একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি,07,08,09

0
760

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি,07,08,09
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৭

ইশি চুপচাপ বসে আছে সোফায়।ওর সামনেই গম্ভীরমুখে অর্থ বসে আছে।ইশি এইবার মিনমিন কন্ঠে বলে,’ কিছু দরকার ছিলো ভাইয়া?আমাকে ডেকে পাঠালেন যে?’

অর্থ নড়েচড়ে বসলো।নিজেকে খানিকটা সামলালো।এইভাবে কোন কারো লাইফ নিয়ে ঘাটাঘাটি করা তার মোটেও ভালো লাগে না।তবে আজ কেমন যেন ও নিজের কৌতুহল দমাতে পারছে না।প্রাহির ওই জয়কে এতোটা ভয় পাওয়ার কারন জানার জন্যে ওর মন মস্তিষ্ক দুটোই অস্থির হয়ে উঠেছে।অর্থ প্রশ্ন করে ফেললো, ‘ আমাকে সব বলবে তুমি।প্রাহি কেন এতোটা ভয় পাচ্ছিলেন উনার কাজিনকে দেখে?আই নিড ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইলস ওফ দ্যাট!’

ইশি শুকনো ঢোক গিললো। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে।সামনের টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢোকঢোক করে খেয়ে ফেললো।এখন একটু ভালো লাগছে।আস্তে আস্তে বলা শুরু করলো ইশি, ‘ প্রাহি আমি হেমন্ত সবে মাত্র কলেজে উঠেছি।একদিন প্রাহির আব্বু মানে আঙ্কেলকে জানান উনাকে মিশনে যেতে হবে।তাও পুরো একবছরের জন্যে।আঙ্কেল আবার আর্মি ছিলেন।আঙ্কেল প্রাহিকে আর আন্টিকে একা এতো বড় বাড়িতে রেখে যাবেন এটা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন।তাই তিনি সিদ্ধান্ত ছিলেন প্রাহি আর আন্টিকে তার বাবার বাড়ি রেখে আসবেন।এতে আর আন্টি আর প্রাহিকে আর এতোটা খারাপ লাগবে না।অবশ্য তখন প্রাহির নানুভাই বেঁচে ছিলেন।তাই তারাও রাজি হয়ে যায়।এটাই ছিলো আঙ্কেলের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।প্রথম ৬ মাস ভালোই কাটছিলো।হঠাৎ একদিন প্রাহির কাজিন মানে ওর মামাতো ভাই জয় বিদেশ থেকে আসে।প্রাহির সাথে কেমন যেন অন্যরকম আঁচরন করতো।প্রাহি প্রায় আমাকে আর হেমন্তকে বলতো যে জয় ওর দিকে কেমন যেন বাজে দৃষ্টিতে তাকায় আবার মাজে মাজে ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করে।হেমন্ত তো একদিন রেগেমেগে জয়কে মারার জন্যে যেতে চাচ্ছিলো।প্রাহি ওকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে থামায় যে আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর তো আঙ্কেল এসেই পরবেন। একদিন হঠাৎ জানতে পারলাম প্রাহিকে হোস্পটিলাইজ্ড করানো হয়েছে।আমি প্রায় ছুটে যাই প্রাহির কাছে।ওর জ্ঞান ফিরতেই আমাদের সবকিছু খুলে বলে ও।সেদিক নাকি ওর মা আর মামি সোপিংয়ে গিয়েছিলেন।আর প্রাহির মামা তো কাজে থাকেন।বাকি থাকে প্রাহির নানুভাই তিনি প্রায় শয্যাশায়ী মানুষ।অসুস্থ থাকেন প্রায় বারো মাসকাল।জা*নোয়ারটা সেই সুযোগটা লুফে নেয়।একলা ঘরে প্রাহির সাথে জোড়জবরদস্তি শুরু করে প্রাহি চিৎকার করাতে প্রাহির গায়ের ওড়না কেরে নিয়ে ওর মুখ বেধে দেয়।বিছানার চাদর দিয়ে ওর হাতপা বেধে দেয়।সেদিনই হেমন্ত প্রাহির থেকে কেমিস্ট্রি সাবজেক্টের নোট্স নিতে এসেছিলো।অনেকক্ষণ কলিংবেল বাজাচ্ছিলো কিন্তু কেউ দরজা খুলছিলো না। উপায় না পেয়ে দারোয়ানকে বললো এক্সট্রা চাবি দিয়ে গেট খুলে দিতে।দারোয়ান যেহেতু হেমন্তকে চিনে তাই আর বেশি দ্বিমত করলো নি।বাড়ির ভীতরে ডুকে হেমন্ত সারাবাড়ি খুজেও প্রাহিকে পাচ্ছিলো না।অবশেষে গেস্টরুমের কাছ থেকে যেতে নিতেই।কেমন যেন শব্দ পায় হেমন্ত।দরজা ঠেলে ঢুকতে নিলে দেখে দরজা বন্ধ।হেমন্ত আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা ভেঙ্গে ভীতরে ঢুকে দেখে যা দেখে তা তো বুঝতেই পারছেন।হেমন্ত সাথে সাথে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে জয়কে।জয় যখন জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। ওকে ছেড়ে প্রাহির কাছে যায় হেমন্ত।প্রাহির অবস্থা দেখে কেঁদে দেয় হেমন্ত।প্রাহির হাতপা খুলে দিয়ে চাদর দিয়ে ওকে ঘুরে দেয়।অল্পর জন্যে প্রাহি সেদিন বেঁচে যায়।হেমন্ত ওকে নিয়ে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যায়।সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয় সবটা। আঙ্কেলকে সবটা বলাতে তিনিও সব ফেলে সেদিনই ছুটে চলে আসেন।জয়কেও ওর বাবা হাস্পাতালে ভর্তি করেন।এতো কিছুর পরেও জয়ের বাবা মা নিজের ছেলের কুকির্তী মেনে নেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন না। তাদের ভাষ্যমতে প্রাহিই নাকি তাদের ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এসব করার জন্যে আহ্বান করেছে।আর জয় ছেলে মানুষ একটু তো বেসামাল হবেই।প্রাহির নানুভাই প্রিয় নাতনির এই অবস্থা মেনে নিতে পারেননি।জয়কে সবাই পুলিশে দিতে চায়।হেমন্ত তো বার বার জয়কে মারার জন্যে যেতে চাচ্ছিলো। আমরা অনেক কষ্টে সামলিয়েছিলাম।প্রাহির মামা মামি পায়ে ধরে বলেন ওনার ছেলেকে যেন জেলে না দেয়।উনাদের কুমিরের কান্না দেখে মেনে নেয় সবাই। কিন্তু প্রাহির নানুভাই তৎক্ষনাৎ প্রাহির মামা, মামি আর জয়কে তেজ্য করে দেন। এমন একটা ঘটনা প্রাহির নানুভাই কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।কিছুদিন পর তিনি মারা যান।এটা যেন প্রাহিকে আরো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।একে সেই ঘটনা আবার ওর নানুভাই মারা যায়।এতে অনেক বড় একটা শক খায় প্রাহি। তিনমাস নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে।আমি আর হেমন্ত অনেক চেষ্টা করে ওকে সুস্থ করেছি।কতো যে পাগলামি করতো।অনেক কষ্টে আবার ওকে আগের মতো করতে সফল হয়েছি আমরা।সেই থেকেই ও জয়ের নাম শুনলেই ভয়ে অস্থির হয়ে যায়।’

একনাগাড়ে সব বলে দম নিলো ইশি। এদিকে সবটা শুনে অর্থ’র সারাশরীর থরথর করে কাঁপছে।রাগে চোখ লাল হয়ে আছে ওর।হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে।ইশি অর্থ’র দিকে তাকালো।অর্থ’র এমন ভয়ংকর রূপ দেখে ভয় পেলো।মিনমিনে কন্ঠে বলে, ‘ ভাইয়া আমি প্রাহির কাছে যাই।’

ইশির কথায় কোনরূপ প্রক্রিয়া করলো না অর্থ।ইশি নিজেও আর কিছু না বলে উঠে চলে যায়।এখন ওর বোধহয় একটু হেমন্ত’র কাছে যাওয়া উচিত।ছেলেটা না জানি কি করছে।রাগ উঠলে তো আবার এই ছেলের হুশ থাকে না।

এদিকে অর্থ নিজের মোবাইলে কারো নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগালো। ফোন রিসিভ হতেই গম্ভীর গলায় বললো, ‘ আই এম সেন্ডিং আ পারসোন্স নেম এন্ড পিকচার।আই ওয়ান্ট ওল হিস ডিটেইলস। এন্ড ব্রিং হিম ফ্রোম হোয়ারএভার ইউ ক্যান।গোট ইট?’

ফোন রেখে আজকের পার্টির সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জয়ের ছবি নিয়ে সেন্ড করে দিলো।তারপ উঠে চলে গেলো। এখন গিয়ে প্রাহিকে দেখে আসতে হবে।মেয়েটার অবস্থা কেমন কে জানে?মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে।

————-
মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে আছে প্রাহি।চেহারাটা কেমন মলিন আর শুকিয়ে আছে। চোখজোড়া কান্নার কারনে ফুলে ঢোল হয়ে আছে।ঠোঁটজোড়াও হালকা ফুলে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।তারপরেও যেন মেয়েটার চেহারায় এক সমুদ্র সমান মায়া জড়িয়ে আছে।অর্থ তাকিয়ে আছে প্রাহির দিকে।মেয়েটাকে একবার দেখা শুরু করলো আর চোখ সরানো যায়না। এরশাদ সাহেবের কথায় প্রাহির থেকে চোখ সরায় অর্থ।

‘ আমরা এখন বিদায় নিতে চাচ্ছি মিষ্টার শিকদার।’

হিয়াজ সিকদার বললেন, ‘ আজ থেকে যান মিষ্টার রহমান।’

‘ না মনে দুঃখ নিয়েন না প্লিজ।আমাদের আজ যেতে হবে।বিদায় দিন আমাকে।’

এরশাদ সাহেবের করুন কন্ঠ শুনে কেউ আর জোড় করলেন না উনাদের।

প্রাহি উঠে দাড়াতে নিতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়।অর্থ দ্রুত পায়ে এসে প্রাহিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সামলে নেয়। এদিকে অর্থ’র স্পর্শ পেয়ে সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠে।থরথর করে কেঁপে উঠে সারা দেহ।অর্থ নরম কন্ঠে বলে, ‘ ঠিক আছেন আপনি?’

প্রাহি দূর্বল চোখে তাকালো অর্থ’র দিকে।আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো ঠিক আছে।অধীক উত্তেজনায় মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না ওর। এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া এগিয়ে এসে মেয়েকে আগলে নিলেন।বাড়ির সবাই উনাদের বিদায় জানালেন।সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রাহিরা রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইশিও চলে যায় উনাদের সাথে।

—————–
ঘটনার চক্করে ডিনার করা হয়নি শিকদার বাড়ির কারোরই। সবাই ডিনার করতে বসেছে।হেমন্তকে অনেক ডাকা হয়েছে কিন্তু ও জানিয়ে দিয়েছে যে ও খাবে না।তাই আর বেশি কেউ জোড় করেনি।হেমন্ত ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না।ক্ষিদে লাগলে নিজে এসেই খেয়ে নিবে।সবাই যখন খাওয়ায় ব্যস্ত তখন হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে আসে হেমন্ত। অনেকটা ব্বিধস্ত দেখাচ্ছে ওকে।হেমন্তকে এই অবস্থায় দেখে অর্থ জিজ্ঞেস করে,’ হেমন্ত হোয়াট হ্যাপেন্ড?এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে।’

হেমন্ত যা বললো তা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না কেউই।শিকদার বাড়ির প্রতিটা সদস্য স্তব্ধ হয়ে আছে শুনে।হেমন্ত বলেছে, ‘ প্রা..প্রাহি! প্রাহিদের গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।ওদের সবাইকে হাস্পাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।সবাই আইসিইউ তে ভর্তি।জলদি যেতে হবে আমাকে।আমি আসি ভাইয়া।’

হেমন্ত আর কাউকে কিছু না বলে।দ্রুত পায়ে চলে যায় বাড়ি থেকে।এদিকে বাড়ির সবাই খাবার রেখে তারাও রওনা হয় হাস্পতালের উদ্দেশ্যে।অর্থ’র বুকটা ধরাসধরাস করছে।হাতপা মৃদ্যু কাঁপছে।একটু আগেও মেয়েটাকে বুকে নিয়েছিলো অর্থ।অদ্ভূত ভালোলাগা কাজ করছিলো মনে।আর এখন এই খবর শুনতে হলো ওকে। এ কেমন ভাগ্যের পরিহাস।অর্থ’র গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিলো।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হাস্পাতালে পৌছাতে হবে। সবাই যেন ভালো থাকে মনে প্রানে তা প্রার্থনা করলো।

#চলবে__________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৮

হাস্পাতালের দমবন্ধকর পরিবেশ,ফিনাইলের করব গন্ধ,চারদিকে মানুষের সমাগম। করিডোরে দাড়িয়ে আছে শিকদার বাড়ির সবাই।কিছুক্ষন পর পর নার্সদের ছুটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই থম মেরে বসে আছে হেমন্ত।আজ ওর এতো রাগের কারনেই এমনটা হলো।ও যদি রাগ করে নিজেকে রুমবন্ধি না করতো তাহলে এমন কিছু হতো না।নিজেরই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। অপারেশন চলছে প্রাহি,এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া বেগমের। অর্থ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।কেমন যেন একটা চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে বুকের বা-পাশটা।অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।মাথাটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে টেন্সনে। কখন ডাক্তার বেরোবে আর কখন ওরা কোন সংবাদ শুনতে পাবে সেই আশায় বসে আছে সবাই।

এদিকে ইশি কাঁদছে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে।নিজের বেষ্টফ্রেন্ডের এই অবস্থা মেনে নেওয়ার মতো না।ইশির কান্নার মাঝেই হেমন্ত’র দিকে চোখ যায়। ইশি ধীরে হেটে যায় হেমন্ত’র দিকে।হেমন্ত’র কাধে আলতো করে হাত রাখলো।হেমন্ত তাকালো ইশির দিকে।তারপর ইশির হাত ধরে হেঁচকা টানে ওর পাশে বসিয়ে দেয়।তারপর ইশির কাধে মাথা রেখে চোখ বুঝে ফেলো।ইশিও আলতো হাতে হেমন্ত’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্রোদন কন্ঠে বলে, ‘ টেন্সন করিস না হেমন্ত।দেখবি সবাই ভালো হয়ে যাবে।’

হেমন্ত কোন কথা বললো না।চুপচাপ ইশির কাধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে রইলো।

————-
‘ আরাফ? খোঁজ পেয়েছিস কোন?কে বা কারা এই এক্সিডেন্ট’টা করেছে।’

অর্থ আরাফকে খোঁজ লাগানোর জন্যে পাঠিয়েছিলো যে আসলেই প্রাহিরা ভুলবশত এক্সিডেন্ট করেছে না-কি ওদের মার্ডার করার চেষ্টা করেছে।সেই খোঁজ নিয়েই আরাফ এসেছে।আর আরাফ আসতেই অর্থ উপরোক্ত প্রশ্নোটা করলো।আরাফ উত্তরে বলে, ‘ ইউ আর এবসুলুটলি রাইট অর্থ।এটা জেনে শুনে ওদের মার্ডার করার পুরো পরিকল্পনা ছিলো।প্রাহিরা বাড়ি যাওয়ার পথেই একটা ট্রাক ড্রাইভার ওদের গাড়িটা ধাক্কা দিয়ে দেয়।আর প্রাহিদের গাড়িটা উলটে যায়।ঘটনা স্থলে ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় তৎক্ষনাত।আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে সেখানকার সিসি টিভি ফুটেজ চেক করে ট্রাকের নাম্বারটা দেখে নেই।আর সেই ট্রাকের আসল মালিককে খুজে বের করার জন্যে লোক লাগিয়ে দিয়েছি।আমাদের লোকেরা সেই কাজই করে যাচ্ছে।’

অর্থ গম্ভীরমুখে সব শুনলো।অতঃপর শান্ত কন্ঠ বললো, ‘ তোর কি মনে হয় না কাজটা জয়ের হতে পারে?’

আরাফ চমকে তাকালো বললো, ‘ মানে?’

‘ মানে সিম্পল।জয়ের আগে থেকেই প্রাহিদের উপরে ক্ষোপ জমা ছিলো।আর আজ তো একেবারে ভরা মজলিসে ওর অপমান হয়েছে।সেই রেশ ধরেই জয় প্রাহিদের উপর এট্যাকটা করেছে।’

আরাফ সবটা শুনলো।অবাক হয়ে বলে, ‘ এই ব্যাটা এমন খারাপ। আর এমন জঘন্য একটা কাজ করতে পারে আমার তো মাথাতেই আসেনি।তুই টেন্সন নিস না।আমি এখনি আমাদের পুরো ফোর্স লাগিয়ে দিচ্ছি।পুরো ঘটনাটা এইবার জয়ের মুখেই শুনতে পাবো আমরা।’

অর্থ সম্মতি জানালো। এরই মাঝে ডাক্তার বেড়িয়ে আসলো।হেমন্ত লাফ দিয়ে উঠে বসে ডাক্তারের কাছে যায়।অস্থির কন্ঠে আওড়ালো, ‘ ডাক্তার?ডাক্তার ওরা কেমন আছে?কি অবস্থা ওদের?’

ডাক্তার মুখ কালো করে ফেললো।ডাক্তারের এমন রিয়েকশন দেখে হেমন্ত আর বিচলিত হয়ে গেলো।অর্থ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, ‘ ডাক্তার ইজ এভ্রিথিং ওলরাইট?’

‘ আ’ম সরি মিষ্টার শিকদার।মিষ্টার রহমানকে বাচাতে পারেনি আমরা।আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি উনাকে বাঁচানোর।কিন্তু উনি উনার মাথায় খুব বাজেভাবে ইঞ্জুর্ড হয়েছিলেন।তাই হাজার চেষ্টার ফলেও উনাকে আমরা বাঁচাতে অক্ষম হয়েছি।এটা আমাদের ব্যার্থতা।’

হেমন্ত কাঁপাকাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ‘ আর প্রাহি আর আন্টি? ‘

ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ প্রাহির বামপা’টায় অনেক আঘাত পেয়েছে।মাথায়ও অনেক আঘাত পেয়েছে।আর মিসেস রহমানকে অনেক চেষ্টার পর বাঁচাতে পারলেও উনি কোমায় চলে গিয়েছেন।একটু পর প্রাহিকে কেবিনে সিফ্ট করা হবে।জ্ঞান ফিরলে আপনারা দেখা করতে পারবেন।আর মিসেন রহমানকে যতোদিন নিঃশ্বাস চলে আমাদের এখানেই ইস্পেশাল ট্রিটমেন্টের মাধ্যে রাখতে হবে।এআ’ম সো সরি।আমাদের ক্ষমা করবেন আপনারা’

ডাক্তার তার বিষাক্ত কথাগুলো বলে চলে গেলেন তার কাজে।হেমন্ত ধপ করে চেয়ারা বসে পড়ে।ইশি হাইমাউ করে কেঁদে দেয়।হিয়া গিয়ে ইশিকে ধরে। রায়হানা আর হেনাও কাঁদছেন উনাদের সামলাচ্ছেন হিয়াজ আর হিয়ান্ত।অর্থ হেমন্ত’র পাশে বসলো।ওর নিজেরও কষ্টে বুকটা ভার হয়ে আসছে।চেয়েও অর্থ কাঁদতে পারছে না।চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে ওর।কাঁদলে এখন চলবে না হেমন্তকে সামলাতে হবে।ছেলেটা অনেক ভেঙে পড়েছে। অর্থ হেমন্ত’র মাথাটা বুকে চেপে ধরলো।ভাইয়ের ভরসার হাতটা পেয়ে জোড়েজোড়ে কেঁদে দেয় হেমন্ত।অর্থ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘ হুস ডোন্ট ক্রায় হেমন্ত।এইভাবে কাঁদলে হবে?কাঁদিস না হেমন্ত।’

হেমন্ত চিৎকার করে বলে, ‘ সব আমার জন্যে হয়েছে ভাই।আমি যদি ওদের দায়িত্বশীলভাবে বাড়িতে পৌছে দিতে পারতাম তাহলে এমনটা হতো না ভাই।সব আমার জন্যে হয়েছে।’

‘ এটা তোর ভুল ধারনা।তুই সাথে থাকলেও কিছুই আটকাতে পারতি না।আল্লাহ্ যা চান তাই হয় হেমন্ত।তুই যদি উনাদের সাথে থাকতিও তাহলে প্রাহিদের সাথে সাথে তুইও আজ হাস্পাতালে ভর্রি থাকতি।কারন কোনকিছু আটকানোর ক্ষমতা আল্লাহ্ ছাড়া আমাদের কারো হাতে নেই হেমন্ত।এখন নিজেকে সামলা। শক্ত কর নিজেকে।এভাবে যদি তুই ভেঙ্গে পরিস প্রাহিকে সামলাবেন কে?তুই ছাড়া উনাকে কেউ সামলাতে পারবে না। নিজেকে শক্ত কর হেমন্ত। এখন উঠ এরশাদ আঙ্কেলের জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে।প্রাহি’র কখন জ্ঞান ফিরে সেটা ডাক্তার কোন নির্দিষ্ট সময় দেয়নি।আঙ্কেলকে কবর দিতে হবে।’

অর্থ’র কথায় হেমন্ত কান্না থামালো।হ্যা ভাই তো ঠিকই বলছে ওকে যে শক্ত হতে হবে।মেয়েটার যে আজ সর্বহারা।বাবা নেই মা তো থেকেও নেই।প্রাহিকে যে একা।এখানে হেমন্ত আর ইশি ছাড়া ওর আপনজন যে কেউ নেই।না ওকে এইভাবে ভেঙ্গে পরলে চলবে না।হেমন্তকে নিজেকে সামলাতে দেখে বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্থ।বুকটা কষ্টে জলে যাচ্ছে।হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে পরে আছে।নিজেকে অনেকটা অসহায় লাগছে অর্থ’র।মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যে পরিচিত মেয়েটার জন্যে এতো কষ্ট কেন লাগছে অর্থ’র? না-কি স্বাভাবিক মানুষের মতোই ও নিজেও কারো কষ্টে সামান্যতম শোকাহত
কিন্তু আরো কতো মানুষদের দেখেছে ওদের প্রিয়জনদের হারাতে।ওর অফিসের এমপ্লিয়েদের কারো মা মারা গেলে বাবা মারা গেলে।অর্থ সেখানে যেতো ওদের কান্না দেখে একটু খারাপ লাগতো।কিন্তু আজ মাত্রারিক্ত কষ্ট হচ্ছে।চোখজোড়া তাদের অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার জন্যে অনুমতি চাইছে।কিন্তু অর্থ তো দূর্বল হৃদয়ের মানুষ না। সে কিছুতেই কাঁদবে না।নিজেকে সবার সামনে দূর্বল প্রমান নেহাত বোকামি ছাড়া কিছুই না।আর অর্থ তো সেইসব বোকামি একদম করে না।
—————–
কেটে গেছে আটঘন্টা। এরশাদ সাহেবের জানাযা সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই।উনার জানায শেষ করে সবাই আবারো হাস্পাতালেই অপেক্ষা করছে প্রাহির জ্ঞান ফিরার জন্যে। হিয়াজ,রায়হানা,হেনা,হিয়ান্ত উনাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে অর্থ।শুধু শুধু হাস্পাতালে এতো মানুষদের ভীর করা ঠিকনা।আর এমনিতেও তারা বুড়ো মানুষ সারারাত নির্ঘুমা থাকলে তারাও অসুস্থ হয়ে পরবেন।ইশি আর হেমন্ত’কে জোড় করেনি অর্থ।কারন ও জানে ওদের হাজার বললেও এখান থেকে সরানো যাবে না।আর ইশি যেহেতু মেয়ে তাই ও একা এখানে থাকাটা ভালো দেখান না এইজন্যে হিয়াও এখানে থেকে গেছে।

অপেক্ষার পালা শেষ করে একজন নার্স আসলো।অস্থির কন্ঠে বলে, ‘ পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।তিনি বার বার তার বাবা মা’কে দেখার জন্যে জেদ করছেন।আমি কিছুতেই উনাকে সামলাতে পারছি না।প্লিজ আপনারা কেউ চলুন।’

সবাই দৌড়ে গেলো প্রাহির কেবিনের সামনে গেলো।প্রাহির কান্নারত কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।অর্থ চোখের ইশারায় হেমন্ত আর ইশিকে বললো ভীতরে যেতে।ইসি আর হেমন্ত তাই করলো।এদিকে হেমন্ত প্রাহির কাছে যেতেই প্রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ এই হেমন্ত।আমাদের গা..গাড়ি এক্সি..এক্সিডেন্ট হয়েছে।আমি তো ঠিক আছি।আমি কতোক্ষন যাবত বলছি আমাকে আব্বু আম্মু’র কাছে নিয়ে যেতে।কিন্তু এই নার্স কিছুতেই আমাকে যেতে দিচ্ছে না।তুই এসেছিস ভালো হয়েছে।এখন আমাকে নিয়ে চলনা আব্বু আম্মুর কাছে।উনারা কেমন আছে আমি নিজের চোখে দেখবো হেমন্ত।’

প্রাহিকে এমনভাবে কান্না করতে দেখে অর্থ চোখ বুঝে ফেললো।মেয়েটার কান্না সহ্য হচ্ছে না ওর।একদম সহ্য হচ্ছে না।ওই ক্রোদনকৃত প্রতিটা বাক্য তীরের ন্যায় বুকটা ঝাঝরা করে দিচ্ছে ওর।

এদিকে হেমন্ত আর ইশি কিছুতেই সামলাতে পারছে না প্রাহিকে।অস্থির আচঁড়ন করছে মেয়েটা।এরমম আচঁড়নে দু তিনবার পায়ে আর মাথায় ব্যাথা অনুভব করায় কুঁকিয়ে উঠেছে।তাও দমে যায়নি ও।সকল ব্যাথা একসাইডে ফেলে দিয়ে নিজের বাবা মার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে প্রাহি।প্রাহিকে সামলাতে না পেরে হেমন্ত প্রাহির গালে চড় মারলো।সবাই অবাক হয়ে গেলো।এই অসুস্থ প্রাহিকে হেমন্ত চড় মারলো?তাও এতো জোড়ে?হেমন্ত রেগে চিল্লিয়ে বলে উঠে, ‘ আঙ্কেল আর নেই প্রাহি! আঙ্কেল আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরকালে পাড়ি দিয়েছেন।আর আন্টি চিরদিনের জন্যে কোমায় চলে গিয়েছেন।সত্যিটা মেনে নেহ প্রাহি মেনে নেহ।’

ইশি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো।প্রাহির এই অবস্থা ওর বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না।প্রাহি হেমন্ত’র এমন বিষাক্তবাক্যগুলো সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষনাত জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে হেমন্ত’র বুকে।হেমন্ত প্রাহিকে দুহাতে আগলে নেয়।তারপর আলতো করে সুইয়ে দিয়ে কান্নারত ইশির দিকে তাকায়।শীতলকন্ঠে বলে, ‘ কান্না করিস না ইশি।ওকে এখন আমাদেরকেই সামলাতে হবে।কাঁদিস না।আমরা ছাড়া যে ওর আর কেউ নেই রে।ও যে আজ থেকে এতিম হয়ে গেলো। আমরাই এখন ওর একমাত্র ভরসা।’

#চলবে_________

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৯
‘ইশি তুমি কি সেদিন কিছুই দেখো নি?মানে তুমিও তো ছিলে গাড়িতে তাইনা?তাহলে তুমি আগে থেকেই কি কোন আন্দাজ করতে পারো নি,বা এমন কোনকিছু মনে হয়নি যে তোমাদের আগে থেকেই কেই ফলো করছে?’ অর্থ’র প্রশ্নে ইশি না বোধক মাথা নাড়ালো।আস্তে করে বলে, ‘ আসলে ভাইয়া গাড়িতে উঠে তো আর কেউ পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে না,তাইনা?আমার ক্ষেত্রেও তাই।তবে প্রাহি’রা যখন আমাকে আমার বাসায় ড্রোপ করে দিয়ে চলে আসছিলো।আমি ওদের গাড়ির পিছনে আমি একটা ট্রাক দেখেছিলাম।আমাদের বাড়ির রাস্তা অনেক সরু।ওখান দিয়ে ট্রাক যাওয়া আসা করে না। করলেও যদি আমাদের এলাকায় কেউ দরকারি জিনিসপত্র আনে তখন আসে।তবে ওইসময় এতো রাতে সেখানে ট্রাক আসা একটা সন্দেহের মধ্যে পড়ে।এটা আমার ব্যর্থতা যে ভাইয়া আমার মাথায় একটুও খেয়াল আসেনি যে ওই ট্রাকটাই ওদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করাতে পারে।’

অর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ইশি বললো, ‘ ভাইয়া আমি একটু প্রাহিকে দেখি আসি।’

অর্থ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তারপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ ওই ট্রাক ড্রাইভারটাকে যে করেই হোক ধরতে হবে।কোন খোঁজ পেয়েছিস ওই লোকের?’

আরাফ ব্যর্থ শ্বাস ফেললো।হতাশ কন্ঠে বলে, ‘ অনেক চেষ্টা করছি খোঁজার কিন্তু পাচ্ছি না। ওই জয়েরও কোন খোঁজ নেই।আমার মনে হয় দুটোই গা ঢাকা দিয়েছে একসাথে।নাহ এইভাবে হবে না।আমাদের আরো করাভাবে আমাদের লোকদের কাজে লাগাতে হবে।’

অর্থ রাগি কন্ঠে বলে, ‘ ঘোড়ার ঘাস কাটছে নাকি ওরা।দু’দিন যাবত খুজে চলেছে কিন্তু কোন ইনফোর্ম আমাদের জানাতে পারছে না।ড্যাম ইট!’

রাগে চেয়ারে জোড়ে একটা দেয়ালে ঘুশি মারলো অর্থ। আরাফ অর্থকে রেগে যেতে দেখে বললো, ‘ রাগিস না প্লিজ।আমরা জলদি খুজে পাবো ওদের।পুলিশও তো তাদের কাজ করছে। জলদি ওই কু’কুরের বাচ্চাদের ধরতে পারবো আমরা।’

‘হুম তাই কর।যতো দ্রুতভাবে পারিস।’ অর্থ’র কথায় আরাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তারপর চলে গেলো।অর্থ তাকালো কেভিনের কাচের দরজার দিকে সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রাহি চুপচাপ বসে আছে।আর ইশি এবং হেমন্ত ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।আজ দুদিন হয়ে গিয়েছে সেই ঘটনার।সেদিন যখন প্রাহির জ্ঞান ফিরে আসে মেয়েটা সেদিন থেকে একটা কথা অব্দি বলেনি কারো সাথে।চুপচাপ বসে থাকে নিস্তেজ মানুষদের মতো।মনে হয় মেয়েটা বেঁচে তো আছে কিন্তু ওর ভীতরে কোন রূহ নেই।কেমন নিষ্প্রান হয়ে থাকে সবসময়।প্রায় আধাঘন্টা চেষ্টার পরেও যখন প্রাহিকে কিছুই খাওয়াতে পারলো না হেমন্ত তখন কেবিন থেকে বের হয়ে আসলো।ওর সহ্য হচ্ছে না প্রাহির এই অবস্থা দেখে।হেমন্ত বাহিরে আসতেই অর্থ বললো, ‘ কিছুই খায়নি?’

হেমন্ত ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো।ধরা গলায় বলে, ‘ এভাবে আর কতোদিন চলবে ভাই?ওকে এই অবস্থায় দেখতে যে আমার একটুও ভালো লাগে না।কিছু খায়নি দুদিন যাবত।শুধু স্যালাইন চলছে ক্যানালার মাধ্যমে।এইভাবে তো ও বেশিদিন বাঁচবে না ও।মরে যাবে ও।’

অর্থ বললো, ‘ ওকে কাঁদাতে হবে হেমন্ত।এইভাবে কষ্ট নিজের মনের মাঝে রেখে গুমড়ে গুমড়ে মারা যাবে।ওকে মেনে নেওয়া শিখাতে হবে।সত্যিটা মেনে নিতে হবে।তুই চিন্তা করিস না। আমি যাচ্ছি ভীতরে।দেখি কিছু করতে পারি কিনা!’

হেমন্ত চোখ মুছে সম্মতি জানালো।অর্থ প্রাহির কেবিনে গেলো।ইশি ইশারা করলো চলে যেতে।তাই ইশি চলে গেলো।অর্থ আস্তে করে প্রাহির পায়ের কাছে বসলো।মেয়েটা এই দুদিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি পরেছে।চেহারার লাবন্যতা যেন হারিয়েই গিয়েছে।মাথায় ব্যান্ডেজ হাতে ক্যানোলা লাগানো। বামপা’টা ব্যান্ডেজ করা।প্রাহিকে এই অবস্থায় দেখে অর্থ’র ঠিক কতোটা কষ্ট হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারবে নাহ।ভীতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ওর।অর্থ আরেকটু এগিয়ে বসলো প্রাহির কাছে।শান্ত কন্ঠে বলে, ‘ কেমন আছো প্রাহি?’

প্রাহির কোন জবাব নেই।অর্থ আবারও বলে, ‘ এইভাবে আর কতোদিন মৌনতা পালন করবেন প্রাহি?এইভাবে চললে তো আপনি মরে যাবেন?আপনি মারা গেলে আপনার মায়ের কি হবে সেই কথা একবারো চিন্তা করেছেন আপনি?আপনার বাবা আর নেই। আপনি তাদের একমাত্র সন্তান।এখন আপনাকেই সবার দায়িত্ব নিতে হবে।আপনার মা’কে বাঁচাতে হবে। আপনার বাবা কি আপনার এই অবস্থা দেখে খুব খুশি হচ্ছেন আপনি মনে করছেন? না একদম ভুল ভাবছেন আপনি।আপনাকে এই অবস্থায় দেখে তিনি মরেও শান্তি পাচ্ছেন নাহ।এভাবে হার মেনে নিলেন?এইভাবে চলবে কিভাবে প্রাহি?আপনাকে যে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে লড়তে হবে।আপনার বাবার হত্যাকারিকে খুঁজে বের করতে হবে।তাকে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।আপনার মায়ের এই অবস্থার পিছনে যে দায়ি তাকে তার সর্বোচ্চ শাস্তি দিবেন আপনি।কিন্তু আপনার মাঝে সেরকম কোন মনোবলই আমি দেখছি না।কেমন সন্তান আপনি?আপনার বাবা মায়ের এই অবস্থার জন্যে তাকে শাস্তি না দিয়ে আপনি নিজেকে নিজে শাস্তি দিয়ে গুমড়ে মরছেন এই হাসপাতালে।এইভাবে হবে না প্রাহি আপনাকে শক্ত হতে হবে।আপনার মায়ের জন্যে আপনাকে বাঁচতে হবে।নিজের মায়ের জন্যে আজীবন লড়তে হবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বিরুদ্ধে।’

কথাগুলো বলে অর্থ তাকালো প্রাহির দিকে প্রাহির চোখজোড়া ছলছল করছে।অর্থ এগিয়ে গিয়ে প্রাহির বাহু ধরে ওর মুখোমুখি হলো।গম্ভীর কন্ঠে বললো, ‘ কাদুঁন প্রাহি।আজ প্রানভরে কাঁদুন।আজই যেন আপনার শেষ কান্না হয়।নিজের সবটুকু কষ্ট উজাড় করে কেঁদে ভাসিয়ে দিন।যেন আজকের পর থেকে আর কেউ আপনাকে কাঁদাতে না পারে।নিজেকে এতোটা পাথর মনে রূপান্তর করবেন।কেঁদে নিন প্রাহি।কাঁদুন আপনার বাবা আর নেই প্রাহি।আপনার মা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন তাদের জন্যে আজ শেষ কান্না কেঁদে নিন।’

অর্থ’র কথা শেষ হতে দেরি।প্রাহির হাইমাউ করে কাঁদতে দেরি নেই।মেয়েটা পাগলের মতো কান্না করছে।অর্থ হ্যাচঁকা টানে প্রাহিকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরলো।কাঁদার জন্যে কারো ভরসা যোগ্য প্রসস্থ বুকটা পেয়ে যেন আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো প্রাহি।নিজের সবটুকু কষ্ট আজ কেঁদেকেটে অর্থ’র বুক ভাসিয়ে দিবে।প্রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ আমার বাবা আর নেই।আমার বাবা।আমি এরপর থেকে কার কাছে নালিশ দিবো।কার কাছে হেমন্ত’র নামে বিচার দিবো।কে আমাকে তারপর আদুরেভাবে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।আমার আম্মুও তো আর কোনদিন আমাকে বকা দিবে না।কেন এমন হলো আমার সাথে?কি এমন পাপ করেছি আমি?যে আমি সব হারিয়ে শূন্যের কোঠায়।আমার বাবাকে মেরে ফেললো ওরা।আমার ভরসার জায়গাটুকু ওরা কেরে নিলো আমার কাছ থেকে।আমাকেও কেন মেরে ফেললো না ওরা।আমাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলো।আমি আমার বাবার কাছে যাবো।আমার বাবাকে দেখবো।বাবার বুকে মাথা রাখবো।নিয়ে চলুন আমার বাবার কাছে।বাবা যাবো আমি।’

অর্থ’র চোখজোড়া লাল হয়ে আসছে।কন্ঠনালিতে কান্না আটকে রাখার জন্যে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।এই মেয়েটার বুকফাটা আজাহারি শুনে ওর নিজের কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। অর্থ প্রাহির মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘ হুস! কাঁদে না আর কাঁদেনা।নিয়ে যাবো আঙ্কেলের কাছে। একটু সুস্থ্য হয়ে উঠুন আপনি!’

প্রাহি উঠে বসলো।চিৎকার করে বলে, ‘ নাহ! আমি এখনি যাবো বাবার কাছে নিয়ে চলুন বাবার কাছে।আমি বাবার কাছে যাবো।প্লিজ নিয়ে চলুন।আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি পাগল হয়ে যাবো।’

‘ ওকে ওকে আপনি হাইপার হবেন নাহ।আমি এখনি নিয়ে যাচ্ছি।’

অর্থ কেবিনের বাহিরে এসে দেখলো ইশি আর হেমন্ত’র চোখে পানি।অর্থ ওদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘ কাঁদিস না প্লিজ তোরা।এখন গাড়ি বাহির কর।প্রাহি পাগলামি করছেন অনেক।উনাকে এখন আঙ্কেলের কবরের কাছে না নিয়ে গেলে হিতে বিপরীত হবে।উনার মাথায় আঘাত পেয়েছেন তাই উনাকে এতোটা হাইপার হতে দেওয়া ঠিক হবে না।’

হেমন্ত বলে, ‘ আচ্ছা ভাই।আমি গাড়ি বাহির করছি তুমি ওকে নিয়ে আসো। ইশি চল।’

ওরা যেতেই অর্থ আবারও প্রাহির কাছে আসলো।কোন কিছু না ভেবেই হুট করে কান্নারত প্রাহিকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো।প্রাহি ভয় পেলেও পরক্ষনে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো অর্থ’র দিকে। দুনিয়াতে এখন প্রাহি বেঁচে থাকবে চারজন মানুষের আশায় এখন প্রথম ওর মা,দ্বিতীয় অর্থ,তৃতীয় হেমন্ত আর চতুর্থ ইশি।অর্থ ওকে ভালোবাসুক আর না বাসুক প্রাহি অর্থকে চিরজীবন ভালোবেসে যাবে। প্রাহি অর্থ’র গলা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁফিয়ে উঠলো। প্রাহির গরম নিঃশ্বাসগুলো অর্থ’র গলায় এসে লাগছে।অদ্ভূত ভালোলাগায় মনটা ছেঁয়ে গেলো অর্থ’র।প্রাহিকে আরেকটু ভালোভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।মেয়েটাকে এইভাবেই আগলে রাখতে চায় নিজের বাহুডোরে অর্থ।কেন চায়?তা জানে না অর্থ।শুধু ও এটাই চায় প্রাহি ওর কাছে থাকুক। ওর সাথে থাকুক।আর ও প্রাহিকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে।কখনও প্রাহির হাত ছাড়বে না এটা মনে মনে নিজের কাছেই নিজে ওয়াদা করলো অর্থ।যেকোন পরিস্থিতিতে প্রাহি ঢাল হয়ে থাকবে ও সারাজীবন।কোন দুঃখ কষ্ট যেন প্রাহিকে ছুতে না পারে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে ও।

#চলবে________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here