আড়াল_কথা,১৮,১৯

0
669

#আড়াল_কথা,১৮,১৯
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৮

হটাৎ শুদ্ধর গলা পেয়ে আড়াল চকিতে দরজার দিকে তাকায়। সদ্য জলে ভেজানো গলা আবারও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো যেনো। কি বলবেন উনি? তাও আবার একলা ঘরে। বৃষ্টির সামনে বলা যেতো না কি? শুদ্ধ আড়ালের থেকে এক হাত দুরত্ব রেখে বিছানায় বসলো। আড়াল চোখ তুলে চাইলো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো। শুদ্ধ নিরবতা ভাঙছে না।

আড়াল এর বড্ড অবাক লাগলো শুদ্ধের নিরবতায়। মনটা এবার ক্রোধের বিষে বিষিয়ে ওঠলো। এমন ভাবে লোকটা নিরব হয়ে বসে আছে যেনো তার কৃতকর্মের জন্য কত অনুশোচনা হচ্ছে। তবে ক্রোধের ছাই মুখে না মেখে শক্ত হয়ে বসে রইলো আড়াল

শুদ্ধ এক লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে আড়ালকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘এখন তোমাকে কিছু কথা বলবো, প্লিজ মন দিয়ে শুনবে। বাবা..’

‘শুদ্ধ ভাইয়া, নিচে কেউ একজন এসেছে। আড়াল এর খোঁজ করছে। বলছে আড়ালের সাথে দেখা করতে চায়। নিচে ড্রয়িংরুমে বাবার সাথে বসে আছে।’

হটাৎ বৃষ্টির গলা পেয়ে শুদ্ধ থেমে যায়। কথা শেষ করে ওঠতে পারে না। শক্ত গলায় বৃষ্টিকে শুধু জিজ্ঞেস করে কয়জন এসেছে? বৃষ্টি উত্তর দেয়, ‘একজন ভদ্রলোক।’

‘তুই গিয়ে বল আড়াল খাবার খাচ্ছে। একটু পর আসছে। যাওয়ার আগে দরজাটা লাগিয়ে যাস।’

আড়াল বৃষ্টির কথা শুনে মনে মনে ভাবছিলো কে এলো তার খোঁজ করতে তা দেখতে এখনি নিচে যাবে। এমন সময় শুদ্ধর এমন অদ্ভুত মিথ্যে শুনে আড়াল খানিক রেগে যায়। খানিক উচ্চ স্বরে বলে উঠে,

‘আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বলে কি আমি আপনার কথা ছাড়া কারো সাথে দেখাও করতে পারবো না? আপনি মিথ্যে কেনো বললেন?’

শুদ্ধ কোনো উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। যাওয়ার আগে বাইরে থেকে লক করে দিয়ে গেলো দরজা। আড়াল হতবাক হয়ে যায় শুদ্ধর এমন ব্যাবহারে। রাগের থেকে কষ্ট বেশি লাগলো। মনে হলো সব স্বাধীনতা বুঝি শেষ হয়ে গেলো। দুমিনিট পর আচমকা লক খোলার শব্দে কান খাড়া হয় আড়ালের। শুদ্ধ আবার এসেছে। তবে হাতে লাল কিছু একটা রয়েছে। সাথে একটা বক্স ও আছে। আড়ালের মনে হলো হাতের রক্তলালের মতো দেখতে ওটা শাড়ি। শুদ্ধ এগিয়ে এসে আড়ালের হাতে শাড়িটা দিয়ে বলে,

‘এই শাড়িটা ঝটপট পাঁচ মিনিটের মধ্যে পড়ে আসবে। অন্যান্য যা যা লাগে সৃষ্টির গুলো সব আছে। যাও ওয়াশরুম থেকে পড়ে এসো।’

‘আমি শাড়ি কেনো পড়বো? যেখানে বিয়ের সময় আপনার শাড়ি ছাড়া কোন প্রবলেম হয়নি সেখানে সামান্য একজন দেখা করতে এসেছে বলে তার সামনে শাড়ি ছাড়া যাওয়াতে প্রবলেম কেনো হবে?’

‘তুমি যদি এভাবেই আমার সাথে তর্ক বির্তক করতে থাকো তাহলে কোন প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাবে না।’

আড়াল শুদ্ধের হাত থেকে শাড়িটা কেড়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শাড়ি পড়া ছোটবেলা থেকেই শেখা। তাই বেশি সময় লাগলো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাড়ি পড়ে বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।

লাল টুকটুকে শাড়ি, চোখ নাক খানিক লাল, ঘারে ঝুলে আছে হাতে করা মাঝারি সাইজের খোপা। দুপাশে অজস্র ছোট বড় চুল ঝুলে আছে নিজেদের মতো করে। শুদ্ধ আড়ালকে কয়েক সেকেন্ড খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে তার সামনে এসে দাড়াতে বলে। আড়াল বেশ বিক্ষোভ পূর্ণ চেহারা নিয়ে শুদ্ধর সামনে এসে দাড়ায়। চোখের দৃষ্টি নত। শুদ্ধ কঠিন স্বরে বলে ওঠে,

‘আমার দিকে তাকাও। যতক্ষণ আমি কথা বলবো আমার চোখে চোখ রেখে মনোযোগ সহকারে কথা শুনবে। চোখের দৃষ্টি বা মনোযোগ আমার থেকে সরে গিয়ে যদি এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে তাহলে দুটোই বাগে আনতে আমি জানি।’

এতোক্ষণ এর বিক্ষোভ এর ছায়া লেপ্টে থাকা মুখে নেমে এলো ভয়ের আধার। আড়াল চোখ তুলে তাকালো শুদ্ধের চোখে। সেদিন জেদের সাথে পাল্লা দিয়ে যার চোখে চেয়ে ছিলো অনিমেষ। আজ তার চোখে চাইতে গিয়ে পাল্লা দিতে হচ্ছে ভয়ের সাথে। নাকি অন্যকিছু। ঠিক বোঝা গেলো না।

আড়াল নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টি দিলো। শুদ্ধর কন্ঠের ন্যায় চেহারাতেও কাঠিন্যতা। সে বজ্র কন্ঠে বলতে শুরু করে,

আমাদের একটু আগে বিয়ে হয়েছে। সেটা যেভাবেই হোক না কেনো। আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব। সে তুমি মানো বা না মানো। তুমি এখন আমার বিয়ে করা বউ সেই অনুযায়ী আমার তরফ থেকে তোমার জন্য এখন দুটো অপশন আছে। হয় বাইরের মানুষের সামনে আদর্শ বউ এর দায়িত্ব পালন করবে অথবা তা বন্ধ দরজার ভেতরে। চাইলে দুটোই একসাথে কন্টিনিউ করতে পারো। বাইরে না ঘরে, কোথায় তুমি বউ এর দায়িত্ব পালন করবে তা তোমার ব্যাপার। তবে ফার্স্ট অপশন চুজ করলে অবশ্যই সবার সামনে আমাদের সম্পর্কটাকে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই প্রেজেন্ট করতে হবে। সবাই জানবে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক। আমাদের সম্পর্কের সীমা হবে ততটুকুই। আর যদি সেকেন্ড অপশন চুজ করো, তাহলে বাইরে কারো সামনে তুমি আমাদের সম্পর্কটাকে কিভাবে প্রেজেন্ট করছো তাতে আমি নাক গলাবো না। বাট পার্সনালি আমি আমার কোন অধিকার ছেড়ে সাধুবাবা হয়ে জীবন কাটাতে পারবো না। বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে সংসার করবো। হানিমুনে যাবো। বাচ্চা কাচ্চা হ…’

‘আপনি চুপ করবেন? আর বলতে হবে না। এতো ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজা বলে দিলেই তো হয় আপনি আমাকে আপনার হাতের পুতুল বানাতে চান। আপনি যেভাবে আমায় নাচাবেন আমি সেভাবেই নাচবো। আপনার সাথে সংসারি করে বাচ্চাকাচ্চার জন্য আমি বিয়ে করি নি। তা…’

‘তার মানে তুমি সেকেন্ড অপশন চুজ করছো। তাইতো? ওকে। তবে এক কাজ করো শাড়ী টারি খুলে ফেলো।’

‘আপনি কিন্তু এবার লিমিট ক্রস করছেন শুদ্ধ! আপনি কিন্তু এমন করতে পারেন না!’

আড়ালের দুইপা পিছিয়ে গিয়ে ভীতু গলায় আওড়ানো শব্দ শুনে শুদ্ধ খানিক বিরক্তি প্রকাশ করে দাতে দাত চেপে বলে,

‘আমি তোমার এক ঘন্টা আগে তিন কবুল বলে বিয়ে করা বর। তাই নাম ধরে ডাকতেই পারো। সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে তুমি যা ভেবে বাংলা সিনেমার পুরোনো ডায়লগ দিচ্ছো আমার তেমন কোনো মুড নেই। আর না তেমন কিছু মিন করেছি। তেমন ইনটেনশন হলে শাড়িটা তোমায় খুলতে বলতাম না। আমার নিজেরও হাত আছে। বলছিলাম যে শাড়িটা খুলে নিজের পছন্দের ড্রেস পরে নিচে যাও। যে এসেছে তাকে তোমার বরের পরিচয় দেওয়ার কোন দরকার নেই। এমনকি কারো কাছেই নয়। শুধু আমি আমার প্রাপ্যটুকু পেলেই হবে। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি চলে এসো।’

শুদ্ধ কথা শেষ করেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। দু দন্ড দাড়ায়না আড়ালকে কিছু বলার সুযোগ দিয়ে। আড়াল লজ্জায় শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। আড়ালের মনে হচ্ছে এতোক্ষণ কথা তো নয় যেনো বিষ মাখা সুঁচ ফোটাচ্ছিলো গায়ে ওই লোকটা। দুমনা করে তাকালো বিছানায় রাখা একটা লাল বক্সের দিকে। হাতে নিয়ে খুলে দেখে তাতে একটা স্বর্ণের চেইন, মাঝারি এক জোড়া কানের দুল আর অবিকল মায়ের হাতের বালার মতো এক জোড়া বালা। সাথে আবার চিকন এক জোড়া ছোট সাদা পাথর বসানো চুরি ও আছে। জ্বলজ্বল করছে লাইটের আলোতে। বালা জোড়া হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে আবার রেখে দিলো। ভাবলো এমন কিছু শুধু মায়ের হাতেই মানায়। তার হাতে নয়। বাকি জিনিসগুলো একে একে পড়ে আয়নার সামনে দাড়ালো। নিজেকে এমন বউ সাজে দেখে মলিন হাসলো আড়াল। হটাৎ কিছু মনে করে মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। নিজের দিকে চেয়ে মনে পড়লো অতীতের কিছু ছন্দস্মৃতি। ইচ্ছে হলো সব টেনে খুলে ফেলতে। মনটা বিশুষ্কতায় এলোমেলো হয়ে গেলো। দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে শান্ত করে রওনা করে ড্রয়িংরুমের উদ্দেশ্যে। এতো রাতে যে এসেছে সে নিশ্চয়ই এমনি এমনি আসেনি। আসন্ন ব্যাক্তির মধ্যেও কি কোন রহস্য আছে যা অজানা। আকাশ পাতাল কল্পনায় ডুবে অন্যমনষ্ক হয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে আড়াল।

শুদ্ধ ড্রয়িংরুমে পৌছিয়ে সোফায় বসা লোকটার মুখ দেখে খানিক খুশিই হয়। মনে মনে যা ভেবেছিলো তাই হলো। সেই এসেছে যার আসার কথা ভেবেছিলো। সরাসরি তার সামনে না যেয়ে পাশের রুমে গিয়ে কাউকে ফোন করে শুদ্ধ। খানিক্ষন পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে শুদ্ধ গলার স্বর নামিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,

‘সব সামলে নিয়েছি আমি। আড়াল আমার কথামতোই তার সাথে দেখা করবে। আর হ্যা, সে কিন্তু আর কাওকে সাথে আনেনি। একাই এসেছে। বাকিটা এবার তুমি সামলাও।’

শুদ্ধ নিজের কথা শেষ করে ওপাশের বলা কথা কিছুক্ষণ শুনে ফোনটা কেটে পকেটে ভরে নেয়। অপেক্ষায় থাকে আড়ালের। তার খুব ভালো করেই জানা আছে আড়াল তার কথামতোই নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিচে আসবে। ভাবতে না ভাবতেই শুদ্ধ দেখতেই পায় সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে আড়াল। আড়ালের স্নিগ্ধতা শুদ্ধের মনে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। লাল টুকটুকে পুতুলের মতো লাগছে মেয়েটাকে। আড়াল আসতেই আড়াল কে থামিয়ে দেয় শুদ্ধ। কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,

‘তোমার সাজগোজ বলছে তুমি ফার্স্ট অপশন চুজ করেছো। এবার ওই রুমে আমি যা যা বলবো সবকিছুতে শুধু হ্যা করে যাবে। একদম পতিব্রতা দায়িত্বশীল স্ত্রীর মতোন। মনে যেনো থাকে।’

শুদ্ধ কথা শেষ করে আড়ালের পেছন থেকে আচল টেনে নিয়ে মাথায় দিয়ে বলে, ‘এবার ঠিক আছে। চলো।’
আড়ালকে আগে যেতে বলে শুদ্ধ পিছন পিছন যেতে থাকে। আড়াল ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসা মানুষটার মুখ দেখে আশ্চর্য নয়নে চেয়ে থাকে। মনে প্রশ্ন জাগে এই মানুষটা এতোদিন কোথায় ছিলো?

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৯

শুদ্ধ কথা শেষ করে আড়ালের পেছন থেকে আচল টেনে নিয়ে মাথায় দিয়ে বলে, ‘এবার ঠিক আছে। চলো।’
আড়ালকে আগে যেতে বলে শুদ্ধ পিছন পিছন যেতে থাকে। আড়াল ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসা মানুষটার মুখ দেখে আশ্চর্য নয়নে চেয়ে থাকে। মনে প্রশ্ন জাগে এই মানুষটা এতোদিন কোথায় ছিলো? মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে আসে একটি ডাক,

‘চাচা!’

সাত্তার সাহেব শুদ্ধর তিন চাচার সাথে কথা বলছিলো আড়ালের বিষয়ে। পরিচয় দিচ্ছিলো নিজের। হটাৎ আড়ালের ডাক শুনে চকিতে পাশ ফিরে তাকায়। চোখে পড়ে লাল জামদানী শাড়ি পড়নে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। যাকে দেখলে একটা সময় বুকের ভেতর ঠান্ডা হয়ে যেতো। তাকে দেখে আজ বুকটা কেঁপে উঠলো। সাত্তার সাহেবের আশ্চর্য নয়নে আবির্ভাব হলো নোনা পানির স্রোত। চোখ দুটো ছলছল করছে। আড়াল খানিক এগিয়ে গিয়ে সামনে দাড়ালে সাত্তার সাহেব উঠে দাড়ান। আড়ালের মাথায় হাত রেখে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠেন।

আড়াল শাড়ীর আঁচল দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। চাচার কান্না দেখে নিজেকে আটকাতে পারছে না আড়াল। চাচার হাতটা ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব। পুরোনো স্মৃতি গুলো তাজা হয়ে উঠছে। তার সাথে চোখে ভেসে ওঠছে চাচাকে নিয়ে হাজারো স্মৃতির মেলা। আড়াল ভাবতে থাকে, ছোটবেলা থেকে বাবাকে কাছে পাওয়া ছিলো স্বপ্নের মতোন। দুই এক বছর পর পর এসে পনেরো দিন এক মাস করে থেকে যেতো বাবা নামক মানুষটা। সারাবছরের বাবার না পাওয়া ভালোবাসা পেতো এই মানুষটার থেকে। সবসময় চোখে চোখে রাখতো, চাওয়ার আগেই সব হাজির করে দিতো। মাকেও অনেক সম্মান করতো। তার নিজের মেয়েদের থেকেও বেশি স্নেহ করতো সর্বদা এই আমাকে। শুধু মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই চাচির সামনে কোন কথা বলতো না। চাচির কথার প্রতিবাদও করতো না। বিয়েতে মত না থাকা সত্ত্বেও চাচি বিয়ে ঠিক করলো তখনও চুপ করেছিলো। পালিয়ে যাওয়ার পরের দিন ফিরে আসার পর চাচির হাতে মার খাওয়ার সময়ও চুপ ছিলো। তবে সেদিন লুকুয়ে কাঁদতে দেখেছিলো চাচাকে। সামনে না এসে লুকিয়ে এসে দেখে যেতো তার আদরের মেয়েটা কেমন আছে কি করছে। চাচা আগে থেকেই নির্ভেজাল মানুষ। ছোটবেলা থেকেই চোখে পড়তো চাচি সারাদিন হাও কাও করলেও তার সাথে কখনো মুখ লাগাতো না। বড্ড শান্তি প্রিয় মানুষ। কিন্তু এতোদিন কোথায় ছিলো চাচা? প্রশ্নটা মনে না রেখে কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠলো আড়াল, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি? আর তোমার মুখে চোখে এসব দাগ কিসের?’

সাত্তার সাহেব সোফায় বসে পড়লেন। চোখ মুছে আড়ালের দিকে চেয়ে রইলেন। আড়ালের করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের মনে কাঁটার মতো বিঁধে থাকা প্রশ্ন করে বসলেন অবাক হয়ে,

‘এ তোর কেমন বেশ রে আরু মা? শাড়ি কেনো পড়েছিস? এসব ছেড়ে তোর জামা পড়ে আয়। আর একেবারে তোর ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আসবি। আমি তোকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। আমরা মা ছেলে মিলে দিন কাটিয়ে দিবো। যা মা। সব গুছিয়ে নিয়ে আয়। আর আপনাদের প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞতা। এ দু’দিন আমার মেয়েটাকে দেখে রেখেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।’

চাচার কথা শুনে আড়াল একটু থম মেরে রইলো। এখন কি বলবে চাচাকে। এমন বিয়ের কথাই বা কি করে বলবে আর কোন মুখেই বা বলবে? আড়াল কি উত্তর দিবে বুঝতে না পেরে মাথা নত অবস্থায় হাসফাস করে কিছু বলতে গেলে আচমকা শুদ্ধ আড়ালকে কিছু বলতে না দিয়ে হাসি মুখে সালাম করে বলে ওঠে,

‘ও কোথাও যাবে না চাচা। এটাই এখন ওর নিজের বাড়ি। আমারা আজ বিয়ে করেছি চাচা। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। বিয়ের আগে আপনার কথা ও কয়েকবার বলেছিলো। কিন্তু আমি খোঁজ করে কোথাও পাইনি আপনাকে। কোথায় ছিলেন আপনি? আর কিছু সময় আগে এলেই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারতেন।’

সাত্তার সাহেবের মুখটা আকস্মিক বদলে গেলো। মুখাবয়ব দেখে বোঝা গেলো না মনের অভিব্যক্তি। প্রকাশ করলেন না চোখের দৃষ্টিতেও। আড়াল নীরবে চোখের জল ফেলছে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে। শুদ্ধর কথা শুনে কোন প্রতিক্রিয়া জানালো না। শুদ্ধ আবারও বলে ওঠলো,

‘আজ এটাই ওর নিজের ঠিকানা। এখানেই থাকবে ও। চাইলে আপনিও আমাদের সাথে থাকতে পারেন চাচা। একা একা না থেকে। তাছাড়া বললেন না তো এতোদিন আপনি কোথায় ছিলেন?’

সাত্তার সাহেবের মুখাবয়বে আবার ফুটে ওঠলো বিষাদ এর ছাপ। করুন স্বরে বলে উঠলেন,

‘দু’দিন আগে আমায় কিছু লোক আটক করে নিয়ে কোথাও বেধে রেখেছিলো। এ দু’দিন অনেক মারধর ও করেছে। আজ আমি কোনমতে পালিয়ে বেঁচে এসেছি। আগে বুঝতে না পারলেও আজ বাড়ি এসে আশেপাশের মানুষের থেকে সবকিছু শুনে বুঝতে পেরেছি আমাকে কে বা কারা আটকে রেখেছিলো। এতোদিন কাল নাগিনী নিয়ে সংসার করেছি। বুঝতে পারিনি এভাবে আমার সব শেষ করে দেবে। কিন্তু আড়াল এমন একটা সময় কি করে তোমাকে বিয়ে করলো? ওর মত আছে তো এই বিয়ে তে?’

‘আমরা একে অপরকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসতাম চাচা। মাঝখানে আন্টির সাথে দুর্ঘটনা ঘটে যায় আর তারপর আমার সাথেও ওর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। দু’দিন আগে ওর চাচিকেও গ্রেফতার করা হয়। আমার বাবা ওর কলেজের প্রফেসর। বাবাও গিয়েছিল সেখানে। বাবা ওকে একা দেখে নিয়ে এসেছিলো এখানে। আর তখন ওকে এ বাড়িতে দেখতে পেয়ে বাড়ির সবাইকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দেই আমি। একটি অবিবাহিতা মেয়েকে বাড়িতে রেখে দিলে অনেকে অনেক রকমের কথা ছড়াতো। আর আমরা দুজন দুজনকে এমনিতেও ভালোবাসতাম। তাই আজ ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা করে নিয়েছি। কিছুদিন যাক। তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে সবাইকে নিয়ে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করা যাবে নাহয়। তাছাড়া পরিস্থিতিও এখন ঠিক নয়। এদিকে আপনার খোজও ছিলো না। আর বাকি সবার কথা আর কি বলবো!

ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধক সোফায় বসা শুদ্ধর তিন চাচা একটুও চমকালেন না শুদ্ধর কথায়। যেনো শুদ্ধর বলা সমস্ত কথাই সত্য। এর মধ্যে ড্রয়িংরুমে আগমন হয় শুদ্ধর মা, চাচি ও আলম সাহেবের। আলম সাহেবকে বিদায় জানাতে এসেছেন সবাই। এতোক্ষণ ডাইনিং রুমে তার আতিথেয়তা চলছিলো। আর বাকিরা রান্নাঘরে ছিলো। বিয়েটা হটাৎ করে সাধারণ ভাবে হলেও রাতের খবারটা তো একটু স্পেশাল করাই যায়। সেই কাজেই এতোক্ষণ আলো বেগম তার জায়েদের কে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো। আলম সাহেব চলে গেলে সোফায় বসা অজ্ঞাত ব্যাক্তিকে চোখে পড়ে আলো বেগমের। চিনতে না পেরে শুদ্ধকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে তার কথা। শুদ্ধ সবাইকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

‘ইনি হচ্ছেন আড়ালের চাচা। এতোদিন বিপদের মধ্যে ছিলেন। সম্ভবত চাচি ওনাকে আটকে রেখেছিলেন এতোদিন। আজ পালিয়ে এসেছেন কোনমতে।’

আলো বেগম এগিয়ে এসে বলে,

‘আপনি ঠিক আছেন তো ভাই? মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছে অনেক মারধোর করা হয়েছে আপনাকে। আপনি পুলিশের কাছে জানাননি আপনার কিডনাপিং এর কথা?’

‘আপনারা আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক আছি। আমি খবর পেয়েছিলাম আড়াল ওর কলেজের আসিফ স্যার এর বাসায় রয়েছে দু’দিন যাবত। তাই ওকে নিতে এসেছিলাম। ও যে আমার আরেকটা মেয়ে। ওকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছি সবসময়। ওকে ছাড়া থাকবো কি করে?’

ও তো এখন আমাদের বাড়ির বউ। আমার ঘরের আলো। ওকে কি করে দিই বলুন। এসব কথা পড়ে হবে। আসুন, আপনি বরং আগে খেয়ে নিন।’

‘না না আমি খেয়েই এসেছি। আপনারা ব্যাস্ত হবেন না। আমি বরং আড়ালকে নিয়ে যাই। কাল না হয় আপনারা গিয়ে নিয়ে আসবেন ওকে। আমার বড় মেয়েও এসেছে বাড়িতে। আড়ালকে বড্ড ভালেবাসে। ওকে দেখতে চায়। আপনারা অনুমতি দিন।’

আড়াল এতোক্ষণ যাবত চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলো কিন্তু এবার নাবিলা আপুর কথা শুনে আর চুপ রইতে পারলো না। আলো বেগমকে করুন স্বরে বলে ওঠলো,

‘মামনি আমি যাই? কাল গিয়ে না হয় কেউ নিয়ে এসো প্লিজ।’

শুদ্ধ তার মাকে কিছু বলতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আড়ালকে বলে ওঠে,

‘ঠিক আছে যাবে। কিন্তু সাথে আমিও যাবো। বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়ি যাবে বর কে ছাড়া? তাই কি হয় নাকি? আজ রাত না হয় চাচা থাকুক এখানে। কাল আমরা যাবো ও বাড়ি।’

‘না না। আজই যেতে হবে। তুমি যেতে চাইলে চলো বাবা। এ তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু আজই যেতে হবে আমাকে। আমার বড় মেয়েটা একলা রয়েছে বাড়িতে। রাতে হয়েছে অনেক।ভয় পাচ্ছে হয়তো। আর আসার সময় খেয়েই এসেছি আমি। তোমরা এখন চলো। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে।’

সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করা হলো এখনই আড়াল আর শুদ্ধকে নিয়ে সাত্তার সাহেব রওনা হবেন। আড়াল আর সাত্তার সাহেব সবাইকে বিদায় জানিয়ে রাস্তায় দাড়ানো শুদ্ধর গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। গাড়িতে ওঠার সময় শুদ্ধর ধাক্কা লেগে সাত্তার সাহেব এর বুক পকেট থেকে বাটন সেট এর ফোনটা পড়ে যায়। পাকা রাস্তার ওপর আচমকা ফোনটা আছড়ে পড়ায় ফোনের সব পার্টস গুলো আলাদা হয়ে পুরো রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। শুদ্ধ পার্টস গুলো তুলে দিতে সাহায্য করে। আড়ালও আশেপাশে খুজে ফোনের বডি পার্টস গুলো তুলে দেয়। কিন্তু সিম টার খোজ পাওয়া যায় না। সবাই মিলে খুজেও সিম এর হদিস মিললো না। রাস্তার অপর পাশে ছোট ছোট গাছ ও ঘাস লতা দিয়ে ভরপুর। তাই সবার মনে হলো হয়তো তার মধ্যেই হারিয়েছে। আর খোঁজাখুজি না করে রওনা হয় তিনজন ও বাড়ির উদ্দেশ্যে।

মাঝ রাস্তা বরাবর আসতেই হটাৎ সাত্তার সাহেব গাড়ি থামাতে বলেন। শুদ্ধ কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, বাড়িতে নতুন জামাই নিয়ে যাচ্ছেন। একটু মিষ্টি কিনবেন। শুদ্ধ গাড়ি না থামিয়ে একি গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে ওঠে,

‘তার কোন দরকার নেই চাচা। এখন যেরকম পরিস্থিতি চলছে তাতে এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি নিশ্চিন্তে বসুন। আমি নতুন জামাই হয়ে তেমন কিছু নিচ্ছি না। আপনাকে আর নিতে হবে কেনো? বাড়িতে চলুন। তাছাড়া বাড়ি থেকে তো কত রকমের খাবার প্যাক করে দিয়ে দিলো সাবার জন্য।’

‘না বাবা তা হয় না। বাড়িতে কিচ্ছুটি নেই। নতুন জামাই নিয়ে খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না।’

‘বললাম তো দরকার নেই চাচা। এইতো আর দশমিনিট এর মধ্যেই পৌঁছে যাবো।’

হটাৎ সাত্তার সাহেব রেগে গেলেন। হিংস্রতা প্রকাশ পেলো তার চেহারা ও কন্ঠে। পিছন থেকে একটি ছুড়ি বের করে শুদ্ধর গলায় রেখে রা’গা’ন্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,

‘তোর ম’রা’র শখ হয়েছে রে শা’লা । গাড়ি থামা বলছি। গাড়ি থামা শু*রে’র বা’চ্চা । তুই থানার রাস্তা দিয়ে কেনো যাচ্ছিস রে? স্কুল রোড দিয়ে কেনো গেলি না? এদিক দিয়ে তো আরও বেশি দুর হয়। আমায় বোকা পেয়েছিস? তুই নিশ্চই পু’লি’শের লোকেদের সাথে মিলে আছিস। পিছনের গাড়িটাও সেই কখন থেকে ফলো করছে। আমি বুঝিনি ভেবেছিস?’

আড়াল আচমকা তার চাচার এমন পরিবর্তন দেখে স্ত’ম্ভি’ত হয়ে যায়। শুদ্ধর গলায় ছু’ড়ি ধরা দেখে ঘা’বড়ে চি’ৎ’কার করে ওঠে। দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে করতে গাড়ি থামাতে বলে শুদ্ধকে। তখনই আচমকা আড়ালের চোখে মুখে র’ক্ত ছিটকে আসে। হাত দিয়ে মুখ হাতড়ালে ভিজে আসে হাত। চোখের সামনে হাত দুটো মেলে ধরলে আড়াল বুঝতে পারে সে আবারও কিছু হারালো। আবারও ঠ’কে গেলো কাছের মানুষের থেকে। আড়াল হালভাঙা হয়ে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায়। নেতিয়ে পড়ে পিছনের সিটে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here