কেউ কথা রাখেনি পর্বঃ শেষ (২য় অংশ)

0
1150

গল্পঃ কেউ কথা রাখেনি
পর্বঃ শেষ (২য় অংশ)
নিঝুম জামান

মিথিলার মৃ/ত্যু/র কিছুদিন পরেই মিথিলার বাবা-মা জানতে পারে আরাফ বিদেশে বিয়ে করেছে।
সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না, তেমনি আরাফের গোপনে করা দ্বিতীয় বিয়ের খবরও গোপন থাকে নি।
মিথিলার মা সেদিন আরাফকে বলেছিল,

— আমাকে মেয়েকে তুমি ঠকিয়েছো, সময়ের পরিবর্তনে তুমিও একদিন ঠকবে। সেদিন বুঝবে
অন্যকে ঠকিয়ে ভালো থাকা যায় না। আমার মেয়েটা মরার আগেও তোমাকে দেখার জন্য ছটপট করছিল, বারবার অনুনয় করেছিল কিন্তু তুমি আসো নি। অথচ নতুন বিয়ে করে সংসার করছিলে। আমার মেয়েটা তো তোমাকে কম ভালো বাসে নি, তার বিনিময়ে তুমি ওর সাথে প্রতারনা করেছো।তুমি একজন নিষ্ঠুর পাষান।
কান্না বন্ধ করো,(ধমকের সুরে) একদম ন্যাকা কান্না
কাঁদবে না। এসব ন্যাকা কান্না একদম সহ্য হয় না
আমার। এখন কাঁদলে কি হবে, যখন তাকে যত্ন করে রাখার ছিল, তখন তো রাখ নি।

আরাফ নিশ্চুপ ছিল। কোনো উত্তর দিতে পারেই নি।পারবে কি করে? সে তো সত্যিই অপরাধী।
.
একমাস দেশে থাকার পরে আবারও বিদেশে পাড়ি জমায় আরাফ। যাওয়ার আগে আফরিনকে নিয়ে
যেতে চেয়েছিল কিন্তু মিথির মা আফরিনকে দেয় নি।
তার সাফ কথা, আমরা যতদিন বেঁচে থাকব আফরিন আমাদের সাথেই থাকবে। ওকে আমরা দেব না। তোমার মতো মিথ্যাবাদীর কাছে তো
দেওয়ার কথাই আসে না।
আরাফও আর বেশি কিছু বলতে পারে নি।
.
আফরিন ওর নানা-নানীর কাছে থাকে। ওর নানীই
ওর মায়ের অভাব পূরন করে মানুষ করে। এজন্যই লোকে বলে, নানী হচ্ছে দ্বিতীয় মা।
কিন্তু মা তো মা-ই। আফরিনের মাঝে মাঝেই মায়ের জন্য অনেক মন-খারাপ লাগে। তার মা বেঁচে থাকলে সেও নিশ্চয়ই বাবার সাথে থাকতো।
.
আফরিন বড় হয়েছে। দেখতে পুরো ওর মায়ের মতো হয়েছে। তবে রাগটা অনেক বেশি। বাবাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। বড় হওয়ার পরে ওর মায়ের সাথে বাবার করা আচরণ সবটাই জানতে পারে। আরাফও প্রায় আঠারো বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী এলিসা তাকে ধোঁকা দিয়ে ছেড়ে চলে গিয়ে গিয়েছে। আঠারো বছর সংসার করেও আরাফকে আপন করে নেয় নি এলিসা। যেই এলিসার প্রেমে পড়ে মিথিকে অবহেলা করেছিল সেই এলিসাই তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে। তাই সে দেশে চলে এসেছে। কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে এসে প্রথম যখন আফরিনকে আরাফ দেখতে পায়, ও তখন চমকে উঠেছিল। অবিকল মিথির মতো দেখতে।
আরাফ তখন গিয়েছিল বাবা হিসেবে আফরিনকে
নিজের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। আরাফের মা স্ট্রোক করে গত হয়েছেন পাঁচ বছর হলো।বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র আপন বলতে এখন আফরিনই।কিন্তু আফরিন সরাসরি বলে দিয়েছে,

— যে বাবা ছোটবেলা থেকে তার সন্তানের প্রতি
দায়িত্ব পালন করে নি, সে বাবার কাছে আমি যাব না।

–মা, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে আমার সাথে বিদেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার নানু
তোমাকে আমার সাথে যেতে দেয় নি। তারা তোমাকে
রেখে দিয়েছিল। (অনুনয়ের সুরে)

— বাহ, চমৎকার কথা বললে। সন্তানের ওপর কার অধিকার বেশি? তার পিতার নাকি তার নানা-নানীর? আমাকে না হয় যেতে দেয় নি তোমার সাথে, তুমি তো পারতে ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে, আমি তো তোমার একমাত্রই মেয়ে ছিলাম বাবা আমার খরচটাও তো পাঠাতে পারতে কিন্তু তুমি তা করো নি। নানা-নানুর ওপরই সব দায়িত্ব রেখে চোরের মত বিদেশে পলায়ন করেছিলে। এখন যখন আমি বড় হয়ে গেছি, এখন এসেছো পিতার অধিকার নিয়ে। না পেয়েচি তোমার ভালোবাসা, না পেয়েছি তোমার কিছু। কেন যাব তোমার সাথে?

এবারও আরাফ নিশ্চুপ। সত্যিই গত আঠারোটা বছর সে বাবা হিসেবে সন্তানের কোনো দায়িত্বই পালন করে নি।
.
.
আরাফ একাই থাকে। আজ তার কেউ নেই। বড্ড একা সে। মিথিলাকে অবহেলা করার শাস্তি পাচ্ছে এখন। মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি
শরীরটাও ভীষণ অসুস্থ। মন ভালো না থাকলে শরীর কীভাবে ভালো থাকবে?আফরিনকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। হয়ত এমন করেই একদিন মিথিলা তাকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু
আরাফ বেশ ভালো করে জানে আফরিনকে
আসতে বললে সে আসবে না। খুবই জেদী মেয়ে।
.
মিথিলা উচ্চশিক্ষিত হয়ে ওর মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও ওর মেয়ে আফরিন তার নানীর
স্বপ্ন পূরণের চেষ্টায় পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহে আফরিন স্কলারশিপ পেয়ে জাপান যাচ্ছে।
যাওয়ার আগে একদিন ওর মামা এসে ওকে বলল,

— আফরিন, যাওয়ার আগে একবার অন্তততোমার বাবাকে দেখে যেও। বড্ড অসুস্থ তিনি। তোমাকে বারবার দেখার আকুতি জানাচ্ছে।

–আমার সময় নেই মামা, তুমি জানিয়ে দিও।

–এমন করো না আফরিন। হাজার হোক, লোকটা তোমার বাবা। তোমার একবার দেখে আসা উচিত।

আফরিন আর বেশি কিছু বলল না। ও টেবিলে বসে কিছু লিখছিল আর কাঁদছিল। যেদিন জাপানে চলে যাবে সেদিন তার বৃদ্ধ নানীকে সালাম করে আসার সময় হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল আর বলেছিল তার জন্মদাতা পিতার কাছে পৌঁছে দিতে। আফরিনের
কথা অনুযায়ী আরাফের কাছে চিঠি পৌঁছে গেল।
অসুস্থ আরাফ তার মেয়ের চিঠির কথা শুনে খুশিতে
ডগমগ হয়ে গেলেন। কিন্তু এ ডিজিটাল যুগে মোবাইলে ফোন না দিয়ে চিঠি লিখলো কেনো মেয়েটা? বেশি কিছু না ভেবে চিঠিটা খুলল। সেখানে লিখা,

বাবা,
আশা করি, এতকাল ভালো ছিলে,সুখে ছিলে, এখনো আছো। আমি হয়ত চিঠি না লিখে ফোনেই সব কথা বলতে পারতাম কিন্তু চিঠিটা পড়ে যাতে তোমার আমার মায়ের কথা মনে পড়ে সেই জন্য লিখা। যদিও মাকে আমি বুঝ হওয়ার পরে দেখি নি। তবে মায়ের সব ঘটনা আমি জানি। মায়ের ব্রেইন
টিউমার ধরা পরার পরে নাকি সবসময় শুধু তোমায় চাতক পাখির মতো দেখতে চাইতো কিন্তু তুমি স্বার্থপরের মতো দূরে ঠেলে দিয়েছিলে। আজ আঠারো বছর পরে দেখ সেই কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটছে তোমার সাথে। আল্লাহ কাউকে ছাড় দিলেও ছেড়ে দেয় না। তুমিও আমাকে দেখার অনেক
ইচ্ছাপোষন করছো তবে তোমাকে
দেখতে আসতে কেনো জানি মন সায় দিচ্ছে
না।
তাই আসলাম না। আমাকে মাফ করে দিও। জানি সন্তান হিসেবে তোমার সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত নয়।

(আফরিন)

চিঠি পড়ে আরাফের আজ একটুও কান্না আসলো না। সে জানতো তার করা ভুলের শা/স্তি একদিন ঠিকই পাবে। স্ত্রী- মেয়ে সবাই তাকে একাকী জীবনে ফেলে গেছে।
এটাই কি তার বিচার?
মানুষ ঠিকই তার করা পাপের কিংবা ভুলের শাস্তি পায়। কেউ দেরীতে কেউবা তাড়াতাড়ি।

….(সমাপ্ত)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here