আড়াল_কথা,০২,০৩

0
808

#আড়াল_কথা,০২,০৩
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২

ভাবতে না ভাবতেই দরজার ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হলো। আমার মুখে ফুটে উঠলো অদ্ভুত এক হাসি। এ হাসি সে দেখতে পাবে না। একান্তই ব্যাক্তিগত এ হাসি। আমার হাসি হোক বা চোখের জল, দুটোই আমার একান্ত প্রাপ্তি বলে আমি মনে করি। আমি দাড়িয়ে রইলাম একিভাবে। পিছন ফিরলাম না। সামনের জং ধরা টিনের গায়ে এক দল লাল পিঁপড়ে সারিবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজ লক্ষ্যে। তাদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পিছনে থাকা ভয়ে তটস্থ দাঁড়ানো ছায়া মুর্তিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘আমি নিজ ইচ্ছেতে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। নিজ ইচ্ছেতেই ফিরে এসেছি। আমায় নিয়ে অযাচিত উপদেশ দিয়ে যে তোকে পাঠিয়েছে তাকে বলে দিস, আমি শুধু পিঁপড়ের মতো কামড়াতেই জানি না। পিঁপড়ের মতোন ধৈর্য ধরে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতেও জানি। পিঁপড়েরা কখনো নিমন্ত্রণ এর অপেক্ষায় থাকে না। আর না থাকে সুযোগ এর অপেক্ষায়। দু’টোই সময় সাপেক্ষে গড়ে নিতে তারা জানে। লক্ষ্যে পৌছানোর রাস্তা না পেলে নতুন রাস্তাও গড়ে নিতে জানে। পিঁপড়ার একবার লড়াই শুরু হলে তা কতক্ষণ চলতে পারে জানিস? মৃত্যু পর্যন্ত। মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তি থাকলে সাহস আর সুযোগ দুটোই হয়ে যাবে। সাহস টা পেয়ে গেছি। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা। খুব শীঘ্রই সেই সুযোগ আমার পায়ে এসে হুমরি খেয়ে পড়বে। এখন তুই যা। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার যা করার আমি এখানে থেকেই করবো। আর আরেকটা কথা। আমাকে নিয়ে ভয় পাবি না। ওরা ততখন আমার কিছুই করবেনা যতখন আমি অসহায় এর খোলস পড়ে আছি। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস।’

হতাস হয়ে চোখের জল মুছলো টুসু। সন্তপর্ণে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো বাইরে। আড়াল যে মারের দাগ লুকোতে সামনে না ঘুরে পিছন ফিরে কথা বললো তা বেশ ভালোই বুঝেছে সে। সেই দুর্বল মেয়েটা আজ দুর্বলতা লুকাতে বেশ ভালোই শিখে গেছে। গেটের ওপাশ থেকে লুকিয়ে সবটাই দেখেছে টুসু। কিভাবে ওই অসভ্য মহিলা আড়ালের গায়ে হাত তুলেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে যায় টুসু। সোজা রাস্তা ধরে দুই মিনিট হেঁটে হাতের বাম পাশের দুতলা বাড়িটিতে ঢুকে একটি রুমের ভেতর এসে দাড়ায়। সামনে কেউ একজন বসে আছে। আড়ালের বলা সব কথা তাকে খুলে বলে। সামনের ব্যাক্তির থেকে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে চলে আসতে নেয় টুসু। তখনি পেছন থেকে সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তি দরাজ গলায় বলে ওঠে,

‘তুইও ওকে বলে দিস টুসু, পিঁপড়ে কখনো একলা চলে না। তারা সর্বদা দলবেঁধে চলে। এটা তাঁদের দুর্বলতার প্রকাশ নয়, বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ।’

টুসু মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।
_____

লাকড়ি ঘরের অর্ধেক জায়গা হিজিবিজি করে লাকড়িতে ঠাসানো। আর অর্ধেকটাতে একটা আধভাঙা চৌকি বসানো আছে। চৌকিতে কোন তোশক পাতা নেই। আছে শুধু মোটা আস্তরণের দুটো ছেড়া কাথা। সেই কাথার নিচে অবশ্য একটা বাশের তালাই দেওয়া আছে। চৌকির উপর বসে আছে আড়াল। অপেক্ষা করছে অন্ধকার হওয়ার। দুপুর থেকে বিকেল অবধি কারো কোন সারা শব্দ পাওয়া যায়নি। যাবে কি করে। সবাইতো গেছে রিসিপশনের অনুষ্ঠানে। আসার সময় নিশ্চই মেয়ে জামাইদের সাথে নিয়েই আসবে। তাদের সামনে তো আর আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। ভালো মানুষ সাজতে নিশ্চয়ই আমাকে এ ঘর থেকে বের করতেই হবে। তখন কি করবে চাচি? তবে তাদের ফিরে আসার আগেই আমাকে বের হতে হবে এ ঘর থেকে। এখন শুধু অন্ধকার হওয়ার অপেক্ষা।

টিনের সহস্র ফুটো দিয়ে এখন আর কোন আলোর রেখা তীরের মতো ছুটে আসছেনা। বাইরে এখন পুরো অন্ধকার হয়ে এসেছে। আড়াল আর সময় নষ্ট না করে চৌকির উপর উঠে দাড়ায়। এখান থেকে খুব সহজেই চালের টিন ছোঁয়া যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে উপরে ওঠা সম্ভব নয়। তাই ওপাশ থেকে কিছু মোটা ও ভারি লাকড়ি এনে জড়ো করে চৌকির ওপর। তারপর সেই লাকড়ির ওপর দাঁড়িয়ে উপরের সারি সারি টিনের মধ্যে থেকে একটি টিন কিছুটা আলগোছে সরিয়ে উঠে পড়ে চালের উপর। পুরোনো ঘর হওয়ার দরুন লোহায় জং ধরে জোরা আলগা হয়ে আছে। তারপর সাবধানে পা রেখে চালের পিছন দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে কিছু সিমেন্ট এর বস্তা ও ইট রাখা আছে। সেই ইটের স্তুপের ওপর পা রেখে নিচে নেমে আসে আড়াল।

আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যায় সামনের দালান ঘরের দিকে। বসার ঘরে যেতেই দেখতে পায় টুসু ঘর গোছগাছ করছে। নতুন জামাই আসবে বলে কথা। তাও আবার জোরা জামাই। ঘর তো ফিটফাট রাখতেই হবে। তাই হয়তো যাওয়ার আগে অর্ডার দিয়ে গেছে টুসু কে। টুসুর সামনে যেতেই টুসু কান্না করে দিয়ে জরিয়ে ধরে আড়ালকে। কাঁদতে কাঁদতে আড়ালকে বলে, ‘ওরা যাওয়ার আগে লাকড়িঘরে তালা মেরে গেছিলো আরু। তাই আর সারাদিনে তোর কাছে যেতে পারিনি রে।’ টুসুকে সান্ত্বনা দিয়ে আড়াল এগিয়ে যায় দক্ষিণ দিকের শেষ ঘরটার দিকে। দরজায় দাড়াতেই আড়াল দেখতে পায় শুকনো শরীর নিয়ে অগোছালো বিছানায় জড়বস্তুর ন্যায় পড়ে আছে তার বাবা। কোন নড়চড় নেই। নড়চড় থাকবে কি করে। প্যারালাইসিস হয়ে গোটা শরীর এর সাথে মুখটাও যে অকেজো হয়ে গেছে। মুখ এক পাশে বেঁকিয়ে যাওয়ার কারনে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে যে বাবা।

বাবার শিয়রের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক দেয় আড়াল। ‘বাবা’ ডাক শুনে সালাউদ্দিন আহমেদ চোখ খুলে তাকায়। আড়ালকে দেখতে পেয়ে গোঙাতে শুরু করে তৎক্ষনাৎ। কিছু হয়তো বলতে চাইছে। কিন্তু তা পারছেন না। একটা সময় চোখ দিয়ে অবিরত জল পড়তে শুরু করে। মুখটা কেমন বিবর্ন হয়ে গেছে। আড়ালের চোখ দিয়েও অনবরত জলের ধারা বইতে থাকে। মানুষটাকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। আড়াল ওর বাবার মাথায় হাত রেখে আবেগ মাখা গলায় ফিসফিস করে বলে,

‘তোমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে বাবা! অশ্রু ঝরছে! এই অশ্রুর কারন আমার জানা নেই। এই পরিস্থিতিতে অশ্রু ঝরার কারনের অভাব নেই। তাই তোমায় সান্ত্বনা দিতে পারছি না। আমার মা ও ঠিক এই ভাবেই অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে এই দুনিয়া ছেড়েছে বাবা। তোমাকে আমি সেই সুযোগ দেবো না। খুব তারাতারি তুমি মুক্তি পাবে এই কষ্ট থেকে। আর অল্পকিছু দিন বাবা। মাত্র অল্প কিছু দিন। তারপর আর তোমায় এতো কষ্ট পেতে হবে না।

কথা শেষ করে রুম থেকে বেড়িয়ে এসে বাইরে দাড়িয়ে হাওমাও করে কেঁদে ওঠে আড়াল। টুসু দুর থেকে দেখতে পায় আড়ালের কান্না। টুসুও কেঁদে ওঠে। আড়ালের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন। এতো কষ্ট কি সত্যিই পাওনা ছিলো। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাড়ায় আড়াল। এখন যেতে হবে। কিছুক্ষণ বাদেই সবাই চলে আসবে। তাই আর সময় নষ্ট না করে যেখান দিয়ে এসেছিলো সেখান দিয়েই চলে যায়। কাল থেকে যে আরেক নাটক শুরু হবে। এখন শুধু তারই অপেক্ষা।

________

সকালের আলো ফুটেছে অনেক আগে। এখন আহমেদ ভিলার সবাই কাজে খুব ব্যাস্ত। নতুন মেয়ে জামাইদের আপ্যায়নে যেনো কোন ত্রুটি না থাকে তাতে কঠোর নজরদারি করছেন আড়ালের চাচি আমিনা বেগম। গতকাল সবার আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গেছিলো। তাই রাতে আর বেশি ঘাটাঘাটি হয়নি আড়ালকে নিয়ে। তখন কোনরকম পাশ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কিন্তু এখন কি করবেন সেই চিন্তায় চিন্তায় মাথা খারাপ হবার যোগার। আমিনা বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তার ছোট জামাই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে বাইরে আসছে। জামাইকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে বসতে বলে মেয়েকে ডেকে নাস্তা দিতে বলেন আমিনা। কিন্তু আরাফাত খেতে মানা করে শক্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘আড়াল কোথায় আন্টি?’ আমিনা বেগম কথা এড়িয়ে গিয়ে বলেন বাবা আগে খেয়ে নাও তারপর সব কথা হবে।’ আরাফাত রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলে,

‘আগে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই আন্টি। আড়াল কোথায়? আমি জানি ও ফিরে এসেছে। ওর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। যে এবাড়ি ছেড়ে অন্যকোথাও গিয়ে উঠবে। আমি নিশ্চিত ও ফিরে এসেছে। আপনারা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। তাই বলুন ও কোথায়? আমার ওর সাথে বোঝাপড়া আছে। অনেক প্রশ্ন আছে আমার।’

আমিনা বেগম পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে আরাফাত কে বলে দেয় আড়ালের অবস্থান। আরাফাত অপেক্ষা না করে দৌড়ে যায় লাকড়ি ঘরের দিকে। আমিনা বেগম পিছন পিছন এগিয়ে যান চাবি নিয়ে। তালা দেওয়া দেখে আরাফাত রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকায় আমিনা বেগমের দিকে। আমিনা বেগম তালা খুলে দিয়ে আর দাড়ান না সেখানে। আরাফাত ভেতরে ঢুকে দেখে..

চলবে..

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩

আমিনা বেগম পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে আরাফাত কে বলে দেয় আড়ালের অবস্থান। আরাফাত অপেক্ষা না করে দৌড়ে যায় লাকড়ি ঘরের দিকে। আমিনা বেগম পিছন পিছন এগিয়ে যান চাবি নিয়ে। তালা দেওয়া দেখে আরাফাত রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকায় আমিনা বেগমের দিকে। আমিনা বেগম তালা খুলে দিয়ে আর দাড়ান না সেখানে। থাকার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। ছেলেটা ভিষন বদরাগি। এখানে থাকলে কি না কি করে বসে। তাই আগে ভাগেই নিজ দায়িত্বে মাঠ ছেড়েছে।

আরাফাত ভেতরে ঢুকে দেখে আড়াল চৌকির কোনায় জড়সড় হয়ে হাটু ভেঙে বসে হাটুর ওপর মাথা দিয়ে আছে। ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় আরাফাত। এগিয়ে যায় সামনে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা মায়াবিনীর দিকে। আড়াল এর মধ্যে একবারও মাথা তুলে তাকায় নি। দরজা আটকানোর শব্দ পেয়েও না। আরাফাত আড়ালকে আচমকা হেঁচকা টানে চৌকি থেকে নামিয়ে দাড় করায়। দাড় করিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। ঠোঁটের কোনা বিচ্ছিরি ভাবে ফুলে থেতলে আছে। গালে পাঁচ আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ। আরাফাত আড়ালের দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘এসব কি করে হলো?’ আড়াল কোন উত্তর দিলো না। একইভাবে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আরাফাত এর দিকে। কোনো উত্তর না পেয়ে এবার প্রশ্ন পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কাল কেনো বিয়ের আসর ফেলে পালিয়েছিলে? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা তুমি জানতে আড়াল। প্রথম দেখায় আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাহলে কেনো আমায় ফেলে কাল চলে গেলে? ঘুরে ফিরে সেই তো আমার সামনেই আজ দাড়িয়ে আছো। আজ যদি তোমায় জোর করে বিয়ে করি, আমায় আটকানোর কিন্তু কারো ক্ষমতা নেই। এমনকি তোমারও না।’

আড়াল ঠোট প্রসারিত করে হাসে। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আরাফাত এর একদম মুখ বরাবর দাড়ায়। মাঝে দুরত্ব খুব কম। চার আঙ্গুল পরিমান জায়গা হবে হয়তো। আরাফাত প্রথমে অবাক হলেও পরে সম্মোহিত হয়ে তাকায় আড়ালের দিকে। আড়াল খুব সহজ হয়ে দাড়িয়ে আছে। কোন সংকোচ এর ছাপ নেই মুখে। আরাফাত এর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না? তাহলে যেইনা আমি আসর ছেড়ে পালালাম ওমনি আপনি নাদিয়া আপু কে বিয়ে করে ফেললেন। ব্যাপার টা অদ্ভুত না!’

‘তুমি ভালো করেই জানো আমার দাদীর শেষ ইচ্ছে দুই
নাতির বিয়ে একসাথে দেখার। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই স্টেপ নিতে হয়েছে।’

আরাফাতের পকেটে হাত দেয় আড়াল। ভেতর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে আরাফাতের মুখের সামনে তুলে ধরে বেশ তাচ্ছিল্য করে বলে,
‘আমি জানতাম আপনি এমন কিছুই বলবেন। আন্দাজ ছিলো আমার। তবে এটা কি মিস্টার আরাফাত কবির? এটাও কি আপনার দাদীর ইচ্ছেতেই হয়েছে? উনি বুঝি আপনাকে জোর করে করিয়েছে এসব।’

আড়ালের আঙুল তাক করা জায়গায় আরাফাত এর নজর পরতেই চমকে উঠে। মোবাইলের গ্লাসে দেখা যাচ্ছে কানের দুই আঙুল নিচে কালচে দাগ বসে আছে। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ খুব ভালোবেসে তার ভালোবাসার চিহ্ন একে দিয়েছে। আরাফাত বলার মতো কোন কথা খুজে পায় না। মাথা নত করে নেয়। তারপর অপরাধীর ন্যায় কৈফিয়ত দিতে বলে,

‘আমি তোমার চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না। জেদের বসে ড্রিংক করেছিলাম। আর সেই অবস্থায় একটা ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র তোমাকে চাই। আমি নাদিয়াকে ছেড়ে দেবো। ওকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করবো। তুমি শুধু আমার হাতটা ছেড়ো না। পাশে থেকো আমার। প্লিজ।’

আড়াল এবার উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বসে পড়ে পাশের আধভাঙ্গা শক্ত চৌকির ওপর। কোনমতে হাসি থামিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাড়ায়। মুখে আশ্চর্য ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘কিন্তু এই দাগটাতো দুদিন আগের নয় আরাফাত। এটা সদ্য জন্মানো দাগ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তা। কাল রাতে আপনার ড্রিংক করার কোন চান্স তো ছিলো না। আর যদি কোনভাবে করেও থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই মাঝরাতে ড্রিংক করে সকাল সকাল আপনি এতোটা ফ্রেশ থাকতেন না। মাঝ রাতে যার মদের নেশায় হুশ ছিলো না, ভুলে নাকি ভুল করে ফেলেছে। সে কিনা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে আমার সামনে সহজ স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়ে আছে। বাহহ!’

আরাফাত এবার হিংস্র হয়ে ওঠে। আড়ালের দুই কাধে শক্ত হাতের থাবা বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করে,

‘হ্যা তুই যা ভাবছিস একদম ঠিক ভাবছিস। এটা তোর বোনেরই দেওয়া ভালোবাসার চিহ্ন। তোর বোনের বেড পারফরমেন্স কিন্তু বেশ হাই লেভেলের ছিলো। মানতে হবে বস! তবে কি জানিস, তুই আমার জেদ ছিলি। আর এখনও আছিস। তবে আগে বিয়ে করতে চেয়েছি। এখন চাই শুধু বিছানার সঙ্গীনী বানাতে। আজ হোক বা কাল তোকে এই শরীরের নিচে পিষিয়ে মারবো আমি। মনে রাখিস।’ কথা শেষ করে উচ্চ শব্দে দরজা খুলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় আরাফাত।

কিছুক্ষণ পর আরাফাতের বড় ভাই সারাফাত আসে আড়াল এর কাছে। ক্ষমা চায় হাত জোর করে। আড়াল বাঁধা দিলে সারাফাত বলে ওঠে,

‘আমার কিছু বলার আছে। আমাকে বলতে দাও প্লিজ। আমি বাইরে থেকে তোমাদের সব কথা শুনেছি।
আমি যদি নাবিলা কে ভালো না বাসতাম আর ওকে বিয়ে করার জন্য জেদ না করতাম তাহলে তোমার সাথে এসব হতো না। আমার জন্যই আরাফাত তেমাকে বিয়ে করার শর্ত রাখার সুযোগ পেয়েছিলো। তুমি বিয়েতে রাজি ছিলে না তা আমি বিয়ের দিনেই জানতে পেরেছি। আগে জানলে এমনটা হতে দিতাম না। ওর মন মানসিকতা যে এতোটা বিকৃত তা আমার জানা ছিলো না। আমার দাদীর অনেক আগে খুব ইচ্ছে ছিলো আমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে একসাথে দেবার। আমার পরিবারকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাবিলাকে বউ করার জন্য রাজি করিয়েছি। তারা নাবিলাকে পছন্দ করলেও নাবিলার ফ্যামিলি পছন্দ করতেন না। আমি নাবিলাকে অনেক ভালোবাসি। ওকে বিয়ের জন্য সবাইকে রাজি করাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি চাই নি যে বিয়েতে কোন ঝামেলা হোক। তাই নাবিলাকে দেখতে এসে তোমাকে আরাফাত যখন পছন্দ করে নেয় আমিও আরাফাতের সঙ্গে মিলে তোমার চাচিকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। যাতে উনি তোমার বিয়ে যে কোন অবস্থায় হোক আরাফাতের সাথেই দেয়। উনি যে কতটা লোভী তা আমি আগে থেকেই জানতাম। ভেবেছিলাম তুমিও ভালো থাকতে পারবে এই জাহান্নাম থেকে বেরোতে পারলে। আমি অল্পবিস্তর জানতাম তোমার অবস্থা সম্পর্কে। তাই এমনটা করেছিলাম। কিন্তু আমি যে তোমাকে এক জাহান্নাম থেকে আরেক জাহান্নামে পাঠাচ্ছিলাম, তা বুঝতে পারিনি। যাই হোক, উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।’ বিয়েটা তিনি হতে দেননি। তুমি আমার সাথে বাইরে চলো। এটা তোমার জায়গা নয়।’

আড়ালকে নিয়ে সারাফাত দালানঘরে চলে যায় সবার সামনে দিয়ে। আড়ালের জন্য বরাদ্দকৃত সেই আগের রুমটিতে আসে। আমিনা বেগম তার দুই মেয়ে কে সাথে নিয়ে ওদের পিছন পিছন আসলে সারাফাত তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আড়াল নিজের রুমেই থাকবে। ও বিয়ে থেকে পালিয়ে কোন ভুল করেনি। তাই কোন শাস্তিও ওর প্রাপ্য নয়। আর আড়াল না পালালে আপনার সাত ঘাটের পানি খাওয়া মেয়েটাকেও সুযোগ বুঝে আরাফাতের গলায় কাল ঝুলাতে পারতেন না। আশা করছি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।’

কথা শেষ করে সারাফাত রুম থেকে বেরিয়ে গেলে আমিনা বেগম ও নাদিয়াও চলে আসে। আসার সময় নাদিয়া মায়ের সাথে ঘ্যানর ঘ্যানর করে সারাফাত এর বলা কথা নিয়ে। নাবিলা থেকে যায় সেখানেই। আড়ালের সামনে গিয়ে পাশের ড্রয়ার থেকে একটা এন্টিবায়োটিক মলম বের করে সেটা আড়ালের ঠোঁটে লাগিয়ে দেয়। লাগানো হয়ে গেলে মলমটা আগের জায়গায় রেখে আড়ালের সামনে দাড়িয়ে বলে,

‘আমি জানি না তুই কেনো এই জাহান্নাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিস। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি তুই যা করছিস জেনে বুঝে প্ল্যান করেই করছিস। আর একটা কথা। আমাকে যদি বড় বোন মনে করে থাকিস তাহলে অবশ্যই আমাকে যে কোন দরকারে ডাকবি। আমি চেষ্টা করবো তোর পাশে থাকার। তুই কেনো আমার মায়ের পেটের বোন হলি নারে আরু! অবশ্য এমন রত্ন শুধু খনিতেই থাকার কথা। কাঁদায় নয়। তোর মা ছিলো সেই খনি। রত্নখনি!’

নাবিলা চলে যায় রুম থেকে। আড়াল মনে মনে বলে, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে আপু। সামনে যা করতে চলেছি তাতে তোমার বড্ড বেশি ক্ষতি হতে চলেছে। তোমার সাহায্য তো দুর তোমার ছায়াও হয়তো হারিয়ে ফেলবো।’

আড়াল কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে থাকে। এর মধ্যে টুসু আসে রুমে। হাসি মুখে জরিয়ে ধরে আড়ালকে। টুসুকে দিয়ে তার বাড়ি ফিরে আসার খবর সে নিজেই আরাফাত এর কানে পৌছিয়ে ছিলো। কাল সন্ধ্যার পর যখন বাইরে এসেছিলো তখন টুসুকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছিলো কি করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে। কেউ দেখার আগেই টুসু চলে যায় রুম থেকে। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বিছানার ওপর পড়ার চেয়ার টা রেখে তার ওপর দাড়িয়ে দেয়ালে থাকা ভেন্টিলেটর এর ভেতর থেকে একটা বাটন মোবাইল বের করে। সেই মোবাইল দিয়ে একটি নাম্বারে মেসেজ টাইপ করে পাঠায়,

‘কাল কলেজে দেখা করতে চাই।’

তৎক্ষনাৎ এক মিনিটের মাথায় একই নাম্বার থেকে রিপ্লাই আসে,

‘আমি নতুন ভবনের ছাদে থাকবো। আপনি প্রথম ক্লাস করে চলে আসবেন।’

অপর ব্যাক্তিটিকে পাল্টা প্রশ্ন করতে না দেখায় আড়াল অবাক হলেও পরে হেসে দেয়। এ হাসিতে আছে প্রসন্নতা। আড়ালের ওপর এক অদৃশ্য আস্থা ও অধিকার রাখে সে ব্যাক্তি। যার কোন ব্যাখ্যা নেই। আছে শুধু প্রাপ্তি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here