#অদ্ভুত_সেই_বাড়িটি_ শেষ পর্ব।
#মুসাফফা_মারহামা_মিম
প্রিয়া লাল রঙের লম্বা শাড়ি পড়ে বসে আছে।সাথে একটি দোপাট্টা।সকাল থেকে কোনো খাওয়া দাওয়া নেই।তার উপর মাথায় প্রচণ্ডরকমের যন্ত্রণা করছে।অসহ্যরকমের যন্ত্রণা। প্রিয়ার ইচ্ছে হলো অনেকটা সময় ধরে ঝর্ণার নিচে বসে থাকবে।সেথা থেকে ঠান্ডা পানি এসে সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদ ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে।কিন্তু নিজের বাড়ি হলে হয়তো এই ইচ্ছে পূরণ করা যেত।এটা তার শশুড় বাড়ি। রায়হানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে।আজ বাসরশয্যা। প্রিয়া বসা থেকে উঠে দাড়ালো। অমনি কারো হাটার শব্দ ভেসে আসলো।শব্দটি প্রিয়ার দরজার সামনে এসে থেমে গেলো।প্রিয়া আবারো খাটে বসে পড়লো। রায়হানের কন্ঠ শুনা যাচ্ছে।আমি কি রুমে প্রবেশ করতে পারি।
প্রিয়া চাপা গলায় বললো জী অবশ্যই। কিন্তু তার কণ্ঠধ্বনি সে নিজেই ভালো মত শুনতে পেলোনা।কিছুক্ষণ পর রায়হান আবারো বললো।আমি কি ঘরে প্রবেশ করতে পারি।
এটা বারবার জিজ্ঞাসা করার কি আছে? ঘরটাতো তারই। প্রিয়া ঈষৎ বিরক্ত হলো।কিন্তু সে জোড় গলায় আওয়াজ করতে পারলোনা।এখন একটাই উপায় নিজে দরজা খুলে দিয়ে রায়হানকে ঘরে প্রবেশ করানো।প্রিয়া উঠে গেলো এবং দরজা খুলে দিয়ে শিরনত করে দাঁড়িয়ে থাকলো।রায়হান কক্ষে প্রবেশ করেই অবাক গলায় বললো।এই আপনি কে বলুনতো?
প্রিয়ার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।লাইটের আলোয় মেয়েটাকে পরিস্ফুট দেখা যাচ্ছে। অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটি। রায়হান ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে আবারো বললো।আপনি কে বললেন নাতো?
প্রিয়া রায়হানের রসিকতা বুঝতে পারলো।ফজলুল সাহেব রায়হানের ব্যাপারে প্রিয়াকে জানানোর সময় বলেছিলেন ছেলেটা খুব দুষ্ট প্রকৃতির। তার পাশে কেউ মন খারাপ করে থাকতে পারেনা। প্রিয়া এইবার অবাক হলোনা।সে একটা ভেংচি কেঁটে আবারো খাটে যেয়ে বসে পড়লো। রায়হান প্রিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বললো।দেখুন আপনার পরিচয় টা দিন আমার মত বাচ্চা ছেলেটার ঘরে কোথেকে একটা মেয়ে এসে বসে পড়লো এটা কি মানা যায়।
আপনি বাচ্চা ছেলে?
হ্যাঁ তা নয়তো কি?মা আমাকে এখনো খাইয়ে দেয়।
আমি এই বাড়ির মালিকের ছেলের বউ।হয়েছে পরিচয় জানা। এবার যান।
কোথায় যাবো?
ঘুমাতে।
আমিতো এই খাটেই ঘুমাবো।
না এখানে না আপনি মেঝেতে ঘুমাবেন।
নিজের কক্ষ থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন আপনিতো ভেরি ডেঞ্জারাস মেয়ে।
হু সেটাই।
আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।তবুও মেঝেতে ঘুমাতে বলবেননা প্লিজ।
আচ্ছা তাহলে এবার লাইনে এসেছেন?
রায়হান সবগুলো দন্ত বের করে হাসলো।এবং ঠান্ডা গলায় বললো।আমি জানতাম আমি একাই দুষ্ট লোক।এখন দেখি তুমিও কোনো অংশে কম না প্রিয়া।
রায়হানের মুখে নিজের নাম শুনে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো বেচারি।
রায়হান আবারো বললো।যাও ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে।তিনি তোমার অতীত সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছেন। তুমি সময় নিতে পারো ।যেদিন নিজে থেকে অনুভব করবে আমাকে ভালোবাসো। সেদিনই আমি তোমাকে কাছে টেনে নিবো। অবশ্য আমার মত হ্যান্ডসাম ছেলে কে ভালো না বেসে কোনো উপায় আছে? প্রিয়া রায়হানের দিকে দৃষ্টি দিলো।ছেলেটা হাসছে।এ হাসিতে মোটেও চাটুকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা।প্রিয়া আর কিছুদিন সময় নিয়ে এরপর বিয়ে করতে চেয়েছিলো।কিন্তু তার বাবার অনুরোধ ছিলো। রায়হানকে যেন সে এখনই বিয়ে করে নেয়।রায়হান বেশ ভালো ছেলে।এমন ছেলেকে তিনি হারাতে চাননা। প্রিয়া এসব ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে চলে আসলো।ঝর্ণা ছেড়ে দিলো।যেন বৃষ্টি পড়ছে।আর সেই পানিতে সে নিজেকে ভিজিয়ে নিচ্ছে।অনেকটা সময় পর সে গোসলঘর থেকে বের হয়ে আসলো। রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। শিরের পার্শ্ববর্তী জানালাটি খোলা। সেথা থেকে শীতল কারক বাতাস কক্ষে প্রবেশ করছে। প্রিয়া রায়হানের পাশে গিয়ে বসলো।ছেলেটার মধ্যে একটা মায়া আছে।ঘুমন্ত মুখচ্ছবিও যেন অত্যাধিক মায়া মায়া লাগে।প্রিয়া বা হাতের কনুই খাটে ঠেকিয়ে তার উপর নিজের গাল রাখলো।বুঝাই যাচ্ছে সে খুব মনোযোগ সহকারে রায়হানকে দেখছে। ইচ্ছে হচ্ছে আঙুল দিয়ে দাড়ি গুলো ধরে দেখবে।মানুষটি ঘুমাচ্ছে টের পাবেনা। প্রিয়া তাই করলো।রায়হানের ঘুম ভেঙে গেলো। প্রিয়া অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। দ্রুত গতিতে দাঁড়িয়ে গেলো।রায়হান মৃদু স্বরে বললো।এখন তোমার জায়গায় আমি থাকলে ঠিকই আমাকে মারতে।
তবে আমি এমন না আমি এর বিপরীত টা করবো।
প্রিয়া বড় বড় চোখ করে রায়হানের দিকে তাকালো।ছেলেটা ওষ্টাধর ফাঁক না করেই হাঁসছে।মানে আবারো রসিকতা করার ইচ্ছে জেগেছে তার। প্রিয়া দু হাত দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বললো।
ঘুমের মাঝখানেও আপনার দুষ্টুমি করতে মনে চায়?
ঘুমের মাঝখানে কই করলাম।তুমি আমাকে জাগিয়ে দিয়েছো তাই এখন একটু করছি।
আমি জাগিয়ে দিলেই আপনি জেগে যাবেন ?
আরে বাবাহ এখন আমার দোষ হয়ে গেলো সব।অথচ তুমি যে আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালে?
৫০০ বার ঘটাবো তবুও আপনি উঠবেননা।
আচ্ছা আমাকে মাফ করো।আমি ঘুমাচ্ছি।রায়হান একটি কোলবালিশ মাঝখানে রেখে আবারো শুয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়াও শুয়ে পড়লো ।বালিশে মাথা ঠেকাতেই মনে হলো একটি কাগজ। ভাজ করে রাখা ।প্রিয়া কাগজটি খুললো।
সেখানে বড় বড় অক্ষরে লিখা তুমি অতিশয় সুন্দরী এক রমনী প্রিয়া।
প্রিয়া হাসলো।মুচকি হাসলো।রায়হানের দিকে তাকালো।সে ঘুমাচ্ছে।প্রিয়া তাকে জাগালোনা।সেও পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
সাদিয়াদের বাড়ি থেকে জানানো হয়েছে তারা এনগেজড করতে চায়না।একেবারে বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চায়।সাদমানের পা ঠিক হলে না হয় সাদিয়া ওই বাড়িতে যাবে। সাদমানের বাবা মা সাদিয়ার বাবার সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। কিছুক্ষণ পরেই সাদমানরা সাদিয়াদের বাড়িতে আসবে। সাদিয়া নিজেকে তৈরি করছে।সানজানা,রিফা,ফিজা,রাজিয়ারা এসেছে।ফিজা আপাতত সাদিয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর সাদমানদের গাড়ি সাদিয়াদের বাড়ির সম্মুখে এসে থামলো।সাদিয়ার বুকে কম্পন শুরু হলো। সানজানা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বললো।এই ওকে দ্রুত সাজা।বর তো চলে এসেছে। সাদমানের সাথে তার মা বাবা,ভাই, বোন এসেছে। প্রথমত তাদের সম্মুখে হরেক রকম খাবার রাখা হলো। সাদমান খাবার মুখে দিতে পারলোনা। তার কাছে অস্থির অস্থির লাগছে।নিরুদ্বেগ ভাব নিজের মধ্যে আনাটা কঠোর মনে হচ্ছে।কাজী সাহেব চলে এসেছেন।সাদিয়ার বাবা আগে মেয়েকে দেখে নেওয়ার ব্যাপারে সাদমানের কাছে সুপারিশ করলেন।সাদমান জানালো।বিয়ে সাদিয়াকেই করতে চাই।তাই সে বাহ্যিক ভাবে যেমনই হোক আমার কোনো সমস্যা নেই।কাজী সাহেব বিয়ে পড়িয়ে ফেলেছেন।মসজিদের মিনার থেকে মাগরিবের আজানের সুমধুর সুর ভেসে আসছে।যেহেতু সাদমান মসজিদে যেতে পারবেনা তাই বাড়িতেই পুরুষরা মিলে জামাতে নামাজ শেষ করেছে।কিছুক্ষণ পর হুইলচেয়ারে করে সাদমানকে সাদিয়ার কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।সাদিয়া বেলকনির দরজার সম্মুখে দণ্ডায়মান। সাদমানের দেওয়া সেই লাল শাড়িটি পড়েছে সে।দেখে মনে হচ্ছে এ মেয়ে কোনো রুপ নগরের রূপবতী। সাদমান অনেকটা সময় অনিমিখে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।অদ্ভুত সেই বাড়িটির কথা মনে হতেই তার চোখ ভিজে উঠলো।সাদিয়া ধীরগতিতে সাদমানের দিকে এগিয়ে আসলো।
কি হয়েছে কান্না করছেন কেন?
না তেমন কিছুনা।আমাকে কখনো ছেড়ে যেওনা।
কখনো যাবোনা কথা দিচ্ছি।
তোমাকে লাল শাড়িতে বেশ মানিয়েছে।
লাল রঙ আমার কাছে কখনোই অনেক পছন্দনীয় ছিলোনা।কিন্তু এখন ভালো লাগে।খুব বেশি ভালো লাগে।আমার পছন্দের রঙ হয়ে গেছে এটা।
আমি দিয়েছি কিভাবে বুঝেছো?
সাদিয়া হাঁটুভাজ করে সাদমানের সম্মুখে বসে পড়লো।এবং তার হাতে হাত রেখে বললো।আপনার মন পড়ে বুঝেছি।
একটা মানুষ এতটা সুন্দরী হতে পারে তোমাকে না দেখলে বুঝতে পারতামনা।
আচ্ছা তাই বুঝি।
হুম।
আকাশ আজ খুব পরিস্কার। চাঁদমামাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। দেখতে চান?
হুঁ
সাদিয়া হুইল চেয়ারের পশ্চাতে ধরে সাদমান কে বেলকনিতে নিয়ে আসলো।বেলকনির এক পাশে গোলাপ ফুলের দুটি টব। দুটো গাছ মিলে ৫ টা ফুল ফুটেছে। সাদমান আর সাদিয়া কিছুক্ষণ আকাশ দেখে সেখানেই বসে থাকলো।
সাদমান একটি গোলাপ ফুল ছিড়ে সাদিয়ার কর্ণে গুজে দিলো।সাদিয়ার শুভ্র গণ্ডদেশে লাজুক ভাব প্রকাশ পেলো।সে শিরনত করে ফেললো।
সাদমান হালকা গলায় বললো।
সাদিয়া হুমাইরা নামটা কেমন?
সুন্দর।
আমার নেক্সট উপন্যাসে আমার নাম দিবো।হুমায়রার বাবা নামে।এবং এই নামেই সবাই আমাকে চিনবে।ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না?
হ্যাঁ অনেক ইন্টারেস্টিং।
আচ্ছা বলোতো হুমায়রা কে?
সাদিয়া ক্ষীণ হেসে বললো।বলতে পারছিনা লজ্জা লাগছে আমার।
হা হা হা তুমি তো বেশ লাজুক।ভালো ভালো লজ্জা নারীর ভূষণ । এটা থাকা ভালো।
৫ বছর পরের কথা।প্রিয়া তার স্বামী সংসার নিয়ে বেশ খুশি।সাদিয়াও ঠিক তাই।এই চার জন মানুষকে যেন আল্লাহ শান্তি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন।শুধু চারজন বললে ভুল হবে।কারন প্রিয়ার দুটো সন্তান হয়েছে।এক ছেলে এক মেয়ে।আর সাদিয়ার ৩ টা।প্রথম দুইটি সন্তান জমজ।এরপর একটা ছেলে হয়েছে।সাদমানকে এখন সবাই চিনে হুমায়রার বাবা হিসেবে।সে আবারো কলম ধরেছে।এবং খুব সাফল্যও অর্জন করেছে।সাদমান মানুষটি কে? এ সম্পর্কে কারো ধারণা নেই।তবুও সাদমান লিখে। এবং শান্তি খুজে নেয়।আল্লাহ তায়ালা প্রিয়া এবং সাদিয়া দুজনকেই সুখি করেছেন।কিন্তু সেটা আল্লাহর ইচ্ছা মত।
সমাপ্ত