতে হলো। এরপর শুদ্ধ ওয়াসিকে নিয়ে চলে আসলো। ওয়াসির আত্মমর্যাদা সেদিন ভেঙে গিয়েছিল। লজ্জায় সেই ঘটনা সে কাউকে বলতে পারেনি। অনেকদিন পর যখন সে আবার আসে স্কুলে তখন দেখতে পায় সবাই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওয়াসি কারো দিকে তাকাতে পারতো না। শুধু হাসি শুনতে পেত। অবশেষে সে স্কুল বদলাতে চাইলো। শুদ্ধের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাই সে যায়নি। কিন্তু ওয়াসি এই স্কুল ছেড়ে চলে যায়।
– এরপর ওয়াসি অন্য স্কুলে ভর্তি হয়নি?
– হয়েছিল, মনোযোগ দিতে পারত না। ওর ভেতরে সেই ইচ্ছা শক্তি ছিল না। এর মধ্যে আমি ঠিক করি প্যারিস যাব। আর চলেও যাই। আর এদিকে আমার ভাই যে কী কষ্ট পাচ্ছিল।
– ওর কী হয়েছিল?
– কী হয়েছিল সেটাই বলত না। একাডেমিক রেজাল্ট এত বাজে হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন উন্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করে। আম্মু বাবা বুঝতে পেরে ওকে ডাক্তার দেখায়। অবস্থা এত সিরিয়াস হয় যে ওকে মানসিক হাসপাতালে রাখতে হয় অনেকদিন। সেখানে ওর আরো বাজে অবস্থা হয়।
– মানে?
– মানসিক হাসপাতালের পরিবেশে ও আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন বাবা আম্মু সিদ্ধান্ত নেয় ওকে হাসপাতালে না নিরিবিলি কোথাও রাখা হবে। এর মধ্যে রিউমার ছড়ায় ওয়াসি ড্রাগ অ্যাডিক্ট আরো অনেক কিছু। এই সবের মধ্যে বাবা সবাইকে বলে ওয়াসি ও বাইরে পড়তে গেছে।
– এসব কী তুমি জানতে না?
– না। আমি ওয়াসির সাথে কথা বলতে চাইলে আম্মু নানা বাহানা দিত। কিন্তু দেশে আসার পর আমি বুঝতে পারি ওয়াসি দেশেই আছে। হঠাৎ একদিন আমাদের এই ছোট ফার্ম হাউসে এসে ওর সাথে দেখা করে আমার সন্দেহ সত্যিতে প্রমাণ হয়। আমি তখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিলাম। বাবা আমাকে বোঝালো, আর একটা বছর পর আমি ডিগ্রিটা পেতে পারি। কিন্তু আমার মন মানছিল না আমার ভাইকে এভাবে দেখে। আমি বিদেশে গেলেও বারবার ওয়াসির চেহারা ভেসে উঠছিল। বাবাকে না জানিয়েই আমি দেশে ফেরত আসি। এরপর সিকান্দার স্যারের সাথে যোগাযোগ করি।
– উনি কে?
– বস।
– মানে?
– এস এস এফ আই এর নাম শুনেছ?
– না মনে হয়।
– সিক্রেট সিকিউরিটি ফোর্স অব ইনটেলিজেন্স। বাংলাদেশের সিকরেট সামরিক গোয়েন্দা দল।
– তুমি খোঁজ পেলে কোথায়?
– আমি যখন ক্যাডেটে ছিলাম তখন সব এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস যোগ দিতাম। সেইসময় একটা সিক্রেট ইন্টারভিউ চলছিল। ধাঁধার মতো প্রশ্ন ছিল। সামান্য কিছু বই আর গিফ্টের জন্য যোগ দিয়েছিলাম। সারা দেশে সিলেক্টেড কিছু ক্যাডেটদের নিয়ে। আমি জানতাম না। আসলে কেউই জানতো না। সিকান্দার স্যার যখন আমাকে সিলেক্ট করলো আমি খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছিল আমার আর্ট কে চুজ করা উচিত। এই গোপন অনিশ্চিত জীবন আমার জন্য নয়। তারপরও সিকান্দার স্যার বললেন পরবর্তীতে যা কিছু দরকার তাকে বলতে আমি যাতে ইতস্তত না হই। ওয়াসির অবস্থা জানার পর সেইসময় আমার দ্বারা কোনো আর্ট ই হচ্ছিল না। শুধু প্রতিশোধ ভাসছিল দুই চোখে। প্রতিশোধের আগুন থাকলে আর্ট হয় না।
– পরে তুমি এজেন্ট হয়েছ?
– না। আমি এখনো এজেন্ট না। আমি সিভিল। আমি ডিফেন্সের লোক না।
– তো?
– বাগ! হিউম্যান বাগ। আমি যে সুযোগ একবার হারিয়েছি ওটা পেতে অনেক কষ্ট হতে পারে। তবে আমি এস এস এফ আই বাগ। ওদের সাথে আমার কন্ট্রাক্ট আছে। সব তথ্য এনে দেই। নজর রাখি সাধারণ বাগ ডিভাইসের মতো। এবং আমি একজন বাগ ডিজাইনার ও। আমার স্পেশালিটি এটাই যে আমি যেকোনো জিনিসে ক্যামেরা মাইক ফিট করতে পারি আর কেউ ধরতেও পারেনা।
– তুমি ম্যাগনেফিসেন্টে কী করছিলে?
– নজর রাখছিলাম।
– ওয়াসির নাম নিয়ে?
– নকল পরিচয়।
– অন্য কেউ কেন না? ধরা পড়ে গেলে?
– এক্সপেরিমেন্ট ছিল। ওরা কী ওর তথ্য এখনো রেখেছিল কি না। ওয়াসি তো কিছুদিন ই ছিল। আর ওয়াসি আত্ম*হ*ত্যা ও করেনি। ওরা ওর তথ্য রাখেনি।
– তো তুমি ধরা পড়নি?
– পড়েছিলাম। তবে পালিয়ে গেছি। এইটা আমার প্রথম বড় প্রজেক্ট। প্যারিসে আর্ট পড়েছি বলেই পেয়েছি। ইন্টারভিউতে অনেক রিয়েল ছিল। আমার মতো অনেক স্পাই অ্যাপ্লাই করেছিল। ওরা সিলেক্ট হয়নি। আমি ওদের লাস্ট চয়েস ছিলাম। দুধভাত বলতে পারো। তবে আমি আসলেই একজন আর্টিস্ট, আমি সিলেক্ট হয়ে গিয়েছিলাম। এতদিন কেউ সন্দেহ করেনি। তবে তোমার বউয়ের জন্য ধরা খেয়ে গেলাম।
– কেন?
– এই যে ঝগড়া করে বসলো। তুমি যে প্রিয়মকে চেনো এটা আমি জানতাম। তোমার ঐ স্ট্রেস বলের মতো আমার একটা স্পাই ক্যামেরা ছিল। সেদিনের কথা গুলো সব রেকর্ড হয়েছে।
– কী!!!
– হ্যাঁ। আমি সব শুনেছি। তুমি সেই যাকে আমি খুঁজছি। তবুও তোমাদের ম্যারিড লাইফের কথা ভেবে আমি কিছু বলিনি। তবুও নাদিয়ার কাজ আমার সন্দেহজনক লাগছিল। বুঝতে পারিনি ও তোমায় রিইউনিয়নে নিচ্ছে। জানলে কিছু একটা করতাম। তবে ভেজাল দেখে বুঝতে পেরেছি আমি ধরা পড়ে গেছি। সোজা বাড়ি চলে আসি। এই যে বাঙ্কারটা বাবা শখ করে বানিয়েছিল। বিদেশে অনেকে যুদ্ধের সময় লুকানোর জন্য বানায়। আজ এখানে আমরা লুকিয়েছি।
– ঐ লোকটা কি ছিল?
– কে?
– যে আমাকে বাঁচালো।
– এস এস এফ আই এর সিক্রেট এজেন্ট AC27। তোমার বাসায় কিলার ছিল তা জেনে তোমাকে মেসেজ দেওয়া হয়েছিল। মেসেজ পড় না কেন?
– মনে ছিল না। আচ্ছা আমার বাসায় এখন?
– সব সামলানো হয়ে গেছে। কেউ জানে না। আর তুমি কিছুদিন এখানে থাকো। নিরাপদে থাকো। এরপর তোমাকে নিয়ে আমাদের প্ল্যান আছে।
– কী প্ল্যান?
– আমরা কেস করবো। আমাদের কিছু প্রমাণ আছে। কিন্তু আমাদের কাউকে দরকার যে সামনে দাঁড়াবে। থাক, পরে সব বিস্তারিত বলব। এখন বিশ্রাম নাও।
– আচ্ছা, আমাকে কেউ খুঁজছে না? চিন্তা করবে না?
– না। বাদ দাও। বিশ্রাম নাও।
জাহিদ চুপ হয়ে বসে ভাবতে লাগলো। কেউ সত্যিই ওর খোঁজ করছে না। ও এভাবে হারিয়ে গেলেও কারো কিছু যায় আসে না। দুই একদিন পর জাহিদের কাছে ওয়াজির এসে বলে নাদিয়া কে ফোন দিয়ে বলতে ও ঠিক আছে। ওরা খুঁজছে ওকে। পুলিশ কেস হলে ঝামেলা হবে। জাহিদ ফোন দিয়ে এই কথাটা বলতেই নাদিয়া ফোন টা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে।
এদিকে সারা এখনো দেশে। জাহিদকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ওর অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলো ও নিখোঁজ। অর্ঘ্যদীপ কে ফোন করতেই সে বলল,
– ওর বাসায় নাকি ব্লাড পাওয়া গেছে।
– কী বলিস!
– ও মনে হয় বেঁচে নেই। ফাইয়াজ ওকে গুম করে দিয়েছে। ওর বউ এখন পুলিশে গেছে। যদি আমাদের কথা বলে দেয় তবে আমরা ফেঁসে যাব।
সারা রাগে ফোন কেটে দিয়েছে। অর্ঘ্যদীপ তা বুঝতে পেরে হাসলো। এখন সারা ফাইয়াজ কে ভুল বুঝবে। এক ঢিলে দুই পাখি। শুদ্ধ ফাইয়াজ দুজন ই। কিন্তু ওর কিলাররা শুদ্ধের লা*শ কোথায় গুম করেছে? নিজেরা গা ঢাকা দেওয়ার আগে কিছু বলবে না?
সারা ওর গাড়ি নিয়ে সোজা ফাইয়াজের বাসায় যায়। ফাইয়াজ কে দেখতে না পেয়ে সোজা ওর বেডরুমে ঢুকেই ওর কলার চেপে ধরে ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, ” তুই কী শুরু করেছিস! শুদ্ধ কে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেললি!”
ফাইয়াজ সারাকে আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
– আমাকে কী তোর গাঁধা মনে হয়? আমি শুদ্ধ কে কেন মারব?
– ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর বাসায় রক্ত পাওয়া গেছে।
– এর মানে আমি মেরে ফেলেছি? আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? যাতে লোক আমাকে সন্দেহ করে। আবার খুন করে নাকি রক্ত রেখে আসবো। আমার তো ওর কথা মনেও নেই।
এই বলে ফাইয়াজ নাদিয়াকে ফোন দেয়, “হ্যালো নাদিয়া, কেমন আছো?” সারা অপেক্ষা করছে ফাইয়াজের কথা শেষ করার। কথা শেষ করে ফাইয়াজ বলল,
– ঠিক আছে।
– শুদ্ধ মরেনি?
– না। অরনী তো বলল সব ঠিক আছে।
– ও যে থানায় গেল।
– দাঁড়া।
ফাইয়াজ সারাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে খোঁজ নিতে লাগলো। অবশেষে ও যখন জানলো জাহিদ বেঁচে আছে আর নাদিয়া মিসিং কমপ্লেইন তুলে নিয়েছে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তা সারাকে জানালো।
– অর্ঘ্যদীপ কে যে বলল?
– হারিয়ে গিয়েছিল। আর এটা সাসপিশিয়াস।
– তুই করিসনি?
– শুদ্ধের বাঁচা মরা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। ও তো এমনিতেই বরবাদ। তবে ও এখন কোথায়? আমি ওকে খুঁজে বের করবো।
– তারপর মেরে ফেলবি?
– তুই আমাকে ভালো করে চিনিস না এখনো। আমি কাউকে নিজের হাতে খু*ন করিনা বা করাই না। কেউ আমার উপর আঙুল তুলুক তা আমি চাই না। ওদের দোষেই ওরা মরে। আর শুদ্ধের মতো লোকের পেছনে এত সময় আর শ্রম দেওয়া ওয়েস্ট। তবে তোরা যদি আমাকে আর বিরক্ত করিস তো এই শুদ্ধের মাথা মুণ্ডু সব গুড়িয়ে ফেলব। নাও গেট আউট! কী জানি, তোকে খুবই চীপ আর থার্ড ক্লাস লাগে।
– মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ!
– শুদ্ধের মতো ছেলের জন্য সোজা আমার বেডরুমে আসিস, থার্ড ক্লাস ই তো।
এরপর সারা বিদেশে চলে যায়। অর্ঘ্যদীপ আর ওর কিলারদের খোঁজ পায় না। সাথে শুদ্ধ ও বেঁচে আছে সেই খবরে ওর ওর কপালের পাশে ঘাম জমে। তবে ওয়াজিরের লোকেরা খোঁজ বের করে ফেলে কিলার কে পাঠিয়েছিল। সব প্রমাণ একসাথে একটা কেস সাজানো হচ্ছে। জাহিদকে বাদী বানানো হবে। সেফটির জন্য ও এখন ওয়াজিরের সাথেই আছে। পিপি আর ওর ভাইদের কে একটা বার্তা পাঠানো হয়েছে যে ও ঠিক আছে। সময় হলে ও নিজেই খোঁজ দেবে। আর নাদিয়া জাহিদকে আবার ও ভুল বুঝে আছে।
ও ভাবছে জাহিদ ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল এসব সাজিয়ে। কথায় কথায় মিথ্যা বলে। এখন কোথাও লুকিয়ে আছে। ওকে বারবার বিশ্বাস করে শুধু ধোঁকা পেয়েছে। এভাবে পুরো এক মাস কেটে যায়। মিষ্টি এখন নাদিয়ার খুব কাছাকাছি থাকে। খুব ভালো বন্ধুত্ব এখনো তৈরী না হলেও ওকে একা রেখে যায় না। নাদিয়া কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। এত গুলো আঘাত ওকে পাথর করে দিয়েছে। ওর মা ওকে আবার আগের ঘরেই নিয়ে এসেছে, কারণ রাত বিরেতে ওর ঘরে গিয়ে ওকে দেখে আসে। রাহু নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। সপ্তর্ষির সাথে বিয়ে করার ইচ্ছায় ওর বোনের জীবন পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু জাহিদ ঠিকই নাদিয়ার খোঁজ খবর নিচ্ছে। ওয়াজিরের সাহায্যে ও মিষ্টির সাথে একটু যোগাযোগ রেখেছে। নাদিয়ার ভালো খারাপ ও জাহিদের কাছে পৌঁছে দেয়, কারণ জাহিদের পক্ষে নাদিয়া থেকে দূরে থাকা খুব কষ্ট হয়ে যায়।
নাদিয়ার শরীর ইদানিং খুব একটা ভালো থাকে না। পিরিয়ডও অনেক দিন ধরে মিসিং। ও যা সন্দেহ করছে তা হলে ও জানে না এখন ওর কী করা উচিত। অনলাইনে টেস্টিং কিট অর্ডার করে আনার সময় মিষ্টি দেখেছে। এখনই ওর স্বামীকে জানানো ঠিক হবে না। নাদিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে কিট হাত বসে আছে। ফলাফল আসা বাকি। আল্লাহ্ তা’লা ওকে আর কী কী পরিস্থিতিতে ফেলবে ও জানে না। কিট হাতে নাদিয়া তাকিয়ে আছে। ফলাফল যা এসেছে নাদিয়া তা নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিটের দুটো দাগ ওর জীবনে কী নিয়ে আসবে? অন্য সময় হলে এই ফলাফলে ও হাসতো, আনন্দ করতো। খুব খুশি হতো। আজ খুব কান্না পাচ্ছে। কী করবে ও? যখনই কি না ও সব শেষ করে সামনে আগাতে চায় তখনই ও নিজেকে সেখানে খুঁজে পায় যেখানে সব শুরু হয়েছিল।
(চলবে)