প্রজাপতি মন (পর্ব:7)

0
1912

#প্রজাপতি মন (পর্ব:7)
♡আরশিয়া জান্নাত

“আমি তোকে বলেছিলাম মনে আছে? বডিগার্ড ছবিটাতে যেমন করে কারিনা ছদ্মবেশে কথা বলতো তুইও কি তিতলি সেজে কথা বলছিস কি না। আমি তোর অজান্তে অনেকবার পরীক্ষাও করছিলাম জানিস? কিন্তু কিছুতেই হিসাব মিলেনি। আজ বুঝলাম কেন মিলেনি! এই সব কিছুর পিছনে আসলে তুই ছিলি। তোর কাজিনকে দিয়ে এই নাটক সাজালি তাই না। কেন আমার ইমোশন নিয়ে এভাবে খেললি আনহা? তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড? তুই কিভাবে পারলি এসব করতে?”

“দেখ তুই যা ভাবছিস তা না। আবার আমি তোকে ক্লিয়ারলি বোঝাতেও পারবোনা ঘটনা কি। শুধু এইটুকু বলবো আমার খারাপ ইনটেনশন ছিল না। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুই খারাপ সঙ্গ বাদ দিয়ে ভালো হয়ে থাক।”

“ক্ল্যাপ হবে! মহীয়সী নারী আনহা। যে তার বখে যাওয়া বেস্টফ্রেন্ডকে ভালো করতে কত সুন্দর ইমোশনাল একটা নাটক সাজালো! ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়ে মরেও গেল। ইশ আজ যদি মরা তিতলিকে না দেখতাম আমি আজীবন এটাই ভাবতাম তিতলি নামের অসম্ভব মিষ্টি একটা মেয়ে মারা গেছে।”

শোন হাসিব তুই এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নাই। একটু সময় দে আমি তোকে সবটা গুছিয়ে বলবো।

হ্যাঁ আবার মিথ্যা গল্প সাজাতে সময় দিবো। তুই আবার কথা গোছাতে এক্সপার্ট ঠিকই নয়ছয় বুঝিয়ে দিবি। ওকে এতোদিন যেমন মিথ্যা শুনে শুনে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছি এখনো বল আমি শুনি। দেখি কতোটা স্যাটিসফাই করতে পারিস।

দোস্ত এভাবে বলিস না। বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে কিচ্ছু করিনাই

যা করেছিস করেছিস। এখন তিতলিকে বল আমি ওকে বিয়ে করবো। আজই করবো। আমার অনুভূতি তো নাটক না আমি ওকে ভালোবাসি ওকেই বিয়ে করবো।

এটা সম্ভব না হাসিব। ও তোর বড় তাছাড়া তামান্না আপুর আকদ হয়ে গেছে অনেক আগেই। দুলাভাই বিদেশ থেকে আসলেই অনুষ্ঠান হবে।

হাসিব এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে বললো, আমি না বুঝতে পারছিনা কিভাবে রিয়েক্ট করবো। রাগ করবো নাকি হাসবো!

আনহা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হাসিব ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, এইসব নাটকের দরকার ছিল না আনু। তিতলি না আসলে হয়তো আমি তোকেই ভালোবাসতাম। একবার ভালোবেসে বললেই পারতি আমি সব ছেড়ে দিতাম। কেন অন্য একটা চরিত্র আনলি আনহা! তোকে আমি ঘৃণা করি। প্রচুর ঘৃণা। আজকের পর থেকে আমি ভুলে যাবো আনহা নামের কোনো মেয়েকে আমি চিনি।

না চাইতেও সব দোষ আনহার কাঁধেই এসে পড়লো। নিশিথার পুতুলনাচের ঘানি তাকে বন্ধুত্বের বলি দিয়ে টানতে হলো!

তুই হ্যাপি তো আপু? তোর জন্য শুধুমাত্র তোর জন্য হাসিব আমাকে ভুল বুঝলো। তুই ফোনে যা করেছিলি তা মানা গেলেও মিট করানোটা তোর সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তুই কেন তামান্না আপুকে তিতলি সাজিয়ে দেখা করাতে গেলি?

তুই গাধি কম না আনহা! তুই স্বীকার করতে গেলি কেন? তুই তিতলি কে দেখেছিলি? তুই বললেই পারতি এসবকিছুই তুই জানিস না! তাছাড়া ওর কাছে সলিড প্রমাণ নাই তামান্নাই তিতলি। তুই আমার সাথে শলাপরামর্শ না করে আগ বাড়িয়ে কেন কথা বলতে গেলি?

বাহ নাইস! আমিতো তোর মতো পাকা মিথ্যেবাদী না, না আমার এমন উপস্থিত মিথ্যে কাহিনী আটবার ট্যালেন্ট আছে। তুই দেখিসনি আপু হাসিবকে আমি কিভাবে সামলেছি। ও কতোটা ভেঙে পড়েছিল। আমার এমনিতেই এই বিষয়ে আত্মগ্লানী আছে।

সেটা তোর উইকনেস! এখানে আমি পুরোটা খুব সহজেই হ্যান্ডেল করতে পারতাম যদি না তুই স্বীকার করতি। যাই হোক এসব কোনো ব্যাপারই না আমি হাসিবকে কল করে সবটা ম্যানেজ করবো ডোন্ট ওরি।

তুই ফের কল করবি ওকে! তুই কেমন আপু?

আমি জানি আমাকে তোর সবচেয়ে নির্দয় মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখিস এই পৃথিবীতে কেউ তোকে ঠিক ততোদিন নত করতে পারবেনা যতোদিন না তুই নিজে নত হবি! একবার নত হওয়া মানেই সব শেষ।

নিশিথা ড্রয়ার থেকে সিম বের করে ফোনে ইন করলো। তারপর হাসিবকে কল দিলো। কিন্তু হাসিব কল রিসিভ করলো না।


নিশিথার জন্য খুব ভালো একটা বিয়ের সমন্ধ এসেছে। ছেলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরই, তার বাবা সাবেক পুলিশ কমিশনার। তারা নিশিথাকে বহুদিন ধরেই অবজার্ভেশন করেই এই আলাপ পাঠিয়েছে। এমন রেপুটেটেড ফ্যামিলি দেখে নাফিজ সাহেব আর দ্বিমত করলেন না। তাদেরকে সরাসরি বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। নিশিথাও স্বাভাবিকভাবেই নিজেই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে যায়। এমনকি পাত্রের সঙ্গে আলাদা করে কথাও বলেছে। তারা দিনক্ষণ ঠিক করে আংটি পড়িয়ে চলে গেলেন। নিশিথাও না বোধক কিছুই বললো না।
ঘটনা ঘটলো তার দুইদিন পর।
হুট করে নিশিথা নিখোঁজ। কোথাও তাঁর খবর নেই। সারা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও নিশিথাকে পাওয়া গেল না। একটা মেয়ে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে একদম ভ্যানিশড হয়ে গেল এ ব্যাপারটা কিছুতেই কেউ হজম করতে পারলো না। টেনশনে নাফিজ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আশেপাশের থানাতেও তার ছবি পাঠানো হলো। আনহা একটা সেশনের জন্য ঢাকায় ছিল তিনদিন পর ফিরে এসে যখন শুনলো বোনকে পাওয়া যাচ্ছেনা ও দৌড়ে রুমে গিয়ে আলমারি খুললো। অবিশ্বাস্যভাবে দেখলো আলমারিতে নিশিথার কোনো কিছু নেই,,,

আনু,
আমি জানি আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে তোরা কেউই আমাকে ক্ষমা করবি না। কিন্তু আসলে আমার পক্ষে সম্ভব না ইমরানকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে জীবন কাটানো। ইমরানের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে বেশ কয়েকমাস আগে। তোকে বলিনি ওর সাথে আমি বেশ কয়েকবার দেখাও করেছি। ও খুব ভালো ছেলে। সত্যি বলতে আমি ওর ব্যবহারে মুগ্ধ ছিলাম। আমি জানি বাবাকে যদি বলতাম আমি একজনকে ভালোবাসি তিনি হয়তো আমার মুখের দিকে চেয়ে রাজী হতেন। কিন্তু এখন সেটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন প্রপোজালের সামনে ইমরানের ব্যাকগ্রাউন্ড খুবই সামান্য। তাছাড়া ও এখনো পড়াশোনাতে আছে। তাই আমি আর রিস্ক নেই নি। তুই জানিস তোর বোন খুব স্বার্থপর।
আব্বু আম্মুকে সামলে নিস। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে আমি আসবো।”

সেদিনের ঘটনা জানার পর নাফিজ সাহেব একদম বদলে গেলেন। তার দুই মেয়ে, বড় আদরের দুই মেয়ে। তাদের নিয়ে তার গর্বের অন্ত ছিল না। বিশেষ করে নিশিথা। নিশিথাকে তিনি অসম্ভব স্নেহ করতেন, সেই মেয়ে যখন মুখে চুনকালি ঘষে দিয়ে চলে গেছে আনহা আর বিশেষ কি? তাই তিনি আনহার বেলা কঠোরতা অবলম্বন করলেন। ওর ফোনে কল রেকর্ডিং অন করে দিলেন। রোজ দুইবার তার কললিস্ট চেক করা হয়। বাইরে যাওয়ার সময় একজন কনস্টেবল সবসময় তার আশেপাশে থাকে। বড়বোনের পালিয়ে যাওয়া যে ছোটবোনের জীবনে কতোটা খারাপ প্রভাব ফেলে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেনা। আনহার জীবন হয়ে গেল বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দী আসামির মতো। নিশিথা! এমন একটা মানুষ যার প্রজাপতির মতো উড়ুক্কু মনের জন্য আনহা তার বহুবছরের বন্ধুত্ব হারিয়েছে, পাড়াপ্রতিবেশীর কটু কথা হজম করেছে। বাবা-মায়ের চোখে সন্দেহের পাত্রী হয়েছে। অথচ যে দোষী সে ঠিকই সুখেশান্তিতে সংসার করে যাচ্ছে!

রাতে খাওয়ার পর নাফিজ সাহেব তার স্ত্রীকে বললেন, ভাবছি আনহাকে বিয়ে দিয়ে দিবো। বাকি পড়াশোনা ও বিয়ের পর করবে।

এক মেয়ের অন্যায়ের শাস্তি আরেক মেয়েকে দিচ্ছো? তোমার বড় মেয়ের মতো ছোটটা না। ও পড়াশোনার বাইরে কোনোকিছুতেই নাই। অযথা সন্দেহ করিও না ওকে পড়তে দাও।

আমার অফিসে এখন মুখ দেখাতে লজ্জা করে জানো? যে মেয়ের জন্য আমাকে সবাই বাহবা দিয়েছিল সেই মেয়ের জন্য এখন….. আমি যে কিভাবে বেঁচে আছি তুমি বুঝবেনা। আমি আর রিস্ক নিবো না। মেয়েরা পরের বাড়ির সম্পদ, এদের যতোই আদর যত্নে রাখোনা কেন এরা কখনোই আপন হবেনা। তোমার কথায় যদি আরো আগেই ওর বিয়ে দিতাম আজ আমাকে এই দিন দেখতে হতো না। তাই আনহার বিয়েতে আমি আর বিলম্ব করবো না।

কার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছো ওকে?

এমন কেউ যাকে আমরা চিনি, যে পরিবারে আনহা সুখে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

কে?

কাল আসলেই দেখবা।

আনিসা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললেন, কেন যে তুই এমন করলি নিশি তোর জন্য আনহার না কপাল পুড়ে!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here