আড়াল_কথা,২০,২১

0
789

#আড়াল_কথা,২০,২১
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২০

আচমকা আড়ালের চোখে মুখে র’ক্ত ছিটকে আসে। হাত দিয়ে মুখ হাতড়ালে ভিজে আসে হাত। চোখের সামনে হাত দুটো মেলে ধরলে আড়াল বুঝতে পারে সে আবারও কিছু হারালো। আবারও ঠ’কে গেলো কাছের মানুষের থেকে। আড়াল হালভাঙা হয়ে চিৎকার দিয়ে জ্ঞা’ন হারায়। নেতিয়ে পড়ে পিছনের সিটে। গাড়ি এখন থেমে আছে শুন’শান মাঝ রাস্তায়। আড়ালের হৃদয় বি’দা’রক চিৎ’কার শুনে শুধু এক পলক তাকিয়ে ছিলো শুদ্ধ পিছনের সিটে। আড়ালকে সিটে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখে বুঝতে পেরেছে জ্ঞা’ন হারিয়েছে ও। গাড়ির ভেতর জুড়ে চলছে বী’ভ’ত্স চিৎকার এর রৌরব খেলা। শুদ্ধের ছু’ড়ি ধরা হাত বেয়ে র’ক্ত পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। গাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে র’ক্তে’র দাগ। হটাৎ চি’ৎ’কার আর গো’ঙানির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেলো। সাত্তার জ্ঞা’ন হারিয়ে ঢলে পড়েছে বাদিকের জানালার গ্লাসে। শুদ্ধ আবারও গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ির গতি আগের মত একইভাবে চললেও গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য পথ নিয়েছে শুদ্ধ। ছু’ড়ি টা সাত্তার এর গায়ের ওপর মুছে নিয়ে সিটের ভেতরে রেখে দেয়। হাতটাও তারই শার্টের পরিষ্কার জায়গায় ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে র’ক্তে’র দাগ মুছে নেয়। অর্ধ পরিষ্কার হাতে নিজের প্যান্ট এর পকেট থেকে ফোন বের করে একটি নাম্বার এ কিছু একটা টাইপ করে মেসেজ করে দেয় তাৎক্ষণিক।

দশ মিনিট পর শুদ্ধ একটি হসপিটাল এর সামনে এসে গাড়ি দাড় করায়। গাড়ী থেকে থামতেই দুজন ছেলে এগিয়ে আসে গাড়ির দিকে। শুদ্ধ গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলে দুজনের মধ্যে রাহাত নামের ছেলেটি বলে ওঠে, ‘ভেতরে সব রেডি আছে চল’। আর সাফিন নামের ছেলেটি শুদ্ধর দিকে না তাকিয়ে সরাসরি সাত্তার কে কাধে করে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় হসপিটাল এর ভিতরে। শুদ্ধ ও সময় ন’ষ্ট না করে আড়ালকে কোলে করে নিয়ে প্রবেশ করে হসপিটালে। যাওয়ার আগে গাড়ির চাবি রাহাত এর হাতে দিয়ে কিছু ইশারা করে যায়। রাহাত ও বেড়িয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ে।

শুদ্ধ আর সাফিন তিন তলার করিডোরে দাড়িয়ে আছে বাইরের দিকে ফিরে। ভেতরে সাত্তার এর ট্রি’টমে’ন্ট চলছে। তার একটা কান কেটে অর্ধেক ঝুলে পড়েছে আর ঘাড়ের ডান দিকে ছুড়ির গভীর ক্ষত। তখন শুদ্ধর গলায় সাত্তার ছু’রি ধরলে তার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে সাত্তারের ঘারে আর কানে বসিয়ে দিয়েছিলো শুদ্ধ। সেই র’ক্ত’ই গিয়ে ফিনকি দিয়ে পড়ছিলো আড়ালের মুখে। আড়াল এর তেমন কিছুই হয়নি। অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর চোখের সামনে অমন ঘটনা দেখে জ্ঞা’ন হারিয়েছে শুধু। একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়ানো হয়েছে তাকে। পাশাপাশি স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।

‘নেক্সট প্লান কি?’

সাফিন এর প্রশ্ন শুনে শুদ্ধ ঘুড়ে দাড়ায়। সাফিন কে উদ্দেশ্য করে লহু স্বরে বলে ওঠে,

‘যা আগে ছিলো। নতুন কোন প্লান নেই।’

‘আড়ালকে নেওয়ার জন্য ওরা এতোটা ম’রিয়া কেনো হয়েছিলো যে এতো রি’স্ক নিয়ে তোদের বাড়ি পর্যন্ত চলে গেলো। তাও আবার একা। এ বিষয়ে কিছু জানিস?’

‘কিছুটা জানি। পুরোটা খানিকক্ষণ পর জেনে যাব।’

‘কিভাবে? ওটাকে যেভাবে মে’রে’ছিস, কথা বলার মতোন অবস্থায় আছে নাকি? যে তুই জিজ্ঞেস করবি আর ও গড়গড় করে সব বলে দেবে।’

‘সেদিন ফুপির রুমের দেয়ালের ভেতর থেকে যে দুই ব্যাগ ভর্তি কাগজ পত্র পাওয়া গেলো সেগুলোই সব প্রশ্নের উত্তর। সন্ধ্যার দিকে সোহাগ আর বাবা গিয়েছিলো উকিলের কাছে সেগুলো নিয়ে। অনেক কিছুই জানা গেছে। বাবা ফোন করে কিছুটা বলেছিলো আমায়। বাকিটা বাবা আর সোহাগ ফিরে এলে জানা যাবে।’

সাফিন আরও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো এরই মধ্যে ডক্টর চলে আসে। সাফিন আর শুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

‘ওনার কানের ছোট একটা অ’পা’রেশন করতে হবে। খুব বেশি রিস্ক নেই। ঘারের ক্ষ’ততে সিরিয়াস কিছু হয় নি। তবে ভুগতে হবে বেশ কিছুদিন। কানের অপারেশন আমরা এখনি শুরু করতে চাচ্ছি। কিছু ফর্মালিটি আছে। ওগুলো অন্তত পুরন কর। তোরা সিআইডির লোক আর আমি তোর নিজের চাচা বলে কি কোন ফর্মালিটিই মানবি না। তখন সাফিন এর কল পেয়ে দৌড়ে এসেছি বাড়ি থেকে। ওটাকে যখন এমন কানকাটা হনুমানই করে ছাড়বি তাহলে আমাদের বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই করতি। ব্যাপারটা সহজ হতো। শুধুশুধু এতো ঘোরাঘুরি করলি।’

শুদ্ধ তার ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে খানিক হেসে বলে ওঠে,

‘তোমার কথা শেষ হলে বলো কি কি ফর্মালিটিস আছে। সাফিন করে দেবে।’

শুদ্ধের ছোট চাচা সৌভিক একজন নার্সকে ডেকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে সাফিনকে পাঠিয়ে দেয় ফর্মালিটিস পূরণ করতে। যেটুকু না করলেই নয়। সৌভিক ওদের পাঠিয়ে নিজে চলে যায় অপারেশন এর প্রস্তুতি নিতে। এর মধ্যে হসপিটাল এ উপস্থিত হয় শুদ্ধের বাবা। শুদ্ধকে সবার আগে জিজ্ঞেস করে আড়ালের কথা। আড়ালের খবর নিয়ে খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে সাত্তারের বিষয়ে একে একে সবটা শোনে শুদ্ধের থেকে। তারপর গম্ভীর হয়ে শুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,

‘আমরা ব্যাপারটাকে যতোটা সহজ ভেবেছিলাম ব্যাপারটি ততটা সহজ নয়। এই কেসটা অনেক আগেই ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে। তুই যা করছিস তা সবটাই আনঅফিসিয়াল। অফিসিয়াল ভাবে যারা কেসটা ক্লোজ করিয়েছে তারা টের পেলে তোর একূল ও যাবে ওকূল ও যাবে। আর এখন যা যা জেনে এলাম তাতে জানি না মেয়েটাকে আদোও বাচাতে পারবি কিনা ওদের হাত থেকে। শুধু শুধু ওরা আড়ালের জন্য মরিয়া হয়ে যায় নি। আড়াল যে এখন সোনার হরিন। ওকে তো ওরা পেতে চাইবেই।’

‘এখানে এসব আলোচনা না করাই ভালো। উকিলের থেকে কি কি জেনেছো তা বাড়ি গিয়ে শুনবো। সোহাগ কাগজপত্র গুলো নিয়ে সঠিক জায়গায় পৌছে গেছে?’

‘হ্যা। ওগুলো রেখে কিছুক্ষণ পর চলে আসবে এখানে।’

আর কোন কথা হলো না দুজনের মাঝে। সাফিন ফর্মালিটি সব পূরণ করে দিলে অপারেশন শুরু হয় সাত্তার এর। রাহাত ও এরমধ্যে চলে আসে। রাহাত আর সাফিনকে হসপিটালে রেখে আড়ালকে নিয়ে রওনা হয় শুদ্ধ ও তার বাবা। বাড়ি পৌঁছে আড়ালের রুমে নিয়ে আড়ালকে শুইয়ে দিয়ে শুদ্ধ তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ঘন্টা খানিক পড় অথবা তার আগেই ওর জ্ঞান ফিরবে। ওর মানসিক অবস্থা ঠিক থাকলে ভালো। নয়তো আবারও ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়াতে হবে রাতটুকুর জন্য। আমি আছি ওর কাছে। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। নয়তো মা তোমায় আজ ঘরে ঢুকতে দেবে না। ওর জ্ঞান ফিরলে আমি সামলে নেবো।’

‘তোর মা আমার বউ। আমার বউ আমি বুঝে নেবো। সেটা তোর চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু তুই কেনো ওর সাথে একা থাকবি? আমিও আছি ওর সাথে। ও উঠলে নিশ্চয় প্যানিক করবে। শুধু ভয় পায়নি মেয়েটা, মনে আঘাতও পেয়েছে অনেক।’

‘তোমার ভাগনি আমার বউ। আমার বউ আমি বুঝে নেবো। সেটা তোমার চিন্তা করতে হবে না। ওকে আমি একাই সামলে নিতে পারবো।’

শুদ্ধের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাগুলো আসিফ সাহেব স্পষ্ট শুনে খানিক বৈক্লব্য হলেন। কিন্তু এমন ভাব করলেন যেনো কিছুই শোনেন নি। এমন বিব্রত অবস্থায় ছেলেটা মাঝে মাঝেই টেনে হিঁ’চ’ড়ে নামিয়ে অভ্যস্ত। ওর সাথে মুখ লাগাতে গেলেই এমন এমন উত্তর দেবে যে পাল্টা উত্তর দেবার কোন অবকাশ থাকবে না। আসিফ সাহেব গলা ঝেড়ে আড়াল এর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। শুদ্ধ ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। শার্টের বাম হাতার দিকটা র’ক্তে’র দাগে ভরে গিয়েছিলো। গাড়ি থেকে নামার আগে হাতাটা গুটিয়ে কনুইয়ের বেশ উপরে তুলে নিয়েছিলো যাতে কারো চোখে না পড়ে র’ক্ত গুলো। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে এখনো হালকা রক্তের দাগ রয়ে গেছে। গোসল করতে হবে এক্ষুনি। শরীর টা রিরি করছে একদম।

শুদ্ধ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে শুদ্ধর মা আসে রুমে। দরজার সামনে থেকে শুদ্ধের বাবাকে দেখতে পায় আড়ালের মাথার কাছে বসা। তিনি পরম স্নেহের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আড়ালের মাথায়। হাতে চুলগুলো পেচিয়ে গেলে আবার ধৈর্যের সহিত দু’হাতে চুলগুলো ছাড়িয়ে আলগা করে দিচ্ছে। যেনো একটি ছোট বাচ্চা তার মায়ের চুল নিয়ে খেলছে। আবার চুলে জট বাধলে মা বকবে সেই ভয়ে খুব সাবধানে চুলগুলো ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আলগা করছে দুহাতে। কি সুন্দর মায়াবী মূহুর্ত। এ যেন সত্যিই মা ছেলের জীবন্ত দৃশ্য। আলো বেগম ভেতরে ঢুকলেন না। আরও একটু পিছিয়ে গিয়ে পর্দার পিছনে লুকিয়ে নিলেন নিজেকে। দেখতে পেলেন তার গুরুগম্ভীর স্বামী আশেপাশে কিছু খুজছেন। বিছানা ছেড়ে ওঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা তেলের বোতল থেকে খানিক তেল আর টি টেবিল এ রাখা গ্লাস থেকে একটু পানি হাতে ঢেলে নিয়ে বিছানায় ফিরে গিয়ে আড়ালের মাথায় মনোযোগ দিয়ে মালিশ করতে লাগলেন। এমন দৃশ্য দেখে অদ্ভুত শান্তি পেলেন আলো বেগম। তৃপ্তি পেলেন হৃদয়ে।

শুদ্ধ বিশ মিনিট সময় নিয়ে গোসল করে বাইরে বেড়িয়ে আসে। ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেয়ে আসিফ সাহেব তড়িৎ গতিতে সোজা হয়ে বসেন। হাতে লেগে থাকা অবশিষ্ট তেলটুকু নিজের মাথায় সাবধানে ঘষে নেন। আলো বেগম আর লুকিয়ে না থেকে রুমের ভেতর চলে এসে সরাসরি দুজনকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেন। যেনো এই মাত্রই এসেছেন রুমে। দুজনেই মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানায় তবে বলে দেয় এই রুমেই খাবে দুজনে। আলো বেগম চলে যায় খাবার আনতে।

শুদ্ধ ও তার বাবা দুজনে একসাথে বসে ভাত মেখে সবে মুখে তুলবে এমন সময় আড়াল বিরবির করে কিছু বলে ওঠে। আলো বেগম এগিয়ে যায় আড়ালের কাছে। আড়াল চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড থম মেরে থাকে। আচমকা চিৎকার শুরু করে দেয় রক্ত বলে। আড়ালের চিৎকারে দুজনই এঁটো হাতে ওঠে পড়ে খাবার রেখে। কারোরই আর খাওয়া হলো না। হবে কি করে, মেয়েটা যে দুজনেরই প্রাণ।

#চলবে

#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২১

আড়াল চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড থম মেরে থাকে। আচমকা চিৎকার শুরু করে দেয় র’ক্ত বলে। আড়ালের চি’ৎ’কারে দুজনই এঁটো হাতে ওঠে পড়ে খাবার রেখে। কারোরই আর খাওয়া হলো না। হবে কি করে, মেয়েটা যে দুজনেরই প্রাণ। আলো বেগম কাছে গিয়ে জাপটে বুকে টেনে নেন আড়ালকে। আড়াল অনবরত মুখের সামনে হাত রেখে র’ক্ত বলে চিৎকার করছে আর এপাশ ওপাশ দেখছে। শুদ্ধ ও আসিফ সাহেব তাড়াহুড়ো করে হাত ধুয়ে আসে প্লেটের মধ্যেই। আসিফ সাহেব কি বলে মেয়েটাকে স্বান্তনা দেবেন বুঝতে পারছেন না। অসহায় চোখে শুধু দেখে যাচ্ছেন আর হাসফাস করছেন। শুদ্ধ আড়ালের সামনে বসে আড়ালকে শান্ত করার জন্য স্নেহমাখা কন্ঠে বলতে থাকে,

‘এরকম করো না আড়াল। একটু স্বাভাবিক হও। এখানে কোন র’ক্ত নেই। তোমার মুখ একেবারে পরিষ্কার। তুমি একটু ছুঁয়ে দেখো।’

আড়াল থামছে না। ওর মনে হচ্ছে শুধু তখনকার ঘটনা। ভাবছে এখনো র’ক্ত মেখে বসে আছে সে। দুর দুরান্ত পর্যন্ত শুধু খু’নি’দের বসবাস। যখন তখন যে কেউ খু’ন হয়ে যাবে। আর খু’নি হবে তার নিজের আপন কেউ। সবটাই যেনো তার চোখের সামনেই হবে। সে শুধু দেখতে পাবে প্রতিরোধ করতে পারবে না। কেউ বিশ্বা’সযো’গ্য নয়। সবাই খু’নি।

আড়ালের অবস্থার অবনতি দেখে শুদ্ধ ইনজেকশন রেডি করতে যায়। ঘুম পাড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আলো বেগম অস্থির হয়ে আড়ালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। আসিফ সাহেব এতোক্ষণ ধরে দেখে যাচ্ছিলো আর উতলা হয়ে ভাবছিলো কি করলে মেয়েটা শান্তি পাবে। শুদ্ধকে ইনজেকশন রেডি করতে দেখে বাধা দিয়ে বলে,

‘এখন আবারও ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পারালে মেয়েটা দুর্বল হয়ে পড়বে। আমি একটু চেষ্টা করছি।’

আসিফ সাহেব আড়ালকে শান্ত করতে মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেন ওর মায়ের কথা,

‘আপনার মায়ের সব থেকে বড় ইচ্ছে কি ছিলো তা জানেন আপনি? আপনার মায়ের জীবনের সমস্ত সুখের গল্প আপনাকে শোনানোর ইচ্ছে ছিলো তার সবথেকে বড় ইচ্ছে। আপনার মায়ের গল্প শুনবেন আড়াল? সুবর্ণা নামের এক রাজকন্যার গল্প।’

আড়াল এর শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত মায়ের নাম পৌঁছাতেই ধপ করে নিভে গেলো যেনো। তার স্যার তার মায়ের নামটা উচ্চারণ করেছে এটুকুই তার বোধগম্য হয়েছে। বাকি কথাগুলো তার কর্ণপাত হয়নি। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ফেলে তাকায় আসিফ সাহেব এর দিকে।

আড়ালকে শান্ত হতে দেখে তিনজনের হৃদয়ে যেন যুদ্ধের সমাপ্তি হলো। শুদ্ধ ইনজেকশন টা রেখে দিতে ঘুড়ে দাড়ালে চোখে পড়ে বাড়ির প্রায় সবাই দরজার সামনে বিষন্ন হয়ে দাড়িয়ে আছে। শুদ্ধ সবাইকে ইশারা করে চলে যেতে বলে। ইনজেকশন সরঞ্জাম জায়গা মতো রেখে দিয়ে এগিয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে সকালে এসে দেখা করতে। এখন আড়ালের অবস্থা ঠিক নেই। সবাই শুদ্ধের কথামতো চলে যায় যে যার রুমে। শুদ্ধ দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে এক পাশে বসে পড়ে। এদিকে আসিফ সাহেব আড়ালকে তার মা সুবর্ণার কথা বলতে শুরু করে,

‘আপনার মা চেয়েছিলো নিজে মুখে আপনাকে শোনাবেন তার সুখের গল্প। এবাড়িতে আসার পর সবাইকে নিয়ে আপনাকে একটা সুস্থ জীবন দেওয়ার বড্ড তাড়া ছিলো তার। জানেন, আপনার মা আর আমি ছিলাম জমজ ভাই-বোন। আমাদের সব ভাই-বোনদের মধ্যে আমার আর সুবর্ণার বন্ডিং ছিলো সব থেকে ভালো। আমরা দুজন আব্বা আম্মার প্রথম সন্তান ছিলাম। আমরা জমজ হলেও ওর থেকে আমি দশ মিনিটের বড় ছিলাম। কিন্তু ও সেটা কখনোই মানতে চাইতো না। বলতো আমি নাকি ইচ্ছে করে আগে আগে চলে এসেছি ওকে একা ফেলে। নয়তো ওই আগে আসতো আর বড় বোন হয়ে যেতো। আমার গাল দুটো টেনে আমাকে ছোট ভাই বলে ডাকতো। আমি ওকে বড্ড ভালোবাসতাম। ওর এই আফসোস আমার মোটেও মনে ধরতো না। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সবসময় আমি আর সুবর্ণা একে অপরকে নাম ধরে ও ‘তুই’ করে সম্বোধন করতাম। আমাদের দুজনকে আব্বা সিক্স এ ভর্তি করাতে নিয়ে গেলেন যেদিন, সেদিন থেকে আমি ওকে ‘আপনি’ করে বলা শুরু করি। আমাদের জন্মদিন ছিলো সেদিন। ও যে কি খুশি হয়েছিলো না। ওর খুশি দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। আজ ও ভুলিনি সেইদিন এর কথা। সেদিন এর পর থেকে ওকে কখনো তুই বা তুমি করে সম্বোধন করি নি। এমনকি আপনি সম্বোধন করা ভুলি নি বড় হয়েও। অন্যান্য ভাইবোনেরা আমাকে অনুসরণ করে ওকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করলে ও সুন্দর করে বুঝিয়ে মানা করে দিতো। ওটা নাকি শুধু আমার কন্ঠেই মানাতো। আপনাকে দেখলে আমার মনে হয় আমার সুবর্ণা দাড়িয়ে আছে আমার সামনে। তাই আপনাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করি। যতবার আমি আপনাকে আপনি সম্বোধন করি ততবার আমার বুকটা শীতল হয়ে যায়। আপনাকে বাঁচতে হবে আড়াল। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। আপনার মায়ের ইচ্ছের কথা ভেবে হলেও আপনাকে সুন্দর করে বাঁচতে হবে। আপনি ভেঙে পড়বেন না। আজ আপনি যা যা জানতে চাইবেন সব প্রশ্নের উত্তর দেবো আপনাকে। আপনি বলুন কি কি জানতে চান। আজকের পর আপনি আর কখনো এসব মনে করবেন না। আজকেই সব প্রশ্ন আর উত্তর এর পর্ব শেষ করে দিন। ওরা আপনার আপনজন ছিলো না কোনদিনই। ওদের দেওয়া ধোঁকা মনে রাখবেন না। কথা বলুন আড়াল। বলুন কি কি জানতে চান?’

আড়াল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর চোখের অশ্রু মুছে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,

‘ওদের সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানতে চাই না। যেটুকু জেনেছি সেটুকু সহ্য করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। আরও না জানি কত কি আমার জানার আড়ালে রয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সামলে নেবো নিজেকে। শুধু একটাই অনুরোধ। আমার মায়ের খুনিরা যেনো তাদের যোগ্য শাস্তিটা পায়। শুধু সেটুকুই আমি নিজের চোখে দেখতে চাই। অনুভব করতে চাই ওদের যন্ত্রণা আর অনুশোচনায় ধুঁকে ধুঁকে নেওয়া নিশ্বাস।’

শুদ্ধ ও আসিফ সাহেব নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না আড়ালের কথায়। মুখে যাই বলুক ভেতর থেকে সামলে নেওয়া যে অতো সহজ নয়। তবু মুখে যে বলেছে এই এখন ঢেড়। বাকিটা সময়ের সাথে পাল্টে যাবে। শুদ্ধ এগিয়ে এসে আড়ালকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘সবগুলো জা’নো’য়া’রের শাস্তি তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে আড়াল। খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারবে ওদের নিদারুণ কষ্টের নিষ্ঠুরতা। শুধু একটু অপেক্ষা করো আর ভরসা রাখো আমাদের ওপর।’

আলো বেগম নিজের ভেজা চোখ মুছে নিয়ে আড়ালের কপালে পরম যত্নে চুমু খান। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যান তড়িৎ গতিতে। এক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসেন হাতে এক গ্লাস উষ্ণ গরম দুধ নিয়ে। আড়ালের হাতে দিয়ে বলেন,

‘মারে ওরা দুজন এখনো কিচ্ছুটি খায়নি। রাত প্রায় অর্ধেক হতে চললো। তুই দুধটা খেয়ে নে। আমি ওদের খাবার দিচ্ছি।’

আড়াল দুধের গ্লাসটি হাতে নিলে আলো বেগম নিচে রাখা প্লেট দুটো নিয়ে ছুট লাগান রান্নাঘরে। যতটুকু মাছ, মাংস তরকারি ছিলো সবটাই এনেছিলো খাওয়াতে। এখন আর কিছুই নেই শুধু ভাত ছাড়া। শুধু অল্প একটু ডাল রয়ে গেছে। দুটো ডিম ভেজে ঝটপট ভাত নিয়ে আসেন দুজনের জন্য। এখনকার মতো এতেই হয়ে যাবে। বাপ ছেলের খাওয়া নিয়ে কোন ঝুট ঝামেলা নেই। যা দেওয়া হবে তা দিয়েই তৃপ্তি করে খেয়ে নেবে। শুধু বেশি তেল ঝাল না হলেই হলো। এদিকে আসিফ সাহেব বলে কয়ে আড়ালকে দিয়ে দুধের গ্লাসটি খালি করান।

দুজনের খাওয়া শেষ হলে আলো বেগম আড়ালের সাথে ঘুমোতে চলে যান আড়ালের রুমে। আড়ালের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন যতক্ষণ না তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু আড়ালের চোখে তো ঘুমেরা বাসা বাধছে না। ঠিক যেমন আপন মানুষগুলো সবাই একের পর এক রং পাল্টিয়ে ধোকা দিয়ে চলেছে ঘুমেরাও তেমন ধোকা দিয়ে সঙ্গ ছেড়ে দিলো বুঝি। চোখে ঘুমের বদলে জায়গা করে নিয়েছে মা বাবার একসঙ্গে র’ক্তা’ক্ত চেহারা, মায়ের শেষবার হাত ধরে বাবাকে ইশারা করে কিছু বলার চেষ্টা, চাচির প্রতিটা অন্যায়ের নিষ্ঠুর স্বীকারোক্তি, বাবার করা প্রতিটি অন্যায়ের অজানা রহস্য উন্মোচন, চাচার আচমকা বদলে গিয়ে হিংস্র রুপ ধারণ করে শুদ্ধের গলায় ছুড়ি ধরা আর তখনই শুদ্ধর ছুরিকাঘাতে চাচার কান ঝুলে পড়া। তারপর চারিদিকে শুধু র’ক্ত আর র’ক্ত। আড়াল চোখ মুখ খিঁচে আলো বেগমকে জাপটে ধরে বুকের ভেতর মুখ লুকায়। চোখের সামনে মায়ের হাসিমুখটা দেখার চেষ্টা করে। যাতে বুকের ঝড়টা শান্ত হয়।

সোহাগ এসেছে কিছুক্ষণ হলো। শুদ্ধ, সোহাগ ও আসিফ সাহেব গেস্ট রুমে বসেছেন। সামনে রয়েছে সুবর্ণার ঘরের দেয়াল ভেঙে বের করা দুই ব্যাগ ভর্তি কাগজপত্র ও কিছু দলিল। সেদিন ওই লোকগুলো পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে যার খোঁজ করছিলো তা হলো আড়ালের বাবার পাপের ধনদৌলত। তারা ভেবেছিলো হয়তো অনেক টাকা পয়সা লুকিয়ে রেখেছে সালাউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু সে যে কাঁচা কাজ করার মানুষ নয়। এতোবড় মাদক সিন্ডিকেটের মধ্যমনি হয়ে কাজ করেছে যেই মানুষটা সে কি আর কোটি কোটি টাকা তার বাড়িতে এমনি এমনি ফেলে রাখবে। ওরা কেউ ধারণাও করতে পারেনি সালাউদ্দিন এভাবে তার পাপের ধন সহিসালামতে দেয়াল বন্দী করে রাখবে।

সেদিন আড়ালকে শুদ্ধ ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ি নিয়ে রওনা হওয়ার পর আড়ালের চাচি আমিনা আর ওই চারজন অজ্ঞাত লোককে আসিফ সাহেব ও তার লোকজন মিলে ধরে নিয়ে আসার সময় আব্বাস নামের লোকটি আড়ালের মায়ের রুমে দৌড়ে ঢুকে পড়েছিলো। সেই লোকটাকে ধরার জন্য আসিফ সাহেব ধস্তাধস্তি করার সময় এক পাশের দেয়ালে ধাক্কা লেগে চির ধরে ধরে যায়। আসিফ সাহেব হাত দেওয়ার পর বুঝেছিলেন ভিতরে ফাঁকা। আর দেয়ালের ওই জায়গাটার রঙও পুরো ঘরের দেয়ালের রঙের তুলনায় একটু বেশি চকচকে আর নতুন মনে হচ্ছিল। আসিফ সাহেব তখনই শুদ্ধকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো বিষয়টি। শুদ্ধ আড়ালকে বাড়িতে রেখে আবারও ফেরত এসেছিলো সেখানে। আসার পর সেই দেয়াল ভেঙে কোন টাকা পয়সা নয় পাওয়া গেছে সতর্কতার সহিত প্যাকেট করে রাখা অনেকগুলো কাগজপত্র ও কিছু দলিল। সেইগুলোই এখন গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে সবার।

শুদ্ধ তার বাবা আর সোহাগকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে উকিল কাগজগুলো দেখে কি বলেছেন? আসিফ সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,

‘এই কাগজগুলো আড়ালের জন্য মৃত্যু ফাঁদ।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here