হৃদয়াবেগ #পর্বঃ০৪,০৫

0
1301

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৪,০৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
০৪

এসএসসি পরীক্ষার পরে তিনমাস বন্ধ থাকে।তন্মধ্যে একমাস শেষ। নাযীফাহ’র দিন কাটে পাড়ার বাচ্চাদের সাথে মার্বেল, বউছি, গোল্লাছুট এসব খেলে। এর মাঝে আমেনা বেগম এসে দিন কয়েক এখানে থেকে গেছে। দু’জনের হায়রে ঝগড়া আর খুনসুটি।

আজ বিচার বসবে নাযীফাহ’র বিরুদ্ধে। কারন সে একজন মাতবর গোছের লোকের মাথা ফাটিয়েছে। কেন ফাটিয়েছে কেউ জানে না। ঘটনা তিনদিন আগের। সব শুনে ওয়াহিদা, জামান আর আমেনা বেগমও এসেছে। এসব ঘটনা অজানা তাহমিদ আর ফাহিমের। সবাই হাজার চেষ্টা করেও নাযীফাহ’র মুখ থেকে একটা কথা বের করতে পারিনি। সে যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে। ফাহমিদা বেগম ম’রা’র মতো আছে। খালেদ মোশাররফ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

আজ বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ কারণ বাজারেই বিচারসভা হবে। মহিলারা এখানে ওখানে লুকিয়ে দেখতে এসেছে। শুরু হলো বিচার কার্য। পাঁচজন মাতবরের একে একে সবাই নাযীফাহকে জিজ্ঞেস করলো কেন সে এই কাজ করেছে। কিন্তু সে নিরুত্তর। কেউ একজন বলে উঠলো,

‘খালেদ ভাইয়ের তো দস্যি। এতো ধিঙি হওয়ার পরও ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলে। দেখেন গিয়ে হয়তো ভালো কথা বলেছে বলে এই ফাজিল মেয়ে তারেক সাহেবের মাথা ফাটিয়েছে।’

যে যা পারছে সব বলছে।অপমানে মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে খালেদ মোশাররফের। এখান ওখান থেকে মহিলারাও কানাঘুষা করতে লাগলো। বিচারকরা সবাই আলোচনা করতে লাগলো নাযীফাহকে কি শাস্তি দেওয়া যায়। প্রায় মিনিট তিরিশ আলোচনার একজন বললেন,

‘নাযীফাহ’র আশেপাশের বাচ্চারাও ওর থেকে এসব উগ্র আচরণ শিখবে।সেজন্য নাযীফাহ ঘরবন্দী হয়ে থাকবে।কারে সাথে মিশতে পারবে না। আর খালেদ মোশাররফ সাহেবকে গ্রাম্য সালিশের বিচারক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। যে নিজের মেয়ে সামলাতে পারে না সে পুরো গ্রামের মানুষের বিচার করবে কিভাবে।’

নাযীফাহ’র গৃহবন্দীর ব্যপারটা বুঝলেও সালিসি কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির কারন বুঝলো না খালেদ মোশাররফ। হয়তো আগের শত্রুতা। বিচার কাজ শেষ। সবাই উঠে দাঁড়ালো। একজন পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের নারী ছয় থেকে সাত মাস বয়সী বাচ্চা কোলে এসে সামনে দাঁড়ালো। উপস্থিত সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই নারীর দিকে।

‘দোষী কে ভালো সাজিয়ে নিরপরাধীদের শাস্তি দিবেন না।’

কেউ একজন বলে উঠলো, ‘মানে?’

তারেক সাহেবের যেন চেহারার রংই পাল্টে গেলো। নারীটি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,

‘আপনারা সবাই জানেন আমার স্বামী কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে শয্যাশায়ী হয়ে যায়। জমানো টাকা যা ছিলো সব উনার পিছনে খরচা হয়ে গেছে। তাই হাজার তিরিশ টাকা আমি আর আমার শ্বাশুড়ি তারেক চাচার কাছ থেকে হাওলাত আনি সুদের উপর। পাঁচদিন আগে তার ১ মাস পূর্ণ হয়। উনি আসে টাকা নেওয়ার জন্য। আমার শ্বাশুড়ি তখন আমার ননাসের বাড়ি গেছে। উনাকে দেখা মাত্র আমি চেয়ার এনে দিলাম। আর উনি সুযোগ বুঝে আমার হাত চেপে ধরে বলে, ‘আমার বিছানায় গেলে এই টাকা দিতে হবে না। উল্টে আমি তোকে আরো টাকা দিবো।’ উনার কথা শুনে রাগে গা রি রি করে আমার। ইচ্ছে করছিলো উনার মুখের উপর বমি করে দেই। উনি আমার সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। বলে না রাখে আল্লাহ মারে কে? খেলা শেষে নাযীফাহ আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল পানি খাওয়ার জন্য। গিয়ে এই পরিস্থিতি দেখে হাতের কাছে যা ছিলো তা দিয়ে উনার মাথায় আঘাত করে।’

কান্নার প্রকোপে গলায় কথা আটকে এলো সে নারীর। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন নারী।

‘নাযীফাহ আমার ফেরেশতার রূপে এসেছে। না হলে যে মেয়ে কখনো এইদিকে আসে না সে আসবে কেন? ওই মেয়েটার জন্য আমার সম্ভ্রম রক্ষা পেয়েছে।’

তারেক সাহেব হুঙ্কার দিয়ে বললেন,

‘এই মহিলা মিথ্যে বলছে। টাকা দিতে পারবে না বলে আমাকে ফাঁসাচ্ছে।’

ভরা মজলিস থেকে কেউ কেউ বলছে,

‘এসব কথা তাহলে নাযীফাহ কেন বলে নাই।’

কথাটা ওই নারীর কানে আসা মাত্রই সে বলে,

‘কারণ এই তারেক চাচা আমাকে হুমকি দিয়েছে, আমি যদি এই ঘটনা কাউকে বলি তো আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে গ্রাম ছাড়া করবে। আমার স্বামীকেও দেখে নেবে।তাই আমি নাযীফাহ’র কাছে অনুরোধ করেছি সে যেন কাউকে না বলে। এখন তো দেখছি চুপ করে আছি বলে নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পাচ্ছে। আপনারা কেমন বিচারক? কোনোকিছু যাচাই ছাড়া শাস্তি দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছেন।’

মাথা নিচু করে বসে রইল সবাই। কারো মুখে কোনো রাঁ নেই। তারেক সাহেব রাগে ফুঁসছেন। টলমল চোখে হাসি ফোটে উঠে খালেদ মোশাররফ সাহেবের। এক পা এক পা করে তিনি মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন,

‘আমার দস্যি মেয়েটা যে একজনের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে আমার সম্মান বাড়িয়ে দিলো। সে এখন তার বাবার গর্বের কারন।’

উপস্থিত সকল উদ্দেশ্য করে খালেদ মোশাররফ বলেন,

‘যে সালিসে কোনো সত্য উদঘাটন ছাড়া বিচার করা হয় থাকলাম না সেখানে সদস্য হয়ে।’

সেখানে আর উপস্থিত না থেকে খালেদ মোশাররফ তার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

উনি চলে আসার পর তারেক সাহেব সেই নারীর পা ধরে ক্ষমা চায় ভরা মজলিসে। বলা চলে এক প্রকার বাধ্য হয়ে ক্ষমা চায়।

____________________________________________

নাযীফাহ আর তার বাবা বাড়ি আসার পরে, তার বাবা ওয়াহিদা, জামান আর আমেনা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার অবুঝ, বাচ্চা মেয়েটাকে বাড়ির বউ করেছেন। এতো কিছু হওয়ার পরও কিচ্ছু বলেননি। অন্য মানুষ হলে হয়তো এতোক্ষণ সম্পর্ক শেষ করে দিতো।’

খালেদ মোশাররফের কথায় আমেনা বেগম কাছে এলেন। নাযীফাহ’র মাথায় হাত রেখে বলেন,

‘ছোট বেলায় আমিও এই ছুড়ির মতো দস্যি ছিলাম। বলা চলে এর থেকেও বেশি।এলাকার মানুষ আমায় নিয়ে ভয়ে থাকতো। বিয়ের পর আমার খুব শখ ছিলো একটা মেয়ের। আমার এই শখ পূরণ হতে হতে হলো না। পরপর তিনবার মেয়ে জন্ম দিলাম তাও মৃত। শেষে জামান হলো। আমার আর বাচ্চাই হলো না। জামানকে বিয়ে করানোর পর ভাবলাম মেয়ে নাই তো কি হয়েছে ছেলের বউ হয়েছে। আবার নাতনি হবে। এবারও আমার আশা পূরণ হলো না। ওয়াহিদা দুই ছেলের জন্ম দিলো। এরপর জন্ম নিলো নাযীফাহ। নাযীফাহ একটু একটু বড় হওয়ার পরের কাহিনি ওয়াহিদা বলতো আর হাসতো। তখনই ভেবে নিয়েছিলাম এই দস্যি মেয়েকে নাতবউ করবো।কারন ওর মাঝে আমি আমার ছোটবেলাকে দেখি।’

____________________________________________

সেই ঘটনার প্রায় পনেরো থেকে বিশ দিন কে’টে গেছে। যে যার কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। সেই ঘটনা বলা হয়নি তাহমিদ কে। কারন ওয়াহিদা ছেলের চোখে নাযীফাহ’র জন্য আতংক দেখেছে। এসব বললে টেনশন করবে সে।

সারাদিনে কোচিং তারপর ইন্টারভিউ আর সন্ধ্যায় টিউশন করিয়ে মাত্রই একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো তাহমিদ। খালেদ মোশাররফের ফোন রিসিভ করতেই শুনতে পেলো, নাযীফাহকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হৃদস্পন্দন থেমে গেলো তার। কি জবাব বুঝে উঠতে পারলো না। এই রাতের বেলা ফাহিম কে নিয়ে রওনা দিলো গ্রামের উদ্দেশ্যে।

শেষ রাতের দিকে গ্রামে গিয়ে পোঁছায় দুই ভাই। নিজেদের বাড়ি না গিয়ে সোজা নাযীফাহ’দের বাড়ি গিয়ে উঠে। তখন প্রায় সকাল। সবারই নির্ঘুম রাত কে’টেছে। তাহমিদ বাড়ি আসার পর সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো।অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তোমাকে বলেছিলাম না মা তোমার ভাইঝিকে সাবধানে থাকতে বলবে। তাকে নিয়ে আমার টেনশন হয়। কোথাও খুঁজবো ওকে? সেই লোকটার বাড়ি গিয়েছিলেন?’

তাহমিদের কথার পিঠে খালেদ মোশাররফ বলেন,

‘গিয়েছিলাম। তারেক সাহেব হাসপাতালে আজ তিনদিন যাবৎ। তাহমিদ বাপ আমার বুকের ধন কই গেলো।আমার একমাত্র সন্তান। এই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছি। আমার বুকের মানিক সুস্থ আছে তো? তোর মামিকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছি। মেয়ের চিন্তায় প্রেশার কমে গেছে।’

‘থানায় মিসিং কমপ্লেন করেছো মামা?’

‘চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছুই করবে নাকি তারা। আমি আশপাশ সব জায়গায় খুঁজেছি কোথায় নেই।’
____________________________________________

দুইদিন হতে চললো নাযীফাহ’র কোনো খুঁজ নেই। প্রত্যেকটা সদস্যের অবস্থা খারাপ। তাহমিদ নিজেকে যতই শক্ত দেখাক না কেন ভেতরে ভেতরে সেও ভেঙে পড়েছে। পাগলের মতো সাথে ফাহিমকে নিয়ে এখানে সেখানে সব জায়গায় খুঁজেছে। পুলিশও খুঁজছে কিন্তু কোনো হদিস নেই।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। এই এখনি বৃষ্টি নামবে বলে। বৃষ্টির অভাবে কৃষকরা এতোদিন ধানগাছ রোপন করতে পারেনি। তাই তাই কেউ জমির দিকে যাচ্ছে যদি বৃষ্টি হয় আশায়। নাযীফাহদের পাশের মকবুল মিয়া ও গেছে জমির কাছে। ওনার জমির কাছে যাওয়ার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তৎক্ষনাৎ নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নেয় ডিপ মেশিনের ঘরের ছাউনির নিচে। যেখান থেকে সব জমিতে পানি সেচ দেওয়া হয়। এটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। হঠাৎই গুঙ্গানোর শব্দে এদিক ওদিক তাকায় মকবুল সাহেব। কোনো কিছু না দেখতে পেয়ে সেই ঘরের একটু ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকান উনি। যা দেখলেন উনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।

____________________________________________

জমির মাঝখানে সেই সেচ মেশিনের ঘরে আছে নাযীফাহ। মকবুল সাহেব সবাইকে ফোন দিয়ে জানালেন। মকবুল সাহেব জমিতে এলে কখনো মোবাইল সাথে আনেন না। কিন্তু আজ কি মনে করে যেন নিয়ে এসেছেন। সেখানে ভীড় করছে অনেকে। নাযীফাহ দীর্ঘ দুইদিন পরে বাবাকে দেখে জ্ঞান হারালো।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে নাযীফাহ। পুলিশ এসেছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। অদূরে তাহমিদ বসে আছে। উসকোখুসকো চেহারা। পুলিশ চলে গেলো। খালেদ মোশাররফ মেয়ের কাছে বসলেন। নাযীফাহ বাবাকে দেখে ছোঠ বাচ্চাদের ন্যায় ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিলো।

‘জানো বাবা, আমি ভেবেছি আর তোমাদের দেখতে পাবো না। ওই নোংরা লোকটা আমাকে সেখানে বেঁধে রেখে এসেছিলো। দুই রাত শেয়ালের ডাকে ঘুমোতে পারিনি। মনে হয়েছে এই বুঝি আমাকে এসে খেয়ে ফেলবে। এতো ভয় আমি কখনো পাইনি। দুইদিন একটু পানিও পাইনি।’

মেয়ের কথা শুনে নিঃশব্দে কাঁদছেন খালেদ মোশাররফ। ফাহমিদা বেগমেরও অবস্থা খারাপ। উনাকে পাশের কেবিনে রাখা হয়েছে।

____________________________________________

পুলিশ ফোর্স গিয়ে হাজির হয় তারেক সাহেবের বাড়ি। ইন্সপেক্টর উনাকে টেনে বিছানা থেকে তুলে।

‘অনেক অসুস্থ হওয়ার নাটক করেছেন। এবার থানায় চলুন।’

তারেক সাহেব কিছু না জানার ভাব ধরে বলে,

‘আমি কি করেছি অফিসার?’

পুলিশ অট্ট হেসে বলে,

‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি তো কলা খাইনি।’

‘আমার অপরাধ তো বলবেন।’

‘নাযীফাহ নামক ছোট্ট মেয়েকে কিডন্যাপ করার অপরাধে।’

ফ্যাকাসে হয়ে এলো তারেক সাহেবের মুখ। নাটক করে হাসপাতালে থাকতে সব তার অজানা। আজই বাড়ি এসেছেন। মাথা নুইয়ে ফেলে সে। পুলিশ লোকটা বিদ্রুপের স্বরে বলে,

‘এখন কিছু বলছন না কেন? জবান বন্ধ হয়ে গেছে।’

পুলিশের পীড়াপীড়ি কাছে অবশেষে হার মানে তারেক সাহেব।

‘হ্যা আমিই করেছি। ওই ছোট্ট মেয়েটার জন্য আমার ছেলে মেয়েরা আমার সাথে কথা বলে না। আমার স্ত্রী আমার সাথে কথা বলে। দূরে দূরে থাকে। সমাজের লোক চরিত্রহীন বলে। কোথাও মুখ দেখাতে পারি না। তাই ওকে কিডন্যাপ করেছি। চেয়েছিলাম না খাইয়ে রেখে মে’রে ফেলতে। কই মাছের প্রান সেই মেয়ের।’

উনার পরিবারের সদস্যরা হতভম্ব হয়ে গেলো। পুলিশ উনাকে ঠেলতে ঠেলতে জিপে নিয়ে তুলেছে।

____________________________________________

সবাই নাযীফাহ’র কাছে বসে আছে। ওয়াহিদা গিয়েছে ফাহমিদার কাছে। দূর থেকে তাহমিদ নাযীফাহ’র কাছে এলো। তাহমিদের চেহেরার এই পরিবর্তন দেখে নাযীফাহ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ নাযীফাহ’র বিস্মিত দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে বলল,

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আমি এবার আমার সাথে করে নাযীফাহ কে নিয়ে যাবো। ওকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে যেতে পারবো না। আর না পারবো ওকে এখানে রেখে ঢাকা গিয়ে শান্তিতে থাকতে। ওই বিকৃত মস্তিষ্কের লোকটা যে পুনশ্চ হামলা করবে না তার জামিনদার কে হবে? অনেক তো হলো ছেলেমানুষী। এখন না হয় বুঝদার হওয়ার পালা।’

চমকিত নাযীফাহ, আতঁকে উঠলো সে।আত্মা কেঁপে উঠলো তার। অজানা নয় তার ঢাকা গেলে তাকে বন্ধি জীবন কাটাতে হবে। ওখানে না আছে খেলার মাঠ আর তার সাথী সঙ্গী। অপরিচিত জায়গায় সে কোনো ভাবে থাকতে পারবে না। বাবার অভিমুখে নেত্রপাত করলো সে। আঁখি পল্লবে যেন এক্ষুনি ভারি বর্ষন হবে। খালেদ মোশাররফ মেয়ের মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে মাথা অধঃকৃত করে ফেলে। নিরুপায় তিনি। মেয়ের এই অসহায় চোখ মুখের ভাবাবেগ দৃঢ় মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরা তার সাজে না। তার একমাত্র আত্মজার জীবন ম’র’ণের প্রসঙ্গভূত বিষয়। অধিকন্তু বর্তমানে তাহমিদ নাযীফাহ’র অভিভাবক। তার একমাত্র মেয়ের সকল দায়িত্ব এখন তাহমিদের। নত মস্তকে বাবাকে দেখে নাযীফাহ প্রতীত হলো তার ঢাকা যাওয়া নিশ্চিত। একবার যখন তাহমিদ ভাই মুখ দিয়ে বের করেছে ঢাকা নিয়ে যাবে তো নিয়েই যাবে।

____________________________________________

ওয়াহিদা বা ফাহমিদা কারোর পক্ষেই সম্ভব না ঢাকা গিয়ে থাকা। ঠিক হলো নাযীফাহ কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমেনা বেগমই যাবেন। উপরন্তু তাহমিদ নারাজ নাযীফাহ’র সাথে দাম্পত্য জীবন শুরু করতে। সে তার সিদ্ধান্তে অটল, আগে নাযীফাহ স্বীয় মঙ্গল অমঙ্গল বুঝবে তারপর বাকিসব। তথাপি এইখানেও সে নাযীফাহ কে রাখবে না। তাহমিদ আর ফাহিম দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। খুঁত খুঁতে স্বভাবের ফাহিম। তার জন্যই আলদা ফ্ল্যাটে থাকা তাহমিদের।

সবকিছু গোছগাছ করছেন ফাহমিদা বেগম। নাযীফাহ মায়ের দিকে নির্নিমিখ আঁখিতে তাকিয়ে আছে। নয়নবারিতে টইটম্বুর কনীনিকা। এক্ষুনি সম্ভবত নিন্মমুখী হবে অক্ষিযুগলের সেই অতি মূল্যবান অম্বু। মেয়ের মায়াময়ী আননে দৃষ্টিপাত করেও করলো না ফাহমিদা বেগম। মেয়ের জন্য তার বক্ষস্থলেও অদৃশ্য র’ক্ত’ক্ষ’র’ন হচ্ছে। কিন্তু তা মেয়েকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। তাহলে তার অবুঝ মেয়েটা আর শহরে যেতে চাইবে না। সবকিছুর উর্ধ্বে মেয়ের নিরাপত্তা।

নাযীফাহ’র সকল প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে উঠানো হলো। এক্ষুনি তারা ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। সবাই উপস্থিত তবে নেই শুধু ফাহমিদা বেগম। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে নয়ননীর বিসর্জন দিচ্ছেন। অবুঝ মেয়েটার অভিমান ভরা অঙ্গরেখার দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। কাল বিকেল থেকে কিছু খায়নি নাযীফাহ। যতবারই খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে ঠিক ততবারই নাযীফাহ কঠিন গলায় বলেছে, ‘গ্রাম থেকে তো শহরে চলেই যাচ্ছি। একেবারে না হয় শহরে গিয়েই খাবো।’

নাযীফাহ’র বরাবর অগ্রসর হলেন খালেদ মোশাররফ। তিনি ঢাকা যেতে চাইলে তাহমিদ বাঁধা দেয়। কি দরকার এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে টানাহেঁচড়া করার। বিষন্ন হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই দু’কদম পিছিয়ে গেলো নাযীফাহ। ছলছল চোখে মুখ ফিরিয়ে সে। মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো খালেদ মোশাররফের মুখমণ্ডল। বাবাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না নাযীফাহ। গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।

মেয়ের এমন মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ব্যথিত হলো খালেদ মোশাররফ। বিষন্ন স্বরে তাহমিদের দু’টো হাত ধরে বলে উঠলো,

‘তোর হাতে আমার বুকের মানিকরে তোলে দিলাম বাপ। আমার মেয়েটা পুরোদস্তুর বাচ্চা। দুনিয়ার মারপ্যাচ কিছুই বোঝে না। তুই কষ্ট করে সামলে নিস। মেয়েটা আমার একমাত্র তোর কথাই ঠিকমতো শুনে। খাওয়া নিয়ে হাজারও বায়না তার। তুই সামনে বসিয়ে খাওয়াবি। না হলে সারাদিনে মুখে কিছু তুলবে না। আমার মেয়ের উপর দিয়ে এতোবড় ঝড় না গেলে আমি কখনো আমার মেয়েকে কাছ থেকে দূরে পাঠাতাম না।’

মামুকে আশ্বস্থ করে গাড়িতে উঠে তাহমিদ। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। পিছনের সীটে বসেছে আমেনা বেগম, নাযীফাহ আর ফাহিম। আর সামনে তাহমিদ আর ড্রাইভার। গাড়ি চলা শুরু করতেই নাযীফাহ আমেনা বেগমের বক্ষকে অবলম্বন করে অশ্রুপাত করতে লাগলো।

গ্রামের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠেছে গাড়ি। দিনের ঔজ্জ্বল্যতা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে নক্ষত্রমন্ডলে মেঘেরা ভির করেছে। আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি বর্ষিত হওয়া আরম্ভ হলো। বজ্রপাতহীন মুষলধারে বৃষ্টি। বারিবিন্দু আছড়ে পড়ছে জানালার কাঁচে। নাযীফাহ মাথা তুলে ক্ষীণ স্বরে ড্রাইভারকে বলে,

‘জানালার কাঁচটা খুলে দিন না দয়া করে।’

নাযীফাহ’র দিকে অপাঙ্গে চাইল তাহমিদ। ড্রাইভার সামনে দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই জবাব দিলো,

‘ যেই পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে, এখন জানালার কাঁচ আধখোলা রাখলে ভিজে যাবেন।’

অগত্যা মন খারাপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ। তাহমিদ ইঙ্গিতে ড্রাইভারকে বলল
কাঁচ খুলে দেওয়ার জন্য। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে উনি এসি বন্ধ করে গাড়ির লক খুললেন।তারপর ফাহিমকে বললেন জানালার কাঁচ খুলে দেওয়ার জন্য। বৃষ্টির ছিটকানো পানি মুখে এসে পড়তেই অধর কোণে হাসি ফুটে উঠলো।উৎফুল্ল, প্রানবন্ত হয়ে উঠলো মন। হাত বাড়িয়ে দিলো বহির্ভাগে। আড়চোখে নাযীফাহ’র উৎফুল্লতা লক্ষ্য করছে তাহমিদ। করতলে বৃষ্টিবিন্দু জমিয়ে ভেতরে আনে হাত।

‘এগুলো বৃষ্টি না গ্রাম ছেড়ে চলে আসায় আমার চোখের নোনাজল এগুলো। আমার চোখের পানি বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরছে।’

নাযীফাহ’র অর্থহীন কথা শুনে নৈঃশব্দে হাসলো তাহমিদ। ড্রাইভার মিটিমিটি হাসছে।তবে শব্দ হচ্ছে না। এতোক্ষণ বহুকষ্টে চেপে রাখা হাসিটা আর আঁটকে রাখতে পারলো না ফাহিম। শব্দ করে হেসে উঠলো সে।

‘তাইলে বইন তুই দয়া কইরা তোর মনের কান্দন থামা। নাইলে আশমান ভেদ করে ঝরা তোর চোখের পানিতে দেশ ভেসে যাবে। এই অবলা মানুষদের উপর রহম কর বইন রহম কর।’

করতলে থাকা অম্বু ফাহিমের সম্মুখ বরাবর নিক্ষেপ করে নাযীফাহ।

____________________________________________

কোথাও একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেজন্য বন্ধ ছিলো যান চলাচল। সেই জ্যামে প্রায় ঘন্টা তিনেক আটকা পড়েছিল তাদের গাড়ি। ঘেমে-নেয়ে একাকার একেকজন। নাযীফাহ মনে মনে কঠোর ভাষায় তিরস্কারও করলো। গোধূলির আকাশে রক্তিম আভা যখন সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হলো ঠিক তখনই জ্যাম ছাড়লো। স্নিগ্ধশীতল বাতাস গাত্র ছুঁয়ে দিতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো নাযীফাহ। অপরদিকে আমেনা বেগম ভর্ৎসনা করতে লাগলো, আগে জানলে কখনো আসতো না। তার আছরের নামায আর মাগরিবের নামায কাজা হয়ে গেলো।

সন্ধ্যার পরপর বাসায় থাকার কথা। অথচ রাত সাড়ে ন’টা ছুঁই ছুঁই মাত্র গাড়ি বাসার নিচে থামলো। ফাহিম তার বলল,

‘ভাইয়া এরা দু’জন তো গভীর ঘুমে নিমগ্ন।’

তাহমিদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো,

‘ডাক দু’জনকে।’

ফাহিম পরপর কয়েকবার আমেনা বেগমকে ডাকতে পিটপিট করে তাকালো। কিন্তু নাযীফাহকে এতোবার ডাকার পরও চোখ মেলল না। ফাহিম নিরাধার চক্ষে তাকালো ভাইয়ের দিকে।

‘ভাইয়া তোমার শিশু পত্নী চোখ খুলছে না।’

হাসি পেল তাহমিদের। কিন্তু চোখে-মুখে তা ফুটে উঠলো না। চোখ রাঙায় সে ফাহিমকে।

‘তুই আগে মালপত্র বের কর। আমি আগে ভাড়া মিটিয়ে নেই।’

ফাহিম মাথা নেড়ে সায় জানায়। চলে যায় গাড়ির ডিকির কাছে। ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে তাহমিদ সতর্কতার সহিত নাযীফাহ কে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। নাযীফাহ’র মাথাটা বুকে রাখতেই শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। হাসলো সে। একটু একটু করে এই অবুঝ মেয়েটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছে সে। যখন শুনলো নাযীফাহ কে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন মনে হয়েছিল তার গলায় কেউ চি’পে ধরেছে।

বাসায় এসে নাযীফাহকে বিছানায় শুইয়ে আগে তাহমিদ ফুডপান্ডায় খাবার অর্ডার করলো। অন্য রুমে খাট নেই তাই ফ্লোরে ম্যাট্রেস পাতলো দুই ভাইয়ের জন্য। এখন থেকে এখানেই থাকবে তারা।

সবকিছু গোছগাছ করা শেষ। আমেনা বেগম নামায পড়ছেন। ঠিক সেই সময় ডেলিভারি বয় এলো খাবার নিয়ে। খাবার নিয়ে বিপাকে সে।প্লেট দুইটা অথচ মানুষ চারজন। দু’টো প্লেটে খাবার নিয়ে আগে সে দাদিকে দিলো।আরেকটা প্লেটে খাবার নিয়ে রুমের দিকে গেলো। ফাহিম এসব দেখে সুদীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল।

‘আহা কি মহব্বত। এইদিকে ছোট ভাই না খেয়ে বসে আছে সেদিকে নজর নেই।’

তাহমিদ মৃদু স্বরে নাযীফাহকে ডাকছে। এপাশ-ওপাশ করে জবাব দিলো সে। তাহমিদ খাওয়ার কথা বলতেই ঘুমন্ত অবস্থায় তার চোখ মুখ কুঁচকে এলো। ঘুম ঘুম গলায় বলে উঠলো,

‘খাবো না আমি। আমার শরীর কেমন জানি করছে।’

‘কাল থেকে না খাওয়া তুই। সেজন্য তোর শরীর দূর্বল। এখন কিছু না খেলে সকালে আরো নেতিয়ে পড়বি।’

নাযীফাহ ‘খাবো না’ বলে আবার ঘুমিয়ে যেতে উদ্যত হতেই আকস্মিক ধমকে উঠে তাহমিদ। কেঁপে উঠে নাযীফাহ। দূর্বল শরীরটা নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। তৎপরে ঠোঁট উল্টে বলে,

‘আপনি আমাকে ধমক দেওয়া, রাগ দেখানো এসবের জন্য গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। আমি জানি তো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাহমিদ।

‘খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে আর বকবো না।’

‘খেতে হলে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুতে হবে। আমার এসব কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। তাই আমি খাবো না।’

‘তাহলে আমি খাইয়ে দেই?’

কথাটা কর্ণকুহরে পোঁছানো মাত্রই বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকায় নাযীফাহ।

____________________________________________

পাশের ফ্ল্যাটের প্রবেশদ্বারের সামনে দন্ডায়মান তাহমিদ। কলিং বেল চাপবে কি চাপবে ইতস্তবোধ করছে। এই সাতসকালে কারো বাসায় যাওয়াটা কেমন দেখায় না। মনের সাথে যুদ্ধ করে কলিং বেল চাপলো তাহমিদ। খানিক সময় পর একজন ২৯ কি ৩০ বছরে নারী দরজা খুলে দেয়। তাহমিদকে দেখে মৃদু হাসলো সে। জবাবে তাহমিদও হাসলো। সৌজন্যতার খাতিরে নারীটি বলল,

‘আরে তাহমিদ যে, ভেতরে এসো। নিতুর বাবা নাস্তা করছে। নাস্তা করে যাও।’

জবাবে তাহমিদ বলে,

‘না ভাবি। আসলে একটা সাহায্যের জন্য এসেছিলাম।’

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উনি।

‘আসলে ভাবি এতোদিন তো আমি আমার ভাই থাকতাম। কাল গ্রাম থেকে আরো দু’জন এসেছে। আমার দাদি আর মামাতো বো,,,’

বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। নিতুর মা জিজ্ঞেস করে,

‘দাদি আর কে?’

নিরব, নিশ্চুপ তাহমিদ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here