হৃদয়াবেগ #পর্বঃ২০,২১

0
1110

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২০,২১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
২০

প্রেয়সীর ক্রন্দনরত অভিমানি আনন আঁখিপটে ভাসতেই বিষন্নতায় আচ্ছাদিত হয়ে গেলো তাহমিদের অন্তর। পরক্ষণে মনকে সান্ত্বনা দিলো এই বলে যে, পড়াশোনার সাথে নো কম্প্রোমাইজ। এখন সে প্রেয়সী না সে এখন ছাত্রী।’

স্ট্রাকচার বোঝানো শেষে সবাইকে এক্সারসাইজ করতে দিলো তাহমিদ। ক্লাসের এই মাথা থেকে ওই মাথা রাউন্ড দিয়ে দেখতে লাগলো সবার এক্সারসাইজ। জান্নাত তাহমিদকে ডাকল,

‘স্যার এক্সারসাইজের চার নাম্বারটা বুঝতে পারছি না। একটু যদি বুঝিয়ে দিতেন?’

তাহমিদ কাছে এসে কলমটা হাতে নিয়ে বুঝাতেই জান্নাত সবার অগোচরে ধীর, মৃদু স্বরে বলল,

‘নাযীফাহ কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। পিপাসা পেয়েছিলো বলে জাস্ট জিজ্ঞেস করেছে আমার কাছে পানি আছে কিনা। আজ আমরা টিফিন পিরিয়ডেও কিছু খাইনি। প্ল্যান ছিলো কিছু খেয়ে তারপর কোচিং-এ আসবো। কিন্তু তার আগেই আপনি কলেজে চলে এসেছেন।’

হাতের কলমটা ফেলে তাহমিদ বিস্মিত হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে জান্নাতের দিকে তাকাতেই জান্নাত মলিন হেসে বলল,

‘আর বোঝাতে হবে না স্যার বুঝে গেছি।’

তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে গেলো তাহমিদের মুখ।মন খারাপ নামক মেঘেরা জমতে শুরু করলো মনের আকাশে।জীবনের প্রথমবার মেয়েটার সাথে এমন কঠোর, অত্যুগ্র,রূঢ় ব্যবহার করলো তাও বিনা কারণে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো তার। থমথমে, বিষন্ন মুখ নিয়ে বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হটকারিতায় করা কার্যকলাপের জন্য আফসোস হতে লাগলো তার। বিষন্নতা কে এক পাশে রেখে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

‘সবার এক্সারসাইজ শেষ? আর কারো কোনো প্রবলেম আছে?’

সকলেই না বোধক মাথা নাড়ে। আরেকটা টপিক নিয়ে আলোচনা করার জন্য বোর্ডে লিখতেই শ্রেণিকক্ষের জানালা দিয়ে মনে হলো কিছু একটা দেখলো সে। দু’কদম পিছিয়ে এসে দাঁড়ালো জানালা বরাবর। জানালা বরাবর থাকা ফুচকা স্টলের দিকে দৃষ্টিপাত করেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো তার। নাযীফাহ আর একটি ছেলে হাসতে হাসতে ফুচকা খাচ্ছে। কথার মাঝে ছেলেটা টিস্যু এগিয়ে দিলো নাযীফাহ’র অভিমুখে। হাসিমুখে তা গ্রহণ করলো নাযীফাহ। দৃশ্যটি দৃষ্টিগোচর হতেই রাগে, ক্ষোভে, ক্রোধে হাতে থাকা মার্কার পেনটা চেপে ধরলো সে। তার হৃদগহ্বরে জ্বলন শুরু হলো। ঈর্ষান্বিত হলো সে। একজন প্রেমিক পুরুষ হিসেবে সে তার বক্ষঃস্থলে জেলাসির আনাগোনা টের পেলো। বোর্ডের কাছে এসে মিনিট দুয়েক চোখ বন্ধ করে রাখলো । যাও ব্যবহারের জন্য খারাপ লাগা শুরু করেছিলো এখন রাগ আর ক্রোধের মাত্রাটা তরতর করে বাড়ছে। টপিকটা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। ক্লাস থেকে বেরিয়ে সে সোজা ওয়াশরুমে গেলো। ট্যাপ চালু করে মাথায় পানি দিতে লাগলো।

____________________________________________

‘বুঝলি আজ আমার কলিজা ঠান্ডা হয়েছে। আমার না নাযীফাহকে একদম পছন্দ না। এতোদিন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। ইশ! নাযীফাহ’র মুখটা দেখার মতো ছিলো।’

পাশে থাকা মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে বলল,

‘আজকে তোর কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি।তুই কি ভেবেছিস নাযীফাহ তোকে ছেড়ে দিবে? মোটেও না।’

ওয়াশরুম থেকে মাত্রই তাহমিদ বের হয়েছিলো আকস্মিক কথা গুলো কর্ণগোচর হতেই পা থেমে গেলো তার। অতঃপর মেয়ে দুটিকে পাশ কাটিয়ে যেতেই তাদের চোখে মুখে আতংক ভর করলো।

রাস্তায় বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নাযীফাহকে খোঁজার চেষ্টা করলো তাহমিদ। আশেপাশে কোথাও নেই। অগত্যা একা একা রিক্সায় চড়ে বসলো বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

কলিংবেল চাপতেই আমেনা বেগম দরজা খুললেন। রাগত স্বরে বললেন,

‘তুই আজকে বিনাকারণে মেয়েটাকে সবার সামনে ধমক দিয়েছিস?’

আচমকা দাদির কথায় ভরকালো তাহমিদ। তারপর দাদির দিকে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

‘যখন ধমকেছি তখন সে আমার না ছিলো মামাতো বোন আর না বউ। একজন ছাত্রী হিসেবে বকেছি। বউ হিসেবে তার সকল বাচ্চামু আমি সাদরে গ্রহণ করে নিবো।তার পাগলামি আমি সহ্য করবো কিন্তু ছাত্রী হিসেবে তার কোনো ফাঁকিবাজি আমি মেনে নিবো না।’

আমেনা বেগম রুঢ় গলায় বলল,

‘হাতে কি তোর?’

‘কিছু না। তবে তুমি আগামী এক ঘন্টা ওই রুমের আশেপাশে যাবে না।’

আমেনা বেগম মুখ ভেঙচিয়ে বললেন,

‘আমার এতো ঠেকা পড়েনি।’

তাহমিদ দ্বারে পা দিয়ে দেখলো নাযীফাহ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শব্দ করে দ্বারের দু’কপাট বন্ধ করলো। মাথা থেকে কাঁথা সরিয়ে ফোলা ফোলা আঁখি পল্লব মেলে তাকালো নাযীফাহ। প্রেয়সীর এলোমেলো আনন দেখে অন্তর্দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হলো তাহমিদের। কয়েকটা শুকনো ঢুক গিলে সে। চেহেরায় গম্ভীর ভাব এনে রাশভারী গলায় বলল,

‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলের সাথে এক প্লেটে ফুচকা খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছেন বুঝি? তাই কলেজ ড্রেস না পাল্টে সোজা শুয়ে পড়েছেন ক্লান্তি দূর করার জন্য?’

তাহমিদের কথা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই রাগে ফুঁসতে লাগলো নাযীফাহ। নাযীফাহ’র রাগকে গ্রাহ্য করলো না তাহমিদ। হাতে থাকা প্যাকেট টা নিয়ে নাযীফাহ’র বরাবর বসলো। তারপর নাযীফাহ কে ইশারায় সেগুলো দেখিয়ে বলল,

‘এখানে চল্লিশ পিস ফুচকা আছে। একেবারে ঝাল দিয়ে বানানো। আমার সামনে এখন এগুলো শেষ করবি। তোর খুব ফুচকা খাওয়ার শখ না? আজ দেখবো তুই কত ফুচকা খেতে পারিস।’

নাযীফাহ অ’গ্নি দৃষ্টিতে একবার তাহমিদের দিকে আরেকবার ফুচকা গুলোর দিকে তাকালো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘সবগুলো ফুচকা আমি এখানে আপনার সামনে বসে শেষ করবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’

শর্তের কথা শুনে ললাটে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে তাহমিদের। কুঁজিত কপালে তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকালো।

‘ফুচকা খাওয়ার সময় আমি যদি ঝালে কাতরাই তাহলে আপনি আমাকে পানি দিতে পারবেন না। আর না আমাকে খাওয়ার জন্য নিষেধ করতে পারবেন।’

তাহমিদ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝালটকে ডুবিয়ে একের পর এক ফুচকা মুখে দিতে লাগলো নাযীফাহ। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। পাঁচটা ফুচকা মুখে দেওয়ার নাযীফাহ সত্যিকার অর্থে ঝালের অস্তিত্ব অনুভব করলো। ঝালে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে তার। ঝালে ঠোঁট আর নাক টকটকে লাল হয়ে গেছে। ঝালের প্রকোপে আঁখি পল্লবে অশ্রু ভর করেছে । সাত নাম্বার ফুচকা মুখে দেওয়ার পর আট নাম্বারে ফুচকায় হাত দিতেই তাহমিদ সেই হাত ধরে ফেলে। শান্ত, নিস্তেজ গলায় বলল,

‘আর খেতে হবে না।’

নাযীফাহ নাক টেনে জবাব দিলো,

‘এটা কিন্তু আমার শর্তে ছিলো না।’

‘আমি তো বলিনি আমি তোর শর্ত মানবো। তাহলে? আর খেতে হবে না।’

‘আমি তো খাবোই।’

বলতে দেরি আর একটানে নাযীফাহ কে বুকের মিশিয়ে নিতে দেরি করলো না তাহমিদ।

‘আমি তোকে অবিশ্বাস করি না। কিন্তু হুট করে কোনো ছেলের সাথে তোকে দেখার পরে যেখানে মাথা রেখেছিস সেখানে জ্বলন শুরু হলো। আমি তো হিংসাপরায়ণ ছিলাম না নাযীফাহ। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে কেন নিজেকে হিংসুক মনে হয়? আমি জেলাস নাযীফাহ প্রচুর পরিমাণে জেলাস।’

বেলা নামতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে গোধূলির আকাশে রক্তিম আভা। তাহমিদ ঠোঁট ছুঁয়ালো নাযীফাহ’র এলোমেলো চুলে।

‘তখনকার ওই ধমকের জন্য তাহমিদ সরি। তুই তো জানিস পড়াশোনার সময় বিরক্ত করলে আমার মেজাজ ঠিক থাকে না। জান্নাত আমাকে সব বলেছে।’

নাযীফাহ লেপ্টে রইলো তাহমিদের বুকে। এইখানে মাথা রাখলে নিজেকে বড্ড সুখী মনে করে সে। প্রশান্তির স্থান এটা। কখনো কখনো তার মনে হয় ঘড়ির কাঁটা থেমে যাক আর সে মিশে থাকুক তাহমিদের বুকের বা পাশে। নাযীফাহ ধীর গলায় বলল,

‘উনি জান্নাতের ছোট ভাই। আপনার সাথে কখনো দেখা হয়নি। চট্টগ্রামে থাকে। আমাকেও ছোট বোনের মতো মনে করে। জান্নাত কে নিতে এসেছিল। সবচেয়ে বড় কথা ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে।’

নাযীফাহ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তাহমিদ।

‘ড্রেস পাল্টে ফ্রেশ হয়ে আয়।

অবশিষ্ট ফুচকা গুলো হাতে নিয়ে অগ্রসর হলো দরজার দিকে। ছিটকিনি খুলে পুনশ্চ নাযীফাহকে বলল,

‘লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, কখনো আমার দূর্বল জায়গায় হাত দিবি না। আজ পার পেয়ে গেলি।পরে কিন্তু আমি ছেড়ে দিবো না।’

তাহমিদ চলে যেতেই অধর প্রসারিত করে হাসলো নাযীফাহ।

____________________________________________

তাহমিদ অবশিষ্ট ফুচকা গুলোর কিছু রাখলো আমেনা বেগমের জন্য বাকি গুলো নিতুদের বাসায় গিয়ে দিয়ে এলো। রাতে আর খাওয়া হলো নাযীফাহ’র। আমেনা বেগম আর তাহমিদ খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার মতো শুয়ে পড়লো। প্রভাতের কিরন চোখে পড়তেই পিটপিট করে তাকালো নাযীফাহ। গুটিগুটি পায়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে গেলো ড্রয়িং রুমের দিকে।সেখান থেকে উঁকি দিলো তাহমিদের রুমে। কোলবালিশ জড়িয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। নাযীফাহ পা বাড়ালো রান্নাঘরে দিকে। একটা চুলোয় চায়ের পাতিল বসালো। চা বানানো শেষে এক কাপ চা নিয়ে ছুটলো তাহমিদের কক্ষে । দূর থেকে মৃদু স্বরে ডাকতে লাগলো তাহমিদকে। নিদ্রামগ্ন তাহমিদের কর্ণে নাযীফাহ’র স্নিগ্ধশীতল কন্ঠস্বর পোঁছাতেই আঁখি পল্লব পিটপিট করতে লাগলো। কাপ হাতে দন্ডায়মান নাযীফাহ কে দেখে অধর কোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। এই যে তার মনের ঘরের ঘরোনি। উঠে বসলো সে।হামি দেওয়ার পর নাযীফাহ’র হাত থেকে কাপটা নিলো। চুমুক দিতেই চোখ বন্ধ করে নিলো সে। কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নিজে যেচে নাযীফাহ জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন হয়েছে চা?’

নাযীফাহ’র কথায় চোখ মেলে তাকায় সে।মৃদু শব্দে জবাব দেয়,

‘গরম গরম চা পাতা ফ্লেভারের শরবত। গরম গরম শরবতের টেস্ট খারাপ না।’

নাযীফাহ কাঁদো কাঁদো হয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,

‘চিনি বেশি হয়ে গেছে?’

তাহমিদ প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো,

‘এতো হাইপার হওয়ার কিছুই নেই। একেবারেই কেউ পারফেক্ট কিছু বানাতে পারে না। ভুল হয়, ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। পায়ে যে চা ফেলিসনি এটাই কপাল। আর আজকে কলেজ যাওয়ার দরকার নেই।’

____________________________________________

নাস্তার টেবিলে বসে আছে দু’জন। আমেনা বেগম নাস্তা শেষ করে স্থান ত্যাগ করেছে আরো আগে।

‘ষোড়শী কিশোরীর মনে ভয়ে কে’টে অন্তর্দেশে সাহসেরা বাসা বাঁধছে? আজকাল আর তাকে লজ্জা পেতে দেখা যায় না। এখন সে অর্ধাঙ্গের চোখে চোখ রেখে কথা বলে। শর্ত দেয় আবার মাঝে মাঝে চোখ রাঙানিও দেয়। ব্যপারটা মোটেও সুবিধার ঠেকছে না।তাগড়া যুবক ভবিষ্যত পরাধীনতার আভাস পাচ্ছে এখনই।’

তাহমিদের মুখ নিঃসৃত উক্তি শুনে কপাল কুঁচকে উক্তির অর্থোদ্ধার করতে লাগলো সে। নাযীফাহ’র মস্তিষ্ক এর তাৎপর্য ধরতে পেরে প্রশস্ত হেসে সে বলল,

‘কারণ মাকড়সা অনুভূতির জাল এপাশেও বুনতে শুরু করেছে। এখন আর তাকে দেখলে লজ্জা ভয় ভিড় করে না। অনুভূতিরা কড়া নাড়ে মনের দোরগোড়ায়।’

নাযীফাহ’র কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তাহমিদ। নাযীফাহ’র বলা কথা গুলো যেন সে হজম করতে পারছে না। ষোড়শী কিশোরীর মনেও যে তার নামের আবেগ আর অনুরাগের ছড়াছড়ি তা যে তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

‘মনে হচ্ছে কেউ একজন হুট করে বড় হয়ে গেছে।’

লজ্জায় নাযীফাহ নত মস্তকে বসে রইলো। তাহমিদের কথার পিঠে মুখ ফসকে মুখে যা এসেছে তাই বলে দিয়েছে সে। এখন মাথা উপরে তোলার সাহস হচ্ছে না। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। এজন্যই বলে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। নিশ্চয়ই তাহমিদ ভাই তাকে খারাপ ভাববে?

সম্মুখে বসা লজ্জায় মোড়ানো কিশোরীকে দেখে শব্দহীন হাসলো তাহমিদ। পুলকিত হলো অন্তঃস্থল।

‘আমার যে ষোড়শী কিশোরীর লজ্জায় লাল হওয়া আনন বেশি ভালো লাগে। তার মিইয়ে যাওয়া মুখ দেখলে আমার হৃদগহ্বরে প্রশান্তিরা ডানা ঝাপটায়।’

কথা গুলো কর্ণগোচর হতেই চমকিত হলো নাযীফাহ। তাহমিদের ভারী শ্বাস আছরে পড়ছে নাযীফাহ’র কাঁধে।মানুষটা তো সমানে বসে ছিলো তার পিছনে এলো কখন? নাযীফাহ ঘাড় ঘুরাতেই তার ওষ্ঠ স্পর্শ করলো,,,,,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

নাযীফাহ ঘাড় ঘুরাতেই তার ওষ্ঠ স্পর্শ করলো তাহমিদের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আবৃত গাল। আকস্মিক স্পর্শে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো নাযীফাহ। হুট করে কি ঘটে গেলো বোধগম্য হলো না তার। স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ সে। তার সমপূর্ণ কায়া অসাড়,নিশ্চল, অনুভূতিহীন জড় বস্তুতে পরিণত হলো। নড়তে ভুলে গেলো সে কিংবা নড়ার জন্য বিন্দু পরিমাণ শক্তি সে পেলো না। গাত্রে জড়ানো ওড়নার একপাশ খসে পড়লো কাঁধ থেকে।

অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত ভাবে নাযীফাহ’র উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে অনড়, স্থির হয়ে গেলো তাহমিদ। আকস্মিক কি ঘটে গেলো অনুভবয়োগ্য হলো না তারও। হতবিহ্বল হয়ে গেলো সে। আপনা-আপনি তার হাত স্পর্শ করলো তার গাল। নিজে নাযীফাহ কে উষ্ণ স্পর্শ দিলেও কখনো নাযীফাহ তাকে সেভাবে স্পর্শ করেনি। ঠোঁটে ফুটে উঠলো পরিতৃপ্তির হাসি। অপ্রত্যাশিত হলেও বউ থেকে পাওয়া প্রথম পরশ। তাহমিদ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

‘পঁচিশে নভেম্বর সকাল আটট পয়ত্রিশ। সেকেন্ডের কাঁটা হেরফের হবে তবে এই তারিখের এই সময়টা আমার স্মৃতির মানসপটে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরদিন, অনভিলষিত ভাবে কিছু পাওয়ার খুশিতে। অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা কখনো কালজীর্ন হয় না। অভূতপূর্ব থাকে সর্বদা, সব সময়।’

কপাল কুঁজিত হয় নাযীফাহ’র। ঘাড় উঁচু করে তাহমিদের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। তাহমিদ ক্রূর হেসে বলে,

‘বউয়ের ঠোঁটে কি ভিটামিন আছে? ঠোঁট জোড়া গাল স্পর্শ করতেই গাত্রে কেমন বল পাচ্ছি। সকাল থেকে শরীর টা ম্যাজম্যাজ করছিলো।এখন শক্তি পাচ্ছি। তাহলে এই ভিটামিনের অভাবে আমার শরীর দূর্বল লাগে। আর আমি শুধু শুধু সবুজ শাক সবজি দিয়ে ভাত খাচ্ছি। আহারে অতীতের দিনগুলোর জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। আগে জানলে নিয়ম করে তিনবেলা এই ভিটামিন গ্রহণ করতাম।’

দাঁতে দাঁত চেপে একের পর এক তাহমিদের লজ্জাজনক কথা হজম করছে নাযীফাহ। এখন কিছু বলতে গেলে আরো লজ্জা দিবে তাহমিদ। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করছে সে। নাযীফাহ’র গা থেকে খসে পড়া ওড়নার পাশটা পুনশ্চ গায়ে জড়িয়ে দিলো তাহমিদ। নিরূদ্ধে সে নাযীফাহ’র কানে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘তিনবেলা নিয়ম করে পাবো কি? থাক তিনবেলা না দুইবেলা দিলেই হবে।তুই রাজি থাকলে ঠোঁট অব্দি পৌঁছানোর দায়িত্ব আমি নিবো।তুই রাজি তো?’

প্রগাঢ় ত্রপায় মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না নাযীফাহ’র।শ্বাস পর্যন্ত আঁটকে আসছে তার। লোকটা এমন কেন? বুঝতে পারছে নাযীফাহ মনের অবস্থা। এসব কথা তার শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সমস্ত কায়া অসাড় হয়ে আসছে।

দু’হাত দূরে গেলো তাহমিদ। হাত ভাঁজ করে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো আপাদমস্তক লজ্জায় মোড়ানো অর্ধাঙ্গীর দিকে। আচমকা বুয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো তাহমিদ। নাযীফাহ ও নড়েচড়ে বসলো। বুয়া আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল,

‘ভাইজান কাপড়চোপড় ধুয়া শেষ। দুপুর আর রাইতের জন্যি কি রানমু এট্টু কন।’

তাহমিদ কিছু না বলে রুমে গেলো। তারপর ম্যানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে বুয়ার হাতে দিয়ে বলল,

‘তিনদিনের জন্য তোমার ছুটি। পাঁচশো টাকা নাও। ভালো মন্দ কিছু কিনে নিও।’

বুয়া বিস্মিত গলায় বলল,

‘ভাইজান হঠাৎ কইরা কি অইছে?’

তাহমিদ অধর জোড়া প্রসারিত করে বলে উঠলো,

‘কিছু হয়নি তবে আজ তোমার ভাইজান খুব খুশি। সেই খুশিতে তোমায় ছুটি দিলাম।’

কথার ফাঁকে এক প্রকার পালিয়ে গেলো নাযীফাহ। না হলে দেখা যাবে আবার উল্টো পাল্টা কথায় পুনরায় লজ্জা পাবে।

____________________________________________

পৌনে এগারোটা বাজে। তাহমিদ ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। তার ভার্সিটি অফ। দরজা থেকে নাযীফাহ ডাকল,

‘তাহমিদ ভাই?’

তাহমিদ ল্যাপটপে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,

‘কি আশ্চর্য বুঝে গেছিস আমি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সেজন্য বুঝি ভিটামিন সাপ্লাই দিতে এসেছিস? তা কোন গালে দিবি, বাম গালে নাকি ডান গালে?’

নাযীফাহ মৃদু শব্দে চিৎকার করে বলল,

‘আপনি সকাল থেকে কিসব শুরু করেছেন? শুধু আজেবাজে কথা। দাদি শুনলে কি বলবে? আপনার মুখে কিছু আটকায় না?’

তাহমিদের দৃষ্টি এখনো ল্যাপটপের স্ক্রিনে স্থির।

‘সরি টু সে যতদিন বউ ভাই বলে সম্বোধন করবে ততদিন নিজেকে এসব বলা থেকে সংযত করতে পারবো না। বউ ভাই বলার সাথে সাথে কনফিউজড হয়ে যাই সে বউ নাকি বোন। তাই ভালোবাসার কথা বলে মনে রাখি সে বোন না বউ।’

নাযীফাহ ভ্রুকুটি করে মিনমিনিয়ে রিনরিনে গলায় বলল,

‘অসভ্য লোক কোথাকার।’

নাযীফাহ’র রিনরিনে গলার স্বর কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছালো তাহমিদের। সে অধর প্রসারিত করে বলল,

‘ইতিহাস সাক্ষী পুরুষরা সবার কাছে সভ্য হলেও একমাত্র বউয়ের কাছে অসভ্য। কারন বাবা হওয়ারও একটা ব্যপার আছে।’

নাযীফাহ ‘ধ্যাৎ’ বলেই চলে গেলো। নাযীফাহ চলে যেতেই শব্দযোগে হাসলো তাহমিদ। মেয়েটাকে রাগাতে তার বেশ লাগে।বিশেষ করে লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া আনন। মিনিট পাঁচেকর মাথায় নাযীফাহ আবারও ফিরে এলো। এবার কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,

‘বুয়া তো চলে গেলো। দুপুরের রান্না কি হবে?’

তাহমিদ ঘাড় ঘুরিয়ে নাযীফাহ’র দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

‘দুপুরের রান্না,,,, ‘

তাহমিদ কে কথা শেষ করতে না দিয়ে নাযীফাহ বলল,

‘রান্না আমি করি?’

কপালে ভাঁজ পড়ে তাহমিদের।

‘নুডলস রান্না করতে গিয়ে পায়ে গরম পানি ফেলেছিস। রান্না করতে গিয়ে কি গা পু’ড়াবি? দরকার নাই।’

নাযীফাহ আদুরে স্বরে বলল,

‘এমন করছেন কেন করি না রান্না। ফুপি আমাকে রান্না শিখিয়েছে তো।’

‘অন্য একদিন করিস। এখন না হয় তোর বরের হাতের রান্না খেয়ে দেখ। খারাপ রাঁধে না তোর বর। মুখে তুলতে পারবি।’

____________________________________________

কোচিং সেন্টারে বসে জান্নাতের জন্য অপেক্ষা করছে নাযীফাহ। এখনো আসেনি সে। এর মধ্যে সেইদিনের সেই মেয়েটা কক্ষে প্রবেশ করলো। নাযীফাহ কে দেখে বাঁকা হাসলো সে। নাযীফাহ পাত্তা দিলো না। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেই জান্নাত আসলো। ব্যাগটা রেখে জিজ্ঞেস করলো,

‘কলেজ যাসনি কেন?’

নাযীফাহ মন খারাপ করে বলল,

‘যেতে দেয়নি।’

জান্নাত উৎফুল্ল হয়ে বলল,

‘জানিস আজ না ফারুক স্যার ক্লাসে গান গেয়েছেন। স্যারের গানের গলা কিন্তু সেই।’

নাযীফাহ আবারও মন খারাপ করে বলল,

‘আজ আমি যাইনি তো তাই।শাহরুখ খানও এসেছে নিশ্চয়ই?’

নাযীফাহ’র কথা শুনে উচ্চ শব্দে হাসলো জান্নাত। তারপর সামনের মেয়েটার দিকে নজর যেতেই ফিসফিস করে বলল কিছু একটা। জান্নাতের কথা শুনে নাযীফাহ ক্রূর হেসে জোরে জোরে বলল,

‘একজন বলল, কেউ যদি কোনো অন্যায় করে তা যেন ভুল করেছে ভেবে ক্ষমা করে দেই। তাই চুপচাপ আছি।না হলে তো আমায় চিনিসই। কিন্তু দ্বিতীয় বার এমন করলে ছেড়ে দিবো না।’

এক এক সবাই আসার পর ক্লাসে আসলো তাহমিদ। কালকের টপিক থেকে পড়া জিজ্ঞেস করতে লাগলো। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর দাঁড় করালো সেই মেয়েটিকে।

‘থার্ড বেঞ্চের লাস্ট ওয়ান স্ট্যান্ড আপ প্লিজ। আপনি বলবেন, পাস্ট পারফেক্ট কনটিনিউয়াস টেন্সের স্ট্রাকচারটা। এবং অন্য ফর্ম থেকে এই ফর্মে নিতে হলে কি কি পরিবর্তন করা লাগবে।’

মেয়েটি আমতা আমতা করে বলল,

‘সাবজেক্ট প্লাস ভারবের সাথের ইডি প্লাস,,,’

ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাহমিদ।

‘আমি কাল এগুলো পড়িয়েছিলাম? কাল তো বললে ক্লাসে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে বুঝতে পারছো না। তার পরও আমি আরো কয়েকবার বুঝিয়ে দিয়েছি, তাহলে? ক্লাসের শেষে জিজ্ঞেসও করেছি কারো কোনো প্রবলেম আছে কিনা। যদি না বুঝতে বলতে পারতে। শুনো, বাবা র’ক্ত পানি করে ইনকাম করে টাকা দেয় পড়াশোনায় ফাঁকি বাজি করার জন্য। টাকা ইনকাম করতে অনেক কষ্ট। শুধু তুমি না এখানের সবার বাবাই কারো কারো মাও জব করে। ভালো করে পড়াশোনা করো। ভবিষ্যতে কিছু একটা করতে পারবে। বাবা মায়ের কষ্টের দাম দাও।’

পড়া বলতে না পারার কারনে পরপর তিনজন টিচার সেই মেয়েটিকে বকাঝকা করলো।আর সব রাগ গিয়ে জমলো নাযীফাহ’র উপর। ক্লাস বেরিয়ে জান্নাত আর নাযীফাহ অপেক্ষা করতে লাগলো তাহমিদের।

জান্নাত আর নাযীফাহ কথা বলার মাঝেই মেয়েটি এসে ফোঁড়ন কাটে।

‘নিজেকে চালাক মনে করো তাই না? ভেবেছো আমরা কিছু বুঝি না। তাহমিদ স্যারের সাথে তোমার এতো কিসের ঢলাঢলি?সব জায়গায় স্যারের তোমাকে দেখা যায় কেন? আমাদের বাচ্চা মনে করেছো।গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েরা নিজেদের সাধু বানায় সবার কাছে। আসলে এদের চরিত্রের ঠিক থাকে না। শহরে এসে সুন্দর সুন্দর ছেলে দেখলে মাথা ঘুরে যায়। কি দিয়ে স্যার কে পাগল করেছো? নিজের রূপ গুন নাকি?’

কর্ণকুহরে কথা গুলো পৌঁছানো মাত্রই কলিজা ফেটে কান্না আসছে তার। কেউ তার চরিত্র নিয়ে কথা বলছে? আঙ্গুল তুলছে চরিত্রের উপর। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার। এক পর্যায়ে ফুঁপানো শুরু করলো সে।

জান্নাতের কাছে অল্প কিছু শুনেই দৌড়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এলো তাহমিদ। নাযীফাহ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নাযীফাহ কাউকে পাত্তা না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাহমিদকে। বাঁধ ভেঙেছে কান্নার।অঝোর ধারায় ঝরছে চোখের পানি।হেঁচকির জন্য কম্পিত হচ্ছে সমস্ত কায়া। মোটামুটি সব স্টুডেন্ট জড়ো হয়ে গেলো। মেয়েটিও আতংকিত হয়ে গেলো। চোখেমুখে ভর করলো এক রাশ ভয়।

নাযীফাহ কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি বলেছে তোকে?’

কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না নাযীফাহ। বার বার হেঁচকি দিয়েই চলেছে সে। তাহমিদ পুনশ্চ জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হলো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো। কি বলেছে তোকে?’

নাযীফাহ কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে বলল,

‘আমার নাকি চরিত্রে সমস্যা
সেজন্য আপনার সাথে এতো ঢলাঢলি করি
এক রিক্সায় যাই।’ বলেই খামচে ধরলো তাহমিদের শার্ট।

কথা গুলো কর্ণগোচর হতেই রাগে চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে গেলো তাহমিদের। চোখেমুখে কাঠিন্য দেখা দিলে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here