আড়াল_কথা,০৪,০৫

0
665

#আড়াল_কথা,০৪,০৫
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৪

কাল কলেজে দেখা করতে চাই।’
তৎক্ষনাৎ এক মিনিটের মাথায় একই নাম্বার থেকে রিপ্লাই আসে,
‘আমি নতুন ভবনের ছাদে থাকবো। আপনি প্রথম ক্লাস করে চলে আসবেন।’

অপর ব্যাক্তিটিকে পাল্টা প্রশ্ন করতে না দেখায় আমি অবাক হলেও পরে হেসে দেই। এ হাসিতে আছে প্রসন্নতা। আমার ওপর এক অদৃশ্য আস্থা ও অধিকার রাখে সে ব্যাক্তি। যার কোন ব্যাখ্যা নেই। আছে শুধু প্রাপ্তি। তা প্রথম থেকেই আমি অনুভব করেছি।
ফোনটাকে আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ঘরটাকে একটু গুছিয়ে নেই। খুব অগোছালো হয়ে আছে। মনে মনে ছক কষতে থাকি পরবর্তী পদক্রম এর।

সাদা দেয়ালের গায়ে কালো ফ্রেমের ওয়াল ক্লক টাতে দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। এখনো ঘর থেকে একবারের জন্যও বের হইনি। নাবিলা আপু সকালের খাবার এ ঘরেই দিয়ে গেছিলো। খাবারের প্লেটটি এ ঘরেই রয়ে গেছে। ভাবলাম খাবারের প্লেটটি দিয়েই আজকের যাত্রা শুরু করি। খাবারের প্লেটটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। রান্নাঘরের সামনে আসতেই আমার হৃদস্পন্দন থেমে গেলো যেনো। শ্বাস আটকে দাড়িয়ে পরলাম। আমার সামনে কেউ দাড়িয়ে আছে।
মা! আমার মা দাড়িয়ে আছে! আমি পাগলের মতো এলোমেলো পায়ে দৌড়ে যাই। জরিয়ে ধরি মাকে। আমার মা এসেছে। আমার মা কোথাও যায়নি আমাকে ছেড়ে। কিন্তু আমার শুকনো মরুভূমির ন্যায় বুকটা মায়ের স্পর্শে শীতল হলো না। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রগাঢ় প্রশান্তির হাওয়ায় কেঁপে উঠলাম না এক চুলও। আচমকা হেঁচকা টান অনুভব হলো। ছিটকে গিয়ে পড়লাম বটির পায়ার ওপর। ডান ভ্রুয়ের মাঝ বরাবর চিনচিন করে জ্বালা করছে। কাটলো বোধহয়। হাত দিয়ে দেখি একটুখানি রক্ত।

আমি অবাক হলাম না। আড়ম্বরশূন্য আমার মুখমণ্ডল। খুব সহজভাবেই উঠে দাড়ালাম। পচা নর্দমায় হাত রেখেছি। দুর্গন্ধ তো গায়ে মাখবেই। পচন ও ধরতে পারে। এ রক্ত তারই খানিক আভাস মাত্র।

চাচি বেজায় চটে গেছে। গালিগালাজ করছেন চাপা স্বরে। পাছে কারো কানে না যায়। নতুন জামাই মেয়ে ছাড়াও বাপের বাড়িরও মানুষও এখন বাড়িভর্তি।

নতমস্তকে চাচির কাছে ক্ষমা চেয়ে বললাম, আসলে তুমি তো শাড়ি পড়না। সালোয়ার কামিজ পড়। আজ পরেছো জানতাম না। এমন শাড়ি তো মায়ের ছিলো আর তোমার হাতের বালাটাও মায়ের হাতের বালার মতো। যেটা মা সবসময় পড়তো। বাবা বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম আয় দিয়ে মাকে কিনে দিয়েছিলো।মা কখনো হাতছাড়া করতো না বালা জোড়া। শাড়ি আর হাতের বালা মিলিয়ে পিছন থেকে অবিকল মায়ের মতো মনে হচ্ছিলো তোমায়। আমার ভুল হয়েছে। মস্ত বড় ভুল। তোমায় মনে করে ভুল করেছি।

মায়ের শাড়ি আর চুড়ির কথা শুনে চাচি বেশ হকচকিয়ে গেল। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বললেন,
‘তোর মায়ের কেন হইবো? এইগুলা আমার। তর চাচায় আইনা দিছে। মেলা দাম। এক্কেবারে ফাও কথা কইবি না।’

আমি মৃদু হাসলাম শুধু। কথা বাড়ালাম না। লাভ কি! তাই চাচিকে বলে চাচির সাথে হাত লাগালাম কাজে। চাচি সবজি ধুয়ে বটি নিয়ে বসলেন সবজি কাটতে। হাত নাড়িয়ে চাড়িয়ে কাজ করছে। কাজের তালে তালে হাতের চিকন দু গোছা চুড়ি ও মোটা বালার সঙ্গে ঘর্ষন লেগে টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। আমার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে বুকের ভেতর। এমন শব্দ দুইমাস আগে প্রায়শই শুনতে পেতাম। কখনো মুগ্ধ হয়ে কান পেতে শোনা হয়নি। কখনো মনে হয়নি খুব মুল্যবান কিছু শুনছি। আজ মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রুতিমধুর ধ্বনি বোধহয় মায়েদের হাতের চুড়ি থেকে উৎপত্তি পেয়েছে। মায়েদের হাতের চুড়ির আওয়াজেও বুঝি নেশা থাকে? হবে হয়তো। কিন্তু এটা আমার মায়ের হাত নয়। এটা আমার মায়ের খুনির হাত।

রাতের বেলা জানালা ধরে দাড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছি এমন সময় নাবিলা আপু এলো। বিছানায় এসে আমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসলো। আমায় মাথায় হাত রেখে বললো, ‘সারাদিন তোর বেশ মন খারাপ দেখেছি আজ। সকালে এতোকিছু হওয়ার পরেও তোর মুখটা এতো শুকনো ছিলো না যতটা দুপুর থেকে দেখছি। কেউ কি কিছু বলেছে? আরাফাত তো চলে গেছে। আর নাদিয়াকেও সারাফাত সাবধান করে দিয়েছে তোর সাথে যেনো না লাগে। মা কি কিছু বলেছে? মিথ্যে বলবিনা। সত্যি বললে বল নয়তো শুধু শুধু বানোয়াট বন্দনা করার প্রয়েজন নেই।’

আমি কিছু লুকালাম না। বললাম, ‘আজ চাচি নতুন শাড়ি আর চুড়ি পড়েছিলো। তুমি খেয়াল করলে শাড়ি না হোক, বালা জোড়া চিনবে। আমার মায়ের বালা ওটা। যেটা মা সবসময় পড়তো। দুপুরে ভ্রুয়ের যে কাটা জায়গায় মলম লাগালে সেটা হয়েছে চাচি কে মা ভেবে পিছন থেকে জরিয়ে ধরার শাস্তি স্বরূপ। আচমকা চাচি কে মায়ের শাড়ি আর বালাতে দেখে মায়ের মৃত্যু বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। মা মনে করে জরিয়ে ধরে মায়ের গায়ের গন্ধ নিতে গিয়েছিলাম। কি বোকামি!

মাকে মেরে নাকি কেউ মায়ের আলমারি লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলাম মায়ের সাথে মায়ের শেষ স্মৃতিগুলোও হারিয়ে ফেলেছি। তাহলে ওগুলো চাচি কিভাবে পেলো আপু?

নাবিলা আপু আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। উঠে বাইরে চলে গেলো। আমি চোখের জল মুছে বসে রইলাম একইভাবে। আপুকে যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর আংশিক আমার জানা আছে। তবু্ও আপুকে এসব বলার কারন আপুর দ্বারা চাচির মনে ভয় ঢুকানো। চাচি বড্ড ভীতু প্রকৃতির। আপুর থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে নেতিয়ে পরবে। আর তখন আমি আমার পরবর্তী পদক্রম অনুযায়ী এগোতে পারবো।

আমি এগিয়ে গেলাম চাচির ঘরের দিকে। চাচি আর নাবিলা আপু কথা কাটাকাটি করছে। চাচি বেশ ভরকানো গলায় থেমে থেমে জবাব দিচ্ছে। একসময় চাচির হাত থেকে বালা জোড়া খুলে নিলো আপু। বললো, ‘এটা আমার কাছে থাকবে।’ চাচি থতমত খেয়ে ভয়মিশ্রিত চাহনিতে চেয়ে আছে। কিছু বলছে না। আমি তখন ঘরে ঢুকলাম। দুজন চুপ করে আছে। আপু বললো, ‘কিছু বলবি?’ আমি চাচির দিকে চেয়ে সহজ গলায় বললাম,

‘আমি কাল থেকে আগের মতো কলেজ যেতে চাই। আমার চলে যাওয়ার হলে আবার ফিরে আসতাম না এ বাড়িতে। তাই ভয়ের কারন নেই। আমার জন্য কোন সমস্যা তোমাদের হবে না। তাই চাচির কাছে অনুমতি নিতে এসে..।’

আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আপু চাচির চোখে চোখ রেখে বললো, তুই কাল থেকে কলেজ যাবি। তোকে কেউ আটকাবে না। মা তো নয়ই। তাই না মা?

চাচি প্রশ্ন পেয়ে যেনো আরও একটু থতমত খেলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘যাইক কলেজে। আমি না করমু কেন? যাইকগা। আমার কোন না নাই।’

আমি অনুমতি পেয়ে চলে এলাম ঘর থেকে। আবছা করে শুনতে পেলাম চাচিকে আবার প্রশ্নের জালে আষ্টেপৃষ্টে জরাগ্রস্ত করছে আপু। আপু কতটা কি জানতে পারবে আমি জানি না তবে আমার এখনো অনেক কিছু জানার বাকি আছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর যে এখনো অজানা।

_______________

ভোরের শুদ্ধ আলো দিয়ে শুরু হলো আমার নতুন সকাল। রান্না আমি পারি না। মা কখনে রান্না করতে দেয়নি। তাই যেটুকু পারি সেটুকু কাজ করে ফেললাম। গত রাতের এঁটো বাসন ধুয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে ফেললাম। মা থাকতে একটুও নোংরা হতে দিতো না। সবসময় পরিষ্কার রাখতো। কিন্তু এখন রান্নাঘরে ঢুকতেও ঘৃনা লাগে। ঘর ঝারু দিয়ে চাচিকে রান্নার কাজে একটু হেল্প করে আমি তৈরি হলাম কলেজের জন্য। সারাফাত ভাই নাবিলা আপু আর নাদিয়া আপুকে নিয়ে আজ চলে যাবে। ভাইয়া তাদের সাথে এক গাড়িতেই কলেজে যেতে বললেন। ভাইয়ার কথা ফেলতে পারলাম না। ভাইয়াট সাথে বেড়িয়ে পড়লাম কলেজের জন্য।

আপুদের বিদায় দিয়ে কলেজে ঢুকলাম। আশেপাশে কতো ছেলেমেয়েরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমার এমন কোন বন্ধু নেই। বন্ধু বানাতেও যোগ্যতা চাই। আমার তা নেই। এগিয়ে গেলাম একাদশ শ্রেনির দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস রুমের দিকে। একটা খালি বেঞ্চে বসে পড়লাম। ক্লাস করার কোন ইচ্ছা নেই। সবকিছু বিষের মতো লাগছে। হটাৎ কিছু একটা মনে করে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে এলাম ক্লাস থেকে। নতুন ভবনের দিকে এগিয়ে পা বাড়ালাম সামনে। মনে মনে ভাবছি আমিতো ফোনের ওই লোকটাকে কখনো দেখিনি। চিনবো কি করে? শুধু ফোনের মাধ্যমে কথা হয়েছে। টুসু তো চেনে। কিন্তু পরিচয় বলেনি। আমি নিজেই নাকি তাকে দেখতে পাবো। ঐদিন ঐ লোকটার কথামত বিয়ে থেকে পালিয়ে তার বলা ঠিকানায় গেলে অবশ্য দেখা হতো। কিন্তু আমি বাবাকে রেখে পালাতে পারি নি। ও বাড়ি ছাড়লে অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে যাবে। তাইতো ফিরে গিয়েছিলাম। ভাবতে ভাবতে কখন নতুন ভবনের সামনে চলে এসেছি টের পাইনি। ছয়তলা সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম ছাদের দিকে।

এতগুলো সিড়ি বেয়ে উঠে দম যেনে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। গলাটা শুকিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে গেছে। একটু পানি পেলে আত্মা ঠান্ডা হতো। আচমকা মুখের সামনে পানির বোতলসহ একটি হাত ও ফ্লোরে মুর্তিমান এক ছায়া আমার সামনে কোথাথেকে উদয় হলো। আমি উপরে চেয়ে দেখি দানবীয় শরীরের অধিকারী একটা ছেলে হাতে পানির বোতল নিয়ে মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। আমি হকচকিয়ে উঠে দাড়ালাম। ছেলেটি পানির বোতল সরাচ্ছেই না। একিভাবে বোতল হাতে দাড়িয়ে আছে। আমি না নেওয়া অবধি বোধহয় সরাবেও না। কি ঘারত্যারা।

আমি বোতলটি হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটি ফেরত দিয়ে দিলাম। ছেলেটি তৎক্ষনাৎ আমাকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। কোন টু শব্দ পর্যন্ত করলোনা। ভেবেছিলাম ধন্যবাদ জানাবো কিন্তু সেই সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। হটাৎ আমার মাথায় এলে এই ছেলেটাই ফোনের সেই ব্যাক্তি নয়তো? আমি হুরমুড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম ঘারত্যারা ছেলেটির খোজে। কোথাও ছেলেটির দেখা মিললো না। এইটুকু সময়ে কর্পূরের ন্যায় উরে গেলো যেন। হটাৎ কে যেন আমার মাথায় হাত রাখলো। আমি একটু চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি….

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৫

আমি বোতলটি হাতে নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে বোতলটি ফেরত দিয়ে দিলাম। ছেলেটি তৎক্ষনাৎ আমাকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। কোন টু শব্দ পর্যন্ত করলোনা। মিনিমাম একটি শব্দও খরচ করলোনা। ভেবেছিলাম ধন্যবাদ জানাবো কিন্তু সেই সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। হটাৎ আমার মাথায় এলো এই ছেলেটাই ফোনের সেই ব্যাক্তি নয়তো? আমি হুরমুড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম ঘারত্যারা ছেলেটির খোজে। কোথাও ছেলেটির দেখা মিললো না। এইটুকু সময়ে কর্পূরের ন্যায় উরে গেলো যেন। হটাৎ কে যেন আমার মাথায় হাত রাখলো। আমি একটু চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ইংলিশ প্রফেসর আসিফ ইশরাক স্যার দাড়িয়ে আছেন। আমি ওনাকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। এতোক্ষণ ওনারই ক্লাস চলছিলো। স্যার বেশ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,

‘ফার্স্ট পিরিয়ডে আমার ক্লাস চলছিলো। ক্লাস না করে এখানে কি করা হচ্ছে?’

‘সরি স্যার। ওই আরকি, এমনি এদিক এসেছিলাম!’

‘অন্তত সত্যি মিথ্যে কোন একটা বাহানা তো দেওয়া উচিত। মাঝে সাঝে পরিস্থিতি সামলাতে একটু বানোয়াট বন্দনা করতে হয়। উদ্দেশ্য সমীচীন হলে, উদ্দেশ্য হাসিল এর রাস্তা বা পদ্ধতি যদি অসমীচীন হয়। হোক না। ক্ষতি কি?’

আমি একটু ভরকে গেলাম স্যারের কথা শুনে। মাথা ওলটপালট হয়ে গেলো। স্যার কখনো পড়ানোর বাইরে এতো কথা বলেন না। ব্যাগ ভর্তি বিস্ময় আমার মনে। গুছিয়ে তুলে রাখলাম। প্রকাশ করলাম না। স্যারকে সালাম দিয়ে পা আগালাম ক্লাসের দিকে। স্যারের আশপাশ থেকে যেতে পারলে রক্ষে। আমি কয়েক পা এগোতেই আমার নোকেয়া বাটন সেটটি পিঠে থাকা ব্যাগের ভেতর কেঁপে উঠলো। বুঝতে পারলাম মেসেজ এসেছে। তারাতাড়ি লেডিস ওয়াশরুম এর দিকে ছুটলাম। এখানে আপাতত কেউ নেই। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে মসেজটা ওপেন করে দেখি সেই লোকের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। তাতে লেখা, ‘আমি ছাঁদে আছি আপনি চলে আসুন’।

ফোনটা ব্যাগের ভেতর রেখে ছুট লাগালাম আবার ছাদের দিকে। সিড়ি পার করতে করতেই নাজেহাল হয়ে গেছি। কোনমতে ছাদে গিয়ে পৌছালাম। কিন্তু আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেলাম না। লোকটা কি আমার সাথে মজা করছে? তখনকার মতো আবারো হাটু ভেঙে বসে পড়লাম। আর দাড়িয়ে থাকার জোর পাচ্ছি না। দু-দুবার ছাদে ওঠানামা করতে করতে নিজেকে হার্টের রোগি মনে হচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা চলছে জোড়দার। পা তো মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাচ্ছে।

হটাৎ মনে হলো সিড়ি বেয়ে কেউ উঠে আসছে উপর দিকে। জাগরুক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো পিছন ফিরে সিড়ির দিকে। কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। একে তো সকালে মাত্র অর্ধেক রুটি খেয়ে বের হয়েছিলাম তার ওপর রোদের তেজ যেন শলাকাবিদ্ধ করছে পুরো শরীরে। হটাৎ মুখের সামনে একটি পানির বোতল সহ হাতের দেখা মিললো। ফ্লোরে দেখা যাচ্ছে মুর্তিমান ছায়া। ঠিক আগের বারের মতো। তবে আগের বারের মতো একটুও ভরকাই নি। বুঝলাম তখনকার ছেলেটা আবার এসেছে। এই ছেলে কি সবসময় পানির বোতল নিয়ে ছাদে ছাদে ঘুরে বেড়ায় নাকি। আচ্ছা এখনো কি তখনকার মতো ত্যারামি করে পানির বোতল হাতে দাড়িয়ে থাকবে? যতখন না হাতে নেবো। এই ছেলেকি কথা বলতে জানে না নাকি? মুখে একবার বলতেও তো পারে, ‘পানিটা খেয়ে নিন।’

আচমকা কেউ সত্যি সত্যিই বললো, ‘পানিটা খেয়ে নিন।’ আমি চকিতে তাকালাম বোতলধারী ব্যাক্তির মুখ পানে। আমি ভুল দেখছি না তো। আাসিফ স্যার! সে এখানে কি করছে? চোখে মুখে অগণিত প্রশ্ন নিয়ে
হুরমুরিয়ে উঠে দাড়ালাম। স্যারকে এখনো বোতল হাতে দেখে একটু লজ্জা পেলাম। দ্রুত স্যারের হাত থেকে বোতল টা নিয়ে দুই ঢোক পানি কোন মতে গলা পার করে বোতলটা স্যারকে ফেরত দিলাম। স্যার কেমন করে তাকিয়ে আছে। এমন করে তাকিয়ে কেনো আছে? আমার কি এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত? স্যার গলা খেঁকিয়ে উঠলেন। আমি সচকিত হয়ে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকালাম স্যারের দিকে। স্যার স্পষ্ট গলায় বললেন,

‘দেখা করতে চেয়েছিলেন দেখা করলাম। এখন এতো চুপ কেনো? পিঁপড়ে মণি!’

আমি বিশাল আকারের এক ধাক্কা খেলাম যেনো। এই নামটায় মা আমাকে মাঝে মাঝে ডাকতো। নামটা ছেটবেলায় দিয়েছিলো। ছোটবেলায় সবাইকে পিঁপড়ের মতো শুধু কামড়াতাম। একটু বড় হওয়ার পরেও কারো সাথে ঝগড়ার সময় কেউ আমায় মারলে আমি কামড়ে শোধ করে দিতাম। বড় হওয়ার পর মা এই নামটায় দুষ্টমি করে মাঝে সাঝে ডাকতো। আমি একটু হেসে উঠতাম। মা ও হেসে ওঠতো সেই দিন গুলো মনে করে। স্যার কি করে এই নাম জানলো? আর ফোনের লোকটাও দুইদিন আমায় পিঁপড়ে বলে সম্বোধন করেছে। তার মানে ফোনের সেই অজ্ঞাত শুভাকাঙ্খী আশিফ স্যার!

‘আপনার কাছে সময় আছে দু মিনিট। পাঁচ মিনিট পর আমার ক্লাস আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার হলে করতে পারেন। বাকি তিন মিনিট আমার কথা বলে আমি চলে যাবো। সময় কম। লেটস স্টার্ট!’

কি দিয়ে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছি না। কথার শব্দ সাজাতে ব্যার্থ হচ্ছি। কোথা থেকে শুরু করবো? প্রশ্ন তো অনেক। মা মারা যাওয়ার পর হটাৎ করে উনি আমার সাথে কেনো যোগাযোগ করলো? আমার সব সমস্যার কথা আমি না জানালেও কিভাবে স্যার জানলো? টুসুও তো এমন অনেক কথা জানে না যা উনি জানেন। আমার মা কে যদি আগে থেকেই চেনে তাহলে মা মারা যাওয়ার আগে কেন কোন যোগাযোগ করলো না? মাকে চিনতো কিভাবে? মা কলেজে তো কখনো আসেনি। এমনকি টুসুও স্যারকে চেনে। কিভাবে চেনে? বিয়ে থেকে পালাতেও স্যার টুসুকে দিয়ে সাহায্য করালো। পালিয়ে যেতে বলা হলো তারই কাছে। কেনো? যেকোন বিপদে কোন না কোনভাবে রক্ষা পেয়ে গেছি এই দুই মাসে। তাতেও কি স্যারের হাত?

‘ইওর টাইম ইস আপ।’

হটাৎ স্যারের কথায় আমার হুশ ফিরলো। আমি প্রশ্ন সাজাতে সাজাতে সময়ের কথা ভুলে গেছিলাম। স্যার বললেন,

‘ও বাড়িতে আপনি সেইফ নন। এই দুদিন বাড়িভর্তি মানুষজন ছিলো। তাই আপনার কোন ক্ষ*তি করার স্পর্ধা ওরা দেখাতে পারে নি। এখন নিশ্চয়ই বাড়ি খালি? এখন আপনাকে বাচানোর মতো ও বাড়িতে কেউ নেই। তাই আপনি আর ও বাড়িতে ফিরছেন না। আজ কলেজ শেষে আমার সাথে আমার বাড়ি যাবেন। আজ থেকে সেটাই হবে আপনার নিজস্ব ঠিকানা। ওবাড়ি আপনার যাবতীয় দরকারি যা আছে সব টুসু নিয়ে আসবে। না আনতে পারলেও সমস্যা নেই। সব নতুন পেয়ে যাবেন। সেসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন ক্লাসে যান। ক্লাস শেষে গেটের সামনে দাড়াবেন। আমি যাচ্ছি। আমার ক্লাস আওয়ার শুরু হয়ে গেছে। আর এটা লাগিয়ে নিবেন।’

আমি আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌছে গেছি। কথা শেষ করে এক সেকেন্ড ও দাড়ালেন না। গটগট করে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। কি সুন্দর হুকুমজারি করে দিলেন, তার সাথে নাকি আজ আমায় যেতে হবে। হুকুমের যেন আস্তো একখানা লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। আমার অনুমতি তো দুরে থাক মতামত পর্যন্ত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যাবার আগে আবার পকেট থেকে একটা মলম বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। ঠোটের ক্ষত জায়গা আর ভ্রুয়ের কাটা জায়গা ইশারা করে লাগাতে বলে চলে গেলেন। তবে জিজ্ঞেস করলেন না কিভাবে এসব হলো। আজ এক সাথে সব আজগুবি ত্যাড়া ত্যারা লোকের পাল্লায় কেনো পড়ছি? আজ কি কোনোভাবে ঘাড়ত্যাড়া দিবস চলছে!

আমি ঠিক করলাম কিছুতেই যাবো না স্যারের সাথে। ও বাড়িতে আমার বাবা আছে। তাকে একলা ফেলে কোনোদিনও কোথাও যাবো না। মা যে বারবার বাবার কথা বলে গেছে। সেই বাবাকে অবহেলা করি কি করে? তার সান্নিধ্য হয়তো খুব কম পেয়েছি। কিন্তু সে বাবা তো। আর তাছাড়া, যেখানে আমার কাছের মানুষগুলোই ভরসাযোগ্য নয়। সেখানে উনি তো আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা ব্যাক্তি। একে তো উনার ব্যাক্তিত্ব আমার কাছে অস্পষ্ট। তার উপর আমার মনের সব প্রশ্নের হদিস ওনার কাছে থাকা সত্ত্বেও উনি নিজে থেকে কিছুই খোলাসা করছেন না। কেমন হেয়ালি করে চলছেন। উনি আমার জন্য ভরসাযোগ্য কিভাবে হতে পারেন। আমি এক্ষুনি বাড়ি চলে যাবো। কলেজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা আর নয়।

ছাদ থেকে নেমে সোজা চললাম গেটের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দারোয়ান আমায় যেতে দিচ্ছে না। প্রথমে বললো, ‘ছুটির আগে যাওয়া মানা।’ তার প্রতিউত্তরে আমি জবাব দিলাম, রোজ কত ছাত্র ছাত্রী যাওয়া আসা করে। কোনদিন দেখিনি এতো নিয়মের রশি টাঙাতে। আজ নিয়ম নিয়ে এতো টানা হেচড়ানোর হেতু কি?’ দাড়োয়ান থতমত খেলো যেন। তারপর থেকে শুধু এক বাক্য আওড়িয়ে যাচ্ছে, আমাকে বের না হতে দেওয়ার নাকি নিষেধাজ্ঞা জারী আছে।

আমি বুঝে গিয়েছি আসিফ স্যারের নির্দেশনায় আমাকে যেতে দিচ্ছে না দাড়োয়ান। আমি ফিরে এলাম গেটের সামনে থেকে। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম যাবো তো আজ অবশ্যই। আমায় নিয়ে এতো ভয়ের কোনো কারন আমার নজরে আসছে না। আমার ক্ষ*তি করার হলে আগে কেনে করলো না চাচি। ক্ষ*তি করার হলে এতোদিন নিশ্চয়ই খাইয়িয়ে পরিয়ে আমায় বা*চিয়ে রাখতো না। তাছাড়া চাচি ভীতু মানুষ। সে এক খু*নের ধাক্কাই এখনো সামলে উঠতে পারেনি। আমার ক্ষ*তি কি করে করবে। মায়ের শ*ত্রু সম্পর্কে কিছু জানা ছিলো না তাই মাকে খুব সহজেই খু*ন করতে সক্ষম হয়েছে। আমিতো আমার শ*ত্রু কে চিনি। তাই আমার ক্ষতি এতো সহজে করে উঠতে পারবে না। আপুরা কেউ না থাকুক। চাচা তো আছে। সেই ছোটবেলা থেকে বাবাকে কাছে পাই নি। চাচার কাছ থেকে অনেক স্নেহ পেয়েছি। চাচা হয়তো চাচির অন্যায় কথার প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু আমার ক্ষতি কখনোই হতে দেবে না।

বাবার সুস্থতার জন্য আর মায়ের খু*নের রহস্যের জট খুলে প্রমানসহ খু*নিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ওই বাড়ি আমায় ফিরে যেতে হবেই। আমার জানার বাইরেও এখনো অনেক অজানা সত্য আছে ওই বাড়িতে। মায়ের খু*নের কথাটাও তো বিয়ের রাতেই জেনেছি। যদিও তা স্যারের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে।

আমি নানান ভাবনা চিন্তা করতে করতে ক্লাসের দিকে ফিরে আসছি তখনই আসিফ স্যার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস থেকে বের হলেন। মুখোমুখি হয়ে গেলাম দুজন। স্যারকে দেখে বিরক্ত লাগলো। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। এতোদিন যাকে স্যার বলে চিনে এসেছি। সম্মান করে এসেছি মনে প্রাণে। তার দিকে বিরক্তি চাহনি দেই কি করে। অযথাই কেমন চুপসানো বেলুনের মতো মুখ নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মনে থাকা এতো অভিযোগ এতো প্রশ্ন কিছুই প্রকাশ করার ইচ্ছা বা মানসিক জোর কোনটাই পেলাম না।

স্যার এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিবেশ বুঝে বেশ লহু স্বরে আমায় বললেন, ‘আপনার মনে যত প্রশ্ন আছে গচ্ছিত করে মনেই রেখে দিন। আজ আমার সাথে আমার বাড়ি গেলে নিজেই নিজের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আর না পাওয়া বাকি প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি নিজ দায়িত্বে আপনাকে দিয়ে দিবো। আমার উপর ভরসা রাখুন। এখন ক্লাসে যান।’

কথা শেষ করে স্যার আমায় পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন নিজ গন্তব্যে। আমি বুঝতে পারছিনা আমি কি করবো। স্যারের কথাগুলো আমায় চুম্বকের মতো টানছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু বাবা? বাবার কি হবে? উনি আমার সম্পর্কে এতোকিছু জানেন। বাবা তো অসুস্থ অসহায় হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। আমার বাবার সম্পর্কেও নিশ্চয় সবটা জানেন। তাহলে তার কথা কেনো চিন্তা করছেন না?

আরেকটা কথা মাথায় বার বার আসছে, স্যারের নাকি দুইজন সন্তান আছে। একজন আমার চেয়ে বড়।মাস্টার্স পড়ছে শুনেছি। আরেকজনের দশ বছর বয়স। ফোর ফাইভে পড়ে হয়তো। তাহলে আমায় আপনি করে কেনো সম্বোধন করেন আগে থেকেই? এতো নতুন ঘটনা নয়। অন্য কোনো শিক্ষার্থীদের কখনো দেখিনি আপনি করে বলতে। মেয়ের বয়সি একজনকে এভাবে আপনি বলে বিব্রত করা কি ঠিক? মোটেও না।

ক্লাসে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। হটাৎ মনে হলো মা বলতো, ‘গালে হাত দিয়ে বসতে নেই।’ আমি হাত নামিয়ে বসলাম। কি করবো এখনো কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি না। ভাবছি তো ভাবছিই।

এখনো একটা ক্লাস বাকি আছে। ক্লাস শেষ হলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন অবকাশ থাকবে না। স্যার আমাকে নিয়ে যাবেই। স্যারের কথার বিরোধিতা করতেও সংকোচ হয়। শেষমেশ ভাবলাম কলেজের পিছনের দেয়াল টপকে পালাবো। হাতে এখনো সময় আছে। যাওয়ার সময় মায়ের সাথেও একটু দেখা করে যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লাম। আসার সময় খেয়াল করলাম আশেপাশের কিছু ছাত্র ছাত্রী বাকা চোখে চেয়ে কিছু বলছে। হয়তো বারবার ব্যাগ হাতে যাচ্ছি আর আসছি সেইটা দেখেই অবাক হচ্ছে। আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। এসব উপেক্ষা করে আমি এগিয়ে গেলাম কলেজের পিছন দিকে। কোনভাবে ঠিক বেড়িয়ে যেতে পারবো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here