একগুচ্ছ_কালো_গোলাপ?পর্ব_৫৩
#লাবিবা_তানহা_লিজা
?
ভোরের দিকে ঘুম ভাঙে লাবিবার । উঠে বিছানায় তানভীরকে না দেখে জানালা দিয়ে উকি দিয়ে মন খারাপ করে ফেলে । এতো সকালে উঠেও দেখা পায় না মানুষটার । ফোন খুজে হাতে নিয়ে লক খুলে দেখে নয়টা এগার এ.ম. টাইম । সময় দেখে নিজের কপালে নিজের চড়াতে ইচ্ছা করে । এই গরমকালেও শীতকালের মতো আবহাওয়া হওয়ায় একদমি বেলা বুঝা যায় না । ঘুম তো ভাঙেই না । ভাগ্যিস ভালো একটা শ্বশুর বাড়ি পেয়েছিলো নয়তো জীবন হয়ে যেতো তেনা তেনা । শুধু কি ভালো শ্বশুর বাড়ি ? কিছুক্ষন চুপ থেকে জোর গলায় বলে উঠলো –হাব্বিটাও অনেক ভালো । বকে ঠিক আছে । বকা খাওয়ার মতো কাজ করলে তো বকবেই । কিন্তু আফসোস একটা সকালেও জনাবের মুখটা দেখতে পারি না । ঘুম কমাতে হবে । এতো কেনো ঘুমাই আমি ?
ওদিকে তানভীর আছে নুপুরের বাসায়। সাথে রাজিব আখি মুইন ও তার ফেমেলি সবাই । আনিস মানতে নারাজ এই প্রস্তাব । যেখানে তার বড় জামাই কোটিপতি সেখানে মধ্যবিত্ত পরিবারে ছোট মেয়ের বিবাহ কিভাবে দিবে সে ? বড় মেয়ের তুলনায় ছোট মেয়েই বা কম কিসে ? শুশীল মোলিয়েম ঔ চাঁদবদন চেহারা দেখে বলিউডের হিরোও তাকিয়ে থাকবে আনিসের ধারনা । সেখানে এই পাত্র কোম্পানি চাকুরিজীবি যেখানে বড় জামাই বেশকয়েক কোম্পানির মালিক । বেশ কয়েকদিন ধরেই ঘটক সহ মুইনের ফেমেলি উঠে পড়ে লেগেছে । সাথে রাজিব ও মত দিয়ে দিয়েছে । তানভীর বড় মুখ করে এই প্রস্তাব এনেছে । এদিকে নুপুরের সাথে কথা বলেও জেনে নেয় এই বিয়েতে তার আপত্তি নেই । সব দিক বিবেচনা করে আনিস একবার ভাবে বিয়েতে রাজি হবে আবার আরেকবার ভাবে না এর থেকে ভালো জামাই সে ডিজার্ব করে । এদিক ওদিক করতে করতে বড় চাপ পরে যায় । ফাইনালি কাল রাতে রাজিবকে একবার বলেছে সে রাজি । কিন্তু সকালেই মত পাল্টে দেয় । রাজিব তানভীরকে ডেকে এনে অনেক বুঝানোর পর আবার রাজি করাতে সক্ষম হয় । সাথে সাথেই মুইনের ফ্যামিলিকে আসতে বলা হয় । মুইনের ফ্যমিলিকে দেখে আনিসের আবার মত অমতে পরিণত হওয়া ভাব ফুটে উঠে । যে কোন মুহুর্তে না না করে বসে । তানভীর কাজীর কাছে ফোন দিয়ে আসতে বলে । সবার আগে কাবিনটা সেরে নেওয়া উচিত ।
রাতে বাবার হ্যা শব্দ শুনে নুপুর যে পরিমান খুশি হয়েছিলো সকালে না শব্দ শুনে সেই পরিমান ভেঙে পড়ে । বুক চিরে কান্না চলে আসে কিন্তু এই কান্না কাউকে দেখাতে পারে না । বুক চিরে কান্নাটা মা বাবার সামনে এলেই সব শেষ হয়ে যাবে যে টুকুনি আশা বেচে আছে । সকালে রাজিব তানভীরকে দেখে অসহায় চোখে নিজের অবস্থাটার জানান দিয়েছে । সেই অবস্থা বুঝতে ন্যানো সেকেন্ড ও লাগে নি রাজিব তানভীরের । কারন তারা দুজনেই সেইম পরিস্থিতি ভোগ করে এসেছে । ভালবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার ভয় যে কতোটা মারাত্মক তা হয়তো প্রত্যেক প্রেমিক প্রেমিকার ই বোধ রয়েছে ।
পাকা কথা বলতে এসেছে মুইনের পরিবার সাথে মুইন ও । সেই অনুযায়ী মেয়েকে আংটি তো পরিয়েই যাবে । ঘরে বসে রেডি হচ্ছিলো নুপুর । আখি সাজিয়ে দিচ্ছে নুপুরকে । টেনশনে বিভোর শুকনো মুখটা দেখে একদমি ভালো লাগছে না আখির । কিছুক্ষন পর পর বুক কেপে উঠছে নুপুরের । ভেতরের চাপা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে । শেষ মেষ না পেরে দু ফোটা চোখের জল বের করে বলে –আপু..মুইনকে না বিয়ে করতে পারলে আমাকে অন্য কোথাও রেখে আসিস যেখানে আমি ভালো থাকবো । কেউ আমাকে বিয়ে করার জন্য বলতে পারবে না ,কেউ বলবেনা মেয়েটা অবিবাহিত, কেউ বলবেনা বয়স হয়ে গেছে অথচ বিয়ে করেনি অপয়া মেয়ে কথাকার ।
আখি মুখ চেপে ধরে ধমক দিয়ে বলে –চুপ থাক তুই । এতো কিসের টেনশন তোর ? তোর স্যার , ভাইয়া আছে না ? সব ম্যানেজ করে নিবে । আপাদতো মুখটা হাসি হাসি রাখ আর ভাব কিভাবে তোকে সুন্দর দেখাবে । এই প্যাচামুখ নিয়ে তোর শ্বশুর বাড়ির লোকের সামনে গেলে অপছন্দ করে দেখবি ওরাই বিয়ে ভেঙে চলে যাবে । কথাটা শুনে নুপুর স্বাভাবিক হবার ট্রাই করে । দরজায় টোকা পড়তেই দেখে তানভীর দাড়িয়ে । ভেতরে আসতে আসতে বলে –সাঝগোজ শেষ ? এটা কি পড়েছো ? থ্রি পিচ কেনো ? এই প্যাকেটে যা আছে পড়ে নাও । মুইন দিয়েছে ।
নুপুর প্যাকেট হাতে নিয়ে খুলে দেখে ভিতরে একটি শাড়ি আর একটি দোপাট্টা । একটা গহনার বক্স ও আছে । খুলে দেখে একটা সোনার নেকলেজ আর একজোড়া ঝুমকো । নুপুর তানভীরের দিকে তাকাতেই তানভীর বলে –পাকা দেখাতে এর থেকে বেশি কিছু সম্ভব নয় । একটু বেশি হলেই তোমার আব্বু রেগে যাবে । তা কেমন ফিলিংস হচ্ছে নুপুর ?
–অনেক ভয় হচ্ছে । আব্বু যদি আবার না করে দেয় ?
— হা হা হা । বোকা মেয়ে । এখনো সেই হ্যা না তেই পড়ে আছো ? আজ তোমার পাকা দেখা নয় নুপুর । আজ তোমার রেজিট্রি হতে যাচ্ছে । এককথায় বিয়ে হতে যাচ্ছে । ফিলিংসটা সেই দিকেই ঘুরিয়ে নাও ।
নুপুরের চোখ জলে টলমল করে উঠে । ঠোটের কোনে হাসির রেখা খেলে । অবিশ্বাসের স্বরে বলে –সত্যি?
তানভীরের হাসি দেখে সিউর হয়ে বলে –আপনি আমার ভাই হলে একটু জড়িয়ে ধরতাম । এখনো ধরতে পারতাম । কিন্তু ধরবোনা । আপনার মালকিং এর পারমিশন নেই ।
–এই বুদ্ধিটা কিন্তু আমার সেই বোকা সোকা দুষ্টু পুতুল বউটাই দিয়েছে ।
–কোথায় ও ? আসেনি কেনো এখনো ? ফোন দেই ?
–তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই আছে ।
নুপুর ফোন দিতেই লাবিবা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই নুপুর বলে –জানু এখনো আসিস নি কেনো ? রেড়ি হয়ে এক্ষুনি বের হ । তারাতারি চলে আয় আমার বাসায় ।
— আধা ঘন্টা দুই মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড থেকে তোর বাসাতেই আমি ।
–আমার রুমে এলি না কেনো ?
–আমি এখন কিচেনে । আন্টি গুড়ো দুধ দিয়ে চমচম বানাতে দিয়েছে আমাকে ।
–হারামি দারা আসতেছি আমি । আমাকে ছাড়াই একা একা খাচ্ছিস ?।
–তুই বিয়ের কনে । তোর এসব খাওয়া যাবে না । ড্রেস নষ্ট করে ফেলবি । ফোন রাখ । আই এম বিজি টু ইটিং গুড়ো দুধ ।
–ধরা পড়বি তুই দেখিস । বদদোয়া দিলাম আমি । আম্মু অনেক হিসাবি মানুষ । চমচম কম পড়লে ধরা খাবি ।
–নো চান্স । আন্টি ক্যান দিয়েছে একটা আমি আরেকটা পেড়ে নিয়েছি ।
নুপুর ফোন রেখে তানভীরের দিক তাকিয়ে বলে –আপনার পুতুল বউ আস্ত একটা বিড়াল ।
তানভীর হেসে চলে যেতেই নুপুর রেড়ি হতে থাকে ।
লাবিবার রান্নার কাজে হেল্প করা শেষ হলে নুপুরের রুমে এসে নুপুরকে আপাদমস্তক দেখে নেয় একবার । গোলাপী শাড়ি কুচি করে পড়া , কানে গলায় সোনার গহনা , হাত ভর্তি চুড়ি , কালজ কালো চোখ , পিঠে ছাড়া চুল সব মিলিয়ে অমাইক লাগছে । নুপুর লাবিবাকে দেখেই জানু বলে জড়িয়ে ধরতে যায় । লাবিবা এক লাফে পিছিয়ে পড়ে । শাড়ি ধরে বলে –দেখেছিস কতো নোংরা ? দেখে নে । না দেখেইতো বুকাবুকি করতে যাচ্ছিলি ।
–এগুলো তো গুড়া দুধ ?।
–কেউ শুনে ফেলবে চুপ থাক । গোছল করে আসছি আমি । লাবিবা ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে বাথরুমে চলে যায় । ফিরে এসে শাড়িটা ঠিকঠাক করে হালকা সাজে । এরপর নুপুরের সামনে এসে বলে –জানু আয় বুকাবুকি করি । দুজন দুজনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে । এমনভাবে ধরে যেন একজন আরেকজনের মধ্যে ঢুকে পড়বে । মিনিটের পর মিনিট চলে যায় তাদের ছাড়াছাড়ির না নেই । মাঝখানে রাজিব নুপুরকে ডাকতে এসে বসে বসে এদেরকেই দেখছে । ছাড়ার নাম নেই দেখে বলে উঠে –তোদের হাগাহাগি শেষ হলে এবার কি রুম থেকে বের হতে পারবি ? নুপুর লাবিবা ছেড়ে দাড়ায় । রাজিব আয় বলে চলে যায় । লাবিবা ব্যাগ থেকে একজোড়া বালা বের করে নুপুরের হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলে –তোর বিয়ের গিফট ।
ড্রয়িং রুমে তুমুল কথা কাটা কাটি হচ্ছে । আনিসুর কিছুতেই মানবেনা এটা । বড় মেয়ের বিয়ে চুপিচুপি হয়েছে দেখে ছোট মেয়েঋ বিয়েও এইভাবে চুপি চুপিই হবে নাকি । অসম্ভব । ইতিমধ্যে কয়েকজন আত্মীয় ও চলে এসেছে । আখি খবর দিয়েছে সবাইকে । ইসমাইল ও এসেছে । তারপর সবাই মিলে বুঝালো আনিসকে ।এখন শুধু কাবিনটাই হচ্ছে আর তো কিছু হচ্ছে না । তার পর না হয় বড় করে অনুষ্টান করে মেয়ে তুলে দেওয়া যাবে । মেয়েতো নিয়ে যাচ্ছে না শুধু রেজিস্ট্রি করিয়ে এখানেই রেখে যাবে । তারপর দু পরিবার মিলে একজোত হয়ে দিন তারিখ ঠিক করে ঘটা করে বিয়ে দেওয়া যাবে । দরজায় দাড়িয়ে নুপুর সব শুনছিলো । অবশেষে আনিস রাজি হলে নুপুরকে ভিতরে এনে বসানো হয় সোফায় মুইনের পাশে । লাবিবা দৌড়ে রুম থেকে দোপাট্টা টি এনে নুপুরের মাথায় দিয়ে দেয় । রেজিস্ট্রি সহ কাজী বিয়েটাও পরিয়ে দেয় । পুরোপুরি স্বামী স্ত্রী তারা এখন । সবার বুকের উপর দিয়ে বয়ে চলা ঝড়টা ধপ করে শেষ হয়ে গেলো । মুইনের পরিবার নতুন বউকে বাড়ি নিয়ে যিওয়ার কথাটা তুলার সাহস মাত্র পেলেন না । কিন্তু মনে মনে খুব করে চাইলেন । মুইন কি পারবে একমুহুর্ত এবার নুপুরকে ছেড়ে থাকতে ? ভেবেই কেপে উঠে মুইন । এতোদিন তো নিজেকে মানানো গেছে নুপুর তার নয় বলে বলে । কিন্তু এখন যে নুপুর তার । নিজের জিনিসটাকে কিভাবে ফেলে থাকবে সে ? নুপুরের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত দিয়ে একমনে এটিই ভাবছে সে । অবশেষে যাওয়ার আগ মুহুর্তে তানভীর আনিসের কাছে একটা প্রস্তাব রাখে –আংকেল একটি অবদার ছিলো । ওরা দুজন কি একটু একান্তে কয়েকমিনিট কথা বলতে পারবে যদি অনুমতি দেন ।
আনিস আর কি অনুমতি দিবে । মেয়ের সাথে মেয়ের জামাই কথা বলবে এখানে তার অনুমতির প্রয়োজন নেই বললেই চলে । এখন তাদের বিয়ে হয়ে গেছে । জামাই যদি থাকতে চায় তাতেও খুশি আনিস ।
–নুপুরের রুমে নিয়ে যাও । বলে বেয়াই বেইনির সাথে কথা বলতে লাগলো । তানভীর রুমের সামনে মুইনকে এনে রেখে চলে যায় । মুইন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে নুপুর খাটের উপর বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখছে । মুইনকে দেখে উঠে দাড়িয়ে পরে । মুইন এগিয়ে এসে সামনে দাড়ায় নুপুরের । নুপুর নিচের দিকে তাকিয়ে ফ্লোরের টাইলস দেখছে । দুই পকেটে হাত দিয়ে গোটা কয়েকটা কালো গোলাপ বের করে একসাথে করে নুপুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে ডাকে –“বউ”।
চমকে তাকায় নুপুর । গোলাপগুলো নুপুরের হাতে গুজে দিয়ে বলে –একগুচ্ছ কালো গোলাপের অভিনন্দন তোমাকে আমার জীবনে আসার জন্য । অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে । শাড়ী গহনাটা আমিই কিনেছি । পছন্দ হয়েছে তোমার ?
– “হু”।
–ধন্যবাদ আমার __
–পেটের কোমড়ের মাথার নুপুর তাইতো ?
স্মিত হেসে একটা হাত টেনে বুকের উপর চেপে ধরে বলে — উহু..। ধন্যবাদ আমার ভালোবাসার বুকের নুপুর ।
To be continue_____
®লাবিবা___?