আড়াল_কথা,১৬,১৭

0
534

#আড়াল_কথা,১৬,১৭
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৬

শুদ্ধ কোন কথা না বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তখন যদি ফোন রিসিভ করতো তাহলে বলে দিতো আড়ালের কথা। এখন আড়ালের সামনে পড়া মানে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। এই একটা নতুন তৈরি হওয়া প্রশ্ন থেকে যে আরও কত প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়াবে মেয়েটা, কে জানে? ইচ্ছে তো করছে শা’লা’কে জামাই আদর কাকে বলে চিনিয়ে দিতে। সব ভন্ডুল করে দিলো।

রুম ছেড়ে বের হতেই সম্মুখস্থ হলো দুজন। শুদ্ধ আশা করেনি এ সময় এইভাবে মুখোমুখি হতে হবে আড়ালের। এখন যদি আবার প্রশ্নের মেলা বসায় তাহলে তো জ্বালা। এহ মেয়েটার নাম প্রশ্নবতী হওয়া উচিত ছিলো। ওর প্রশ্নগুলোও যেনো ওর নাকের ঘামের মুক্তো দানার মতোই। লেপ্টা লেপ্টি আছেই। পিছুই ছাড়ে না।

আড়াল শুদ্ধকে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে বৃষ্টির রুমের দিকে চলে যায়। ফিরেও তাকায় না। শুদ্ধ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয় আড়ালের যাওয়ার দিকে। অত্যন্ত অবাক হয় আড়ালের ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিমাতে। যেন শুদ্ধ নামক কোন মানুষ তার সামনেই পড়েনি।

যার জন্য বেরোচ্ছিলো সেই যখন মিউট হয়ে গেছে তাহলে আর শুধু শুধু বাইরে গিয়ে কি লাভ। রুমে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে ছাদের পথে হাটা দেয়। কিছুটা সময় এই শরীরটাকে প্রকৃতির উন্মুক্ত বাতাবরণ এর বুকে সঁপে দেওয়াই যায়। কিছুদিন পর তো এই বুকের মালিকানা অন্য কারো হয়ে যাবে। তখন স্বয়ং নিজেরও সেই মানুষটার অনুমতি ব্যাতীত এই বুক স্পর্শ করা হবে মহাঅপরাধ। সে না চাইলে থেমে রবে এই বুকের হৃৎস্পন্দন। তখন এই প্রকৃতি আমাকে একা নয় আমাদের দুজনকে একসাথে ছুঁয়ে দেবে। আজ না হয় একলাই প্রকৃতির সান্নিধ্য গ্রহন করি।

আড়াল শুদ্ধকে দেখানোর জন্য এমনিই বৃষ্টির রুমে প্রবেশ করেছিলো। যাতে শুদ্ধ এড়িয়ে যাবার জন্য বাড়ি থেকে কোথাও চলে না যায়। তখন যেভাবে বাইরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তাতে তো মনে হলো পাড় পাওয়ার জন্য পালানোর রাস্তা খুঁজছে। তাই তখন পাত্তা না দিয়ে বৃষ্টির রুমে যাওয়া। শুদ্ধকে ছাঁদে যেতে দেখে আড়াল বৃষ্টির রুম থেকে বেড়িয়ে এসে সোজা ছাঁদের দিকে অগ্রসর হয় বিড়বিড় করতে করতে।

আজ দানবটা পালাবে কই। আজতো সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। শেষ সিড়িটা পার করে ছাঁদে পা দিতেই চোখে পড়ে এক পুরুষালী অবয়ব। আকাশের অজস্র তারাদের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে রেলিং ঘেষে। এগিয়ে গিয়ে তার বা পাশে দাঁড়ালাম। মাঝে এক হাত দুরত্ব। সে একবার বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে আকাশে নিবদ্ধ করলো। মনে মনে গুছিয়ে নিলাম কিভাবে কি প্রশ্ন করবো। ভাবলাম রিয়াদ ভাইয়ার প্রশ্ন দিয়েই শুভারম্ভ করি।

‘এতো রাতে একটা ছেলেকে অন্ধকার এর ভীরে একা ছাঁদে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আর লোভ সামলাতে পারলে না তাই না? চলে এসেছো ভাব জমাতে। তখন তো বাড়ির ভেতরে থাকতে এমন ভাব করলে যেনো কখনো আমায় চোখের দেখাও দেখো নি। আর এখন একা পেয়ে এমন কনফিডেন্স নিয়ে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে আছো যেনো আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড। আর এখানে এসেছো রুফডেট করতে।’

হটাৎ ওনার আকস্মিক গা জ্বালানি কথায় নাক কান ফেটে এলো লজ্জায়। ছিঃ! বজ্জাত একটা। দানবটা জানে আমি এখানে কেনো এসেছি। তবুও নাটক করছে। রাগ না দেখিয়ে মাথা ঠান্ডা করলাম। মা বলতো রাগ হলে মাটির দিকে তাকাতে হয়। তাহলে নাকি রাগ কমে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। উনি তো এটাই চায় যে আমি ওনার কথায় রেগে গিয়ে আসল কথা থেকে সরে আসি। তাতো হতে দিচ্ছি না। ওনাকে চমকে দিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস এর সহিত বলে ওঠলাম,

‘আমার জিনিস না বলে চুরি করে নিজের কাছে রেখে আবার বেহায়াপনা করছেন। এতো দেখছি চোরের মায়ের বড় গলা।’

আমার কথায় উনি যেনো খানিক ঝটকা খেলেন। পাশ ফিরে আমার সামন বরাবর দাড়িয়ে বিদ্রুপ স্বরে বলে উঠলেন,

‘বাই এনি চান্স তুমি কি তোমার ‘মন’ এর কথা বলছো? শোনো আমার কাছে কোনো উটকো, অনর্থক জিনিসের কোনো জায়গা নেই। আই এম ভেরি চুজি পার্সন, ওকে?’

‘একদম উল্টা পাল্টা বলে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেন না। আপনি আমাকে যতোটা বোকা মনে করেন আমি ঠিক ততোটাও বোকা নই। আমি আমার রেকর্ডার এর কথা বলছি। মন টন এর কথা নয়। এখন আমি যা যা বলবো সব চুপচাপ শুনে তারপর ঠিকঠাক উত্তর দিবেন। মাঝপথে কোন উল্টা পাল্টা কথা বলে আমায় থামানোর চেষ্টা করলে সিরিয়াসলি বলছি, এক ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবো। এই বাড়িতে প্রথমদিন আমাকে আপনি কোলে করে নিয়ে এসেছেন। তাই তো?’

‘অন্য কাওকে এক্সপেক্ট করো?’

‘দেখুন আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নেবেন না। তার সাথে আমার বড্ড আড়ি বাধ। আমি জানি আপনিই আমাকে গতকাল দুপুরে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন। টুবলু বলেছে আমাকে সেটা। আমার কোমরে একটা রেকর্ডার লুকানো ছিলো। চাচির কথা রেকর্ড করবো বলে ওটা নিয়ে চাচির সামনে গিয়েছিলাম। জ্ঞান হারানোর সময় ওটা আমার সাথেই ছিলো। এই বাড়িতে এসে জ্ঞান ফেরার পর তা আমি পাইনি। আমি শিওর ওটা আপনার কাছেই আছে। আপনিই নিয়েছেন ওটা। আজ দুপুরে মায়ের কবরে যে ফুলের গাছগুলো লাগানো দেখলাম তাও আপনিই লাগিয়েছেন। স্যার নয়। রিয়াদ ভাইয়ার মিথ্যে এক্সিডেন্ট এর কথা বলে ইচ্ছে করে আমাকে ওই ক্লিনিক এ নিয়ে গেছেন এবং ওই কেবিনের সামনে নিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেছেন। যাতে ওই জানোয়ারের অবস্থা আমি নিজ চোখে দেখতে পারি। ওই জানোয়ারটাকে আপনিই শাস্তি দিয়েছেন। অন্য কেউ নয়। আর এইসবের মূল হচ্ছে ওই রেকর্ডার। ওই রেকর্ডারে আমি আমার লাইফের ভালো খারাপ সব কিছু নিজের মুখে বলে রেকর্ড করতাম। সবার সাথে মিশে কথা বলতে পারতাম না বলে মা বাবাকে দিয়ে আনিয়েছিলো ওটা। ওটাই ছিলো আমার বেস্টফ্রেন্ড। সেই রাতের কথা আর ওই জানোয়ারের শাস্তি দেওয়ার কথা আমি রেকর্ড করেছিলাম ওটাতে। মায়ের কবরে ফুল গাছ লাগানোর ইচ্ছের কথাও রেকর্ড করা ছিলো। সবগুলোই আপনি পূরণ করছেন। কেনো করছেন এসব? এসব করে কি প্রুভ করতে চাচ্ছেন? আমার মন বলে মায়ের খুন নিয়েও এখনো এমন কিছু আছে যা আমি জানি না। চাচির বলা সেই ‘উনি’ নামক কেউ আছে যার সন্ধান আপনি জানেন। টুসু কোথায় আছে তাও আপনি জানেন। কিন্তু বলছেন না। কেনো এতো হেয়ালি আর কেনোই বা এই হেয়ালি চক্রের সম্মুখ দ্বার এ শুধু আমি একাই দাড়িয়ে আছি। আপনারা তো সব জানেন। আপনি জানেন, স্যার জানে, টুসুও জানে। হয়তো বাড়ির অন্য সদস্যরাও জানে। তাহলে আমি কেন নয়? বলুন, উত্তর দিন।’

আড়াল কান্নারত অবস্থায় কথা বলতে বলতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। এতো এতো প্রশ্ন যেনো হাঁপিয়ে তুলেছে মস্তিষ্কের আঙিনা। মনে হচ্ছে যেনো আরও কিছু প্রশ্ন করা বোধহয় বাকি রয়ে গেলো। ভালোবেসে মায়ের দেওয়া নামটার মতো জীবনটাও আড়াল রয়ে গেলো। এতো প্রশ্নের উত্তর কোথায়? মনে হচ্ছে, শুধু উত্তর নয় আরও অনেক প্রশ্নেরও হদিস করা বাকি আছে।

‘তুমি কি চাইছো আমি তোমাকে কোলে তুলে আদর করে চোখের জল মুছিয়ে দেই? নাকি নিজেই নিজের চোখের জল মুছে উঠে দাড়াবে?’

আমি চট করে মাথা তুলে ওনার দিকে তাকালাম। আমার কথাগুলো যেনো বিন্দুমাত্রও ওনাকে ছুতে পারেনি। এতোটা পাষান কেউ কিভাবে হতে পারে? আমি উঠে দাড়িয়ে দু’পা এগিয়ে ওনার একটু কাছে গিয়ে দাড়ালাম। ওনার চোখে চোখ রেখে লহু স্বরে বললাম,

‘আমি বুঝে গেছি আপনি আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। আজ থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই খুঁজে নেবো। আপনাকে আর কখনো কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না আমাকে। আমার রাস্তা আমি ঠিক খুঁজে নেবো। আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে নাহয় এটা ছিলো যে আমি যেনো বাবার মতো কোন অন্যায় না করি। কোন পাপ যেনো আমার হাতে না হয়। কলুষিত না করি নিজেকে। কিন্তু সব জানলে নিশ্চয়ই পাপ হবে না তাইনা?’

‘আমি না চাইলে তুমি এবাড়ির বাইরে পা ও রাখতে পারবে না। খোঁজ করা তো দুরের কথা।’

‘আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলে আমি নিজের ক্ষতি করতে বাধ্য হব। আমার হারানোর মত কিছুই নেই। তাই নিজের ক্ষতি করতে আমার একটুও বাধবে৷ না। আমার ক্ষতির কারণ নিশ্চশই হতে চাইবেন না।’

‘আড়াল!’

ওনার উষ্মান্বিত দৃষ্টি আর বজ্র কন্ঠের রুঢ়তা আমাকে একটুও কাঁপিয়ে তুললো না। আমি অনুভব করলাম ওনার দৃষ্টি আমায় সাবধান করছে। আমি তা উপেক্ষা করে নেমে গেলাম ছাঁদ থেকে। রুমে গিয়ে বসে মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে কোথা থেকে শুরু করবো। সবার আগে মনে হলো টুসুর খোজ দিয়ে শুরুটা করতে হবে। আর চাচির সাথেও দেখা করতে হবে। সেদিন চাচি ‘উনি’ বলে কাকে সম্বোধন করে কথা বলছিলো। বাবা ঠিক কি কাজ করতো? এসব জানতে হবে। এখন শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা। কাল থেকে মাঠে আমায় একাই নামতে হবে।

রুমে ঢুকে দরজাটা হালকা চাপিয়ে জানালার সামনে দাড়ালাম। বাইরের আঁধার রাতের তমোসাচ্ছন্ন রাতের মতো মনে হচ্ছে জীবনটাকে। চোখ সরাতে ইচ্ছে হলো না। হটাৎ দরজা লক করার শব্দ হলো। খানিক চমকে পিছন ফিরে তাকালাম। চোখের সামনে দাড়িয়ে আছে এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। চোখ থেকে যেনো লাভা বর্ষন হচ্ছে। একটু আগে ছাদেও তো উনি ঠিক ছিলো। আমার ক্ষতি করার কথা বলে থ্রেট দেওয়ার পর একদম নিরব হয়ে ছিলো। এখন ওনাকে দেখে এতো ভয় কেনো করছে? মনে হচ্ছে আজই বোধহয় আমার জীবনের শেষ দিন। উনি দরজা বন্ধ করে আমার সাথে কি করবেন? এখন কি আমার চিৎকার করা উচিত? হটাৎ ওনার এগিয়ে আসা দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। উনি আমার দিকে এভাবে এগিয়ে আসছে কেনো? পিছিয়ে আসতে আসতে হটাৎ অনুভব হলো আমার পিঠে দেয়াল ঠেকে গেছে। পিছানোর আর জায়গা নেই। উনি আমার থেকে এক হাত দুরত্ব রেখে দাঁড়ালেন। আমার ক্রস্ত চোখে ঢেলে দিলো তার অমর্ষিত দৃষ্টি। এ দৃষ্টি আমার ধৈর্য দ্বার ভঙ্গুর করার জন্য পর্যাপ্ত। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুজে এলো আমার চোখ। হটাৎ ওনার লহু স্বরের ভয়ংকর কিছু বাক্য এলো আমার কানে,

‘তোমার ক্ষতি যদি হতেই হয় তবে সেটা আমার দ্বারাই হবে। আর যদি ভালো কিছু হয় তাও আমার দ্বারাই হবে। ক্ষতিই যখন চাও তাহলে তাই নাহয় হোক। বল কি ক্ষতি করতে চাও নিজের? অপশন কি তুমি চুজ করবে না আমি? থাক আমিই করছি। তোমার আছে বলতে তো শুধু এই শরীরটা। আর তো কিছু নেই। নিজের শরীরের ক্ষতিই তো করার কথা তখন বেশ গলা বাড়িয়ে বলছিলে, তাই না? সেটা নাহয় আমিই করে দিচ্ছি। তাহলে শুরু করা যাক?’

আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে ওনার প্রতিটি বাক্যে। আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই দরজায় শব্দ হলো। বিনা সময় ব্যায়ে উনি আমার থেকে সরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন খুলে দিতে। যেনো উনি জানেন, কে এসেছে। উনি দরজা খুলে দিতেই লক্ষ্যভূত হলো অনেক গুলো চেহারা। সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো। কারো চেহারা অনুসন্ধায়ক বিভ্রান্তিতে ছেয়ে আছে তো কারো চেহারাতে প্রকাশ পাচ্ছে প্রফুল্লতা। বাড়ির প্রতিটি সদস্য উপস্থিত রয়েছে রুমের ভেতরে। এতোগুলো চেনামুখ এর মধ্যে আবিষ্কার করলাম একজনের অচেনা মুখমণ্ডল। একজন বয়স্ক টুপি পড়া লোক দাড়িয়ে আছেন হাতে কিছু একটা নিয়ে। মনে অজানা ভয় অঙ্কুরিত হলো মনের ভেতর। কি হতে চলেছে আমার সাথে?

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৭

বাড়ির প্রতিটি সদস্য উপস্থিত রয়েছে রুমের ভেতরে। এতোগুলো চেনামুখ এর মধ্যে আবিষ্কার করলাম একজনের অচেনা মুখমণ্ডল। একজন বয়স্ক টুপি পড়া লোক দাড়িয়ে আছেন হাতে কিছু একটা নিয়ে। মনে অজানা ভয় অঙ্কুরিত হলো মনের ভেতর। কি হতে চলেছে আমার সাথে?

হটাৎ পেছন থেকে গুবলি এগিয়ে এলো। শুদ্ধর হাত ঝাঁকিয়ে নরম স্বরে বললো,

‘ভাইয়া তুমি আজ কেনো বিয়ে করবে? তোমার ঢিসুম ঢিসুম করা শেষ হলে না বিয়ে করবে বলেছিলে? মা বললো, আজই নাকি তোমার বিয়ে তাই আলম নানাকে ডেকে এনেছে তোমায় বিয়ে করাতে।’

গুবলু, টুবলু আর তিন্নিও এতোক্ষণে ঘিরে দাড়িয়েছে শুদ্ধকে। ওরাও একে একে বলে ওঠে,

‘হ্যা ভাইয়া। তুমি তো বলেছিলে ওয়ান মান্থ ইকুয়াল টু থার্টি ডে’স যেনো মিষ্টপু ডাকি। আর তারপর তুমি ঢিসুম ঢিসুম শেষ করে এসে মিষ্টিপুকে বিয়ে করলে পারমানেন্টলি মিষ্টি ভাবি ডাকবো আমরা। কিন্তু সবে তো দুদিন হলো। এখনি বিয়ে করলে তো এখন থেকেই মিষ্টি ভাবি ডাকতে হবে। মা ও তো এখানে আসার আগে বললো আফটার থার্টি ডে’স নয় আজ থেকেই মিষ্টি ভাবি ডাকতে হবে।’

বাচ্চাদের কথোপকথন চলতে চলতে সবাই যে যার মতোন জায়গা করে নিয়েছে। কেউ বসে গেছে কেউ দাড়িয়ে আছে। রিয়াদ শুদ্ধর দিকে এগিয়ে গিয়ে গুবলি কে কোলে নিয়ে বাকিদের শুদ্ধর থেকে সরিয়ে আনতে আনতে বলে,

আরে পিচ্চি বউ আমার, তুমি আমাদের নিজের সংসারে মন দাও না অন্যের সংসারে নাক গলানোর কি দরকার? তুমি এখানে ছোট শাশুমায়ের কোলে বসে বসে ভাবো কাল সকালে কোন রাইমটা আমায় শোনাবে। আর এইযে শা’লা শা’লি’গণ আপনারও বসে বসে তাই ভাবুন। কাল নিউ রাইম না শোনাতে পারলে কিন্তু সংসারি থেকে বাদ দিয়ে দেবো বলে দিলাম।’

শুদ্ধ দরজা খুলে দিয়ে এসে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে এখনো একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের কথারও কোনো উত্তর দেয় নি। আড়াল পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। দুঃস্বপ্ন লাগছে সবকিছু। বাচ্চাদের কথা শুনে বুঝতে পারছে এখন সে বিয়ে নামক বাধনে বাধা পড়তে চলেছে। এটাও পরিষ্কার যে এখন বিয়েটা হুট করে হলেও আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো বিয়ের বেপারটা। জ্ঞাত ছিলো সবাই, শুধু সেই ছিলো অজ্ঞাত।

প্রথমে যখন সবাই রুমে প্রবেশ করলো তখন গুটিকয়েক মানুষের মুখে বিভ্রান্তির ছাপ থাকলেও এখন সবার চেহারা রয়েছে প্রজ্বালিত। সবাই উদ্রি্ত, উৎসুক চেহারা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করছে কথা ও নিজেদের অনুভুতি। টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত বয়ষ্ক কাজী কিছু লেখালেখি করছে চেয়ারে বসে। এর মধ্যে চেয়ারের ছড়াছড়ি লেগে গেছে রুমের ভেতরে। শুদ্ধর মা এসে ওরনার কিছু অংশ টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো আড়ালকে। আড়াল করুণ চাহনি দিলো আলো বেগমের দিকে। আড়ালের থুতনি ছুয়ে চুমু খেলো আলো বেগম। ভরসা বিনিময় করলো মায়া দৃষ্টি দিয়ে।

শুদ্ধের ইশারা পেয়ে বৃষ্টি এগিয়ে এসে একটা টাচস্ক্রীন প্রযুক্তির ফোন এনে আড়ালের হাতে দেয়। আড়াল প্রশ্নাত্মক চেহারায় ফোন হাতে নিতেই শুদ্ধ নিজের ফোনে কিছু টাইপ করে আড়ালের হাতে থাকা ফোনে পাঠিয়ে দেয়। হটাৎ হাতে থাকা ফোনটা কেপে ওঠে। আড়াল লকহীন ফোনটার আলো জ্বলে ওঠতে দেখে স্ক্রিন এ তাকায়। কিছু শব্দের মাঝে নিজের মা ও টুসু নাম চোখে পড়ে স্ক্রিনে ভেসে থাকা একটি এসএমএস নোটিফিকেশন এ। তা দেখে ক্ষিপ্রবেগে মেসেজ ওপেন করে আড়াল। চোখে পড়ে পাঁচ ছয় লাইনের অপ্রতিম কিছু লেখা।

‘সুষ্ঠুভাবে তিন কবুল বলে দিলে তিনদিন পর পর যেকোন তিনটি করে প্রশ্নের উত্তর পাবে আমার কাছ থেকে। আর যদি কোন নাটকীয়তার চমৎকারিত্ব দেখাও, তাহলে জিবনে কখনো তোমার মায়ের আসল খু’নি’র নাগাল পাবে না। তোমার চাচি তো শুধুমাত্র একটা গুটি মাত্র। মেইন প্লেয়ার অন্যকেউ। যাকে তুমি তোমার মায়ের খু’নি হিসেবে ভাবতেও পারবে না।’

আড়াল স্তম্ভিত হয় গুটিকয়েক লাইনের ছোট বার্তাটি পড়ে। মনে মনে আওরায়, ‘তার মানে মায়ের খু’নি অন্যকেউ। চাচি নয়? কিন্তু চাচি যে বললো সে নিজ হাতে আমার মায়ের প্রা’ণ নিয়েছে। তাহলে আসল খু’নি কে? তার নাগাল পেতে হলে এই বিয়েটা আমায় করতেই হবে। এতোদিন পর্যন্ত মনে হতো জানা প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু অজানা। এখন মনে হচ্ছে শুধু উত্তর নয় প্রশ্নের ও সন্ধান করা বাকি আছে। আরও কত অজানা প্রশ্ন রয়ে গেছে গোপনে তাই জানা নেই, তাহলে একা একা এতো উত্তরের সন্ধান কি করে করবো?’

এতোক্ষণ মনে মনে কবুল না বলার ছক কষলেও এখন কবুল বলার তর সইলো না আড়ালের। মনে মনে উদগ্রীব হলো কবুল নামক পবিত্র শব্দ দিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে। এই শব্দটি যে শুধু অজ্ঞাত প্রশ্নের উত্তর নয় একটা নতুন সম্পর্কেও আটকে দেবে তা বুঝেও মনে ঠায় দিলো না কোন দ্বিধাদ্বন্দ। নিজের মনকে বুঝ দিলো নানান ভাবে। মস্তিষ্ক ঘিরে ছেয়ে গেলো তিক্ততা। মনের কোনে উকি দিলো মায়ের শেষ স্মৃতি। মা যেনো রান্না করছে আর তার হাতের বালার সুমধুর টুংটাং আওয়াজ আসছে কানে। রান্না ঘরের সামনে দাড়িয়ে শুনে যাচ্ছে একটি মেয়ে। যে কখনো তার মাকে জরিয়ে ধরে বলতে পারেনি, ‘মা ভালোবাসি তোমায়’। হটাৎ কারো ঝাঁকি পেয়ে আড়াল অশ্রু টলটলে চোখে সামনে তাকায়। যে চোখে এতোক্ষণ মায়ের মায়ামাখা মুখটা ভাসছিলো, সেই চোখে এখন মামনির চেহারা দেখতে পেলো। কবুল বলার জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে পাশ থেকে। নিজেকে সামলাতে না পেরে আলো বেগমকে জাপটে ধরে ঝরা বৃষ্টির মতো ঝমঝমিয়ে কেঁদে ওঠলো আড়াল। সবাই বেশ থমকে গেলো আড়ালের কান্না দেখে। কাঁদতে কাঁদতে তিনবার বলে দিলো কবুল শব্দটি। সই করতে বলা হলে কাঁপা হাতে সই করে দেয়। সম্পূর্ণ বিয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়ে গেলে শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে যায় বিনাবাক্যে। আড়াল এখনো আলো বেগমকে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।

চারপাশে বিবর্ণ কৃষ্ণকায় তলিয়ে আছে আশপাশ। এই অন্ধকার এর বুকে শুদ্ধর নিজেকে মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে নিজের সত্তাকে। আড়ালের কান্নার প্রতিটি মুহূর্ত উপপ্লব তুলেছে শুদ্ধর বুকে। ভীষন যন্ত্রণা ঘোষণা করছিলো মন তখন। নিজের অনুভূতি গুলো ফিকে লাগছিলো। মনে হচ্ছিল খুব শক্ত করে বুকে টেনে নিতে। চোখের ঝরা মুক্তগুলোকে নিজের বুকপকেটে জমানোর বড্ড তৃষ্ণা লাগছিলো। এ তৃষ্ণা মিটবে কবে?

‘কাঁদিস না মা। হা কর। খেয়েনে। বিয়েটা তোর অমতে হলেও তোর জন্য কষ্টের কারণ কখনোই হবে না এই বিয়ে। আমার ছেলেটার ওপর ভরসা রাখ। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়তো বিয়েটা হয়েছে, কিন্তু তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ের সম্পর্কটা শুদ্ধ এগিয়ে নেবে না। আমায় বলেছে ও। তুই যত সময় চাস নে। জানি না আজ তোদের মধ্যে কি কথা হয়েছে। কেনো এমন হুট করে আলম চাচাকে ডেকে এনে বিয়ের ব্যবস্থা করলো। তোদের বিয়ে আরও একমাস পর হবার কথা ছিলো। তোকে বলেছে কিনা জানি না। বললেও কতটা বলেছে তাও জানি না। এখন বিয়েটা যখন হয়েই গেছে মন থেকে মেনে নিস মা।’

আলো বেগম আড়ালকে কয়েক গাল ভাত খাইয়িয়ে দিয়ে বৃষ্টিকে আড়ালের সাথে বসিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে। ওদিকে আলম সাহেবের আতিথেয়তা হচ্ছে। সেদিকে যেতে হবে। বৃষ্টি কাছে এসে বসতেই আড়াল নিজেকে ধাতস্থ করে এক গ্লাস জলে গলা ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘স্যার কোথায়?’

‘জেঠু তো আজ এখনো আসেনি। কোথায় আছে জানি না। শুদ্ধ ভাইয়া বললো চলে আসবে।’

‘সবসময় এতো রাত করে বাসায় ফেরেন স্যার?’

‘নাহ তো। এর আগে দুই একবার দেরি করে এসেছে। সবসময় না।’

‘তোমরা সবাই আগে থেকেই জানতে ওনার সাথে আমার বিয়ে হবে? এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো?’

‘হ্যা। সবাই জানতো। আমরা তো সবাই অনেক এক্সাইটেড ছিলাম। তবে তোমাকে এ বিষয়ে কিছু বলা মানা ছিলো। কিন্তু জেঠু ক…’

‘তুই তোর রুমে যা। আমার ওর সাথে কিছু কথা আছে।’

হটাৎ শুদ্ধর গলা পেয়ে আড়াল চকিতে দরজার দিকে তাকায়। সদ্য জলে ভেজানো গলা আবারও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো যেনো। কি বলবেন উনি?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here