গল্পঃ কেউ কথা রাখেনি
পর্বঃ ০৪
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
আরাফ বিদেশে চলে যাওয়ার দশদিন পরে আমার কোল জুড়ে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান এলো। কয়েকদিনের জন্য মেয়েকে দেখতে পারল না আরাফ, ভাবতেই অনেক খারাপ লাগলো। আরাফ ভিডিওকলে মেয়েকে দেখে মেয়ের নাম রাখল “আফরিন”।
নতুন অতিথির আগমনে আমাদের দুই বাড়িতেই আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। মেয়ে হওয়ার একমাস পরেই আমার শ্বাশুড়ি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন।
শ্বাশুড়ি আম্মার আচরণ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
আগের মতো এতো বকাঝকা কিংবা কথায় কথায় খোঁটা দেয় না। তবে এ বাড়িতে আসার পর থেকে আরাফের জন্য মনটা অনেক কাঁদে। যদিও প্রতিদিন ভিডিওকলে ওর সাথে
আমার কথা হয়, তবুও মনের কোণে শূন্যতা অনুভব
করি।
.
এসএসসি পরীক্ষায় আমি বেশ ভালো রেজাল্টই করি। লুকিয়ে পড়ে যে ৪.৩৩ পেয়েছি এটাই আমার সাত কপালের ভাগ্য। এখন পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির কেউ জানে না আমি যে এখনো পড়াশোনা করছি।আরাফের কাছ থেকে কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে সামলিয়ে, ঘরের কাজ সামলিয়ে পড়তে বসাটা খুব কঠিন! আরাফ থাকলে হয়ত ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ম্যানেজ করতো। পড়তে বসতেও খুব ভালো লাগে না।
মাঝে মাঝে পূর্নিমার রাতে রুমের জানালাটা খুলে জোৎস্না দেখি আর আরাফের জন্য চাপা অভিমান জমিয়ে রাখি। ওর কি একটুও ইচ্ছে করে না আমার সাথে জোৎস্নাবিলাস করতে? আমাকে রেখে বিদেশে পাড়ি না জমালেই তো পারত? দেশেই কোনো কাজ
নাহয় করতো, সংসারে অভাব থাকলে না হয় থাকতো, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তো হতো! চোখের সামনে তো অন্তত ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতাম।
.
.
দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুই-দুইটা বছর। এইচএসসি পাশ করে ফেলেছি। যদিও রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়েছে।
আমার মেয়েটাও কথা বলতে শিখে গেছে। আধো- আধো করে অনেক কথাই বলে। আরাফ দেশে এখনো ফিরে নি।
ওকে দেশে আসতে বললে আমাকে নানারকম বাহানা দেয়। কখনো আমার ওর বলা কথাগুলো বিশ্বাস হয়, আবার কখনো বিশ্বাস হতে চায় না।
ওর আচার-আচরণও অনেক বদলে গেছে। আমার জন্য পাগলামি করা আগের আরাফ নেই।
ইদানীং আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হয়। হয়ত প্রিয় মানুষটা আজ পাশে নেই বলে আমার এমন হয়।
মাঝে মাঝে গাঁ কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তখন মনে হয় ইশ! আরাফ যদি কপালে হাত দিয়ে বলতো তোমার তো জ্বরে গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। তখন হয়ত জ্বর কমে যেত।
একদিন হঠাৎ ড্রয়িংরুমে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম। পরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম শ্বাশুড়ীর রুমে।
আমার মা, আম্মা, ননদ, আমার মেয়ে সবাই আমার পাশে বসে আছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,,
— এখন তোর কেমন লাগছে মিথি?
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
–কি হয়েছিল আমার, মা?
–তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। মনে হয় তোর শরীরটা অনেক দূর্বল। চারঘন্টা পরে তোর জ্ঞান ফিরলো। বেয়ান তো তোর জ্ঞান ফিরছিল না বলে ভয় পেয়ে গেছিল। আমাকে কল দিয়ে বলল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসতে। এসে দেখি তোর জ্ঞান নেই।
–ওহহ আচ্ছা। (মিথি)
.
এরপর প্রায়ই আমার মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হতো, আমি প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যেতাম। আমার এমন ঘনঘন অজ্ঞান হওয়া দেখে আমার মা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার মাথায় বিভিন্ন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেয়। মাথার সব
পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখে ডাক্তার আমাকে বলে,
–আপনার মাথায় ব্রেইন টিউমার হয়েছে। এজন্যই
আপনার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতো, ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যেতেন।
আমার মনে এমনই একটা সন্দেহ হচ্ছিল। হয়ত ভয়ংকর কোনো রোগ আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে।
আজ সেই সন্দেহটাই সত্যি হলো। রোগের কথা শুনে আমার ভয় লাগলো না। ডাক্তারের কথা শুনে আমার মা হকচকিয়ে উঠলেন। আর উত্তেজিত হয়ে বললেন,
–কি বলছেন ডাক্তার সাহেব? এখন কি হবে আমার মেয়ের? অপারেশন করলে সুস্থ হয়ে যাবে তাই না?
–আপনি শান্ত হোন। অপারেশন করা যাবে না কিনা সেটা টিউমারের অবস্থানের ওপর জানতে হবে।
আর অপারেশন সাকসেসফুল হবে নাকি হবে না সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো বলতে পারবে। ব্রেইন টিউমারের অপারেশন রোগীর জ্ঞান ফিরার ওপর ডিপেন্ড করে। জ্ঞান ফিরতেও পারে, আবার নাও ফিরতে পারে।
তবে যদিও অপারেশন করা হয় তবে দ্রুত করানো দরকার কেননা টিউমার থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে, একবার ক্যান্সার হলে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
[ ★ব্রেইন টিউমার সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। তাই ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়]
ডাক্তারের কথা শুনে মা সেখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি মাকে নিয়ে চলে এলাম।
চিন্তায় আমার ঘুম হচ্ছিল না। আমার কিছু হলে আমার দুই বছরের নিষ্পাপ আফরিনের কি হবে?
নিজের চেয়েও আফরিনের জন্য চিন্তা বেশি হতো।
আমি মা/রা গেলে আরাফ আবার বিয়ে করার
পর আফরিনকে আদর করবে তো?
পরবর্তী একসপ্তাহ আমার মাথায় অনেক টেস্ট করা হলো। ডাক্তাররা অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল আমার অপারেশন করবে, যদিও তা আমার জন্য
ঝুকিঁপূর্ণ। অপারেশন এবং পরবর্তী খরচের জন্য আমার প্রায় নয় লাখ টাকার প্রয়োজন।
এতো টাকার কথা শুনে আমি শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকানো যায় না। তিনি কিছুতেই আমার অপারেশনের জন্য এত টাকা খরচ করতে ইচ্ছুক নন। তিনি কথার আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেন, পরের মেয়ের জন্য এতটাকা নষ্টের কোনো মানে হয় না। অথচ আরাফ প্রতিমাসে প্রায় দেড়লাখ টাকার মতো পাঠায়।
আম্মার কথা শুনে আমার বাবা-মা তো খুবই ক্ষেপে গেলেন। বাবা বললেন,
–ও যদি পরের মেয়েই হয় তাহলে আজ থেকে আমার মেয়ে আপনার বাড়িতে আর যাবে না। আমিই আমার মেয়ের চিকিৎসা করব।
.
যদিও পরে আরাফ আমার চিকিৎসার জন্য একসাথে সাত লাখ টাকা পাঠিয়েছিল। আমার অপারেশন করার দিন ঠিক হয়ে গেল। আমি আরাফকে বারবার ফোনে বলছিলাম, অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে একবার তোমাকে দেখতে চাই। আমি আর নাও ফিরতে পারি। শেষবার অন্তত তোমাকে দেখতে চাই। সেদিনও আরাফ বলেছিল ওর পক্ষে এখন আসা সম্ভব না। আল্লাহ ভরসা।
সেদিন আমার ভীষণ অভিমান হয়েছিল ওর ওপর। চাই না আমার টাকা-পয়সা, আমি শুধু আমার ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পেতে চাই।
.
অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলাম হয়ত আমাকে আরাফ না বলেই
চলে আসবে। কিন্তু সে আসে নি। আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। অপারেশন থিয়েটার হতে হয়ত আর বেঁচে ফিরতে পারব না।উনিশ বছরের জীবনটা ভালো-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে। আফরিনকে আদর করে মায়ের কাছে দিলাম। কোমড় অবধি লম্বা চুল কেটে ফেলতে হয়েছিল অপারেশনের জন্য। দুই রাকাত নামাজ পড়ার উদ্দেশ্য অযু করি। ওয়াশরুম থেকে
বের হওয়ার সময় বেসিনের আয়নায় নিজেকে
এক নজর দেখে চলে আসি। নামাজ শেষ হলে আমাকে ওটিতে ঢোকানো হয়।
কিছুক্ষন পর নার্স এসে আমাকে ইনজেকশন দেয়।
আস্তে আস্তে আমার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে।
কে জানে এই দুইটি চোখ আর কখনো খুলবে না কিনা?
#চলবে