#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
‘মা আর মামুর পাগলামির জন্য এখন তোকে বিয়ে করতে হয়েছে নাযীফাহ। আমি এখনই বিয়ে নামক বেড়াজালে আবদ্ধ হতে চাইনি।এখন বিয়ে করতে চাইনি এর মানে এই না যে আমি অন্য কারো সাথে কমিটেড। বিয়ে হলো একটা পবিত্র বন্ধন। ‘কবুল’ এই তিনটি শব্দের অনেক জোর। তুই জানিস আমি পড়ুয়া মানুষ। আমার দুনিয়া মানে পড়াশোনা। আমার স্বপ্নটা অনেক বড় নাযীফাহ। তাছাড়া তুইও অনেক ছোট।আবেগের বয়স তোর। মামু ভেবেছে আবেগের বসে যদি তুই কাউকে মন দিয়ে বসিস। সেই ভয় থেকে বিয়ের তোরজোর।’
এতটুকু বলে থামল তাহমিদ। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাল জামদানী পরিধেয় নববধূ। যার সাথে সে ঘন্টা খানিক আগে ‘আকদ’ সম্পন্ন হয়েছে।আজকের আগ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কটা ছিলো মামাতো বোন আর ফুফাতো ভাইয়ের। ঘন্টা খানিক আগে ‘কবুল’ নামক শব্দের জন্য সম্পর্কের মানেটাই বদলে গেলো। বর্তমানে এক হাত ঘোমটা দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর মামাতো বোন না তার বিয়ে করা বউ। ‘তার বিয়ে করা বউ’ মনে মনে কয়েকবার আওড়াল শব্দটা।আনমনে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখে গেলো তাহমিদের। গেলো ফেব্রুয়ারিতে তার তেইশ শেষ করে চব্বিশে পা দিলো। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে আর তার মা তাকে জিরুতে দিলো না। একেবারে ধরে বেঁধে নিজের ভাইঝির সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো। চব্বিশ বছরের তাহমিদের সাথে পনেরো বছর বয়সী নাযীফাহ’র বিয়ে কেন দিলো সেটাই ভেবে পায় না সে। যে মেয়ে কি না এসএসসি পরীক্ষার্থী হয়েও এখনো সুযোগ পেলে গাছে চড়ে বেড়ায়। পাড়ার বাচ্চাদের সাথে মাঝে মাঝে মারবেল খেলে। মাঠে ফুটবল খেলে। সেই ইমম্যাচিউর বাচ্চা মেয়েটা নাকি তার বউ। গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক হলো সে।
‘আমি নিজেই এখনো অগোছালো। আমি নিজেকে একটু গুছিয়ে নেই। তুইও পড়াশোনা কর। তোর মাঝে ম্যাচিউরিটি আসুক। অনুভূতি বুঝতে শিখ। ততদিনে আমারও একটা গতি হয়ে যাবে।’
তাহমিদ কথা শেষ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। চৌকাঠ ডিঙানোর আগে পিছু ফিরে শান্ত স্বরে ডাকল,
‘নাযীফাহ?’
এমন কোমল গলা শুনে মাথা তুলে তাকাল নাযীফাহ। তাহমিদের এমন শান্ত ডাকে কিছু একটা ছিলো।
‘তুই ডানপিটে আমি জানি। শয়তানি তোর শিরায় উপশিরায়। আমার এসবে কোনো বাঁধা নেই। যার যার একটা স্বাধীন জীবন আছে। আমি চাই না জীবনের কোনো একটা সময় গিয়ে তুই বলিস যে, ‘আপনার জন্য আমার কৈশোরটা দূর্বিষহ কেটেছে।’ স্বামী হয়েছি বলেই যে অধিকার ফলাবো এমন পুরুষ আমি না। তবে এইটুকু মাথায় রাখিস তুই এখন আর তুই শুধু কারো মেয়ে না। কারো স্ত্রী আর কারো বাড়ির পুত্রবধূ। দুই বাড়ির সম্মান তোর হাতে। তোর মনে যেন অন্য কারোর জন্য অনুভূতি জন্ম না নেয়। ‘কবুল’ বলে যাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিস তার মাঝেই যেন অনুভূতি সীমাবদ্ধ থাকে। কাল সকালে হয়তো ঢাকা চলে যাবো। এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত বাঁদরামি কম করে পড়াশোনায় মনযোগ দে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। মামুর একমাত্র সন্তান তুই। তোকে নিয়ে মামুর স্বপ্ন। আর নিজের যত্ন নিবি।’
আর দাঁড়ালো না সে। হনহন করে চলে গেলো বসার ঘরের দিকে। তাহমিদ যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আঁচল কোমড়ে গুঁজল। এতোক্ষণ ভালো মেয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো তার। তাহমিদের সামনে যেতেই তার লজ্জা করে। বছরে দু’টো ইদ ছাড়া আর তাহমিদের সাথে তার দেখা হতো না। তাহমিদ শহরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। আর সে থাকে গ্রামে। এতোক্ষণ তাহমিদ কি বলে গেলো সে দিকে তার ধ্যান ছিলো না। তার ধ্যান তো আব্বাস চাচার পেয়ারা গাছে ঝুলতে থাকা পেয়ারা জোড়ার দিকে। সকালে অংক প্রাইভেট শেষ করে দেখেছিলো। কেমন অসহায় মতো তাকিয়ে ছিলো নাযীফাহ’র দিকে। পেয়ারা দু’টো যেন কেঁদে কেঁদে বলছিলো,
‘আমাদেরকে তোর সাথে করে নিয়ে যা নাযীফাহ। এভাবে আর গাছে ঝুলে থাকতে ভালো লাগছে না।’
পেয়ারা দু’টো কথা বলছে ভাবতেই ফিক করে হেঁসে দিলো সে। বাড়িতে আসার পর তার মা আর তাকে বেরুতে দিলো না। না হলে এতোক্ষণে পেয়ারা তার পেটে চালান করে দিতো। কি কাঁদাটাই না কেঁদেছে সে। যখন শুনেছে তার বিয়ে। তাও কিনা তাহমিদ ভাইয়ের সাথে। উনার সামনে আসতেই তো নাযীফাহ লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে যায়। সবার সাথে বনলেও নাযীফাহ’র শুধু বনে না ফুফুর শ্বাশুড়ির সাথে। দেখা হলে সারাক্ষন শুধু ঝগড়া করে। এসব ভাবতে ভাবতে খাটে ধপাস করে শুয়ে পড়লো সে। তবে বাঁচা গেছে তাহমিদ ভাই বলেছে ও বাড়ি নাকি যেতে হবে না। কবে যেতে হবে সেটাও বলেনি। যদি কয়েকদিন পরে এসে বলে ও বাড়ি যেতে তখন কি হবে?
কিয়ৎকাল পরে কুটিল হেঁসে নাযীফাহ মনকে বুঝালো,
‘তখন না হয় কান্নাকাটি নামক মেলোড্রামা করে সব ভেস্তে দিবে।’ পাখার বাতাস গায়ে মাখিয়ে আরামে চোখ বুঁজলো সে।
____________________________________________
তাহমিদ এসে দাঁড়ালো বসার ঘরে। সেখানে আড্ডাতে মত্ত তার বাবা, মা এবং মামু। মামি নিশ্চয়ই রান্নাঘরে।তাদের কথার মাঝেই গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিলো তাহমিদ। সবাই তাকালো তার দিকে। সে ধীর পায়ে তার মামুর কাছে গিয়ে বসল।
‘দুই ভাইবোন তো একেবারে ধরে বেঁধে আমাদের বিয়ে দিয়েছো। এখন দয়া করে সংসার করতে বলো না। নাযীফাহ একটু বড় হউক আমিও এমবিএ শেষ করে চাকরির খোঁজ করি। রগে রগে তোমার মেয়ের বাঁদরামি। আর এখনই সংসারের ভূত ওর মাথায় চাপাতে চাইছি না।’
এতটুকু বলে থামল সে। নিজের ভাগ্নের কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয় খালেদ মোশাররফ এর।
‘এই না হলে আমার জামাতা।’
চোখ রাঙায় তাহমিদ।
‘ওহ মামু জামাতা বলবে না। আজকের আগে যেমন ভাগ্নে বলতে এখনো বলবে।’
কথার মাঝে ফোড়ন কাটে তাহমিদের মা ওয়াহিদা।
‘দেখ ভাই তুই যে আগে আমার মাটির ব্যাংকের জমানো টাকা গুলো চুরি করতি, মনে আছে?এখন আমি সেই সব টাকা উসুল করবো। যখন তোর মেয়েকে একেবারে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো, তখন মোটা অংকের যৌতুক দিতে হবে।’
নিজের স্বামীকে ইশারা করে, ‘কি বলো তাহমিদের বাবা?’
জামান সাহেব গা ছাড়া ভাব নিলেন।
‘এটা তোমাদের ভাইবোনের ব্যপার এর মাঝে আমাকে টানছো কেন? ছেলে যে আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছে এতেই আমি শান্তি।’
খালেদ মোশাররফ চশমা পরিষ্কারের ভঙ্গিতে ফুঁ দিলেন।
‘দিলাম না যৌতুক। কি করবি?’
‘অ’ত্যা’চা’র করবো তোর মেয়েকে।’
বোনের কথায় হাসলো খালেদ মোশাররফ।
‘ভাইঝি বাদঁরামো করে হাত পা কাটলেও যে ফুফু পাগলের মতো ছুটে আসে। সে নাকি করবে অ’ত্যা’চা’র।’
‘তোর মেয়ে যে মায়ের আদল পেয়েছে। নাযীফাহ কাছে পাশে থাকলে মনে হয় আমার মা আমার কাছে আছে। শান্তি লাগে খুব।’
‘আমি কিন্তু কাল সকালেই ঢাকা ব্যাক করবো। এখন বিভিন্ন ভার্সিটি পরীক্ষা হচ্ছে। একজন কোচিং সেন্টারের শিক্ষক হিসেবে এই সময় আমার গ্রামে থাকা বেমানান।’
মা আর মামুর মন অন্যদিকে ঘুরাতে এই কথা বলে তাহমিদ। না হলে এখনই ম’রা বাড়ির মতো কান্না শুরু করবে।
‘সেকি কালই চলে যাবে?’
রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে বসার ঘরে আসতে আসতে বলেন ফাহমিদা বেগম।
‘হুম মামি। এখন ওদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমি একদিন এখানে থাকলে ওরা পিছিয়ে যাবে। মা বাবা চা শেষ কর তাড়াতাড়ি। বাড়ির পথে রওনা দিতে হবে।না হলে বেশি রাত হয়ে যাবে।’
‘কাল সকালে ঢাকা যাবি ঠিক আছে। এখান থেকেই না হয় সকালে চলে যাস।’
‘না মামু সব দরকারি জিনিস আমাদের বাড়িতে রয়ে গেছে।’
খালেদ মোশাররফের কথার উত্তরে বলল তাহমিদ।
‘আচ্ছা সে না হয় যাবে তোমরা। রাতের খাবারটা খেয়ে যেও।’ তাহমিদের কথা শুনে বলল ফাহমিদা বেগম।
‘না মামি তোমাদের উপর বিশ্বাস নেই। তোমরা কথা বলতে বলতে খাবার খাবে। আর রাত দশটা বেজে যাবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাদের জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে দিচ্ছি। মাউই মা আসলে কত ভালো ছিলো।’
‘মা তো আসতে চেয়েছিলেন। ঘরোয়াভাবে হউক আর যেমনই হউক বড় নাতির বিয়ে। কিন্তু অসুস্থতা আর হতে দিলো। তবে মা ভীষণ খুশি নাযীফাহ’র সাথে ঝগড়া করার জন্য আর বাড়িতে আসতে হবে না। ও বাড়িতে বসে বসে ঝগড়া করতে পারবে। কবে যে আমার ছেলের সুমতি হয় ঘরের বউকে ঘরে নেওয়ার আল্লাহ মালুম।’ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন জামান সাহেব।
‘আপনারা চা শেষ করুন আমি খাবার প্যাক করছি।’ বলেই আবার রান্নাঘরের দিকে গেলো ফাহমিদা বেগম।
____________________________________________
রাতে খাওয়ার সময় মেয়েকে ডাকতে আসলেন ফাহমিদা বেগম। দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে দেখেন মেয়ে তার সারা খাটে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমোচ্ছে। শাড়ি এলোমেলো। মেয়ের ঘুমের নমুনা দেখে শব্দহীন হাসলেন উনি। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ভাবলেন,
‘গায়ে গতরে বড় হলেও স্বভাব আচরণে এখনো বাচ্চা নাযীফাহ। অথচ এই অবুঝ মেয়েটারই নাকি বিয়ে হয়ে গেছে।’
‘নাযীফাহ?’ আলতো স্বরে ডাকলেন ফাহমিদা বেগম।
মায়ের ডাকে পিটপিট করে তাকালো সে।
‘রাতের খাবার খাবি না, মা?’
‘খাবো না মা। ঘুমুতে দাও।’ ঘুম ঘুম গলায় বলল নাযীফাহ।
‘রাতে ভাত না খেলে কিন্তু শরীর থেকে এক চড়ুই পাখির সমান মাংস কমে যায়।’
‘কমলে ভালো। কেউ আর আমাকে মুটি বলবে না। আমি গাছের মগডালে চড়তে পারবো।’
‘আল্লাহ এই মেয়ের ঘুমের মাঝেও এসব ভাবে। এই মেয়ে কবে বড় হবে? এর সমান অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়ে গেছে। আর এই মেয়ে এখনো ছোট বাচ্চাদের মতো গাছে চড়ার কথা বলছে।’
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে রুম থেকে প্রস্থান করলেন ফাহমিদা বেগম। মায়ের কথায় মুচকি হেঁসে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো নাযীফাহ।
____________________________________________
ভোরে নিজের সবকিছু গোছগাছ করছে তাহমিদ। একটু পরেই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। সকাল সকাল রওনা হওয়ার একটাই কারণ, আজকের ক্লাসটা যেন কোনোভাবে মিস না যায়। একটা বক্সে বিরিয়ানি নিয়ে তাহমিদের রুমে আসলেন ওয়াহিদা।
‘বাবা, ঢাকায় কি তোর কোনো পছন্দ আছে? নাকি আমরা আমাদের সবার সিদ্ধান্ত তোর উপর চাপিয়ে দিয়েছি?’
অকস্মাৎ মায়ের কথায় চমকিত হয় তাহমিদ।
#চলবে